নবীনগর থেকে মনসুরের বাবা এসে হাজির। বরকত আলি। দবির মিয়ার ধারণা ছিল, মনসুরের নিকট আত্মীয় কেউ নেই। মনসুর প্রায়ই বলত, একলা মানুষ আমি, একটা মুটে পেট। কিন্তু মনসুরের বাবার কাছে জানা গেল–মনসুরের পাঁচ বছর বয়সের একটা ছেলে আছে। ছেলেটা তার নানাবাড়ি থাকে। তার মার বিয়ে হয়ে গেছে অন্য জায়গায়। দবির মিয়া শুকনো গলায় বলল, আপনি কী করেন?
কিছু করি না জনাব। সামান্য জমিজিরাত আছে। টুকটাক ব্যবসা আছে।
দবির মিয়া দেখল বরকত আলির মধ্যে একটা সচ্ছল ভাব আছে। গায়ের নীল রঙের পাঞ্জাবিটা বেশ পরিষ্কার। পায়ে স্যাণ্ডেল।
কিসের ব্যবসা আপনার?
ওষুধের। আমার একটা কানপাকার ওষুধ আছে। চালু ওষুধ।
নিজের আবিষ্কার?
জ্বি না, আমার আজানের। হেকিম শরিয়ত আলির।
দবির মিয়া ঈষৎ কৌতূহলী হয়। বাবলুর কানপাকার ঝামেলা আছে। ঠাণ্ডা লাগলেই তার কান দিয়ে পুঁজ পড়ে।
ওষুধ কি রকম?
ভালো ওষুধ, খুব চালু।
বরকত আলি তার চামড়ার ব্যাগ খুলে ফেলল। ব্যাগভর্তি ছোছোট শিশি। শিশিতে সবুজাভ একটি তরল পদার্থ। সঙ্গে ছাপান হ্যাণ্ডবিল আছেঃ শরিয়ত আলির স্বপ্নপ্রাপ্ত কর্ণশুদ্ধি আরক।
কত করে?
দামটা একটু বেশি। পাঁচ টেকা! আপনে একটা ফাইল রাখেন। টেকা লাগব না।
দবির মিয়া চা আনতে লোক পাঠাল। বরকত আলিকে তার ছেলের ব্যাপারে মোটই বিচলিত মনে হল না। চা খেতে খেতে বলল, কর্মফল, বুঝলেন ইসাব? ছেলেটারে কত কইলাম ব্যবসাপাতি দেখ। সূতিকা রোগের একটা ওষুধ আছিল, একটা আছিল বাতের, বাতনাশক কালে বড়ি। কিছুই শুনা না। মাথা খারাপ ছোট বয়স থেকেই।
ছেলের মরার খবর পেয়েছেন কবে?
বিষ্যুত বারে।
কে দিল খবর?
ললাকের মুখে শুনলাম। খুব আফসোসের কথা।
হুঁ।
তা শুনলাম, ওসি সাহেব দশ হাজার টেকা দিবে ক্ষতিপূরণ। ক্ষতিপূরণ টেকায় তো হয় না। তা কী করা বলেন?
ক্ষতিপূরণের কথাটা শুনলেন কোথায়?
লোকজনের মুখে শোনা। কথাটা কি সত্যি?
আমি জানি না। আপনি দেখেন খোঁজ নিয়ে।
আপনারে সাথে নিয়া একটু যাইতে চাই।
দবির মিয়া গভীর হয়ে বলল, যান, আপনে একাই যান।
কয়েকটা দিন আপনার এইখানে থাকা লাগতে পারে। আপনার কোনো অসুবিধা নাই তো জনাব?
না, অসুবিধা নাই। মনসুর আপনার ছেলে তো?
জ্বি, প্রথম পক্ষের সন্তান। অজুর পানি কই পাওয়া যায়, আছরের নামাজের সময় হইছে মনে হয়।
দবির মিয়া তাকে মসজিদটা দেখিয়ে দিল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, জুঘরের গোরস্থানে মনসুরের কবর আছে। বললে ওরা দেখিয়ে দেবে।
বরকত আলিকে ছেলের ব্যাপারে খুব একটা চিন্তিত বলে মনে হল না। সে কালো ব্যাগ হাতে নিয়ে বাজারের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করল। নান্টুর দোকানে চা খেল। বিকালের ট্রেনে বরফ বোঝই বাক্সে যে-সব মাছ যায় সে-সব মাছ দর-দাম করল। নীলগঞ্জ শহরে একটা হেকিমী ওষুধের দোকান চলবে কিনা, সেই সম্পর্কে খোঁজ-খবর করল।
ওসি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেল মাগরেবের নামাজের পর। ওসি সাহেব ছিলেন না। সেকেণ্ড অফিসার তাকে বিশেষ সমাদর করলেন। নান্টুর দোকান থেকে পিয়াজু এনে খাওয়ালেন। নগদ পয়সা দিয়ে দু ফাইল শরিয়ত আলির স্বপ্নপ্রাপ্ত কৰ্ণশুদ্ধি আরক কিনে রাখলেন। বরকত আলি অভিভূত হয়ে পড়ল। চার পাশে এমন সব হামদর্দ লোকজন। আজকালকার যুগে এমন দেখা যায় না।