আনন্দ পুরষ্কার পাওয়ার পর লেখক বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে অনেকে আমাকে অভিনন্দন জানান। কেউ কেউ জানান ঘৃণা। মৌলবাদী গোষ্ঠী প্রচার করছে যেহেতু আমি ইসলামের বিরুদ্ধে লিখি তাই বড় আনন্দে হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠী আনন্দবাজার আমাকে পুরষ্কার দিয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকা হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠীর পত্রিকা এ আমি আগে শুনিনি। এ যাবৎ যত লেখা আনন্দবাজার এবং দেশ পত্রিকায় পড়েছি, কখনও কোনও লেখা পাইনি যেখানে হিন্দু মৌলবাদীর পক্ষে কোনও কথা আছে বরং হিন্দু মৌলবাদীর বিপক্ষেই লেখা ছাপা হয় পত্রিকাগুলোয়। কেউ কেউ বলেছে, কোনও এক কালে আনন্দবাজারের ভূমিকা ছিল মুসলমানবিরোধী, সেই কোনও কালে আমার জন্মও সম্ভবত হয়নি, আমি এর দায় নিই কী করে! সম্পাদক বদলায়, প্রকাশক বদলায়, নতুন নতুন সাংবাদিক যোগ হন, পত্রিকার চরিত্র আদর্শও সেই সঙ্গে বদলায়। বাংলাদেশে যে পত্রিকা এক সময় দেশ স্বাধীনের বিরুদ্ধে লিখত, সেই পত্রিকাই এখন পক্ষে লিখছে, এর কারণ পুরোনো কালের মানুষ সরে গিয়ে নতুন কালের মানুষ এসেছে পত্রিকায়, পত্রিকার নাম ঠিকানা একই আছে, কিন্তু লেখা আগের চেয়ে আলাদা, মূল্যবোধ ভিন্ন। দ্বিতীয় অভিযোগটি হল আমি র এর এজেন্ট। গুজবের মত সংক্রামক আর কিছু নেই বোধহয়। ইনকিলাব আজ লিখল আমি র এর এজেন্ট, পরদিন দশটি পত্রিকায় লিখে ফেলে আমি র এর এজেন্ট।
রি কি?’ এই প্রশ্নটি মনে উঁকি দেয়। মিলনের কাছে জিজ্ঞেস করি, ‘মিলন র কি?’
মিলন বলে, ‘বুবু আপনে র মানে কি বুঝেন না! র তো হইল .. ‘
‘র তো হইল কি?’
‘মানে ধরেন র চা। দুধ না মিশাইয়া চা বানাইলে তো র চা -ই হয়। ধরেন আমগর কম্পানিতে র মাল আমদানি করে, পরে এই র মাল গুলা দিয়া প্রসেস কইরা কেমিকেল প্রডাক্ট বানানি হয়।’
‘কিন্তু র এর এজেন্ট মানে কি?’
‘মনে হয় বিদেশ থেইকা র মাল টাল আনার এজেন্ট।’
‘কিন্তু আমি তো কোনও র মাল আনার এজেন্ট না!’
‘লেখছে আর কী! আপনেরে নিয়া আজাইরা কত কথাই ত লেকতাছে ওরা।’
‘কিন্তু মিলনরে এর এজেন্ট বইলা আমারে গালি দিব কেন? মানুষ তো বিদেশি কত জিনিস পত্র আনে, তারা ত গালি খায় না!’
‘দিছে আপনেরে গালি। মনে করছে নিষিদ্ধ কোনও র মাল আনেন।’
‘নিষিদ্ধ মাল?’
‘এইটা বুঝেন না বুবু!’ মিলন বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ে। ‘বাংলাদেশে কি বিদেশের সব র মাল আসা লিগাল নাকি? কিছু ত নিষিদ্ধ মাল আছেই!’
‘যেমন?’
‘ধরেন ফেনসিডিল, কাশির ওষুধ। ফেনসিডিল খাইয়া পুলাপান নেশা করে। ইণ্ডিয়া থেইকা ফেনসিডিল আনে চুরাকারবারিরা। এহন যদি আপনি ফেনসিডিল আনেন, তাইলে কি তা নিষিদ্ধ না?’
‘কিন্তু ফেনসিডিল তো কোনও র জিনিস না। ওষুধ। বোতলের ওষুধ।’
‘ওই ফেনসিডিল বানানির মাল যদি আনেন হেইডা ত র ই। ঘরে বইয়া বানাইলেন।’
‘তাইলে আমারে চুরাকারবারি বা ইললিগাল ব্যবসায়ী কইতে পারত। র এর এজেন্ট কয় কেন?’
‘মনে করছে আপনের কোনও গ্রুপ আছে। গ্রুপটা র মাল আনে। আপনে জড়িত আছেন গ্রুপ এর সাথে।’
‘কিন্তু আমি ত এইরকম কোনও গ্রুপের সাথে জড়িত না।’
‘জড়িত থাকতে হইব নাকি! ওরা আপনের বিরুদ্ধে লিখতে চায়। এহন যেইডা লিখলে জনগণের মন আপনের দিকে বিষাক্ত হইয়া উডে, সেইডা লিখতাছে।’
মন থেকে র যায় না। র এর এজেন্ট আমি। আমার সঙ্গে যাদের ওঠা বসা, তারা কেউ এ ধরণের ব্যবসা করে না। তবে কেন আমাকে র এর এজেন্ট বলবে! অনেকদিন আমি মীমাংসাহীন র র মন নিয়ে বিষণ্ন বসে থাকি। মাস গেলে পর একদিন খসরু এলে তাকেই জিজ্ঞেস করি, ‘আচ্ছ! খসরু ভাাই, র কি?’ খসরুর সঙ্গে আমার পরিচয় শিপ্রার মাধ্যমে। লোকটি ব্যবসায়ী, দুটো ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু নিয়ে এনার্জি প্যাক নামে একটি জেনারেটর তৈরির কারখানা দিয়েছে। মতিঝিলে অফিস। প্রায়ই আমার বাড়িতে আসেন। কেমন আছি না আছি জানতে চান।
রি মানে? কি ব্যাপারে র?’ খসরু জানতে চান।
‘আমারে বলে আমি নাকি র এর এজেন্ট।’
খসরু অট্টহাসি হাসেন।
‘তোমারে র এর এজেন্ট বলতাছে, আর তুমি নিজে জানো না র কি? এইটা কোনও কথা হইল?’
মিলনের সংজ্ঞাটি গলগল করে মুখে এসে যায়। তার আগেই খসরু বলেন, ‘র হইল ইন্ডিয়ার ইণ্টেলিজেন্স এজেন্সি ! আমেরিকার যেমন সিআইএ। ভারতের তেমন র।’
আমি তাজ্জব হয়ে বসে থাকি। ‘তাই নাকি!’
‘তুমি নিশ্চয়ই জানো।’
‘না আমি জানতাম না।’
‘বল কি? তোমার পেছনে যে স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোক ঘুরে, তা জানো? তুমি যেইখানে যাও, তোমারে ফলো করে।’
‘নাহ! ক্ই। আমি তো দেখি নাই! মানে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ! কন কি!’
‘দেখ গিয়া বাড়ির সামনে একজন হাঁটতেছে। তোমার বাসায় কে আসতেছে, বাসা থেকে কে কোথায় যাচ্ছে, সব খবর রাখতেছে।’
আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কি অন্যায় করেছি আমি যে আমাকে র এর এজেন্ট বলবে। পুলিশের গোয়েন্দা বাহিনী আমার পেছনে লেগে থাকবে! অন্যায়টি খুঁজতে থাকি। অন্যায় খুঁজে পাই না। এ দেশের রাজনীতি হয় ভারত বিদ্বেষ দিয়ে, যে যত বেশি ভারত বিদ্বেষ দেখাতে পারবে, সে তত ভোট পাবে। দেশের মানুষের কথা ভাবার জন্য রাজনীতিবিদ নেই বললেই চলে। আমার পেছনে যে চর লাগা, তা ভারতীয় দূতাবাসের এক অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময়ই লক্ষ করি। একটি সাদা গাড়ি আমার রিক্সার পেছন পেছন সারা পথ গেল। আমার গতিবিধি সরকারি নথিভুক্ত হচ্ছে। আমি শান্তিনগর বাজারে গিয়ে ফুলকপি আর পুঁটিমাছ কিনলেও পেছনে সরকারি বাহিনী যাবে। ঘাড়ের কাছে আমি টের পাই কারও কারও নিঃশ্বাস। আমার ভয় হতে নিয়েও হয় না। আমি জানি আমি কোনও মূল্যবান মানুষ নই। ডাক্তারি করি, অবসরে লিখি। এমন কোনও ডাক্তারি নয়, এমন কোনও লেখা নয়। ভাল ডাক্তার হতে গেলে এফসিপিএস পাশ করতে হয়। ভাল লেখক হতে গেলে বাংলা সাহিত্যে অঢেল জ্ঞান থাকা চাই। আমার এফসিপিএসও হয়নি। সাহিত্যের অঢেল জ্ঞানও নেই।
বিচিন্তা পত্রিকাটি ফলাও করে ছেপেছে সুকুমারী থেকে চুরি। আমার বইয়ের লেখাগুলো আমার নয়, অন্যের। সুকুমারী থেকে চুরির জন্য যে শাস্তি আমার পাওনা, সে আমি মাথা পেতে গ্রহণ করতে রাজি আছি। কিন্তু চুরি বিশারদরা বলতে শুরু করেছেন নির্বাচিত কলাম বইটিতে ইসলামকে গাল দিয়েছি আমি, পুরস্কার পাওয়া তো আমার উচিত হয়ইনি, আমার শাস্তি পাওয়া উচিত। যে লেখা আমার নয়, অন্যের, সে লেখার জন্য আমি শাস্তি পেতে যাবো কেন! কিন্তু শাস্তির দাবি তারা করে এবং তখন কিন্তু একটুও অনুমান করে না যে যেসব লেখার কারণে তারা আমার শাস্তি দাবি করছে, সেসব আমার নিজের না হয়ে অন্যের হতে পারে। আমার শাস্তির দাবি না করে তো সেই অন্যের শাস্তির দাবি তাদের করা উচিত! কিন্তু না, তারা আমাকেই শাস্তি দেবে। গ্লানির গভীরে ডুবে থাকা আমাকে কে যেন ডেকে তোলে। কে যেন আমার কানে কানে বলতে থাকে, বেদ সম্পর্কে মন্তব্য তোমার নিজের না হলেও ইসলাম সম্পর্কে মন্তব্য তো তোমার নিজের! মূলত বইটি কি বেদ নিয়ে, নাকি মুসলমান সমাজে নারীর অবস্থা নিয়ে লেখা? আমি ক্লান্ত কণ্ঠে বলি, লেখাগুলো তো আমার এবং আমার চারপাশের জীবনের কথা। কানে কানের কেউ বলে, শাস্তি সে কারণে তোমাকেই দিতে চাইছে, সুকুমারীকে নয়। যদিও ডাক শুনে উঠেছি, আমার বিস্মিত চোখ লক্ষ করে আমার আগের উচ্ছঅল উজ্জ্বল পরিবেশটি কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেছে। আগে যারা আমার লেখা নিয়ে বলত যে আমি ভাল লিখছি, চমৎকার লিখছি, তারাই এখন দোষ ত্রুটি ধরছে আমার লেখায়। দোষ ত্রুটি ধরছে কারণ আমি পুরস্কার পেয়েছি। পুরস্কার পাওয়ার লেখকের লেখার মান যে উঁচুতে থাকে, সেই উঁচুতে আদৌ আমার লেখা আছে কি না তা তারা বিচার করে দেখছে। বিচারে হার হচ্ছে আমার। আনন্দ পুরস্কার আমাকে একটি অদ্ভুত অচেনা জগতে টুপ করে ফেলে দিয়েছে। বড় একা লাগে নিজেকে। যেন একটি সিন্দুকের ভেতর আমাকে আর আনন্দ পুরস্কারটিকে পুরে সিন্দুকটি বন্ধ করে দিয়েছে কেউ, আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে থাকে।
কলকাতায় যখন আমাকে নিয়ে উচ্ছঅ!স খুব প্রচণ্ড, নির্বাচিত কলাম বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে আশাতীত রকম বিক্রি হতে শুরু করেছে। তখনই খবর বেরোলো যে আমি চুরি করে বই লিখেছি। চৌর্যবৃত্তির খবর এক দেশ থেকে ঝড়ো হাওয়ায় উড়ে আরেক দেশে খুব দ্রুত চলে যায়। বিচিন্তার খবর হুবুহু ছাপা হয়ে যায় কলকাতার পত্রিকায়। আনন্দবাজার বিরোধী পত্রিকাগুলোর জন্য এ চমৎকার এক খবর বটে।সুকুমারী থেকে চুরি নিয়ে কলকাতায় খুব বেশি না হলেও কিছু কাণ্ড ঘটে গেছে। নারীবাদী লেখিকা মৈত্রেয়ী চট্টে াপাধ্যায় আমার এই চুরি নিয়ে মুখর হয়ে উঠলেন। কেন আমি চুরি করতে গেলাম, কেন তথ্য স্বীকার করিনি সুকুমারীর বইয়ের সে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পণ্ডিত শিব নারায়ণ রায় মৈত্রেয়ীর প্রতিবাদ করে লিখলেন, দৈনিক পত্রিকার কলামে তথ্য স্বীকারের প্রয়োজন হয় না, হত গবেষণামূলক কোনও গ্রন্থ, কথা ছিল। শিব নারায়ণ রায় আনন্দ বাজার পত্রিকায় বড় একটি লেখাও লিখলেন, মিথ্যে কলংক রটিয়ে এই তীক্ষ্ণ কলমকে ভোঁতা করা যাবে না। কলকাতায় না হয় একটি রফা হল। কিন্তু বাংলাদেশে চোর চোর বলে কিছুদিন গালাগাল করে বইয়ের কোথায় কোথায় কোরান হাদিস সম্পর্কে আমি কী বলেছি তা নিয়ে পড়ল। মামলা ঠুকে দিল আমার বইয়ের প্রকাশকদের বিরুদ্ধে। যেসব পত্রিকায় লিখি, সেসব পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশকদের বিরুদ্ধেও মামলা। প্রকাশ্যে বই পোড়ানো হল। বইয়ের দোকানগুলোয় হুমকি দিয়ে এল আমার বই বিক্রি করলে মাথা ফাটিয়ে দেবে। ইনকিলাব পত্রিকায় একজন লিখলেন, আমার ফাঁসি হওয়া উচিত। ফাঁসি! এ আর এমন কী নতুন দাবি! সাধারণত রাজনৈতিক জঙ্গী মিছিলে অসৎ রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসি চাওয়া হয়। ফাঁসি তো আর সত্যিকার হয় না। মনের রাগ প্রকাশ ফাঁসি চাই বলেই প্রকাশ করার অভ্যেস মানুষের।— প্রবোধ দিই নিজেকে। কিন্তু কোথায় যেন কিসের একটা কাঁটা বিঁধে থাকে।
নারীর ওপর নির্যাতন নিয়ে লিখছিলাম, লোকে বাহবা দিচ্ছিল। কিন্তু যখনই নারীর ওপর নির্যাতন কেন হয়, তা তলিয়ে দেখতে গিয়ে ধর্মের কথা বলেছি, তখন দেখি আমি আর বাহবা পাচ্ছি না। মৌলবাদিদের কথা বলছি না, যাঁরা পাঁচ বেলা নামাজ পড়েন না, রোজা করেন না, দাড়ি কামিয়ে, সুটেড বুটেড হয়ে নিজেদের প্রগ্রেসিভ আখ্যা দিয়ে ঘুরে বেড়ান, যে মেয়েরা বেআব্রু চলাফেরা করেন, পরপুরুষের সঙ্গে মেলামেশাও করেন অনায়াসে, গানবাজনা কালচার ইত্যাদি নিয়ে আছেন, এবং সবচেয়ে বড় কথা, যে মেয়েরা নারীমুক্তির আন্দোলন করছেন যুগ যুগ ধরে, সংস্থা খুলেছেন, সমিতি বানিয়েছেন, তাঁরাও ভুরু কপালে তুলে বলেন, ‘মেয়ের সাহস কত দেখ! ধর্মের বদনাম করছে। মৌলবাদিদের কার্যকলাপ নিয়ে লিখছিল, সে না হয় ভাল, কিন্তু ধর্মকে টানা কেন! ধর্ম দোষটা কি করেছে!’ আমার সমর্থকরাও আমার বিরোধী হয়ে উঠল। কোনও ধর্ম বিশ্বাসের বালাই যেন যাঁদের, নারী পুরুষের সমতায় যাঁরা বিশ্বাস করেন, কেবল বিশ্বাস করলেই হয় না, যাঁরা সংষ্কারমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক—তাঁরাই কেবল আমাকে সমর্থন করছেন। অবশ্য সকলে নয়। আহমদ ছফা, লেখক বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি নানা নামে ভুষিত তিনি, দিব্যি জাঁকিয়ে বসেছেন আমার বদনাম করার জন্য। কাগজে নিরবধি লিখে যাচ্ছেন আমার বিরুদ্ধে। আহমদ ছফাকে আমি রুদ্রর মাধ্যমে চিনি, রুদ্র বেশ ভক্ত ছিল ছফার। ছফা দেখতে অনেকটা মামদো ভুতের মত। মামদো ভুত আমি কখনও দেখিনি। কিন্তু ছোটবেলায় মামদোভুতের গল্প যখন শুনতাম, ঠিক এরকম একটি মানুষের মত দেখতে অথচ মানুষ নয় কিছুর আমি অনুমান করতাম। প্রথম যেদিন আমি ছফাকে দেখি, সেদিনই রুদ্রকে বলেছিলাম, তোমার এই ছফা ভাই দেখতে এমন কেন? দেখতে কেমন? রুদ্র বলেছিল। বলেছিলাম, দেখতে কেমন যেন মামদো ভুতের মত। রুদ্র আমার এই বেফাঁস মন্তব্যের উত্তরে বলেছে, ছফার মত জ্ঞানী লোক খুব কমই আছেন এ দেশে। ছফার প্রতি রুদ্রর শ্রদ্ধার একটি কারণ ছিল, রুদ্রর প্রথম বই ছাপতে ছফা সাহায্য করেছিলেন। রুদ্র ছফাভক্ত, ছফা যেমনই দেখতে হোক না কেন। ছফা লিবিয়ার টাকা খেয়ে ইসলাম ইসলাম জপ করছেন বলে বাজারে গুঞ্জন ছিল। রুদ্র ওসব কথায় কান দেয়নি। আমাদের রাজাবাজারের বাড়িতে ছফা এসেছেন দুদিন, রাতে থেকেওছেন। বিকট সুরে যখন এক রাতে গান গাইতে শুরু করলেন, আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভয় পেলেও ভক্তি জিনিসটি সংক্রামক। রুদ্রর ছফাভক্তি আমার ভেতরেও খুব দ্রুত ছড়িয়ে গেল। আমিও, যেমনই যেখতে হোন তিনি, তাঁকে ভক্তি করতে শুরু করলাম। কোনওকালেও বিয়ে না করা লোকটি নানারকম মেয়েদের নিয়ে গল্প করতেন। কলকাতার এক সুন্দরী মেয়ে ইন্দিরা ছফার প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছে, ছফা তাঁর মামদোভুতো মুখে প্রেমের সব বিচিত্র কাহিনী বর্ণনা করেন তাঁর ভক্ত শ্রোতার উপস্থিতিতে। পরে এই ইন্দিরাকেই একসময় বিয়ে করে নিয়ে আসেন মৃদুল চক্রবর্তী, ইত্যাদির আড্ডায় মাঝে মাঝে আসা গানের ছেলে মৃদুল। কেবল গানের ছেলেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেও বটে, মাস্টারি করেন। ছফার সঙ্গে বিভিন্ন দূতাবাসের মাখামাখি আছে, বিশেষ করে জার্মান দূতাবাসের। গ্যাটের ফাউস্ট বইটি অনুবাদ করে ফেললেন একদিন। রুদ্রর সঙ্গে বিচ্ছেদের পরও আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে ছফার দেখা হত। দেখা হত মূলত ইত্যাদিতে। একসময় আমার কবিতা অনুবাদ শুরু করলেন তিনি। আমাকে তাঁর বাড়িতে নেমন্তন্নও করেছেন। ফাউস্টের অনুবাদক করছেন আমার কবিতার অনুবাদ! কবিতার ভূয়সী প্রশংসা করে আমাকে রীতিমত ভয় পাইয়ে দেন ছফা। এমন কবিতা নাকি লেখা হয়নি বাংলা সাহিত্যে। আমার কবিতা সারা বিশ্বে অনুবাদ হওয়া উচিত। তাঁর ইচ্ছে আমার কবিতার একটি ইংরেজি অনুবাদের বই তিনি ছাপবেন। এমন যাঁর আবেগ তিনি কি করে এমন হঠাৎ বদলে গেলেন, সুনামের সমুদ্র থেকে বদনামের বিলে ঝাঁপ দিলেন! এটি একটি প্রশ্ন বটে। আমি আনন্দ পুরষ্কার পেলাম, তাতে তাঁর এত মনোকষ্ট হওয়ার কারণ কি! ছফাকে একদিন আমি আমার আরমানিটোলার বাড়িতে রাতের খাবারের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে দেখি লিলি নেই। দরজা হাঁ হয়ে আছে, ভেতরে সব আছে, কেবল তিন ফুট তিন ইঞ্চি, গোলগাল মুখ, গায়ের রং কালো, পরনে সবুজ হাফপ্যান্ট, লাল জামাটি নেই। নেই তো নেই, কোথাও নেই। দক্ষিণা হাওয়ায় কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে। পাতিপাতি করে পাড়া খুঁজে, আত্মীয় বন্ধুদের বাড়ি খুঁজে, রাস্তাঘাটনদীরপাড় খুঁজে থানায় ডায়রি করে রাতে যখন বাড়ি ফিরলাম, এর মধ্যে দুঘন্টা দারোয়ানের ঘরে বসে অপেক্ষা করে চলে গেছেন আহমদ ছফা। সে রাতে অবশ্য আরমানিটোলার রাস্তায় উদাসীন দাঁড়িয়ে থাকা লিলিকে পাওয়া যায়। আহমদ ছফার কাছে সেদিনের ঘটনাটি বলব, ক্ষমা চাইব, তার আগেই তিনি পত্রিকায় লিখে ফেললেন আমার নিন্দা করে একটি কলাম। আনন্দ পুরষ্কার পাওয়ার পর নিন্দা লাগামছাড়া হয়ে উঠল। আনন্দবাজার আর দেশ থেকে প্রথম বাংলা একাডেমিকে পুরষ্কার দিতে চেয়েছিল, বাংলা একাডেমি সে পুরষ্কার নেবে না জানিয়ে দিয়েছিল। এরপর আমাকে যখন নির্বাচন করা হল পুরষ্কারের জন্য, আহমদ ছফা লিখলেন, ‘আসলে তসলিমা নাসরিন কিছুই না। সবটাই ছ্যাবলামো আর চৌর্যবৃত্তিতে ভরপুর। যেহেতু সে মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে লিখেছে সে জন্যে আনন্দবাজার তাকে লাইম লাইটে নিয়ে এসেছে।.. গ্রামের দুই মাতবর প্রতিবছর একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়ায়। একবার হল কি, এক মাতবর প্রতিদ্বন্দ্বীর ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য বাড়ির কাজের মেয়েটিকে অন্য মাতবরের বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আনন্দবাজারের কর্মটিকে আমার সেরকম মনে হয়েছিল। যেহেতু বাংলা একাডেমি পুরষ্কারটি প্রত্যাখ্যান করল, সেজন্য ক্ষুব্ধ ব্যথিত হয়ে বাংলা একাডেমির মুখে একটি চপেটাঘাত করার জন্য তাঁরা তসলিমাকে বেছে নিলেন।’
কী ছফা কী হয়ে গেলেন! পত্রিকায় তসলিমাবিরোধী কলাম লিখে আহমদ ছফার শান্তি হল না, পুরো একটি বই লিখে ফেললেন তিনি। আহমদ ছফার লেখার প্রতিবাদ করে একদিন বিরুপাক্ষ পাল লিখলেন একটি কলাম। ‘আহমদ ছফার মত প্রাজ্ঞ সাহিত্যিকের দ্বারা এ ধরনের রূপকের ব্যবহার তাঁর ধৈর্যচ্যূতি ও ঈর্ষামূলক ক্ষোভকে প্রকট করে তুলেছে সর্বসমক্ষে। যৌবনে পুরষ্কৃত বা নন্দিত হওয়ার বিপদ অনেক, কিন্তু এ ধরনের অপবাদমূলক বিপদের জন্য বোধহয় কেউ বোধহয় প্রস্তুত থাকেন না। পুরষ্কার উত্তর পর্বে তসলিমা সংবাদপত্রে অনেক কথা বলেছেন। আহমদ ছফার মতে—আমি মনে করি না তসলিমা এসব কথাবার্তায় যথেষ্ট কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিতে পেরেছেন। শুধু তসলিমার দোষ দিয়ে লাভ কি! তথাকথিত অনেক প্রাজ্ঞ ব্যক্তিই তো সংবাদপত্রের কলামে এন্তার আজেবাজে বকে থাকেন। ছফা সাহেব একটু ভেবে দেখবেন কি কথাগুলো তাঁর জন্যও প্রয়োগ করা যায়। তসলিমা নাসরিনের কথাবার্তায় আহমদ ছফা কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় পান না, তার কারণ হল, তসলিমা নাসরিন যা ভাবেন, সেটাই বলেন সাহসের সাথে। অন্য দশজন কচ্ছপসদৃশ বুদ্ধিজীবীর মতো তিনি তাল বুঝে মাথা বের করেন না, তিনি অনর্গল মাথা বের করেই আছেন। এ জন্যেই বোধহয় অনেক মৌসুমী সাহিত্যিকের মনে হয়, তাঁর কাণ্ডজ্ঞান কম। .’ কানে আসে নানারকম খবর। কবি রফিক আজাদ নাকি আমার মত তুচ্ছ লেখকের আনন্দ পাওয়ায় খুব ক্ষুব্ধ। রফিক আজাদ আমাকে খুব স্নেহ করতেন এরকমই আমার মনে হত। তাঁর প্রথম স্ত্রী আদিলা বকুল আমার কাছে মাঝে মধ্যে এসে মনের কথা বলে হালকা হন জেনে তিনি স্বস্তিবোধ করেছিলেন। আদিলা মেয়েটি বড় ভাল, অনুরোধ করেছিলেন আমি যেন তাঁকে সঙ্গ দিই, মনের জোর দিই। আদিলা আমাকে তাঁর কষ্টের কথা অনেক বলেছেন। কবিতা লিখলে আদিলা বকুল রফিক আজাদের চেয়েও বড় কবি হতে পারতেন কিন্তু সরল সোজা সহিষ্ণু মানুষটি সারাজীবন কেবল দিয়েই গেছেন তাঁর স্বামীকে, নিজেকে নিঃস্ব করে একসময় দেখলেন স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। আদিলাকে তিনি ছেড়ে যান বা যাই করুন, এ কথা ঠিক যে রফিক আজাদ খুব বড় কবি। আমার মত ছোট কবি যদি ভুল করে একটি পুরস্কার পেয়েই যায়, তবে তো তাঁর বড়ত্ব কিছু কমে যায় না!
চারদিক থেকে মৌলবাদী আর দুর্মুখ লেখকদের বাক্যবাণে আমি যখন নাস্তানাবুদ তখন একদিন রফিক আজাদের চেয়ে অনেক বড়, আক্ষরিক অর্থে দেশের সবচেয়ে বড় কবি শামসুর রাহমান লিখলেন ‘তসলিমার কলমের মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। লিখলেন,ইতিমধ্যে আমাদের সংষ্কৃতির ক্ষেত্রে তসলিমা নাসরিন একটি সাড়া জাগানো নাম। কলামিস্ট হিসেবে তিনি বিখ্যাত, তাঁর খ্যাতি দেশের সীমানা অতিক্রম করেছে। কলামের জন্য তিনি পুরষ্কৃত হয়েছেন বিদেশে। তিনি অনেক প্রথাবিরোধী কথা বলেছেন, তাঁর কলামগুলো সাহসী উচ্চারণে ভরপুর। তসলিমা নাসরিনের সাহসের তারিফ করতে হয়। তিনি আমাদের পুরুষশাসিত,পশ্চাৎপদ, ঘুণেধরা সমাজকে চাবকেছেন বার বার, অচলায়তনকে দিয়েছেন ধাককা। ধর্মীয় গোঁড়ামি, সংকীর্ণতা এবং অমানবিকতার বিরুদ্ধে ঠোঁটকাটা মন্তব্য করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। কোনো রাখঢাক নেই তাঁর উচ্চারণে। কবুল করতে দ্বিধা নেই, আমি অন্তত তসলিমা নাসরিনের মত সাহসী নই। আমার এমন অনেক কথা বলতে ইচ্ছে হয় যা আমি সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করি, কিন্তু জন্মান্ধ সমাজপতি এবং তিমিরবিলাসী, মধ্যযুগে বসবাসকারী ঘাতকদের ভয়ে সেসব কথা বলা থেকে বিরত থাকি। এতে আমার ব্যক্তিত্ব সংকুচিত হয়, নিজের অক্ষমতার জন্য লজ্জাবোধ করি আর তসলিমা নাসরিনকে মনে মনে সাধুবাদ জানাই।’
কবিতার বইগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের সমাজের অনেকেই নারীর ব্যক্তিসত্তাকে বিকশিত হতে দিতে চায় না। চারদিক থেকে নিষেধের তর্জনী এবং ছিঃ ছিঃ রব ওঠে। নারী যে একজন মানুষ, এই বোধ জাগ্রত নেই সমাজের মনে। এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারেন না বলেই তসলিমা দ্রোহী হয়ে ওঠেন, নিজের পায়ের বেড়ি ভেঙে ফেলেন, অন্যদেরও ভেঙে ফেলার আহবান জানান।’
কেবল শামসুর রাহমান নন, এপার বাংলার জাহানারা ইমাম, রশীদ করীম, নাজিম মাহমুদ, মযহারুল ইসলামের মত বিদগ্ধ ব্যক্তি লিখেছেন আমাকে নিয়ে। ওপার বাংলার শঙ্খ ঘোষ, ভবতোষ দত্ত, কেতকি কুশারি ডাইসন, শিব নারায়ণ রায়, আনন্দ বাগচি, মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়, বিজয়া মুখোপাধ্যায়, সুতপা ভট্রাচার্যের মত বড় বড় লেখক ওখানকার কাগজে আমার লেখা নিয়ে আলোচনা করেছেন। কেউ বলছেন দুর্দান্ত, কেউ বলছেন দুঃসাহসী, দুর্বিনীত, এমন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বড় দুস্প্রাপ্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহা লিখেছেন, ‘তসলিমা নাসরিন আজ আমাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লেখক। তাঁর নির্বাচিত কলাম এই মুহূর্তে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বই, সমাজের পাইক পেয়াদা ঠেঙারে বরকন্দাজদের গাঁজলা ওঠা হল্লারও প্রধান কারণ এই বই।’ —এ সবই অপ্রত্যাশিত। আমার জন্য অতিপ্রাপ্তি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনন আবৃত্তি সংঘ আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। স্বননের সঙ্গে জড়িত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লেখক বুদ্ধিজীবিদের তালিকায় সনৎ কুমার সাহা একজন। আমাকে স্বম্বর্ধনা দেওয়া হয় স্বননের পক্ষ থেকে। বিখ্যাত লেখক হাসান আজিজুল হক আমাকে ফুলের তোড়া দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানান, আমার সম্পর্কে স্তূতিবাক্য আওড়ান। আমি তো মঞ্চে বসে স্তূতির তোড়ে ভেসে যেতে থাকি। আমাকে যখন বলতে বলা হল, দুটো কী একটি ধন্যবাদ জাতীয় বাক্য বলার পর দেখি মাথা ফাঁকা। ফাঁকা মাথা থেকে আর কোনও শব্দ আমার জিভের দিকে আসছে না। সাহিত্য সংস্কৃতি যেমন আসে না, রাজনীতি, সমাজ ইত্যাদিও আসে না। জানি শ্রোতারা অপেক্ষা করছেন কড়া কড়া কিছু কথা শোনার জন্য কিন্তু সকলকে হতাশ করে আমাকে বিমূঢ় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কিন্তু কবিতা যেদিন পড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে, সাবাস বাংলাদেশ নামের বিশাল মুক্তিযোদ্ধা-মূর্তির সামনে, আমার কণ্ঠে কোনও জড়তা ছিল না। কবিতা পড়তে দাও, সারারাত ক্লান্তিহীন পড়ে যাবো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধিজীবীর অভাব নেই, আবার ইসলামী ছাত্র শিবিরেরও অভাব নেই। শিবিরের পাণ্ডারা প্রগতিশীল ছাত্র শিক্ষকদের দিব্যি ঠাণ্ডা মাথায় খুন করছে, হাত পায়ের রগ কেটে দিচ্ছে। হিশহিশ শব্দ সারাক্ষণ ঘাড়ের পেছনে, আশঙ্কারা ঘাপটি মেরে বসে থাকে লোমকূপে। সনৎ কুমারই লিখেছেন, যখন আমি কবিতা পড়তে মঞ্চে উঠেছি, ‘কবিতা শোনার আগ্রহের সঙ্গে মেশে এক অরুচিকর অস্থিরতা, আজকের বাংলাদেশে যার পৌনঃপুনিক আক্রমণে আমরা এখন প্রায় অভ্যস্ত। বুকের ভেতর শুনতে পাই চাপা ধুকপুকুনি, যেন বিশ্রী একটা কিছু ঘটে যেতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। .. পেছনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি শ্রোতাদের ভেতর কোনও কোনও অংশে মূর্তিমান বীভৎসতা থোকায় থোকায় কুণ্ডুলি পাকিয়ে তার সমস্ত কদর্যতা উগরে দিতে চাইছে। সেখানে হামলে পড়া মুখগুলো থেকে জান্তব লালসার লাম্পট্য গলে পড়তে থাকে। চোখের তারায় ফিনকি ছোটে ঘৃণার আর প্রত্যাখ্যানের। যেন এক মূর্তিমান আপত্তিকে হিংস্র আক্রমণে ছিন্নভিন্ন করতে পারলেই তাদের নিশ্চিন্তি।’ নাহ, ছিন্নভিন্ন আমাকে হতে হয়নি। কবিতা পড়ে আস্ত আমি মঞ্চ থেকে নেমেছি[ রাজশাহীতে নাজিম মাহমুদের বাড়িতে ছিলাম, যে কদিন ছিলাম। খুব প্রাণোচ্ছল মানুষ নাজিম মাহমুদ, আমাকে নিয়ে, আমার লেখা নিয়ে উচ্ছ!সের তাঁর শেষ নেই। এমনিতেও হৈহুল্লোড় করা মানুষ তিনি। কিছু কিছু মানুষের বয়স হয় না। কিছু কিছু মানুষ সজীব কিশোর থেকে যেতে পারেন বৃদ্ধ বয়সেও। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে ঘুরে দেখালেন আমাকে। অনেকের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে নিলেন। অভিনন্দনের ঢল নামে কিন্তু এতেও তুষ্ট হন না সনৎ। লেখেন, ‘যে সুস্থতার স্বপ্ন তসলিমার চোখে, যার জন্যে আমাদের সবার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত, তাকে আমরা প্রাণ খুলে অভিনন্দন জানাতে পারি না। মলিন মুখে কুণ্ঠিত হাত তুলে চুপিচুপি সহমর্মিতা আর একাত্মতা জানিয়ে বিদায় হই। বুঝতে পারি, এর বেশি এগুনো যাবে না।’ আমার কিন্তু মোটেও মনে হয়নি আমাকে কিছু কম ভালবাসা হচ্ছে। বরং বার বারই বলেছি মনে মনে, এত আমার কাম্য ছিল না তো! এটা ঠিক যে আমাকে যখন ঝেড়ে গাল দেওয়া হয়, আমি অনেকটা প্রস্তুত থাকি গাল খাবার জন্য, যেন এই গালই আমার প্রাপ্য ছিল। কেউ প্রশংসা করলেই চমকে উঠি, বুকের ভেতর কেমন জানি লাগে। আমি বুঝি যে প্রশংসা আমাকে লজ্জা দিচ্ছে, কুণ্ঠা দিচ্ছে, অস্বস্তি দিচ্ছে। প্রশংসা পাওয়ার জন্য মনে মনেও প্রস্তুত থাকি না।
লেখালেখি চলছে। পক্ষে বিপক্ষে। তবে পক্ষের লেখার তুলনায় বিপক্ষের লেখাই বেশি, বিপক্ষের কলমে ধার বেশি, তেজ বেশি, ক্ষোভ বেশি। আমার নামের সামনে থেকে, লক্ষ্য করি, জনপ্রিয় শব্দটি তুলে দিয়ে বিতর্কিত শব্দটি বসানো হচ্ছে। আমার লেখা নিয়ে বিতর্ক হয়, এত বিতর্ক নাকি অন্য কোনও লেখক নিয়ে হয় না। আমি যা-ই লিখি না কেন, লেখাগুলো মানুষকে হাসায়, কাঁদায়, ভাবায়, রাগায়, কিছু না কিছু করেই। লেখাগুলো নিয়ে কেউ না কেউ কিছু বলেই। লেখার সীমানা ছাড়িয়ে আমার শরীরের দিকে ধেয়ে আসে অনেকের লম্বা লম্বা জিভ, ধার ধার নখ। বাংলার বাণী পত্রিকায় মীর নূরুল ইসলাম আমার প্রসঙ্গে লিখেছেন ভিন্ন দৃষ্টির অন্যরকম একজন কবি শিরোনাম দিয়ে একটি কলাম। ‘যাঁকে নিয়ে এত কথা, তাঁকে আমি কখনো দেখিনি। তাঁর বিপক্ষে শুনেছি অনেক অশ্রাব্য কথা। সেসব কথায় শ্লেষ আছে, বিদ্রুপের বিষাক্ত বাক্যবাণ আছে। শুধু নেই কাব্য প্রতিভার আলোচনা কিংবা সমালোচনা। শারীরিক তত্ত্ব ও তথ্যের কথা বলা হয় মজাদার মশলার মিশ্রণে। যেন একটা নারীদেহ কেটে হাঁড়িকাবাব বা বটিকাবাব বানিয়ে মাংসলোভীদের সাজানো টেবিলে পরিবেশন করা হল। অথচ এই মানসিকতার বিরুদ্ধেই তিনি সোচ্চারকণ্ঠ। এই হিংস্রতা আর পাশবিকতার বিরুদ্ধেই প্রতিপক্ষকে জাগ্রত করার দুর্বার সাধনায় পরিচালিত তাঁর কালি কলম।’
পক্ষের লেখাগুলো চেয়ে বিপক্ষের লেখাগুলো আমি মন দিয়ে পড়ি। দৈনিক সংগ্রাম, ইনকিলাব, দিনকাল, মিল্লাত, বাংলাবাজার পত্রিকা আমার বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে নেমেছে। সংগ্রাম, ইনকিলাব, মিল্লাত মৌলবাদিদের পত্রিকা। বাংলাবাজার পত্রিকার প্রকাশক সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরি যদিও মৌলবাদী নন, কিন্তু আমার প্রসঙ্গ এলে মৌলবাদীদের পক্ষ নিতে দ্বিধা করেন না। মতিউর রহমান চৌধুরির সঙ্গে আমার কখনও কোনও বিরোধ ছিল না, বিরোধ শুরু হল যখন তিনি কলকাতার দেশ পত্রিকা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। দেশে নীরদ চৌধুরীর একটি লেখা ছিল যেখানে তিনি বাংলাদেশকে তথাকথিত বাংলাদেশ বলেছেন। নীরদ চৌধুরীর সঙ্গে কয়েক বছর পর এ নিয়ে কথা হয়েছে আমার, আমি যখন জিজ্ঞেস করেছি কেন তিনি বাংলাদেশকে তথাকথিত বাংলাদেশ বলেছেন, তিনি উত্তরে, হেসে, বলেছেন, পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ বাংলা অঞ্চল মিলিয়ে বংলাদেশ। পূর্ববঙ্গের কোনও অধিকার নেই বাংলাদেশ নামটিকে দখল করার। পশ্চিমবঙ্গ আজও পশ্চিমবঙ্গ রয়ে গেছে। নীরদ চৌধুরীর যুক্তি আমি শুনেছি। যে যুক্তি মতিউর রহমান চৌধুরি দিয়েছিলেন, তাও শুনেছি। মতিউরের বক্তব্য তথাকথিত বাংলাদেশ বলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। তা মেনেছিলাম। কিন্তু তারপর যে কাণ্ডটি তিনি করতে শুরু করলেন, তা মানতে পারিনি। কলকাতা থেকে বাংলাদেশে দেশ আসা চিরকালের জন্য বন্ধ করতে হবে, এই দাবি নিয়ে তুমুল হৈ চৈ শুরু করলেন। দেশ পত্রিকার প্রকাশক তথাকথিত শব্দটির জন্য ক্ষমা চাওয়ার পরও। সরকারের সঙ্গে মতিউরের মাখামাখি থাকার কারণে সরকার থেকে হঠাৎ একদিন দেশ পত্রিকার সবগুলো কপি বাজেয়াপ্ত করা হল, বাংলাদেশে দেশ আসা বন্ধও করে দেওয়া হল। দেশের পাঠকেরা মুখ চুন করে বসে রইল। দেশ উন্নত মানের সাহিত্য পত্রিকা। এটি বন্ধ হওয়ার পর প্রতি সপ্তাহে আমাদের পড়ার মত তেমন কোনও কাগজ রইল না। বাংলা ভাগ হয়ে গেছে, এ দেশের রাজনীতি এখন ভারত বিরোধী রাজনীতি, যে যত বেশি ভারতকে গাল দিতে পারে, তার তত জনপ্রিয়তা বাড়ে। এক দল অন্য দলকে দোষ দিয়ে যাচ্ছে, অন্য দল নাকি ভারতের কাছে এ দেশটি বিক্রি করে দেবে। প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে এরকম লাগাতার লেগে থাকলে এ দেশের কি সত্যিকার কোনও লাভ হয়! কোথায় ভারত, কোথায় বাংলাদেশ। হাতির সঙ্গে মশা লেগেছে ঝগড়া করতে। দুই বাংলা মিলে যদি না যেতে পারে না যাক, অন্তত সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক যোগাযোগটি তো থাকতে পারে। এতে দুই বাংলার মানুষেরই তো উপকার হয়! তথাকথিত শব্দের তথাকথিত অপরাধে দেশ নিষিদ্ধ হয়ে গেলে এ দেশের কার কতটা কী অর্জন করা হয় বুঝতে পারি না। দেশ নিষিদ্ধ হওয়ায় এমনই রাগ হয়েছিল যে প্রতিবাদ করে একটি কলাম লিখলাম পত্রিকায়। দেশের বিরুদ্ধে মতিউর রহমানের এমন ক্ষিপ্ত হওয়ার মূল কারণটি কী তা উদ্ধার করে জানিয়ে দিলাম যে তিনি বাংলাবাজার পত্রিকায় শারদীয়া দেশের বিজ্ঞাপন চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে দেওয়া হয়নি বিজ্ঞাপন, দেওয়া হয়েছে ইত্তেফাক আর ইনকিলাবে, তাই তিনি আগুন হয়ে আছেন রাগে। মূল কারণ বিজ্ঞাপন, তথাকথিত শব্দটি কোনও কারণ নয়। আমার লেখাটি ছাপার পর মতিউউরের বিষধর ফণা আমার দিকে তাক করা। বাংলাবাজার পত্রিকাটিতে দিনে দুবার করে আমাকে কোপানো হয়। চরিত্র সামান্য পাল্টালো বাংলাবাজার পত্রিকার যখন মতিউর দেউলিয়া হয়ে পত্রিকা বিক্রি করে দিলেন ইয়াহিয়া খানের কাছে। মিনারের বদৌলতে সাহিত্য রসিক বস্ত্রকল ব্যবসায়ী ইয়াহিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। ইয়াহিয়ার সঙ্গে আমার একটি হঠাৎ হঠাৎ দেখা সম্পর্ক রয়ে গেছে। ইয়াহিয়া আমার লেখার অনুরাগী তিনি। লেখার অনুরাগী হলে মাঝে মাঝে কেউ কেউ এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকেন যে কোনও কাজে ব্যবহৃত হবার জন্য। আমার নিজের জন্য দরকার না হলেও নির্মলেন্দু গুণের জন্য বাংলাবাজার পত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদক পদে একটি চাকরির জন্য ইয়াহিয়া খানকে ব্যবহার করেছি। পত্রিকাটির মালিক প্রকাশ্যে জাকারিয়া খান অপ্রকাশ্যে ইয়াহিয়া খান হলেও সম্পাদক তখনও মতিউর রহমান চৌধুরি। সম্পাদকের ঘরে বসে চা খেতে খেতে মতিউরের সঙ্গে গুণকে দুহাজার নয় তিন হাজার নয় পাঁচ হাজার টাকা মায়নের ব্যবস্থা পাকা করে তবে আমি কাপের শেষ চা টুকু তৃপ্তি করে পান করেছি। নির্মলেন্দু গুণের মত বড় কবিকে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। আমি কোনও অন্যায় আবদার করিনি। ইয়াহিয়া খানকে বলে তাঁর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির শ্রমিকের কাজে গুণের পরিবারের সদস্য গীতার এক বোনকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম, কিছু কাজের কাজ করে মনে প্রশান্তি আসে। ইসলামরক্ষকেরা ওদিকে একজন একজন করে লিখে যাচ্ছেন আমার বিরুদ্ধে। তবে তাঁরা যুক্তি খণ্ডনে না গিয়ে সোজা কোরান হাদিসের ধ্রুব সত্যকে সামনে খাড়া করেন। কোরান হাদিসের বক্তব্যে যুক্তি না থাকলেও আবু ফয়সল লিখলেন, ‘পরিবারকে রক্ষা করার জন্য ইসলামের ব্যতিক্রমী বিধানকে ভিত্তি করে নারীর প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কি তা ব্যাখ্যা করা একাডেমিক অনেস্টি নয়। নাসরিন এই একাডেমিক ডিসঅনেস্টি প্রায় সবখানেই করেছেন। নাসরিন তাঁর লেখা দ্বারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। তাঁর লেখা দ্বারা আলটিমেটলি ইসলামের কোনও ক্ষতিই হবে না। ইসলামের উপর এর চেয়ে অনেক ঘোরতর আক্রমণ যা বিভিন্ন কর্নার থেকে এসেছে যা ইসলামের পণ্ডিতগণ মোকাবিলা করেছেন এবং করতে সম্ভব।’ যদিও ইসলামের কোনও ক্ষতিই হবে না বলা হয়েছে, কিন্তু ইসলামপন্থীরা মোটেও আমাকে ভুলে থাকতে পারছে না, এমন ভাবে আক্রমণ করছে যেন আমি ইসলামের কল্লা কেটে ফেলে দিচ্ছি কোথাও। আমাকে রোধ করতে না পারলে, আশঙ্কা, ইসলাম নির্ঘাত মরবে।
ইনকিলাবে ছাপা হল ডাঃ গোলাম মোয়াযযমএর কোরআন পড়লে যাদের মাথা ঘোরে তাদের উদ্দেশে। লোকটি কোরানের যুগোপযোগী ব্যাখ্যায় বেশ ওস্তাদ। আধুনিক বিজ্ঞানের সবকিছুর তথ্যই তিনি কোরআন ঘেঁটে বের করে দিতে পারেন। বিজ্ঞানে আজ নতুন কিছু আবিস্কার হল, কালই তিনি সেটি খুঁজে পাবেন কোরআনে। বলবেন, আল্লাহ তো এই তথ্য কবেই দিয়ে বসে আছেন। তবে মজার ব্যপার হল, বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের আগে কোরআনীয় আবিস্কারটি হয় না। বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাক হোলের কথা আগে বলেছেন, পরে কোরআনবিদরা ব্ল্যাক হোলের কথা খুঁজে পাবেন কোরানে। না পেলেও কোনও একটি আয়াতের ব্যাখ্যা এমন ভাবে করবেন যেন ব্ল্যাক হোলের কথাই আকারে ইঙ্গিতে আল্লাহ বলেছেন। কোরআনে লেখা আছে, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে, পাহাড়গুলো কিলক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে যেন পৃথিবী পড়ে না যায়। এতকাল এসব কথা মেনে এলেও এখন বিজ্ঞান-জানা মুসলমানরা স্বীকার করবেন না যে কোরআনে তা লেখা আছে। পরিস্কার আরবীর অপরিস্কার অনুবাদ করে বোঝাবেন, পৃথিবী স্থির বলতে আল্লাহ আসলে অন্য কিছু বোঝাতে চেয়েছেন। আল্লাহ কোথায় কি বোঝাতে চেয়েছেন তা আল্লাহর চেয়ে আজকাল ধুরন্দর জ্ঞানীরা বেশি বোঝে। গোলাম মোয়াযযম লিখেছেন, ‘পৃথিবী স্থির এ কথা কোরআনে কখনও বলেনি। কোরআন বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক নয়। মানুষকে দ্বীন বোঝাবার জন্য আল্লাহ প্রাকৃতিক বহু বিষয়ের উদাহরণ দিয়েছেন এবং তাতে যা বলা হয়েছে সেগুলো বিজ্ঞানের সীমায় পড়ে। বাইবেল মানুষের লেখা বলে তাতে বহু বৈজ্ঞানিক ভুল তথ্য পাওয়া যায়। সম্প্রতি মরিস বুকাইলি তার বিখ্যাত গ্রান্থে স্পষ্ট বলেছেন, কোরআনে কোনও ভুল তথ্য পাওয়া যায় না কারণ এটা মানুষের রচিত নয়। কোরআনে আছে আল্লাহর হুকুমে চন্দ্র সূর্য তাদের কক্ষপথে ঘোরার বা আবর্তনের কথা। যা বৈজ্ঞানিক সত্য। পৃথিবীকে আন্দোলিত না করার জন্য পাহাড়কে কিলকের মত স্থাপন করেছেন বলায় লেখিকা কোরআনে ভুল রয়েছে বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। ..পৃথিবী পতনের কথা কোরআনে বলা হয়নি। লেখিকার চপলতা নেহাতই মূর্খতার পরিচয়। তার বালিকাসুলভ অজ্ঞতাজনিত উক্তি নিতান্তই হাস্যকর। সুতরাং স্বল্প জ্ঞান নিয়ে বিজ্ঞান আলোচনা না করাই উত্তম।..হুরকে কোরআনের এক জায়গায় আজওয়াজে মুতাহহারাত বলা হয়েছে অর্থাৎ পবিত্র সঙ্গিনী। সুতরাং পবিত্রের সঙ্গ যারা অপবিত্র কোনও কল্পনা করে, তারা তাদের নিজের কলুষিত মনেরই প্রকাশ করে থাকে। যারা কার্লমার্ক্সকে দেবতার মত মানে তাদের পিছে ঘুরলে শুধু মাথাই ঘুরবে কোনও লাভ হবে না। মার্কসবাদ কাল্পনিক মতবাদ তাই আজ আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত। এদের পত্রিকায় ইসলাম বিরোধী মিথ্যা প্রবন্ধ ছাপানো সম্ভব হলেও এতে ইসলামের পবিত্র অঙ্গে কোনও দাগ পড়বে না। মুসলমানরা ঠিকমত কোরআন হাদিস মেনে চলছে না বলে পৃথিবীতে পিছিয়ে আছে। কিন্তু ইসলাম তথা আল্লাহর সর্বশেষ কিতাবে কোনও ভূল নেই, এটা অমুসলিমরাও মানতে বাধ্য হচ্ছে। যারা মানে না তারা আর যাই হোক মুসলমান নয় এবং ইসলাম তথা কোরআনের বিরুদ্ধে লিখার আগে আরও একটু পড়াশোনা করার দরকার নতুবা শুধু হাসির পাত্র হতে হবে। এ ধরনের অবিশ্বাসী মুসলমানরা মুসলিম নাম রেখে এদেশের যাবতীয় সুবিধা ভোগ করছে এটাও একটা বিরাট প্রতারণা ও ধোঁকা।’ যেহেতু আমি লিখেছিলাম যে আমাদের সৌরজগতের সঙ্গে আল্লাহতায়ালার সৌরজগতের কোনও মিল নেই, গোলাম মোয়াযযম উত্তরে বলছেন, ‘বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে বাংলাদেশে এ ধরনের অবৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ছাপা হয় জেনে খুব দুঃখ হচ্ছে এবং বোঝা যাচ্ছে এ দেশের শিক্ষার মান বিশেষ করে বিজ্ঞান শিক্ষার মান কত নিম্নস্তরের ও মধ্যযুগীয়।’
মিল্লাত পত্রিকায় ফারিশতা তাঁর রোজনামচা লিখেছেন, ‘আমাদের দেশের এক নারী কলামিস্টের ধারণা পুরুষের হাতে গড়া এই পুরুষ প্রধান সমাজের স্বার্থের প্রয়োজনেই ধর্ম সৃষ্টি করে সুচতুর পুরুষ আর সেখানে স্বয়ং বিধাতাও নাকি নারী বিদ্বেষী। ধর্মগ্রন্থ বাইবেল, ত্রিপিটক, বেদ, উপনিষদ এমনকী পবিত্র কোরআন শরীফ থেকে কিছু কিছু অসংলগ্ন শ্লোক ও আয়াতসমূহের উদ্ধৃতি হাজির করে অতি সম্প্রতি অকাল কুষ্মাণ্ড একটি দৈনিকের কলামে তিনি একটি প্রবন্ধ ফেঁদে তাঁর এই উদ্ভট ও বিকৃত চিন্তার ফসল বিষবৃক্ষে পানি সিঞ্চন করে ধর্মের সকল বন্ধন থেকে নারীকে মুক্ত করার অপচেষ্টা করেছেন। অবশ্য এর আগে পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায় পর্যায়ের এই লেখিকা সর্বভুক কাকের মত বহুবার সমাজ দেহের পরিত্যক্ত ও পরিত্যজ্য ময়লা ঠুকরিয়ে বের করে সমস্ত পরিবেশকেই দুর্গন্ধযুক্ত করার অপপ্রয়াস করেছেন। ধর্মীয় নিয়ম কানুনের প্রতি তাঁর প্রবল বিদ্বেষ এবং পুরুষের প্রতি তাঁর সীমাহীন আক্রোশ আমি তখন থেকেই লক্ষ্য করে এসেছি। আমি শুনে এসেছি যে, তিনি নাকি একজন সুশিক্ষিতা নারী এবং পেশায় একজন ডাক্তার। তাছাড়া তিনি নাকি একজন কবিও বটে। ধর্মবিরোধী ও পুরুষ বিদ্বেষী এই মহিলা কবির সাম্প্রতিক লেখা একটি তথাকথিত কবিতার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আমার এক আত্মীয়া। তাঁর কবিতা নামধারী এই পংক্তিমালার একাংশে লিখেছেন যে হাত ধরলেই মরণ। মনে হয় সেই ছেলেবেলা নাকি মেলাবেলা থেকেই কারও হাত ধরার প্রবল আকাঙ্খা ছিল তাঁর। কিন্তু বেশ কয়েকবার বেশ কয়েকজনের হাত ধরে যে অভিজ্ঞতা তাঁর সঞ্চিত হয়েছে, তাতে আর নতুন করে কারও হাত ধরার শখ তাঁর ফুরিয়ে গেছে। কি জানি! কিন্তু বাপু, যতদিন ওই পোড়া দেহটি আছে ততদিন যে কারও না কারও হাত ধরতেই হবে। তাছাড়া কাদায় বা গর্তে পড়লে কারও হাত ধরেই তো উঠতে হয়। কলামিস্ট সাহেবার অবস্থা দেখে আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে, তিনি এখন সত্যিই নাক অবধি দুর্গন্ধযুক্ত কাদায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন। আর এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে হলে তাঁকে কারও হাত ধরেই উপরে উঠতে হবে। হাত ধরাকে তিনি যতই মন্দ বলুন না কেন, সঠিক হাত ধরতে পারলে সে হাত তাঁকে কেবল কর্দমামুক্ত করবে না তাঁকে বাঁচিয়েও তুলবে। ….নারীমুক্তি আন্দোলনে আপনার লেখা আরও সমৃদ্ধি আনবে যদি সঠিক হাত সত্যিই ধরতে পারেন। আমার ধারণা এ সমাজে নারীর দুর্গতি দেখে আপনি প্রতিনিয়ত আহত হচ্ছেন। আপনার অবলোকন পদ্ধতি সঠিক এবং আপনি লেখেনও আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে। আপনি একজন ভাল লেখিকা। আহা আরও কত ভালই না হত, আপনি যদি ধর্মীয় বিষয়েও কেবলই একপেশে চিন্তা না করতেন।..’
কলকাতার মুসলমান মৌলবাদীরাও বসে নেই। সাপ্তাহিক কলম, মীযানে লেখা চলছে আমাকে আক্রমণ করে। নারী স্বাধীনতার ব্যপারটি ওদের পছন্দ নয়। প্রকৃতির উদাহরণ দিয়ে একজন লিখেছেন, পুরুষ হল সূর্য আর নারী হল চাঁদ। ‘আল্লাহ নারীকে দিয়েছেন কমনীয়তা আর পুরুষকে দিয়েছেন কঠোরতা। এ দুয়ের পরিপূরণে সার্থক ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হয় সমাজ ও পরিবার। এ দুয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জন্ম নেয় দ্বন্দ্ব সংঘাত, অশান্তি, অকল্যাণ। তসলিমারা নারী পুরুষের পরিপূরণ চায় না। চায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ফলে পদে পদে ঘটছে বিপর্যয়। মৌলবাদীদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে লেখনীতে বক্তব্য রাখা যায়। কিন্তু মৌলবাদীদের মত নির্মল চরিত্র ও নীতি নৈতিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায় না। মৌলবাদীরা ইসলামের দর্শনে অনুপ্রাণিত। যৌগবাদীরা প্রবৃত্তির তাড়নায় উন্মাদ।’ আমার নিন্দা করে ওসব পত্রিকায় যে লেখাই ছাপা হয়, বাংলাদেশের মৌলবাদীরা নিজেদের কাগজে সগৌরবে তার পূনর্মুদ্রণ করে।
ভারতবর্ষের বাইরে বসেও আমার লেখা অনেকে পড়ছেন। দেশের বাইরেও দেশের মত আমার লেখা নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলে। লণ্ডন থেকে লেখক গোলাম মুরশিদ তাঁর ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে চলে এলেন আমার সাক্ষাৎকার নিতে। শফিক আহমেদ এবং তাঁর স্ত্রীও লণ্ডন থাকেন, সাহিত্য সংস্কৃতির জ্ঞান প্রচুর, আমার সঙ্গে দেখা করলেন দেশে এসেই। বোস্টনের মেঘনা দেশে বেড়াতে এসে আমার খোঁজ করে আমার জন্য ঝুড়ি ভরে আনা ভালবাসা রেখে গেলেন। একদিকে ভালবাসা। আরেকদিকে ঘৃণা। মাঝখানে আমি। ভালবাসা ঘৃণা দুটোই আমাকে নাড়ায়। তবে ভালবাসা আমাকে কাবু করে ফেলে না। ঘৃণাও না। আমি যেন ধীরে ধীরে দুটোই অন্তস্থ করার জন্য অথবা দুটো থেকেই মুক্ত হবার জন্য নিজেকে নির্মাণ করছি। আমার লেখা নিয়ে যাদের অতি আবেগ সে ভালবাসা বা ঘৃণা যেটিই হোক, আমাকে মাঝে মাঝে বড় অপ্রতিভ করে তোলে। একবার টাঙ্গাইল থেকে এক মেয়ে এল আমার বাড়িতে। মেয়েটি কলেজ পাশ করেছে, এখন চাইছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে কিন্তু বাড়ি থেকে কিছুতেই তাকে পড়তে দেবে না। মেয়ে চলে এসেছে পালিয়ে আমার কাছে। আমিই যেন এখন আশ্রয় তার। যেন আমিই জানি এখন তার কী করতে হবে। আমার লেখা পছন্দ করে বলে বাড়িতে মেয়েটি চড় থাপ্পড় খেয়েছে। গালিগালাজ শুনেছে। তারপরও সে দমে যায়নি। জোর গলায় বলেছে যে তার জীবনে আমার চেয়ে বড় অন্য কেউ নেই। না বাবা মা, না ভাই বোন, আত্মীয় স্বজন। ভগবান বা আল্লাহ বলে কোথাও কিছু থেকেও থাকে, সেও এত বড় নয়। কেবল অল্প বয়সী মেয়েই নয়, মধ্যবয়সীদেরও ভিড় হয়। পনেরো থেকে পঁচাত্তর সব বয়সীই সব পেশার সব শ্রেণীর মেয়ে মহিলা আমার দরজায় কড়া নাড়ে। সকলেই নিজের জীবনের সব কথা অকপটে বলে আমাকে। আমি কষ্টের বিভিন্ন রূপ দেখি, বিভিন্ন রঙ দেখি। অনেকে আমার কাছে শক্তি চায়, সাহস চায়। আমি কি যোগাতে পারি কোনও শক্তি বা সাহস! আমার মনে হয় না। অনেকে হতাশা নিয়ে ফিরে যায়। কেউ কেউ আঠার মত লেগে থাকে, জানি না কী পায় আমার মধ্যে। নাহিদ নামের এক মেয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্রী, দেখা করতে এল। দেখা করতে এলে কথাবার্তা বলে বিদেয় হওয়ার কথা। কিন্তু বিদেয় হতে চায় না। বিদেয় হলেও কদিন পর আবার দরজায় চেহারাটি উঁকি দেয়। ঝুনু নামের এক মেয়ে, রাজনীতি করে, দেখা করতে এল। বসতে দেওয়া হল। চা বিস্কুট দেওয়া হল। এরপরও বসে থাকে। একটু ছুঁয়ে দেখতে চায় আমাকে। মিতুল এল, নিপা এল, দুই বুদ্ধিদীপ্ত রূপসী কিশোরী, ভিখারুন্নেসা ইস্কুলের ছাত্রী। এদের আসা ক্রমশ নিয়মিত হয়ে উঠল আমার শান্তিবাগের বাড়িতে। মামুন আর আনু, অল্প বয়সী দম্পতি, এদের আসাও নিয়মিত, আনু একটি দোকানে জিনিসপত্র বিক্রি করার কাজ নিয়েছে, মামুনের চাকরি নেই। অভাবের সংসার ওদের। একদিন ভোরের কাগজের সম্পাদকের কাছে চিঠি লিখে মামুনকে পাঠিয়ে দিই সম্ভব হলে একটি চাকরি যেন ছেলেটিকে দেওয়া হয়। মামুনের লেখা কিছু চিঠি পড়েই বুঝেছি ছেলেটির লেখার হাত খুব ভাল। ভোরের কাগজে মামুনের চাকরি হয়। আমার দিন যেতে থাকে হাসপাতালের কাজে, সংসারে, লেখায়, আড্ডায় আর ভক্তকূল সামলানোয়। গুরুর আচরণ যেহেতু আমার স্বভাবে চরিত্রে নেই, ভক্তকূল অচিরে বন্ধুর মত হয়ে ওঠে, বাড়ির লোকের মত। অবাধ বিচরণ তাদের আমার বাড়িতে।
আজকাল মোল্লা মুন্সি দেখলে দ্রুত পাশ কাটিয়ে যাই। এদের আস্ফালন দেখে মনে হয় আমাকে বুঝি কাঁচা খেয়ে ফেলবে। কিন্তু তারপরও হঠাৎ হঠাৎ অবিশ্বাস্য সব কাণ্ড ঘটে। একদিন দাড়িঅলা লুঙ্গি পাঞ্জাবি পরা এক লোক সোজা ঢুকে গেল আমার বাড়িতে। বাড়িতে আসা যাওয়ার সময় কেউ হয়ত বাইরের দরজাখানা খুলে রেখেছিল। বাড়ির সবাই আমার শোবার ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছে। হঠাৎ অচেনা একটি লোককে শোবার ঘরে ঢুকতে দেখে আমি আর্তনাদ করতেও ভুলে যাই ভয়ে। কী চায় এই লোক! এখানে কেন! আমার হতভম্ব মুখের দিকে চেয়ে লোকটি বলল, ‘ভয় পাবেন না, আমি কোনও খারাপ উদ্দেশ্য নিয়া আসি নাই। আপনাকে এক পলক দেখতে এসেছিলাম। বহুদিনের ইচ্ছ! ছিল আপনাকে একবার দেখব। আজ আমার জীবন সার্থক হল।’
অনাকাঙ্খিত অতিথিকে খুব দ্রুত বাড়ির বাইরে বের করে দেওয়া হল। লোকটি কি সত্যিই জীবন সার্থক করতে ওভাবে বেড়ালের মত ঢুকেছিল বাড়িতে!