১৬. দেশে দেশে গণিকাবৃত্তি
এই ভারত উপমহাদেশ সেই প্রাচীন যুগ থেকেই বহিরাগতদের অনুপ্রবেশের কারণে ভারতীয় আদি সংস্কৃতি হারিয়ে গিয়ে এক মিশ্র সংস্কৃতির নাম ভারতীয় সংস্কৃতি। তথাকথিত সনাতন ধর্ম (বৈদিক ধর্ম বা পৌরাণিক ধর্ম বা হিন্দু ধর্ম), বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম, শিখ ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম সব মিলিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতি ঘেঁটে ঘ। হয়ে গেছে। ফলে প্রাচীন যুগে যে পেশা ছিল বৈধ, রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকৃত, সম্মানীয়–সেই একই পেশা আজ না ঘরকা না-ঘাটকা, না-বৈধ না-অবৈধ, ন যযৌ ন তস্থৌ ভাব। তাই গণিকাবৃত্তির প্রসার আছে ঠিকই, ভবিষ্যতেও আরও প্রসার ঘটবে। সেইসঙ্গে থাকবে নিরাপত্তাহীনতা, থাকবে পুলিশি অনুপ্রবেশ, থাকবে মস্তানদের দৌরাত্মও।
ঝেড়ে কাশেননি অনেক দেশের আইনপ্রণেতারা। অনেক আইনপ্রণেতাই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না গণিকাবৃত্তি বৈধ না অবৈধ। অবৈধ করে দিলে সমাজের উঁচুতলার সাহেবসুবোরা নারী-রসদ থেকে বঞ্চিত হবেন। আবার বৈধ করলে যথেষ্টভাবে গণিকাবৃত্তিতে চলে আসবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। চাহিদার থেকে জোগান বেশি হলে শরীর সস্তায় বিকোতে পারে। সমাজের ভারসাম্যও নষ্ট হতে পারে। বৈধ হোক বা অবৈধ হোক, পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই যে দেশে গণিকাবৃত্তি হয় না। আছে গণিকা, আছে গণিকাবৃত্তি, আছে গণিকালয়। বরং বলা ভালো পরিধি ক্রমশই বাড়ছে। বর্তমানে এমন অনেক দেশ আছে, যেখানে গণিকাবৃত্তি আইনত বৈধ। বৈধতা সত্ত্বেও সেখানে যেমন সকল নারী-পুরুষ যেমন গণিকাবৃত্তিতে আসেনি, ঠিক তেমনি যেসব দেশে গণিকাবৃত্তি অবৈধ, সেখানেও গণিকাবৃত্তি নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। অবশ্য নিশ্চিহ্ন করার ব্যাপারে কেউ গুরুতর প্রয়াস করেছে আমার জানা নেই। যাই হোক, আমরা জেনে নেব গণিকাবৃত্তি ১০০ টি দেশের মধ্যে ৫০ টি দেশে বৈধ, ৩৯ টি অবৈধ এবং ১১ টি দেশে সীমাবদ্ধ বৈধ।
৫০ টি বৈধ দেশগুলি হল–(১) আর্জেন্টিনা, (২) আমেরিকা, (৩) অস্ট্রিয়া, (৪) বেলজিয়াম, (৫) বেলিজ, (৬) বলিভিয়া, (৭) ব্রাজিল, (৮) কানাডা, (৯) চিলি, (১০) কলম্বিয়া, (১১) কোস্টা রিকা, (১২) সাইপ্রাস, (১৩) চেক রিপাবলিক, (১৪) ডেনমার্ক, (১৫) ডোমেনিকান রিপাবলিকান, (১৬) ইকুয়াডর, (১৭) এল সালভাদর, (১৮) ইস্টোনিয়া, (১৯) ইথিয়োপিয়া, (২০) ফিনল্যান্ড, (২১) ফ্রান্স, (২২) জার্মানি, (২৩) গ্রিস, (২৪) গুয়াতেমালা, (২৫) হন্ডুরাশ, (২৬) হাঙ্গেরি, (২৭) ইন্দোনেশিয়া, (২৮) আয়ারল্যান্ড, (২৯) ইজরায়েল, (৩০) ইটালি, (৩১) কিরগিজস্তান, (৩২) লাটভিয়া, (৩৩) লুক্সেমবার্গ, ৩৪) মেক্সিকো, (৩৫) নেদারল্যান্ডস, (৩৬) নিউজিল্যান্ড, (৩৭) নিকায়াগুয়া, (৩৮) পানামা, (৩৯) পারাগুয়া, (৪০) পেরু, (৪১) পোল্যান্ড, (৪২) পোর্তুগাল, (৪৩) সেনেগল, (৪৪) সিঙ্গাপুর, (৪৫) স্লোভাকিয়া, (৪৬) সুইজারল্যান্ড, (৪৭) তুরস্ক, (৪৮) ইউনাইটেড কিংডম (স্কটল্যান্ড সহ), (৪৯) উরুগুয়ে, (৫০) ভেনেজুয়েলা।
৩৯ টি অবৈধ দেশগুলি হল–(১) আফগানিস্তান, (২) আলবানিয়া, (৩) অ্যাঙ্গোলা, (৪) অ্যান্টিগা ও বারবুদা, (৫) বাহামা, (৬) বারবাডোজ, (৭) কাম্বোডিয়া, (৮) চিন (তাইওয়ান সহ), (৯) ক্রোয়েশিয়া, (১০) কিউবা, (১১) ডোমিনিকা, (১২) ইজিপ্ট, (১৩) গ্রেনাডা, (১৪) গুয়ানা, (১৫) হাইতি, (১৬) ইরান, (১৭) ইরাক, (১৮) জ্যামাইকা, (১৯) জর্ডন, (২০) কেনিয়া, (২১) উত্তর কোরিয়া, (২২) দক্ষিণ কোরিয়া, (২৩) লাইবেরিয়া, (২৪) লিথুয়ানিয়া, (২৫) মাল্টা, (২৬) ফিলিপিনস, (২৭) রোমানিয়া, (২৮) রুয়ান্ডা, (২৯) সেন্ট কিটস ও নেভিস, (৩০) সেন্ট লুসিয়া, (৩১) সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রেনাডাইনস, (৩২) সৌদি আরব, (৩৩) সালভেনিয়া, (৩৪) দক্ষিণ আফ্রিকা, (৩৫) সুরিনাম, (৩৬) থাইল্যান্ড, (৩৭) ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, (৩৮) উগান্ডা, (৩৯) সংযুক্ত আমির শাহি।
১১ টি সীমাবদ্ধ বৈধ দেশগুলি হল–(১) অস্ট্রেলিয়া, (২) বাংলাদেশ, (৩) বুলগেরিয়া, (৪) আইসল্যান্ড, (৫)। ভারত, (৬) জাপান, (৭) মালয়েশিয়া, (৮) নরওয়ে, (৯) স্পেন, (১০) সুইডেন, (১১) ইউনাইটেড স্টেট।
এক গণিকালয়ের গণিকার স্বীকারোক্তি প্রকাশ করে যে, এটা আমেরিকার সর্বোচ্চ উপার্জন’। গণিকাবৃত্তি, যা আইনিভাবে স্বীকৃত, যেখানে বলে দেয় এই গণিকাবৃত্তির কাজে আসলে কী হয়! এখানে এই পেশায় গণিকাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত কোনো নারী বা পুরুষ লজ্জা বোধ করেন না, বরং শরীরের সঙ্গে এমন আতিথেয়তায় তাঁরা খুবই সুখী। পরিসংখ্যানে তাঁরা হিসাব দেয় যে, কন্ডোম আর তৈলাক্ততায় (লুব্রিকেটিং) তাঁরা ১,৭৫০ পাউন্ড ব্যয় করে। শুধু তাই নয়, ৭,১১,০০০ পাউন্ডের বিনিময়ে তাঁদের নিজেদেরকে সেইভাবে সাজাতে হয়। সেরা সুন্দরীদের কাঁধে কাঁধ মেলাতে তাঁরা দৈনিক সময়ের সাথে ১২ ঘণ্টা থেকে ১৪ ঘণ্টা ব্যয় করে। এক একজনকে সেক্সপার্ট তাঁদের আঁকড়ে রেখেছেন। অনেকে তো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। ক্লায়েন্টরা যেমন কেউ ডিভোর্সি, কেউ কুমারী, কেউ কেউ বিধবাদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করে। অনেকেই অকপট স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, তাঁরা আন্তরিকভাবে মনে করেন, এই যৌনমিলন স্বাস্থ্য আর সুস্থতার জন্য তাঁদের প্রয়োজন। এখানে দ্বিমত নেই যে, সবটুকুই স্বয়ংকৃত এবং মান্য। তাঁরা মনে করেন শারীরিক, মানসিকভাবে চরমভাবে প্রভাবিত—তাই অকপটেই বিনিময়।
এখানে ২০ বছর বয়স থেকে অনেকেই স্বাধীনভাবে ঠিকাদার যৌনকর্মী হিসাবে কাজ করেন। সেখানে প্রতিদিনকার রোজনামচা বলে, তাঁরা সকাল ৭ টায় ঘুম থেকে ওঠে। তাঁরা হাঁটতে বেরোয়। শুধু তাই নয়, তারপর তাঁরা মনোবিজ্ঞান শিক্ষায় প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্য নেয়। পড়াশোনা কখনোই বন্ধ থাকে না। মনোবিজ্ঞান, যৌনতা, সমাজবিজ্ঞান তাঁদের উপজীব্য বিষয়। অনলাইন ভিডিওগুলির সাহায্যে তাঁরা জনগণকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারে। আয়ারল্যান্ড এই বিষয়ে একটু পিছিয়ে থাকলেও যৌনকর্মীরা মনে করে তাঁদের বৈধতা আবশ্যক। তবে এটাও আশ্চর্যের বিষয় যে, এদের পরিবার এটাকে কেবল এক পেশা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পরিবাররাও উন্মুক্ত সমর্থন দিয়েছেন এবং তাঁদের প্রতি যত্নশীল। সত্যিই সময় অনেক এগিয়ে গেছে, এখানে প্রযুক্তির সাহায্য নিজের কুমারিত্বকে নিলামে বৃহত্তর অংশ বলতে তাঁদের দ্বিধাবোধ হয় না। এখানে কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায় নয়, ধর্ম নয়—বরং উন্মুক্ততা এসেছে মনে। তাই স্বীকৃতি গণিকাবৃত্তির।
তাঁরা মনে করে এই ধরনের কর্মজীবন সংক্ষিপ্ত, কিন্তু অবশ্যই লাভজনক। একরাতে তাঁরা ১০,০০০ ডলার উপার্জন করতে পারে, যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৭,০৩,৮৫০ রুপি। তাঁদের মতে, বেডরুমের দরজা আর আত্মসমান সহ প্রত্যাশায় উন্মুক্ত। হালকা গোলাপি ম্যানিকিউর, অ্যান্ডারওয়্যার তাঁদের পেশায় ভালোই অনুরণন তোলে। এঁদের মধ্যে অনেকেই প্রথম জীবনে পর্নোগ্রাফিতে অভ্যস্ত। পরে তাঁরা স্ট্রিপ ক্লাবে কাজ করেন, আর তারপরই তাঁরা শরীর তথা যৌনতা বিক্রি করতে নেমে পড়েন। কারণ এখানে ক্ষমতাই হৃদয়ের খবরদারি করে, আর তা পর্যাপ্ত না-হলেই সম্পর্কের বাঁধন ক্ষুণ্ণ হয়।
পরিসংখ্যান বলছে, উদাহরণস্বরূপ ব্লগিং কলগার্ল বেল্লে ডে জোর ( Belle de jour), উল্লেখযোগ্য। এরা ব্লগকে মাধ্যম করে, পিএইচডির সময় এই পেশায় আসে, আর যৌন-সম্পর্ক স্থাপনে সাফল্য লাভ করে পায়। শুধুমাত্র তাঁর উপার্জন একরাতে ১০,০০০ ডলার ছাপিরে ৪০,০০০ হাজার ডলার হয়ে যায়। কলগার্ল’ বেল্লে ডে জোর ১৯৬৭ সালে ক্যাথেরিন ডিনিউভের সঙ্গে একটি ছবিতে অভিনয়ও করেন। কান চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি বিশ্বের সেরা হোটেলে ছিলেন। এমনকি প্রভাবশালী পুরুষদের হৃদয়ের আভিজাত্যের যৌনক্ষুধা মেটাতেন তিনি। যথার্থ রুচিপূর্ণ মানুষের সঙ্গিনী এঁরা। স্বীকারোক্তি বলে যে, ২০১২ সালে লিবিয়ার একনায়কতন্ত্রের ছেলের সঙ্গী হিসাবে যে অপরাধমূলক অভিযোগ ওঠে, সেখানে একরাতে এই পেশায় আয় ৪০,০০০ ডলার। স্বীকারোক্তিতে আরও অভিযোগ করে যে, সেন্ট ট্রোপজের মধ্যে এক নৌকাঁচালক আছেন। এই নৌকা তরতাজা মেয়েদেরকে বিনিয়োগে নামায়। তাঁরা মাদ্রাসায় নিয়োগ হয়, তবে সবই ধান্দার বাজারে বিকিয়ে যায়। বিকিয়ে যায় সিনেমার পরিচিত মুখ, টাকায় মুখে ঢাকা পড়ে অভিনয়। যৌনতার বয়স অর্থের কাছে তরুণ রক্তের উদ্দীপনা চায়। উল্লেখ্য, একজন সৌদি প্রিন্স এক মডেলের সঙ্গে রাত কাটালে, সেই মডেল এক রাতে ১০,০০০ ডলার লাভ করে, আবার তার থেকে বেশি অর্থ দিয়ে কেবল সেক্সর জন্য প্রায় ৯ থেকে ৯০ ভাগ সময় তাঁদের পুষতে পারে।
প্যরিস তো আবার এককাঠি উপরে। সেখানে যৌনকর্মীদের যৌনতার পাঠ দেওয়া হয় যৌনবিদ্যালয়ে। কী থাকে সিলেবাসে? আসুন, জেনে নিই—(১) এখানে যৌনতা করার সময় দৈহিক অবস্থান দেখানো হয়। (২) যৌনতা করার সময় মৌখিক (Oral Sex) সেরা যৌন সঞ্চালন দেখানো হয়। গলার দিকে শিথিল পেশির চলন, আর অন্যান্য পুরুষের অন্তর্ভুক্ত যা কিছু তা সম্যকভাবে শেখানো হয়। (৩) প্রতিনিধিত্ব এবং দাসত্ব—দুই ধরনের শরীরী খেলায় তার প্রভাব শেখানো হয়। (৪) আধিপত্যের ক্ষেত্রে কোর পেশি, জাং পেশি ভারসাম্য বিকাশে কীভাবে ক্রিয়া করে, তার গুরুত্ব বোঝানো হয়। (৫) কখন কীভাবে আঙ্গুল আর জিভের ব্যবহার করতে হবে, তা শেখানো হয়। (৬) গ্রুমিং ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা একান্ত প্রয়োজন। কারণ বিকিনির লাইনে কোনো চুল আছে কি না, আর কোনো অস্পষ্ট ক্ষত আছে কি না নিশ্চিত করার জন্য এই গ্রুমিংয়ের ব্যবস্থা। (৭) চোখে চোখ, প্রচণ্ড উত্তেজনায় চেহারায় উপভোগ, আর সঙ্গি বা সঙ্গিনীর সঙ্গে উত্তেজনায় উভয়পক্ষের ভোগ সম্পর্কে জানা। (৮) শরীরের কম্পন কীভাবে, কখন ব্যবহার করতে হবে, তা শেখানো। (৯) পরিতৃপ্তি সর্বাধিক করার জন্য একসঙ্গে কাজ করার পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হয়। (১০) অবশেষে শেখানো হয়, পরিতৃপ্তি হলেই কাস্টমার টিকে থাকবে। এই পদ্ধতি হল বাণিজ্যিক। আর এর দ্বারাই নিয়মমাফিক নিত্য স্বাভাবিক চলনের সার্থকতা। অর্থাৎ টিকিয়ে রাখার প্রক্রিয়াকরণ যথার্থ করতেই এই শিক্ষা।
“Prostitution: Prices and Statistics of the Global Sex Trade” থেকে বিশ্বব্যাপী পতিতাবৃত্তি সম্পর্কে কিছু পরিসংখ্যান এবং তথ্য পাওয়া যায়। সারা বিশ্বে গণিকার সংখ্যা প্রায় ১৩,৮২৮,৭০০ টি। এটা সারা বিশ্বে কত গণিকা আছে তার আনুমানিক চিত্র। দেশগুলির গণিকার সংখ্যা বিপুল পরিমাণে পাবলিক উৎস থেকে সংগৃহীত হয়েছিল। উৎসগুলির মধ্যে রয়েছে—নিরাপত্তা পরিসেবা অনুমান, জনস্বাস্থ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন এবং বিশ্বব্যাপী ফৌজদারি বিচার কার্যক্রম থেকে অন্যান্য পর্যবেক্ষণের তথ্য। এবার দেখে নিতে পারি, কোন্ দেশে কতজন গণিকা গণিকাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত–(১) চিন ৫,০০,০০০ জন (২) ভারত ৩,০০,০০০ জন (৩) আমেরিকা ১,০০,০০০ জন (৪) ফিলিপিনস ৮,০০,০০০ জন (৫) মেক্সিকো ৫,০০,০০০ জন (৬) জার্মানি ৪,০০,০০০ জন (৭) ব্রাজিল ২,৫০,০০০ জন (৮) থাইল্যান্ড ২,৫০,০০০ জন (৯) বাংলাদেশ ২,০০,০০০ জন (১০) দক্ষিণ কোরিয়া ১,৪৭,০০০ জন (১১) তুরস্ক ১,১৮,০০০ জন (১২) তাইওয়ান ১,০০,০০০ জন (১৩) কাম্বোডিয়া ৭০,০০০ জন (১৪) ইউক্রেন ৬৭,৫০০ জন (১৫) ব্রিটেন ৫৮,০০০ জন (১৬) কেনিয়া ৫০,০০০ জন (১৭) ভিয়েতনাম ৩৩,০০০ জন (১৮) দক্ষিণ আফ্রিকা ৩০,০০০ জন (১৯) সংযুক্ত আরব শাহি ৩০,০০০ জন (২০) ফ্রান্স ২০,০০০ জন (২১) সুইজারল্যান্ড ২০,০০০ জন (২২) পোল্যান্ড ১৯,০০০ জন (২৩) মঙ্গোলিয়া ১৯,০০০ জন (২৪) ইসরায়েল ১৭,৫০০ জন (২৫) কোস্টা রিকা ১৫,০০০ জন (২৬) নেদারল্যান্ড (হল্যান্ড) ৭,০০০ জন (২৭) নিউজিল্যান্ড ৩,৫০০ জন (২৮) ডেনমার্ক ৩,২০০ জন (২৯) আয়ারল্যান্ড ১,০০০ জন।
সারা বিশ্বের যে দেশগুলি গণিকাবৃত্তিতে রাজস্ব আদায়ের নিরিখে প্রথম দশে আছে, সেই দশটি দেশের বেশ্যাবৃত্তির ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে পারি। প্রথম দশের দেশগুলি হল যথাক্রমে–(১) চিন, (২) স্পেন, (৩) জাপান, (৪) জার্মান, (৫) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, (৬) দক্ষিণ কোরিয়া, (৭) ভারত, (৮) থাইল্যান্ড, (৯) ফিলিপাইন, (১০) তুরস্ক।
(১) চিন : উত্তর কোরিয়া নাম বললেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার আর চরম শাস্তির কথা মনে পড়ে। প্রায় ১০,০০০ উত্তর কোরিয়ার নারী ও মেয়েশিশু অবৈধভাবে শিকার। ২০০৫ সালের উৎস বলছে, গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ উত্তরদাতাদের মধ্যে নারী ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ মানব পাচারের শিকার। এটা চিনে ‘ট্রাফিকিং’ নামে খ্যাত। ট্রাফিকেরা একপ্রকার লুট, ড্রাগ আটক বা অপহরণ করে। তারপর নারীরা ইন্টারনেট সেক্সের সাইটগুলির মাধ্যমে গণিকাবৃত্তিতে বাধ্য হয়, আর স্থান হয় নাইটক্লাবগুলিতে। উত্তর কোরিয়ার শ্রম উপনিবেশগুলিতে এই ধরনের পুনর্বাসন ব্যবস্থা রাখে। এখানে সবচেয়ে ভয়াবহতা হল যে, কেবলমাত্র চিনের জনগোষ্ঠীকে ‘উত্তর কোরিয়ার বিশুদ্ধ রক্ত রক্ষার জন্য’ নামে গর্ভপাত জোরদার করে। এমনকি ‘কোরীয় তরঙ্গ’-এর জনপ্রিয়তার কারণে দক্ষিণ কোরিয়া কলেজের মেয়েরা দালালদের দ্বারা চিন, হংকং, তাইওয়ান এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় গণিকাবৃত্তিতে সংযুক্তির জন্য প্রেরণা পায়। ২০১১ সালে ম্যাকাওতে চিনের মানুষের সেবা করার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার পত্নীদের একটি বিশাল আংটি উন্মোচিত হয়েছিল। ম্যাকাওতে গণিকাবৃত্তি হিসাবে কাজ করার সময় কিছু কোরিয়ার নারী কিমিনস পরেন। ম্যাকাওতে অনেক জাপানি ‘অশ্লীল’ অভিনেত্রী গণিকা হিসাবে কাজ করে এবং তাঁদের গ্রাহকেরা সমৃদ্ধ হলেন চিনা পুরুষ। মঙ্গোলিয়ার নারী বেইজিংয়ে বার্লিতে গণিকাবৃত্তি হিসাবে কাজ করে।
উনিশ শতকে অথবা তার সমসাময়িক সময়ে পোর্তুগিজ গণিকারা ম্যাকুতে পরিচালিত হত। কিছু চৈনিক ব্যাবসায়ী ম্যাকু থেকে এসে পোর্তুগিজ গণিকাদের বিয়ে করত। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৩০ সালে সংহাইতে ৮০০০ হোয়াইট রাশিয়ান গণিকা ছিল। চিনা শহরগুলিতে অনেক ইউরোপীয় নারী নিজেদেরকে এসকর্ট হিসাবে বাজারে আকৃষ্ট করে। তাঁরা স্বাধীনভাবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের কাজ করে। সাংহাইতে অনেক রাশিয়ান নারী গণিকা হিসাবে কাজ করে। এটা বলাই যায় যে, হার্বিনে রাশিয়ান গণিকা এবং আফ্রিকান ছাত্রদের পৃষ্ঠপোষকতাও প্রকট। অনেক ভিয়েতনামী নারী চিনের পুরুষদের যৌনতা প্রদান করে। গুয়াংজি সীমান্তে বিভিন্ন উপায়ে ভিয়েতনাম থেকে চিনের পাচারকারী হিসাবে ভিয়েতনামীরা নারী পাচারের শিকার। ভিয়েতনামের সঙ্গে চিন সীমান্তে ‘ভিয়েতনামী নারী মার্কেট তৈরি করা হয়। এটা কেবলমাত্র যৌনতা প্রদানের কেন্দ্র। এমনকি প্রতি বছর কেনিয়া, রুয়ান্ডা বা উগান্ডা থেকে হাজার হাজার নারী চিন, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার গণিকাদের মধ্যে যুক্ত হয়।
প্যালেস্টাইন সমাজে মহিলাদের যৌনতা, সেইসঙ্গে ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলি দ্বন্দ্বের অবস্থা বিবেচনা করে সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিকগুলি পরীক্ষা করা হয়। ওআইসিটাইপটি প্যালেস্টাইনী যৌথ পরিচয়কে শক্তিশালী করে উভয়ই এবং একই সময়ে একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে তাঁদের যৌনতা কীভাবে পরিচালনা করা যায় সে বিষয়ে অল্পবয়সি নারীদের বার্তা প্রেরণ করে। হংকং গণিকাবৃত্তিতে বৈধতা অবাধ। চিনের চেয়েও এই স্থান গণিকাবৃত্তি উচ্চবৃত্তিতে বিশেষ আকার নিয়েছে। বাণিজ্যের কাজে অংশ নেওয়ার জন্য চিনের মহিলারা মূল ভূখণ্ড থেকে হংকং ও মাকাওয়ে ভ্রমণ করে। এই অভিযানে নারী পাচারের অভিযোগও আছে। এখন প্রশ্ন পাচারকারীর নারীরা কোথা থেকে এসেছে? পরিসংখ্যান বলছে, নারীরা মূল ভূখণ্ড চিন, মঙ্গোলিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসে।
এলিজাবেথ হুইলার এন্ডরু ( ১৮৪৫- ১৯২৭) এবং ক্যাথারিন ক্যারোলিন বুশেলেল (১৮৫৬- ১৯৪৬), যাঁরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নারীদের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লিখেছিলেন। তাঁর কলমের উপাদান ছিল—হংকং তংকা বাসিন্দা, গণিকাবৃত্তি শিল্প এবং বিদেশি নাবিকদের জন্যে সরবরাহকারী। তংকারা চিনাদের সঙ্গে বিয়ে করে না। কিন্তু সেটা জলপথের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাঁরাই ব্রিটিশদের এই কাজে সহায়তা করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল চিনা গণিকা পশ্চিমাদের সেবা করতে ভয় পায়। হংকংয়ের নিম্ন শ্রেণি ইউরোপীয়রা সহজেই তাতার গণিকাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। কান্টার প্রদেশে বেশিরভাগ চিনা নাগরিকের মধ্যে তংকা মহিলারা গণিকাবৃত্তিতে সীমাবদ্ধ ছিল। রিপাবলিকান যুগে গুমের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতেই গণিকাদের সংখ্যাও বেড়ে ওঠে।
মাঞ্চু ভ্রমণকারী কিয়াই-শি ১৭৭৭ সালে শিনজিয়াংয়ের করসাহরের এলাকায় তোরঘুত ও খোশোত নারীদের মধ্যে গণিকাবৃত্তির কথা বলেন। তিনি কাশগারে গণিকাবৃত্তির প্রসার সম্পর্কেও লিখেছেন যে, শিনজিয়াংয়ের কয়েকজন মাঞ্চু সৈন্য ও কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে লন্ডন-তুর্কি পত্নীর সঙ্গে আঞ্চলিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। ১৯০০ সালে কাশগারের রাশিয়ার কর্মকর্তাদের দ্বারা গঠিত একটি পার্টিতে স্থানীয় তুর্কি (উইঘুর) নারীর উপস্থিতি রাশিয়ান রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভের সম্মুখীন হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে স্কটিশ ধর্মপ্রচারক জর্জ ডব্লিউ হান্টার উল্লেখ করেছেন যে, তুর্কি মুসলমানদের দারিদ্র (উইঘুর) তাঁদের মেয়েদের বিক্রি করে দিত এবং এই প্রথাটি শিনজিয়াংকে তুলে ধরেছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তুর্কি গণিকা ছিল। বিপরীতে, তিনি তুগান মুসলমানদের (হিউইউ) সম্প্রদায়ের মধ্যে খুব কম গণিকাবৃত্তি দেখেন। একই সময়ে ফিনল্যান্ডের সামরিক কর্মকর্তা কার্ল ম্যানেনহিম জানান যে, হোটেনের বিভিন্ন রাস্তাগুলি উইঘুর গণিকাদের দ্বারা বিনিময় করেছিল, যাঁরা ভ্রমণকারীদের সঙ্গে তাঁদের পরিসেবা বিক্রি করার জন্য বিশেষ অভিজ্ঞ ছিল। তুর্ন থেকে রেকর্ডগুলি ইঙ্গিত দেয় যে, শিনজিয়াংয়ের তুর্কি গণিকাদের গ্রাহকরা চিনের ব্যবসায়ীদের যথোপযুক্ত ছিল।
(২) স্পেন : স্পেনকে বলা হয় গণিকাবৃত্তিতে বিশ্বের রাজধানী। গণিকাবৃত্তি স্পেনে এত জনপ্রিয় (এবং সামাজিকভাবেও গ্রহণযোগ্য) যে, জাতিসংঘের গবেষণায় দেখা গেছে যে, স্পেনীয় পুরুষদের ৩৯ শতাংশই অন্তত একবার গণিকা সেবা গ্রহণ করেছে। ২০০৯ সালে স্প্যানিশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে দেখা গেছে, একবার গণিকা ব্যবহারকারীদের হার ৩২ শতাংশ। জাতিসংঘের সংখ্যা কম, সম্ভবত ১৪ শতাংশের চেয়েও বেশি, উদারমনস্ক হল্যান্ড বা ব্রিটেনের তুলনায় অনেক বেশি। ৫ এবং ১০ শতাংশ মধ্যে ‘Oscillate’ রিপোর্ট করা হয় এবং শুধু পুরুষরা এটা স্বীকার করতে ইচ্ছুক ছিল। এই বিশাল চাহিদা পূরণের জন্য স্পেনের প্রায় ৩,০০,০০০ গণিকা স্পেনে কাজ করছে। অন্ধকার নামতেই শহরের কেন্দ্রস্থলগুলিতে, যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট, রাস্তার পাশে একচেটিয়া বার, শ্যাম্পেনের পকেটগুলো বা নমনীয় নারীদের শেপিং লক্ষণ দ্বারা সর্বশেষে স্বীকৃত। সম্প্রতি ১৮০ জন যৌনকর্মী সহ ফরাসি সীমান্তে ক্লাব প্যারাডাইজ খোলা হয়েছিল, এটি ইউরোপের বৃহত্তম গণিকালয় হিসাবে গড়ে উঠল। ক্লাব বড়ো হলেও কম বয়সি ক্লায়েন্টদের প্রত্যাশা পূরণ করে।
‘Spanish Association for the Social Reintegration of Female Prostitutes’ দ্বারা পরিচালিত গবেষণা বলছে, ১৯৯৮ সালে সাধারণ ক্লায়েন্টের মধ্যে ৪০ বছর বয়সি পুরুষদের প্রাধান্য ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ২০০৭ সালে সেই বয়সের ক্রম অনেক কমে গেছে। এখন প্রশ্ন হল, কমবয়সিরা কেন গণিকালয়ে যাচ্ছে? উত্তর হল, তাঁরা এই ক্ষেত্রে সবকিছু খুব দ্রুত পেয়ে যাচ্ছে, যেটা তাঁদের ইচ্ছার সঙ্গে সহমত আর চাহিদার সঙ্গে জোগান সহজলভ্য। যেখানে শরীর কেনাবেচাতে টাকা দেওয়ার অর্থ হল অধিকার বোধ জন্মানো। অধিকারের সঙ্গে ক্ষমতা মানে ইচ্ছার অপমৃত্যু, বর্বরতার জয়। তবে এটা খুব নির্মম, এটা কিন্তু বলা যায় না। কারণ সহজলভ্য উষ্ণতা যদি প্রয়োজনে দেহকামনার সঙ্গে এক হয়ে কেবল অর্থকে ভিত্তি করে ব্যাবসার নামে পরিসেবার রূপ নেয়, তাহলে হয়তো সেটা অধিক প্রয়োজনে, নিমর্মতা মোটেই নয়।
এখন প্রশ্ন হল, তবে কি দেহজ কারণই একমাত্র কারণ? না, কেবলমাত্র দেহজ নয়। বরং স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যক্তি স্বাধীনতা বোধকে প্রতিষ্ঠা করতেই এই গণিকাবৃত্তির রমরমা। ফ্রাঙ্কো যুগে সংকীর্ণতাভিত্তিক পরিবারের চাপ একসময় গণিকালয়গুলি নিষিদ্ধ করে দেয়। ১৯৩৫ সালে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রেও গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৩৯ সালে ‘ডিকটেটরশিপ’ (একনায়কতন্ত্র) প্রতিষ্ঠা হয়। সে সময় যৌনকর্মের ক্ষেত্রে যৌনপল্লিগুলি প্রায় একঘরে হয়ে যায়। এটা ছিল সেই সময়ের একনায়কতন্ত্রের প্রভাব। যেহেতু সময় কখনও থেমে থাকে না, যেহেতু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়, এক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটল। তবে ১৯৪১ সালে এই আইন বাতিল হয়। ১৯৬২ সালে ১৮ জুন স্পেনে প্রাচীনপন্থী স্পেনীয়ভাব বিলুপ্ত হয়। গোপন ইচ্ছার অগোচর সমৃদ্ধি একনায়কের ইন্দ্রপতনে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। অর্থাৎ কেবলমাত্র স্পৃহা নয়, সংকীর্ণ চাপের ঊর্ধ্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করাই মূল কারণ। তবে ধীরে ধীরে গণিকাবৃত্তি বর্তমানে ইয়োলো পেজে স্থান পেয়েছে। স্প্যানিশ প্রদেশে ১৯৮০-এর দশকে একজন যদি গণিকালয়ে রাত কাটাতেন, তবে সেটা কুমারীত্ব হারানোর বিষয়ের মধ্যে গণ্য হত না। এবার তাহলে বুঝতেই হয় যে, যৌনবৃত্তি ক্ষুগ্নিবৃত্তির মতোই নিবৃত্তি ভোজনের সাধারণ অনুসঙ্গ ছাড়া আর কিছুই নয়।
১৯৯০ সালে ম্যাগাজিন, ইন্টারভিউ এবং অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকেরা Spanish Lover Guide’ প্রকাশ করে নিজেরা কৃতিত্ব অর্জন করতেন। বর্তমানেও যে ক্লায়েন্ট’ কথাটার গুরুত্ব হারায়নি, তা কিন্তু কথার মূলে শব্দপ্রয়োগ থেকেই বোধগম্য হয়। যদি ফ্রাঙ্কো যুগের সংকীর্ণতাভিত্তিক পরিবারের চাপ বর্তমানে গণিকাবৃত্তি সমর্থনের মূল কারণ হয়, তবে বর্তমানে দামি সংবাদপত্রগুলিতে যৌনকর্মীর জন্য বিজ্ঞাপন ‘যৌনবিপ্লব’ নামে অভিহিত হয়। কারণ পুরানো ভিত্তি নয়, বরং স্বৈরাচারের পতন আর স্বাভাবিক সাবলীলতার জয়ই হল ‘যৌনবিপ্লব’ শব্দের পরিচায়ক। উল্লেখ্য, এখনও একটি প্রধান ‘জাতীয় দৈনিক মাদ্রিদ’-এ ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ বিজ্ঞাপন গণিকাদের জন্য, আর তাদের কাছ থেকে সমস্ত রকম পরিসেবার জন্য বিবিধ মূল্য নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপনে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়। এখন প্রশ্ন হল বিজ্ঞাপনগুলি দূর করা কি সম্ভব নয়? আসলে স্পেনের মুদ্রণের মাধ্যমে অনিশ্চিত অর্থনৈতিক রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে এবং এটি ন্যায়সংগত।
যাই হোক, স্পেনে এই পেশা বাণিজ্যিক ধারার স্বীকৃত হলেও বাস্তবে পেশা বলতে যা বোঝায়, তার কোনো স্বীকৃতি নেই। ২০০৯ সালে শুধুমাত্র স্বরাষ্ট্রমন্ত্রালয় ১৭ টি আন্তর্জাতিক অপরাধের মূলে যৌনকর্মকে দায়ী করেছে। ১৯১৯ সালেই জানুয়ারি আর এপ্রিল মাসে ‘El Pais’ পত্রিকার মতে, কর্তৃপক্ষ যৌনদাসত্বে ক্রীত মহিলাদের ৪৯৩ টি মামলা দায়ের করে। মাদ্রিদভিত্তিক এনজিও ‘প্রোকেক্টো এসপেরা’-র মুখপাত্র মার্টা গঞ্জালেজ মত প্রকাশ করেন যে, নারী বিক্রির জন্য সম্পূর্ণ অসচেতনতাই দায়ী। এখানে ক্লায়েন্টরা বেশিরভাগ সময়েই বুঝতে পারেন না যে, এটি তাঁদের পরিবারের জন্য একটি মৃত্যু হুমকিস্বরূপ, তাই সচেতনতা একান্ত আবশ্যক।
স্পেনের গণিকাবৃত্তি কোনো নির্দিষ্ট আইনের দ্বারা সংযত নয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে অবৈধ। জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে স্পেনে ৭০,২৬৮ গণিকালয় আছে। গণিকাবৃত্তি সরাসরি স্পেনের ফৌজদারি কোডে অন্তর্ভুক্ত নয়, তবে পিং পিং হিসাবে অবৈধ। সেক্ষেত্রে ১৮৮ ধারা একমাত্র নিষিদ্ধ ধারা, বিশেষ করে পিং পিং দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ ভীতি প্রদর্শন, শঠতা বা প্রয়োজনের শিকার হয়, তবে ১২ থেকে ২৪ মাসের জেল হতে পারে।
তবে কি স্পেন গণিকাবৃত্তি স্বীকার করেনি কোনোদিন? মধ্যযুগে কিন্তু স্পেনে গণিকাবৃত্তিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সতেরো শতকে চতুর্থ ফিলিপের ফরমানে এটি বন্ধ হয়। উনিশ শতকের পর ইসাবেল দ্বিতীয় রাজত্বকালে এই প্রথা আবার শহরে চালু হয়, রমরমিয়ে এই ব্যাবসা বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত পর্যায়ে যায়। ১৯৩৫ সালে আবার এই গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ হয়, শুরু হয় একনায়কতন্ত্র, বাতিল হয়ে যায় এই আইন। ১৯৭৫ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। পায়। ১৯৯৯ আরও সংশোধন করা হয় এবং এই যৌন-ব্যভিচারের শিকারদের আশ্রয় প্রদান করা হয়।
২০০৯ সালের TAMPEP গবেষণার মতে, শতকরা ৯৫ শতাংশ যৌনকর্মী অভিবাসী। প্রায় শতকরা ৮০ শতাংশ লাতিন আমেরিকান (প্রধানত ইকুয়েডর, কলম্বিয়া এবং ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র থেকে)। তবে পূর্ব। ইউরোপীয় অভিবাসী (প্রধানত রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া) আগমনের কারণে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।
ইমিগ্রেশন প্রসঙ্গে স্পেন উল্লেখযোগ্য। ২০০৮ সালে স্প্যানিশ সরকার পাচার করা নারীদের সাহায্য করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১২ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৩ পর্যন্ত বার্সেলোনার এশিয়ান ১৩৮ টি পরিদর্শনে ৫৪৪ গণিকা সনাক্ত করা হয়েছিল। ৩০ নভেম্বর ২০১২ সালে প্যারাগুয়ে থেকে ৩৪ বছর বয়সি একজন মহিলা কুয়েনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তখন তিনি তাঁর মেয়ের সঙ্গে একটি গণিকা করছিলেন।
স্পেনের যৌনকর্মীদের সঙ্গে কাজ করার সংস্থাগুলির মধ্যে আছে এপিআরএএমপিপি (অ্যাসোসিয়েশন প্যারা লা প্রেভেনসিওন, রেইন্সরসিওন ইয় এটেনসিওন দে লা মুজার প্রোফ্লুইটিডাডা) যৌনকর্মীদের অধিকার সংগঠন হিটাইরা (মাদ্রিদ), সেইসঙ্গে আঞ্চলিক সংগঠন যেমন এসআইসিএর অস্টুরিয়াস, এএমটিটিসিএসইএ (অ্যাসোসিয়েশন দে মুজিরেস), ট্রানসুকেসেলস ইয়ে ট্রাভিস্টিস কমো ট্র্যাজেজাদাসাস স্পেসিস এ এস স্পনা, মালাগা) এবং সিএটিএস (কমেট দে অ্যাপোও লাস ট্র্যাজাজাদাসার ডেল সেক্সো, মুরসিয়া)। স্প্যানিশ যৌনকর্মীরা তাঁদের সুরক্ষার অভাব সম্পর্কে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে। একটি যোগাযোগ মাধ্যম যৌনকর্মীদের অভিযোগগুলি নির্ধারণের জন্য প্রকাশ করে। স্প্যানিশ সংস্কৃতি যৌনকেন্দ্র হল গোয়া। স্পেন যৌন-পাচারের শিকার নারী এবং শিশুদের জন্য ট্রানজিট দেশ। স্পেনের পাচারকারীরা লিবিয়া থেকে মরোক্কো পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং এখানে সাগরের দক্ষিণে স্পেনে স্থানান্তরিত হয়।
কিছু ইন্টারনেট সূত্র সত্ত্বেও স্পেনের গণিকাবৃত্তি আইনি বলে দাবি করে, সত্য হল যৌনকর্মীরা আইনি ভ্যাকুয়ামেই আছে। যৌন শ্রমিকদের দণ্ডিত করা হয় না, বরং এর পরিবর্তে ক্রয়কারীরা আইন দ্বারা শাস্তি পায়। স্পেনের ৯০ শতাংশ যৌনকর্মী মানব পাচারের শিকার বলে মনে করা হয়, যা আইনতভাবে জটিল মনে হতে পারে। ১৯৫৬ সাল থেকে গণিকালয়গুলি স্পেনে অবৈধ ছিল। কিন্তু আজকাল তাদের বেশিরভাগই ‘হেসেস্টারিয়া’ বা ‘ক্লাব’ হিসাবে ছদ্মবেশী এবং স্বাভাবিক হিসাবে কাজ করার জন্য আছে। স্পেনের কিছু অংশে বার্সেলোনা সহ যৌনকর্মী ও তার ক্লায়েন্ট উভয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা যেতে পারে। সত্যিকার অর্থে, স্পেনের গণিকাবৃত্তি অন্যান্য দেশের মতো কলঙ্কিত নয়। সাধারণ মানুষ বার্সেলোনার গ্রান ভিয়া এবং বার্সেলোনায় লাস রাযাম্বলাসের মতো খোলা জায়গাগুলিতে যৌনকর্মীদের কাছে আসতে পারেন, যা অনেকগুলি স্প্যানিশ শহরের একটি সম্পূর্ণ সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির মতো মনে হয়। স্পেনের গণিকাবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্যকর ব্যাপার নয়, এটি নেদারল্যান্ডস বলে। হিউম্যান ট্র্যাফিকিং বা মানব পাচার হল গুরুতর বিশ্বব্যাপী সমস্যা এবং শোষিত যৌনকর্মীদের নিয়োগের জন্য কিছুটা অসন্তুষ্ট ক্রিয়াকলাপ, যা সরাসরি অর্থোপার্জনে সহায়ক।
(৩) জাপান : জাপানে গণিকাবৃত্তির প্রাচীন ইতিহাসের উৎস সহজলভ্য নয়। কারণ হয়তো এই বৃত্তি রুচিসম্মত নয় বলেই ইতিহাসের প্রাচীনকাল কেউ রচনা করার প্রয়োজন বোধ করেনি। জাপানে ঠিক কবে ঠিক কোন্ অঞ্চলে প্রথম যৌনপেশার অভ্যুদয় হয়েছিল, সেটা জানতে হলে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন। তবে কিছু তথ্য দেওয়া যেতেই পারে। প্রাচীনকালে জাপানের গণিকাবৃত্তি জাপানি সমাজে একটি বুনকা’ (সংস্কৃতি) হিসাবে দেখা হত। জাপানি ভাষায় যৌনকর্মীদের নানা শব্দবন্ধে বলা হয়েছে, যেমন–ইউজো, আসোবি মে, তাইউ, ওইরান, শোওবাই ওননা, কুগুৎসুমে, শিরাবিয়োশি, জোরোও, ইউকুন, শোওগি, গেই, গেইজুৎসু, গেইশাবুনকা, ইউনা, অদোরিকো, হাকুজিন, জোকাবুকি ইত্যাদি।
জাপানের গণিকাবৃত্তিকে কয়েকটা যুগে ভাগ করা যায়। ৭১০ সাল থেকে ৭৯৪ সাল পর্যন্তকে বলা হয় নারা যুগ’, ৭৯৪ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্তকে বলা হয় হেইয়ান যুগ’, ১১৮৫ সাল থেকে ১৩৩৩ সাল পর্যন্ত সময়কে বলা হয় “কামাকুরা যুগ’, ১৩৩৩ সাল থেকে ১৫৭৩ ‘মুরোমাচি যুগ’, ১৪৬৭ সাল থেকে ১৫৭৩ সাল পর্যন্ত ‘গৃহযুদ্ধের যুগ’ বা ‘ছেনগোকু জিদাই’-ও বলা হয়, ১৬০৩ সাল থেকে ১৬৬৮ সাল পর্যন্ত এদো যুগ। এই সময়কালে জাপানিদের শরীর বিক্রি বা যৌনপেশার কথা জানা যায়। এই সময়কালে আমরা ‘ইউজো’ বা আসোবি মে’ শব্দবন্ধের গণিকানারীদের কথা জানতে পারে। এঁরা যেমন শরীর বিক্রি করে অর্থ রোজগার করতেন, তেমনি নাচ-গান-অভিনয় করেও অর্থ রোজগার করত। মানয়োওশুউ’ (সহস্র পাতার বই) নামে এক প্রাচীন কবিতা-সংকলনে এইসব নারীদের ‘উকারে মে’ বা ‘ইউকোওজোফু’ বলা হয়েছে। নারা যুগ থেকে হেইয়ান যুগ পর্যন্ত ‘মিকো’ বা ‘ফুজো’ শব্দবন্ধের যুবতী নারীরা শিন্তো জিনজা মন্দিরে সেবাদাসী হিসাবে কাজ করত। এইসব সেবাদাসী বা দেবদাসীদের কেউ কেউ বিভিন্ন সরাইখানা, হাটবাজার, নদীবন্দর প্রভৃতি জায়গাগুলিতে গিয়ে বিনোদন যেমন দিত তেমন যৌনসেবাতেও লিপ্ত হতেন। জাপানি সমাজে এঁদের জন্য শব্দবন্ধ বরাদ্দ হয়েছে ইউজো’ বা ‘আসোবি মে’। মুরোমাচি যুগে জাপানের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ‘কোওশোকুকা’ অর্থাৎ ‘অশোভন এবং ‘কেইসেইইয়া’ অর্থাৎ ‘রাজকীয় গণিকালয়’ নামে গণিকালয় গড়ে উঠেছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগে। জানা যায় সে সময়ে সুজিকো নামে এক ধনী গণিকা একটি বড়ো গণিকালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল। এদো যুগের প্রথম দিকে জাপানের কিয়োতো নগরে ইজুমো-নো-ওকুনি নামে এক প্রভাবশালী ও লাস্যময়ী নারীর কথা জানা যায়, যিনি পক্ষান্তরে গণিকা ছিল। তিনি হাজার হাজার গণিকাদের পরিচালনা করতেন। এমন অবস্থা হয় যে, কিয়োতো নগরের চারিদিক ভাসমান গণিকা ছড়িয়ে পড়ে যেন বিপর্যস্ত অবস্থা। এই বিপর্যস্ততা থেকে রেহাই পেতে বা সমাজকে রক্ষা করতে ভাসমান গণিকাদের একত্রিত করে জাপানের প্রথম গণিকালয়টি স্থাপন হয়। এরপর ওসাকা ও এদো শহরেও গণিকালয় স্থাপিত হয়। তবে জাপানের সামুরাই শাসক তোয়োতোমি হিদেয়োশির রাজত্বকালে শাসক অনুমোদিত প্রথম গণিকালয়টি স্থাপিত হয়। সেই গণিকালয়ের মালিকের নাম ছিল সাবুরোজোয়েমোন হারা।
জাপানের এদো শহর। ১৫০০ সালে যে শহরের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১০০০ জন। ১৬০০ সালে জনসংখ্যা এসে দাঁড়ায় ১,৫০,০০ জনে। ১৭০০ সালে সেই সংখ্যা এসে পৌঁছোয় ১ কোটিতে। মানুষের জৈবিক চাহিদা মেটাতে এ শহরে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে স্থাপিত হল স্বর্গীয় প্রমোদপুরী, যার নাম দেওয়া হল জাপানি ভাষায় ‘য়োশিওয়ারা, বাংলা অর্থ দাঁড়ায় গণিকালয়। এদো বাকুফুর কেন্দ্রীয় প্রশাসনের প্রচুর সৈন্যসামন্ত, সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সাধারণ কর্মচারী ছিল। বিশাল সেনাবাহিনীর অধিকাংশই ছিলেন অবিবাহিত যুবক। এমনিতেই এদো যুগে মেয়েদের চেয়ে পুরুষের সংখ্যা ছিল অস্বাভাবিক বেশি। একজন নারীপ্রতি আটজন পুরুষ। ফলে সকলের পক্ষে বিয়ে করে যৌনজীবন ভোগ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। অতএব যৌনচাহিদা মেটাতে শহরের প্রায় সর্বত্র গণিকালয় গড়ে উঠেছিল গোপনে। শুধু এদো শহরেই নয়, দেশের অন্যান্য শহরেও গণিকালয় গড়ে উঠেছিল। ১৬১২ সালে জিনয়েমোন শোউজি নামে এক ব্যক্তি গণিকাদের জন্য একটি সংরক্ষিত পরিবেষ্টন তৈরির আবেদন করেন সরকারের কাছে। অনুমোদন মিলল না। জিনয়েমোন দমে না-গিয়ে পুনঃপুনঃ চেষ্টা করতে লাগলেন অনুমোদন পাওয়ার জন্য। অবশেষে ১৬১৭ সালে অনুমোদন মিলে গেল। স্থাপিত হল গণিকালয়। অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে সরকার কিছু নিয়মকানুনও বেঁধে দিল। যেমন–(১) গণিকালয়ে তালিকাভুক্ত গণিকাদের পরিবেষ্টনের ভিতরেই থাকতে হবে। পরিবেষ্টনের বাইরে কোথাও গিয়ে তাঁরা যৌনব্যাবসা করতে পারবে না। কোনো ক্লায়েন্টের সঙ্গে বাইরে কোথাও যেতে পারবে না। (২) গণিকারা জমকালো পোশাক দামি অলংকারে সাজতে পারবে না। (৩) কোনো ক্লায়েন্ট ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একবার এসে নির্দিষ্ট সময়ের বেশি থাকতে পারবে না। (৪) পরিবেষ্টিত এলাকার অভ্যন্তরে উঁচু বাড়িঘর নির্মাণ করতে পারবে না ইত্যাদি।
য়োশিওয়ারা পুরুষদের জন্য যৌন-উপভোগের আনন্দ-অমরাবতী হলেও মেয়েদের জন্য ছিল দাসত্ব। কারণ এখানে ঢোকার পর বেরোবার আর কোনো উপায় ছিল না। ৯-১০ বছর বয়সি মেয়েদের গরিব বাবা-মায়েরা যোশিওয়ারাতে বিক্রি করে দিতেন। সেইসব শিশুকন্যাদের বড়ো হওয়া পর্যন্ত যোশিওয়ারা কর্তৃপক্ষ প্রচুর টাকা খরচ করত। ভোগযোগ্য হয়ে উঠলে তবেই গণিকাপেশায় নিযুক্ত করত। গণিকাদের কেশসজ্জার কাজ করতেন অভিজ্ঞ নর-নারী। ক্লায়েন্টের কাছে আরও আবেদনময়ী করার জন্য গণিকাদের যৌনকেশ চর্চা করতে হত। যৌনাঙ্গের উপরিভাগে ‘ইরেজুমি’ (উল্কি) আঁকাতে হত। তাঁদের বিক্রয়কল্পে যে টাকা বাবা-মাকে দিতে হত, সেই টাকা মেয়েদেরই শোধ করতে হত। এককালীন শোধ করা ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তাই সেখান থেকে মুক্তি মৃত্যুর আগে মিলত না। এইসব মেয়েরা বাকি জীবনে মাত্র তিনবার ছুটি পেত। বাবা ও মায়ের মৃত্যুর পর এবং হানামি নামে একটি উৎসবে। এই বন্দিদশা থেকে উদ্ধারের একমাত্র পথ ছিল টাকা শোধ করা। যদিও সেই বিপুল পরিমাণের টাকা নিজের থেকে শোধ করা যেত। কিন্তু তা তো হওয়ার জো নেই। কারণ তাঁরা গণিকালয়ে যৌনকর্মী হিসাবে চাকরি করত মাত্র। পারিশ্রমিক হিসাবে যা পেত, তা দিয়ে নিজের চলাই কঠিন হয়ে যেত। তা থেকে অর্থ সঞ্চয় করে শোধ দেওয়া তো আকাশকুসুম।
জাপানে গণিকাবৃত্তি সে দেশের ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়। জাপানে গোটা দেশ জুড়ে হাজার হাজার ‘ওনছেন’ রিসর্ট হোটেল থাকে, যেখানে ‘কলগার্ল’ ও ‘কম্পেনিয়ন’ বলে পরিচিত, যাঁদের নিয়ে রাত্রিযাপন করা হয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগ থেকে তো বটেই, আধুনিক যুগেও মেয়েরা গণিকাবৃত্তির সঙ্গে আছে। পণ্যপ্রস্তুতকারী সংস্থা ও চলচ্চিত্র বিষয়ক পোস্টারে নগ্নপ্রায় নারী না-থাকলে সেগুলি কোনো পোস্টারই নয়। জাপানিরা যৌনতা বিষয়ে খুবই সচেতন। গণিকাদের প্রকাশ্যে ফুওজোকু’ বা ‘বাইশুন’ বলা যায় না, বলতে হয় ‘সেক্স ওয়ার্কার’। জাপানি ‘বুনকা’ শব্দটির বাংলা অর্থ সংস্কৃতি। ফুওজোকু বুনকা’, ‘বাইশুন বুনকা’ শব্দগুলির বাংলা অর্থ দাঁড়ায় গণিকা সংস্কৃতি। এই বুনকার পিছনে প্রতিদিন কোটি কোটি ইয়েন-ডলার বিনিয়োগ হয়ে চলেছে। ৮০ ও ৯০ দশকে উপচে পড়া বাব অর্থনীতির রমরমা অবস্থার প্রভাবে জাপানি পুরুষরা দল বেঁধে ফিলিপিন্স ও থাইল্যান্ডের গণিকালয়ের তরুণীদের সঙ্গে যৌন-উপভোগ করার জন্য যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল।
জাপানের আধুনিক সমাজব্যবস্থায় গণিকা সংস্কৃতি ধরে না-রাখলে বড়ো বড়ো লেনদেন, আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ব্যাবসা-বাণিজ্য এবং দেশ-জাতির কলুষতা রক্ষা করা কঠিন।
আধুনিক যুগে ১৯৫৬ সালের ‘গণিকাবৃত্তি বিরোধী আইন অনুসারে কোনো ব্যক্তি গণিকাবৃত্তি করতে পারে না বা তাঁর গ্রাহক হয়ে উঠতে পারে না।” উদার ব্যাখ্যা এবং আইন শূন্য প্রয়োগে যৌনশিল্পকে উন্নতি করতে প্রতি বছর আনুমানিক ২.৩ ট্রিলিয়ন ইয়েন আয়কে ২৪ বিলিয়ন ডলার করে দেওয়া হয়েছে। জাপানের ‘যৌনশিল্প’ কিন্তু গণিকাবৃত্তির সমার্থক নয়। যেহেতু জাপানি আইন গণিকাবৃত্তিকে ‘অর্থের বিনিময়ে অনির্দিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে যৌন-সম্পর্ক হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে, তাই বেশিরভাগ ফুজুকু কেবল কথোপকথন, নৃত্য বা স্নানের মতো আইন-কানুন পরিসেবাগুলি অফার করে আইনিবলেই। তবুও এমআইডাব্লিউ এবং জাপানের ন্যাশনাল উইমেনস এডুকেশন সেন্টারের জরিপে দেখা গেছে যে, শতকরা ২০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত জাপানি পুরুষ যৌনতার জন্য অর্থ প্রদান করেছে।
পঞ্চদশতম শতাব্দী থেকে চিনা, কোরিয়াব এবং অন্যান্য পূর্ব এশিয়ায় দর্শকরা জাপানে গণিকাবৃত্তি ঘটিয়েছিল। পরে এই অনুশীলনটি ‘পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চল থেকে আসা দর্শকদের মধ্যে অব্যাহত থাকে। পোর্তুগিজ দর্শনার্থীরা এবং তাঁদের দক্ষিণ এশীয় ও আফ্রিকান ক্রু সদস্যরা প্রায়ই জাপান দাসত্বের সঙ্গে জড়িত ছিল। তাঁরা জাপানি নারী ও মেয়েদের ক্রীত হিসাবে ধরে নিয়েছিল। তাঁদের জাহাজে যৌন ক্রীতদাস হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল, অথবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আমেরিকা ও ভারত, ম্যাকাও এবং অন্যান্য পোর্তুগিজ উপনিবেশগুলিতেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্রুত জাপানের অধিনায়ক এবং সৈন্যদের সেবা করার জন্য নারুহিকো হিগাশিকুনি সরকারের গণিকাবৃত্তি সংগঠিত করার জন্য বিনোদন ও বিনোদন সমিতি গঠিত হয়। ১৯৪৫ সালের ১৯ আগস্ট, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাপানি জাতিটির ‘বিশুদ্ধতা রক্ষা করার জন্য সহযোগী সৈন্যদের জন্য গণিকাবৃত্তি সেবা প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় সরকারি কার্যালয়কে আদেশ দেয়। এই গণিকাবৃত্তি ব্যবস্থাটি সান্ত্বনা ব্যবস্থার অনুরূপ ছিল। কারণ জাপানি পুলিশ বাহিনী এই কেন্দ্রগুলিতে নারীদের গণিকাবৃত্তি জোরদার করার জন্য সচেষ্ট ছিল। একইভাবে প্যাসিফিক যুদ্ধের সময় জাপানি সেনাবাহিনী নারীদের জোরপূর্বক গণিকাদের ভোগ করেছে। পুলিশ বাহিনী এই ক্যাম্পগুলিতে সেবা করার জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত এবং লাইসেন্সহীন উভয় গণিকাদেরই জোরপূর্বক ভোগ করেছে। সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছে, “শোয়া যুগের হাজার হাজার ‘ওকিচিস’ উৎসর্গের মাধ্যমে, আমরা দখলি সৈন্যদের পাগলামো উন্মত্ততা ধরে রাখতে এবং ভবিষ্যতে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের জাতিটির বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে এবং সংরক্ষণ করতে পারি।” এই ধরনের ক্লাব মন্ত্রিপরিষদ কাউন্সিলর ইয়োশিও কোডমা এবং রয়াইচি সাসাকাওয়া দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
১৯৪৬ সালে SCAP (Security Content Automation Protocal) লাইসেন্সপ্রাপ্ত গণিকাবৃত্তি ব্যবস্থাকে বাতিল করে দেয়। যার ফলে তথাকথিত আকসেন (লাল লাইন) সিস্টেম, যার অধীনে লাইসেন্সকৃত নাইট লাইফ প্রতিষ্ঠানগুলি একটি সাধারণ ক্লাব বা ক্যাফে হিসাবে বিবেচনার ভিত্তিতে যৌন পরিসেবা দিতে শুরু করে। মানচিত্রের উপর ‘লাল লাইন’ অঙ্কন করে স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষ ঐতিহ্যগতভাবে এই ধরনের স্থাপনার অবস্থান নিয়ন্ত্রণ করে। অন্য এলাকায়, তথাকথিত ‘নীল লাইন প্রতিষ্ঠানগুলি রেস্টুরেন্ট, বার বা অন্যান্য ক্ষেত্রে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত স্থাপনাগুলির বিকাশের অধীনে যৌন-পরিসেবাগুলি সরবরাহ করেছিল। টোকিওতে সুপরিচিত ‘লাল লাইন’ জেলাগুলিতে যশিওয়ারা ও শিনজুকু ২-চোম ছিল, যেখানে সুপরিচিত ‘নীল লাইন’ জেলা ছিল কাবুকি-চ। ১৯৪৭ সালে সাম্রাজ্য অধ্যাদেশ (৯ নং) নারীকে গণিকা হিসাবে কাজ করার জন্য প্ররোচিত করে। যদিও গণিকাবৃত্তি আইনি ছিল। বেশিরভাগ বিল গণিকাবৃত্তি করার জন্য আরও আইনি জরিমানা জোগানোর জন্য নিয়ন্ত্রণগুলি প্রবর্তিত হয়েছিল। কিন্তু শাস্তিযোগ্য পর্যায়ে বিরোধের কারণে পাস করা হয়নি। ১৯৫৬ সালের ২৪ মে জাপানের ডায়েট এন্টি-গণিকাবৃত্তি আইন পাস করে, যা ১৯৫৮ সালের এপ্রিল মাসে কার্যকর হয়েছিল। এন্টি-গণিকাবৃত্তির আইন প্রকৃত বা প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে যৌনমিলনের কাজকে অপরাধী করে। এটি ‘লাল লাইন’ এবং ‘নীল লাইন’ সিস্টেমগুলি নির্মূল করে এবং যৌন বিনোদন’ প্রবিধানগুলি, যেমন, ‘সোয়াপল্যান্ডস’ এবং ফ্যাশন স্বাস্থ্য পার্লারগুলির অধীনে চলতে দেওয়া বেশ কয়েকটি প্রদত্ত যৌন পরিসেবাগুলিকে অনুমোদন দেয়। ২০১৩ সালে জাপান রিস্টোরেশন পার্টির সহসভাপতি তোরু হাশিমতো প্রস্তাব করেছিলেন, “জাপানে আইনিভাবে তাঁদের যৌনশক্তি প্রকাশ করতে পারে এমন স্থান আছে” এবং তাঁদের এই সুবিধাগুলির ব্যবহার না-করা পর্যন্ত, যৌন প্রবৃত্তিগুলি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।”
২০০৩ সালে রিপোর্ট করা হয়েছিল যে, জাপানে গণিকাবৃত্তিতে প্রায় ১৫০,০০০ জন জাপানি নারী জড়িত ছিল। ন্যাশনাল পুলিশ এজেন্সি রেকর্ড অনুযায়ী ২০১৩ সালে গণিকাবৃত্তির অপরাধে গ্রেফতারকৃত ৫০ জন জাপানি নাগরিকের মধ্যে ৩১ (৬২%) মূল ভূখণ্ড চিনা, ১৩ (২৬%) কোরিয়াব এবং ৪ (৪%) থাই গণিকা ছিল। ১৯৫৬ সালের এন্টি-গণিকাবৃত্তি আইনের নিবন্ধ ৩ দ্বারা আধুনিক জাপানে গণিকাবৃত্তি অবৈধ হলেও, গণিকাবৃত্তির সংজ্ঞা কঠোরভাবে কোটা হিসাবে সীমিত। এর মানে হল মুখমৈথুন, পায়ুমৈথুন, পশুমৈথুন এবং অন্যান্য নন কোয়েল্ট যৌনকর্মগুলো আইনি। ১৯৪৮ সালের পাবলিক মরালস রেগুলেশন আইন প্রভাবিত ব্যবসাগুলি ১৯৮৫ ও ১৯৯৯ সালে সংশোধিত ‘অ্যাডাল্ট বিনোদন ব্যবসার নিয়ন্ত্রন আইন’ নামেও পরিচিত, যা এই ব্যবসাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
‘হেলথ’ যৌন-পরিসেবা একটি পরিচিত শব্দ। বৈষম্য হচ্ছে যে, গণিকাবৃত্তির নিজস্ব কোনো আস্তানা নেই এবং এটি অবশ্যই একটি মেয়ে বা ‘এসকর্ট পরিসেবা’, যা নারীদের তাঁদের গ্রাহকদের ঘরে বা হোটেলগুলিতে পাঠানো হয়। আউটডোর কলগার্ল ব্যাবসাগুলি হোম ও অ্যাপার্টমেন্ট মেলবক্সে, টেলিফোন বুথ, রেস্টরুম এবং জাপানের বড় শহরগুলির মতো বিজ্ঞাপন হ্যান্ডবিল বিতরণ করে। এই ব্যাবসা বা অন্যান্য অনুরূপ ব্যাবসা খুঁজে পেতে অনেক ওয়েবসাইট আছে। ফ্যাশন-হেলথ ক্লাব জাপানের সমস্ত বড় শহরগুলিতে পাওয়া যায় এবং তাঁদের উজ্জ্বল ঝলকানি আলো এবং নারীসুলভ সজ্জা কারণে স্পট করা সহজ। প্রায়শই হেলথ ক্লাব হিসাবে বিজ্ঞাপন, অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে অপরিচিত বিদেশিদের বিভ্রান্ত করতে পারে। এই ক্লাবগুলি সাধারণত প্রবেশদ্বারের কাছাকাছি তাঁদের তথাকথিত ম্যাসেজের ছবি পোস্ট করে। যাই হোক, কখনো-কখনো মুখ এবং পিক্সেলেশন কালো রেখাচিত্র দিয়ে সেন্সর করা হয়।
ইমেজ ক্লাবগুলিতে তাৎক্ষণিক ফোটোগ্রাফ গ্রহণ, একটি মহিলার অন্তর্বাস অপসারণ বা বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট পরিসেবাদির জন্য আইটেমযুক্ত মূল্য প্রদান করতে পারে। ইমেজ ক্লাবগুলিতে কাজ করে এমন নারীদের প্রতিদিন ৩০,০০০ থেকে ৩৫,০০০ ইয়েন প্রদান করে এবং তা থেকে প্রতি মাসে একজন নারী ১ মিলিয়ন ইয়েন আয় করতে পারে। পিংক স্যালন’, জাপান দেশে এটি এক ধরনের গণিকাবৃত্তি, যা ‘ওরাল যৌন-বিশেষজ্ঞ হিসাবে পরিচিত। পিংক ফ্ল্যাশগুলি গণিকাবৃত্তির জন্য খাদ্য সরবরাহ করে, ব্যক্তিগত কক্ষ ছাড়া অপারেটিং এবং সীমাবদ্ধতার জন্য প্রদত্ত পরিসেবাদিকে সীমাবদ্ধ করে। তাঁরা জাপান জুড়ে এবং তাঁদের মধ্যে কাজ করা নারীরা প্রতি শিফটে এক ডজন বা আরও বেশি পুরুষদের সেবা করতে পারে। সোপল্যান্ড, বা সোপু, একটি জাপাপলিশ শব্দ, যা দুটি ইংরেজী শব্দ ‘সোপ’ এবং ‘ল্যান্ড থেকে সৃষ্ট এবং এটি জাপানের রাতের বিনোদন বিনোদন শিল্পের অংশ, যা ‘মিজু শোবাই’ নামেও পরিচিত।
যেহেতু অর্থের জন্য যৌন-সঙ্গত আনুষ্ঠানিকভাবে জাপানে নিষিদ্ধ, তবুও জাপানে বিভিন্ন ধরনের গণিকাবৃত্তি বিকাশ লাভ করেছে। যদিও সোপগুলির জন্য প্রধান ক্লায়েন্ট পুরুষ হয়, বিশেষত মহিলা ক্লায়েন্টদের জন্যেও কয়েকটি সোপল্যান্ড আছে। বিভিন্ন ধরনের সোপল্যান্ড আছে এবং তাঁরা সাধারণত বিভিন্ন সোয়াপল্যান্ডের কমপ্লেক্সে অবস্থিত। সুপরিচিত কমপ্লেক্স সপোরো, সুসুকিনো, টোকিওর জোশিয়ার ও কাবুকিচো, গিফুতে কাওয়াসাকেন, গিফুতে কানজুয়েন, শিগায় ওগোটো, কোবেতে ফুকুহারা, ওডওয়ারারে সাগামামুনুমাটা এবং ফুকুওকাতে নকাকুতে অবস্থিত। তবে অন্যান্য অনেকগুলি এলাকাও আছে।
১৯৫৮ সালে জাপানে স্পষ্টভাবে গণিকাবৃত্তি অবৈধ হয়ে যাওয়ার সময় সোয়াপল্যান্ড শুরু হয়, যেখানে স্নান দ্বারা নারীর শরীর ধুয়ে এক সাধারণ ফর্ম হিসাবে কাজ করে। তাঁরা মূলত তুর্কি-বুরো নামে পরিচিত ছিল, যার অর্থ তুর্কি স্নান। তুর্কি পণ্ডিত স্রেট সানকাক্লি ১৯৮৪ সালের প্রচারণার পর গণিকাবৃত্তির জন্য এই নামটির ব্যবহারকে অস্বীকার করে নতুন নাম ‘সোপল্যান্ড’ তাঁদের নামকরণের জন্য দেশব্যাপী প্রতিযোগিতার বিজয়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। সুমাটা’ (কখনো-কখনো ‘পশ্চাদপসরণ’ হিসাবে পশ্চিমে পরিচিত) জাপানি গণিকাবৃত্তিতে জনপ্রিয় একটি অ-তীব্র যৌন কার্যকলাপের জাপানি শব্দ। বলা যায় এটি একটি পুরুষ ক্লায়েন্টের উপর মহিলা যৌনকর্মী দ্বারা সঞ্চালিত ফ্রন্টেজের একটি ফর্ম। যৌনকর্মী তার আন্তঃসম্পর্কীয় যৌনতায় এবং ল্যাবিয়া মেয়ের সঙ্গে ক্লায়েন্টের সেক্সকে চাঙা করে এবং এখানে penile-vaginal প্রবেশ ছাড়া উল্লাস উদ্দীপনা করা হয়। এই কার্যকলাপটি ১৯৫৬ সালের এন্টি-গণিকাবৃত্তি আইনকে কঠোর করে তোলে, যা অর্থের জন্য যৌনসঙ্গিনীকে নিষিদ্ধ করে।
মূলত জাপান হল যৌন-পাচারে পুরুষ, নারী এবং শিশুদের জন্য ট্রানজিট দেশ। উত্তর-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকা থেকে পুরুষ, নারী এবং শিশুরা চাকরি বা জালিয়াতি বিয়ের জন্য জাপানে বেড়াতে আসে এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়। পাচারকারীরা বার, ক্লাব, গণিকালয় এবং ম্যাসেজ পার্লারগুলিতে জোরপূর্বক গণিকাবৃত্তি করার জন্য জাপানে নারীর প্রবেশাধিকার সহজতর করার জন্য বিদেশি নারী ও জাপানি পুরুষদের মধ্যে জালিয়াতি বিয়ে করে থাকে। পাচারকারীরা বাধ্যতামূলক গণিকাবৃত্তিতে ঋণের দাসত্ব, সহিংসতার হুমকি, নির্বাসন, ব্ল্যাকমেইল এবং অন্যান্য মানসিকভাবে বাধ্যতামূলক পদ্ধতি ব্যবহার করে। গণিকালয় পরিচালকরা কখনো-কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে অসৎ আচরণের দ্বারা শিকারদের উপর জরিমানা চাপিয়ে দেয়। পূর্ব এশিয়া ও উত্তর আমেরিকা সহ পশ্চিমাঞ্চলীয় গন্তব্যগুলিতে শোষিত হওয়ার আগে পাচারকারীরা জাপানকে ট্রানজিট করে। জাপানি নাগরিক, বিশেষত পালিয়ে যাওয়া কিশোরী মেয়েরাও যৌন পাচারের শিকার। অত্যন্ত সংগঠিত গণিকাবৃত্তি নেটওয়ার্কগুলি ঝুঁকিপূর্ণভাবে জাপানি নারী ও মেয়েশিশুদের লক্ষ করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট’ অফিসে মনিটরিং ও ট্র্যাফিকিংয়ে ব্যক্তিদের জাপানকে ‘টায়ার ১’ দেশ হিসাবে স্থান করে নিয়েছে।
(৪) জার্মান : আইন অনুসারে জার্মানে গণিকাবৃত্তির আয় থেকে গণিকাদের ট্যাক্স প্রদান করতে হয়। জার্মানের আমস্টারডাম ‘গণিকাবৃত্তির রাজধানী হিসাবে পরিচিত। জার্মানে অন্য শিল্প বছরে ১৫ বিলিয়ন ইউরোর বেশি আয় করে এবং ৪,০০,০০০ গণিকা প্রতিদিন ১.২ মিলিয়ন পুরুষকে সেবা করে।
জার্মানের ইতিহাস জুড়ে সরকার সাধারণত শিল্পে জড়িতদের নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ করতে পছন্দ করে। এটি মূলত ২০০২ সালে গণিকাবৃত্তির আইন দ্বারা বর্ধিত অধিকারগুলির সঙ্গে ১৯২৭ সালে (ভেরিয়াল ডিজিজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আইন) নিষ্পত্তি করা হয়েছিল। এই আইনটি গণিকাদের কাজের চুক্তিতে জড়িত থাকার (এবং প্রয়োগ করার অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণ ও গণিকাদের আইনি অধিকার উন্নত করতে চাওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা দিতে এবং স্বাস্থ্যবিমা ব্যবহার করে।
ফলে জার্মানে যৌন হয়রানি থেকে গণিকাবৃত্তিজনিত অপরাধ বেড়েছে। বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপে থেকে নারীদের শোষণ একটি প্রধান সমস্যা। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, দেশের প্রায় শতকরা ৭০ শতাংশ নারী বিদেশে কাজ করে। ২০০২ সালে তৈরি করা আইনটি ব্যাপকভাবে ব্যর্থ বলে মনে করা হয়। অনেক গণিকা অল্প সময়ের জন্যই দেশে থাকে। গণিকারা উচ্চ করের অর্থ প্রদান করে এবং রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধি করে। তবে নারীকে রক্ষা করার জন্য বেশিরভাগই সামান্য কাজ করে।
বন শহরের গণিকালয়গুলিতে পার্কিং মিটারগুলির মতো ভেন্ডিং মেশিনগুলির মাধ্যমে Immenburgstrasse-এ কাজ করার জন্য একটি রাতের যৌন কাজ কর প্রদান করে। মিউনিখের পুরো শহর কেন্দ্রটি ‘সেরপারেজিরক’। হামবুর্গের কুখ্যাত ‘রিপারবার্ন’ (রেড লাইট এরিয়া) সবচেয়ে সুপরিচিত এলাকা। উল্লেখ্য যে, কয়েকটি রাজ্যে ৩৫,০০০-এরও কম অধিবাসীদের শহরগুলিতে গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ করে। অন্যদিকে, বার্লিনের গণিকাবৃত্তিকে সর্বত্র অনুমতি দেওয়া হয়।
ফ্রাঙ্কফুর্টের সমৃদ্ধ ব্যাংকিং শিল্প এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রায়ই সফল যৌনবাজারের সঙ্গে যুক্ত হয়। এটি সমৃদ্ধ রেড লাইট এরিয়ার আশেপাশে হুপবানহফে ‘বাহনফসভিয়ের্টেল’ (Bahnhofsviertel) নামে পরিচিত এবং পেশাদার যৌনশিল্প হিসাবেও পরিচিত। ইরোস সেন্টারে (ম্যাডাম বা মালকিন বা মক্ষীরানি ছাড়া সস্তা লাইসেন্সপ্রাপ্ত গণিকালয়) জার্মানিতে সবচেয়ে বড়ো গণিকালয়গুলির মধ্যে এই সুবিধা আছে। কলোনি জিস্টেমান্ডার স্ট্রাব (Geestemunder Strabe) রাস্তার গণিকাবৃত্তি করার অনুমতি দেয়, কিন্তু মজার বিষয়, মাদক বিক্রেতা এবং পাম্পগুলি অনুমোদিত নয়। উপরন্তু মেগা গণিকালয় ‘পাসচা’ (Pauscha) ১২ তল এবং ১০০ টিরও বেশি কক্ষ আছে।
একটি জার্মান চলচ্চিত্র এবং বিনোদন সংস্থা হোস্ট এবং চলচ্চিত্রগুলি বিভিন্ন থিমগুলির সঙ্গে গ্যাং ব্যাং (gang bang) দল, যা তাঁরা জনসাধারণের কাছে পর্নোগ্রাফি হিসাবে বিক্রি করে। প্রতি অংশগ্রহণকারী ৩৫ ইউরো প্রদান করে, যা পানীয় এবং খাদ্যের অন্তর্ভুক্ত। ‘বিনোদন’ হিসাবে প্রদত্ত মহিলারা সকলেই গণিকা নারী। কন্ডোম ব্যবহারে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ, যদিও বাণিজ্যিক যৌন-ক্রেতা বা ক্লায়েন্টরা পরিচয় গোপন করার জন্য মাউথ-মাস্ক সরবরাহ করা হয়, যাতে কেউ চিনতে না পারে। পুরুষদের অবশ্যই একটি সাম্প্রতিক এইচআইভি রিপোর্ট (দুই সপ্তাহের পুরোনো নয়) আনতে হবে, অথবা গণিকালয়ে এসে অতি দ্রুত পরীক্ষা করাতে হবে। জার্মানিতে পর্নোগ্রাফি, গণিকালয় এবং গণিকাবৃত্তি প্রচারের জন্য বেশ কয়েকটি টিভি শো আছে। সেইসব জার্মান চ্যানেলগুলি রিয়ালিটি শোতে গণিকাবৃত্তি সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করে। গণিকা নারীরা কেমন পরিসেবা প্রদান করে এবং তা কতটা উত্তেজনাপূর্ণ এবং ভালোবাসাপূর্ণ সে সম্পর্কে কথা বলে। ২০১০ সালে এই চ্যানেলটি এমন একটি গণিকালয় সম্পর্কে একটি অনুষ্ঠান প্রচার করেছে, যা যৌনকল্পনাকে (Sex fantasy) যৌন-সম্পর্ক স্থাপন করতে সহায়তা করেছে। YouTube-এ একটি ভিডিও এই গণিকাবৃত্তির পঞ্চম বার্ষিকী প্রদর্শন করে, যেখানে অনেক জার্মান সেলিব্রিটিদের উপস্থিত থাকতে দেখা যায়।
২০১১ সালে ‘দ্য উইলসহেইমস’ (Wollersheims) নামে একটি রিয়ালিটি শোয়ে গণিকালয়ের মালিক বার্ট উইলসহেইম এবং জার্মানির সবচেয়ে প্রতারক গণিকার বসের নতুন প্রেম’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠান করে। ৯০-এর দশকে ওয়ালারশিম (wollersheim) মানব পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তাঁরই নির্দেশে একজন গণিকা নারীকে অপহরণ করা হয়েছিল। কারণ সেই মহিলা গণিকাবৃত্তি করতে চাননি এবং তাঁর নতুন প্রেমিক (বা পাম্প) স্থানান্তর ফি দিতে ইচ্ছুক ছিল না।
বিখ্যাত ‘প্যারাডাইজ ব্রথেল’ চেইনটির ম্যানেজার মাইকেল বিয়ারেটিন (Michael Beretin) জার্মানির গণিকাবৃত্তি সংবলিত দুটি রিয়ালিটি টিভি প্রোগ্রামে জড়িত ছিলেন। আর-একটি শোতে ‘বার্ডেল এসওএস’ গোষ্ঠী আরও নগদ টাকা আনায় সহায়তা করার জন্য গণিকাকেই ‘জ্যাজ’ করে। ২০১৫ সালে বিয়ারেটিনকে (Beretin) মানব পাচার, জোরপূর্বক গণিকাবৃত্তি এবং জালিয়াতির সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও জার্মান টেলিভিশন চ্যানেলগুলি অনুষ্ঠানের আয়োজন চালিয়ে গেছে।
যৌনসম্পর্কের জন্য অর্থ প্রদানের সঙ্গে মানুষদের মধ্যে পার্থক্য কী? ব্যাপারটি আসলে পর্নো এবং গণিকাবৃত্তির মধ্যে স্পষ্টভাবে কোনো পার্থক্য নেই। বাস্তবিকই পর্নো এবং গণিকাবৃত্তির মধ্যে যোগসূত্র অবিচ্ছেদ্য। গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, সাধারণ জনসংখ্যার তুলনায় বিগত বছরগুলিতে গণিকাবৃত্তিতে যাওয়া ব্যক্তিরা দ্বিগুণ পর্নোগ্রাফি দেখেছেন। এটিও বিস্ময়কর নয় যে, এই গ্রাহকরা যখন দেখেন, তখন তাঁরা যে পর্নো কাজগুলি করতে চায় সেগুলি শোনার জন্য অনেকগুলি পর্নো ছবির সঙ্গে প্রস্তুত থাকে। জার্মানিতে গণিকাবৃত্তি, পর্নোগ্রাফি ব্যাপকভাবে উদযাপন করে এবং সমাজের অগ্রগতি হিসাবে স্বাগত জানায়।
মানব পাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জার্মানি গণিকাবৃত্তির নতুন আইন পাস করেছে। এটি আরও নিয়ন্ত্রণ, আরও প্রণিধানযোগ্য এবং আরও জরিমানা করার জন্য ভাবা হচ্ছে। এর ফলে জার্মানিতে যৌনকর্মী হিসাবে অর্থ উপার্জন করা আরও কঠিন হয়ে উঠবে। গণিকাবৃত্তি শিল্পের নিয়ন্ত্রণ এবং যৌনকর্মীদের সুরক্ষা, যা আইন হিসাবে কার্যকর হয়। গণিকাবৃত্তি এখন নতুন আইনের অধীনে ঘনিষ্ঠভাবে নজরদারির অধীনে থাকবে। জার্মানির প্রাক্তন পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী ম্যানুয়েল শোশেগ (Manuela Schwesig) যখন এক বছর আগে জার্মান বুন্ডস্ট্যাগে খসড়া আইন পেশ করেছিলেন, তখন তিনি বলেন, “এই দেশে গণিকাবৃত্তির চেয়ে স্ন্যাকবার খোলা কঠিন”। এখানকার যৌনকর্মীরা প্রায়শই অপমানজনক কাজের পরিবেশের মুখোমুখি হন। নতুন আইনের মতে, যৌনকর্মীদের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিবন্ধন করতে হবে এবং একটি জনস্বাস্থ্য পরিসেবা থেকে চিকিৎসা পরামর্শ চাইতে হবে। ভবিষ্যতে যৌনসেবা প্রস্তাবকারী গণিকাকে একটি পারমিটের জন্য আবেদন করতে হবে, যা শুধুমাত্র স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যবিধি এবং শয্যাঘরের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে দেওয়া হবে। নতুন আইনটি ফ্ল্যাট-রেট (flat-rate) গণিকাবৃত্তি এবং গ্যাং ব্যাং গোষ্ঠীগুলিকে নিষিদ্ধ করে, যার মধ্যে একজন গণিকা বা যৌনকর্মী একযোগে বেশ কয়েকজন পুরুষকে সেবা করতে হবে। এছাড়া কন্ডোম ছাড়া যৌনকর্ম নিষিদ্ধ করা হয়। জার্মানিতে বিলিয়ন ইউরো গণিকাবৃত্তি বাজার, যা ২,০০,০০০ থেকে ৫,০০,০০০ নারী ও পুরুষদের মধ্যে কোথাও না কোথাও কাজ করে।
(৫) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র : ফেডারেশন আইনের পরিবর্তে রাষ্ট্র আইনের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গণিকাবৃত্তি অবৈধ। তবে নেভাদা রাজ্যের কিছু গ্রামীণ কাউন্টিতে গণিকাবৃত্তি বৈধ। এই নেভাদা রাজ্যেই লাস ভেগাস (Las Vegas) একটি বিখ্যাত শহর, যে শহরটিকে একটি প্রমোদনগরী হিসাবে সারাবিশ্বে বিখ্যাত। এ শহর যেমন জুয়া খেলার বিখ্যাত, তেমনি গণিকাবৃত্তির জন্যও বিখ্যাত। জুয়া আর গণিকাভোগের টানেই প্রতি বছর কয়েক কোটি মানুষ এ শহরে বেড়াতে আসে। লাস ভেগাস নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আলো ঝলমলে একটা ছবি। উদ্দাম আনন্দ, উৎসব। কিন্তু তার পিছনেই আছে অন্ধকার। সেই অন্ধকার সবাই দেখতে পায় না, জানতে পারে না, অনুভব করতে পারে না।
লাস ভেগাসেই আছে আমেরিকার সবচেয়ে দামি হোটেলগুলি। এই হোটেলগুলি গণিকাবৃত্তির প্রসোদকানন। এখানে যৌনতা এতটাই উদ্দাম ও উদোম যে, হোটেলে নিজের ঘরে যৌনক্রিয়া করে সেটা একরকম, কিন্তু উদ্দাম যৌনতায় নরনারী মেতে ওঠে হলঘরেও। তবে হলঘরের যৌনমিলন সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে হয় না, যতটা সম্ভব পোশাক শরীরে রাখা থাকে। এমনকি হোটেলের সুইমিং পুলেও নর-নারী যৌনমিলন করে। প্রতিদিন এত এত ব্যবহৃত কন্ডোম, মদের বোতল, যৌনরসে সিক্ত নোংরা পোশাক, সিরিঞ্জ আর বমি পরিষ্কার করতে করতেই সাফাইকর্মীরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
আমেরিকায় সর্বত্র নিষিদ্ধ হলেও গণিকাবৃত্তি সারা দেশেই ঘটে। দেশের গণিকাবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ ফেডারেল সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষমতাগুলির এক্তিয়ার নয়। তাই এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দশম সংশোধনীর অধীনে বাণিজ্যিকভাবে সেক্সকে অনুমোদন, নিষিদ্ধকরণ বা অন্যথায় বাণিজ্যিকভাবে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য রাজ্যগুলির ডোমেন ব্যতীত ম্যানগ্র আইনের অধীনে অন্তর্বর্তী বাণিজ্য অংশ হিসাবে কংগ্রেস এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বেশিরভাগ রাজ্যে গণিকাবৃত্তিকে জনসাধারণের ক্রম-অপরাধের অপরাধে বিভ্রান্তিকর বলে মনে করা হয়, যা কমিউনিটির আদেশকে বাধা দেয়। গণিকাবৃত্তি একটি সময় পর্যন্ত ভয়ানক অপরাধ বলে মনে করা হত।
বর্তমানে নেভাদা বৈধ গণিকাবৃত্তি-নিয়ন্ত্রিত। নেভাদা সংশোধিত সংবিধিগুলির মধ্যে নির্ধারিত শর্তগুলির অনুমতি দেওয়ার একমাত্র মার্কিন অধিকারী। শুধুমাত্র আটটি কাউন্টিতে বর্তমানে সক্রিয় গণিকাবৃত্তি আছে। ক্লার্ক কাউন্টি (যা লাস ভেগাস-প্যারাডাইজ মেট্রোপলিটন এলাকায় আছে), গণিকা কাউন্টি (যার মধ্যে রেইনও আছে), কারসন সিটি, ডগলাস কাউন্টি এবং লিঙ্কন কাউন্টিতে সমস্ত ধরনের গণিকাবৃত্তি অবৈধ। অন্য কাউন্টিগুলি তাত্ত্বিকভাবে গণিকাবৃত্তিকে অনুমোদন দেয়। তবে কিছু কাউন্টিতে বর্তমানে কোনো সক্রিয় গণিকাবৃত্তি নেই। রাস্তার গণিকাবৃত্তির আয় থেকে জীবনযাপন করা নেভাদা আইনের অধীনে অবৈধ। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ জাস্টিসের মতে, ২০০৪ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, দেশে প্রায় ১৫-২০ শতাংশ পুরুষই গণিকার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক করেছে। অন্য দেশগুলির মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণিকাবৃত্তিটি তিনটি বিস্তৃত বিভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে—রাস্তায় গণিকাবৃত্তি, গণিকালয়ে গণিকাবৃত্তি এবং এসকর্ট গণিকাবৃত্তি।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকান বিপ্লবের কয়েকজন নারী যাঁরা মহাদেশীয় সেনাবাহিনীর অনুসারী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সেনা ও কর্মকর্তারা যৌন অংশীদার হিসাবে পরিসেবা নিয়েছিল। বিশেষত ভেনেরিয়াল রোগের (venereal diseases) সম্ভাব্য বিস্তারের কারণে গণিকাসঙ্গে সেনাবাহিনী নেতৃত্বের জন্য একটি উদ্বেগজনক উপস্থিত হয়েছিল। তবে সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা সৈন্যদের মনোবল বজায় রাখতে গৃহযুদ্ধের সময় গণিকাদের উপস্থিতিকে উৎসাহিত করেন। ১৮৬৩ সালে ২০ আগস্ট মার্কিন সেনা কমান্ডার ব্রিগেড, জেনারেল রবার্ট এস এবং গ্র্যাঞ্জার ইউনিয়ন সৈন্যদের মধ্যে ভেনেরিয়াল রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য ন্যাশভিল, টেনেসিতে গণিকাবৃত্তি বৈধ করেছিলেন। এই পদক্ষেপ সফল ছিল এবং কঠোর সুস্থতা প্রোগ্রামের কারণে ভেনেরিয়াল রোগের হার মাত্র চার শতাংশে নেমে গিয়েছিল। যার জন্য সমস্ত গণিকাবৃত্তি নিবন্ধন করতে এবং একটি বোর্ড প্রত্যয়িত চিকিৎসকের প্রতি দুই সপ্তাহের জন্য পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল, যার জন্য তাঁদের পাঁচ ডলারের নিবন্ধন ফি এবং প্রতি পরীক্ষায় ৫০ সেন্ট চার্জ করা হয়েছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে পার্লার হাউস গণিকালয়গুলি উচ্চশ্রেণির ক্লায়েন্টদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কনসার্ট স্যালুনে পুরুষরা খেতে পারে, গান শুনতে পারে, যৌনতার জন্য নারীসঙ্গ নিতে পারে। লোয়ার ম্যানহাটানের ২০০ টিরও বেশি গণিকালয় বিদ্যমান। গণিকাবৃত্তি আইনানুগ আইনের অধীনে অবৈধ ছিল বটে। কিন্তু পুলিশ ও শহরের কর্মকর্তাদের উদাসীনতায় এটি কখনোই কার্যকর ছিল না। কারণ তাঁরা গণিকালয়ের মালিক ও মালকিন দ্বারা প্রভাবিত ছিল। বিংশ শতাব্দীতে, অর্থাৎ ১৯০৮ সালে ‘ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (বিওআই) প্রতিষ্ঠা করা হয়, যাতে তাঁরা অপহরণ করা হয়েছে কি না তা খুঁজে বের করা সম্ভব হয়। গণিকালয় কর্মচারীদের সাক্ষাতে ‘সাদা দাসত্ব’ (white slavery) তদন্তের জন্যেও এই প্রতিষ্ঠান সক্রিয় ছিল। এক শহরে ১১০৬ জন গণিকার সাক্ষাৎকারে ৬ জন বলেছে তাঁরা সাদা দাসত্বের শিকার। ১৯১০ সালের ‘হোয়াইট স্লেভ ট্রাফিক আইন’ তথাকথিত ‘সাদা দাসত্ব’ নিষিদ্ধ করেছিল। এটি অনৈতিক উদ্দেশ্যে (Immoral Purposes)। মহিলাদের অন্তর্নিহিত পরিবহন নিষিদ্ধ করে। পরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ‘অনৈতিক উদ্দেশ্য’-এর অধীনে সম্মিলিত বিদ্রোহে (debauchery), ব্যভিচার এবং বহুগামিতাও অন্তর্ভুক্ত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে গণিকালয় বা গণিকাবৃত্তি আইনে অপরাধমূলক কিছু আইন ছিল। ১৯১৮ সালে চেম্বারলাইন-কাহন আইন (Chamberlain-Kahn Act) সরকারকে যৌন সংক্রামিত রোগ (এসটিডি) হওয়ার সন্দেহে যে-কোনো মহিলাকে সংহত করার ক্ষমতা দিয়েছে। একটি মেডিকেল পরীক্ষায় প্রয়োজন হত এবং একটি এসটিডি প্রকাশ করা হত। এই আবিষ্কার গণিকাবৃত্তি প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারে। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল মূলত মার্কিন সৈন্যদের মধ্যে ভেনেরিয়াল রোগের বিস্তার প্রতিরোধ করা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নিকটস্থ সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীর ক্যাম্পগুলিতে ভেনেরিয়াল রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধে স্টোরিভিল (Storyville) বন্ধ হয়ে যায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ঔপনিবেশিক ফিলিপাইনে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনী ‘আমেরিকান পরিকল্পনা’ নামে একটি গণিকাবৃত্তি ব্যবস্থাপনা প্রোগ্রাম গড়ে তোলে, যা সেনা ও সেনানিবাসের পাঁচ মাইলের মধ্যে কোনো গণিকাকে গ্রেফতার করতে সামরিক সক্ষম করে। সংক্রামিত হলে সুস্থ না-হওয়া পর্যন্ত একজন গণিকাকে হাসপাতালে বা ফার্ম উপনিবেশে (Farm Colony) দণ্ডিত করা যেতে পারে। ন্যাশনাল ভেনেরিয়াল ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যাক্ট’, যা ১ জুলাই, ১৯৩৮ কার্যকর হয়েছিল, ভেনেরিয়াল রোগগুলির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করার জন্য ফেডারেল তহবিলের অনুমোদন করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে প্রবেশের পর এই আইনের অধীনে অনুমোদন দ্বিগুণ হয়। মে আইন ৩ (May Act,3) রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর দ্বারা কার্যকর হয়ে যায়। ১১ জুলাই, ১৯৪১ যুক্তরাষ্ট্রীয় সামরিক ক্যাম্প এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর আশেপাশে বাণিজ্যিক ভাইসকে (commercialized vice) দমন করার ক্ষমতা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারকে সশস্ত্র করে।
মে আইন, যা ১৯৪১ সালের জুন মাসে প্রণয়ন হয়েছিল। করেছিল সামরিক ঘাঁটির চারপাশে সীমিত অঞ্চলগুলিতে গণিকাবৃত্তি প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে। এটি যুদ্ধকালীন সময় প্রধানত কার্যকর করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও মার্কিন মিলিটারিদের মধ্যে যৌনশিক্ষা চালু ছিল। ১৯৪৪ সালে মন্টেন্সেন (Mortensen) বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের উদ্দেশ্য গণিকাবৃত্তি না-হওয়ার কারণে গণিকারা রাষ্ট্রীয় সীমান্ত জুড়ে ভ্রমণ করতে পারে বলে রায় দেয়। ১৯৬৭ সালে নিউইয়র্ক সিটি ম্যাসেজ পার্লারের জন্য লাইসেন্সের প্রয়োজনীয়তা বাতিল করে। কারণ প্রচুর ম্যাসেজ পার্লার সাক্ষাৎ গণিকালয় হয়ে ওঠেছিল। ১৯৭০ সালে নেভাদা গণিকালয় নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। ১৯৭১ সালে মসতং রাঞ্চ (Mustang Ranch) নেভাদায় প্রথম লাইসেন্স প্রাপ্ত গণিকালয় হয়ে ওঠে। অবশেষে রাষ্ট্রের মধ্যে ১৭টি গণিকালয় বৈধকরণ পরিচালিত হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে, মসতং রাঞ্চ (Mustang Ranch) নেভাদা সবচেয়ে বড় গণিকালয় হিসাবে জেগে ওঠে, অন্যান্য বৈধ নেভাদা গণিকালয়ের তুলনায় রাজস্ব সহ আরও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
১৯১৭ সালে নিউ অর্লিঙ্গ সরকার গণিকাবৃত্তি বন্ধ করে দিয়েছিল। ১৯১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি সানফ্রান্সিসকোতে একটি গণিকাবৃত্তিমূলক প্রচারণা জনসাধারণের সভাগুলোতে বিশাল জনতাকে আকর্ষণ করেছিল। এক সভায় ৭০০০ জন উপস্থিত ছিলেন, ২০,০০০ জনকে রুমের অভাবের জন্য বাইরে রাখা হয়েছিল। রেভেরেন্ড পল স্মিথ একটি কনফারেন্সে গণিকালয়ের মুখোমুখি হন। ৩০০ গণিকালয় সহনশীলতার জন্য একটি আবেদন করেছিলেন এবং ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন যে, তাঁরা দারিদ্র্যের কারণে গণিকাবৃত্তিতে বাধ্য হয়েছিলেন। স্মিথ যখন বললেন, তাঁরা সপ্তাহে ৮ থেকে ১০ ডলারে অন্য কাজ করবে। তখন মহিলারা হতাশার সঙ্গে হেসে উঠল, যা তাদের জনসাধারণের প্রতি সহানুভূতি হারিয়েছিল। এর পরপরই পুলিশ গণিকালয়ের প্রায় ২০০ টি বাড়ি বন্ধ করে দেয়।
১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে হেইডি ফ্লিস (Heidi Fleiss) আমেরিকার সেরা পরিচিত মালকিনদের (গণিকালয়ের) একজন হয়ে ওঠে। ২০ শতকের প্রথম দিকে ফোনের ব্যাপক ব্যবহারে কলগার্লদের উদ্ভব হয়। তাঁরা সম্ভাব্য গ্রাহকদের কাছে তাঁদের কার্ডে লেখা ফোন নম্বর দেয়। গণিকাবৃত্তির নতুন ট্রেন্ড ‘কলগার্ল’ হিসাবে ক্রমবর্ধমান ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ চর্চা হয়ে গেছে। ১৯৬০-এর দশকে যৌন-বাণিজ্য শ্রমিকদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। ১৯৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভনিরোধক ব্যবহারের জন্য প্রথম Oral Contraceptive Pill অনুমোদিত হয়। একটা সময় পর্যন্ত গর্ভাবস্থা প্রতিরোধে ‘পিল’ গণিকাবৃত্তিতে ব্যাপক সাহায্য করেছিল। ১৯৭১ সালে বিখ্যাত নিউ ইয়র্ক মালকিন জাভিয়ের হোল্যান্ডার (Xaviera Hollander) লিখেছেন “The Happy Hooker : My Own Story’ নামে একটি বই, যে বইটি তাঁর সতোর জন্য উল্লেখযোগ্য ছিল এবং যৌন সম্পর্কে ইতিবাচক লেখার প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। জাভিয়ের হোল্যান্ডারের প্রথম দিকের অগ্রদূত (১৯২০-৩০) গণিকালয়ের একাধারে মালকিন ও লেখক পোলি অ্যাডলার (Polly Adler) ছিলেন, যিনি ঘরে বসে বইটি A House is not a Home’ ছিল। পরে A House is not a Home’ নামে একটি চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে ‘Sex worker’ শব্দটি “Scarlot Harlot’ হিসাবে পরিচিত হল।
(৬) দক্ষিণ কোরিয়া : দক্ষিণ কোরিয়ার গণিকাবৃত্তি অবৈধ। কিন্তু কোরিয়ার ‘Women’s Development Institute’ মতে, ২০০৭ সালে কোরিয়াতে ১৪ ট্রিলিয়ন দক্ষিণ কোরিয়ান যৌন-বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জন করেছে ১৩ বিলিয়ন ডলার (আনুমানিক), যা দেশটির মোট দেশীয় উৎপাদনের মোট ১.৬%। কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল কলেজ পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২৩.১% পুরুষ এবং ২.৬% নারীর গণিকাবৃত্তির মধ্য দিয়ে তাঁদের প্রথম যৌন অভিজ্ঞতা হয়েছে। একই সময়ের মধ্যে জনসংখ্যার গণিকাদের সংখ্যা ১৮%। অর্থাৎ ২,৬৯,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। ২০০৭ সালে যৌন-ব্যাবসার লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৯৪ মিলিয়ন ডলার, যা ২০০২ সালে ১৭০ মিলিয়ন ডলার থেকেও কম। আইনি নিষেধাজ্ঞা ও পুলিশ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও গণিকাবৃত্তি চলতে থাকে দক্ষিণ কোরিয়াতে, যখন যৌনকর্মীরা সক্রিয়ভাবে রাষ্ট্রের কার্যক্রমকে প্রতিরোধ করছে।
দক্ষিণ কোরিয়াতে মেয়েদের কুমারীত্ব হারানোর অভ্যাস ব্যাপক। কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল কলেজে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষরা প্রথমত গণিকাবৃত্তির অভিজ্ঞতার জন্য যথাক্রমে ২৩.১%, এবং মহিলাদের ১৩.৪% গড়ের জন্য ২.৩% শতাংশের কম প্রকাশ করেছে। কোরিয়ার আধুনিকীকরণের আগে কোনো গণিকা ছিল না। কিন্তু অভিজাত জমিদার শ্রেণিদের জন্য নারীদের একটি জাতি যৌনশ্রম পালন করত। আধুনিকীকরণে কোরিয়ান জাতিব্যবস্থা পুরোপুরি নির্মূল হয়ে যায়। ১৮৭৬ সালে কূটনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে দেশটি প্রথমে তাঁদের বন্দরটি খুলতে শুরু করে। কোরিয়াতে প্রথম গণিকাদের জন্য গণিকালয় শুরু হয়। ১৯৬০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত মার্কিন ক্যাম্প শহরে গণিকাবৃত্তি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলির বাইরে (উদাহরণস্বরূপ ক্যাম্প ক্যাসি এবং ক্যাম্প স্ট্যানলি) লক্ষ করা যায়। কোরীয় সরকার ও মার্কিন সামরিক বাহিনীর মধ্যে আলোচনার ফলে এটি মার্কিন সেনা মোতায়েনের ক্যাম্প শহরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের মধ্যে গণিকালয় জড়িত ছিল। Western Princess’ নামে পরিচিত এক গণিকা সরকার নিবন্ধিত হয় এবং সমস্ত গণিকাকেই মেডিকেল সার্টিফিকেট বহন প্রয়োজনয়ীতার কথা জানান। মার্কিন সামরিক পুলিশ এই মার্কিন ক্যাম্প শহরে গণিকালয় অঞ্চলের নিরাপত্তা প্রদান করে এবং যৌন-সম্পর্কিত রোগের মহামারি প্রতিরোধে অসুস্থ বলে বিবেচিত গণিকাদের আটক করতে থাকে। এই সরকারের অতীত প্রেরণা ছিল আমেরিকায সামরিক, উত্তর কোরিয়া থেকে দক্ষিণ কোরিয়া রক্ষা—যা ছেড়ে চলে যেতে হবে। যদিও মার্কিন কর্মকর্তারা জনসাধারণের গণিকাবৃত্তিকে নিন্দা প্রকাশ করেছিলেন, তবে তাঁরা এটিকে প্রতিরোধ করার জন্য সামান্য পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করে। কিছু স্থানীয় নাগরিক পরামর্শ দেয় যে, মার্কিন সেনা কর্তৃপক্ষ সৈনিকদের বাণিজ্যিক যৌন পরিসেবাগুলি পছন্দ করে।
২০০৩ সালে কোরিয়ান মন্ত্রণালয়ের জেন্ডার ইকুইলিটি ঘোষণা করে যে, ২,৬০,০০০ নারী গণিকাবৃত্তির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। অর্থাৎ ২৫ জন কোরিয়ান মহিলাদের মধ্যে ১ জন যৌনপেশায় জড়িত। ‘Korea Women’s Development Institute’ প্রস্তাব করেছে যে, গণিকাবৃত্তি শিল্পে ৫,১৪,০০০ থেকে ১.২ মিলিয়ন কোরিয়ান নারী অংশগ্রহণ করে। উপরন্তু ‘Korean Institute of Criminology’-এর রিপোর্টে দেখা গেছে যে, ২০% পুরুষ প্রতি মাসে কমপক্ষে ৪ বার যৌনসঙ্গমের জন্য অর্থ প্রদান করে এবং দৈনিক ৩,৫৮,০০০ জন কোরিয়ান নারী গণিকাবৃত্তি করে।
২০০৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার ‘Special Law on Sex Trade 2004’ নামে একটি বিশেষ গণিকাবৃত্তি বিরোধী আইন প্রণয়ন করে শরীর কেনাবেচা তথআ গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ করে দেয়। এরপর দ্রুত আইন বাতিলের দাবিতে ২,৫০০ জনেরও বেশি যৌনকর্মীরা রাস্তার বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেছিল যে, এই আইন তাঁদের জীবিকা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। ২০০৬ সালে জেন্ডার ইকুলিটি মন্ত্রণালয় গণিকাবৃত্তির চাহিদা মেটাতে একটি প্রচেষ্টা শুরু করে দেয়। অফিসাররা পরে যৌনকর্মীদের বেতন দেওয়ার অঙ্গীকার করে। এই নীতির সপক্ষে ব্যক্তিরা দাবি করে যে, তাঁরা সংস্কৃতির অবসান করতে চায়, যাতে লোকজন মাতাল হয় এবং যৌনতা কিনতে যায়। ২০০৭ সালে সরকার ঘোষণা করেছিল যে, কোরিয়ানরা যৌনতা অবৈধভাবে বিক্রি করবে, সেইসঙ্গে কোরিয়ান মহিলারা যৌনতা বিক্রি করতে বিদেশেও যাবেন। আদালতগুলি ৩৫,০০০ ক্লায়েন্টের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। ২০০৩ সালে যাঁরা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিল, তাঁদের তুলনায় ২.৫ গুণ বেশি।
২০০৪ সালে বিশেষ আইন প্রণয়ন করার পর রেড লাইট এরিয়াতে একটি কঠোর ব্যবস্থা (Crackdown) ছিল। যদিও ওই এলাকার বেশিরভাগ গণিকালয়গুলি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল। তেমনি কঠোর ব্যবস্থাটি যত তাড়াতাড়ি ঘটেছিল, ততই গণিকাবৃত্তি আরও আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে ওঠেছিল এবং কম দাম এবং অতিরিক্ত পরিসেবাদি নিয়ে আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক ব্যাবসা হয়ে ওঠেছিল। দক্ষিণ কোরিয়াতে রেড লাইট এরিয়াগুলিকে অ্যামস্টারডাম ও জার্মানির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার চারটি প্রধান গণিকাপল্লি হল—চেওনিঙ্গানি ৫৮৮ (Cheongnyangni 588), ইয়ংসান স্টেশন (Yongsan Station), সিওলের মিয়া-রাই (Mia-ri in Seoul) এবং ডাইগুয়ের জগালমাদং (Jagalmadang in Daegu)।
জেন্ডার ইকুইলিটি ও পরিবার মন্ত্রণালয় ২০১২ সালের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ৩৫% পালিয়ে যাওয়া যুবকদের গণিকাবৃত্তির কাছে উন্মুক্ত করা হয়েছে ক্রেতা অথবা গণিকা হিসাবে। ইন্টারনেট চ্যাটের মাধ্যমে যৌনতা বিক্রি করে এমন সম্ভ্রান্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে রিপোর্ট করা হয়েছে। গণিকাবৃত্তির নির্মূলকরণের জন্য ‘United Voice’ অনুসারে, কম বয়সিদের গণিকাবৃত্তিকে ধর্ষণের মতো অপরাধ এবং সিফিলিসের মতো রোগের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে বলে মনে হয়। ‘United Voice’ দ্বারা সার্ভেতে জানা যায়, অর্ধেকের বেশি মেয়েরা প্রায়শই পূর্ববর্তী স্বামী, সমাজ বা পরিবার থেকে বিতাড়িত এবং দালাল দ্বারা ব্ল্যাকমেইল কারণে যৌন বাণিজ্যে আসে এবং বাকি অর্ধেক রাতারাতি ধনী হওয়ার লালসা নিয়ে স্বেচ্ছায় আসে।
যদিও ২০০৪ সালের হিসাবে সরকার মানব পাচার নিষিদ্ধ করেছিল এবং গণিকাবৃত্তির জন্য জরিমানা বৃদ্ধি করেছিল। যৌন-বাণিজ্য ও তাঁর ক্ষতিগ্রস্তদের সুরক্ষা রোধে ২০০৪ সালের আইন পাস করা হয়েছে। পাচারকারীদের দমন করার মতো শাস্তি, ক্ষতিগ্রস্তদের নির্বাসনের অবসান এবং ভিকটিমদের জন্য আশ্রয়স্থল প্রতিষ্ঠা করাই ছিল উদ্দেশ্য। ২০০৫ সাল নাগাদ মানব পাচারের জন্য ১৪৪ জন মানুষ জেলে ছিলেন। ২০০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন অভিবাসন কর্মকর্তা স্বীকার করেছিলেন যে, “কোরিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিয়োগকারী, দালাল, মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে একটি অত্যন্ত সংগঠিত যুক্তিসংগত নেটওয়ার্ক আছে।” লস এঞ্জেলেস পুলিশের একজন মুখপাত্র জানান, গণিকাবৃত্তির জন্য মাসে যে ৭০ থেকে ৮০ জন গ্রেফতার হয়, তার প্রায় ৯০ শতাংশই কোরিয়ান নারী। লস এঞ্জেলেস পুলিশ অনুমান করে যে, ৮০০০ কোরিয়ান গণিকা ওই শহর ও উপকূলে কাজ করছে। ২০১২ সালেও দেখা যাচ্ছে সরকার যৌন পাচারের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রেখেছে। বহুবিধ পাচারমূলক সচেতনতা প্রচারণা পরিচালনা করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়া হল মানব পাচারের জন্য একটি উৎস এবং গন্তব্য দেশ (destination country)। অল্প বয়সি মেয়েদের কোরিয়ার যাওয়ার জন্য সংস্থাগুলি উচ্চহারে বেতন দিয়ে থাকে এবং তাঁরা সেখানে পৌঁছানোর পর তাঁদেরকে যৌনদাসী হিসাবে কাজ করার জন্য বাধ্য করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কোরিয়ার রেড লাইট এরিয়ায় নব্য রাশিয়ান মেয়েদের দেখা যায়। তাঁরা গ্রাহকদের বিনোদনের জন্য বার, স্ট্রিপ ক্লাব এবং কফি শপে অপেক্ষা করে। ২০০০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ ২০০১ সালের মধ্যে প্রায় ৬,০০০ রাশিয়ান নারী বুশান বন্দর এবং জিম্পের মাধ্যমে কোরিয়াতে প্রবেশ করেছিল। ২০০০ সালে ৩,০৬৪ রাশিয়ান নারী গণিকাবৃত্তির জন্যে দক্ষিণ কোরিয়াতে প্রবেশ করেছিল।
(৭) ভারত ভারতের গণিকাবৃত্তি নিয়ে আগের অধ্যায়গুলিতে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তাই এই অধ্যায়ে পুনরাবৃত্তি করব না। এখানে সেইসব বিষয়ই আলোচনা করব যা আগের অধ্যায়গুলিতে আলোচিত হয়নি। গণিকাবৃত্তি মূলত অর্থের বিনিময়ে যৌনসেবা) ভারতে আংশিক বৈধ। তবে পাবলিক প্লেসে গণিকাবৃত্তি, গণিকালয়ে গণিকাবৃত্তি, হোটেলে গণিকাবৃত্তি, শিশু গণিকাবৃত্তি, দালাল এবং পাচার অবৈধ। মুম্বাই, দিল্লি এবং কলকাতা সহ বেশ কয়েকটি গণিকালয় অবৈধভাবে ভারতীয় শহরগুলিতে পরিচালনা করে। UNAIDS অনুমান করে দেশে ৬,৫৭,৮২৯ গণিকা আছে। জরিপ প্রদর্শন করেছে যে, গণিকাবৃত্তিতে আনুমানিক ১.২ মিলিয়ন শিশুও জড়িত আছে।
বৈধ গণিকাবৃত্তি নিজেই অস্পষ্ট। যৌনকর্মীদের পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রাথমিক আইন হল ১৯৫৬ আইনটি, যা অনৈতিক ট্রাফিক (দমন) আইন (SITA) নামে পরিচিত। এই আইনের মতে, গণিকারা ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের ব্যাবসা অনুশীলন করতে পারে, কিন্তু আইনিভাবে গ্রাহকদের কাছে অনুরোধ করতে পারে না। তবে বিবিসি একটি নিবন্ধে উল্লেখ করে যে, ভারতে গণিকাবৃত্তি অবৈধ। ভারতীয় আইনটি ‘গণিকাবৃত্তি’ হিসাবে নিজের যৌনসেবা বিক্রি করার অভ্যাসকে বোঝায় না। ক্লায়েন্টদের প্রকাশ্যে যৌন কার্যকলাপ (sexual activity) জন্য শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। সংগঠিত গণিকাবৃত্তি অবৈধ। যতক্ষণ পর্যন্ত এটি স্বতন্ত্রভাবে এবং স্বেচ্ছায় করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত একজন নারী (ভারতীয় গণিকাবৃত্তি আইনের ধারা ৩৭৭-এর অধীনে পুরুষের গণিকাবৃত্তি ভারতের কোনো আইনের ক্ষেত্রে স্বীকৃত নয়, এমনকি সম্মিলিতভাবে মলদ্বারে যৌন হয়রানিও অবৈধ) তাঁর শারীরিক বেনিফিটের বিনিময়ে তাঁর শরীর ব্যবহার করতে পারে। এমনকি পাবলিক প্লেসের ২০০ গজের মধ্যে তাঁর পেশা বহন করতে নিষিদ্ধ করা হয়।
ইন্ডিয়ান পেনাল কোড (আইপিসি), যা SITA-কে পূর্বাভাস দেয়, তা প্রায়ই ‘জনসাধারণের অসদাচরণ’ (Public Indecency) বা জনসাধারণের বিরক্তিকর’ (Public Nuisance) হিসাবে যৌন অপরাধীদের চার্জ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। ১৯৮৬ সালে পুরোনো আইনটি অনৈতিক ট্রাফিক (প্রতিরোধ) আইন বা আইটিপিএ হিসাবে সংশোধন করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক ক্লায়েন্টদের অপরাধী করার জন্য এটি সংশোধন করার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করা হয়েছে। কলকাতায় নারী যৌনকর্মীদের জীবনযাত্রার উন্নতিতে ইতিবাচক বিকাশে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমা সংস্থা ২৫০ ব্যক্তিকে জীবনবিমা সরবরাহ করেছে। গত কয়েক বছরে ভারতে যৌনকর্মীদের এবং তাঁদের সন্তানদের মধ্যস্থতাকারীদের দ্বারা এবং এইচআইভি / এইডসের হুমকি বেড়ে যাওয়ার কারণে গণিকাবৃত্তি বৈধকরণের লক্ষ্যে ভারতে ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি দেখা গেছে। অনৈতিক ট্রাফিক (প্রতিরোধ) আইন বা আইটিপিএ ১৯৮৬ সালে জাতিসংঘের ঘোষিত চুক্তির ফলে ১৯৫৬ সালে নিউইয়র্কে পাচার দমনের দায়ে স্বাক্ষরিত হওয়ার এক আইন সংশোধনের ১৯৮৬ সালের সংশোধনী। অল ইন্ডিয়া সাপ্রেশন অব অনৈতিক ট্রাফিক অ্যাক্ট (All India Suppression of Immoral Traffic Act ) নামে এই আইনটি বর্তমান আইন সংশোধন করা হয়। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল যৌনকর্মের বিভিন্ন দিকগুলি ধীরে ধীরে ফৌজদারি করে ভারতে গণিকাবৃত্তি সীমিত করার এবং অবশেষে গণিকাবৃত্তির অবসান। নিম্নরূপ PITA এর প্রধান পয়েন্টগুলি হল—গণিকার গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। একইভাবে কলগার্লরা পাবলিকলি ফোন নম্বর প্রকাশ করতে পারবেন না (জরিমানা ৬ মাস পর্যন্ত)। কোনো যৌনকর্মীকে কোনো পাবলিক জায়গায় গণিকাবৃত্তির জন্য শাস্তিপ্রদান করা হয়। (জরিমানা ৩ মাসের কারাদণ্ড)
২০০ গজের মধ্যে একটি যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌনকর্ম জড়ালে চার্জ করা যেতে পারে (৩ মাসের কারাদণ্ড )। যৌনকর্মী ১৮ বছর বয়সের নীচে হলে ক্লায়েন্টকে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে শাস্তি ৭ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড। বাবু বা দালাল বা পোষ্য প্রেমিক, যাঁরা গণিকাবৃত্তির মাধ্যমে উপার্জন করে, তা দণ্ডনীয় অপরাধ। কোন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ যদি গণিকার সঙ্গে বসবাস করে এবং তা প্রমাণিত হয়, তবে তাকেও দোষী মনে করা হয়। শাস্তি জরিমানা সহ ২ বছরের কারাদণ্ড। বড়িওয়ালি এবং গণিকালয়-রক্ষীদের বিরুদ্ধে মামলা করা যেতে পারে। ভারতে গণিকালয় চালানো অবৈধ। প্রথম অপরাধের জন্য জরিমানা সহ ১ থেকে ৩ বছর কারাদণ্ড। কেউ যদি যৌন-শোষণের উদ্দেশ্যে আটক করে, তাহলে মামলা দায়ের করতে পারে। শাস্তি ৭ বছরের বেশি সময় কারাবাস। হোটেলে গণিকাবৃত্তি চালানোও একটি ফৌজদারি অপরাধ।
২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, আইন সংশোধন বিবেচনা করার জন্য গণিকাবৃত্তি আইনি করা উচিত এবং একটি প্যানেল গঠন করা উচিত। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের মতে, মর্যাদা সহকারে বসবাসের অধিকার’ একটি সাংবিধানিক অধিকার এবং শ্রমকর্মীদের মর্যাদা সহকারে কাজ করার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির শর্ত সম্পর্কিত একটি আদেশ জারি করে। আদালতে কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে পুনর্বাসনের জন্য আগ্রহী দেশে যৌনকর্মীদের সংখ্যা নির্ধারণের জন্য একটি জরিপ পরিচালনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে ২০১২ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টের কাছে একটি আপিল করেছিল যে যৌনকর্মীদের সাংবিধানিক মর্যাদা সহকারে বসবাসের অধিকার’ অনুযায়ী তাদের ব্যাবসা চালানোর অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। সরকারি পরামর্শে বলা হয়েছে যে, আদালত কর্তৃক এ ধরনের কোনো অনুমোদন আইটিপিএর অত্যাবশ্যক হবে, যা সম্পূর্ণরূপে গণিকাবৃত্তিকে নিষিদ্ধ করে। বিরোধিতাকারী আইনজীবী এই আইনটি শুধুমাত্র গণিকাবৃত্তি কার্যক্রম এবং পিম্পসের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করেছিল। সুপ্রিম কোর্টের এই আবেদনটি পর্যবেক্ষণ করার জন্য রাজি হয়েছে।
একনজরে ভারতীয় গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে আইন :
যৌনকর্মী : কোনো গণিকা যদি প্রলুব্ধ করে বা আহ্বান জানায় তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হবে। একইভাবে, কলগার্লরাও তাঁদের ফোন নম্বর জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারবে না। (জরিমানাসহ ৬ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড, ৮ নং পয়েন্ট)।
প্রকাশ্য স্থান অথবা ‘বিজ্ঞাপিত স্থানের’ কাছাকাছি গণিকাবৃত্তির জন্যও যৌনকর্মীদের শাস্তি হবে (জরিমানাসহ তিনমাস পর্যন্ত কারাদণ্ড, পয়েন্ট ৭),
ক্লায়েন্ট : গণিকাদের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার জন্য একজন ক্লায়েন্ট অপরাধী হিসাবে গণ্য হবে এবং সে যদি কোনো প্রকাশ্য স্থানের কিংবা বিজ্ঞাপিত স্থানের’ ২০০ গজের মধ্যে কোনো যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌনসংসর্গে লিপ্ত থাকে তবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে। (তিনমাস পর্যন্ত কারাদণ্ড, ৭ নং পয়েন্ট)। যৌনকর্মী যদি ১৮ বছরের নীচে হয় তাহলেও ক্লায়েন্টদের শাস্তি দেওয়া হবে (৭ থেকে ১০ পর্যন্ত কারাদণ্ড, যদি গণিকা শিশু অথবা নাবালিকা হয়ে থাকে)।
কুটনি বা বাবু : গণিকাদের আয়ের অর্থে জীবনযাপন করা কুটনি বা বাবু বা লিভ-ইন প্রেমিকেরাও অপরাধী। গণিকাদের সঙ্গে বসবাস করা যে-কোনো প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকেই অপরাধী হিসাবে ধরে নেওয়া হবে, যদি না সে নিজেকে দোষমুক্ত হিসাবে দেখাতে না পারে। (জরিমানাসহ ২ বছরের জেল, ৪ নং পয়েন্ট)।
গণিকালয় : গণিকালয়ের মালিক এবং এর রক্ষকের দণ্ডাজ্ঞা হতে পারে; গণিকালয় চালানো অপরাধ। (প্রথম অপরাধের জন্য জরিমানাসহ ১ থেকে ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে)। যৌন শোষণ করার জন্য কাউকে গণিকালয়ে আটক করে রাখলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। (৭ বছরের অধিক কারাদণ্ড, পয়েন্ট ৬)। হোটেলে গণিকাবৃত্তিও একটি আইনত অপরাধ।
জোগান দেওয়া এবং পাচার করা : কোনো ব্যক্তি যদি কুটনিগিরি করে অথবা করার চেষ্টা করে তবে উক্ত ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। এছাড়াও কোনো ব্যক্তি যদি কাউকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায় (মানব পাচার) তবে তাঁরও একই শাস্তি হবে। (প্রথম অপরাধের জন্য জরিমানাসহ ৭ বছরের কারাদণ্ড এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে আজীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে; পয়েন্ট ৫বি)।
উদ্ধারকৃত মহিলা : সাহায্যপ্রার্থী যে-কোনো যৌনকর্মীকে উদ্ধার করতে এবং নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে তাকে পুনর্বাসন করাতে সরকার আইনত বাধ্য থাকবে। (পয়েন্ট ২১)।
এই আইন মোতাবেক প্রকাশ্য স্থানগুলি হল–সর্বসাধারণের ধর্মীয় পূজাঅর্চনার স্থান, শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান, ছাত্রাবাস/হস্টেল, হাসপাতাল ইত্যাদি। PITA আইন মোতাবেক রাজ্য সরকার যেসব স্থানগুলিকে গণিকাবৃত্তি মুক্ত ঘোষণা করেছে সেগুলিকে বলা হবে ‘বিজ্ঞাপিত স্থান। এই আইন অনুসারে গণিকালয় হল এমনই একটি স্থান, যেখানে দুই অথবা ততোধিক যৌনকর্মী রয়েছে (২)। গণিকাবৃত্তি এমনিতে কোনো অপরাধ নয়, কিন্তু সলিসিটিং, গণিকালয়, কুটনি ইত্যাদি হল বেআইনি।
উন্নয়ন সংস্থা ‘সংলাপ’-এর বেশিরভাগ গবেষণা ইঙ্গিত করে যে, ভারতে বেশিরভাগ যৌনকর্মী নিজেদের বা তাঁদের সন্তানদের ভরণপোষণ করার জন্য গণিকা হিসাবে কাজ করেন। বেশিরভাগই মেয়েরা এই পেশাটি পছন্দ করেন না। কিন্তু বিবাহ বহির্ভূত, বিবাহবিচ্ছেদ এবং তাঁদের পরিবারের দ্বারা তাঁদের বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর এই পেশায় চলে আসে। যৌনকর্মীদের সন্তানরাও এই ধরনের কাজেও জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অল বেঙ্গল উইমেন ইউনিয়নের ১৯৮৮ সালে একটি সার্ভে রিপোর্ট বলছে, কলকাতায় ১৬০ জন যৌনকর্মীদের মধ্যে একটি উপযুপরি নমুনা (random sample) সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাতে দেখা গেছে—তাদের মধ্যে ২৩ জন দাবি করেছেন যে, তাঁরা তাঁদের এ পেশা নিজেরাই পছন্দ করে নিয়েছেন, বাকি ১৩৭ জন নারী যৌন-বাণিজ্য এজেন্টের মাধ্যমে এসেছে।
১৯৯৬ সালে মুম্বাইয়ের এক গণিকালয়ে বিশাল চিরুনি তল্লাসি করে ৪৮৪ জন গণিকার মধ্যে ৪০% নারীকে উদ্ধার করা হয়েছিল, যাঁদের নেপাল থেকে আনা হয়েছিল। ১৯৯০ সালে ভারতে এক গণনা দেখা গেছে যে, গণিকালয়গুলিতে ২,০০,০০০ নেপালি মেয়ে ছিল, যাঁদের বয়স ১৪ বছরের নীচে।
ভারত একটি উৎস, গন্তব্য, এবং যৌন পাচারের শিকার নারী এবং শিশুদের জন্য সংযোগ দেশ। ভারতের বেশিরভাগ পাচারের সমস্যা অভ্যন্তরীণ এবং সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত সামাজিক স্তরের—নিম্নতম বর্ণবাদী দলিত, উপজাতি সম্প্রদায়, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নারী ও মেয়েশিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবণতা। হাজার হাজার অননুমোদিত কাজ প্রদানকারী সংস্থাগুলি (Placement Agencies) মিথ্যা প্রতিশ্রুতির দিয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের এবং শিশুদের পাচার করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, লক্ষ লক্ষ নারী ও শিশু ভারতে যৌন হয়রানির শিকার হয়। প্রথাগত রেড লাইট এরিয়ার পাশাপাশি, ছোটো হোটেল, যানবাহন এবং ব্যক্তিগত বাসস্থানগুলিতে নারী ও শিশুদের পাচার করা হয়।
ভারতে ৭ টি স্থান, যেখানে গণিকালয়গুলি একটি ঐতিহ্য। নারী তাঁদের জীবিকার জন্য এই পেশাকে সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে। এটি খুব স্পষ্ট যে, কেন গণিকাবৃত্তি (অর্থের জন্য যৌনসেবা বিনিময়) বিশ্বের প্রাচীনতম পেশা বলে মনে করা হয়? প্রথম দিকের সময়ে, সৌজন্যে সাম্রাজ্যগুলিতে রাজকীয় অবস্থা উপভোগ করত, যা আজকে ভারতে একটি খুব দুর্বল অবস্থা থেকে নেমে এসেছে। ভারতে গণিকাবৃত্তি অবৈধ হলেও, আপনি কি জানেন যে দেশে এমন জায়গা রয়েছে যেখানে আজও নারী তাঁদের জীবিকার জন্য এটির উপর নির্ভরশীল? ভারতের কয়েকটি বিখ্যাত গণিকালয়–
আমাদের দেশে একাধিক জায়গা আছে যেখানে এই কাজ এবং সেই সমস্ত জায়গাকেই রেড লাইট এরিয়া বা রেড লাইট স্ট্রিট বা রেড লাইট ডিস্ট্রিক্ট বলা হয়। এরকমই কুখ্যাত দশটি নিষিদ্ধ এলাকার কথা বলব যেগুলি আমাদের দেশের বিভিন্ন বড়ো শহরে আছে।
(১) মীরাগঞ্জ, উত্তরপ্রদেশ : উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদে আছে এই রেড লাইট এলাকা মীরাগঞ্জ। যৌন আনন্দের জন্য এখানে অত্যন্ত সুন্দরী গণিকা পাওয়া যায়। কিন্তু এই মীরাগঞ্জ জোরপূর্বক গণিকাবৃত্তি এবং অবৈধ পাচারের জন্য বিখ্যাত। এখানে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং নেপাল ও বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশ থেকেও গণিকা আছে।
(২) চতুর্ভুজস্থান, মুজাফফরপুর : এটি একটি মোগলীয় ধরনের রেড লাইট এরিয়া। এলাকাটি মোগলদের দ্বারা শুরু হয় এবং এটি ২৫০০ জন যৌনকর্মীর একটি বাসস্থান। এখানকার প্রতিটি গণিকালয়ে একজন ম্যাডাম বা মাসি থাকে, যে ওই নির্দিষ্ট গণিকালয়ের সর্বময় কত্রী।
(৩) শিবদাসপুর, উত্তরপ্রদেশ : বারাণসী স্টেশন থেকে দশ মিনিটের পথ শিবদাসপুর। এটা একটা যথেষ্ট ঘন। জনবসতিপূর্ণ এলাকা। এটিও একটি মোগল আমলের নিষিদ্ধ এলাকা। অনেক আগে এটি শুরু হয়েছিল। এখানে খুব বড়ো আকারের কোনো গণিকালয় নেই, কিন্তু ছোটো বড়ো অনেক ঘর আছে যেখানে চলে গণিকাবৃত্তির কাজ। প্রাচীনকাল থেকেই বারাণসী গণিকাবৃত্তির জন্য বিখ্যাত এবং মার্জিত ড্যানুসাস, যা আমরা এটিকে ‘তাওয়াইফ সংস্কৃতি’ বলে অভিহিত করি। কিছু বলিউড চলচ্চিত্রও এই সংস্কৃতির গভীর দিক দেখিয়েছে। কিন্তু একইরকম পরিস্থিতি এখনও অব্যাহত রয়েছে এবং যা আরও বেশি ক্ষতিকর।
(৪) ইটওয়ারি, মহারাষ্ট্র : নাগপুরের গঙ্গা-যমুনার সংযোগস্থলে অবস্থিত ইটওয়ারি। এখানে অনেক যুবতী মেয়ে গণিকাবৃত্তির কাজ করে থাকে। এখানে শুধুমাত্র অবৈধ গণিকাবৃত্তিই চলে না, সঙ্গে আরও অন্যান্য দুষ্কর্ম চলে এবং স্মাগলিংয়ের ব্যাবসাও চলে।
(৫) বুধওয়ার পেঠ, মহারাষ্ট্র : পাঁচ হাজারের বেশি যৌনকর্মী আছে বুধওয়ার পেঠে এবং একাধিক গণিকালয় আছে। অনেক লোক এখানে যান এখানকার আকর্ষণে। এছাড়াও এই এলাকাটি ইলেকট্রনিক্স দ্রব্যাদির বাজার এবং অজস্র বইয়ের দোকানের জন্য বিখ্যাত।
(৬) কামাথিপুরা, মহারাষ্ট্র : মুম্বাইয়ের কামাথিপুরা জায়গাটি তার নামের জন্য এখন বেশি পরিচিত হয়। এখানকার প্রধান আকর্ষণ হল, এখানকার গণিকালয়গুলি এবং এই জায়গাটিকে এখন মুম্বাইয়ের রেড স্ট্রিট বলা হয়। এটি এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম রেড লাইট এরিয়া। এই এলাকাটি আর্থিক রাজধানীতে সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গাগুলির মধ্যে একটি, যেখানে অপরাধের হার কখনও নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
(৭) জিবি বোড়, দিল্লি : জিবি, রোড বা গারস্টিন বাস্তিয়ন রোড দিল্লির একটি অত্যন্ত জনবহুল জায়গা এবং এখানে আছে একাধিক দোকান। এখানে রাস্তার দু-পাশে অনেক পুরনো উঁচু উঁচু বিল্ডিং দেখতে পাওয়া যায়। এটি রাজধানীর আর-একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র, যেখানে পুরোনো মাল্টি-স্টোরেড বিল্ডিং দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে নীচের তলায় নিয়মিত দোকান হিসাবে কাজ করে এবং বাকি ফ্লোরগুলি গণিকালয় হিসাবে কাজ করে। এখানে গোটা দেশের মেয়েদের এনে বিক্রি করা অন্যতম বড় ব্যাবসা। আপনি যদি দিল্লিতে থাকেন, তবে আপনার যৌনকর্ম ব্যতীত এই স্থান সম্পর্কে সচেতন হওয়ার কথা নয়। এই এলাকাটি যেখানে সমগ্র দেশ থেকে মেয়েশিশুদের এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিক্রি করা হয়।
(৮) মুভাত্তুপুলা, কেরালা : ভারতের অন্যতম আধুনিক গণিকালয়। এখানে ক্লায়েন্টরা অনলাইনে বুকিং করেও আসতে পারেন আনন্দ করার জন্য। তাছাড়াও এখানে ফোনে বুকিংয়ের সুবিধাও আছে বিভিন্ন এজেন্ট মারফত। এই এলাকায় যৌনকর্মীরা প্রধানত কেরলের মেয়ে এবং শ্রীলঙ্কারও কিছু মেয়ে আছে এখানে।
(৯) রেড লাইট জেলা, জম্মু : জম্মুতে আছে রেড লাইট অঞ্চল। যদিও জম্মু বিখ্যাত এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য। কিন্তু অনেক পুতুলের মতো সুন্দরী মেয়েরা আছে এখানে, যাঁরা যৌনকর্মীর কাজ করে। এখানকার বেশিরভাগ মেয়েকেই জোর করে করানো হয় এই কাজ।
(১০) ওয়াডিয়া, গুজরাট : প্রাচীনকালে থেকেই এই এলাকায় নারী পতিতাবৃত্তির মাধ্যমে তাঁদের পরিবারকে সমর্থন করার জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে,। যদিও পুরুষরা আসলে মহিলাদের জন্য গ্রাহকদের সন্ধান করে। সঠিক ভাষায়, এই শহরে পুরুষরা পিম্পস এবং শতাব্দী প্রাচীন সংস্কৃতি বর্তমান। যার কারণে এটি শেষ করা কঠিন। শিক্ষা ড্রাইভ এবং গণ বিবাহের একটি ছোটো প্রভাব ফেলেছে বটে, কিন্তু বড়ো অনুশীলন অবৈধভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে।
(১১) উত্তরপুর, মধ্যপ্রদেশ : উত্তরপ্রদেশের একটি ছোট্ট গ্রাম নেক্র, এখন ৪০০ বছর ধরে নেক্রর গণিকাবৃত্তি একটি ঐতিহ্য আছে। রাজধানীর লখনউ শহর থেকে আনুমানিক দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। এই গ্রামের প্রায় ৫,০০০ নারী তাঁদের উপার্জনের জন্য এই গণিকাবৃত্তি উপর মূলত নির্ভর করে। এই গ্রামের বাচ্চারা, সাধারণত তাঁদের মায়েদের সঙ্গে বসবাস করে তাঁদের পিতা কে কেউ জানে না।
(১০) সোনাগাছি, পশ্চিমবঙ্গ : এশিয়ার সবচেয়ে বড়ো গণিকালয় কলকাতার সোনাগাছি। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, এখানকার গণিকালয় নির্মাণ করেন ব্রিটিশরা, তাঁদের সেনাবাহিনীর জন্য। কারণ তাঁদের স্ত্রীরা তখন ইংল্যান্ডে থাকত। বর্তমানে প্রায় ১১ হাজারের বেশি যৌনকর্মী আছে এখানে। বলা হয় যে, ইংরেজরা জোরপূর্বক বিধবা মহিলাদের নিয়ে আসত এখানে। এখানে একাধিক ছোটো বড়ো বিল্ডিং রয়েছে যেখানে চলে এই কাজ। না, এই ঐতিহ্যবাহী সোনাগাছি নিয়ে আলোচনা এতটুকুতেই শেষ করা যায় না। আলাদা একটি অধ্যায়ে বিস্তারিত লেখার সুযোগ আছে এবং লিখব।
একটা ঘটনার উল্লেখ করে ভারতের গণিকাবৃত্তির আলোচনা শেষ করব। এমন একটা সম্প্রদায়ের মেয়েদের কথা বলব যেখানে এক সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের পরিবারে জন্ম নেওয়া সবচেয়ে বড়ড়া মেয়েকে গণিকাবৃত্তির দিকে ঠেলে দেয়। যেখানে দেশের বেশিরভাগ পরিবারের বাবা-মায়েরা মেয়ে সন্তানের চাইতে ছেলে সন্তানদের বেশি পছন্দ করে। সেখানে হিনা জন্মগ্রহণ করলে তাঁর বাবা-মা রীতিমত উৎসব উদযাপন করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত এই উদযাপনের পিছনে ছিল বিচিত্র একটি উদ্দেশ্য। হিনা ভারতের পশ্চাৎপদ সম্প্রদায়ের একজন সদস্য। এই সম্প্রদায়ে শত শত বছর ধরে এখন পর্যন্ত একটি প্রথা প্রচলিত আছে। যেখানে সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাঁদের পরিবারে জন্ম নেওয়া সবচেয়ে বড়ো মেয়েকে গণিকাবৃত্তির দিকে ঠেলে দেয়। আর এই গণিকাবৃত্তি শুরু হয় মেয়ের মাত্র ১০ থেকে ১২ বছর বয়সেই। পরিবারের পুরুষ সদস্য থেকে শুরু করে বাকি সবার জীবন ওইটুকু মেয়ের আয়ের উপরই নির্ভর করে। কোনো-কোনো ক্ষেত্রে মেয়েটির নিজের বাবা অথবা ভাই দালাল হিসাবে কাজ করে। যখন এই মেয়েটির বয়স হয়ে যায়, তখন তাঁর জায়গা দখল করে নেয় তাঁরই ছোটো বোন।
এভাবেই এই প্রথা সম্প্রদায়ের সবার গ্রহণযোগ্যতার উপর নির্ভর করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পালন হয়ে আসছে। এই সম্প্রদায়ে বিয়েটাও হয় ভিন্নভাবে। এখানে বিয়ে দেওয়ার সময় কনের পরিবার বরের পরিবারের কাছ থেকে বড়ো অংকের অর্থ দাবি করে। যেটাকে অনেকেই উল্টো যৌতুক হিসাবে আখ্যা দেন। হিনাকে জন্মের পর থেকে এই ধরনের জীবনের জন্য প্রস্তুত করা হয় এবং তারপরে খুব অল্প বয়সেই তাঁকে এই কাজে জোরপূর্বক ঠেলে দেওয়া হয়। বিবিসি হিন্দিকে তিনি বলেন, “আমাকে যখন এই পেশায় ঠেলে দেওয়া হয়। তখন আমার বয়স মাত্র ১৫ বছর। পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে আমাকে আমার মা ও দিদিমার দেখানো পথেই। চলতে হয়েছে। ১৮ বছর বয়সে আমি প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার সঙ্গে কত অন্যায় হয়েছে এবং ভীষণ রাগও হয়েছিল তখন। কিন্তু এ ছাড়া আমার আর কিই-বা করার ছিল? যদি আমি এভাবে উপার্জন না করতাম তাহলে আমার পরিবার কীভাবে বাঁচত?” প্রতিদিন তাঁর কাছে গ্রামীণ ধনী থেকে শুরু করে ট্রাক চালক পর্যন্ত একাধিক ক্লায়েন্ট আসত।
ভারতের বাচ্ছা সম্প্রদায়ের মানুষেরা সাধারণত ভীষণ দারিদ্রপীড়িত। পরিবারের জন্য উপার্জন এবং আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে তাঁরা নারী সদস্যদের উপর নির্ভর করে। পেশায় আসা এক-তৃতীয়াংশের বেশি মেয়ে বয়সে অনেক ছোটো। বাচ্ছা সম্প্রদায় একসময় যাযাবর উপজাতি গোষ্ঠী ছিল। পরে তাঁরা মধ্যপ্রদেশের তিনটি জেলায় ছড়িয়ে যায়। এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা বেশিরভাগ গ্রামীণ এলাকা বা মহাসড়কের পাশে থাকে, যেখানে ট্রাক ড্রাইভাররা বিরতি নিয়ে থাকে। অল্প বয়সি মেয়েরা, যাঁরা কিনা স্থানীয়ভাবে খেলোয়াড় হিসাবে পরিচিত। তাঁরা দলবেঁধে, না-হলে একা একাই ক্লায়েন্টদের অনুরোধ করার জন্য অপেক্ষা করে। এছাড়া পথের দু-পাশে প্রায়শই ছোটো দোকানের মতো বুথ থাকে, সেখানে মেয়েটির দালাল হিসাবে তার ভাই না-হলে বাবা, ক্লায়েন্টকে আহ্বান জানায়। তাঁরা চালকদের সঙ্গে একটি চুক্তি করে, যা সাধারণত ক্লায়েন্ট প্রতি ভারতীয় মুদ্রায় ১০০ থেকে ২০০ হয়ে থাকে। স্থানীয়দের মতে, একটি কুমারী মেয়ের জন্য সর্বোচ্চ দাম পাওয়া যায়। ক্লায়েন্ট প্রতি সেটা ৫০০০ রুপি বা ৭২ ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হিনা বলেন, “প্রতিদিন দিনের বেলা প্রায় চার থেকে পাঁচজন পুরুষ আসে। রাতের বেলা আমরা হোটেল বা কাছাকাছি অন্য কোথাও যাই। সবসময় সংক্রমিত রোগে ভোগার ঝুঁকি ছিল।” ‘দ্য হিন্দু পত্রিকা ২০০০ সালে এই ধরনের চিকিৎসার অবহেলার বিষয়টি তুলে ধরে প্রতিবেদন করে। তাঁরা জানিয়েছে যে, এই সম্প্রদায়ের ৫৫০০ সদস্যকে পাওয়া গেছে যারা এইচআইভি পজিটিভ। শতাংশের হিসাবে এই আক্রান্তের হার সম্প্রদায়ের মোট জনসংখ্যার ১৫%। এসব খেলোয়াড়দের অনেক মেয়েরা গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এই পেশায় আসায় কয়েক বছরের মাথায় হিনা একটি কন্যাশিশুর জন্ম দেয়। মা হওয়ার পরও তাঁকে আরও বেশি বেশি পরিশ্রম করার জন্য চাপ দেওয়া হত। অনেক মেয়েরা এক পর্যায়ে গর্ভবতী হয়ে পড়লেও তাঁদের এই কাজ চালিয়ে যেতে হয়। সন্তানদের যত্ন নেওয়ার জন্য আরও অর্থ উপার্জন করতে চাপ দেওয়া হয় তাঁদের। একজন যৌনকর্মী হওয়ার অর্থ হল যে, সে তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্যে কারোকে বিয়ে করার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। অবশেষে হিনা স্থানীয় এনজিও-র সহায়তায় এই প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন।
সামাজিকভাবে অনুমোদিত এই প্রথার উৎস নিয়ে অনেক তত্ত্ব আছে। তাঁদের মধ্যে একজন জানায়, কীভাবে নরমেডিক উপজাতিদের বাহিরাগত হিসাবে অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। পরে তাঁরা এই যৌনপেশাকে দারিদ্রতা কাটিয়ে ওঠার উপায় বলে মনে করতে থাকে। এই সম্প্রদায়ের প্রায় ৩৩,০০০ সদস্য আছে, যাঁর মধ্যে অন্তত ৬৫% নারী। বেশি সংখ্যক নারী হওয়ার একটি কারণ হল এই অঞ্চলে অল্প বয়সি মেয়েদের অবৈধভাবে পাচার করা হয়। মধ্যপ্রদেশের যেখানে এই সম্প্রদায় বসবাস করে, সম্প্রতি একটি আইন পাস করে, সেখানে ১২ বছরের কম বয়সি শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক কেউ ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়ের সঙ্গে যৌন-সম্পর্ক করলে তাঁদের কারাদণ্ডও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এই ধরনের পদক্ষেপ পরিস্থিতি পরিবর্তন আনতে পারেনি।
বাচ্ছা সম্প্রদায়ের এই গণিকাবৃত্তির প্রথা পরিহারের উদ্দেশ্যে ১৯৯৩ সালে একটি প্রকল্প চালু করা হয়। কিন্তু এটি এখনও সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা হয়নি। নারী ও শিশু কল্যাণ বিভাগের কর্মকর্তা রাজেন্দ্র মহাজন বলেন, “প্রতি বছর আমরা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার জন্য অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্যে প্রতিবছর বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকি, কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের মানদণ্ডগুলো পূরণ করতে পারেনি।”
(৮) থাইল্যান্ড : শতাব্দী ব্যাপী থাইল্যান্ডের গণিকাবৃত্তি আধুনিক থাইল্যান্ড। Ayutthaya রাজত্বের (১৩৫১ ১৭৬৭) সময়, গণিকা বৈধ এবং রাজস্বও নেওয়া হয়। ১৯৬০ সাল থেকে থাইল্যান্ডে গণিকাবৃত্তি অবৈধ হল। যাই হোক, এটি জাতীয় জিডিপির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হিসাবে (২০১৫) বছরে আনুমানিক ৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের রাজস্ব অর্জন করেছিল।
থাইল্যান্ডে সব গণিকারা কি নারী? না, তা হতে পারে না। কারণ প্রতি দশজনের একজন পুরুষ যৌনকর্মী। এখানকার ক্লায়েন্ট বেশিরভাগই বিদেশি। এদের পোশাকে আর ব্যাবসায় নিজেদের সংস্কৃতি বজায় রাখার এক বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা আছে। তবে এই গণিকাবৃত্তি শিল্প এক নির্দিষ্ট স্থান, অর্থাৎ ব্যাংককের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। এই শহরে রেস্তোরাঁগুলি যৌনপেশার জন্যে উর্বর জায়গা। এখানকার শ্রমিকেরাও যৌনতা বিক্রি করে।
পরিসংখ্যান বলছে, থাইল্যান্ড ৬০ লাখ (আনুমানিক) মানুষ বসবাসকারী একটি দেশ। দেশটি প্রধানত বৌদ্ধ (৯৫%) অধ্যুষিত দেশ। অন্যান্য ধর্মের মধ্যে রয়েছে মুসলিম (৩.৮%), খ্রিস্টান (০.৫%), হিন্দুধর্ম (০.১%) এবং অন্যান্য (০.৬%)। থাইল্যান্ডের তিন-চতুর্থাংশ আদিবাসী ১৪% চিনা এবং ১১% বিভিন্ন জাতি। যদিও কৃষি হল দেশটির নেতৃস্থানীয় পেশা (৫৪%), পরিসেবা শিল্প, যা যৌন-ব্যাবসা সংক্রান্ত সমস্ত ব্যাবসাগুলির ৩১% এবং শিল্প ১৫% অনুসরণ করে। (সিআইএ ওয়েবসাইট : থাইল্যান্ড)
বলতে দ্বিধা নেই যে, থাইল্যান্ড যৌন-ব্যাবসার শ্রেষ্ট কেন্দ্র। ১৯৬০ সালে এই ব্যাবসা এখানে অবৈধ ছিল। তা সত্ত্বেও এই ব্যাবসা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। এই গণিকাবৃত্তিতে প্রতি বছর ২,০০,০০০ মানুষকে নিযুক্ত করা হয়েছে। এই পেশায় নারীরা সর্বাধিক যুক্ত। যদিও-বা শিশু ও পুরুষ আছে। বেশিরভাগ চাকরির টোপে পড়ে নিজেদের আত্মীয়দের সাহচর্যে এই পেশায় যুক্ত হয়েছে। কেউ আবার সামাজিক অপমান ভুলতে এবং সেখান থেকে অব্যাহতি পেতে এখানে এসেছেন। এছাড়া হোটেল, রেস্টুরেন্ট, নাচ ক্লাব ছেড়ে বর্তমানে এই উন্মুক্ত পথে, এমনকি যৌন পর্যটনে এর বহুল প্রভাব চোখে পড়ে। এখানে যৌন-ব্যাবসা জাপান, জার্মানি, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মতোই সাবলীল হয়ে উঠেছে। ভিয়েতনামের যুদ্ধের পর যৌন-ব্যাবসা মার্কিনি সামরিক বাহিনীদের জন্যই ভোলা হয়। ব্যাংককের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বাজার এই যৌন পর্যটনের জন্যে আজও টিকে আছে। আজ এখানে বিজ্ঞাপনে মার্কিনিদের জন্য যৌন প্যাকেজ ট্যুর দেওয়া হয়। হোটেলগুলিতে থাকা, খাওয়ার সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের নারী অতিথিও ভাড়া দেওয়া হয়। আখেরে হোটেলগুলি যৌনক্রীড়ার কর্মক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
থাইল্যান্ডে প্রজনন আইন ও প্রতিরোধের আইন, বিই ২৫৩৯ (১৯৯৬) আর্টিকেলে সরাসরি গণিকাবৃত্তি আইনত নিষিদ্ধ। এই আইনের অধীনে, গণিকাবৃত্তির সংজ্ঞা হল—“যৌন-সংযম বা অন্য কোনো কাজ, অথবা অন্য কোনো ব্যক্তির কমিশন অর্থের বিনিময়ে অন্য কোনো ব্যক্তির যৌন-বাসনা বা অন্য কোনো উপকারে ফিরে আসার জন্য, যে ব্যক্তিটি পরিসেবা গ্রহণ করে এবং যে ব্যক্তি কাজ সম্পাদন করে, সেটি একই লিঙ্গের বা হোক না-কেন।”, তা অপরাধ। গণিকাবৃত্তির উদ্দেশ্যে অন্য ব্যক্তির সঙ্গে গণিকাবৃত্তির প্রতিষ্ঠানে জড়িত ব্যক্তিরাও কারাগারের মেয়াদ বা জরিমানা বা উভয়ের মুখোমুখি হয়। শিশু গণিকাবৃত্তির ক্ষেত্রে গুরুতর জরিমানা (যার মধ্যে গণিকা ১৫ বছরের কম বয়সি হলে ৬ বছর পর্যন্ত কারাবাস) হয়। অন্যথায় আইন। সাধারণত ব্যক্তিগত জায়গায় গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয় না। এই আইনটি গণিকাবৃত্তি ব্যাবসা ও প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে বড় অংকের জরিমানা ধার্য করে। এছাড়াও ফৌজদারি কোড গণিকবৃত্তি থেকে অর্জিত অর্থ সংগ্রহ বা ব্যবহার করার জন্য জরিমানা নির্ধারণ করা হয়েছে।
গণিকাবৃত্তির আইন প্রতিরোধ ও নির্যাতন শিশু গণিকাবৃত্তি ও পাচারের উপর বিশেষ মনোযোগ নিবেশ করেছে থাইল্যান্ড সরকার। ধারা ৮ বলছে, ১৫ বছরের কম বয়সি যৌনকর্মীদের যৌন-সম্পর্ক স্থাপন করলে ২ থেকে ৬ বছরের কারাদণ্ড এবং ১,২০,০০০ টাকা জরিমানা করে ক্লায়েন্টদের শাস্তি দেয়। ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সের যৌনকর্মীদের ক্ষেত্রে কারাগারের মেয়াদ ১ থেকে ৩ বছর, এবং জরিমানা ৬০,০০০ টাকা পর্যন্ত ধার্য করা যায়। পাচারের বিষয়ে ধারা ৯-এর বিধান অনুসারে, যে ব্যক্তি বা কোনো ব্যক্তি যিনি তাঁর বা তাঁর সম্মতি মোতাবেক, এমনকি সেই ব্যক্তির গণিকাবৃত্তির জন্য কোনো ব্যক্তিকে কিনে নেয়, উচ্ছেদ করে এবং কোনো অপরাধ সংঘটিত বিভিন্ন কাজ কি না তা নির্বিশেষে, রাজ্যের অভ্যন্তরে বা বাইরে যা করা হয়, তাহলে ১ থেকে ১০ বছর মেয়াদে কারাগারবাস এবং ২৫ হাজার থেকে ২ হাজার বাহাত জরিমানা করা হবে। উপরন্তু ধারা ৯ এর অধীনে যে-কোনো অপরাধ প্রতারণা, হুমকি, সহিংসতা, অযৌক্তিক প্রভাব বা জোরপূর্বক অনুশীলনের মাধ্যমে যদি সংঘটিত হয়, তার ফলে এক-তৃতীয়াংশ গুরুতর শাস্তি হয়।
দণ্ডবিধির সংশোধনী আইন (নং ১৪), বিই ২৫৪০ (১৯৯৭) আর্টিকেলে স্পষ্টভাবে বলেনি যে, থাইল্যান্ডে গণিকাবৃত্তি অবৈধ। কিন্তু দণ্ডবিধির ২৮৬ ধারা অনুসারে—যে ব্যক্তি ১৬ বছর বয়সি একজন গণিকাবৃত্তির উপার্জনের উপর নির্ভর করে, এমনকি যদি তাঁর আয়ের কিছু অংশের উপর নির্ভর করে, তবে তাঁকে ৭ থেকে ২০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হবে এবং ৪ হাজার থেকে ১৪ হাজার বাহাত জরিমানা করা হবে বা যাবজ্জীবন দণ্ডিত করা হবে। জরিমানা নির্দিষ্ট করা না হলেও, আইনের ধারায় একই কোনো ব্যক্তি যিনি (i) কোনো গণিকার সঙ্গে বসবাস করেন বা বাস্তবসম্মতভাবে সংযুক্ত হন, তাঁকে শাস্তি দেন (i) কোনো গণিকা দ্বারা পরিচালিত বোর্ডিং, অর্থ বা অন্যান্য সুবিধা পান অথবা (iii) কোনো গ্রাহকের সঙ্গে ঝগড়া করতে সহায়তা করে। আইনটি শিশু গণিকাবৃত্তি মোকাবিলার জন্যও লিখিত ছিল। কিন্তু সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার অভাব ছিল, কারণ এটি একটি পর্নো কাজ’ কি না তা সংজ্ঞায়িত করে না।
১৯৬৬ সালের বিনোদন স্থান আইনটি (Entertainment Places Act of 1966) বিনোদনের চৌহদ্দিতে গণিকাবৃত্তি ঘটালে নির্দিষ্ট ধরনের বিনোদন প্রতিষ্ঠানের মালিকের উপর অপরাধ সাব্যস্ত হয়ে থাকে। যার ফলে তাঁরা অপরাধমূলকভাবে দায়বদ্ধ হয়ে পড়ে। গণিকালয় পরিচালনা করা, অনুরোধ এবং অন্যদের গণিকাবৃত্তি থেকে লাভজনক সম্পর্কিত কার্যক্রম অবৈধ। থাই আইন অনুযায়ী গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ। তবে কারাওকে বার (Karaoke bars) এবং ম্যাসেজ পার্লারগুলিকে স্বাভাবিক, বৈধ ব্যবসা হিসাবে নথিভুক্ত করা যেতে পারে। যৌনকর্মীদের গ্রেফতার করা হয় তখনই, যখন এই ধরনের কাজ চৌহদ্দির মধ্যে সংঘটিত হবে। তখন পুলিশ সাধারণত যৌনকর্মী এবং ক্লায়েন্টের মধ্যে বিনিময় হিসাবে গণিকাবৃত্তির আচরণকে বিনিময় হিসাবে মেনে নেয়।
সোয়া ম্যাসেজ ইনস্টিটিউটস, জাপানি সোপল্যান্ডগুলির মতো, সাধারণত ওয়েল ম্যাসেজ, নগ্ন শরীরের ম্যাসেজ বা স্নান চিকিৎসা যা যৌন পরিসেবাগুলিও অন্তর্ভুক্ত করে। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে পুরুষ ক্লায়েন্ট নারী গণিকাদের সঙ্গে যৌন কার্যকলাপে ব্যস্ত হতে পারে। ব্যাংককের কিছু প্রতিষ্ঠানে প্রচুর পরিমাণে সোপ ম্যাসেজ ব্যাবসার জড়িত আছে।
থাইল্যান্ডের থাই-ম্যাসেজের জন্য পরিচিত হলেও এটি ‘নুয়েট ফেন বোয়ার’ নামে পরিচিত ম্যাসেজের যৌনতাহীনতা (Non-sexual), ঐতিহ্যগত কায়দায় ম্যাসেজের চালু আছে। কিছু ম্যাসেজ পার্লারে হাত দিয়ে লিঙ্গমৈথুন (handjobs), ওরাল সেক্স এবং যৌনসঙ্গম (Sexual Intercourse) সহ অতিরিক্ত খরচ করলেই পাওয়া যায়। ২০১৬ সালে ‘Federation of Thai Spa Associations’ (FTSPA) কর্তৃপক্ষ কিছু ম্যাসেজ পার্লারে দেওয়া যৌন-পরিসেবাদি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। FTSPA বজায় রাখে যে, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ‘চমৎকার স্বাস’ (pretty spas) বা ম্যাসেজ পার্লারগুলি থেকে পর্যটকরা যৌন-পরিসেবাদি কিনতে পারে।
১৯০৫ সালে যখন রামা ভি দাসত্ব (slavery) নিশ্চিহ্ন করেন। তখন মহিলারা নিজেদের ছাড়া কিছু খুঁজে পেলেন না। তাই তাঁরা বেঁচে থাকার জন্য তাঁদের শরীর বিক্রি করতে শুরু করে। সেই সময় প্রায় লক্ষ লক্ষ চিনা পুরুষ নির্মাণ কাজ (Construction Work) করতে এসেছিল, যাঁরা যৌন-সম্পর্কের দাবি করেছিল। ১৯০৮ সালে তৎকালীন রাজা গণিকাবৃত্তি বৈধকরণ এবং যৌনকর্মীদের চিকিৎসা সেবা পেতে আইন পাস করেন। থাইল্যান্ডের প্রাচীন গ্রন্থগুলির একটি প্রাচীন, ধারাবাহিক ঐতিহ্য, যা সাধারণত ধম্মসাৎ (Dhammasattha) সাহিত্যের শিরোনামে বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে গণিকাবৃত্তি বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত এবং সর্বজনীনভাবে নিষিদ্ধ করে। বিংশ শতাব্দীতে যৌনশিল্প (Sex Industry) সম্পর্কিত বিভিন্ন আইন পাস করা হয়, যার মধ্যে ১৯০৮ সালের সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ আইন এবং বিনোদন স্থান আইন, ১৯৬৬ (Entertainment Places Act of 1966) অন্তর্ভুক্ত। ১৯৫০-এর দশকে থাই প্রধানমন্ত্রী ফিল্ড মার্শাল সরিত থানতারাত (Sarit Thanarat) নৈতিকতা নিয়ে প্রচারণা শুরু করেন, যার মধ্যে আছে জরিমানা ও কারাদণ্ড আরোপের মাধ্যমে গণিকাবৃত্তিকে অপরাধে পরিণত করা। থাইল্যান্ডের যৌনকর্মীরা যৌনবৃত্তি করেন আর্থিক চাপের জন্য নয়, প্রমাণ রয়েছে যে বেশিরভাগ মেয়েরা গণিকাবৃত্তি পছন্দ করেন।
(৯) ফিলিপাইন : ফিলিপাইনের গণিকাবৃত্তি অবৈধ, যদিও যৌনকর্মীদের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারীরা খুব কমই বিরল। পাচারের ক্ষেত্রে জড়িত ব্যক্তিদের জন্য জরিমানা করা হয় বটে, যা ২০০৩ সালের ‘Anti-Trafficking in Persons Act of 2003’ দ্বারা সুরক্ষিত। গণিকাবৃত্তি প্রায়শই বার, কারওকে বার (কেটিভি হিসাবেও পরিচিত), ম্যাসেজ পার্লারস, ব্রথেলস (এটি কাসা নামে পরিচিত), রাস্তায় চলমান গণিকাবৃত্তি এবং এসকর্ট সেবা দিতে দেখা যায়। ফিলিপাইনের ‘Population Institute and Demographic Research and Development Foundation’ কর্তৃক ২০০২ সালে ‘তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক উর্বরতা ও যৌনতা চর্চা’ পরিচালিত হয়েছিল যে, ১৯% তরুণ পুরুষ যৌনতার জন্য অর্থ প্রদান করেছিল এবং ১১% যৌন অনুগ্রহের জন্য অর্থ প্রদান পেয়েছিল। ২০১৩ সালে আনুমানিক ৯৭.৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ফিলিপাইনে ৫,০০,০০০ গণিকাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত ছিল। ২০০৫ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, সিনেটর পিয়া এস (Pia S. Cayetano) তার অ্যান্টি-গণিকাবৃত্তি আইন’ (সেনেট বিল নং ২৩৪১, ২০১০)-এ বলেছিলেন যে, ফিলিপাইনে গণিকাবৃত্তিতে শোষিত মানুষের সংখ্যা ৮,০০,০০০ এর চেয়ে বেশি হতে পারে।
ফিলিপাইনে গণিকারা স্থানীয় গ্রাহকদের এবং বিদেশিদের যৌন-পরিসেবা দিয়ে থাকে। এখানকার গণিকাবৃত্তি এক উচ্চতর ঘটনা। অলিঙ্গাপো সিটি, এঞ্জেলস সিটি, আলবেয়ের লিগাজিপ সিটি, পাসে সিটি এবং জাম্বলেস শহরগুলির সাধারণত পূর্ব এশীয় ও পশ্চিমা দেশগুলির বিদেশি ব্যবসায়ীদের মধ্যে গণিকাবৃত্তি চলে। অলিঙ্গাপো সিটি এবং এঞ্জেলস সিটিতে গণিকাবৃত্তি যথাক্রমে সাবিক বে ন্যাভাল বেস এবং ক্লার্ক এয়ারবেসে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। ১৯৯১ সালে যখন পিনাতুবো পর্বতমালার একটি আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎগার হয়, এটি ক্লার্ক এয়ারবেসের বেশিরভাগ অংশই ধ্বংস হয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯২ সালে বেসটি বন্ধ করে দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত কিছু গণিকাবৃত্তি বাণিজ্যও বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ম্যানিলার মেয়র আলফ্রেডো লিম যখন ১৯৯২ সালে শুরু হওয়া ম্যানিলার আর্মি এলাকার যৌনশিল্প এলাকাগুলি বন্ধ করে দেন, তখন বেশিরভাগ গণিকারা নতুন গ্রাহক খুঁজতে এঞ্জেলসে চলে যায়। যৌন পর্যটকদের এটা যেন তীর্থক্ষেত্র। সিবুর মতো অন্যান্য পর্যটন এলাকাগুলিও একটি উচ্চ-প্রোফাইল গণিকাবৃত্তি শিল্পের বিকাশ হয়েছে। অনলাইন ডেটিং সাইট এই প্রবণতা উৎসাহিত করতে একটি বড় ভূমিকা নিয়েছে।
ফিলিপাইনের একক অবাঞ্ছিত মা হওয়ার পরে কিছু নারীও গণিকাবৃত্তি শিল্পে যোগ দেয়। গণিকাবৃত্তি গ্রহণের বিভিন্ন কারণের মধ্যে রয়েছে ফিলিপাইনের কৃত্রিম গর্ভনিরোধের অসম্পূর্ণতা, অপর্যাপ্ত যৌনশিক্ষা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে বিলম্ব এবং বহু ফিলিপিনো পুরুষের মধ্যে একটি টেকিক্যাল মনোভাব। ফিলিপাইনে প্রতি বছর জন্মগ্রহণকারী শিশুদের অর্ধেকেরও বেশি অবৈধ এবং অবৈধ শিশু বছরে প্রায় ২ শতাংশ হারে বেড়েছে।
মেসেজেস হিসাবে কাজ করা মহিলাদের জরিপের মাধ্যমে জানা যায়, ৩৪ শতাংশ তাঁদের দরিদ্র বাবা-মাকে সাহায্য সমর্থন করার জন্য তাঁদের এই কাজ পছন্দ, ভাইবোনদের সাহায্য করার জন্য ৪ শতাংশ এবং স্বামী বা ছেলেবন্ধুদের সহায়তায় ২৪ শতাংশ। ২০ শতাংশের বেশি কাজটি স্রেফ ভালো লাগে বলেই করেন। কিন্তু মাত্র ২ শতাংশ বলেছিলেন এটি সহজ কাজ এবং মাত্র ২ শতাংশ কাজটি উপভোগ করার দাবি করেছে। এক তৃতীয়াংশেরও বেশি রিপোর্ট করেছে যে, তাঁরা হিংস্রতা বা হয়রানির শিকার হয়েছে, বিশেষ করে পুলিশের কাছ থেকে।
International Labour Organization’ কর্তৃক পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, ফিলিপাইনের ম্যাসেজ পার্লারের ৫০ শতাংশ নারী “with a heavy heart” নিয়ে তাঁদের কাজ করেছে এবং ২০ শতাংশ বলেছে যে, তাঁরা ‘Conscience-stricken’। কারণ তাঁরা এখনও গ্রাহকদের সঙ্গে যৌন-সম্পর্ক করেন। ফিলিপাইনের বারগার্লদের সাক্ষাৎকারে দেখা গেছে যে, তাঁদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি গ্রাহক যখন ক্লায়েন্টের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক লিপ্ত হয়, তখন ‘কিছুই’ অনুভব করেননি এবং বাকিরা বলেছিলেন যে এই পেশায় লেনদেনগুলি তাঁদের দুঃখ দেয়।
ফিলিপিন্স একটি উৎস দেশ এবং অল্প পরিমাণে, নারী ও শিশুদের যৌন পাচারের শিকার একটি ডেসটিনেশন এবং যোগাযোগের দেশ। আনুমানিক ১০ মিলিয়ন ফিলিপিনো বিদেশে বসবাস করে বা বিদেশে কাজ করে এবং ফিলিপিনস প্রতি বছর বিদেশে কাজ করার জন্য সরকার প্রায় ২.৩ মিলিয়ন নতুন বা পুনর্নবীকরণ চুক্তি প্রক্রিয়া করে। এই অভিবাসী কর্মীদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা যৌন পাচারের শিকার, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলেও।
গনসাল (Gonzales) বলেন, “এমন সময় ছিল যখন তাদের খাবার কিনতে কোনো টাকা ছিল না। যখন আপনার সন্তানদের খাওয়ানোর কোনো কিছুই না থাকে, তখন দ্রুত অর্থের জন্য গণিকাবৃত্তিতে পরিণত হওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে, সেই হাতছানি কিছুতেই এড়ানো যায় না।” গনসাল যৌনকর্মীদের আহ্বান করে। গনসাল বলেন–“আমরা তাঁদের ‘গণিকা নারী’ বলে ডাকি, কারণ গণিকাবৃত্তি কোনো চাকরি নয় বরং মানবাধিকার লঙ্ঘন।” গনসাল বলেন, তবে তাঁর গ্রুপ নারীকে তাঁদের ব্যাবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য করে না।”
(১০) তুরস্ক : তুরস্কে গণিকাবৃত্তি বৈধ এবং অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত। তুর্কি সমাজের ধর্মনিরপেক্ষতা গণিকাবৃত্তিকে ২১ শতকের প্রথম দিকে আইনি অবস্থা অর্জনের অনুমতি দেয়। দেশে সাধারণ ঘর’ (General Houses) হিসাবে পরিচিত, গণিকালয় পরিচালনার জন্য অবশ্যই সরকার থেকে সম্মতি গ্রহণ করতে হয়। এর ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি যৌনকর্মীদের কাছে পরিচয়পত্র প্রদান করে, যার মাধ্যমে তাঁদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা এবং অন্যান্য সামাজিক পরিসেবাদির অধিকার দেয়। যাই হোক, অনেক স্থানীয় সরকারে এখন নতুন নথিভুক্ত না করার নীতিও আছে। সেই কারণে কিছু শহর যেমন আঙ্কারা (Ankara) ও বিরসা (Bursa) আদালতের আদেশে গণিকালয়গুলি বিধ্বস্ত করা হয়েছিল।
তুরস্কের গণিকালয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ২২৭ নম্বর আর্টিকেল (Turkish Penal Code,Law No. 5237) প্রয়োগ করা হয়। তবে এই আইনের প্রয়োগ বেশ বিতর্কিত আছে। গণিকালয়গুলি প্রমোট করলে ২ মাস থেকে ৪ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। তবে অবৈধ গণিকালয় লাইসেন্স দেওয়া ছাড়াই একটি গণিকাবৃত্তির কাজ হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা না-করে গণিকা হওয়া, লাইসেন্স ছাড়াই গণিকা হওয়া, অথবা নথিভুক্ত হওয়া ছাড়া গণিকালয় পরিচালনা করলে তা শাস্তিযোগ্য, সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদণ্ড।
স্ট্রিপ ক্লাব (Strip Clubs) বর্তমান তুরস্কেও উপস্থিত। তবে স্ট্রিপ ক্লাবগুলিকেও লাইসেন্সপ্রাপ্ত হতে হয় এবং স্ট্রিপগুলিকে অবশ্যই নথিভুক্ত হতে হবে এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। স্ট্রিপ ক্লাবগুলিতে প্রবেশকারী সকল ব্যক্তিকে অন্তত কঠোরভাবে ১৮ বছরের উপর হতে হবে।
২০০৪ সালে, তুরস্কের সমাজসেবী ও যৌনকর্মীরা ঘোষণা করেছিল, তাঁরা তুরস্কের প্রথম যৌনকর্মী ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার প্রকল্পে কাজ করেছে। আঙ্কার চেম্বার অফ কমার্স বলছে, তুরস্কে গণিকালয়ের সংখ্যা প্রায় ১,০০,০০০। ৫৬ টি গণিকাপল্লি দ্বারা নথিভুক্ত গণিকার সংখ্যা ৩,০০০। পুলিশের কাছে নথিভুক্ত গণিকার সংখ্যা ১৫,০০০। এছাড়া ৩০,০০০ মহিলা লাইসেন্স পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছে। গণিকাদের বয়স ১৮ এবং ৪০-এর মধ্যে। বার্ষিক টার্নওভার ৩ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার।
ইউএনডোকির (UNDOC) একটি প্রতিবেদন অনুসারে, তুরস্ক যৌন-বাণিজ্য সম্পর্কিত মানুষের পাচারের শিকার হওয়া শীর্ষস্থানীয় ডেসটিনেশন। ২০০৪ সালে পাচারকর্মে চিহ্নিত শিকারদের জন্য উৎস দেশগুলি হল তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, আর্মেনিয়া, মোলদাভিয়া, কিরগিজস্তান, রাশিয়া, জর্জিয়া, ইউক্রেন, আজারবাইজান, রোমানিয়া, কাজাখস্তান, বেলারুশ, বুলগেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া। উল্লেখযোগ্যভাবে রাশিয়ান সংগঠন অপরাধ সিন্ডিকেটগুলি গণিকাবৃত্তির জন্য মহিলাদের পাচারের কাজে জড়িত এবং তুরস্ক সহ বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশগুলিতে রাশিয়ান ও ইউক্রেনীয় নারীরা গণিকায় পরিণত হয়। ২০০৬ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, সোভিয়েত রাষ্ট্রের যৌন-ক্রীতদাসদের জন্য দ্রুততম এবং বৃহত্তম বাজারে পরিণত হচ্ছে। মোলদাভিয়া এবং ইউক্রেন থেকে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি নারী তুরস্ক জুড়ে যৌনদাস হিসাবে কাজ করছে বলে মনে করা হয়। তুরস্কের আঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আইসিগুল আকবের (Aysegul Akbay) মতে, প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক বাজার মূল্য নিয়ে তুরস্কের গণিকালয়ের সংখ্যা ১,০০,০০০-এরও বেশি।
নথিভুক্ত গণিকাদের জন্য যৌন-সংক্রামিত রোগের জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা পরিচালনা করা বাধ্যতামূলক এবং কন্ডোম ব্যবহারও বাধ্যতামূলক। তুরস্কের পুলিশ সঠিকভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে কি না তা যাচাই করার জন্য এবং নথিভুক্ত গণিকালয়ের সত্যতা যাচাই করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং তাঁরা যদি তা না করে তবে তারা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করে। তবে পুরুষ গণিকারা এই নিয়মের অধীনে নিবন্ধিত করতে পারবেন না। তবে বেশিরভাগ গণিকাই নিবন্ধিত নয়। কারণ স্থানীয় সরকারগুলি নতুন নিবন্ধন না-করে নীতিটি তৈরি করেছে।
ব্যবহারকারীদের তথ্য অনুযায়ী তুরস্কে ভিআইপিদের যৌনসেবা লাভ করার জন্য খরচ করতে হয় প্রতি ঘণ্টায় ৩০ মার্কিন ডলার এবং সারা রাতের জন্য ১০০ মার্কিন ডলার। আঙ্কার, ইজমির এবং ইস্তানবুলের মতো বৃহত্তর মহানগর এলাকার গণিকাদের যৌন পরিসেবার হার আরও বেশি হয়। এইসব এলাকার যৌনকর্মীরা সারা রাতে ৫০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত রোজগার করতে পারে। গণিকামহলের এক মহিলা মালিক ছিলেন তুরস্কের বৃহত্তম করদাতা। বস্তুত লাইসেন্স প্রাপ্ত যৌনকর্মীরাই কর প্রদান করে। ফলে তুরস্কের মুসলিম সরকার তাঁদের সামাজিক সুরক্ষা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাগুলি প্রদান করে। লাইসেন্স ছাড়াই যাঁরা অবৈধভাবে কাজ করে, তাঁদের উপর তুরস্ক পুলিশ অত্যাচার এবং জরিমানা এবং তোলাবাজি চালায়। গত দশকে ক্ষমতাসীন ইসলামবাদী বিচার ও উন্নয়ন দল (একক) নিঃশব্দে কয়েক ডজন গণিকালয় বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে শত শত নারী গৃহহীন এবং বেকার হয়ে পড়েছিল। পুলিশী অভিযান সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে (এবং তুরস্কের আইএমএফ চালিত অর্থনৈতিক সংস্কার) জোর করে বেঁচে থাকার জন্য আরও বেশি নারীকে যৌনকর্ম করতে বাধ্য করছে। কিন্তু সরকার এখন লাইসেন্স প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে। রাস্তায় গণিকাদের রেখেছে, যেখানে তাঁরা হয়রানির শিকার, পুলিশের অত্যাচার ও জরিমানা জারি থাকছে। ইস্তানবুলের হৃদয় টাক্সিম স্কোয়ারে হেয়েরেটিন বুলান (Hayrettin Bulan) পুরুষ গণিকাবৃত্তির জন্য ঘোষণা করেছেন। এই ঘোষণাটি দারিদ্র-বিরোধী (Anti-poverty) গ্রুপ সেকাট ডের’ (Sefkat Der) দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। গ্রুপটি রাষ্ট্র পরিচালিত গণিকাবৃত্তির জন্য শেষ যুদ্ধ করছে। বুলান বলেছে, নারীদের জন্য গণিকাবৃত্তির আহ্বান জানাতে তাঁদের এই মৌলবাদী পদক্ষেপ হতাশা থেকে বেরিয়ে এসেছে। বুলান বলছেন, “সরকার মূলত যৌন-দাসত্বকে রক্ষা করার জন্য আইনি ভিত্তি ব্যবহার করছে। তাঁরা বলে যে, পুরুষদের যৌনতা দরকার এবং তাঁদের জন্যে গণিকালয়ের প্রয়োজন হবে। কিন্তু অন্যদিকে তাঁরা ‘লিঙ্গ-সমতা’ (Gender Equality) নীতিগুলি গ্রহণ করে না। বুলান এবং তাঁর সহকর্মীরা যুক্তি দেন যে, “যদি আপনি অনুমান করেন যে, নারীদের যৌনতা দরকার এবং তাঁদের জন্য একইরকমের গণিকালয় দাবি করেন, তাহলে এই চাহিদা মেটাতে পুরুষ গণিকালয়ও খোলা উচিত।
অটোম্যান সাম্রাজ্যে গণিকাবৃত্তি : গণিকালয়গুলি দাবি করে, এ পেশা বিশ্বের প্রাচীনতম পেশা। কিন্তু যখন এই পেশা অটোমান যুগে ছিল, তখন খুব কমই পরিচিত। এটি কেবলমাত্র অল্প গবেষণায় ঘটেনি। বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, দাসত্ব এবং ব্যভিচার অটোমান প্রথাগত আইন এবং মুসলিম আইন ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। শরিয়ায় গণিকাবৃত্তি হয় না। তা ছাড়া, গবেষকরা অভিযোগ করেছেন যে, অটোমান রেকর্ডগুলিতে উল্লিখিত যে ঘটনাগুলি ‘অনৈতিকতা’ (Immorality) আসলে গণিকাবৃত্তি জড়িত কি না তা নির্ধারণ করার জন্য যথেষ্ট নির্দিষ্ট নয়।
প্রথমবারের মতো আমরা গণিকাবৃত্তি সম্পর্কে জানতে পারি সুলতান সুলায়মানের শেষ বছরগুলিতে মহৎ শাসনের (১৫২২-১৫৬৬) সময়। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে রেফিক আহমেট সেভেনগিলের ‘ইস্তানবুল নাসিল ইগ্লেনিয়ঙু (Istanbul Nasil Egleniyordu) নামে ঘটনাটি ঘটে। সুলতানির নামে একটি জেলার স্থানীয় লোকজন একসঙ্গে মিলিত হয়ে স্থানীয় কাদি (বিচারক) গিয়েছিল এবং এই এলাকার বাসিন্দা পাঁচজন নারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল। সেই নারীদের নাম ছিল আরাপ ফাতি, নারিন, গরিটিলি নেফাইস, কামার। অভিযোগ ছিল যে, এই মহিলারা খোলাখুলিভাবে গণিকাবৃত্তিতে জড়িত ছিল। পাঁচজন নারীর মধ্যে শুধুমাত্র আরাপ ফাতিকে যখন ডাকা হয়েছিল তখন বিচারকের সামনে উপস্থিত হতে অস্বীকার করেন। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল যে, এই নারীর বাড়ি বিক্রি হবে এবং মহিলাকে শহর থেকে বের করে দেওয়া হবে।
যখন ইমাম আরাফ ফাতির বাড়িতে এসেছিলেন, তখন তিনি ইমাম, কাদি ও শরিয়া আইনকে অভিশাপ দিয়েছিলেন এবং এটি নির্ধারণ করা হয়েছিল যে, তিনি তাঁর বাড়িতে অপরিচিতদের (তাঁরা পুরুষ ছিলেন, যাঁরা তাঁর পিতা বা স্বামী বা ভাই কেউ নয়) অনুমতি দিয়েছিলেন। ইস্তানবুলের একটি ভিন্ন এলাকার তারও অনুরূপ অবস্থা হয়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাঁর বাড়ি বিক্রি হয় এবং তাঁর স্বামী ফিরে না-আসা পর্যন্ত তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
গণিকালয় এই সময়ে এক জায়গায় সীমাবদ্ধ ছিল না, গোটা ইস্তানবুল জুড়ে দেখা যায়। সুলতান দ্বিতীয় সেলিম (১৫৬৬-১৫৭৪) শহরটিতে গণিকালয় এবং অনৈতিকতার তদন্তের জন্য আহ্বান জানায় এবং সংশ্লিষ্ট সকলের এবং তাঁদের শাস্তি নিবন্ধনের জন্য ডিক্রি জারি করে। গণিকারা কারাগারে ছিল। স্পষ্টতই গণিকাবৃত্তি বন্ধের ডাক দেওয়া খুব সফল ছিল না। কারণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অন্য উপায় সন্ধানে ঘুষ দেওয়া খুব সহজ ছিল।
“Prostitution in Ottoman Istanbul, Late Sixteenth–Early Eighteenth Century” are মারিনস সারিয়ানিস মন্তব্য করেছেন যে, ১৬ শতকের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী আইনটি অস্পষ্ট ছিল বলে মনে করা হয়। তবে আইনটি অপরাধ ছিল। অটোমানরা ব্যভিচার সম্পাদনকারী নারীদের কাছ থেকে জরিমানা করতে পছন্দ করে এবং এটিও সেই গণিকাবৃত্তিকে উপযুক্ত বলে মনে করে। কারণ তাঁরা তাঁর সেবাগুলির জন্য অর্থ প্রদানের দাবিতে কাদিতে যাওয়ার ব্যাপারে দ্বিধা বোধ করে না। বিদেশিদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকার গণিকাদের বাড়ি থেকে বের করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। অথচ মুসলিম নারীদের গণিকাবৃত্তি করার ক্ষেত্রে টেকনিক্যালি নিষিদ্ধ ছিল।
(১১) নেপাল : নেপালে পতিতাবৃত্তি অবৈধ। Human Trafficking and Transportation (Control) Act’, ২০৬৪, ২০৬৪ সালের আইনের নং ৫ নম্বর (২০০৮), গণিকাবৃত্তি এবং মানব পাচারের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করে গণিকাবৃত্তির উপার্জনের জীবনজীবিকাকে অপরাধী করে তোলে। UNAIDS (United Nations Programme on HIV/AIDS)-এর অনুমান, দেশে ৬৭,৩০০ গণিকা আছে।
যদিও নেপালে যৌনকর্মকে বিশেষভাবে অপরাধমূলক করার মতো কোনও আইন নেই, তবে ১৯৮০-এর দশক জুড়ে এমন কিছু আইন প্রণীত হয়েছিল, যা নেপালের অভ্যন্তরে এবং বাইরের পাচারকে অপরাধমূলক যৌনকর্মের দিকে ব্যবহার করতে হয়। এই আইনগুলির অনেকগুলি মাঝে মাঝে যৌনকর্মীদেরও দোষারোপ করার জন্য ব্যাখ্যা করা হয়, যা প্রত্যক্ষ যৌন পাচারের এবং যৌনকর্মের মধ্যে পার্থক্য জ্ঞানের অভাব (Lack of Knowledge) থেকে আসে। যৌনকর্ম’ এমন একটি শব্দ যা বিশ্বজুড়ে বৈধ এবং অবৈধ যৌনশিল্পের সমস্ত দিককে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। শরীরী এবং মৌখিক (Oral) সহ যৌনকর্মের বিভিন্ন ধরন আছে। এই পার্থক্যটি এমন, যা সত্য কি না বোঝা যায় না। সুতরাং পাচারের বিরুদ্ধে নেপালের মধ্যে প্রণীত অনেক নীতি ও আইন–অনেকের যুক্তি যৌনকর্মের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা উচিত নয়। দাসত্ব, পাচার বন্ধ করার চেষ্টাকারী কর্তৃপক্ষ এবং আইন যৌনকর্মী, ক্লায়েন্ট এবং যৌনশিল্পের সঙ্গে জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধে ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়।
১৯৮৬ সালে, নেপালে ট্র্যাফিক ইন হিউম্যানস (কন্ট্রোল) আইনটি পাস হয়েছিল এবং গণিকাবৃত্তি ধরনের পাচার বন্ধ করার লক্ষ্যে ছিল। তবে এই আইনটি অন্যান্য অনেকের মতোই অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল। মূলত এই কারণে যে, এই আইনটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাচারের ঘটনা রোধ না করে গণিকাবৃত্তিকে অপরাধী করে তোলা হয়েছিল। ২০০৮ সালে ‘Human Trafficking and Transportation (Control) Act গণিকাবৃত্তি ও মানব পাচারের সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করে গণিকাবৃত্তির উপার্জনের জীবনযাপনকে অপরাধী করে তোলে।
অনেকের কাছেই যৌনশিল্পে প্রবেশের একমাত্র উপায় হল যে, তাঁরা নেপালে অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকতে সাহায্য করে। তবে শ্রমের শিল্প বা পরিসেবা প্রকল্পের মধ্যে যৌনকর্ম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত নয়। নেপালে যৌন পাচারের একটি বড় ঘটনা আছে বটে। তবে সাধারণভাবে অনেকেই স্বেচ্ছায় যৌনকর্মে বিশ্বাস রাখে।
আজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশগুলির মধ্যে নেপাল সর্বাধিক দারিদ্র্যপীড়িত। গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, নেপালি জনসংখ্যার প্রায় ৩৮ শতাংশ প্রতিদিন ১ মার্কিন ডলারে জীবন নির্বাহ করে এবং ৮২ শতাংশ প্রতিদিন ২ মার্কিন ডলারে জীবন নির্বাহ করছে। দারিদ্র্যের এই উচ্চ হারের কারণে, গ্রামীণ দরিদ্র নেপালি লোকেরা সাধারণত বড়ো পরিবার, ভূমিহীন বা খুব কম জমির মালিক, নিরক্ষরতার উচ্চ হার এবং নির্দিষ্ট জাতি, বর্ণ এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠীতে মনোনিবেশিত হয়। দারিদ্র্যের এই বিষয়গুলি নেপালের যৌনশিল্পে সিজেন্ডার (Cisgender) এবং হিজড়া পুরুষ এবং মহিলা উভয়ই যৌনকর্মে অংশ নেয়। তাঁদের বিশাল পরিবারগুলির কারণে এই যৌনকর্মীদের পরিবারের মধ্যে সহায়তা করার একটি উপায় খুঁজে নেওয়া। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় যে, মহিলা যৌনকর্মীরা এবং সাধারণভাবে মহিলাদের পক্ষে ঘরোয়া পরিবেশ এবং কর্তব্যগুলি ভেঙে ফেলার খুব বেশি সুযোগ নেই, যা তাদের দারিদ্র্যে মধ্যে ফেলে রেখেছে। সুতরাং তাদের জন্য একমাত্র বিকল্পটি হল যৌনকর্মে চলে আসা।
অন্যান্য দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলির মতো নেপালেও মহিলাদের জন্য সীমিত পরিমাণে সংস্থান রয়েছে। সম্প্রতি নেপাল সরকার পারিবারিক সম্পৃক্ততা, শারীরিক অখণ্ডতা, মালিকানা অধিকার এবং সামগ্রিক নাগরিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে নারীদের আরও বেশি অধিকার স্বীকৃতি দিয়েছে। যাই হোক, এর ফলে এই সত্যটি পরিবর্তন করে না যে, নেপালি সমাজে এখনও নারীদের উচ্চাসনে উপবিষ্ট করা হচ্ছে এবং পুরুষদের মতো সমান অধিকার নেই।
নেপালে বেশিরভাগ মহিলারাই এই যৌনকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত হয়। কারণ অন্যথায় তাঁদের খুব কমই কোনো সুযোগ থাকে। এই মহিলারা যে কাজটি করে তা নারীর ক্ষমতায়ন বোধ করে। এই অর্থে যে, তাঁরা তাঁদের পরিবারকে আরও ভালোভাবে সাহায্য করতে পারে এবং সমাজ নারীদের সঙ্গে যেরূপ আচরণ করে তা ছাড়া অন্য কোনও কিছুর জন্যেও করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে যৌনশিল্পে মেয়েরা নেপালের বাইরে বা শহরে আরও কেন্দ্রীভূত হয় তাঁদের পরিবারকে আরও ভালোভাবে সাহায্য করার জন্য কার্পেট কারখানায় নিযুক্ত করতে বাধ্য হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের প্রত্যক্ষ পাচারে অপহরণ করে বা যোগদান করতে বাধ্য করা হয়। দারিদ্র্যের বিষয়টি নেপালের অনেক পরিবারকে হতাশায় ফেলেছে, ঘরে ঘরে সাহায্যে জন্য অর্থ উপার্জনের জন্য তাঁদের মেয়েদের রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে।
নেপালে মানব পাচার, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে যৌন পাচার স্বেচ্ছায় যৌন কাজের একটি সাধারণ পূর্বসূরী। অর্থাৎ যৌন পাচারের জগৎ থেকে পালানোর পরে নেপালে ফিরে আসার সময় মহিলারা স্বেচ্ছায় যৌনকর্মেই ফিরে আসে। কারণ শুধুমাত্র এই কাজটিই তাঁরা ঠিকঠাক জানে। নেপালের এই যৌনপেশাই প্রতিদিন এই হাজার হাজার মহিলাদের দারিদ্র্য ও সংগ্রামের (স্বল্পমেয়াদি হলেও) স্বস্তি দিয়ে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব যৌনপেশার ক্ষেত্রে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে এবং অবশ্যই এটা যৌনকর্মের বিরুদ্ধে বড়ো যুক্তি।
নেপালের মেয়েরা পরিবার এবং নিজের জন্য আরও ভালো সুযোগের প্রত্যাশায় অনেকেই যৌনপেশায় প্রবেশ করেন। নেপালে এটি বিশেষভাবে সত্য, যেটি বিশ্বের সর্বনিম্ন মানব বিকাশের সূচকযুক্ত দেশগুলির মধ্যে একটি। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন (United Nations Human Development) সূচকে ১৪৩ তম স্থান পেয়েছে। যেহেতু যৌনকর্মীরা সাধারণত নেপালের অভ্যন্তরে জাতিব্যবস্থায় নিম্নবর্ণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে (ইউএন নেপাল পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, যৌনকর্মীদের বেশিরভাগই তামাং ও দলিত ছিলেন)। ভারত এবং অন্যান্য দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলিতে তাঁরা মনে করেন যৌনপেশা হল একমাত্র সুযোগ, যা তাদের সত্যিকারের জীবন এবং তাঁদের পরিবারের উন্নতি করতে পারে। সাধারণত নেপালি বর্ণবাদ ব্যবস্থা যে-কোনো নিম্নশ্রেণির লোকদের উচ্চতর শ্রেণিতে উঠতে খুব কঠিন করে তোলে। এমন বিরল উদাহরণ আছে যেখানে নির্দিষ্ট শ্রেণির সদস্যদের উত্থান ঘটেছিল এবং এমনকি এই ক্ষেত্রে সদস্যরা কেবল তাঁদের নিজ বর্ণের মধ্যেই উঠে আসে। এই সামাজিক বন্ধনের (Trap) কারণে যৌনশিল্পকে সামাজিক ব্যবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় হিসাবে দেখা হয়। যৌনকর্মের ফলে নিম্নবর্ণের ব্যক্তিরা তাঁদের পরিবারকে বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করতে পারে। স্বল্পমেয়াদে যৌনশিল্পে যাওয়া একটি যৌক্তিক সমাধানের মতো, যেহেতু এই যৌনকর্মীদের বেশিরভাগ অর্থ তাঁদের পরিবারের উন্নতির জন্য ব্যবহৃত হয়। দীর্ঘমেয়াদি যৌনকর্মের পরিণতি যৌনকর্মীরা বিভিন্ন ধরনের গুরুতর ঝুঁকির মুখোমুখি হন, যার মধ্যে রয়েছে যৌন সংক্রমণজনিত রোগ, সুরক্ষা হ্রাস এবং মানবাধিকার হ্রাস।
নেপালে বেশিরভাগ জনসংখ্যাপূর্ণ এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ, (MARPs) যেমন—যৌনকর্মীদের, যাঁরা শরীরে মাদক ইনজেক্ট করে (IDUs), যেসব পুরুষরা (MSM) পুরুষদের সঙ্গে যৌনমিলন করে এবং অভিবাসীদের মধ্যে এইচআইভির (HIV) প্রকোপ বাড়ছে। ১৯৮৮ সাল থেকে যখন নেপালে এইচআইভি/এইডসের প্রথম ঘটনাটি প্রকাশিত হয়েছিল, তখন এইডসের ১,৭৫০ টিরও বেশি এবং এইচআইভি সংক্রমণের ১১,০০০-এরও বেশি মামলা আনুষ্ঠানিকভাবে রিপোর্ট করা হয়েছিল। যেহেতু নেপাল তার জনস্বাস্থ্য নজরদারি সিস্টেমের (Public Health Surveillance) ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ, তাই সারা দেশে সংক্রমণের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে জানা যায়। ইউএনএইডস (UNAIDS) অনুমান করেছে যে, ২০১৮ সালে প্রায় ৩০,০০০ এইচআইভি নিয়ে বাস করছিল। যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি প্রবণতা ধরা পড়েছিল ৪.২ শতাংশ, সাধারণ জনগণের জন্য এটি ০.১ শতাংশ ছিল।
যৌনকর্মে মহিলাদের প্রবেশ কখনো-কখনো একটি অপ্রত্যাশিত মোড় নিতে পারে। যদিও কিছু মহিলা স্বেচ্ছায় যৌনপেশায় প্রবেশ করে, তবে তাঁদের একটা বড়ো অংশ ভারত এবং আশেপাশের অঞ্চলে বৃহত্তর যৌন পাচারের শিকার হয়। ভারতে মেয়ে পাচার একটি বড়ো সমস্যা, যা আন্তর্জাতিক সংবাদে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ৭,০০০ নেপালি মেয়েকে ভারতে পাচার করা হয়, যেখানে তাঁদের যৌনকর্মে বাধ্য করা হয়। নেপালি মহিলা এবং মেয়েদের (বিশেষত কুমারী), ভারতের যৌনবাজারে খুবই চাহিদা। কারণ তাঁদের ফর্সা চামড়া এবং তরুণ চেহারার (Young Look) কারণে তাঁদের সর্বদাই কমবয়সি মনে হয়। চিন ও নেপালের মধ্যে উন্মুক্ত সীমানার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিপুল সংখ্যক নেপালি মহিলা গণিকাবৃত্তিতে অথবা চিনা পুরুষদের কাছে নববধূ হিসাবে বিক্রি হয়েছে।
যৌনশিল্পে জীবনযাপন করার সময় অনেকেই যুক্তি দিয়েছিলেন যে, এ পেশা মানবাধিকার হারানোর মতো সাধারণ ঝুঁকি। অনেক সময়, বিশেষত নেপালে, যৌনশিল্প সংক্রান্ত অপরাধ সংগঠিত হয়। নেপালের মতো দেশগুলিতে যৌনশিল্পে মোট দেশজ উৎপাদনের ২ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে অবদান রাখে। এই কারণে কর্মকর্তা এবং পুলিশরা এসব দুর্নীতির জন্য সক্রিয় থাকে। এটি যৌনকর্মীদেরকে দুর্বল অবস্থানে ফেলেছে। কারণ প্রতিষ্ঠানটি তাঁদের সুরক্ষার জন্য বাধ্য হয় এবং তাঁদের সমস্যাগুলিকে উপেক্ষা করে এবং নির্যাতনে অংশ নেয়। যৌনকর্মীরা যদি এইসব কর্মকর্তাদের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাত, তাহলে তাঁদের নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ দাবি করতে পারত। নেপালে নেপালি ক্লায়েন্টদের জন্য কিছু চিনা যৌনকর্মীও আছে। নেপালের পুলিশ নেপালি পুরুষদের জন্য চিনা যৌনকর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে। নেপাল দেশটি হল নারী ও শিশু পাচারের উৎস, ট্রানজিট এবং গন্তব্য দেশ। নেপালি মেয়েরা ভারত, মধ্য প্রাচ্য, এশিয়া এবং উপ-সাহারা আফ্রিকাতে যৌন পাচারের শিকার হয়। বিপুল সংখ্যক নেপালি যাঁরা ভারতে ভ্রমণ করেন বা অনিবন্ধিত (Unregistered) এজেন্টদের উপর নির্ভর করে এবং অভিবাসীরা বিশেষত যৌন পাচারের ঝুঁকির মধ্যেই থাকে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং সম্ভবত অন্যান্য দেশ থেকে কিছু অভিবাসী নেপালকে মধ্য প্রাচ্যের কর্মসংস্থানের পরিবহন পথ করে। সম্ভাব্যভাবে নকল নেপালি ভ্রমণের নথি ব্যবহার করে এবং মানব পাচারের বিষয় হয়। কিছু সরকারি কর্মকর্তা নেপালি নকল পরিচয়পত্র এবং ভুয়া তথ্য অন্তর্ভুক্ত করতে বা সম্ভাব্য শ্রম অভিবাসীদের প্রতারণামূলক নথি সরবরাহের জন্য ঘুষ গ্রহণ করে বলে অভিযোগ করা আছে। ২০১৫ সালের ভূমিকম্পের ফলে বাচ্চা সহ অনেক নেপালি যাঁদের বাড়ি বা জীবিকা ধ্বংস হয়েছে, তারা পাচারের শিকার হয়েছে।
কাঠমান্ডুকে বলা হয় যৌন-শহর। নেপালে ম্যাসেজ পার্লারগুলি আপনাকে কেবল চনমনে হওয়ার ম্যাসেজ পরিসেবা দেয় না, সেইসঙ্গে দুটি পরিসেবাও অফার করে। একটি প্রকৃত দীর্ঘমেয়াদি বডি ম্যাসাজ, স্বল্পমেয়াদি ম্যাসাজ যাতে যৌনসঙ্গম থাকে। গণিকাবৃত্তি নেপালে অবৈধ, যার কারণে গণিকালয় মালিকরা ম্যাসেজ পার্লার, কেবিন রেস্তোঁরা এবং নৃত্য বারের মাধ্যমে যৌনবৃত্তি করে। নেপালের বেশিরভাগ যৌনকর্মী রাস্তায় না-গিয়ে ম্যাসাজ পার্লার এবং ডান্সবারে চাকরি পছন্দ করেন। কারণ তাঁরা পুলিশের অভিযান থেকে নিরাপদ থাকতে পারে এবং আরও ভালো উপার্জন করে তাঁদের সামাজিক অবস্থানও বজায় রাখতে পারে। নেপালের বেশিরভাগ যৌনকর্মী অশিক্ষিত, যৌনকর্মী হওয়ার নীতি এবং সচেতনতা সম্পর্কে অবগত নয়। যৌনকর্মীরা অবশ্যই দারিদ্র্য থেকে স্বল্পমেয়াদি স্বস্তি পান, তবে দীর্ঘ সময় ধরে তাঁরা এইচআইভি/এইডস-এর মতো সামাজিক ট্রমা এবং যৌন সংক্রমণে ভুগতে পারেন।
ধারণা করা হয় যে, ২,০০,০০০ নেপালি মহিলাকে ভারতে গণিকাবৃত্তির জন্য বিক্রি করা হয়েছিল। কিছু মেয়েদের ১১ বছর বয়সে তাঁদের পরিবার দ্বারা বিক্রি করা হয়েছিল। যেহেতু নেপালি মহিলারা বেশ সুন্দরী হিসাবে বিবেচিত হয় এবং খুব অল্প বয়সি বলে মনে হয়, তাই চাহিদাও তুঙ্গে। ক্লায়েন্টরা মনে করে নেপালি মেয়েরা কুমারী এবং এইচআইভি এবং অন্যান্য যৌন সংক্রমণজনিত রোগ (এসটিডি) থেকে মুক্ত, তাই মেয়েদের বেশি দাম দিতে পিছ-পা হয় না। যদিও বোম্বের একটি সার্ভে রিপোর্ট ইঙ্গিত দিয়েছে যে ৫০ শতাংশ গণিকা এইচআইভিতে আক্রান্ত। বর্ণবাদী নেপালের নিম্নবর্ণের যৌনকর্মী, যাঁদের উপার্জন পুরো সম্প্রদায় সমর্থন করে। মেয়েরা কোনো সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ভোগ করেন না এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে ফিরে যান। খুব কম বিবাহিত, কারণ বর্ণের বাইরের পুরুষরা যৌনকর্মীদের সঙ্গে বিয়ে করে না এবং বর্ণের ভিতরে পুরুষরা কেবলমাত্র কমপক্ষে ৩ কন্যা পরিবারের সঙ্গে মেয়েদের বিয়ে করে, যাতে সমাজে আয় রক্ষা করতে পারে। ভাদি সম্প্রদায়ের গণিকারা ৭০ শতাংশই এসটিডি সংক্রামিত। ভারতীয় গণিকালয় থেকে ফিরে আসা নেপালি গণিকা এবং সিজনাল অভিবাসী কর্মীরা যাঁরা তাঁদের পরিসেবা ব্যবহার করেন, তাঁদের মাধ্যমেই নেপালের বিস্তৃত সম্প্রদায়ের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমিত হয়। প্রচলিত প্রতিরোধ কর্মসূচি যেগুলি গণিকাদের কন্ডোম ব্যবহার করতে এবং এটি কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা শেখানোর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। পাচার বন্ধে নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা সফল হয়নি। পরিশেষে, মহিলাদের অবস্থা অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে, যাতে তাঁরা স্বায়ত্তশাসিত ব্যক্তি হিসাবে বিবেচিত হয়, যাঁরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারে।
একুশ বর্ষীয়া মায়া নামে একজন নেপালি যৌনকর্মীর গল্প বলি। নেপালের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় খানারে যেখান থেকে তিনি প্রায় ৫ কিলোমিটার (৩.১০ মাইল) শহর ইটাহাড়িতে এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ইটাহাড়ি, এটি নেপাল এবং ভারতকে সংযোগকারী একটি হাইওয়ে, যা একটি উন্মুক্ত সীমান্ত ভাগ, এটি যৌন-ব্যাবসার জন্য একটি যথার্থ শহর। শহরটি ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছে একটি জনপ্রিয় গন্তব্য, যাঁরা যৌনকর্মী ভাড়া নিতে চায়।
মায়া জানায় যে, ১৪ বছর বয়স থেকে তিনি এই শহরের যৌনশিল্পে কাজ করছে। ২০১৩ সালে, তিনি যে হোটেলটিতে কাজ করেছিলেন সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল এমন একজনকে বিয়ে করেছিলেন। তখন তিনি যৌনপেশা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। লোকটি তাঁর বা অন্য কোনও যৌনকর্মীর ক্লায়েন্ট ছিল না। তবে তাঁর মেয়ে স্বস্তিকার যখন তিন মাস বয়স তখন স্বামী মায়াকে ত্যাগ করল। মায়া তখন যৌনশিল্পে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। তিনি দিনের বেলা ক্লায়েন্টদের সঙ্গে দেখা করেন, যখন কোনও প্রতিবেশী স্বস্তিকার দেখাশোনা করে। কারণ সে রাতে বাচ্চার জন্য সময় দেয়। সে এক সপ্তাহে ২,০০০ রুপি (১৮.৭১ ডলার) থেকে ৫০০০ টাকা (৪৬.৭৭ ডলার)-এর মধ্যে আয় করেন। এটি কোনো বাড়িতে বা হোটেল ক্লিনারের উপার্জনের চেয়ে অনেক বেশি। মাত্র অষ্টম শ্রেণির পড়াশোনা নিয়ে মায়া, যিনি তাঁর মেয়ের সঙ্গে ভাড়া ঘরে থাকে। সে বলে। তাঁর কাছে অন্য কিছু উপায় নেই। মায়া বলে, “এই পেশা আমার পছন্দ হওয়ার কারণে নয়, তবে আমি এই কাজটি করতে বাধ্য হই।” কাঠমান্ডু আসার দু-বছর পরে এক বন্ধু তাঁকে বলেছিল একটি কারখানায় কাজ করলে সে বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারবে। মায়া যখন এই পরিকল্পনার সঙ্গে একমত হয়ে গেল, বন্ধুটি তাঁকে কোনো কারখানায় নয়, ইটাহারির এক হোটেলে নিয়ে গেল এবং তাঁকে সেখানে রেখে গেল। এমতাবস্থায় মায়া খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। জায়গাটি নতুন ছিল এবং কাউকে চিনত না। এখানে তাঁকে কী করতে কী তাঁর কাজ সে কিছুই জানত না। এদিকে হোটেল মালিক তো মায়াকে কী করতে পারে তার অপশন দিল। (১) হোটেলটি ছেড়ে দিতে হবে, (২) হোটেলে থেকে ফাইফরমাস খাটতে হবে এবং (৩) যৌনকর্মী হিসাবে কাজ করতে হবে। মোদ্দা কথা বসে খাওয়া চলবে না। দুই সপ্তাহ পর মায়া যৌনকর্মী হিসাবে কাজ করতে রাজি হয়ে যায়। তিনটি অপশনের মধ্যে যে গণিকাবৃত্তিতেই ফায়দা বেশি, সেটা ১৪ বর্ষীয় মায়ার বুঝে নিতে বিলম্ব হয়নি। তরুণ কিশোর ক্লায়েন্টদের কাছে সে খুব জনপ্রিয় ছিল। অনেক পুরুষ তাঁর সঙ্গ পাওয়ার আশায় তালিকাবদ্ধ হয়ে অপেক্ষা করত। ওই হোটেলটিতে আরও ৫ জন যৌনকর্মী ছিলেন। তবে তাঁদের সকলেরই বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। হোটেল কোনো গণিকালয় নয়–এটি সাময়িকভাবে থাকার জন্য একটি আদর্শ জায়গা। তবে যে ঘরে ঘুমানো এবং খাওয়ার জন্য খাবার আছে, সেখানকার সাধারণ পরিসেবাগুলি ছাড়াও হোটেলটি যৌনকর্মীও সরবরাহ করত।
যৌন পাচার ও জোরপূর্বক গণিকাবৃত্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্য বিশ্বব্যাপী যৌন-বাণিজ্যকে নিন্দা করা হয়েছে। তবে নেপালের একটি বড়ো যৌন পরিবহন কেন্দ্র ইটাহারিতে। এই বাণিজ্যটি বাড়ছে, কারণ অল্প শিক্ষায় শিক্ষিত অল্পবয়সি মেয়েরা এই পেশা বেছে নিয়েছে। নেপালে যৌন-বাণিজ্য আইন নয়, তাই এটি অবৈধ বা আইনিও নয়। তবুও এই পেশা সমৃদ্ধ হচ্ছে, বিশেষ করে কাঠমান্ডু, পোখারা, সুনসারি এবং কৈলালিতে। নারায়ণ প্রসাদ কাফলে বলেছেন, নেপালে যৌন-বাণিজ্যের বিষয়ে কোনো জাতীয় সমীক্ষা হয়নি, তবে জাতীয় এইডস ও এসটিডি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের ২০১১ সালের এক অনুমান অনুযায়ী দেশে মহিলা যৌনকর্মীর সংখ্যা ২৬,৫০০-এরও বেশি হয়ে গেছে। ২০১০ সালে সুইস ত্রাণ সংস্থা টেরে ডেস হোমস দ্বারা পরিচালিত আরেক জরিপে অনুমান করা হয়েছে যে ১১,০০০ থেকে ১৩,০০০-এর মধ্যে কিশোরী ও যুবতীরা কাঠমান্ডু উপত্যকায় বিনোদন শিল্পে কাজ করছিল। যৌন-বাণিজ্য সাধারণত ভালো অর্থ প্রদান করে। অনেকের ধারণা যৌনকর্মীর সংখ্যা আরও। বাড়তে থাকবে। কাঠমান্ডুতে অবস্থিত যৌনকর্মী ফেডারেশনের জাগৃতি মহিলা মহাসংঘের সভাপতি বিজয়া কালাকাল মায়ার মতো বাণিজ্যের অনেক মেয়ে এবং যুবতী মহিলারা সমস্যাগ্রস্ত ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসে। মায়া বলেছেন যে, তাঁর বাবা-মা আলাদা হয়ে যাওয়ার পরে তিনি ১২ বছর বয়সে পশ্চিম নেপালের ডাঙ জেলায় নিজের বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। তিনি নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে গিয়েছিলেন, সেখানে তিনি এক হোটেলে ডিশ ওয়াশার হিসাবে কাজ পেয়েছিলেন এবং মাসে মাসে প্রায় ৩০০ রুপি (২.৮১ ডলার) আয় করেছিলেন। ইটাহারি সংগঠন মহিলা সহযোগী সামুহের সভাপতি বিমল মল্লা ঠাকুরি বলেছেন—মেয়েরা ১২ বছরেরও কম বয়সি। বস্তুত নেপালি মেয়েরা ভারতীয় ক্লায়েন্টদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। কিছু ক্লায়েন্ট এক রাতের জন্য ২০,০০০ টাকা (১৮৭.০৭ ডলার) পর্যন্ত নেপালি গণিকাদের দিয়ে থাকে।
(১২) গ্রিস : প্রাচীন গ্রিসের একটি সাধারণ দিক ছিল গণিকাবৃত্তি। গ্রিসের গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং বিশেষত বহু বন্দরগুলিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গণিকা যৌনপেশায় নিযুক্ত ছিল এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে উপস্থাপন করত। এ পেশায় কোনো গোপনীয়তার ব্যাপার ছিল না। শহরগুলি গণিকালরের নিন্দা করত না বা ঘৃণার চোখে দেখত না। উপরন্তু তাঁরা যাতে ঠিকঠাকভাবে পেশাটি চালিয়ে যেতে পারে তার জন্য রাষ্ট্র কিছু প্রয়োজনীয় নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠা করেছিল। গ্রিসের গণিকাবৃত্তিতে নারী-পুরুষ উভয় আলাদাভাবে জড়িত। প্রধানত পুরুষ ক্লায়েন্টেদের জন্য সকল বয়সের মহিলারা এবং যুবকেরা গণিকা ছিল। একই সঙ্গে অবশ্য মুক্ত মহিলাদের সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কগুলি কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হয়েছিল। ব্যভিচারের ক্ষেত্রে ধরা পড়লে অপরাধীকে হত্যা করার আইনি অধিকার ছিল। ধর্ষণের শাস্তিও একইরকম ছিল। পুরুষের জন্য বিবাহের গড় বয়স ছিল ৩০ বছর বয়স, অল্প বয়সি এথেনিয়ান দাস বা গণিকাদের কাছে না-গিয়ে যৌন-সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইলে তার কোনো বিকল্প ছিল না।
প্রাচীন গ্রিসের ধ্রুপদী যুগে পর্নাই (Pornai) ছিল দাস ও বর্বরদের উৎস। হেলেনিস্টিক (Hellenistic) যুগে যুবতী মেয়েদের নাগরিক পিতাদের বাতিল বা পরিত্যক্ত করার বিষয়টি দাসত্ব করা যেতে পারে। অন্যথায় প্রমাণিত না-হওয়া পর্যন্ত এগুলি দাস হিসাবে বিবেচিত হত। পর্নাই সাধারণত পিরিয়াস (অ্যাথেন্সের বন্দর) বা এথেন্সের কেরামাইকোসের মতো ‘রেডলাইট’ এলাকার অবস্থিত গণিকালয়গুলিতে যুক্ত ছিল।
অ্যাথেন্সে কিংবদন্তি আইনপ্রণেতা সলনকে (Solon) নিয়ন্ত্রিত দাম দিয়ে রাষ্ট্রীয় গণিকালয় তৈরি করার কৃতিত্ব দেওয়া হয়। ব্যভিচার রোধ করার জন্য তিনি জনস্বাস্থ্যের পরিমাপ হিসাবে এটি করেছিলেন। এথেন্স যুবক যুবতীদের দ্বারা পরিপূর্ণ এবং সহজাত বাধ্যবাধকতা এবং অনুপযুক্ত দিকের দিকে বিপথগামী হওয়ার অভ্যাস উভয়ই দেখে তাঁরা মহিলাদের ক্রয় করত এবং বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের প্রতিষ্ঠা করত, সজ্জিত করত সাধারণ সবার কাছে। গ্রিক কবি ফিলেমন বলছেন—মহিলাদের উলঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেও আপনি প্রতারিত হবে না। সব কিছু দেখুন। হয়তো আপনি অস্বস্তি বোধ করতে পারেন। আপনার সামান্য বেদনা বোধও হতে পারে। দরজাটি খোলা, একটি ওবোল (গ্রিক মুদ্রা) খরচ করুন। আশা করি সেখানে কোনো ছদ্মবেশ নেই, স্ন্যাং কথাবার্তা নেই বা কোনো গণিকারা আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে না। সরাসরি আপনার ইচ্ছামতো আপনি যেভাবেই চান আপনি বেরিয়ে আসুন, তাঁকে জাহান্নামে বলতে পারেন। কারণ তিনি আপনার কাছে অপরিচিত।
ফিলেমন বিশেষভাবে বলেছেন, সলোনিয়ান গণিকালয়গুলি রোজগার নির্বিশেষে সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য একটি পরিসেবা দিত। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সোলন আফ্রোডাইট পান্ডেমোস মন্দির তৈরি করার জন্য গণিকালয়গুলি থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব ব্যবহার করেছিল। এমনকি যদি এই ঘটনার ঐতিহাসিক যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ থাকে, তবে এটি স্পষ্ট করে যে, ধ্রুপদী এথেন্স গণিকাবৃত্তিকে গণতন্ত্রের অঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করত। গণিকাদের পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে বেশ সস্তাই ছিল। মৌলিক কাজগুলির ক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ নেই। এটি সত্যিকারের দাম (Actual Price) ছিল বা ভালো চুক্তি (Good Deal) হিসাবে চিহ্নিত প্রবাদ ছিল কি না তা নির্ধারণ করা কঠিন।
রাস্তায় কাজ করা স্বাধীন গণিকারা পরের স্তরে ছিল। সম্ভাব্য ক্লায়েন্টদের কাছে সরাসরি তাঁদের কমনীয়তা প্রচারের পাশাপাশি তাঁদের প্রচারের প্রশ্রয় ছিল। এই গণিকাদের বিভিন্ন উৎস ছিল–মেটিক (একটি শহর) মহিলারা, যাঁরা অন্য কাজ খুঁজে পেতেন না বা দরিদ্র বিধবা বা বয়স্ক পর্নাই যাঁরা তাঁদের স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার যৌনপেশায় সফল হয়েছিলেন। এথেন্সে নিবন্ধিত হয়ে রাজস্বও দিতে হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পেশার উপর নির্ভর করে সৌভাগ্যবান হয়েছিল। প্রথম শতাব্দীতে রোমান মিশরের কিষ্টে (Qift)। গণিকাদের প্রবেশের জন্য ১০৮ ড্রাচমা (Drachma) দিয়েছিল।
গণিকাদের শুল্ক মূল্যায়ন করা খুব কঠিন ছিল। পঞ্চম এবং চতুর্থ শতাব্দীতে গণিকারা গড় চার্জ তিন ওবোল থেকে শুরু করে এক ড্রাচমা পর্যন্ত চার্জ করতে পারত। প্যালাটিন নৃতাত্ত্বিক তথ্য উদ্ধৃত করেছে। এক ডজন দর্শনের জন্য পাঁচ ড্রাচমা গ্রাহকের ব্যবস্থা উল্লেখ করেছে। দ্বিতীয় শতাব্দীতে হিটেরার সংলাপে লুসিয়ান গণিকা অ্যাম্পেলিস পরিদর্শনকালে পাঁচটি ড্রাচমা একটি মাঝারি মূল্য (৮, ৩) হিসাবে বিবেচনা করেছেন। একইভাবে একটি অল্প বয়স্ক কুমারী মিনা (গ্রিক মুদ্রা) দাবি করতে পারে, এটি ১০০ ড্রাচমা (৭, ৩), বা গ্রাহককে কাছ থেকে দুই মিনাও দাবি করতে পারে। একজন যুবতী এবং সুন্দরী গণিকা তাঁর সহকর্মীর চেয়েও বেশি দাম নিতে পারে। বয়স্ক গণিকাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট বাজারও ছিল। ক্লায়েন্ট এক্সকুসিভিটি দাবি করলে পারিশ্রমিকও পরিবর্তন হত। একদল বন্ধুও এক্সক্লসিভিটি কিনতে পারে।
অনেক ব্যয়বহুল এবং একচেটিয়া গণিকারা ‘হিটেইরা’ (Hetaera) নামে পরিচিত ছিল, যার অর্থ সহচর। হিটেইরা (Hetairai) ছিলেন সুন্দরী, মার্জিত, সুশিক্ষিত, এঁরা প্রায়শই দক্ষ যৌনকর্মী হয়ে থাকে এবং মুক্ত হিটেইরা তাঁদের নিজস্ব আর্থিক নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিল। হিটেইরাই সাধারণত উচ্চবিত্ত পুরুষদের সঙ্গী ছিল। কখনো-কখনো তাঁরা বয়স্ক পুরুষদের সঙ্গে তাঁদের স্ত্রীদের চেয়ে বেশিবার মদ্যপান অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা কম বয়সিদের কাছে যৌনশিল্পে ‘শিক্ষক হিসাবে কাজ করতেন। হিটেইরা, পর্নাইয়ের গণিকারা পৃথক বা একক ক্লায়েন্টদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক করত এবং যৌনতার পাশাপাশি সাহচর্যও সরবরাহ করত। পর্নাই, হিটেইরাইকে প্রতিটি পৃথক যৌন ক্রিয়াকলাপের পরিবর্তে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সংস্থার জন্য অর্থ প্রদান করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ২ বছর আগে স্ট্রাবো (Strabo) করিন্থ শহরের ভৌগলিক/ঐতিহাসিক বিবরণে করিন্থের অ্যাফ্রোডাইট মন্দিরে মহিলা মন্দির কর্মচারীদের বিষয়ে কিছু মন্তব্য লিখেছিলেন, যা সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৭০০-৪০০ সময়কালের কাছাকাছি। লিখেছেন—“এফ্রোডাইটের (Aphrodite) মন্দিরটি এত সমৃদ্ধ ছিল যে, এটি এক হাজারেরও বেশি হিটেইরাকে কাজে লাগিয়েছিল, যা পুরুষ ও মহিলা উভয়ই দেবীকে দিয়েছিলেন। অনেক লোক তাদের কারণে এই শহরটি পরিদর্শন করত এবং এইভাবে এই হিটাইরা শহরের ধন-সম্পদে অবদান রেখেছিল। কারণ জাহাজের ক্যাপ্টেনরা খুব দৃঢ়ভাবে সেখানে তাঁদের অর্থ ব্যয় করত। একাধিক উপায়ে সেই মহিলাদের যৌন-ব্যবসার দিকে ইঙ্গিত করে। এই মন্দির সম্পর্কে স্ট্রাবো সরাসরিই বলেছেন–“মহিলারা এখানে তাঁদের দেহ দিয়ে অর্থ উপার্জন করতেন।”
খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৪ সালে, অলিম্পিক গেমসে করিন্থের (Corinth) নাগরিক যিনি পেন্টাথলনের প্রশংসিত রানার এবং বিজয়ী ছিলেন, সেই জেনোফোন (Xenophon) নামে এক ব্যক্তি ১০০ জন যুবতী মেয়েকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য দেবীর মন্দিরে উৎসর্গ করেছিলেন। এটি আমরা একটি স্তোত্রের কারণে জানি, যা পিন্ডারকে লিখিত আদেশ দেওয়া হয়েছিল, “এই অতিথি মেয়েদের পেরোথো এবং বিলাসবহুল করিন্থের দাস” হিসাবে স্বাগতম জানায়। ড্যানিয়েল আরনাড (Daniel Arnaud), জুলিয়া অ্যাসান্তে (Julia Assante) এবং স্টেফানি। বুডিন (Stephanie Budin)-এর মতো লিঙ্গ-গবেষকদের কাজ পণ্ডিতদের পুরো ঐতিহ্যকেই সন্দেহযুক্ত করে তুলেছে, যা মন্দিরের ‘পবিত্র’ গণিকাবৃত্তির ধারণাটিকে সন্দেহ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। বুডিন (Budin) পবিত্র গণিকাবৃত্তির ধারণাটিকে একটি মিথ হিসাবে বর্ণনা করেছেন এবং রাজস্বের ভিত্তিতে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, উৎসগুলিতে বর্ণিত রীতিগুলি পারিশ্রমিকহীন আধ্যাত্মিক যৌনতা বা অ-যৌন ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ছিল, সম্ভবত সাংস্কৃতিক অপবাদও ছিল। যদিও আধুনিক যুগে জনপ্রিয়, যদিও এই মতামতটি তাঁর পদ্ধতিগত সমালোচনা না করে চলে যায়নি, এটি একটি আদর্শিক এজেন্ডা বলে অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ধ্রুপদী স্পার্টা (Sparta), প্লুটার্ক (Plutarch) দাবি করেছেন যে, মূল্যবান ধাতু, অর্থের অভাব এবং লাইকুরগাসের (Lycurgus) দ্বারা প্রবর্তিত কঠোর নৈতিক ব্যবস্থা থাকার কারণে কোনো গণিকা ছিল না। প্লুটার্কের বিরোধিতা হিসাবে ব্যাখ্যা করা যেতেই পারে। তবে সারাহ পোমেরো (Sarah Pomeroy) যুক্তি দেখান যে, চিত্রিত করা জমকালো ব্যাঙ্কোয়েট ধর্মনিরপেক্ষ নয় এবং চিত্রিত মহিলাটি তাই গণিকা নয়। স্পার্টান (Spartan) নাগরিকদের জন্য মূল্যবান ধাতু ক্রমশ সুলভ হয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে গণিকাবৃত্তিতে প্রবেশ করা আরও সহজ হয়ে উঠেছিল। ৩৯৭ সালে আউলনের পেরিওসিক গ্রামে এক গণিকার বিরুদ্ধে স্পার্টান পুরুষদের দুর্নীতি করার অভিযোগ করা হয়েছিল। এমনকি হেলেনিস্টিক (Hellenistic) যুগে, স্পার্টায় নামকরা ভাস্কর্যগুলি কোটিনা (Cottina) নামে হিটেইরা দ্বারা উৎসর্গীকৃত ছিল। কোটিনা নামে একটি গণিকালয়ও স্পার্টায় বিদ্যমান বলে মনে হয়েছিল। সে সময়ের গণিকাদের সামাজিক অবস্থার মূল্যায়ন করা কঠিন। তবে অনেকে মনে করেন মহিলা হিসাবে তাঁরা গ্রিক সমাজে প্রান্তিক ছিল। তবে তাদের জীবন বা গণিকালয়ে যে তারা কাজ করেছে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণের কথা জানা যায় না। সম্ভবত গ্রিক গণিকালয়গুলি রোমের মতো ছিল। তবে অসংখ্য লেখক এ বিষয়ে বর্ণনা করেছিলেন এবং পম্পেই শহরে তা সংরক্ষণ করে রেখেছেন। গণিকারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপবাদজনক শব্দের মধ্যে একটি ছিল ‘খামতিপিস’ (Khamaitypes)। প্রাচীন গ্রিকদের কাব্যিক চিন্তাভাবনার এই শব্দটির দ্বারা ‘নীচু’ কিছু বলে মনে হয়েছিল।
লেখক লুসিয়ান (Lucian) গণিকাদের সম্পর্কে বলছেন—এখানকার গণিকারা হয় স্বাধীন। এখানকার উৎসগুলি লাভের উৎস হিসাবে বিবেচনা করা ছাড়া দাস-গণিকারা পরিস্থিতি নিয়ে নিজেকে উদ্বিগ্ন বোধ করে না। প্রাচীন গ্রিক পুরুষরা গণিকা সম্পর্কে কী ধারণা করেছিল তা পুরোপুরি স্পষ্ট। মূলত তাঁদের ক্রিয়াকলাপের বাণিজ্যিক প্রকৃতির জন্য নিন্দিত হয়। গণিকাবৃত্তির দক্ষতা গ্রিক কমেডির চলমান থিম। গণিকা একমাত্র এথেনিয়ান মহিলাই ছিল, যাঁরা অর্থ পরিচালনার কাজ করেছিল। তাদের আচরণের একটি ব্যাখ্যা হল গণিকার পেশা সংক্ষিপ্ত হতে থাকে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের আয়ও হ্রাস পেতে থাকে। ব্যাবসার সমস্ত স্তরেই কম বয়সি এবং সুন্দরী গণিকারা সম্ভবত বয়স্ক, কম আকর্ষণীয় সহকর্মীর চেয়ে বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারে। তাঁদের সীমিত সময়ে যথাসম্ভব পরিমাণ অর্থ অর্জন করতে হয়েছিল। এই ড্রাইভটি অবশ্যই সকল পেশার পক্ষে স্বাভাবিক, যেহেতু প্রত্যেকেই কোনো না-কোনো সময়ের বিপর্যয়ের মুখোমুখি।
চিকিৎসা গণিকাদের দৈনন্দিন জীবনের নামকেওয়াস্তে, খুব আংশিক এবং অসম্পূর্ণ সাহায্য করে। উপার্জন চালিয়ে যাওয়ার জন্য দাস-গণিকাদের যে-কোনো মূল্যে গর্ভাবস্থা এড়াতে হত। গ্রিকরা গর্ভনিরোধকের কৌশলগুলি সম্বন্ধে রোমানদের মতো ততটা পরিচিত নয়। গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস (Hippocrates) একটি গ্রন্থে লিখেছেন–দাস-গণিকারা যে-কোনো মূল্যে গর্ভাবস্থা এড়াতে চাইত। গর্ভাবস্থা থেকে মুক্ত হতে তাঁরা লাফাত এবং নিচু হত, গোড়ালি দিয়ে পাছা স্পর্শ করত। শুক্রাণুকে দূরে রাখতে এবং ঝুঁকি এড়াতে এটাই একমাত্র পথ ছিল। এটাও সম্ভবত মনে হয় যে, পর্নাইয়ের গর্ভপাত বা শিশু হত্যাও একটা পথ ছিল। স্বাধীন গণিকাদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা তেমন স্পষ্ট নয়। সর্বোপরি মেয়েরা এই ‘চাকরিতে প্রশিক্ষিত হত, তাঁদের মায়েদের উত্তরসূরি হতে এবং মায়েরা বৃদ্ধ হলে তাঁদের সাহায্য করত।
গ্রিক মৃৎশিল্পীরাও গণিকাদের প্রতিদিনের জীবন সম্পর্কে অন্তদৃষ্টি তুলে ধরে। তাঁদের প্রতিনিধিত্ব সাধারণত চারটি ভাগে ভাগ করে—বনভোজন দৃশ্য, যৌন ক্রিয়াকলাপ, টয়লেট দৃশ্য এবং তাদের অপব্যবহার চিত্রিত দৃশ্য। টয়লেট দৃশ্যে গণিকাদের শারীরিক আদর্শের চিত্র হিসাবে উপস্থাপিত হয় না; স্তন্যপানরত স্তন, মাংসের রোলস ইত্যাদি। সেখানে একটি কাইলিক্স (এক ধরনের ধাতব পাত্র) আছে, যা একটি গণিকাকে একটি কক্ষে সেই পাত্রে প্রস্রাব করতে হবে। যৌন ক্রিয়াকলাপের উপস্থাপনে গণিকার উপস্থিতির বিষয়টি প্রায়শই একটি পার্সের উপস্থিতি দ্বারা চিহ্নিত করা হত, যা অফার করে যে শরীরী সম্পর্ক হবে তার মধ্যে একটি আর্থিক উপাদান আছে। যা প্রদর্শন করে লিপফ্রোগ (Leapfrog) বা সোডোমি (Sodomy)—এই দুটি অবস্থানই বেশ জটিল এবং দৃশ্যত পৃথক। লিপফ্রোগে মহিলাটি মাটির উপর দুই হাত ভাঁজ করে থাকত। সোডমিকে একজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্য অবনমিত বলে মনে করা হত এবং মনে হয় লিপফ্রোগের অবস্থান (মিশনারি আসনের বিপরীতে) মহিলার পক্ষে কম তৃপ্তিযুক্ত বলে বিবেচিত হত। পরিশেষে, বেশ কয়েকটি ফুলের তোড়া দৃশ্যের প্রতিনিধিত্ব করত, যেখানে গণিকাকে লাঠি বা স্যান্ডেল দেখিয়ে হুমকি দেওয়া হত। গ্রিকরা তাকে অবজ্ঞাপূর্ণ বলে গণ্য করতে বাধ্য করেছিল। যেমন ফেলিটিও, সোডোমি বা একাধিক অংশীদারদের সঙ্গে যৌনমিলন করতে বাধ্য করত। যদিও হিটেইরা গণিকারা নিঃসন্দেহে গ্রিসের সর্বাধিক মুক্ত মহিলা ছিল, তাঁদের মধ্যেও অনেকের ‘সম্মানজনক’ হওয়ার এবং স্বামী বা স্থায়ী সহযোগী খুঁজে পাওয়ার ইচ্ছা ছিল। এথেনিয়াস মন্তব্য করেছেন যে “যখন এই জাতীয় মহিলারা স্বচ্ছল জীবনে পরিবর্তিত হন এবং তাঁরা যে নারীদের সম্মানের প্রতি গর্বিত হন তাঁদের থেকে আরও ভালো হয়। তবে নাগরিক শ্রেণির কোনো মহিলাদের স্বেচ্ছায় হিটেইরা হওয়ার কোনো নজির নেই। এটি অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয়, যেহেতু নাগরিক শ্রেণির মহিলাদের কোনো কাজ করার জন্য কোনো উৎসাহই ছিল না।
গণিকাবৃত্তি ছিল প্রাচীন এবং আধুনিক বিশ্বের প্রায় সমস্ত সংস্কৃতির অংশ। গণিকাবৃত্তির ইতিহাস অত্যন্ত জটিল এবং এটি শুধুমাত্র সহজ জীবনধারণের পছন্দ বা দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির ফল হিসাবেই সহজ এবং বোঝা কঠিন। গণিকাবৃত্তির প্রথম দিকের তথ্যগুলি প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় সুমেরীয় সংস্কৃতির দিনগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত, যেখানে ব্যাবসা এবং নাবিকদের আকর্ষণ করে এমন বাজার-এলাকা বিকাশের পাশাপাশি গণিকাপেশাও সমৃদ্ধ হয়েছিল।
সুমেরীয় দেবী ইন্নানা, যিনি ‘ইশতার’ নামে সুপরিচিত। তিনি মধ্য প্রাচ্য জুড়ে অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উপাসনা ছিলেন। অন্যান্য বিষয়গুলির মধ্যে গণিকা এবং সরকারি কাজের পৃষ্ঠপোেষক ছিলেন। গণিকাবৃত্তি প্রাচীন গ্রিক সমাজের অংশ ছিল, যেখানে এটি যুক্তিসংগতভাবে গৃহীত হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ এবং পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালে অ্যাথেন্সে গণিকাবৃত্তি আইনি ছিল এবং অন্য যে-কোনো পেশার মতোই। যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেককেই তাঁদের আয়ের উপর রাজস্ব দিতে হত। এখানে দুই ধরনের গণিকা বা যৌনকর্মী ছিল—পাই এবং হিটেইরা। পর্নাই শব্দটি ‘ক্রয়যোগ্য হিসাবেও অনুবাদ করা যায় এবং এটি আধুনিক ইংরেজি ভাষায় ‘পর্নোগ্রাফি’ শব্দের উৎসও।
গ্রিসের বেশিরভাগ গণিকাদের মুক্তাঙ্গন ছিল এই পর্নাই শহর, এই পর্নাইরা ছিল রাস্তায় কাজ করা সাধারণ গণিকা। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ক্রীতদাস বা সীমিত অধিকার সহ বিদেশি হিসাবে বিবেচিত হত। সকলেরই যৌন-পরিসেবা দিয়ে অর্থোপার্জনের সুযোগ ছিল। পর্নাই গণিকারা কেবল একটি কৌশল আয়ত্ত করেছিল, সেটা হল চরম যৌন আনন্দ দেওয়া। রাস্তায় যারা কাজ করত তাঁরা নতুন ক্লায়েন্টকে শহরের নির্দিষ্ট জায়গায় প্রলুব্ধ করার জন্য অত্যন্ত উদ্ভাবনী বিপণনের কৌশল অবলম্বন করত, বিশেষ স্যান্ডেল পরত, ‘আমাকে অনুসরণ করুন’ বার্তাটি রাখত। কথিত আছে যে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে এথেনিয়ার একজন রাষ্ট্রপতি ও আইনবিদ সোলন (Solon) পর্নাইয়ে গিজগিজ করা গণিকালয়গুলিকে বিশাল অঙ্কের তহবিল দিয়েছিলেন। পেশাটি ‘গণতান্ত্রিক’ হওয়ায় দাস-গণিকারা তাঁদের স্বাধীনতাকে কিনতে পারত। বেশিরভাগ উচ্চাভিলাষীরাই তাঁদের নিজস্ব গণিকালয় খুলত।
প্রাচীন গ্রিসে কোনো পুরুষের ৩০ বছর বয়সি হওয়ার পরেই তাঁরা বিয়ে করা আশা করত। কিন্তু যৌনকামনা নিবৃত্তির জন্য তাঁরা প্রায়শই গণিকাদের সঙ্গ উপভোগ করত। কখনো-কখনো পুরুষরা দীর্ঘ সময় ধরে একজন রক্ষিতা বা উপপত্নী কাছে রাখত। সেই রক্ষিতার সঙ্গে কেমিস্ট্রি জমে উঠলে কখনো-কখনো তাঁরা বিয়েও করে নিত। যাই হোক, যদি এইরকম একটি বিয়ে যেখানে শিশুর জন্ম দেয়, সেইসব সদ্যজাত শিশুদের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃত ছিল না। সুতরাং দুর্ভাগ্যক্রমে সেইসব শিশুদের মেরে ফেলা হত। এরকম হত্যাকাণ্ড একটি সাধারণ অভ্যাস ছিল।
হিটেইরা গণিকারা যৌনশিল্পে যাত্রীদের এথেন্সে বেশিদিন থাকার জন্য প্ররোচিত করত। কিন্তু এর ফলে শহরটি কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল। স্থানীয় এবং বিদেশি উভয়ই যৌন-পরিসেবা, পাশাপাশি বিবাহিত পুরুষদেরও উপভোগ করত তাঁরা। গ্রিসের বিবাহিত মহিলাদের তেমন স্বাধীনতা ছিল না এবং তাঁরা তাঁদের স্বামীদের অন্যায় সম্পর্কে খুব বেশি কিছু করতেও পারেনি। একটি মামলার প্রমাণ আছে, যেখানে অ্যাথেন্সের এক মহিলা বিবাহবিচ্ছেদের জন্য একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। কারণ হিসাবে উল্লেখ করা ছিল–তাঁর স্বামী গণিকার সঙ্গে জড়িত। যেখানে গণিকাবৃত্তির ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত মহিলারা বেশি স্বাধীনতা ভোগ করত এবং তাঁদের নিজের জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ছিল এবং তাঁরা অর্থ উপার্জন করতে পারত এবং নিজস্ব ব্যাবসা শুরু করতে পারত এবং তাঁরা কী করতে চায় তা স্থির করতে পারত, সেখানে বিবাহিত মহিলারা ছিল ঠুটো জগন্নাথ।
থিসপিয়ায় (বুয়েটিয়া) অ্যাপিকেলের মেয়ে ছিলেন ফ্রেইন (Phryne)। তবে তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি এথেন্সে কাটিয়েছিলেন। যদিও আমরা তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর সঠিক তারিখগুলি জানি না, বিভিন্ন ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন যে, তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৩৭১ সালে। থিবেস লেপ্যাক্টার যুদ্ধের অনেকটা সময় পরে থিপসিয়াকে ধ্বংস করেছিলেন এবং সেখানকার অধিবাসীদের বহিষ্কার করেছিলেন। তাঁর অসাধারণ সৌন্দর্যের জন্য তিনি বিভিন্ন চিত্রশিল্পী এবং ভাস্করদের কাছে দুর্দান্ত মডেল হয়ে ওঠেন, দুর্দান্ত প্রক্সিটেলস (যিনি তাঁর ক্লায়েন্টদের একজনও ছিলেন) সহ। ফ্রেইনের সৌন্দর্য অনেক প্রাচীন গ্রীক পণ্ডিতদেরও ভাবনার বিষয় হয়ে উঠেছিল, যাঁরা তাঁর সুন্দর চেহারার প্রশংসা করেছিলেন, অ্যাথেনিয়াস ফ্রিইনের জীবনের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিলেন—“ফ্রেইন সত্যই সুন্দরী মহিলা ছিলেন। এমনকি ব্যক্তির সেই অংশগুলিতেও, যা সাধারণত দেখা যায় না, কোনোভাবেই তাকে উলঙ্গ দেখা সহজ ছিল না। কারণ তিনি এমন একটি পোশাক পরতেন, যা তাঁর পুরো শরীরকে ঢেকে রাখত এবং সে কখনও প্রকাশ্যে স্নান (সে সময়ে প্রকাশ্যে স্নান করার রীতি ছিল) করত না। কিন্তু ইলেউসিনিয়ার উৎসব এবং পোসেইডোনিয়ার উৎসব উপলক্ষে, তখন তিনি একত্রিত সমস্ত গ্রিকদের সামনে নিজের পোশাকটি খুলে রাখতেন এবং চুল সরিয়ে তিনি সাগরে স্নান করতে যেতেন। আর এঁর থেকেই অ্যাপেলস তাঁর নগ্ন ছবি এফ্রোডাইট আনাদ্যোমিনে তুলেছিলেন এবং প্র্যাক্সাইটেলস ভাস্কর। যিনি তাঁর প্রেমিক ছিলেন, তাঁর দেহ থেকে স্নিডাসের অ্যাফ্রোডাইটকে মডেল করেছিলেন। থিয়েটারের মঞ্চের নীচে অবস্থিত তাঁর ইরোসের মূর্তির পাদদেশে তিনি এই শিলালিপিটি লিখেছিলেন—
“Praxiteles has devoted earnest care
To representing all the love he felt,
Drawing his model from his inmost heart:
I gave myself to Phryne for her wages,
And now I no more charms employ, nor arrows,
Save those of earnest glances at my love.”
অ্যাথেনিয়াস আরও রেকর্ড করেছিলেন যে, ফ্রেইন সম্ভবত তাঁর সময়ের স্বনির্মিত ধনী মহিলা। তিনি তাঁর জীবনের এক পর্যায়ে এত বেশি ধনী হয়েছিলেন যে, তিনি থিবসের দেয়ালগুলির পুনর্নির্মাণের জন্য অর্থের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বে ধ্বংস করেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে, ‘আলেকজান্ডার দ্বারা ধ্বংস, ফ্রেইন দ্য সিটেনিয়ান পুনরুদ্ধার করা লাইনটি দেওয়ালে লিপিবদ্ধ করা হবে। একজন মহিলা—এই বিষয়টির জন্য কেবল কোনও মহিলাই নয়, একজন গণিকা—এই বিষয়টি দেখে ভয় পেয়েছিলেন যে, গ্রেট আলেকজান্ডার ধ্বংস করেছিলেন, ফিরিনের এই প্রস্তাবটি শহরের পৌরপতিরা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং দেয়ালগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।
ফ্রেইনের ‘ঐশ্বরিক’ চেহারা, অবিশ্বাস্য সম্পদ এবং বিখ্যাত প্রেমীদের সত্ত্বেও ইতিহাসের বইগুলিতে ফ্রেইনকে যেভাবে অমর করে তুলেছিল তা তাঁর বিখ্যাত নির্মাতা হলেন এথেনিয়াস। এথেনিয়াস লিখেছেন যে, তাঁর বিরুদ্ধে একটি আর্থিক অভিযোগের জন্য মামলা করা হয়েছিল এবং হাইপ্রেইডস, যিনি তাঁর অন্যতম প্রেমিক ছিলেন তাঁর পক্ষ থেকে তাঁকে রক্ষা করেছিলেন। তিনি অভিযোগের প্রকৃতি নির্দিষ্ট করেননি, যদিও কিছু যাচাই না-করা ঐতিহাসিক উৎস হিসাবে (সিউডো-প্লুটার্ক) উল্লেখ করেছেন যে, তিনি অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন।
যদিও সেদিন আদালতে সত্যই কী ঘটেছিল, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিরাট বিরোধ আছে। তবে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য এক সূত্র (এথেনিয়াসের) একথা বলেছে যে, বিচারকরা তাঁর সুন্দর স্তনদুটি দেখার জন্য হাইপ্রেইডস আদালতের কক্ষে মাঝে ফ্রেইনের পোশাক টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিল। তাঁর যুক্তি ছিল যে, কেবল ঈশ্বরই কোনো দেহকে এত নিখুঁতভাবে তৈরি করতে পারেন এবং তাঁকে হত্যা করা বা কারাবন্দি করাটাকে নিন্দানীয় ও অসম্মানীয় হিসাবে দেখা হয়েছে। ঈশ্বর অসন্তুষ্ট হবেন। অ্যাথেনিয়াস উল্লেখ করেছেন, “এখন ফ্রেইন থিপ্পিয়ার বাসিন্দা এবং ইউটিয়াসের বিরুদ্ধে আর্থিক অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হলেও পরে তিনি খালাস পেয়েছিলেন। যার কারণে ইউথিয়াস এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে, হার্মিপ্লাস আমাদের যেমন বলেছেন, তিনি কখনও কোনো মামলা পরিচালনা করেননি। কিন্তু হাইপ্রেইডস যখন ফ্রেইনের পক্ষে যুক্তি শোনালেন, তিনি মোটেই সফল হননি। তবে এটি স্পষ্ট ছিল যে, বিচারকরা তাঁকে নিন্দা করতে চেয়েছিলেন, তাঁকে আদালতের মাঝামাঝি সময়ে নিয়ে এসেছিলেন এবং ফ্রেইনের গায়ের পোশাকটি টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন এবং তার নগ্ন স্তন প্রদর্শন করিয়েছিলেন। বিচারকদের একটি কুসংস্কারজনক ভয় জাগিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, যাতে তাঁরা অনুকম্পার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় এবং যখন তিনি খালাস পেয়েছিলেন, নিম্নলিখিত আদেশে একটি আদেশ জারি করা হয়েছিল—“এরপরে কোনো বক্তা কারও পক্ষ থেকে দয়া অনুভব করার চেষ্টা করবেন না এবং যে-কোনো পুরুষ বা মহিলা অভিযুক্ত হওয়ার পরে তাঁর মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয় উপস্থিত থাকাকালীন”। যা ফ্রেইনের কাছে হারানো কেস হিসাবে মনে হয়েছিল, হাইপ্রেইডসের অনুপ্রেরণামূলক অভিনয়ের পরে তাঁর পক্ষে দ্রুত একটি জয়ে রূপান্তরিত হয়েছিল। ফ্রেইন আদালতকে বিজয়ী করে তুলেছিলেন। চিত্রকর্ম সহ বিভিন্ন শিল্পকর্মের অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তোলে ফ্রেইন। ফরাসি ভাস্কর আলেকজান্দ্রে ফালগুইয়ার লিখেছেন ভাস্কর্যটি ফ্রেইনির। বিখ্যাত হিটেরাইকে আজ কিছু পণ্ডিত দমনবিরোধী স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে ধর্মভ্রষ্টতার ছদ্মবেশ হিসাবে দেখেন, যদিও আমাদের বেশিরভাগই একমত হবেন, তাঁর জীবনের কিছু পছন্দ কোনো মহিলার পক্ষে সবচেয়ে আদর্শ বা নৈতিক ছিল না।
আধুনিক গ্রিসের হালহকিকৎ কেমন? আধুনিক গ্রিসে আর্থিক পঙ্গুতার কারণে এক টুকরো স্যান্ডউইচের মূল্য সংগ্রহের জন্য যৌন-বিক্রয়কারী কিশোরীরা গণিকাদের দাম সর্বকালের সর্বনিম্ন স্থানে ফেলে দিয়েছে। গ্রিসের পঙ্গু আর্থিক সংকটের অর্থ হল ইউরোপীয় দেশগুলিতে আরও বেশি মহিলারা স্যান্ডউইচের ব্যয়ের চেয়ে কম দামে শরীর বিক্রয় করছে। হ্যাঁ, গ্রিসের কিছু মহিলা স্যান্ডউইচের দামের জন্য শরীর বিক্রয় করছেন। কিছু ক্ষেত্রে যৌন-সেশনের দাম ৫০ ইউরো থেকে কমে মাত্র ২ ডলারে নেমেছে। গণিকাবৃত্তি বৈধ, তবে ৫২৫ গ্রিক গণিকালয়ের মধ্যে ১০ জনেরই লাইসেন্স আছে। একটি নতুন প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে যে, পূর্ব ইউরোপীয় মহিলাদের তুলনায় আরও বেশি গ্রিক মহিলারা কঠিন সময়গুলোতে অনুসরণ করে গ্রিসে গণিকা হিসাবে কাজ করছেন। এথেন্সের প্যান্টিন ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক গ্রেগরি লাজোস (Lazos) এই প্রতিবেদনের লেখককে দাবি করেছেন, “কিছু মহিলা কেবল একটি পনির পাই বা স্যান্ডউইচের জন্য তাঁদের খাওয়ার প্রয়োজনে তাঁরা যৌন-ক্ষুধার্ত হয়। অধ্যাপক লাজোস বলেছিলেন যে, গ্রিসে ১৮,৫০০ জন যৌনকর্মীর নাম লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
গ্রিসে গণিকাবৃত্তি বৈধ এবং মজুরি হ্রাস এবং বর্ধমান বেকারত্বের কারণে এই শিল্পটি দ্রুত বাড়ছে। মিঃ লাজোস বলেছিলেন, ‘মেয়েদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার ইন্ডাস্ট্রি যা তাদের প্রয়োজনের উপর নির্ভর করে ব্যাবসার বাইরে আসা এবং বাইরে চলে যায়, এবং মহিলা গণিকাদের মোট সংখ্যা চমকপ্রদ হয়ে ওঠে। গ্রিক একাডেমিক এক অনুসন্ধানে দেখেছে যে, যৌন-বাণিজ্য শিল্পের ৮০ শতাংশই এখন গ্রিক মহিলারাই প্রাধান্য পাচ্ছে, যা ১০০ মিলিয়ন ডলারের ব্যাবসায় পরিণত হয়েছে। ২০০৪ সালের অলিম্পিক গেমসের আগে গণিকাবৃত্তির আইনে পরিবর্তন আনার প্রস্তাবের প্রতিবাদে গ্রিসের দেড় শতাধিক গণিকা একটি গণিকালয়ের বাইরে আন্দোলন-বিক্ষোভ করেছিলেন। গ্রিক সরকার বেশ কয়েকটি গণিকালয় স্কুল ও গির্জার কাছাকাছি অবস্থিত জানতে পেরে সেগুলি বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল।
‘National Center for Social Research’ ঘোষণা করেছে যে, অর্থনৈতিক সংকট শুরুর পর থেকে গ্রিসে গণিকাবৃত্তির হার ১৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এর অর্থ হল যে মহিলারা সাধারণত যৌনকর্মী হিসাবে কর্মসংস্থান খুঁজছেন না, তাঁরাও এখন সাহায্য করছে এবং উপায় হিসাবে এই পেশার দিকে ঝুঁকছে। ইকেকে (EKKE) পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বর্তমান গ্রিসে ২০,০০০ পতিতাদের মধ্যে মাত্র ১০০০ জনেরও কম মহিলা আইনিভাবে নিবন্ধিত। রাস্তার গণিকাবৃত্তি গ্রিসে অবৈধ, কারণ এঁরা নিরাপদ নয়। আইনি বৈধ গণিকালয়গুলিকে নিরাপদ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কারণ তাঁদের অঞ্চলের নিরাপত্তার পাশাপাশি স্বাস্থ্য স্ক্রিনিং দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই অঞ্চলগুলিতে কর্মরত মহিলাদের একটি নিবন্ধ এবং মেডিকেল কার্ড বহন করা দরকার হয়। অধিকন্তু, দেশে একটি বিশাল নির্ধারিত সংখ্যক পকেট খোলা হয়েছে, যেখান অবৈধ গণিকালয়গুলির সেরা আবরণ। বাইরে থেকে পার্লার বা স্টুডিও মনে হলেও সেগুলি আসলেই মুখোশের আড়ালে গণিকালয়। গ্রিসের গণিকারা ও গণিকালয়গুলি ১৯৯৯ সালে আপডেট হওয়া আইন অনুসারে কাজ করে।
গ্রিসে ১৮ বছর বয়সি হলেই তাঁর জন্য গণিকাবৃত্তি আইনিভাবে বৈধ এবং এটি নিয়ন্ত্রিত। অনুমান করা হয় যে, এক হাজারেরও কম মহিলাই বৈধভাবে গণিকা হিসাবে নিযুক্ত হয়েছেন। প্রায় ২০,০০০ জন নারী, যাঁদের মধ্যে অর্ধেক বিদেশি নারী এবং অন্য অর্ধেক গ্রিক অবৈধ গণিকাবৃত্তিতে লিপ্ত রয়েছেন। অর্থনৈতিক সংকটে আক্রান্ত বহু মহিলা গণিকাতে পরিণত হয়েছেন। নারী-শরীর বিক্রির বাজার আছে, সেই বাজারে বিক্রিও বেশি। বাজার ছোটো হলেও পুরুষ-শরীরও বিক্রি হচ্ছে সেখানে। আকাশচুম্বী বেকারত্বের মোকাবিলা করতে যৌনপেশাই। এখন একটা বিকল্প পথ অবশ্যই।
গণিকাবৃত্তিতে জড়িত ব্যক্তিরা কেবলমাত্র রাষ্ট্র পরিচালিত গণিকালয়গুলিতে (স্টুডিও’ নামেও পরিচিত) কাজ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে মহিলাদের অবশ্যই ১৮ বছরের বেশি হতে হবে, অবিবাহিত হতে হবে, গ্রিসে বাস করার এবং কাজ করার নাগরিক অধিকার থাকতে হবে, এসটিআই থেকে মুক্ত থাকতে হবে। মানসিক অসুস্থতা থাকলে নয়, মাদকাসক্তি থাকলে নয় এবং হত্যা, পিম্পিং, শিশুপর্নো, পাচার, ডাকাতি বা ব্ল্যাকমেইলের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়নি এমন মহিলা গণিকাবৃত্তিতে আসতে পারবে। এছাড়া তাঁদের অবশ্যই স্থানীয় প্রদেশে নিবন্ধন করতে হবে এবং প্রতি দুটি সপ্তাহে আপডেট হওয়া একটি মেডিকেল কার্ড বহন করতে হবে। গ্রিক কর্তৃপক্ষ ১৯৯৯ সালের আইন বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার অধীনে বলা হয়েছে যে, সমস্ত গণিকালয়কে অবশ্যই অনুমতি দেওয়া উচিত। অনুমতি সাধারণত রাজ্যের প্রবীণ মহিলাদের দ্বারা দেওয়া হয়। এই প্রবীণ মহিলাগুলির মধ্যে বেশিরভাগই প্রাক্তন গণিকা। গণিকালয়গুলি সর্বজনীন ভবন থেকে কমপক্ষে ২০০ মিটার দূরে থাকতে হবে। ২০০৪ সালের অ্যাথেন্স অলিম্পিকের আগে এটি কমিয়ে ১০০ মিটার করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু গ্রিক সরকার এই প্রস্তাবটি কার্যকর করেনি। ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে গ্রিসে এইচআইভি সংক্রমণ ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এইচআইভির হার এক বছরে এতটা বৃদ্ধির ফলে অ্যাথেন্সের কর্তৃপক্ষ অনেক মাদকসেবী এবং গণিকাদের গ্রেপ্তার করেছিল এবং এই ব্যক্তিদের উপর। এইচআইভি জন্য বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষা পরিচালনা করেছিল। মিডিয়া পাচারে জড়িত ছিল এবং যাঁরা এইচআইভি পজিটিভ ছিল তাঁদের নাম এবং ছবি প্রকাশ করেছিল। এই পদক্ষেপটি গণিকাদের যদি ইতিবাচক পরীক্ষার জন্য তাদের নাম প্রকাশিত হয়, তবে তাঁদের পরীক্ষা করা থেকে সতর্ক করে তুলেছিল। গ্রিসে এইচআইভি সংক্রমণ ২০০ শতাংশ বৃদ্ধির মূল কারণ যৌনকর্মী এবং ক্লায়েন্টদের মধ্যে কন্ডোমের ব্যবহার। খুবই বিরল (ইউএনএআইডিএস দ্বারা অনুমান করা হয় ৮.৭ শতাংশ)। এটি এইচআইভি এবং অন্যান্য এসটিআই সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
গ্রিস একটি যৌনকর্মীদের ডেসটিনেশন, ট্রানজিট এবং খুব সীমিত পরিমাণে হলেও নারী ও শিশুদের যৌন পাচারের শিকার হওয়ার উৎস দেশ। পূর্ব ও দক্ষিণ ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম আফ্রিকা এবং পূর্ব এশিয়ার কিছু মহিলা এবং শিশুরা রাস্তায়, স্ট্রিপ ক্লাব, ম্যাসেজ সেলুন এবং হোটেলগুলিতে লাইসেন্সবিহীন গণিকালয়গুলির জন্য যৌন পাচারের শিকার হয়েছে। গ্রিসে অবিসংবাদিত শিশু অভিবাসী বৃদ্ধির ফলে শোষণের শিকার শিশুদের সংখ্যা বেড়েছে। কিছু পাবলিক কর্মকর্তাকেও মানব পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি ২৩৩/২০০৩ যৌন পাচার এবং জোরপূর্বক যৌনশ্রম উভয়ই নিষিদ্ধ এবং ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের শাস্তি নির্ধারণ করে। ২০১৫ সালে পুলিশ ১৮ টি যৌন পাচারের ঘটনা তদন্ত করেছিল। সরকার ২০১৬ সালে যৌন পাচারের জন্য ২৫ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। পুলিশ ২০১৫ সালে ৩৪ জনের মধ্যে পাঁচ শিশু সহ ২৬ জন যৌন পাচারের শিকারকে সনাক্ত করেছে।
(১৩) বাংলাদেশ : বাংলাদেশে গণিকাবৃত্তি আইন অনুযায়ী বৈধ, তবে তা নিয়ন্ত্রিত। গণিকা হিসাবে কাজ করতে হলে তাঁকে অবশ্যই রেজিস্ট্রি করতে হবে এবং আদালতে উপস্থিত হয়ে একটি হলফনামা জমা দিতে হবে এই মর্মে যে, তাঁরা তাঁদের নিজস্ব পছন্দ ও জোরজবরদস্তি ছাড়াই গণিকাবৃত্তিকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে এবং তাঁরা অন্য কোনো পেশা খুঁজে পেতে অসমর্থ। তবে বাংলাদেশের সংবিধান বলছে যে, “রাষ্ট্র জুয়া ও গণিকাবৃত্তি প্রতিরোধ করবে।” তবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিশু গণিকাবৃত্তি, জোরপূর্বক গণিকাবৃত্তি, অবৈধ গণিকালয় ইত্যাদির বিরুদ্ধে আইন বলবৎ আছে। বিভিন্ন আইন কখনো-কখনো গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। ২০০০ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত রায় দেয় যে, দেশে ১০০ জন গণিকা গ্রেফতার অভিযান ছিল বেআইনি। যদিও এ দেশে গণিকাবৃত্তি একটি বৈধ পেশা। তবে প্রায়ই পুলিশ বাহিনী বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে হোটেলে বেআইনি গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে অভিযান করে এবং গণিকা ও তাঁদের গ্রাহক উভয়কে গ্রেপ্তার করে আদালতে চালান করে দেয়। বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ৩৭২, ৩৭৩, ৩৬৪ (ক) ও ৩৬৬ (খ) ধারায় গণিকাবৃত্তির উদ্দেশ্যে অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্রয়-বিক্রয়ের শাস্তির বিধান বর্ণনা করা হয়েছে।
এক সময় গণিকাবৃত্তি কেবল গণিকালয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে সে সময় গণিকাদের সংখ্যা নিরূপণ করা সহজ ছিল। বর্তমানে অনিবন্ধিত বা পার্টটাইম দেহব্যবসায়ীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে। শুধুমাত্র গণিকালয়ে জরিপ চালিয়ে পরিসংখ্যান তৈরি করা সম্ভব নয় কত সংখ্যক মহিলা যৌনপেশায় জড়িত। স্থানীয় কিছু এনজিওর হিসাবে ২০০৮ সালে মহিলা গণিকার সংখ্যা ছিল আনুমানিক ১,০০,০০০ লাখ। ২০১৬ সালে ইউএনএইডসের হিসাবে এই সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১,৪০,০০০।
বাংলাদেশে ১৪ টি বৈধ গণিকালয় আছে। অর্থাৎ এই গণিকালয়গুলি বাংলাদেশে সরকার দ্বারা অনুমোদিত। এগুলি হল টাঙ্গাইল শহরের বেবিস্ট্যান্ড কান্দাপাড়া গণিকালয়, রাজবাড়ি জেলার দৌলতদিয়া গণিকালয়, খুলনার সুন্দরবন সংলগ্ন বাণীশান্তা গণিকালয়, যশোরের বাবুবাজার গণিকালয়, মাড়োয়ারি মন্দির গণিকালয়, ঝালাইপট্টি গণিকালয়, ফরিদপুর শহরের রথখোলা গণিকালয়, ময়মনসিংহ গাঙ্গিনাপাড় গণিকালয়, জামালপুরের রানিগঞ্জ গণিকালয় ইত্যাদি। এসব গণিকালয়ে সরকার অনুমোদিত লাইসেন্সধারী গণিকা আছে। মজার বিষয় হচ্ছে, এইসব লাইসেন্সধারী গণিকাদের একটি বড়ো অংশই হল ১৮ বছরের নিচে। এঁরা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে লাইসেন্স নিয়ে কাজ করছে। “The Global March Against child Labour’-এর হিসাব মতে বাংলাদেশে ১৮ বছরের নিচে গণিকার সংখ্যা প্রায় ২০,০০০। ২০০৫ সালে মার্কিন সরকারের মানবাধিকার রিপোর্ট অনুসারে অবশ্য ১৮ বছরের নিচে গণিকার সংখ্যা ছিল ২৯ হাজারের বেশি। এসব শিশু গণিকারা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গ্রোথ বাড়ানোর জন্য গোরুর জন্য ব্যবহৃত মোটা-তাজাকরণ ট্যাবলেট সেবন করে এবং দৈনিক ১৫-২০ জন পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়। গত ২০১৬ সালে ব্রিটেনের ‘ইন্ডিপেনডেন্ট’ পত্রিকা বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার কান্দাপাড়া গণিকালয় নিয়ে একটি রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টে জানানো হয়, এই গণিকালয়ে একটি নারী প্রবেশ করে ১২-১৪ বছর বয়সে। গত বছর বিদেশি কয়েকটি মিডিয়ায় বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার কান্দাপাড়া গণিকালয় গণিকাদের ছবিসহ নাম প্রকাশ পায়। সেখানে খদ্দেরকে আলিঙ্গনরত অবস্থায় ১৪ বছর বয়সি আসমা, ১৭ বছর বয়সি কাজল, ১৫ বছর বয়সি পাখি, ১৭ বছর বয়সি সুমাইয়াকে দেখা যায়। বাংলাদেশ মানব পাচারের জন্য একটি উৎস, ট্রানজিট ও গন্তব্য দেশের মধ্যে অগ্রগণ্য। এখানে নারী ও শিশুদের পাচারের শিকার হতে হয়। এখানকার মেয়েদের পাচার করে ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়, যাঁদের অধিকাংশই যৌনপেশায় জড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যে-কটি গণিকালয় আছে, তার মধ্যে দৌলতদিয়া গণিকালয় দেশের মধ্যে বৃহত্তম। এটি পৃথিবীর বড়ো কয়েকটি গণিকালয়ের মধ্যেও একটি। এখানে আমি দৌলতদিয়া গণিকালয় ছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রথম সারিতে থাকা গণিকালয়ের কথা উল্লেখ করব। দৌলতদিয়া গণিকালয় দিয়ে শুরু করি।
দৌলতদিয়া গণিকালয় : দৌলতদিয়া গণিকালয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো গণিকালয়। এটি এশিয়ার সবচেয়ে বড়ো গণিকালয়গুলোর একটি। এখানে প্রায় ৪,০০০ যৌনকর্মী যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত। দৌলতদিয়া গণিকালয়টি বাংলাদেশের রাজবাড়ি জেলার অন্তর্গত গোয়ালন্দ উপজেলায় অবস্থিত। গোয়ালন্দ উপজেলার একটি ইউনিয়ন হল দৌলতদিয়া। দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে গণিকালয়টি অবস্থিত। ১৯৮৮ সালের দিকে এটি প্রতিষ্ঠিত বলা হলেও সংশ্লিষ্ট স্থানে বহুকাল আগে থেকেই গণিকাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বাস করতেন এবং অননুমোদিত ও অবৈধ গণিকালয় হিসাবে কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল। বর্তমানে এখানে সরকারি হিসাবে প্রায় ১,৫০০ যৌনকর্মী থাকে। প্রতিদিন প্রায় ২০০০ থেকে ৩০০০ জন ব্যক্তি এখানে যৌন পরিসেবা নিতে আসেন। শরীরে জৌলুস। বাড়াতে বা অক্ষুণ্ণ রাখতে কাউ প্রোটিন albumin সেবন করে থাকে। ২০ টি ট্যাবলেটের দাম ১০ টাকা।
দৌলতদিয়া গণিকালয়টি সরকারি অনুমোদিত হলেও বিভিন্ন সময় এখানে আইন বহির্ভুত কাজকর্ম চলছে। যেমন, বেআইনিভাবে জোরপূর্বক কোনো মহিলাকে যৌনপেশায় বাধ্য করা বা নারী পাচারের মতো অভিযোগ রয়েছে। গণিকালয়ের অভ্যন্তরে নানা রকম মাদকদ্রব্য বিক্রি ছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ ওষুধ সেবন, অপ্রাপ্তবয়স্ক যৌনকর্মী নিয়োগ, তাঁদের উপর শারীরিক নির্যাতনসহ অনেক অমানবিক ও বেআইনি কার্যকর্ম সংগঠিত হওয়ার অভিযোগ আছে। বিভিন্ন এনজিও এবং সামাজিক সংগঠনরা মনে করেন যৌনকর্মীরা এখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করে এবং অনেক সময় বিভিন্নভাবে তাঁদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। দৌলতদিয়া গণিকাপল্লির গণিকাদের পারিশ্রমিক প্রতি ঘণ্টায় ১০০ টাকা থেকে শুরু। দরকষাকষিও চলে।
দীর্ঘ ৪৭ বছর পর গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া বর্তমানে নতুন নামে পরিচিত হচ্ছে সরকারিভাবে। দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হাসিনা সরকার নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে একটি গেজেট প্রকাশ করেছে। নাম পরিবর্তনের কারণ গণিকালয় তকমা থাকায় এই অঞ্চলের বসবাসকারী গণিকাদের ছেলেমেয়েদের কোনো স্কুলে ভর্তি নিত না। ফলে তারা পড়াশোনার কোনো সুযোগ পেত না। উক্ত গেজেটবলে ‘দৌলতদিয়া গণিকালয়’ পরিবর্তে ‘দৌলতদিয়া বাজার পূর্বপাড়া’ বলে পরিচিত হয়েছে। বর্তমানে এই গণিকাপল্লির সন্তানেরা পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। স্থানীয় স্কুলগুলোও খুশি।
কান্দাপাড়া গণিকালয় : কান্দাপাড়া গণিকালয় বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন গণিকালয়। প্রায় ২০০ বছর আগে এই গণিকালয়ের গোড়াপত্তন হয়, দেশভাগের আগে অবিভক্ত ভারতে অবস্থিত ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে গণিকালয়টি জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়। উচ্ছেদের আগে পর্যন্ত এই গণিকালয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম গণিকালয় হিসাবে বিখ্যাত ছিল। কান্দাপাড়া গণিকালয়টি বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলায় অবস্থিত। কান্দাপাড়া গণিকালয়ে মোট ঘর আছে প্রায় ৮০০টি। এখানে প্রায় ৯০০ জন যৌনকর্মী বসবাস করেন। এই গণিকালয়কে ব্যবহার করে কোনো মহিলাকে বসবাস ও যৌনপেশা হিসেবে গ্রহণ করতে হলে সেই মহিলাকে আদালতে উপস্থিত হয়ে একটি হলফনামা জমা দিতে হয়। এই মর্মে যে, তাঁরা তাঁদের নিজস্ব পছন্দ ও জোরজবরদস্তি ছাড়াই যৌনপেশাকে বেছে নিয়েছে এবং একই সঙ্গে এটাও উল্লেখ করতে হবে যে, তাঁরা অন্য কোনো পেশা গ্রহণ করতে বা খুঁজে পেতে অসমর্থ। কান্দাপাড়া গণিকালয়ে বৈধ যৌনকর্মীর সংখ্যা ৯০০ জন বলা হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা অনেকগুণ বেশি। ২০১৪ সালের শেষের দিকে ‘Bangladesh National Women Lawyers Association’ যৌনকর্মীদের উচ্ছেদকে অবৈধ কর্মকাণ্ড বলে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে এক মামলা দায়ের করে। আদালত তাঁদের আবেদনের পক্ষে রায় দেন। ফলে কান্দাপাড়ার যৌনকর্মীরা তাঁদের পুরোনো আবাস ও পেশা ফিরে পায়। বর্তমানে কান্দাপাড়া গণিকালয়টি ২ মিটার দেয়াল। দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। এই পাঁচিল পরিবৃত্তের ভিতরে মূল গণিকালয়টি অবস্থিত। মূল গণিকালয়ের ভিতরে সরু সরু রাস্তা আছে, আর রাস্তার পাশ দিয়ে বিভিন্ন দোকানপত্র আছে। জার্মান আলোকচিত্রশিল্পী সান্দ্রা হোইন কান্দাপাড়া গণিকালয়ে আসেন এবং এখানকার জীবনমান ও গণিকালয়ের অবস্থা নিয়ে ছবি তোলেন। ছবিগুলো প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক মহলের কাছে কান্দাপাড়া গণিকালয়ের দুরবস্থার চিত্র প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যৌন পরিসেবা নিতে এলেও ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে কান্দাপাড়া গণিকালয়কে বিভিন্ন সময় হামলা ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। বাংলাদেশে সামাজিক ভাবে গণিকা ঘৃণ্য চোখে দেখা হয়।
টানবাজার গণিকালয় : টানবাজার গণিকালয় বাংলাদেশের আর-একটি গণিকালয়। ধারণা করা হয় যে, প্রায় ৪০০ বছর আগে অর্থাৎ অবিভক্ত ভারত-ভূখণ্ডে এই গণিকালয়ের যাত্রা শুরু হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালে গণিকালয়টি উচ্ছেদ করে দেওয়ার আগে এটি ছিল দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো গণিকালয়গুলির মধ্যে একটি। টানবাজার গণিকালয় নারায়ণগঞ্জ জেলার টানবাজার পার্কের পাশে কুটিপাড়ায় অবস্থিত ছিল। টানবাজার মূলত রং, সুতো ও কেমিক্যাল পণ্যের ব্যাবসার জন্য বিখ্যাত। এই গণিকালয়ে যাওয়ার জন্য দুটি রাস্তা ছিল। একটি ‘আশা’ ও ‘মাশা’ নামের সিনেমা হলের পাশ দিয়ে এবং অন্যটি টানবাজার মসজিদের পাশ দিয়ে। প্রায় ৩ একর জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছিল এই গণিকালয়টি। টানবাজার গণিকালয় বর্তমানে মোহাম্মদ কমপ্লেক্স’-এ এসেছে। তবে পুরোনো গণিকালয়ের ৪/৫ তলা কিছু ভবন এখনও আছে। এখান থেকে যৌনকর্মীরা গোটা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
টানবাজার গণিকালয়ে প্রায় ২০০০টি ঘরে ৩৫০০ জনের বেশি যৌনকর্মী যৌনপেশার সঙ্গে জড়িত ছিল। যাঁদের অনেকেই বংশানুক্রমে সেখানে বসবাস করত। প্রায় ৪০০ বছর ধরে সেখানে যৌনপেশাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ড়া গণিকালয়টি গড়ে উঠেছিল। ১৯৯৯ সালে সাধারণ একশ্রেণির জনগণ ও পুলিশ একযোগে আচমকা মধ্যরাতে যৌনকর্মীদের উপর হামলা করে এবং তাঁদের সেখান থেকে বের করে দেয়। যৌনকর্মীদের আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্য যে মন্দির ছিল, সেই ‘মা ফাতিমা মন্দির’ও ভেঙে ফেলা হয়। কোনোরকম পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়াই তাঁদের উচ্ছেদ করা হয়। এর প্রতিবাদে গোটা বাংলাদেশে বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। গণিকালয় রক্ষা আন্দোলনে সেই সময় যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম সর্দারনি ছিলেন রিতা খানম।
বাংলাদেশের জনৈক সাংসদ শামীম ওসমান বলেন, “এই গণিকাপল্লিতে ১১,০০০ মেয়ে ছিল, যাঁদের বয়স ৯ থেকে ১১ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশের অনেক বড়ড়া বড়ো লোক, যাঁরা আজকে টিভি টকশোতে কথা বলেন বা বড়ো বড়ো পত্রিকার সঙ্গে জড়িত সুশীল সমাজ। এখান থেকে প্রতি মাসে ৩০০ করে মেয়ে নিয়ে পুনর্বাসন দেখাত। পুনর্বাসন দেখিয়ে মাথাপিছু ৫০,০০০ টাকা নিত। সাংসদ দাবি করেছেন, টানবাজার গণিকাপল্লি থেকে থানা পেত প্রতিদিন ৪৫ লাখ টাকা। ৪৫ লাখ!
গাঙ্গিনাপাড় পতিতালয় : গাঙ্গিনাপাড় গণিকালয় ময়মনসিংহ রেলস্টেশন থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরে। ভবনের উপরে বিশাল সাইনবোর্ডে লেখা—“আসুন, এইডস থেকে বাঁচুন”। নাজমা বোডিং’ নামে একটা গণিকালয়। সরকার অনুমোদিত গণিকালয়গুলির একটি হল গাঙ্গিনাপাড়। ৪০,০০০ টাকায় মিলে যায় রেজিস্ট্রেশন। দুই পুলিশ কর্মকর্তার গ্রিন সিগন্যাল আর টাকা দিলেই মেলে যৌনপেশার রেজিস্ট্রেশন নম্বর। এখানে আনুমানিক ৪০ জন সর্দারনির অধীনে ৪০০ থেকে ৫০০ মেয়ে যৌনপেশায় যুক্ত আছে। যৌনকর্মীদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ভবনে ছোটো ছোটো নিজস্ব ঘর। এক একটা ঘরের ভাড়া ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা। ঘরগুলি এক-একজনের নামে পরিচিতি। ঘোট ঘোট এসব রুম সর্দারনিরা দৈনিক ভিত্তিক ভাড়া নিয়ে থাকেন। ঘরের মূল মালিককে দেওয়া হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। বেশির ভাগ সর্দারনী আবার ভাড়া দেন নিয়ন্ত্রণে থাকা গণিকাদের কাছে। তাদের কাছ থেকে আদায় করা হয় দৈনিক ১,০০০ থেকে ১,৫০০ টাকা। কোনো-কোনো ঘরে টাঙানো রয়েছে গণিকার বাঁধাই করা বড়ো ছবি। ময়মনসিংহের এই গণিকালয়ে কিশোর-যুবকদের ক্লায়েন্টদের ক্রমাগত বৃদ্ধি লক্ষণীয়। প্রতিদিন পাঁচ শতাধিক ক্লায়েন্ট এই কিশোর-যুবকরাই। এখানে কিশোরী গণিকাদের প্রচুর চাহিদা। ক্লায়েন্টদের পছন্দের তালিকায় এইসব কিশোরীরাই। রাত ১১টা পর্যন্ত আসা-যাওয়া চলে। তারপর বন্ধ হয়ে যায় গণিকালয়ের প্রধান ফটক। ভিতরে চলে যৌনপ্রমোদ। সেখানে পাহারায় থাকে বেতনভোগী দারোয়ান। শহরের প্রাণকেন্দ্র রমেশ সেন এলাকায় প্রতিষ্ঠিত এই গণিকালয়ের বয়স প্রায় ১৫০ বছর।
২০০১ সাল থেকে গণিকালয় নিয়ন্ত্রণে ‘শুকতারা কল্যাণ সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন আছে। এই সংগঠনে আছে ১১ সদস্যের নির্বাচিত কমিটি। ২ বছর পরপর যৌনকর্মীদের সরাসরি ভোটে এ কমিটি নির্বাচন করা হয়। এই সংগঠনের সভাপতি লাভলি প্রায় ৩০ বছর ধরে এই পল্লিতে পেশাগত কারণে বসবাস করে। সাধারণ সম্পাদক রুমানা আক্তার। কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে লাভলি বলেন—গণিকালয়ের যৌনকর্মীদের অধিকার আদায়ে তাঁরা কঠোর ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন। কাউকে ধরে নিলে কিংবা নতুন মেয়ে আনলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা তাঁরাই গ্রহণ করেন। অভিযোগ রয়েছে, মূলত নেত্রীদের দ্বারাই সাধারণ যৌনকর্মীরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হচ্ছে। অপরদিকে নেত্রীরা টাকার কুমির বনে গেছে। তিনি বলেন, আগে কোনো সংস্থা বা কমিটি না-থাকায় যৌনকর্মীরা ছিলেন অসহায়। এখন সময় পাল্টেছে। নিজেদের পেশাকে করেছি নিরাপদ। এদিকে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিকবার গণিকালয়ের কাজকর্ম বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শেষপর্যন্ত তা কার্যকর করতে পারেনি প্রশাসন। সভাপতি লাভলি বলেন, আমরা সেক্স করে জীবিকা নির্বাহ করছি। যতদিন ভালো লাগবে এ পেশায় থাকব। এ সকল প্রভাবশালী সর্দারনিদের এই শহরে একাধিক ভাড়া বাড়ি আছে। এঁরা আবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। তারপরও এ ব্যাবসাকে পুঁজি করে রেখেছেন।
সন্ধ্যাবাজার গণিকালয় : সিলেটের ধোপাদিঘীর পাড় এলাকায় সন্ধ্যাবাজার গণিকালয়, যা স্থানীয়ভাবে ‘পৌরবিপণি’ নামে পরিচিত। এখানেই একটি আবাসিক হোটেলের মধ্যেই আছে একটি মিনি গণিকালয়। নিচে মসজিদ, উপরে গণিকালয় হওয়ার কারণে জায়গাটি বিশেষভাবে আলোচিত। এই কারণেই গণিকালয়টি নজরে আসার উচ্ছেদও করে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে এঁরা জায়গাটির আশেপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।
এ তো গেল কিছু রেজিস্টার্ড গণিকালয়গুলির কথা। এছাড়াও বাংলাদেশে প্রায় হাজারখানেক গণিকালয় আছে। রাস্তার পাশে যে আবাসিক হোটেলটি দেখতে পাচ্ছেন, সেটিও গণিকালয় হতে পারে। পেতে পারেন মাত্র ৩০০/৪০০ টাকা পারিশ্রমিকের গণিকাও।
মাড়োয়ারি মন্দির গণিকালয় : মাড়োয়ারি মন্দির এলাকার নিষিদ্ধ তিনটি গণিকালয়। মাড়োয়ারি মন্দির এলাকার এক নম্বর গলির মালিক ডাঃ ইয়াকুব তাঁর ২৪টি ঘর থেকে ভাড়া বাবদ দিন ১০০ টাকা হারে মাসে ৭২ হাজার টাকা আয় করে। দুই নম্বর গলির মালিক দুই সহোদরা কণা ও কাজল তাদের ১৬টি ঘর থেকে মাসে ভাড়া বাবদ আদায় করে ৪৮ হাজার টাকা। তিন নম্বর গলির মালিক একসময়ের যৌনকর্মী মেরি তাঁর দ্বিতল বাড়ির ২৭টি ঘর থেকে দিন ৪০ টাকা হারে মাসে ৩২ হাজার টাকা ভাড়া বাবদ আয় করে। ঘরওয়ালিদের ঘরের পজিশন বাবদ এককালীন বাড়িওয়ালাকে দিতে হয় ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। এই গণিকালয়ের ঘরওয়ালিদের আছে আর-এক নাম সর্দারনি’। শারীরিক আবেদন হারানোর কারণে এঁরা এখন আর নিজ দেহ বিক্রি করতে পারে না। ফলে জীবিকার জন্য ভাড়াটিয়া রাখে ২/৩ বা তারও অধিক যৌনকর্মীকে। এই যৌনকর্মীরা ৩ বেলা খাবার ও ঘরের জন্য ভাড়া দেয় দিন প্রতি ১০০ টাকা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কিছু কিছু সর্দারনির অধীনে আছে ১২/১৩ বছরের অল্প বয়সি মেয়ে, এখানে যাঁরা ছুকড়ি’ হিসাবে চিহ্নিত হয়। এরা যে অর্থ আয় করে তার পুরোটাই নিয়ে নেয় সর্দারনি। বিনিময়ে তাদের আশ্রয়, খাবার, পরিধান ও চিকিৎসাসহ যাবতীয় দায়িত্ব নেয়। প্রতিদিন এই যৌনকর্মীদের মাথা প্রতি নাইটগার্ডকে দিতে হয় ১০ টাকা, ভিতরে নিয়মিত পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য দিতে হয় চাঁদা। দিনভর কঠিন যন্ত্রণার পরও রাতে একটু শান্তিতে ঘুমোনোর কোন সুযোগ নেই তাঁদের। ছোট্ট ঘরে একটি খাটে সর্দারিনীসহ ৩/৪ জনকে ঘুমাতে হয় কোনোরকমে। সকালে ল্যাট্রিনের জন্য লাইন, স্নানের জন্য অপেক্ষা, দিনভর নানা পুরুষের মনোরঞ্জন, বিকৃত রুচিসমপন্ন মানুষের বিচিত্র উৎপাত সব কিছুকেই এদের আলিঙ্গন করতে হয় হাসিমুখে। কারণ, এই হাসিই তাদের বিজ্ঞাপন। পুঁজি শরীর।
রাজনীতিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশেষ বাহিনী, পুলিশসহ সমাজের কথিত অভিজাত থেকে নিচুতলার সব শ্রেণির মানুষই এখানকার নিত্য অতিথি। এক প্রশ্নের জবাবে তারা জানায়, গত বছরখানিক ধরে তেমন কোনো উৎপাত নেই। কিন্তু তার আগে ২/৩ বছরে অত্যাচারের ঝড় বয়ে গেছে তাঁদের উপর দিয়ে। এমনও দিন গেছে তাঁদের যে, থালা-বাসন পর্যন্ত কেড়ে নিয়ে গেছে মাস্তানরা। যশোরের সব থেকে পুরাতন একটি দৈনিকের সম্পাদকের মেজো ছেলের উৎপাতের কথা বলতে গিয়ে তারা জানায়, এক সময় সে টাকা তত দিতই না, বরং মারার হুমকি দিত। অনুরূপ অভিযোগ আনে এই শহরের একটি আক্রমণাত্মক দৈনিকের একজন ক্রাইম রিপোর্টারের বিরুদ্ধে, পরে দৈনিকটির সম্পাদকের কান পর্যন্ত বিষয়টি পৌঁছোলে তিনি নাকি তাদের পাওনা ৫০ টাকা দিয়েছেন। এছাড়াও প্রায়ই সাংবাদিক পরিচয়ে প্রতারকরা এখানে ভিড় করে। এই। সংবাদ সংগ্রহকালে প্রতিবেদক দেখতে পান কতিপয় সাংবাদিককে এই নিষিদ্ধ গলিতে আহ্বান করতে। শহর। ও শহরতলির অনেক মানুষের স্ত্রী হয়ে আছে এই গণিকারা। কথিত ওই স্বামীর উদ্দেশ্য একটাই—স্ত্রীর উপার্জিত অর্থ ভোগ করা। এ ধরনের স্বামীর মধ্যে প্রভাবশালী একটি রাজনৈতিক দলের প্রথম শ্রেণির নেতার ছেলের নামও শোনা যায়। বর্তমানে মাড়োয়ারি মন্দিরের সামনে স্যালভেশন আর্মির (নেদারল্যান্ডের একটি স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠান) একটি পরামর্শ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ডাক্তাররা নিয়মিত তাঁদের রক্তসহ আনুষঙ্গিক পরীক্ষা করে।
ব্রিটিশ যুগেরও আগে মোগল আমলে এই মাড়োয়ারি মন্দির এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধুমাত্র এখানেই না, শহরের গাড়িখানা রোডের পুরোনো পুলিশ ফাঁড়ির পিছনে ঝালাইপট্টি এলাকায়ও সেই সময়ে গড়ে ওঠে। গণিকালয়। তিন নম্বর গলির অতীত উল্লেখ করে তিনি জানান, এই বাড়ির মালিক মেরি এই পল্লির গণিকা ছিল, বয়স এখন তার ৬০, প্যারালাইসিস হয়ে বর্তমানে তিনি শয্যাশায়ী। এই মেরি বাড়ি কিনেছেন বুলি নামক আর-এক গণিকার কাছ থেকে, বৃদ্ধা বয়সে তিনি (বুলি) এই বাড়ি বিক্রি করে ভারতে চলে যান। শোনা যায় বুলি মারা গেছেন বেশ কিছুকাল আগে।
ঝালাইপট্টি ও বাবুবাজার গণিকালয় : যশোরের আরও দুটি গণিকালয়—ঝালাইপট্টি ও বাবুবাজার। ঝালাইপট্টি ও বাবুবাজারের দুটি করে চারটি গলি বা বাড়িতে মোট ৬৭টি ঘরে যৌনকর্মীর সংখ্যা রয়েছে ১৩৭ জন। ঘরওয়ালি আছে ৬৭ জন, চৌকিদার গার্ড আছে প্রায় ১৫ জন, এছাড়াও আছে অনেকের ২/১ জন করে ছেলে-মেয়ে, রয়েছে রাঁধুনি (মাসি)। গড়ে প্রায় ৩০০টি মুখের সরাসরি নির্ভরতা রয়েছে এই পেশার আয়ের উপর। পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল আছে অসংখ্য পরিবার। গণিকাদের অনেকের বাবা মার সংসারসহ এই ব্যাবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নানা পেশার মানুষের জীবন। সরেজমিনে দেখা গেছে, মাড়োয়ারি মন্দির গণিকালয়ের তুলনায় এই দুটি গণিকালয় অতিমাত্রায় নিম্নমানের। ক্লায়েন্ট আকৃষ্ট করার যোগ্যতার ভিত্তিতে এই সমস্ত গণিকালয়গুলি বিভাজিত হয় বিভিন্ন শ্রেণিতে। এই বিভাজনে মাড়োয়ারি মন্দির গণিকালয় চিহ্নিত হয় অভিজাত শ্রেণির গণিকালয় হিসাবে, আর ঝালাইপট্টি ও বাবুবাজার গণিকালয় চিহ্নিত হয় নিম্নশ্রেণির হিসাবে। মাড়োয়ারি মন্দির বাসিন্দাদের জন্য আছে একতালা দুইতলা পাকা ভবন, কয়েকটিতে আছে টালির ছাউনি, ভিতরে হার্ডবোর্ডের সিলিং। এসব ঘরগুলোর মধ্যে জৌলুস কম নয়। আছে রঙিন টেলিভিশন, ফ্রিজ, ফ্যান, পালঙ্ক, সোফা। বেশভূষায় পড়েছে স্যাটালাইটের প্রভাব, পরিধানে রয়েছে স্কার্ট, চোখে গগস, শরীরে দামি অর্নামেন্টস। অপরদিকে ঝালাইপট্টি ও বাবুবাজার গণিকালয়ের চিত্র করুণ। সারিবদ্ধ নিচু নিচু খুপড়ি ঘর, গোলপাতার ছাউনি, ভাঙাচোরা, চাটাইয়ের বেড়া, অনেক ঘরের দরজায় চটের আড়াল বা আচ্ছাদান। ভিতরে নেই কোনো আধুনিকতার বালাই। দিনেরবেলাতেও ঘরে সূর্যের আলো প্রবেশ করে না। এরই মাঝে টিমটিমে বিজলি বাতির স্বল্প আলোয় ঘরে বিরাজ করে এক ভৌতিক অবস্থা।
প্রবীণ পৌর কর্মকর্তা (অবঃ) চুড়িপট্টি নিবাসী দেওয়ান মোস্তফা আমান বলেন মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামল থেকেই যশোর শহরে চলে আসছে গণিকাবৃত্তি। ব্রিটিশ যুগে শহরের তিনটি স্থানে বর্তমান ইডেন মার্কেট ও শিল্প ভাণ্ডারের পিছনে গড়ে ওঠে প্রথম শ্রেণির গণিকালয়। কাঁঠালতলা গণিকালয়, হোটেল মিড টাউন ও মাড়োয়ারি মন্দিরের মাঝে মাড়োয়ারি বাবুদের প্রয়োজনে গড়ে ওঠে দ্বিতীয় শ্রেণির এবং ঝালাইপট্টির পুরোনো ছাগলহাটার দক্ষিণে গড়ে ওঠে তৃতীয় শ্রেণির গণিকালয়। শহরের অভিজাত শ্রেণির মানুষরা যেত কাঁঠালতলা গণিকালয়ে। ইতিহাস আছে বর্তমান জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারের বাংলো ছিল তৎকালীন জমিদারদের বাইজিখানা। এই বাইজিখানায় সপ্তাহে দু-দিন কলকাতা থেকে ৮ ঘোড়ার ফিটন গাড়িতে চড়ে আসতেন জমিদার ব্যারিস্টার মন্মথনাথ রায় ও তাঁর সঙ্গীরা। শনিবার আধা বেলা এবং রবিবার সারাদিন ফুর্তি করে তিনি পুনরায় কলকাতায় চলে যেতেন। সে সময়ে ওই বাইজিখানায় মেয়ে সাপ্লাই দেওয়া হত চাঁচড়া রায়পাড়ার ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে। জানা যায় কখনও টাকা দিয়ে কখনও জোরপূর্বক ওই মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হত বাইজিখানায়। যে পরিবারের এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই।
জনশ্রুতি আছে যে, আজকের দড়াটানা জামে মসজিদ যে স্থানে অবস্থিত, অতীতে সেখানে ছিল গণিকালয় ও বাইজিখানা। কাপুড়িয়া পট্টি এলাকায় ছিল নামজাদা সব বাইজিদের বসতবাড়ি। এই বিশেষ আকর্ষণে একদা ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে জমিদার, মহাজন, মাড়োয়ারি বাবুরা ছুটে আসতেন এই প্রাচীন যশোর পৌরশহর জনপদে। বাবুবাজার, বাবুঘাট, মাড়োয়ারি মন্দির এই স্থানিক নামবাচক শব্দ আজও বহন করে চলেছে সেই প্রাচীন গণিকাবৃত্তির ইতিহাস। প্রাচীন এই গণিকাবৃত্তির ইতিহাস-ঐতিহ্য আর শিল্পের সঙ্গে কোনো মিল নেই আজকের গণিকাবৃত্তির। হয়তো-বা পরিবর্তনশীল এই সমাজের গণিকাবৃত্তির আধুনিক রূপান্তরের ফলেই শিল্প হারিয়েছে পুরোনো ধাঁচের এই সব গণিকালয়গুলি। হয়তো-বা পণ্যের সস্তা মূল্যই এই গণিকালয়গুলিকে আরও বেশি অস্বাস্থ্যকর করে তুলেছে। তবুও ব্যাবসার সচেতনতা এবং সেই সঙ্গে ন্যূনতম আর্থিক সংগতি থাকার কারণে মাড়োয়ারি মন্দির গণিকালয়ের বাসিন্দারা স্ব-উদ্যোগে নিয়মিত পয়ঃনিষ্কাশন ও আনুষাঙ্গিকের ব্যবস্থা করলেও নিম্নশ্রেণির এই দুটি গণিকালয়ের (ঝালাইপট্টি ও বাবুবাজার)-তে নিয়মিত পয়ঃনিষ্কাশন স্বাস্থ্যকর রাখার কোনো ব্যবস্থাই তাঁরা নিতে পারে না। ডাক্তারী পরীক্ষাসহ কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিধি এখানে মানা হয় না। মুখে তাঁরা যাই বলুক না-কেন, ডাক্তার হয়তো-বা কদাচিৎ যায়ও কিন্তু সবকিছুই ‘ওকে’ হয়ে যায় সামান্য টাকায়। ফলে বছরের পর বছর ধরে এই গণিকালয়গুলি যে সমাজে মারাত্মক সব রোগের বীজ ছড়াচ্ছে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
কেমন আছে বাংলাদেশের যৌনকর্মীরা? বাংলাদেশে ‘গণিকাবৃত্তি’ বৈধ হলেও নানা কারণে উচ্ছেদ হয়েছে বেশ কিছু গণিকালয়। গণিকাপেশা নির্মূলের সদিচ্ছার জন্য নয়, অনেকক্ষেত্রেই উচ্ছেদের আসল কারণ জমি দখল। বাংলাদেশে যেমন বৈধ যৌনকর্মী আছেন প্রায় ১ লাখ, তেমনি অবৈধভাবে আছেন আরও তিন-চার লাখ। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরের মধ্যে মাদরীপুর, খুলনার ফুলতলা এবং টাঙ্গাইল মিলিয়ে মোট তিনটি গণিকালয় উচ্ছেদ করা হয়েছে। এর মধ্যে টাঙ্গাইল ছাড়া আরও দুটি এখন বহুতল মার্কেট। টাঙ্গাইলের রেজিস্টার্ড গণিকালয়ের যৌনকর্মী হাসি ডয়চে ভেলেক জানান, “আমাদের নির্মম নির্যাতন আর অত্যাচার করে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। আমাদের অনেকের নিজেদের জমি ও ঘর থাকার পরও আমরা সেখানে থাকতে পারিনি। পরে আদালতের রায়ে আমরা ফিরে আসতে পারলেও সবাই আসেনি। তাঁরা এখন দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। জানি না তাদের সন্তানরা কেমন আছে, কেমনভাবে চলছে তাদের জীবন।” হাসি বলেন, “আমরা ফিরে এলেও এখন আমাদের উপর পুলিশের নতুন নির্যাতন শুরু হয়েছে। পুলিশ হামলা চালায়, খদ্দের ধরার নামে চাঁদা নেয়। ওদিকে বাড়িওয়ালারাও ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। ছোট্ট একটা রুমের একদিনের ভাড়া ৬০০ টাকা। তার উপর মাস্তানদের চাঁদা তো আছেই। তাই যৌনকর্মীদের অনেকেরই এখন পেটে ভাত নেই। কেউ কেউ ধার দেনা ও ঋণ করে চলছে।” টাঙ্গাইলের গণিকালয়কে আবার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে যাঁরা আন্দোলন করেছেন, তাঁদের মধ্যে সবার আগে আসে মাহমুদা শেলির নাম। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমার মনে হচ্ছে, পুলিশ প্রশাসন এখন কৌশলে এই গণিকালয়টি উচ্ছেদ করতে চায়। তাই ক্লায়েন্টরা যাতে আসতে না পারে, সেজন্য তাঁরা নানাভাবে হয়রানি করে। ক্লায়েন্ট না-এলে যৌনকর্মীরা তাঁদের কাজ টিকিয়ে রাখতে পারবে না। তিনি জানান, “এই যৌনপল্লিটি উচ্ছেদের পিছনে প্রভাবশালী মহলের হাত ছিল। তাঁদের টার্গেট ছিল এখানকার জমি দখল করা। তাই তাঁরা দু-ঘণ্টার মধ্যে যৌনপল্লিটি উচ্ছেদ করেছিল।”
নারায়নগঞ্জের টানবাজার এবং ঢাকার ইংলিশ রোডের গণিকালয়ও এক রাতের মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এই দুটি গণিকালয়ের যৌনকর্মীদেরও মারপিট ও নির্যাতন করে উচ্ছেদ করা হয়। প্রভাবশালীরা প্রশাসনের সহায়তায় এ কাজ করে। যৌনকর্মীদের আটক করে প্রিজন ভ্যানে ভবঘুরে কেন্দ্রে পাঠানো হলেও, তাঁরা শেষপর্যন্ত সেখানে থাকেননি। পুলিশও এঁদের উপর অত্যাচার করে, ভয় দেখিয়ে ওঁদের ভোগ করে, ধর্ষণ। করে। সেখান থেকে পালিয়ে তাঁদের অনেকেই এখন ভাসমান যৌনকর্মী।
জয়া শিকদার যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা ‘অ্যাক্টিভিস্ট মুভমেন্ট’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান নির্বাহী। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, “যৌনকর্মীদের উচ্ছেদ করা হলে তাঁদের ভাসমান না-হয়ে উপায় থাকে। তাঁদের বিকল্প পেশা নেই। ফলে দিন দিন ভাসমান যৌনকর্মীদের সংখ্যা বাড়ছে। তা ছাড়া ভাসমান যৌনকর্মীরা স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সুবিধা পর্যন্ত পায় না। ফলে তাঁরা নানা রোগে আক্রান্ত হয়। তাঁদের সন্তানরাও দুর্বিষহ জীবনযাপন করে।”
বাংলাদেশে ‘গণিকাবৃত্তি’ অবৈধ নয়। প্রাপ্তবয়স্ক নারী, যাঁদের বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি, তাঁরা স্বেচ্ছায় ঘোষণা দিয়ে এই পেশা বেছে নিতে পারেন। তবে রাষ্ট্র গণিকাবৃত্তি বন্ধে ব্যবস্থা নেবে। এখানে জোর করে কাউকে এই পেশায় নিয়োজিত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তা ছাড়া ১৮ বছরের নীচে কোনো নারী এই পেশা বেছে নিতে পারবেন না। তবে এই পেশা স্বেচ্ছায় বেছে নিতেও পুলিশকে ঘুস দিতে হয়। ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকার কমে অনুমতি মেলে না। সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্ক’-এর আরিফুর রহমান সবুজ ডয়চে ভেলেকে জানান, “আমাদের হিসাবে সারা দেশে ২৫,০০০ ভাসমান এবং যৌনপল্লিগুলোতে ৭০,০০০ বৈধ যৌনকর্মী আছেন।” তবে জয়া শিকদার মনে করেন, “বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে এই সংখ্যা পাঁচ লাখের কম হবে না।”
বাংলাদেশে অনেকক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হয়ে গণিকালয়গুলিতে হাজির হন মেয়েরা। প্রত্যন্ত অঞ্চলের হতদরিদ্র পরিবারের সদস্যরা কখনো-কখনো অর্থের লোভে মেয়েদের বিক্রি করে দেন বলে জানিয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা। এছাড়া ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে কিংবা বিদেশ যাওয়ার লোভ দেখিয়েও মেয়েদের গণিকালয়ে আনা হয়। অভিযোগ রয়েছে, গণিকালয়ের মালিক নতুন আসা যৌনকর্মীদের শরীর ভোগ্যপণ্য করে তুলতে স্টেরয়েড ট্যাবলেট সেবনে বাধ্য করে, যা সাধারণত গোরুকে খাওয়ানো হয়। গোরুর স্বাস্থ্য বাড়াতে ব্যবহার করা এই ট্যাবলেট মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকর। কম বয়সি নাবালিকা মেয়েরা পূর্ণ যুবতী হয়ে ওঠে স্টেরয়েডের প্রভাবে। বাংলাদেশের এক গণিকালয়ের মালিক রোকেয়া জানান, স্টেরয়েড ওষুধ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ভালো কাজে দেয়। কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক, বিশেষ করে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সি মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়। তা সত্ত্বেও অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের স্বাস্থ্য ভালো করতে এই বিশেষ ধরনের ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়। স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে গিয়ে একসময় বেশিরভাগ গণিকা স্টেরয়েডে আসক্ত হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড ইউকে এক সমীক্ষার ভিত্তিতে ২০১০ সালে জানায় যে, বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ যৌনকর্মী ওরাডেক্সন বা অন্যান্য স্টেরয়েড ট্যাবলেট নিয়মিত গ্রহণ করে। তাঁদের গড় বয়স ১৫-৩৫ বছর। স্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারণা চালাচ্ছে অ্যাকশন এইড। সংস্থাটির বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার জানিয়েছেন, “ওরাডেক্সন গ্রহণ করার পর শুরুতে মেয়েদের শরীরে চর্বির পরিমাণ বাড়তে থাকে। কিন্তু এটি নিয়মিত সেবন করলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, চামড়ায় ক্ষতসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়।”
বাংলাদেশের বেশ কয়েক নারীকে মধ্যপ্রাচ্যে যৌনদাসী হিসাবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। তাঁদের পাচার করে সিরিয়ায় নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক বার্তাসংস্থা। এসব নারীকে ফিরিয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে। তবে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন গণিকালয়েও বাংলাদেশি নারীদের জোরপূর্বক গণিকাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। কাজ দেওয়ার নাম করে বাংলাদেশের মেয়েদের মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে যায় একশ্রেণির দালাল। বহু বছর থেকেই তাঁরা অতি সক্রিয়। বাংলাদেশী এইসব মেয়েরা সৌদিতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়।
বিদেশিদের খুশি করতে বাংলাদেশের আশ্রিত রোহিঙ্গা নারীদেরও যৌনকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অল্পবয়সি মেয়েরা বিদেশিদের যৌনকর্মে ব্যবহারের টার্গেট হয়ে উঠছে। কক্সবাজার থেকে যৌন-ব্যাবসার জন্য রোহিঙ্গা মেয়ে ও শিশুদের পাচার করা হচ্ছে বলে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বিবিসি নিউজের একটি দল এবং অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশন সেন্টিনেল ওই অনুসন্ধানে নামে। তাঁরা কক্সবাজারের ছটো হোটেল ও সৈকতের রিসোর্ট থেকে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দালালদের টেলিফোন নম্বর যোগাড় করে। এই হোটেল ও রিসোর্টে যৌন-কর্মকাণ্ডের জন্য রুম ভাড়া পাওয়া যায়। পুলিশকে বিষয়টি জানিয়েই বিবিসি নিউজের দলটি এসব নম্বরে ফোন করে দালালদের কাছে জানতে চায় বিদেশিদের জন্য অল্পবয়সি রোহিঙ্গা মেয়ে পাওয়া যাবে কি না। এর উত্তরে টেলিফোনের ওপার থেকে এক দালাল জানায়–“অল্পবয়সি মেয়ে আছে, কিন্তু রোহিঙ্গা মেয়ে কেন খোঁজা হচ্ছে? ওরা তো খুব নোংরা”। আরও গভীরে গিয়ে দেখা গেল রোহিঙ্গা মেয়েদের সেখানে সবচাইতে সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে। গণিকাবৃত্তির ক্ষেত্রেও তাঁরা সেখানে সবচাইতে নিচের সারিতে রয়েছে। বিবিসির দলটি দালালকে জানালো যত দ্রুত সম্ভব তাঁরা এসব মেয়েদের সঙ্গে রাত কাটাতে চায়। খুব দ্রুতই বিভিন্ন দালালদের কাছ থেকে রোহিঙ্গা মেয়েদের ছবি আসতে শুরু করল। যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছর। বলা হল ছবির মেয়েদের পছন্দ না-হলে আরও মেয়ে দেখানো সম্ভব। চাইলেই পাওয়া যাবে। এভাবে এত রোহিঙ্গা মেয়ে পাওয়া গেল, যা খুবই ভয়াবহ। দালালদের সঙ্গে কথাবার্তার রেকর্ডিং ও ভিডিও স্থানীয় পুলিশকেও দেওয়া হয়েছে। অভিযানের অংশ হিসেবে দলটি কক্সবাজারের ওই দালালকে ফোন করে। ছবিতে দেখা দুটো মেয়েকে রাত আটটায় শহরের একটি নামি হোটেলে পাঠাতে বলা হয়। ফাউন্ডেশন সেন্টিনেলের এক কর্মী ‘অনুবাদক হিসাবে হোটেলের বাইরে অপেক্ষা করছিল। হোটেলের কার পার্কে অপেক্ষা করছিল পুলিশ। রাত আটটার দিকে বেশ কিছু ফোন কলের পর একটি গাড়িতে করে ড্রাইভারের সঙ্গে ছবিতে দেখা মেয়ে দুটিকে পাঠানো হয়। বিদেশি ক্লায়েন্ট সেজে থাকা ব্যক্তিটি জানতে চায় আজ রাতের পরে আরও মেয়ে পাওয়া যাবে কি না। গাড়ির চালক সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। টাকা হস্তান্তরের পরই পুলিশ গাড়ির চালককে গ্রেপ্তার করে। মেয়ে দুটিকে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। দারিদ্র আর গণিকাবৃত্তির জালে যেন এই মেয়ে দুটি আটকে গেছে। তাঁরা জানায় গণিকাবৃত্তি ছাড়া জীবন চালানো তাঁদের জন্য খুব কঠিন।
আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পর্যায়ে নারী ও শিশু পাচারে খুব শক্তিশালী নেটওয়ার্ক দরকার হয়। এ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট এখন যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা মেয়েদের ঢাকা, নেপালের কাঠমান্ডু ও ভারতের কোলকাতায় নিয়ে আসা হয় বলে তথ্য পাওয়া গেছে। কলকাতায় ব্যস্ত যৌন-ব্যাবসায় এরকম অনেক নারীদের পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছে তাঁরা। এরপর তাঁদের আজ খোঁজ মিলছে না। এমন ওয়েবসাইটও পাওয়া গেল যেখানে কীভাবে রোহিঙ্গা মেয়েদের ব্যবহার করা যায়, সে নিয়ে ধাপে ধাপে তথ্য দেওয়া হয়েছে। কীভাবে ধরা পরার হাত থেকে বাঁচা যায়, কোন্ এলাকায় সবচাইতে বেশি শিশু পাওয়া যায়, এমন সব তথ্য দিয়েছে এক ব্যক্তি। যদিও এই ওয়েবসাইটটি পুলিশ সরিয়ে ফেলেছে। তবে তার আগে সেটি যাচাই করে জানা গেছে কীভাবে শিশুকামী ও পাচারকারীদের টার্গেট হয়ে উঠছে রোহিঙ্গা শিশু ও নারীরা। বাংলাদেশে নতুন সেক্স ইন্ডাস্ট্রি গড়ে না-উঠলেও যৌনকর্মী হিসাবে কাজের জন্য মেয়ে সরবরাহ বেড়ে গেছে। আর সেটির অন্যতম শিকার রোহিঙ্গা মেয়েরা। বাংলাদেশের কক্সবাজারে ক্যাম্পগুলোতে নারীদের যৌন নির্যাতন ও যৌনপেশায় জড়িয়ে পড়ার এমন অনেক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া গেছে। অল্প বয়সি নারী ও শিশুরা এর মূল টার্গেট। বিপদগ্রস্ত এই নারী ও শিশুদের মূলত কাজের লোভ দেখিয়ে ক্যাম্প থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ক্যাম্পে রোহিঙ্গা শিশু ও তাঁদের অভিভাবকরা বলছেন দেশের বাইরে কাজ, রাজধানী ঢাকায় বাড়িঘরে গৃহকর্মীর কাজ বা হোটেলে কাজের অনেক প্রস্তাব আসছে তাঁদের কাছে। মারাত্মক ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পে বিশৃঙ্খল পরিবেশ পাচারকারীদের সুযোগ যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মাসুদা নামের আর-এক কিশোরী তাঁর কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন, “আমি জানতাম আমার কপালে কী আছে। যে মহিলা আমাকে কাজ দেওয়ার কথা বলেছিল সেও একজন রোহিঙ্গা। অনেকদিন আগে এখানে এসেছে। সবাই জানে যে, সে লোকজনকে যৌনকাজে সহায়তা করে। আমার কোনো উপায় ছিল না, কারণ এখনও আমার জন্য কিছুই নেই।”
‘Research Evaluation Associates for Development (RED)’ সমীক্ষায় বলছে বাংলাদেশের গণিকাপল্লির যৌনকর্মীদের অবস্থা খুবই করুণ। নারায়ণগঞ্জের টানবাজার, মাসদাইর, রূপালি গেট, হাজিগঞ্জ; ঢাকায় তেজগাঁও, কমলাপুর; ময়মনসিংহের স্বদেশিবাজার, নিমতলি, কান্দুপট্টি, রাজবাড়ির দৌলতদিয়া ঘাট; টাঙ্গাইলের কান্দাপাড়ার যৌনকর্মীরা খুবই বিপন্ন। পুলিশ, মস্তান সবাই গিলে খাচ্ছে, নিঙড়ে নিচ্ছে দেহরস। পাশবিক অত্যাচার করে ভবঘুরে কেন্দ্রে চালান করে দিচ্ছে যৌনকর্মীদের। সেখানে পুলিশদের দ্বারা যৌনকর্মীরা ব্যবহৃত হচ্ছে, চলছে যৌন-সন্ত্রাস। বিভীষিকাময় পরিস্থিতি।
গণিকাদের উচ্ছেদ করে গাজিপুরের কাশিমপুর এবং পুবাইল ভবঘুরে কেন্দ্রে আশ্রয় দেওয়া হয়। পুলিশ মাঝেমধ্যেই গণিকাপল্লিগুলিতে অতর্কিতে হানা দিয়ে মেয়েদের আটক করে ভবঘুরে চালান করে দেয়। মধ্যরাতে পুলিশের অতর্কিত হামলায় গণিকাপল্লিরা মেয়েরা আতঙ্কিত হয়ে বাথরুমের পিছনের পাইপ, দেয়াল, পায়খানাপূর্ণ ড্রেন দিয়ে পালানোর সময় মলমূত্রে মাখামাখি হয়ে যায়। যেহেতু মধ্যরাতে পুলিশি হামলা শুরু হয়, যেহেতু এই সময়ে যৌনকর্মীরা যৌনকর্মে ব্যস্ত থাকেন–অতএব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যৌনকর্মী মেয়েদের সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে অথবা খোলা বুকে ঘর ছেড়ে পালাতে হয়। ধরা পড়লে পুলিশ নৃশংসভাবে এঁদের উপর অত্যাচার করে, শারীরিক নির্যাতন করে। তাঁদের চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয়। মেয়েদের তলপেটে ভারী বুটের লাথি নেমে আসে। পুলিশ-ভ্যানে তুলে এঁদেরকে পাটতনের উপর ফেলে কয়েকজন পুলিশ মিলে ধর্ষণ পর্যন্ত করে থাকে।
বাংলাদেশের গবেষক-লেখক শাহিন পারভিনের কয়েকটি কেস স্টাডি রিপোর্ট গণিকাবৃত্তি প্রসঙ্গে এক সমীক্ষায় মাধ্যমে যে কজন তথ্যদাতার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাঁরা সকলেই একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই গণিকাবৃত্তিতে এসেছেন। জানাচ্ছে এঁরা কেউই স্বেচ্ছায় এই পেশায় আসেননি। তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা, দুঃখ-কষ্ট ও কোন্ প্রক্রিয়ায় তাঁরা এই পেশায় এসেছেন সেই চিত্র স্পষ্ট হয় পাঁচজনের এই কেস স্টাডি থেকে। পনেরো জন পতিতার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল।
কেস স্টাডি–এক : নাম স্বপ্ন। পেশা ভাসমান গণিকা। বয়স ২৬। কাজের জায়গা সোহরাওয়ার্দি উদ্যান ও রমনা পার্ক। রাতে ফুটপাতে বা পার্কে ঘুমিয়ে থাকেন। স্বপ্ন ১২ বছর বয়সে তাঁর দুর সম্পর্কীয় এক মামার সঙ্গে ঢাকায় আসেন। তাঁর মামা তাঁকে একটি বাড়িতে কাজের জন্য দেয়। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর সে নতুন আর-এক বাড়িতে কাজ ধরে। সেই বাড়ির ছেলের সঙ্গে তাঁর প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক হয়। গোপনে তাঁরা বিয়েও করে নেয়। কিন্তু এসব জানাজানি হলে গৃহকর্তা তা মেনে নিতে চায় না। এর মধ্যে স্বপ্নার এটি সন্তানও হয়। সন্তান হওয়ার পর স্বপ্নার শ্বশুর তাঁর স্বামীকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয় এবং তাঁকে ঘর থেকে বের করে দেয়। তাঁর স্বামীও তাঁর আর কোনো খোঁজখবর নেয়নি। স্বপ্নকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে সে কোলের সন্তানকে গ্রামে তাঁর বোনের কাছে রেখে আসে এবং সে গার্মেন্টসে ৩০০ টাকার একটি কাজ জোগাড় করে। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর গার্মেন্টসের এক দারোয়ান তাঁকে ধর্ষণ করে। এর ফলে এ কাজটিও হারায় স্বপ্না। এক মহিলা ৯০০ টাকায় বাসায় কাজ ঠিক করে দেবে বলে নিয়ে যায় একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে তিনজন পুরুষ স্বপ্নকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। ধর্ষণ করার পর ওই মহিলা স্বপ্নকে ৫০ টাকা দেয় এবং সেখান থেকে বের করে দেয়। এই মহিলার সাহায্যেই এক হোটেলে কিছুদিন কাজ করে। হোটেলের এক কাস্টমার তাঁকে টানবাজারে নিয়ে যায়। এখানে সে পাঁচ বছর কাজ করে। কিছু টাকাপয়সাও তাঁর জমে। কিন্তু কিছুদিন পর উচ্ছেদ হলে সে সেইসব টাকাপয়সা আনতে পারেনি। উচ্ছেদের পর সে কাসিমপুরে বন্দি ছিল। সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশের হাতে ধৃত হয় এবং প্রচণ্ড মার খান। এরপর তাঁর পরিচিত একজন স্বামীর পরিচয় দিয়ে তাঁকে সেখান থেকে ছাড়িয়ে আনে। ছেড়ে দেওয়ার সময় স্বপ্নাকে একটা সেলাই মেসিন আর ৭০০০ টাকা দেওয়া হয়। এসব নিয়ে কিছুদূর আসতে না-আসতেই কিছু দুষ্কৃতি তাঁর সেলাই মেসিন কেড়ে নেয়। ছাড়িয়ে আনার জন্য সেই পরিচিত লোকটিকে ৫০০ টাকা দিয়েছিল। বাকি টাকা গ্রামের বোনকে দিয়ে সে ঢাকায় এসে সোহরাওয়ার্দিতে ভাসমান গণিকা হিসাবে কাজ শুরু দেয়।
কেস স্টাডি–দুই : নাম জাহানারা। বয়স ৩০। সন্তান দুটি। বাপের বাড়ি ময়মনসিংহ। বিয়ের পর তাঁর স্বামী তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসে। স্বামী হোটেলে কাজ করত। বিয়ের পর প্রথম ৪/৫ বছর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালোই ছিল। ওইসময় তাঁর একটা সন্তান হয়। সন্তান জন্মের পর তাঁর স্বামীর অন্য এক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক হয় ও নেশায় আসক্ত হয় এবং জাহানারাকে খুব শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। তাঁর স্বামীর সঙ্গে বাড়িতে মাঝেমধ্যে একটা পুলিশ এসেও নেশা করত। একদিন তাঁর স্বামী পুলিশকে বাড়িতে রেখে সরে পড়ে। পুলিশটি জাহানারাকে ধর্ষণ করে। এরপর থেকে প্রায়ই তাঁর স্বামী পুলিশের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সরে পড়ত। আর প্রতিদিন জাহানারা ওই পুলিশের দ্বারা যৌন-লালসার শিকার হত। স্বামী কিন্তু সংসারের খরচ দিত না। ফলে বাচ্চা ও নিজের খাবার জোটানোর জন্য সে বাসা-বাড়িতে কাজ করতে শুরু করে। কিন্তু বাচ্চার কারণে কেউ তাঁকে বেশিদিন কাজে রাখত না। এরপরে সে ওই পুলিশের সাহায্যে পুলিশের ইনফর্মার হিসাবে কাজ শুরু করে। কিন্তু বেশিদিন ওই কাজ করতে পারে না। কারণ তাঁর এক দেবর জেলে ছিল। সে জেল থেকে বের হয়ে জাহানারাকে ওই কাজ ছেড়ে দেওয়ার জন্য হুমকি দিলে ওই কাজ ছেড়ে দেয়। জাহানারার পেটে যখন দ্বিতীয় সন্তান তখন তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। এরপর সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে এসে দেহ-ব্যাবসা শুরু করে। প্রায় দুই বছর সে এই কাজ করেছে। কাজ ছাড়ার পাঁচ মাস আগে জাহানারার টাইফয়েড হয়। টাইফেয়েডের ফলে তাঁর এক হাত ও এক পা দিয়ে কোনো কাজই করতে পারে না। উদ্যানে সে সারাদিন একটা পলিথিন বিছিয়ে ৫ বছরের ছেলে ও ১ বছরের মেয়েকে নিয়ে শুয়ে থাকে। খিদে পেলে ৫ টাকার বিনিময়ে খাবার কিনে খেত। জাহানারা সাধারণত রাতে খদ্দেরদের সঙ্গে দেহ-ব্যাবসা করত।
কেস স্টাডি–তিন : নাম কালী। বয়স ২৮। আজিমপুর বস্তির বাসিন্দা কালীর দুটি সন্তান। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর প্রায় ১০ বছর দেহ-ব্যাবসার পেশায় আছে। কালী যখন ছোটো ছিল তখন তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। বাবার মৃত্যুর পর তাঁদের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকত। কেউ তাঁকে দেখতে পেত না। সারাক্ষণ গালিগালাজ করত। এ সময় কালীর মাসি তাঁকে এক বাড়িতে কাজ দেওয়ার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসে। কালী ওই বাড়িতে কিছুদিন থাকার পর থেকে ওই বাড়ির ছেলের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হতে থাকে। হয়রানি এড়াতে একদিন সে সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে এক মহিলার কাছে আশ্রয় পায়। এই মহিলাই কালীকে দেহ ব্যাবসায় নিয়ে আসে। এই পেশায় থাকতে থাকতে এক ছেলের সঙ্গে কালীর প্রেম হয় এবং একে অপরকে বিয়ে করে। বিয়ের পর কালী দেহ-ব্যাবসা ছেড়ে দেয়। কিন্তু বিয়ের পর কালী জানতে পারে তাঁর স্বামীর আরও একটি স্ত্রী আছে এবং স্বামীর নেশাও করে। বিয়ের আগে তাঁর স্বামী তাঁর সঙ্গে বেশ ভালো ব্যবহারই করত। কিন্তু বিয়ের পরই কালীর উপর শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে। এরই মাঝে তাঁর একটি সন্তান হয়। তাঁর স্বামী সন্তান ও তাঁর খরচ তত দিতই না, উলটে দেহ-ব্যাবসা করে অর্থ উপার্জনের জন্য চাপ দিত। কালীর পেটে দ্বিতীয় সন্তান, তখন তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। এই বিপদে কেউ তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। কালী সন্তান পেটে নিয়ে দেহ-ব্যাবসায় চলে আসে তাঁর সন্তান আর নিজের খাবার জোগাড় করেছে। মাঝে এই পেশায় বিরতি দিয়েছিল দ্বিতীয় সন্তান প্রসবের কারণে। এরপর পুনরায় পেশায় ফিরে আসে। কাজে আসার সময় তাঁর বাচ্চাদের এক পিসির কাছে রেখে আসে। প্রতিবেশীরা জানত কালী গার্মেন্টসে কাজ করে।
কেস স্টাডি–চার : নাম হামিদা। বয়স ৩৫। এক সন্তানের মা। ১৫ বর্ষীয় সেই সন্তান হামিদার মায়ের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে থাকে। হামিদা বিধবা। স্বামী পুলিশের চাকরি করত। নয় বছর আগে তিনি মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পরে হামিদার উপর খুব নির্যাতন করত শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরা। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে হামিদা তাঁর বাপের বাড়িতে চলে আসে সন্তানকে নিয়ে। তাঁর ও তাঁর সন্তানের দায়িত্ব ভাইয়েরা নেয়নি। এমতাবস্থায় হামিদা ধারকর্জ করে দিন গুজরান করতে থাকে। কিন্তু হামিদা কোনো ধারই শোধ দিতে পারেনি। ফলে একটা সময় কেউই আর ধার দিতে চায় না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হামিদা মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে চলে আসে ঢাকার মাসির বাড়ি। সেখান থেকে এক বাড়িতে গৃহকর্মী হিসাবে কাজ নেয়। সেখানে হামিদা প্রায়ই গৃহকর্তা ভাইয়ের দ্বারা যৌনলালসার শিকার হতে থাকে। এ ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে গৃহকত্রী হামিদাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেয়। মাসির বাড়ি ফিরে এলে এক মাস সেখানে থাকার পর সেই মাসি সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে গণিকাবৃত্তিতে ঢুকিয়ে দেয়। হামিদার পরিচিত-পরিজনেরা জানত সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কাজ করে। থাকত আজিমপুর বস্তিতে। সে দুপুর ২/৩ টায় উদ্যানে আসত রাত পর্যন্ত কাজ করত এবং সকাল ৭/৮ টা নাগাদ বাড়ি ফিরত।
কেস স্টাডি–পাঁচ; নাম নাজমা। বয়স ২৯। পরিবারে তাঁর স্বামী ও দুই সন্তান। থাকেন আজিমপুর বস্তিতে। স্বামী অসুস্থ বলে কোনো কাজকর্ম করতে পারে না। স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর নাজমা সংসারের সব দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নেয়। কাপড়ের ব্যাবসা শুরু দেয়। কিন্তু কাপড়ের ঠিকমতো না জানায় কাগজ কুড়োনোর কাজ নেয়। এতসব করেও অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসার খরচ আর সংসার চালানো একবারেই সম্ভব হচ্ছিল না। এরপর বাধ্য হয়েই গণিকাবৃত্তিতে যোগ দেয়। টানা তিন বছর সে এই কাজ করেছে। গণিকাবৃত্তি করে স্বামীর চিকিৎসা, সংসার চালানো, শ্বশুর-শাশুড়ির দেখাশোনা এবং ননদকে ১০ হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে বিয়েও দিয়েছে সে। নাজমার এই পেশার কথা শুধুমাত্র স্বামীই জানত। বাকিরা জানত সে গার্মেন্টসে কাজ করত। তবে এ কাজ নাজমার মোটেই ভালো লাগত না। ভালো না লাগার কারণ, এ পেশাকে গোপন রাখতে তাঁকে সবসময় অনর্থক মিথ্যা কথা বলতে হত। ভয়ে ভয়ে তাঁর দিন কাটত।
এ চিত্র শুধু বাংলাদেশের নয়। এ চিত্র ভারত সহ বিভিন্ন দেশে প্রায় একই। গণিকা হওয়া ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের বিষয় নয়। খুব কম গণিকাই মানসিকভাবে এ পেশাকে বেছে নেয়।
গণিকালয়ের বাইরেও বহু নারী দেহব্যাবসায়ে জড়িত। বিভিন্ন শহরে-নগরে বাড়ি ভাড়া করেও এঁরা গণিকাবৃত্তি চালায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থেকে শুরু করে গৃহবধুরাও অতিরিক্ত আয়ের জন্য এই কাজ করে থাকে। আবাসিক হোটেলে ঘর ভাড়া নিয়ে দেহব্যাবসায় করা একটি প্রতিষ্ঠিত কর্ম। এক শ্রেণির দালালের মাধ্যমে সাধারণ নারীরা খদ্দের জোগাড় করে।
বাংলাদেশে তো গণিকাদের হোম সার্ভিসও চালু আছে। বাংলাদেশের জনৈক দালাল অকপটে জানিয়েছেন–“ঢাকায় হোটেলে পুলিশের হয়রানি। ফ্ল্যাট বাড়িতে স্থানীয় হোমরাচোমরা ও মস্তানদের উৎপাত। তাঁদের বখরা না-দিয়ে নিস্তার মেলে না। তাই বাধ্য হয়েই হোম সার্ভিসে জড়িয়ে গেছি। খদ্দেরের কল পেলে বাসায় যাই।” রাজধানীর এক যৌনকর্মীর আবাসিক হোটেলে নিয়মিত যাতায়াত ছিল তাঁর। কিন্তু সেখানে কমিশন দিয়েও রেহাই ছিল না, তাঁদের অন্যান্য চাহিদায় সাড়া দিতে হত। এ অবস্থায় বাধ্য হয়েই তাঁকে বেছে নিতে হয়েছে হোম সার্ভিস। এভাবে অসংখ্য যৌনকর্মী নানাভাবে তাঁদের পেশাকে বিস্তৃত করেছে এখন। হোটেল আর রাজপথ পেরিয়ে তাঁরা যুক্ত হয়েছে হোম সার্ভিসে। তাদের এ পেশার নেপথ্যে রয়েছে শক্তিশালী দালাল চক্র। এঁরা প্রকাশ্যে চলার পথে হাত বাড়িয়ে পথিকদের হাতে ধরিয়ে দেয় তাদের ভিজিটিং কার্ড। রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট, বাসস্ট্যান্ড, বাজার, অলিগলি ও অফিস-আদালতের সামনে দালালরা এসব কার্ড বিলি করে। যে-কোনো প্রয়োজনে ফোন দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মুহূর্তেই জনতার ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে যায় তাঁরা। যৌনকর্মীরা জানায়, আবাসিক হোটেলের ম্যানেজার ও বয়-বেয়ারা নির্দিষ্ট কমিশনের ভিত্তিতে খদ্দের যোগাড় করে দেয় তাঁদের। অনেক পেশাদার যৌনকর্মী অবশ্য নিজেরাই কার্ড বিলি করে। এসব কার্ডে সাধারণত মধ্যস্থতাকারীর মোবাইল নম্বর থাকে। পার্ক, ওভারব্রিজ এলাকায় তাদের তৎপরতা বেশি। আরেক কৌশল হল হারবাল চিকিৎসার নামে ভিজিটিং কার্ড বিতরণ। ফার্মগেট, শাহবাগ, কাকরাইল, মালিবাগ, মতিঝিল, সায়েদাবাদ, গাবতলি এলাকায় এ তৎপরতা বেশি। ব্যস্ততম গাড়িতে ছুঁড়ে দেওয়া হয় যৌন-চিকিৎসার নামের হ্যান্ড বিল। ওইসব চিকিৎসার আড়ালে চলে যৌন-ব্যাবসা। রাজধানীর আবাসিক হোটেলের সামনে প্রতিদিন অবস্থান করে দালাল চক্র। টার্গেট করা পথচারীকে তাঁরা ডাকে মামা বলে। কাছে এলেই ধরিয়ে দেয় ভিজিটিং কার্ড। বলে, মামা যেমন বয়সের দরকার সব ব্যবস্থা আছে। জায়গার সমস্যা হলে বলবেন। তবে রেটটা বাড়িয়ে দিতে হবে। যৌনকর্মীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের পরিচিত মানুষের মাধ্যমে বাড়িতে খদ্দের পেয়ে থাকে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ফ্ল্যাট বাড়িতে ভিআইপি যৌন-ব্যাবসা নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে মহাখালী ডিওএইচএস, গুলশান, বনানী লালমাটিয়া, দিলু রোড, ইস্কাটন রোড, সেন্ট্রাল রোড, মোহম্মদপুর, রামপুরা, শান্তিনগর, উত্তরা, কাকলী, কালাচাঁদপুর এলাকায় এ ব্যাবসা চলছে বলে জানায় এক যৌনকর্মী। তবে ভিআইপি এলাকায় যৌন-ব্যবসা পরিচালিত হয় বিশেষ গোপনীয়তায়। সেখানে যাতায়াত করে বিশেষ ধরনের খদ্দের। মালিবাগের এক ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মী জানায়, ঢাকা শহরের দু-একটা স্থান ছাড়া সব জায়গাতেই এ ব্যাবসা চলছে। মোবাইল ফোন ও ভিজিটিং কার্ডের মাধ্যমে এ ব্যাবসার গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। পেটের দায়ে যে যৌনকর্মীরা রাস্তায় নেমেছে পুলিশের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হতে হয় তাঁদের। কিন্তু ভিআইপি এলাকায় পুলিশকে সালাম দিয়েই ঢুকে যায় তাঁরা। পথচারী আলাল মিয়া জানান, তার হাতে একটি কার্ড পড়েছিল। কল করলে একজন পুরুষ রিসিভ করে। বিনয়ের সঙ্গে জানায়, আপনার ফোনের অপেক্ষায় আছেন ঢাকার বিভিন্ন কলেজ, ইউনিভারসিটির ছাত্রী ও মধ্য বয়সের মহিলা যৌনকর্মী। বলুন কী সেবা করতে পারি স্যার? তাঁর মতে, আজকাল সংসারে অশান্তি, স্বামী বিদেশে বা স্বামীর কর্মস্থল ঢাকার বাইরে এ ধরনের অনেক মহিলা হোম সার্ভিসে যোগ দিয়েছেন। ভিজিটিং কার্ডের নম্বরধারীরা সাধারণত চারটি ভাগে রাজধানীতে যৌনকর্মী সরবরাহ করে। প্রথমত, যৌনকর্মীকে ভিজিটরের বাড়ির ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, যৌনকর্মী ও ফ্ল্যাট ভিজিটরকে নিরাপদে নিয়ে আসা। তৃতীয়ত, হোটেল ঘরে যৌনমিলনে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা এবং চতুর্থত, প্রাইভেট পরিবহন ও পার্ক।
তবে বিশেষ শ্রেণির যৌনকর্মীরা নিজের ফ্ল্যাট বাসা-বাড়িতে খদ্দেরকে আপ্যায়ন করে। একটি সূত্র জানায়, সংখ্যায় কম হলেও কেবল টাকার জন্য নয়, নিজেদের যৌনবাসনা পূরণ ও মনোরঞ্জনের জন্যও অনেক মহিলা এ কাজে নেমেছে। এমনও যৌনকর্মী আছে যাদের সন্তান বড়ো স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। সূত্র মতে, আবাসিক হোটেলের প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ ভিজিটিং কার্ডধারী যুবক এখন যৌনকর্মীদের মধ্যস্থতাকারীর কাজে লিপ্ত। ভিজিটিং কার্ডের আয় থেকে চলছে তাঁদের সংসার। কাওরান বাজারের এক হোটেল বয় জানায়, আজকাল ভদ্রঘরের মেয়েরাও যৌন-ব্যাবসার প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা নেমেছে এ পেশায়। তাঁরা বড়ো বড়ো হোটেলে যায়। তাঁদের কন্টাক্ট নম্বর কেবল হোটেলে পাওয়া যায়। ডিওএইচএস-এর এক যৌনকর্মী সম্পর্কে সে জানায়, দূরের জেলায় ব্যাবসা করে। নিঃসন্তান। প্রতি শুক্রবার স্বামী ঢাকায় ফেরে। ওই মহিলা সপ্তাহে তিন দিন আমাদের মাধ্যমে নিজের বাড়িতে খদ্দের নেয়। ভিজিটের অর্ধেক টাকা দিয়ে দেয়। বনানীর এক যৌনকর্মীর স্বামী সরকারি কর্মকর্তা। সে এক সন্তানের মা। তবুও অতিরিক্ত টাকার রোজগারের নেশায় এ পেশায় এসেছে। সূত্র খুব বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, সে একেবারে হাড়কিপটে। জিজ্ঞেস করা হয়, মহিলার আয় কত? সপ্তাহে ২৫ হাজার টাকা। আর সে কমিশন পায় ৫ হাজার টাকা। জানতে চাওয়া হয় কতদিন ধরে মহিলা এ কাজে লিপ্ত? উত্তরে জানায়, ৪ মাস। আরেক সূত্র জানায়, হোটেলে শুধু গণিকা মেয়েরা আসে না। কেউ আসে গণিকা সেজে। খদ্দের দেখে পছন্দ হলে বাসায় নিয়ে যায়। বিনিময়ে আমাদের কিছু টাকা ধরিয়ে দেয়। তাঁর মতে এরা গণিকা নয়। স্বামীর অসংগতি, সংসারে ঝামেলা ও বিভিন্ন মানসিক কষ্টের কারণে এ কাজে তাঁরা ঝুঁকে পড়েছে। জানতে চাওয়া হয়, এই ধরনের মহিলাদের সংখ্যা? সে বলে, তার হাতে আছে ২৩ জন। প্রতিদিন পালাক্রমে তাঁদের খদ্দের পাঠাতে হয়। এঁরা ‘ভাবী’ নামে পরিচিত। এই ‘ভাবী’দের ভিজিট কেমন? ঘণ্টা প্রতি ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। তবে সুদর্শন পুরুষ তাঁদের বেশি পছন্দের। তাঁদের জন্য ডিসকাউন্ট আছে। এ সূত্রটির মাসিক আয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এক যৌনকর্মী জানায়, সে ঢাকায় এসেছে স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে। প্রতিবেশী ভাবীর সঙ্গে পরিচয়ের পর তাঁর উৎসাহে এ পেশায় এসেছে। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর শতাধিক খদ্দের জুটে গেছে। এক ডাকে সবাই তাঁকে চেনে। পুলিশ তাঁর জন্য কোনো সমস্যা নয় বলে জানায়।
বাংলাদেশের গণিকাবৃত্তিতে নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও পাওয়া যায়। নারীদের গণিকাবৃত্তিতে সাহায্য করতে স্বামী পরিচয়ে পুরুষ ভাড়াও পাওয়া যায়। ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে যৌনকর্মীদের আনাগোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ওইসব যৌনকর্মীরা এখন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ফ্ল্যাট বাড়ি ভাড়া নিয়ে দেহ-ব্যাবসা শুরু করেছে। বাড়ি ভাড়া নিতে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বামী ছাড়া বাড়ির মালিক বাড়ি ভাড়া দিতে চান না। বাড়ি ভাড়া নেওয়ার ওই প্রতিবন্ধকতার কথা চিন্তা করে যৌনকর্মীরা তাঁদের পূর্বপরিচিত কোনো পুরুষকে স্বামী হিসাবে ভাড়া করেন। বাড়ি ভাড়া করার সময় সঙ্গে থাকেন ভাড়াটে স্বামী। দেখা গেছে, বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় বাড়ির মালিককে বলা হয় স্বামী নিয়মিত ঢাকায় থাকে না, বাইরের কোনো জেলায় চাকরি বা ব্যাবসা করে। একই সঙ্গে বলা হয়, বাসায় নিয়মিত থাকবে তাঁর স্ত্রী ও দুই বা তিন বোন। ওই বোনদের থাকার কথা বলে বৈধ করে নেওয়া হয় আরও দুই-তিনজন যৌনকর্মীকেও। এভাবেই ঢাকা শহর জুড়ে ফ্ল্যাট বাড়িগুলোতে চলছে যৌন-বাণিজ্য।
শনির আখড়ার সোহান (ছদ্মনাম) বরিশাল থেকে অভাবের তাড়নায় ঢাকায় আসেন। এসএসসি পাস নয়, তাই কোনো চাকরি দিতে চাইছে না কেউ। এরই মধ্যে দেখা মিলে ছিনতাইকারী কাজলের সঙ্গে। নিরূপায় হয়ে তাঁর সঙ্গে যোগ দেয় সংসদ ভবন এলাকায় ছিনতাইয়ের কাজে। পরিবর্তন করে ফেলে নিজের বংশ-পরিচয়ও। এরই মধ্যে পরিচয় হয় স্বামী পরিত্যক্তা রূপার (ছদ্মনাম) সঙ্গে। তখন তিনি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে। চাকরির পাশাপাশি যৌন-ব্যবসায় লিপ্ত ছিলেন।
সিদ্ধান্ত হয় স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে দুজন রাজধানীর শনির আখড়ায় বসবাস করবেন। এরপরই বিউটি পার্লার ব্যাবসার আড়ালে রুপা শুরু করে জোরালো যৌন-ব্যাবসা। বিধি বাম, এলাকার দুষ্ট বেরসিক ছেলেরা জেনে যায় সোহান-রূপা আসলে স্বামী-স্ত্রী নয়। দুজনের এই অবাধ বসবাসে বাদ সাধে তাঁরা। দুজনকেই বাধ্য করে সত্যিকারের বিয়েতে। এছাড়াও সোহান রাজধানীর শান্তিনগর, বাড্ডা, ফার্মগেট এলাকাসহ ৮/৯টি জায়গায় যৌনকর্মীদের স্বামী পরিচয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে নিজে রোজগার করছেন মোটা অঙ্কের টাকা। আর মাঝে মধ্যে খদ্দের জোগাড় করে দিলে তাঁর কমিশন তো আছেই।
রাজধানীতে তিন ধরনের কাজের জন্য মহিলাদের স্বামী পরিচয়ে পুরুষ ভাড়া করার ক্ষেত্র চিহ্নিত করা গেছে। বিশেষ করে যৌন-ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত নারীরা বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় স্বামী হিসেবে লোক ভাড়া করে বাড়ির মালিককে দেখিয়ে থাকেন। এনজিওসহ বেশকিছু মাল্টিপারপাস কোম্পানি থেকে ক্ষুদ্রঋণ নেওয়ার শর্ত হিসাবে স্বামীর পরিচয় ও তাঁর ছবি ব্যবহার করতে স্বামী ভাড়া করেন। এছাড়া, সাম্প্রতিককালে পাসপোর্ট অফিসে কোনো মহিলা স্বামী ছাড়া একা গেলে তাঁকে স্বামীর উপস্থিতি দেখানোর প্রয়োজনে স্বামী ভাড়া করে আবার স্বামী নিয়ে আসার ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে হয়।
১৯৯৭ সালে স্থানীয় কমিশনার এক সময়ের কান্দুপট্টির অধিপতি হোসেন মোল্লার নেতৃত্বে তথাকথিত পঞ্চায়েত কমিটি নামে একটি সংঘবদ্ধ চক্র সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র ইংলিশ রোডে কান্দুপট্টির গণিকাদের উপর অতর্কিতে হামলা চালিয়ে গণিকালয়ে অবস্থানরত নারী ও শিশুদের উচ্ছেদ করেছিল। তাঁদের উপর নির্মম নির্যাতন চালায় এবং গণিকাদের সারাজীবনের সঞ্চিত সম্পদ লুটপাট নিয়ে যায়। উচ্ছেদকৃত মমতাজ বেগম নামে জনৈক গণিকা উচ্ছেদকৃত যৌনকর্মীদের একত্রিত করে ‘পতিতা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি কমিটি গঠন করে প্রেসক্লাবে অবস্থান শুরু করে। এই সংগ্রাম পরিষদকে সামনে রেখে নারীপক্ষ এবং বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন মিলে সংহতি প্রকাশ করে এই আন্দোলনের সঙ্গে যোগ দেয়। ১০ টি নারী ও মানবাধিকার সংগঠন মিলিতভাবে কান্দুপট্টি নারী ও শিশু সংহতি পরিষদ’ নামেও একটি কমিটি গঠন করে। নারীপক্ষের উদ্যোগে কালুপট্টি থেকে উচ্ছেদকৃত যৌনকর্মীদের নিয়ে আরও একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয় এবং বাংলাদেশে প্রথম ‘উল্কা নারী সংঘ’ বিভিন্ন কাজ করে আসছে। অন্যদিকে ‘কেয়ার’ এইচআইভি/এইডসের কাজ করতে গিয়ে ঢাকায় ভাসমান যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করছে। নারী মৈত্রী এবং বিডাব্লিউএইচসি যৌনকর্মীদের সঙ্গে অনুরূপ প্রকল্প চালাচ্ছিল।
দুর্জয় নারী সংঘ, উল্কা নারী সংঘ, মুক্তি নারী সংঘ, টানবাজার ও নিমতলী যৌনকর্মীদের বাংলাদেশ সরকারের কাছে যে দাবিগুলি জানিয়েছে, তা হল–(১) পুনর্বাসনের নামে উচ্ছেদ বন্ধ করতে হবে, (২) যৌনকর্মীদের বর্তমান বাসস্থানে রেখে উন্নয়ন কর্মসূচি নিতে হবে, যেমন–শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি, (৩) সরকারকে যৌনকর্মীদের উন্নয়ন কর্মসূচি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে যৌনকর্মী ও মনবাধিকার ও নরী আন্দোলনের কর্মীসহ সকলকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, (৪) যে কারণে এবং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন নারী যৌনকর্মী হয়, সরকারকে সকল কারণগুলি চিহ্নিত করে প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিতে হবে, (৫) যেসব দালাল, পাচারকারী সহ জড়িত সকল লোকজন, যাঁরা গোটা প্রক্রিয়ার জড়িত তাঁদের চিহ্নিত করতে হবে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে, (৬) যেসব যৌনকর্মীকে পুনর্বাসনের নামে তাঁদের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে বা হচ্ছে তাঁদের বাসস্থান ও জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে, এবং (৭) পুনর্বাসনের নামে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা বন্ধ করতে হবে।
মূলত উচ্ছেদের পর যৌনকর্মীদের জোরপূর্বক ভবঘুরে কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু গণিকারা তো কেউ ভবঘুরে নয়! তাঁদের ভবঘুরে কেন্দ্রে নেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট আইন আছে? গণিকাদের ভবঘুরে কেন্দ্রে নেওয়ার ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে বেআইনি। ১৯৯৯ সালে ৩১ জুলাই পুনর্বাসনে অনাগ্রহী গাজিপুরের কাশিমপুর ভবঘুরে কেন্দ্রে স্থানান্তরিত যৌনকর্মীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ২২৭ জন যৌনকর্মী বন্দিদশা থেকে মুক্তির জন্য দুপুরে খাবার গ্রহণ না করে বিক্ষোভে অংশ নেন। এমনকি মুক্তি না-দিলে যৌনকর্মীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেবে বলে হুমকি দেয়। যৌনকর্মীদের নেত্রী সাথী বলেন, “মুক্তি না-দিলে তাঁরা কেন্দ্রের ভিতর আগুন জ্বালিয়ে দেবে। গাছ থেকে লফিয়ে বা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেবে। ওইদিন কেন্দ্রে এলেই আপনারা লাশ দেখবেন।”
বাংলাদেশে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। এখানে প্রায়শই যৌনকর্মীদের অমানুষিক পুলিসি নির্যাতন নেমে আসে। মাঝেমাঝেই পুলিশের সঙ্গে যৌনকর্মীদের খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায়। চলে গুলি, কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জ। চলে গণিকাদের শ্লীলতাহানি, ধর্ষণও। রাতের অন্ধকারে যৌনকর্মীদের কোলপাঁজা করে বাসে তোলা হয়। টানাহ্যাঁচড়ায় যৌনকর্মীদের শরীর থেকে কাপড় খুলে পড়ে। সঙ্গমকালীন পুলিশের রেইড হওয়ার কারণে। পতিতারা নগ্ন হয়েই রাতভর দৌড়াদৌড়ি করে ছুটে পালায়। নারী সংগঠনের জনৈক নেত্রী সুফিয়া কামাল স্পষ্টত ক্ষোভ উগড়ে জানান–সমাজে অনেক ধনীঘরের মেয়েবউরাও গণিকাবৃত্তি করে। প্লেনে করে নামে, প্লেনে করে চলে যায়। তাঁদের নিয়ে তো কেউ মাথা ঘামাতে সাহস পায় না? এই গরিব মেয়েগুলোর উপর। কেন এত অত্যাচার করা হবে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক পুলিশ, সেই পুলিশই এঁদের পেটায় বেশি।”