১৬. তিনতলায় টেলিফোন বাজছে

তিনতলায় টেলিফোন বাজছে, অনিন্দ্য তখন একতলায়। ইলেকট্রিকের লাইন সারাচ্ছিল। বাড়ির এইসব কাজ সে নিজেই করে। ওপরের বারান্দা থেকে ঝি বলল, ছোড়দাদাদাবু, আপনার টেলিফোন!

এখন সারাদিন কোনো কাজ নেই। বই পড়ে পড়ে চোখ ব্যথা হয়ে যায়। মুম্বই যাওয়ার ব্যাপারটা এখনও ঠিক হয়নি। তেহরানে মা কিছুতেই যেতে দিলেন না।

তবে আজ কিছুক্ষণ আগে একটা উত্তেজক কাজ পাওয়া গিয়েছিল। একটা চোর ধরা পড়েছে। একটা রোগা মতন বারো-তেরো বছরের ছেলে ঢুকে পড়েছিল বাড়ির মধ্যে। কী সাহস, উঠে গেছে একেবারে দোতলায়। দুপুর বেলা সারাবাড়ি নিস্তব্ধ, সদর দরজাটাও খোলা ছিল, ছেলেটা অনিন্দ্যর রেডিয়ো আর ঘড়ি ঠিক চুরি করে পালাতো। পুরোনো চাকর রঘু সহায় হঠাৎ দেখে ফেলেছে।

রঘু সহায় বোধ হয় ছেলেটাকে মেরেই ফেলত, অনিন্দ্য কোনোরকমে আটকেছে। এত রোগাপটকা ছেলেকে মেরে হাতের সুখ নেই।

বরং অনিন্দ্য মনে মনে একটু হেসেছিল। তাদের মতন একটা ডাকাতের বাড়িতে চুরি করতে এসেছে ওইটুকু এক পুঁচকে! তার বাবা পারমিট চুরির দায়ে প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিলেন। দাদারও এখন অঢেল ব্ল্যাকমানি। আধুনিককালে এগুলোরই নাম ডাকাতি। আর এই বেচারা সেই পুরোনো টেকনিকেরই চোর রয়ে গেল।

থানায় ফোন করা হয়েছিল। পুলিশ বলেছে, ছেলেটাকে থানায় জমা দিতে। অনিন্দ্যর মা আপত্তি করেছেন। রাস্তা দিয়ে অনিন্দ্য ওই চোরকে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। বরং বিকেল বেলা দাদা বাড়িতে আসুক, তারপর যা হয় ব্যবস্থা করা যাবে। চোরটাকে আটকে রাখা হয়েছে ভাঁড়ারঘরে। টেলিফোনের কথা শুনে অনিন্দ্য ভাবল, আবার বুঝি থানা থেকেই কিছু বলছে?

হাতের কাজ ফেলে রেখে অনিন্দ্য তরতর করে ওপরে উঠে এল। ওপাশ থেকে পলার গলা।

অনিন্দ্য বলল, কী ব্যাপার? হঠাৎ?

পলা খানিকটা নম্র ও লজ্জিতভাবে বলল, এমনিই, বিশেষ কিছু কারণ নেই। তুই কেমন আছিস?

আমি খারাপ থাকব কেন?

না, মানে, শরীর-টরীর ভালো আছে তো?

চমৎকার আছে।

আমি ভাবছিলাম, তোর আবার জ্বর-টর হয়ে গেল কি না। কপালটা কি এখনও ফুলে আছে?

মোটেই না।

শোন অনিন্দ্য, দু-দিন ধরে আমার মনটা বড্ড খারাপ হয়ে আছে। সেদিন আমরা রাগের মাথায় এমন বিশ্রী কান্ড করলাম। দেবযানী তোর মাথাটা অত জোরে ঠুকে দিল, খুবই অন্যায় করেছে।

দেবযানী মাথা ঠুকেছে, তুই ঠুকিস নি তো?

কক্ষনো না। আমি বরং ওদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম।

অনিন্দ্যর মুখে একটা পাতলা হাসি ফুটে উঠল। একবার তাকাল দরজার দিকে। সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই আছে দোতলায়। একতলায় ইলেকট্রিক তারের মুখ খোলা রয়েছে, মেইন সুইচ অফ করা হয়নি, কেউ ছুঁয়ে ফেললেই দারুণ শক খাবে। তবু সে তরল গলায় বলল, আমি ঠিক জানতাম, আমার সম্পর্কে তোর খানিকটা দুর্বলতা আছে।

তুই মাঝে মাঝে এমন সব খারাপ কথা বলিস! যদিও জানি, সেগুলো ঠিক মিন করিস না —তাই রাগ হয়ে যায়। পরে ভেবে দেখলাম, সামান্য মুখের কথা তো, আর তো কিছু না, তাতেই আমাদের অতখানি রেগে যাওয়া মোটেই উচিত হয়নি। দেবযানীর আবার বড় বেশি বেশি রাগ।

রাগলে ওকে বেশি ভালো দেখায়।

তাই বুঝি?

কেন, তুই লক্ষ করিস নি?

ওসব ছেলেরাই লক্ষ করে। আমরা অত বুঝি না। তবে দেবযানী তো সুন্দরীই, সবাই ওকে সুন্দর বলে।

পলা তোর থেকে সুন্দর নয় অবশ্য।

বাজেকথা বলিস না। আমি দেখতে কীরকম, তা আমি ভালোরকমই জানি। তবে আমার কিন্তু দেব্যানীর থেকে শিখাকেই দেখতে বেশি ভালো লাগে। নাক-চোখ-মুখ কোনোটাই আলাদা করে বেশি সুন্দর নয় হয়তো, কিন্তু সব মিলিয়ে বেশ একটা ব্যক্তিত্ব আছে শিখার মধ্যে।

তোদের তিনজনের মধ্যে তোর চোখ দুটোই সবচেয়ে সুন্দর।

আবার ইয়ার্কি হচ্ছে! এই শোন, তার সঙ্গে ওদের আর দেখা হয়েছিল?

কাদের?

শিখা, দেবযানীর।

না?

আমি ওদের বলেছিলাম, অনিন্দ্যকে ডেকে মিটমাট করে নিতে। এমন একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়ে গেল, কিন্তু দেবযানীটা এমন ন্যাকা।

বেশ ন্যাকা আছে, তাই না? ছে

লেবেলা থেকে সকলের মুখে সুন্দর, সুন্দর শুনছে তো, তাই সবসময় একটা নেকু নেকু ভাব করে থাকে।

অনিন্দ্য নিঃশব্দে হাসতে লাগল। তার চোখ দুটো ঝকঝক করছে এখন। এই বিশ্রী গুমোট দুপুরে সে আর একটা চমৎকার আনন্দ পেয়ে গেল।

দেবযানী কি আমার ওপরে এখনও রেগে আছে?

খুব।

ঠিক আছে, আমি ওকে আরও রাগিয়ে দেবার ব্যবস্থা করব।

এই, যা, অনিন্দ্য তুই আর খিছু করিস না, প্লিজ! তোর কী দরকার ওর সম্পর্কে মাথা ঘামানোর? ও রাগ করে থাকলে তোর কী আসে যায়?

এইসব ন্যাকা মেয়েদের একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার, না? নাহলে তো সারাজীবনই ন্যাকা থেকে যাবে।

তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু তুই কিছু করিস না। আমি অনুরোধ করছি।

আচ্ছা ঠিক আছে, তুই যখন বলছিস! জানিস তো, তোর কোনো কথা আমি অগ্রাহ্য করতে পারি না।

আহা! কী মন ভেজানো কথা! তোকে আর আমার চিনতে বাকি নেই।

সত্যি বলছি। পাইলট ভদ্রলোক তোকে আগেই কবজা করে নিয়েছে, না হলে আমি একবার চান্স নিতাম। তোকে আমার অনেক কথাই বলা হয়নি। একদিন তোকে স্বপ্নে দেখলাম।

খুব গুল ঝাড়ছিস।

বিশ্বাস করছিস না? তা হলে আমি কী করতে পারি! পাইলটদাদা এখন কোথায়?

ইস্তাম্বুলে গেছে, দু-দিন পর ফিরবে।

দেখিস, এয়ার হোস্টেসের সঙ্গে প্রেম করে না তো?

কী জানি! ছেলেদের তো বিশ্বাস নেই।

অনিন্দ্য রিসিভারে ঠোঁট রেখে চুঃ করে একটা লম্বা শব্দ করল। পলা চমকে গিয়ে বলল, ও কী?

তোকে একটা চুমু খেলাম।

আবার অসভ্যতা হচ্ছে?

বাঃ, এতদূর থেকে চুমু খেলেও দোষ? আমার অনেক দিনের একটা ইচ্ছে—

ঠাট্টা করছিস তো আমার সঙ্গে?

ঠাট্টা? তুই বুঝতে পারিস নি, আমি তোকে কতটা ভালোবাসি? আর একটা চুমু খাই?

আবার চুঃ শব্দ করে অনিন্দ্য বলল, এবার তুই একটা চুমু দে আমাকে?

অনিন্দ্য, আমি ফোন নামিয়ে রাখছি।

ঠিক আছে, ইচ্ছে করলে নামিয়ে রাখতে পারিস।

এইসব কথা শুনলে আমার ভয় করে, বিশ্বাস কর।

কেন, কেউ দেখে ফেলবে নাকি? টেলিফোনে চুমু খাওয়ায় তো সে ভয় নেই।

এসব কথা আমার শুনতে একটুও ইচ্ছে করে না। দুপুরটা একদম চুপচাপ, কিছুই করার নেই, যাচ্ছেতাইরকম গরম—এই সময় যদি… তুই এক বাড়িতে আর আমি অন্য বাড়িতে…কোনোরকম বিপদের ভয় নেই, তবু টেলিফোন যন্ত্রটা যখন আছে, এর একদিকে তুই ঠোঁট দিলি আর একদিকে আমি—মনে কর তোর নীচের ঠোঁটটা ঠিক আঙুর ফল খাওয়ার মতন টুপ করে আমার মুখে পুরে নিলাম, অপূর্ব মিষ্টি, তারপর তোর জিভের সঙ্গে জিভ লাগিয়ে উঁ, উঁ, উঁ।

অনিন্দ্য, প্লিজ, অনিন্দ্য।

খারাপ লাগল?

শোন তোকে একটা অন্য কথা বলছি, খুব জরুরি।

পলা, এবার তুই যদি আমাকে একটা চুমু না দিস, তাহলে খুব দুঃখ পাব।

ওসব কথা থাক, বলছি তো একটা জরুরি কথা আছে।

কোনো জরুরি কথা আমি শুনব না, আগে একটা চুমু না দিলে।

 তোকে নিয়ে মহামুশকিল।

কী হল?

এই তো দিলাম।

বেশ ভালো করে, দু-ঠোঁটের মধ্যে আমার একটা ঠোঁট নিয়ে।

এইসব কথা শুনলেই ভয়ে আমার বুকটা দুপটুপ করে।

আমি তোর বুকে মাথা রাখলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আঁচলটা সরিয়ে দে একটু।

আবার অসভ্যতা হচ্ছে।

তুই কী জরুরি কথা বলবি বলছিলি।

শোন, সিটিজেন্স কমিটি থেকে কাল বেলেঘাটার একটা বস্তি সার্ভে করা হবে। আমরাও যাচ্ছি সবাই।

আমরাও মানে?

আমি, শিখা, ধৃতি, অরবিন্দ, দেবযানী।

তা হলে তো অনেকেই আছে।

তুইও আয়-না আমাদের সঙ্গে। এই, সুব্রতর খবর কী রে?

কী জানি!

ও সেই স্লিপিং পিল খেয়েছিল তারপর থেকে আর খবর পাইনি, যদি সুব্রতকে একটা খবর দেওয়া যেত।

হুঁ, হুঁ।

তুই আসছিস তো?

আঃ, কী চমৎকার!

কী হল? তুই শুনছিস না আমার কথা?

নিশ্চয়ই শুনছি—আমি তোর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি, কী সুন্দর গরম তোর বুক, মাঝে মাঝে বাচ্চাছেলের মতন আমি দুধ খাওয়ার জন্য–

ছি ছি ছি ছি ছি—তুই কি একটাও সিরিয়াস কথা শুনতে পারিস না?

—তোর ভালো লাগছিল কি না স্বীকার কর আগে।

—এই কে যেন আসছে এদিকে। পলা ঝন করে টেলিফোন নামিয়ে রাখল। হা-হা শব্দে হেসে উঠল অনিন্দ্য। পলা এমন ভাব করল যেন কেউ তাকে বেসামাল অবস্থায় দেখে ফেলেছে।

অনিন্দ্য দোতলায় নেমে এসে একটা সিগারেট ধরালো। তার মুখে বেশ একটা তৃপ্তির ভাব। চোখ দু-টি যদিও চঞ্চল, আরও কোনো একটা পরিকল্পনা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।

আবার সে তিনতলায় উঠে এসে টেলিফোন তুলল। একটা নম্বর ঘুরিয়ে গম্ভীরগলায় জিজ্ঞেস করল, বাদল আছে?

ওপাশ থেকে উত্তর এল, না, বাদল বাড়ি নেই।

তপন, তপন আছে?

না, সেও নেই।

ওই দু-জন যে এ-সময় বাড়ি থাকে না তা অনিন্দ্য খুব ভালোভাবেই জানে। তবু গলায় বিরক্তি ফুটিয়ে বলল, তপনও নেই? তাহলে দেবযানীকেই ডেকে দাও একবার।

আপনি কে বলছেন?

আমি রিজেন্ট পার্ক থেকে বলছি, তপনের ছোটো মামা।

ধরুন ডেকে দিচ্ছি।

দেবানীর মা নেই। না হলে ছোটোমামার ভাঁওতাটা খাটত না। যদি দেবযানীর কাকা ফোন ধরত তাহলেও গলার আওয়াজ চিনে ফেলত। ওদের বাড়িতে বড্ড কড়াকড়ি।

দেবযানী এসে ফোন তুলতেই সে বলল, আমি ছোটোমামা নই।

হ্যালো, কে?

আমি অভিজিৎ পালিতও নই।

কে আপনি?

আমি অনিন্দ্য।

সঙ্গে সঙ্গে দেবানী ফোন ছেড়ে দিল।

কৌতুকহাস্যে অনিন্দ্য সিগারেটে দু-একটা টান দিয়ে আবার সেই নম্বর ডায়াল করল। দেবযানী হ্যালো বলতেই অনিন্দ্য বলল, তুমি টেলিফোনের পাশেই বসে আছ কেন?

আমার ইচ্ছে।

যদি আমার সঙ্গে কথা বলতে না চাও, তাহলে লাইনটা কেটে দিয়ে রিসিভারটা পাশে নামিয়ে রাখো। না হলে আমি বারংবার রিং করব।

টেলিফোনে এ-রকম বিরক্ত করলে পুলিশে খবর দেওয়া যায়।

তা তো যায়ই। কিন্তু পুলিশ আমাকে খুঁজে বার করলেও আমার পক্ষে এখন থানায় যাওয়ার অসুবিধে আছে। কারণ আমার জ্বর হয়েছে, আর কপালের ফুলো জায়গাটায়…

তোমার জ্বর হয়েছে?

হ্যাঁ, খুব বেশি-না অবশ্য। তবে কপালের কাটা জায়গাটায় যদি সেপটিক হয়ে যায়, তাহলে জ্বর আরও বাড়বে।

সেপটিক?

হ্যাঁ। চটি জুতোর ধুলো লেগেছিল তো। রাস্তার ঘোড়ার ইয়ে অনেক সময় জুতোতে লেগে যায়…তবে টিটেনাস যে হয়নি, তা বোঝা গেছে—চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে তো।

সেপটিক হলে কী হয়?

পদ্মনাভকে মনে আছে? আমাদের সঙ্গে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ত—দাড়ি কামাবার সময়ে একটা ব্রণ কেটে ফেলে ইরিসিপ্লাস হল, দু-দিনের মধ্যে মারা গেল— সেটাও এক ধরনের সেপটিক।

অনিন্দ্য, তুমি শুধু শুধু আমাকে ভয় দেখাচ্ছো।

তোমাকে ভয় পেতে কে বলেছে? তোমার এতে কী-ই-বা আসে যায়?

এবার অনিন্দ্যই দুম করে ফোনটা রেখে দিল। এতক্ষণ গম্ভীরভাবে কথা বললেও তার মুখে দুষ্টুহাসিটা ঠিক লেগে আছে।

তিন মিনিট বাদে আবার টেলিফোন বেজে উঠতেই তার মুখের হাসিটা অনেকখানি বিস্তৃত হয়ে গেল। বিজয়ীর হাসি।

সে ফোন তুলতেই দেবযানী বলল, অনিন্দ্য তুমি যা বললে তা সত্যি? কপালের ওইটুকু কেটে যাওয়ার জন্যই জ্বর হয়েছে? অন্য কেউ কিছু জানে না তো! শিখাকে জিজ্ঞেস করলাম…

আমি তো আর কারুকে কিছু জানাতে যাইনি…

তবে আমাকে জানালে কেন? আমারই দোষে ব্যাপারটা হয়েছে বলে?

না, তাও নয়…

ইস, আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। কেন করলাম বোকার মতন। রাগ হলে আমার জ্ঞান থাকে না…তোমার খুব ব্যথা হচ্ছে?

খুব নয়।

আমি কী করি? আমিও কপাটে মাথা ঠুকব, আমার কপালটাও ওরকম কেটে ফেলব?

খবরদার ওসব কোরো না। কপালে যদি দাগ হয়ে যায়! মেয়েদের কপালে দাগ থাকলে বিয়ে হতে চায় না।

না হোক গে। আমার এত খারাপ লাগছে। অনিন্দ্য, তুমি কেন সবসময় আমার পেছনে লাগো বলো তোর তুমি আমাকে অতটা রাগিয়ে দিলে বলেই…আমি কক্ষনো কারুর গায়ে হাত তুলি না…আমার ছোটো ভাই ভন্তু—ও এক-এক সময় এমন কান্ড করে, তবু আমি মারতে পারি না।

আমাকে মেরে বেশ হাতের সুখ হয়েছিল তো?

খবরদার, আর ওকথা বলবে না। অনিন্দ্য, বিশ্বাস করো, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আমার কোনো ব্যবহারে যদি কেউ কষ্ট পায়—

পলা বলছিল, তুমি নাকি বলেছ, অনিন্দ্যটা মরে গেলেই তুমি খুশি হও।

মুখ দিয়ে একটা ভয়ের শব্দ করল দেবযানী। তারপর দারুণ বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, পলা বলেছে এইকথা? আমি কোনোদিন এ-রকম কথা চিন্তাও করি না—ছি ছি ছি, আমি নিজে মরে যেতে পারি তবু অন্য কারুর…

দেবযানীর অস্পষ্ট ফোঁপানো কান্না শুনতে পেয়ে অনিন্দ্য একটুখানি চুপ করে থেকে ওকে কাঁদতে দিল। তারপর বলল, পলা তাহলে ভুল শুনেছে। তুমি নাকি কোনোদিন আমাকে ক্ষমা করবে না?

মোটেই ভুল শোনেনি। আমার নামে ইচ্ছে করে বানিয়ে বলেছে। যা ঝুড়িঝুড়ি মিথ্যেকথা বলে। হিংসুটি কিনা এক নম্বরের…

পলা কেন তোমাকে হিংসে করবে?

তা ও-ই জানে। দু-চক্ষে দেখতে পারি না। তুমি জানো না, সেদিন থেকে আমার মনের মধ্যে যে কী ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি বার বার ভাবছি, আমি এত খারাপ হয়ে গেছি। তোমার সঙ্গে তো কথা না বলে চলে আসতেই পারতাম।

জানি, আমাকে দেখলেই তোমার রাগ হয়।

মোটেই না। তুমি সবসময় ইচ্ছে করে আমাকে অপমান কর।

আমি শুধু তোমাকে একবার চুমু খেতে চেয়েছি।

ছিঃ ওইসব কথা কেউ বলে?

আমি কী করব, তোমাকে আমার ভাললা লাগে, তোমার মতন এত সুন্দর মেয়ে আমি কখনো দেখিনি, এত সরল, বিশেষ করে চোখ দুটো এত সুন্দর।

এসব তোমার বানানো কথা।

যদি তাই মনে কর, তাহলে আমি আর কী করতে পারি? আমার কথাবার্তার ধরন একটু কাঠখোট্টা, কিন্তু আমি যে মনে মনে তোমাকে কতখানি…

ওসব কথা থাক।

বলতে দাও। জ্বরটা বাড়ছে মনে হচ্ছে, বেশিক্ষণ কথা বলতে পারব না। তোমাকে শুধু জানিয়ে রাখতে চাই, আমি তোমার একজন ভক্ত। তুমি আমাকে যতই ঘৃণা কর, তবু তোমাকে আমি ভালোবাসব, তোমার চোখ দুটোর কথা ভাবলেই আমার বুকটা কাঁপে..

আমি মোটেই তোমাকে ঘৃণা করি না। শোনো, আমি তোমার সঙ্গে যে খারাপ-ব্যবহার করেছি, সেটা মুছে ফেলার জন্য আমি কী করতে পারি?

একটাই মাত্র কাজ আছে। তুমি এক্ষুনি আমার বাড়িতে চলে আসবে। আমার কপালে জলপট্টি লাগাবে, আমার পাশে বসে থাকবে। আমার ঠোঁটে তুমি চটির ধুলো লাগিয়েছিলে, সেটা আঁচল দিয়ে মুছে দিয়ে সেখানে একটা চুমু দেবে…

প্লিজ, ওইকথা বোলো না।

তুমি আমাকে দেখতে আসতে চাও-না?

তোমার জ্বর হয়েছে, তোমাকে দেখতে যেতে পারি নিশ্চয়ই, কিন্তু ওইসব কথা যদি বল–

ঠিক আছে, তাহলে আসতে হবে না।

আমি সে-কথা বলিনি।

তাহলে চলে এসো এক্ষুনি।

আজ? কিন্তু আজ যে আমাদের বাড়িতে অনেক লোকজন আসবে, তাদের সঙ্গে বেরোবার কথা আছে আমার।

বুঝতে পেরেছি, তুমি কাটিয়ে দিচ্ছ। তোমার বাড়ি তো আমার বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়

বিশ্বাস করো, আজ সত্যি উপায় নেই। আগে থেকে কথা দেওয়া আছে, এরমধ্যে আমি যদি বেরিয়ে যাই, খুব খোঁজাখুঁজি হবে। দিদির কাছে বকুনি খাব। কালকে যাব, কথা দিচ্ছি, কাল তোমায় দেখতে যাব।

ঠিক?

হ্যাঁ। বললাম তো কথা দিচ্ছি।

হ্যাঁ।

দুপুর বেলা ঠিক এই সময়ে?

কিন্তু কাল যদি আমার জ্বরটা আরও বাড়ে? হয়তো আমি অজ্ঞান হয়ে থাকব, তোমাকে। চিনতেই পারব না।

না, না, বাড়বে না। আমি তোমার জন্য প্রার্থনা করব। জানো তো, আমি ঠাকুরে বিশ্বাস করি।

তুমি যে-ঘরে বসে ফোন করছ, সেখানে আর কেউ আছে?

না। কেন?

তুমি ঠাকুরের কাছে যত ইচ্ছে প্রার্থনা করো। মোটকথা কাল তোমাকে আসতেই হবে। আর, এখন আমাকে একটা চুমু দাও। টেলিফোনেই।

ওই কথাটা শুনলেই আমার লজ্জা করে—

লজ্জার কী আছে? রিসিভারে মুখ লাগাও। মনে করো, আমার ঠোঁটের ওপর তোমার ঠোঁট, তারপর?

উঁ, না, অনিন্দ্য পারব না আমি।

তোমার অত সুন্দর ঠোঁট, কেন পারবে না?

একবার কিন্তু।

হ্যাঁ একবার।

টেলিফোনটা রেখে দিয়ে অনিন্দ্য একলা ঘরের মধ্যে নাচতে লাগল। কোমর বেঁকিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ভাংড়া নাচ নেচে বেরিয়ে এল বাইরে। সিঁড়িতে একটা কাগজ পড়েছিল। সেটাতে ফুটবলের মতন শট করল। তারপর সেটাকে মারতে মারতেই নেমে এল নীচে।

প্রফুল্লভাবে শিস দিতে দিতে সে ইলেকট্রিকের তারটা লাগাতে শুরু করল আবার। কাজটা সমাপ্ত হলে সে ভাঁড়ারঘরের জানলার দিকে তাকাল।

চোরটা জানলার শিক ধরে একদৃষ্টে চেয়ে আছে তার দিকে। অনিন্দ্যর মনে হল, আজ পৃথিবীতে কোনো মানুষের বন্দি থাকা উচিত নয়।

দরজার শিকলটা খুলে দিয়ে সে বলল, এই, বেরিয়ে আয়।

চোরটা তবু বেরোতে সাহস করছে না।

অনিন্দ্য ঘরের মধ্যে ঢুকে ছেলেটার ঘাড় ধরে বাইরে নিয়ে এল। নতুন করে আবার মার খাওয়ার জন্য ছেলেটার শরীর কুঁকড়ে আছে। তার চোখের নীচে শুকনো জলের দাগ।

অনিন্দ্য তাকে সদর দরজার দিকে এক ধাক্কা দিয়ে বললে, যা। পালা!

বাইরে থেকে রঘু সহায় তক্ষুনি ঢুকল। সে ছেলেটাকে প্রায় খপ করে লুফে নিয়ে বলল, কেয়া ভাগতা হ্যায়। রঘু সহায় তার চুলের মুঠি ধরতেই অনিন্দ্য বলল, ছেড়ে দাও? হাওয়ায় শার্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সে চার টাকা তিরিশ পয়সা বার করে আনল। ছেলেটার হাতে সেগুলো খুঁজে দিয়ে বলল, যা ভাগ। চুরি যদি করতে হয়, অন্য পাড়ায় করবি। ফের এ-পাড়ায় এলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *