তার পর শুরু হল কাজ। কিন্তু এ কি কাজ! একে বোধ হয় বলা চলে কাজের উন্মত্ততা। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, বুঝি অন্য পরিবেশ নেই, জগৎও নেই। মহিম মাথায় করে কিনে নিয়ে এল বিলাতি মাটি, তার সঙ্গে মিশাল নরম মাটি। তার এ কাজকে সে দীর্ঘদিন স্থায়ী রাখতে চায়। তাই দিনের পর দিন চলল, শুধু মাটির অবিকল ছাঁচ গড়া অখিলে আর তার মোষের সেই আলিঙ্গনের মর্মন্তুদ ছবি। সেই ছাঁচে ঢালা হবে বিলাতি মাটি, কাদা মাটির ও আরও নানান বস্তুর মিশ্রিত মশলা। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, কলকাতার ময়দানে বড় বড় মূর্তি, সব ফিরিঙ্গি সাহেব মেমদের। মনে হয়েছিল, বুঝি বাংলা দেশ নয়, দেশ সাহেবদের। সে সব নাকি ঢালাই ধাতুর তৈরি। কিন্তু হাঁ, কারিগর বটে! কী সুন্দর কাজ! আর মহিমের এ কালাচঁাদ আর অখিলের মূর্তি কোথায় থাকবে? কোন ময়দানে, কোন পথের ধারে?
যাক সে ভাবনা, তার উঠোন তো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।
মহিম বুঝি পাগলই হয়ে গেছে। কাজ আর কাজ। নিষ্পলক চোখ, কখনও ঘাড় বাঁকায়, আপনমনে কথা বলে, হাসে আবার গুম হয়ে বসে থাকে। প্রহর গড়ায়। কখনও মনে হয়, সে যেন নয়নপুরে নেই, অন্য কোথাও চলে গেছে! কখনও দেখে বিরাট একটা মোষ আকাশের কোল ঘেঁষে ভয়াল বেগে ছুটে চলেছে! যার দিকে চায়, তাদের সকলেই যেন অখিল বলে মনে হয়। কাজের মাঝেই এক অদ্ভুত আবেগে সে হঠাৎ কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকে। সেটা পলায়ন নয়, যেন মায়ের কোলে স্তন পান করতে করতে হঠাৎ শিশু আনমনা হয়ে স্তন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে, আবার স্তন মুখে গুঁজে দেয়, তেমনি এক খেলা। কখনও কখনও আপনমনেই তীক্ষ্ণ চোখে যেন লক্ষ করে, একটা মানুষের টুকরো টুকরো হাড় পড়ে আছে তার কাছে, তার প্রতিটি গ্রন্থির সঙ্গে গ্রন্থি বাঁধতে গিয়ে সে যেন হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। দেহের থেকে আলাদা করে নেওয়া সমস্ত তন্ত্রী জট পাকিয়ে গেছে, কেমন করে সে সব সারা অঙ্গে ঠিক করে পরিয়ে দিতে হবে, যেন খেই হারিয়ে ফেলছে তার। তার পর আচমকা তার চোখের সামনে একটা জ্যান্ত মানুষের ভেতরটা যেন ধরা পড়ে যায়। একটা অদ্ভুত কলকল শব্দে দিকে দিকে রক্তের ওঠা-নামা, বিচিত্র ভাঁজ মাংসের, তার ভেতরে একটা অন্ধ গুহা। সেখানে কিছু বা দেখা যায়, কিছু যায় না। এমনি সব অদ্ভুত চিন্তা।
অহল্যা তাড়া দেয়, ধরে নিয়ে যায়, ধমক দেয়। যাও নেয়ে এসো, না হইলে সব গোবর গণেশ করে দেব। খাওয়া ভুললে রেখে দেব কিন্তু রান্নাঘরে পুরে কুলুপকাটি এঁটে।’
ভারত দূর থেকে উঁকি মারে, কোটা ডান হাত থেকে বাঁ হাতে নেয়, বাঁ হাত থেকে ডান হাতে। ভাবে ছোঁড়ার চোখে মুখে কী যেন রয়েছে। এতই আপনভোলা যে, ভরত গিয়ে তার স্বাভাবিক মর্যাদায় একটু টিটকারি দেবে, তাও প্রাণ চায় না। মনে বলে, পাগল কি আর গাছে ফলে?…কিন্তু পরমুহূর্তেই নিশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে তার বুক। সমস্ত ছোটখাটো মামলাগুলোতে তার গো-হারা হয়েছে। সত্য, সে পরকে ঠকিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। মহিম তাকে শনি বলে গাল দিয়েছে। কিন্তু আজ সরাসরি জমিদারের সঙ্গে মামলায় যদি তার পরাজয় হয়, তবে এ ভিটে যে চাটি হবে! সবই তো গেছে জমিদারের গর্ভে, বাকি খুব সামান্যই। তাকে ঠেকেজোড়া দিয়ে রাখতে কি ভরত পারবে!
তবে এ হল তার নিতান্তই একলার ভাবনা। নিতে চাইলেও এর ভাগ সে কাউকে দেয়নি। সে একাকীত্বের কথা মনে করে নিশ্বাস সে কিছুতেই চেপে রাখতে পারে না!
এর কিছু দুশ্চিন্তা অহল্যারও আছে, তবে তার কিছু করবার নেই। সে দেখে, মহিম এত সমস্ত কাজের মধ্যেও মাঝে মাঝে কেমন যেন উন্মনা হয়ে ওঠে, আশেপাশে কেবলি তাকায়।
অহল্যা জিজ্ঞেস করে, কারে খোঁজো, কী চাই? বার বার এড়িয়ে গিয়ে শেষটায় মায়ের কাছে শিশুছেলের মত বলে, কুঁজো মালা তো আসল না বউদি, সে কি নয়নপুরে আসে নাই?
ও মাগো! অহল্যা হাসিতে ফেটে পড়ে। বলে, এই কথা? তুমি কি তুমি আছ যে দেখবে? সে আসল, দেখল, হাত মাত ঝুলিয়ে কত রঙ্গ করল। তা এতক্ষণে সে বোধ হয় রাজ্য মাতিয়ে বেড়াচ্ছে।
বটে! কুঁজো কানাই এর মধ্যে ঘুরে গেছে! কিন্তু সে তো কিছু বলল না মহিমকে। তার আবেগদীপ্ত চোখের দিকে তাকালে যে মহিম অনেক কিছুর হদিস পায়। মানুষটা পাশে থেকে বকবক করে, বিচক্ষণের মতো কখনও বা চোখ কুঁচকে ভ্রূ তুলে মহিমের কাজ দেখে, হাসে, মাথা নাড়ে। মহিমের মতো সেও যেন পুতুলে প্রাণপ্রতিষ্ঠার সাধনায় আত্মসমর্পণ করেছে। সামনে থাকলে টের পাওয়া যায় না সে কতখানি। না থাকলে বড় ফাঁকা লাগে।
সেই রাত্রেই কুঁজো কানাই এল। রাত্রি তখন গভীর। ভরত অহল্যা শুয়ে পড়েছে। মহিমের ঘর অন্ধকার, সে বসে আছে দাওয়ায়। ঘুম নেই তার চোখে। না, কখনওই নয়। হ্যাঁ, এমনই তার কাজের দুরন্ত বেগ যে, আরেগ ও চিন্তা বলে বস্তুটা যতক্ষণ ক্লান্ত হয়ে না পড়ছে ততক্ষণ ঘুম নেই তার!
অন্ধকারে হাত আর মাথা দুলিয়ে কানাই আসছে দেখেই মহিম চিনতে পারল। পেছনে পেছনে পাড়ার কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে আসছে। পেছন ফিরে কানাই তাড়া দিতে কুকুরগুলো খেপে ওঠে আরও। কানাই তাড়া দিয়ে হাসে।
মহিম তাড়াতাড়ি দাওয়া থেকে নেমে গিয়ে কুকুর তাড়িয়ে কানাইয়ের হাত ধরে। এখন আসলা যে কানাইদা?
মহিমের কোমরে হাত দিয়ে কানাই বলল, চিনি তো তোমারে। জানি যে, ঘুম নাই তোমার চ’কে। তা, দেখো না, পাছে লাগছে পাজিগুলান। দাওয়ায় উঠে বলল, রাতে-বেরাতে তো বার হই না। কুকুর তাড়া করে, গাঁয়ের ঘরে মেইয়েমানুষরা ভয়ে ভুকরায়, মালি দেয় লোকে। কিন্তুক না আইসে পারলাম না একটুখানি। তারপর খাড়া হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে মহিমের কাঁধে হাত দিয়ে মাথাটা তার নামিয়ে নিয়ে আসে নিজের মুখের কাছে। বলে, অখলে আর তার মোষের পিতিমে গড়তে লাগছে দেখে পরান মোর কেবলি বলছে, তুমি যেন দেবতা।
কেন কানাইদা?
দেবতা মানুষকে কি এত ভালবাসে? সে যদি তোমার ছটাকখানেক ভালও বাসত অখলেকে তবে বুঝি এমনটা হইত না।
এ যে কুঁজো কানাইয়ের পোড়া প্রাণের জ্বালা, তা জেনে বিস্মিত বেদনায় স্তব্ধ রইল মহিম। দেখল, কানাই নিজের মনে মাথা দোলাচ্ছে। বলল, দেবতা নয়, সে কান্না, সে ছবি যদি তুমি দেখতে কানাইদা!
জানি জানি, মোরে বলতে হইবে না।’ বলে আরও চিন্তামগ্নভাবে মাথা নাড়ে কানাই।
একটু চুপ থেকে মহিম বলল, মোর চোখে ঘুম নাই সে তুমি জানো তো কী বলে খবর না দিয়ে গাঁ ছাড়লে তুমি?
কানাই হেসে তাড়াতাড়ি মহিমের হাত নিয়ে নিজের গায়ে মাথায় বোলাতে লাগল। বলল, খানিক লজ্জায়, সে মোরে সবাই বলছে তুমি নাকি পাগলাপনা হইছিলে। তার পর চোখে মৃতি ফুটিয়ে ফিসফিস করে বলল, সেও এক মস্ত কাজ। এবার যে যার ধান কেটে নিয়া আসবে, ঝাড়াই মাড়াই করবে। তা সে জমিদারই হোক আর যাই হোক। তোমার জমিতে খাটি, তোমার জমিতে বাস করি, তা বলে কি তোমার গোলাম থাকব? কাজ নাও, দাম দাও, হ্যাঁ। শুধু এই লয়, বাড়তি খাজনাও বন্ধ। অক্ষয় জোতদারের সঙ্গেও খুব একটা কিছু হবে ধানের ভাগ দখল নিয়ে। গাঁয়ে ঘরে ওরা মোরে দেখতে পারে না জানোয়ার বলে। কিন্তু যখন কাজের কথা বলল, মহী পরানটা মোর জেগে উঠল। খবরদার বলো না যেন কাউকে এ-সব কথা, মানা আছে।
কুঁজো কানাইয়ের গোপন কথা যে মহিম জানে, তা, সে প্রকাশ করতে চাইল না। মহিম বলল, তা তুমি আসো নাই কেন এতদিন? নয়নপুরে কি ছিলে না?
কানাই যেন মহিমকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো বলল, ছিলাম গো ছিলাম। গাঁয়ে ঘুরে ঘুরে ভাবটা দেখছি একটু, মনিষ জনে কী বলে। আর, সবারে বললাম তোমার নতুন কীর্তির কথা। আবার মহিমের ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল, চোখ বড় বড় করে, কাল হইল বোধন, সবাই পিতিমে দেখবে। তোমার কালাচাঁদের পিতিমে দেখতেওযে আসবে সবাই। কাজ তোমার শেষ হইবে কবে?
এইবার শেষ হইবে। তুমি না আসলে থাকলে মোর ভাল লাগত না।’
বটে কথা। মাথা দুলিয়া হাসল কানাই। বলল, তুমি শুধু মোরে লয়, অখলের মোষটারেও ভালবাস। তবু তুমি কুঁজো লও। বলে, আর একদফা মহিমের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আসব, কাল আসব।
তার পর ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ করে আবার ঘুরে দাঁড়াল, কী ভেবে মাথা দুলিয়ে হাসল, নাল ঝরল খানিক হাঁ করা তার মুখের থেকে! চোখ ঠেলে উঠল কপালে। বলল, তবে বলি একটা কথা।
মহিম বলল, কী কথা কানাইদা?
কানাইয়ের ঠেলে ওঠা চোখের দৃষ্টি অন্তরাবদ্ধ হয়ে উইঠল। ফিসফিস করে বলল, কালু মালার সোন্দরী মেইয়ে সোয়ামীর বেড়ন খেয়ে কুরচিতলায় পা ছড়িয়ে বসে কাঁদে, সে মুর্তি কি গড়া যায় না?
হাসতে গিয়ে হঠাৎ বুকের কাছে খচ করে কী যেন বিধে গেল মহিমের, কথা বলতে পারল না।
পরমুহূর্তেই কানাই হো হো করে হেসে উঠল। মিছেমিছি কেমন খেপলাম তোমারে, পাগল খ্যাপা।
বলতে বলতে অন্ধকার উঠোনে নেমে ছুটে চলে গেল সে। সে অন্ধকারেও মহিম স্পষ্ট দেখতে পেল একটা মানুষের পিঠে যেন কালো কুৎসিত অপদেবতা বোঝার মতো চেপে তার নৈশ অভিযানে বেরিয়েছে। যেন উধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে একটা ভারবাহী পশু।
ওদিকে খুট করে একটা শব্দ হল। অহল্যা বেরিয়ে মহিমের কাছে এসে বলল, কে, কুঁজো মালা আসছিল বুঝি?
হ্যাঁ।
অহল্যা বলল, নেও, পরানটা ঠাণ্ডা হইছে?
অন্ধকার থেকে চোখ সরল না মহিমের। বলল, পরান যে ঠাণ্ডা হয় না কভু; সেখানে মোর কেবলি আগুন আগুন। তারপর অহল্যার দিকে তাকিয়ে বলল, বউদি, এ জগতে সবার পরানেই বুঝি আগুন। কুঁজো মালারও।
আগুন। অহল্যা দেখল অন্ধকারেও মহিমের চোখ যেন জ্বলছে। হ্যাঁ, বুঝি সবার পরানেই আগুন। সে আগুন কী, কীসের, কখন কেমন করে, কীরূপে মানুষের প্রাণের মধ্যে দপ করে জ্বলে ওঠে তার কোনও হদিস জানা না থাকলেও আগুনের আঁচ লাগে নির্বাক অহল্যার। সে তরতর করে দাওয়া থেকে উঠোনে নেমে গিয়ে মুহূর্ত থেমে বলল, রাত মেলাই, শুতে যাও। তার পর উঠোন পেরিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। এ বিশ্ব সংসারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আগুন, আগুন মানুষের বুক ভরা, পেট ভরা। সে কথা কি বলে দিতে হবে অহল্যাকে? না, ওগো না! অহল্যাকে তোমরা যে যা-ই ভাবো, তার বুকভরা আগুনকে যে নজরেই দেখো, সে জ্বালা যে শুধুই তার। নিরন্তর দহন যে মাত্র একলার।