দোতলা বাসের জানলা থেকে কলকাতাকে দেখতে বেশ অদ্ভুত লাগছিল। ঠাসাঠাসি বাড়ি, ছায়াছায়া রাস্তা, রাস্তার ভিড়, গাড়ির শব্দ–অথচ নিজেকে এসবের অনেক উঁচুতে এমন ভাবতে পারার মজা হচ্ছিল। হঠাৎ দীপাবলীর মনে হল তার পাশে যে সুদীপ বসে। আছে সে বিবাহিত। যার কাছে সে চলেছে তার বিয়ে হয়েছে। অর্থাৎ তাদের প্রজন্মের মানুষরা এখন একটা জীবন থেকে আর একটা জীবনে ঢুকে পড়েছে। অথচ সে দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়। মনের ঘরের বদ্ধ বাতাসটা আবার ছটফটানি শুরু করল। আর সেইসময় সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, তুমি বিয়ে করছ না কেন?
কাকে? মুখ ঘোরালো দীপাবলী। আর চলতি বাসের হাওয়ার চাপে তার মুখের ওপর একফালি চুল খসে এল মাথা থেকে। সেদিকে তাকিয়ে সুদীপের চোখ হঠাৎই অন্যরকম হয়ে গেল। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দীপাবলী বলল, আরে, উত্তরটা দাও!
সুদীপ মাথা নাড়ল, নেই। উত্তর নেই।
যাক। বাঁচালে। দীপাবলী হেসে উঠল।
আমি বুঝতে পারি না, তোমার মত সহজ সুন্দরী গুণী মেয়ের জীবনে কোন সত্যিকারের ভাল ছেলে আসছে না কেন? ছেলেগুলো কি অন্ধ?
দাঁড়াও দাঁড়াও। টপাটপ কয়েকটা শব্দ ব্যবহার করে ফেলেছ। সহজ সুন্দরী ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারলাম না। আটপৌরে ভাল দেখতে?
বাজে বকো না। ন্যাচারাল বিউটির প্রতিশব্দ হিসেবে ভাবা যায় না।
সবুজ মাঠ দেখে তো চোখ জুড়িয়ে যায়। ন্যাচারাল বিউটি। কিন্তু চতুষ্পদ জন্তুদের। ছেড়ে দাও সেই মাঠে, তার সৌন্দর্য দেখবে না ঘাস খাবে? আর গুণী? এইটে যা বললে? কি গুণ আছে আমার যা কেউ বাইরে থেকে সাইনবোর্ডের মত দেখতে পাবে?
তুমি অদ্ভুত।
একটু বাকি আছে। সবশেষে তুমি বলেছিলে সত্যিকারের ভাল ছেলে। হোয়াটস দ্যাট?
মানে ভাল ছেলে। ভাল চাকরি করে, শিল্পসংস্কৃতিতে আগ্রহ আছে, রুচি মার্জিত।
সুদীপ, এই তোমার ভাল ছেলের ব্যাখ্যা?
কেন? ভুল হল?
ছেলেটি যদি ব্যবসা করে, শিল্প সংস্কৃতির ধারে কাছে নেই কিন্তু যে মেয়েটিকে সে ভালবাসে তাকে উগ্রভাবেই ভালবাসতে চায়। তাকে যত্নে রাখতে পৃথিবীর কোন কিছুর সঙ্গে সেই ছেলে কম্প্রোমাইজ করতে চায় না। একে কিরকম ছেলে বলবে?
ওয়েল! সুদীপ চোখ বন্ধ করল, খারাপ বলতে অসুবিধে হচ্ছে।
শব্দটা সোনার পাথরবাটি। একটি পুরুষ ভাল কি খারাপ তা বিচার করতে পারে সেই নারী যে তার সঙ্গে থাকে। ওই নারীর ভাবনার সঙ্গে কারো ভাবনার মিল নাও হতে পারে এবং সেটাই স্বাভাবিক। তা আমি যখন কোন পুরুষের সঙ্গে থাকতে পারছি না তখন–। হেসে কথাটা নিয়ে আর এগোল না দীপাবলী।
সুদীপ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আচমকা জিজ্ঞাসা করল, তুমি কখনও কারও প্রেমে। পড়েছ দীপাবলী? কোন সম বা অসমবয়সী পুরুষের?
দীপাবলী হাসতে চাইল। এবং তখনই বাতাসটা যেন পাখা ঝাপটাল। সে কি কারো প্রেমে কখনও পড়েছে? আচ্ছা, প্রেমে পড়া বলে কেন? প্রেমে তো মানুষ ওঠে। তার উত্তরণ হয়। মুহূর্তেই চোখের সামনে অমলকুমারের মুখ ভেসে এল। একটা চিনচিনে ব্যথা, হৃৎপিণ্ডের ওজন আচমকা বেড়ে যাওয়া! কোনরকমে সহজ হল দীপাবলী। শমিত? শমিত এখন শুধুই অস্বস্তি। জলের দাগ শুকিয়ে থাকা সাদা কাগজ।
সুদীপ এবার হাসল, কি হল?
মাথা নাড়ল দীপাবলী, নিজের প্রেমে এমন মজে আছি যে অন্যের প্রেমে পড়ার কোন সুযোগই পাইনি। আমার দ্বারা কিস্যু হবে না, তাই না?
রিহার্সাল না থাকায় মায়াকে বাড়িতেই পাওয়া যাবে ভেবেছিল দীপাবলী। কিন্তু দরজা খুলল একটি কাজের মেয়ে। সুদীপ প্রশ্ন করে জানল, মায়া এখনও ফেরেনি। সুদীপ হেসে বলল, এসো আমার ঘরে এসসা।
ততক্ষণে দীপাবলী বেশ সহজ, ব্যাস বাইরে থেকে এসে যিনি অন্তরে ঢুকে বসে আছেন। তাঁর জন্যে বাকি লাইনগুলো তুলে রাখো। বাঃ! চমৎকার সাজিয়েছে তো ঘরখানা।
সুদীপ চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসল, আমার কৃতিত্ব কিছু নেই। তোমার বন্ধু পুরুলিয়া শান্তিনিকেতন থেকে জিনিসপত্র এনে একে সুন্দর করার চেষ্টা চালিয়েছে। এসো, মায়া ফেরার আগে এক কাপ করে চা খেয়ে নিই। খুব খিদেও পেয়েছে।
আমার পায়নি। মায়া আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারি।
ধরো, মায়া যদি আজ না আসে? তুমি সারারাত অপেক্ষা করবে?
তুমি বড্ড বাজে বকো।
খুব একটা বাজে নয়। তুমি তো মায়াকে চেনো।
এরকম করে নাকি?
অসাক্ষাতে এসব বললে নিন্দে করা হবে। বসো। সুদীপ উঠে ভেতরে চলে গেল।
দীপাবলী আলমারির দিকে এগোল। ঠাসঠাস বই এবং দেখলেই বোঝা যায় রীতিমত ব্যবহৃত হয়। কারো মলাট একটু ছিঁড়ে গিয়েছে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে ব্যস্ততার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে। একটা তাকে পাশাপাশি আজকের কবিতার বই। বুদ্ধদেব বসু থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়। মাত্র কিছুদিন আগে সে বুদ্ধদেব বসুর চিল্কায় সকাল কবিতাটি মনে করতে চাইছিল। মন কিছুতেই তুলে আনতে পারছিল না শব্দগুলো। ভরের প্রথম শিউলিমাখা রোদের মত একটা অনুভূতি মশারির আড়াল আনে চারপাশে। হাত বাড়াল দীপাবলী। তার খুব ইচ্ছে করছিল কবিতাটি পড়তে এবং তখনই দরজায় শব্দ হল। কাজের মেয়েটি ছুটে আসছিল কিন্তু তাকে ইশারায় থামতে বলে সে এগিয়ে গেল। দরজা খুলতেই দেখল মায়ার মুখটা কেমন পাল্টে গেল। যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না সে।
এত দেরি করে বাড়িতে ফেরা হয় কেন? কপট গাম্ভীর্য গলায় আনল দীপাবলী।
তুই? হঠাৎ ছিটকে উঠল শব্দটা, মায়া ঘরে ঢুকে দীপাবলীকে জড়িয়ে ধরল, আমি ভাবতেই পারছি না তুই এখানে! কখন এলি? কি করে ঠিকানা পেলি।
নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দীপাবলী বলল, তোদের সঙ্গে কথা বলাই উচিত না। বিয়ে করলি চোরের মতন। একটা খবর পর্যন্ত দেবার প্রয়োজন মনে করলি না। সংসার করছিস তাও জানালি না! যদি আজ গড়িয়াহাটায় সুদীপের সঙ্গে দেখা না হয়ে যেত তাহলে।
এখন কোন অজুহাত দিলে শুনছি না। ব্যাপারটা হঠাৎই হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া তুই সরকারি চাকরি নিয়ে কোথায় পোস্টিং পেয়েছিল তাও তো আমরা জানি না। দরজা বন্ধ করে মায়া ভিতরের দরজার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ও কোথায়?
তোর বর নিশ্চয়ই আমাকে বাড়িতে একা রেখে বেরিয়ে যাবে না? দীপাবলী হাসল।
মাথা নাড়ল মায়া। ওরা দুজনে মুখোমুখি বসল। মায়া জিজ্ঞেস করল, কি দেখছিস?
তোকে একদম অন্যরকম দেখাচ্ছে না বলে পারল না দীপাবলী।
মোটা হয়েছি? মায়ার মুখচোখে একটু যেন লজ্জা!
তা তো বটেই। তুই আর মেয়ে নেই!
হো হো করে হেসে উঠল মায়া। এবং সেই হাসির মধ্যেই সুদীপ ঘরে ঢুকল। তার হাতে দুকাপ চা। ছোট টেবিলে কাপ দুটো রেখে সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, এত হাসির কি হল?
দীপাবলী মাথা নাড়ল, কিছু না। কিন্তু তুমি চা করে আনলে?
জবাব দিল মায়া, পিটপিটে লোকদের যা অবস্থা! কাজের মেয়েটা চা ভাল করতে পারে না। উনি তাই ওকে চা করতে দেবেন না। শুধু চা দিলে?
সুদীপ ফিরে যাচ্ছিল, সম্ভবত নিজের কাপটি নিয়ে আসতে, যাওয়ার আগে বলে গেল, আমি যা পেরেছি করেছি, তুমি এসে গেছ যখন তখন চার্জ টেকওভার করো।
বিরক্ত ভঙ্গিতে মায়া উঠতে যাচ্ছিল দীপাবলী তাকে নিষেধ করল, আমি কিছু খেতে পারব না, তুই বস।
সন্ধের অনেক পরেও ওদের আড্ডা শেষ হল না। মায়া ওকে জোর করে খাইয়ে দিল। দীপাবলীর খুব ভাল লাগছিল। কয়েকবছর আগেও যাদের কলেজের ছাত্র হিসেবে অনেক নিয়মকানুন মেনে চলতে দেখেছে আজ তারা স্বামী স্ত্রী হিসেবে সেসব নস্যাৎ করতে বসেছে। পারছে। সুদীপের হাবভাব এবং চেহারা যতটা এখনও চেনা মায়া তার থেকে। অনেক বেশী পাল্টে গিয়েছে নিজের অজান্তে। শরীরে ঈষৎ মেদ লাগা, চামড়া চকচকে হওয়া, কথা বলায় তৃপ্তি ফুটে ওঠা, এসব তো ছিলই তার সঙ্গে আরও কিছু। একটা সময় দীপাবলী সেটাও আবিষ্কার করল। যেসব স্বামী স্ত্রীদের সে এতকাল দেখে এসেছে তাদের স্ত্রীরা বয়স এবং ব্যক্তিত্বে অবশ্যই স্বামীর নিচে ছিল। মায়ার ব্যক্তিত্ব মাঝে মাঝে সুদীপের থেকে বেশী মনে হওয়ায় স্বামী স্ত্রীর প্রচলিত আচরণের ছবি কিছুটা বদলে গিয়ে আজ চোখে ঠেকছিল। শমিতের পাশে মায়াকে কখনই এমন মনে হয়নি। সুদীপকে চিরকাল শমিতের অনুগামী হিসেবে দেখেছিল। তখনই সুদীপ এবং মায়া ছিল প্রায় সমান সমান। আজ সুদীপ নিজেকে যতই পরিবর্ধিত করুক মায়া বয়স এবং অভিজ্ঞতা পেয়ে তার অনেকগুণ বেশী এগিয়ে গিয়েছে। চোখে ঠেকার কারণ এটাই। পুরুষকে লাঠি ঘোরাবার সুযোগ দিতেই এককালে বিয়ের সময় আট দশ বছরের কম বয়সী নারীর সন্ধান করা হত।
ওরা শোওয়ার ঘরে বসে আড্ডা মারছিল। কথা বলছিল মায়াই বেশী। সুদীপ সায় দিচ্ছিল। বেশীর ভাগ কথাই ওদের নাটক নিয়ে। এখনও গ্রুপ থিয়েটার তার পায়ের তলায় কোন মাটি পায়নি। সেই একই আর্থিক অনিশ্চয়তা এবং দুর্দশার মধ্যে নাটক করে যেতে হচ্ছে। ফলে ব্যক্তিগত ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। কবে কখন একটা কল শো পাওয়া যাবে সেই আশায বসে থাকা। কিন্তু সুদীপের বক্তব্য হল সাধারণ মানুষের একটু একটু করে। গ্রুপ থিয়েটারের নাটক সম্পর্কে আগ্রহ বাড়ছে। একটা যুগের নাট্যকর্মীরা নিজেদের শহিদ করবে হয়তো কিন্তু পরের যুগের নাট্যকর্মীরা যখন তার ফল ভোগ করবে তখন এর মূল্য। বোঝা যাবে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই যারা স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে প্রাণ দেয় তারা স্বাধীনতা ভোগ করে না। মায়া এই বিশ্লেষণ গ্রহণ করতে নারাজ। একটু তিক্ততা দুজনের কথাবার্তায় ফুটে উঠল। পুশসেল করার ক্ষমতা শেষ হয়ে গেলে হল ভাড়া বিজ্ঞাপন টিকিট ছাপার খরচ পকেট থেকে দিয়ে দিনের পর দিন শো করে নাট্য আন্দোলন করছি বলে যে সুখ মনে মনে তৈরী করা হচ্ছে তা সে মানতে রাজি নয়। পরিষ্কার বলতে পারল, নাটক করতে ভালবাসি বলেই করে যাচ্ছি। ওরা এই ভালবাসার ওপরে এক একটা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে আনন্দ পায়। বলতে পারিস খুব এক্সপেনসিভ ভালবাসা ওসব গ্রুপ থিয়েটার টিয়েটার যারা করে তারাই ভাবে। দর্শক নাটক দেখতে যায় সিঙ্গল থিয়েটারের টানে। সুদীপ প্রতিবাদ করেছিল। তার বক্তব্য থিয়েটার দলগত শিল্প। লেখা গানের মত একা কিছু করা এই শিল্পে সম্ভব নয়। সিঙ্গল থিয়েটার বলে কোন কিছু থাকতে পারে না। কাঁঠালের আমসত্ব। মায়া বিশদ করেছিল। এই ষাট দশকেও শ্যামবাজারের বাইরে নাটক দেখতে। যাঁরা আসেন তাঁরা বিশেষ একজনের জন্যেই আসেন। হয় শম্ভু মিত্র আছেন নয় উৎপল দত্ত। শেখর চ্যাটার্জীর গ্রুপ অথবা জ্ঞানেশ মুখার্জীর। একমাত্র নান্দীকারেই আরও কয়েকজনের নাম শোনা যাচ্ছে কিন্তু প্রথমেই থাকছেন অজিতেশ ব্যানার্জী। মুশকিল হল যিনি পরিচালক তিনিই প্রধান চরিত্রের অভিনেতা। বিজ্ঞাপনে শুধু তাঁরই নাম যায়। ফলে দৰ্শক আগে তাঁকেই জানতে পারে। এবং তিনি যদি ক্ষমতাবান হন, দর্শককে আকৃষ্ট করতে পারেন তাহলে থিয়েটারটা তাঁর নামেই চিহ্নিত হয়ে যায়। যে ভাবনা নিয়ে গ্রুপ থিয়েটার করার চেষ্টা হয়েছে তা চাপা পড়ে, ব্যক্তির নামই বড় হয়ে ওঠেক্রমশ। সিঙ্গল থিয়েটার তো বটেই এবং সেটা ডিরেক্টার ওরিয়েন্টেড থিয়েটার। এই কথাটা দলের পরিচালক-অভিনেতা ছাড়া আর সবাই মানবেন। এমন কি প্রযোজনা নামাবার আগে পরিচালককে তাঁর দলের কোন সদস্য যদি কিছু ঠিকমত সাজেশন দেন তাহলে তিনি তা গ্রহণ করতে অক্ষম হন। ব্যাপারটা এমন যে তাঁর দলে আর কেউ ভাল নাটক বোঝে না। শো-এর পরে টিকিট না। কেটে আমন্ত্রিত হয়ে কিছু গুণী মানুষ গ্রীনরুমে আসেন বাহবা জানাতে এবং তাঁরা কথা বলেন পরিচালক-অভিনেতার সঙ্গে। কলকাতা শহরে কিছু গুণী মানুষ আছেন যাঁরা গ্রুপ থিয়েটারের শো-গুলোতে চরে বেড়ান আমন্ত্রিত হয়ে এবং নিজেদের নাট্যবোদ্ধা হিসেবে জাহির করেন। এঁরা টিকিট কাটেন না, কেউ কেউ কাগজে দু-এক কলম লেখেন এবং এদের অনুগ্রহ পেয়ে নাম কেনেন পরিচালক-অভিনেতা কিন্তু তার বিনিময়ে টিকিট বিক্ৰী হয় না। মায়ার বক্তব্য ছিল এভাবে নাটক বাঁচানো যাবে না। পনেরশ টাকা খরচ এবং একশ টাকা টিকিট বিক্রী হলে একসময় মুখ থুবড়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। দলের সবাইকে গ্রুপ থিয়েটারের নামে নিজেকে উৎসর্গ করার ট্যাবলেট খাইয়ে কতদিন আর সচল রাখা যাবে। এই কারণেই এখন থেকে এই থিয়েটারকে প্রফেশনাল হতে হবে। এর দৃষ্টিভঙ্গীও পাল্টানো দরকার। শেষ তাস ফেলল মায়া, এই যেমন সুদীপ, যতদিন আগের দলে ছিল ততদিন কেউ ওকে চিনত না। ও ছটফট করত। আর যেই নিজের দল করল, পরিচালক হল, সবাইকে গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শের কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করল অমনি ওর নাম ছড়িয়ে পড়ল। টিকিট বিক্ৰী হোক বা না থোক, সুদীপের খুব নাম হয়েছে।
হঠাৎ সুদীপের গলা পাল্টে গেল, তুমি কি বলতে চাইছ মায়া?
কাঁধ ঝাঁকালো মায়া, আমার এই সিস্টেমটাই ভাল লাগছে না।
সেটা আলাদা কথা। কিন্তু তুমি আমার যোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ করছ। আমি জানি। তুমি আমাকে কখনই স্বীকার করতে পারবে না। আমি যত ভাল নাটকই করি না কেন তোমার কাছে স্বীকৃতি পাব না।
কেন? আলতো করে প্রশ্নটা উচ্চারণ করল মায়া।
সেটা তুমি ভাল করেই জানো। সুদীপ মাথা নাড়ল, তোমাকে আমি স্বাধীনতা দিচ্ছি। যদি মনে করো আমাদের দলে তুমি বাধ্য হয়ে থাক তাহলে স্বচ্ছন্দে চলে যেতে পার।
মায়া হাসল, কোথায় যাব? নাটক করতে না পারলে যে ভাত হজম হবে না।
যেখানে হজম হবে সেখানে যাও। সুদীপের গলা চড়ায় উঠল, আমার যোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ নিয়ে আমার দলে থাকতে হবে না। দলের ক্ষতি হবে তবু সেটা মেনে নেব।
বাঃ। চমৎকার। নিজের মুখেই বলে ফেললে আমার দল। আপত্তিটা তো সেখানেই।
দীপাবলী চুপচাপ শুনছিল। ওর খুব মজা লাগছিল। থিয়েটার সম্পর্কে এইসব কথা সে নিজে একসময় অনেক বলেছে। তার বলে যাওয়া কথাগুলোই আজ মায়া আবৃত্তি করছে। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে থিয়েটার সম্পর্কে কোন কথা বলার অধিকার তার নেই। স্রোতে গা ভাসালেই দলের সঙ্গে আত্মীয়তা তৈরী করা যায়। পাড়ে দাঁড়িয়ে দৰ্শক হলে কথাবাতার জায়গাও কমে আসা উচিত। কিন্তু ওর মজা লাগছিল অন্য কারণে। সুদীপ এবং মায়া স্বামী স্ত্রী। সমবয়সী। কিন্তু এখন এরা যেভাবে কথা বলছে তাতে মনে হচ্ছে ওরা কলেজ। ইউনিভার্সিটিতে পড়য়া বন্ধু। মতান্তর হওয়ায় উত্তেজনা এসেছে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা। অথবা সমীহ যা এতকাল দেখে আসা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কগুলোকে আলাদা করত তা এখানে একেবারেই অনুপস্থিত। সুদীপ কি মায়াকে পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত করছে শমিতকে নিয়ে? ও কি এখনও শমিত সম্পর্কে হীনন্মন্যতায় ভোগ? কথাগুলোয় যেন সেইরকম গন্ধ মিশে আছে।
সুদীপ উঠে দাঁড়িয়েছিল, থাকগে। যে জন্যে দীপাবলী এ বাড়িতে এসেছে তা নিয়ে কথা বল।
দীপাবলী সঙ্গে সঙ্গে বলল, আরে তুমি যাচ্ছ কোথায়? বসো। সুদীপ মাথা নাড়ল, তোমরা কথা বল, আমি এখনই আসছি।
সুদীপ চলে গেল। মায়া বলল, ও ওরকমই। মাথা গরম হলে ঠাণ্ডা করতে কিছুক্ষণ একলা থাকে। এবার তোর কথা বল। চাকরি ছেড়ে কলকাতায় থাকবি ঠিক করেছি?
আজ্ঞে হ্যাঁ। ওই চাকরি করা গেল না। ওপরওয়ালা আর স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষের পা-চাটা হয়ে থাকতে আমি পারব না। দীপাবলী বলল।
তোর কিন্তু সাহস আছে। এমন সুন্দর চেহারা নিয়ে ওইরকম মাঠে জঙ্গলে একা একা পড়ে থাকতিস কি করে? আমি হলে কিছুতেই পারতাম না।
আমার তো আর কিছুই নেই, শুধু সাহসটুকু আছে। শোন, তুই আমাকে একটা থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দে। গড়িয়াহাটায় তোর বরের সঙ্গে দেখা হতেই বলল তোকে কথাটা বলতে।
মায়া হাসল, তুই এখানে এসে থাক।
এখানে? হাঁ হয়ে গেল দীপাবলী, ভাগ।
শোন। তুই কিছুদিন আমাদের পুরোনো বাড়িতে থাকতে পারিস। এখন গেলে চিনতে পারবি না। পার্টিশন হয়ে যাওয়ার পরে যে যার নিজেরটা আলাদা করে নিয়েছে। আমাদের সেই কমন সিড়িটাও আর নেই। মা উঠে গিয়েছে পেছনের দিকটায়। অসুখ হবার পরে তুই ছাদের ওপরে যে ঘরটায় ছিলি সেটাও মা পেয়েছে। মা তো বাড়িতে একাই থাকে, তুই থাকতে চাইলে খুশীই হবে।
বাঃ। এর চেয়ে ভাল আর কিছুতেই হবে না। কিন্তু মাসীমাকে ভাড়া নিতে হবে।
সেটা তুই মায়ের সঙ্গে কথা বলে দ্যাখ।
মাথা নাড়ল দীপাবলী, তোকে গিয়ে বলতে হবে। উনি যদি আমার কাছে ভাড়া নেন। তাহলেই আমি ওবাড়িতে থাকব। নইলে অন্য কোথাও ব্যবস্থা করে দে।
তুই বিয়ে করলে এসব সমস্যা হত না।
দীপাবলী উঠে দাঁড়াল, ঠিক আছে, সুদীপকে ডাক।
সুদীপ নিশ্চয়ই কাছাকাছি ছিল। কথাটা শোনামাত্র ঘরে ঢুকল, তাহলে সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। দীপাবলী বলল, আগে মাসীমার সঙ্গে কথা বলে দেখি।
মায়া বলল, আমি দীপাবলীকে এগিয়ে দিয়ে আসছি।
দীপাবলী আপত্তি করল কিন্তু মায়া শুনল না। দরজায় দাঁড়িয়ে সুদীপ বলল, যদি সম্ভব হয় একদিন রিহার্সালরুমে চলে এসো। দলের সবাইকে দেখবে তোমার ভাল লাগবে।
দেখি। দীপাবলী বিদায় নিল। খানিকটা তফাতে এসে মায়া বলল, একসময় আমি অসুস্থ ছিলাম বলে তোক জোর করে শমিত অভিনয় করিয়েছিল। এখন আমার অনিচ্ছা দেখে সুদীপ সেটাই রিপিট করতে চাইছে।
দীপাবলী হাসল, তুই কিন্তু সুদীপকে সব ব্যাপারে যা ইচ্ছে তাই বলছিস।
সেইরকম মনে হল বুঝি। হাঁটতে হাঁটতে উদাসীন গলায় বলল মায়া। সুরটা কেমন লাগল, দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, তুই সুদীপকে ভালবাসতিস জানতাম না তো?
এখন কি করে জানলি! এই তো বললি সব ব্যাপারে যা ইচ্ছে তাই করছি।
বাঃ, ভাল না বাসলে তোরা বিয়ে করতিস নাকি?
মায়া জবাব দিল না। ওরা দুজনে নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল। ঘড়িতে রাত হয়েছে। যদিও দোকানপাট বন্ধ না হওয়ায় সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। বাসস্ট্যাণ্ডে এসে মায়া আচমকা জিজ্ঞাসা করল, তোকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি। তুই শমিতকে বিয়ে করলি না কেন?
নিজের অজান্তেই ঘুরে দাঁড়াল দীপাবলী, অসাড়ে বলল, তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
কেন? আমি মিথ্যে বলছি?
একশবার মিথ্যে। শমিতের সঙ্গে আমার এমন কোন সম্পর্ক হয়নি যে বিয়ের কথা। উঠতে পারে।
তুই অস্বীকার করছিস দীপা।
এরকম ধারণা তোর কেন হল?
শমিত তোর কোয়াটার্সে যায়নি?
গিয়েছিল। গিয়ে আমাকে অপদস্থ করেছে।
মানে? আমি একা একটি কাজের মেয়েকে নিয়ে থাকি। সে মেয়েটিকে প্রলুব্ধ করেছে। পাশের গরিব গ্রামে গিয়ে মদ খেয়ে এমন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল যে হাসপাতালে ভর্তি না করে উপায় ছিল না। লোকটা গিয়েছিল ছন্নছাড়া আবহাওয়া নিয়ে আমার জীবনকে অস্থির করতে।
কেন?
আমি জানি না।
তুই ওর বাড়িতে কোনদিন যাসনি?
গিয়েছিলাম। যখন থাকার জায়গা নেই, অথচ দরকার সেই সময়ে।
কেন?
বাঃ। শমিত ছিল আমাদের বন্ধু। তুই আর ও আমাকে অসুস্থ অবস্থায় তুলে নিয়ে এসেছিলি যাদবপুরের কলোনি থেকে। আমার হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল শমিত। একজন বন্ধুর কাছে আমি নিশ্চয়ই সাহায্যের জন্যে যেতে পারি।–
সেদিন তোদর মধ্যে কিছু হয়নি?
হয়েছিল। শমিত জোর করে আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রেম নিবেদন করেছিল। আমি প্রচণ্ড আপত্তি করেছিলাম। তোর কথা বলে সরে এসেছিলাম।
আমার কথা?
হ্যাঁ। আমি জানতাম তুই শমিতকে ভালবাসিস।
ও। তাই সরে এসেছিলি?
সত্যি কথা বলছি, শমিতকে বন্ধু ভাবতাম, তার বেশী কোন ইচ্ছা আমার মনে আসেনি।
কিন্তু শমিত আমাকে অন্য কথা বলেছে?
কি বলেছে?
ও তোকে ভালবাসে। এবং এই কারণেই আমাকে গ্রহণ করতে চায়নি।
এটা একদম ওর সমস্যা আমি কখনও জড়িত ছিলাম না।
তুই বলছিস শমিত আমাকে মিথ্যে বলেছে?
আমি জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি আমার সঙ্গে ওর কোন প্রেমের সম্পর্ক ছিল না।
অদ্ভুত লাগছে।
তুই এতসব জানলি কি করে? শমিতের সঙ্গে তোর যোগাযোগ আছে?
মাঝে মাঝে। ওই বলেছে তোর কাছে ও গিয়েছিল। আর কিছু বলেনি।
বলেছে তুই ওকে ফিরিয়ে দিয়েছি। নিশ্বাস ফেলল মায়া, এখন সত্যিই ওর জন্যে আমার খুব কষ্ট হয় দীপা। শুধু জেদের জন্যে কোথাও স্থির হতে পারল না।
দীপাবলী মায়ার দিকে তাকাল, তোর সঙ্গে শমিতের তাহলে এখনও যোগাযোগ আছে?
বললাম তো। মুখ ফেরাল মায়া।
সুদীপ জানে?
জিজ্ঞাসা করেনি কখনও তবে বুঝি অনুমান করছে।
সুদীপ নিশ্চয়ই পছন্দ করছে না তোর সঙ্গে শমিতের কোন সম্পর্ক থাক!
স্বাভাবিক।
তবু করছিস কেন?
আই কান্ট হেল্প। পারি না। অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারছি না।
শমিত?
ওকে আমি বুঝতে পারি না। মাঝে মাঝে এমন নিৰ্লিপ্ত থাকে যে মনে হয় ওর পৃথিবীতে কোথাও আমি নেই। হঠাৎই দুম করে এমন আচরণ করে ফেলে যে মিল পাওয়া যায় না।
শমিত কি চায়?
জানি না।
কিন্তু তুই ঠিক কাজ করছি না মায়া। সুদীপকে তুই পছন্দ করে বিয়ে করেছিল।
মানছি। কিন্তু বিয়ের আগে একটা সত্য বুঝতে পারিনি।
কি সেটা? আমার পক্ষে সুদীপকে মেনে নিয়ে চিরকাল ঘর করা অসম্ভব। ও ভীষণ ভাল মানুষ। যাকে বলে ন্যানো মানুষ। ও যে মাঝে মাঝে চকচকে কথা বলে সেটা একটা মুখোশ। আসলে একেবারে ঝুঁকি নিতে না চাওয়া ভীরু বঙ্গসন্তান। এরকম মানুষকে বাংলাদেশের বেশীর ভাগ মেয়ের মা হয়ত জামাই হিসাবে পছন্দ করবে। কিন্তু আমার কাছে বড় আলুনি হয়ে গেছে। ও যা তা আমার কাছে মূল্যহীন আর ও যা হবার ভান করে সেটা যে শুধুই ভান তা বুঝতে আমার দেরি হয় না।
এজন্যে দায়ী তুই।
হ্যাঁ। তোর জন্যে শমিত দুর্বল এটা শোনার পর স্রেফ জেদের বশে আমি সুদীপকে বিয়ে করেছিলাম। নইলে আজ আমার জীবন অন্যরকম হত। তুই জানিস শমিতের গ্রুপে একটাও ভাল অভিনেত্রী নেই। ও বারংবার বলছে আমাকে জয়েন করতে। কিন্তু আমি পারছি না।
এবার পারবি। সুদীপ তোকে গ্রুপ থেকে ছেড়ে দিতে চেয়েছে।
সেইজন্যেই আরও পারব না।
দীপাবলী মায়ার হাত ধরল, মায়া, এখন তুই আফসোস করছিস কিন্তু কে জানে শমিতকে বিয়ে করলে তুই স্বস্তি এবং শান্তি দুটোই হারাতিস হয়তো। ওর মত বেপরোয়া নিয়ম না মানা একগুয়ে পুরুষকে দূর থেকে পছন্দ করা যায় কিন্তু কাছে গেলে জ্বলেপুড়ে মরতে হয়।
এভাবে বাঁচার চেয়ে মরণ আরও ভাল ছিল।
দীপাবলী হাত ছেড়ে দিল, তাহলে সুদীপকে ডিভোর্স করছিস না কেন?
হঠাৎ দীপাবলীকে অবাক করে দিয়ে মায়া হেসে ফেলল, মাঝে মাঝে নিজেকেই বুঝতে পারি না, তাই। যাকগে। তোর বাস আসছে। তুই আগামীকাল সকালে মায়ের ওখানে চলে আয়। আমি দশটা নাগাদ যাব।
সেই রাত্রে হোস্টেলে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পরেও দীপাবলী ঘুমাতে পারছিল না। তার কেবলই মনে হচ্ছিল মায়া ঠিক বলেনি। সে মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল বলে শমিতকে মায়া। বিয়ে করেনি এটা মোটেই সত্যি নয়। নিজেকে কি রকম ময়লাটে বলে মনে হচ্ছিল তার। শমিতকে কি কখনও ভালবাসার কথা বলেছে? কখনও এমন ইঙ্গিত দিয়েছে? সে চোখ বন্ধ করে পরিচিত মানুষের মুখ দেখতে চাইল। তিনজন তার জীবনে খুব বন্ধুর মত কাছাকাছি এসেছিল। প্রথমে অসীম। উনিশকুড়ি বছরের একটি ভাল ব্যবহার করা ছেলের প্রতি তো সব মেয়েই বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে। একথা ঠিক, অসীম যখন তাকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল তখন সে ধীরে ধীরে আবেগে আক্রান্ত হয়েছিল। স্রেফ বন্ধুত্ব এবং অন্য ধরনের আবেগের মাঝখানে যখন সে দাঁড়িয়ে তখনই বুঝতে পেরেছিল। অসীমের সঙ্গে তার মানসিকতার লক্ষ যোজন তফাত। যাত্রা শুরু করার মুখে সে তাই থেমে যেতে পেরেছিল। একজন নারী হিসেবে ওই আবেগের শিকার হওয়া, শুধুই প্রাথমিক কেঁপে ওঠা কি অপরাধ? না। কিছুতেই নয়। অসীমকে সে কখনই প্রেমিক হিসেবে সম্মান দেয়নি। দেওয়া অসম্ভব ছিল। তারপর শমিত। হ্যাঁ, যে কোন নারী শমিতের আকর্ষণ এড়াতে অক্ষম হবে। তার পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্যের নানান হাত বাড়িয়ে আর এক শমিত ধীরে ধীরে তার মনে জায়গা করে নিচ্ছিল। কিন্তু সে জানত শমিতের সঙ্গে মায়ার সম্পর্কের কথা। শুধু সেই কারণেই সবসময় বন্ধুত্ব রেখে গিয়েছে, প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে এগোয়নি। একই সঙ্গে আবেগের ঝরনা আর নির্লিপ্তির বাঁধ মনের ভেতর তৈরী হয়ে গিয়েছিল বলেই সে শমিতের বাড়ি থেকে ওই দুপুরে সরে আসতে পেরেছিল। যাকে বলে পরিপূর্ণ ভালবাসায় আপ্লুত হওয়া তা কখনই শমিতের ক্ষেত্রে হয়নি। যাকে সে সবসময় দূরে রেখে দিয়েছে, যার প্রতি একই সঙ্গে আবেগ এবং নির্লিপ্তি মনে দানা বেঁধেছে সে কি করে তার প্রেমিক হবে? শমিতকে না পেলে সে বাঁচবে না এমন ভাবনাও মনে আসেনি। শমিত তার কর্মস্থলে গিয়েছিল ঝড় হয়ে, সে একজন বন্ধুর মত ততটুকু কর্তব্য করেছে যতটুকু করা উচিত। সে কখনই এমন কোন আচরণ করেনি যার জন্যে শমিতের জীবন ছারখার হয়ে যেতে পারে। তাহলে? এই যে এটুকু জড়িয়ে পড়া, তাও কি অন্যায়? জীবনে যে পুরুষ প্রথমে আসবে তাকেই চোখ বন্ধ করে প্রেমিক হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, এ কেমন কথা? তৃতীয় মুখ। অমলকুমারের। হ্যাঁ, ওর সঙ্গে অসীম বা শমিতের কোন মিল নেই। বরং বলা যায়। অমলকুমার সেই পুরুষ যে তার মনের ছন্দে পা ফেলে। তার প্রতি সে আকৃষ্ট হয়েছে কিন্তু সেটা পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে কোথাও একটা সঙ্কোচ এসে আড়াল করেছে। তার মনে। হয়েছিল অত্যন্ত ভদ্র এবং শোভনভাবে অমলকুমারের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠছে যার মধ্যে কোন তাড়াহুড়ো নেই, আকাঙ্ক্ষার কোন শিখা গ্রাস করতে মুখ বাড়ায়নি। অমলকুমার সেটা বোঝেনি তা বুঝতে সে নারাজ। কিন্তু যেটা অনুচ্চারিত ছিল সেটা উচ্চারণ করতে শেষ পর্যন্ত রাজি হল না অমলকুমার। দীপাবলী যখন রসিকতা করে লিখত অমলকুমারকে সংসারী হবার উপদেশ দিয়ে তখন যেন প্রতিটি অক্ষরে তার বিপরীত কথাই বলতে চাইত। খুড়তুতো ভাই-এর বিধবা স্ত্রী হিসেবে যে সম্পর্ক নিয়তি তৈরী করে দিয়েছিল তা কখনই আড়াল হয়নি কিন্তু দীপাবলী মনে মনে চাইত প্ৰস্তাবটা অমলকুমারের কাছ থেকেই আসুক। আঃ। তার বদলে এল বিয়ের চিঠি। এই শহরে অমলকুমার এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, হয়তো ভাবী বিয়ের স্বপ্ন দেখছে সে। কষ্ট হয়েছিল খুব ঠিকই চিঠি পেয়ে। কিন্তু যাকে বলে ভেঙ্গে পড়া তা কেন পড়েনি সে?
এরও উত্তর তার জানা আছে। অমলকান্তির প্রতি তার প্রেম জন্মেছিল। কিন্তু প্রেমের স্বীকৃতি না পাওয়া পর্যন্ত বোধহয় শেকড় মনের গভীরে ছড়িয়ে পড়ে না। অমলকুমার যেহেতু তাকে সেই স্বীকৃতির স্তরে নিয়ে যায়নি তাই একটা গুমরে ওঠা কষ্ট মুখ তুলেছিল শুধু। হয়তো জীবনে কোন পুরুষ না এলে এই কষ্টের স্মৃতি কখনই মুছে যাবে না। জীবনে আবার কোন পুরুষের কথা মনে হতেই সে হেসে ফেলল। বাংলাদেশের একজন মেয়ের তিন-তিনটে পুরুষ বন্ধু জীবনে এলে তার চরিত্র সম্পর্কে কত গল্প তৈরী হয়। সে প্রেমে পড়ক বা প্রেমের আভাসে থাক।
হঠাৎ দীপাবলী চেতনা ফিরে পেল। সে এসব ভাবছে কেন? যতক্ষণ না সে কোন অন্যায় করছে ততক্ষণ কোন অনুশোচনার প্রশ্নই ওঠে না। সে কোন অন্যায় করেনি। মায়ার জীবনযাপন ওর সমস্যা। তার কোন দায় নেই। দীপাবলী চেষ্টা করল ঘুমাতে। বালিশ আঁকড়ে।
সতীশবাবু দুঃসংবাদটা দিলেন। কলকাতা থেকে ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। সকালের অফিস তখন ছুটি হবার মুখে। সতীশবাবুও বেরুচ্ছিলেন। দীপাবলীকে দেখে। থেমে গেলেন। বললেন, তাহলে কি সব স্থির করে এলেন এবারে?
দীপাবলী অফিসের বাইরের ঘরে চেয়ার টেনে বসল, হ্যাঁ। থাকার জায়গা পেয়ে গেছি।
মন স্থির হয়ে গিয়েছে? লোকটি অদ্ভুত গলায় জিজ্ঞাসা করল।
মানে?
চেষ্টা করলে তো এখান থেকে বদলিও হওয়া যেত।
নাঃ। যা ঠিক করেছি তা আর পাল্টাবো না।
ও। আপনার জন্যে স্নানের জল তুলিয়ে রেখেছি। আপনি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করুন। আমি ঘন্টাখানেকের মধ্যেই খাবার নিয়ে ফিরে আসছি। সতীশবাবু বললেন।
কেন? ভ্রূ-কোঁচকালো দীপাবলী, আপনি খাবার আনতে যাবেন কেন? তিরি কোথায়?
সে নেই। মাথা নিচু করলেন বৃদ্ধ।
নেই মানে? অবাক দীপাবলী।
সে এখানকার কাজ ছেড়ে দিয়েছে।
সেকি? যাওয়ার সময় তো কিছু বলেনি। অদ্ভুত ব্যাপার। ও কি নেখালিতে স্বামীর কাছে ফিরে গেল? ব্যাপারটা আমি ভাবতে পারছি না সতীশবাবু!
না মা, সে নেখালিতে যায়নি। শুনছি সে হাটতলার পাশে ঘর নিয়ে অৰ্জুন নায়েকের আশ্রয়ে আছে। আমি অনেক নিষেধ করেছিলাম চাকরি ছাড়তে, শোনেনি।
কি বলছেন আপনি? প্ৰায় চিৎকার করে উঠল দীপাবলী।
হ্যাঁ মা। বলে গেল, আজ নয় কাল যে কাজটা করতেই হবে সেটা সময় থাকতে করাই ভাল। আপনি চলে যাওয়ার পর ওর কপালে যা লেখা ছিল তা বোধহয় পড়তে পেরেছিল।
দীপাবলী দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। জীবন বড় বিচিত্র। কখনই কোন হিসেব ঠিকঠাক মেলে না। নিজেকে খুব ছিবড়ে বলে মনে হচ্ছিল তার।