ঠকচাচার বাড়িটি শহরের প্রান্তভাগে ছিল— দুই পার্শ্বে নানা পুষ্করিণী, সম্মুখে একটি পীরের আস্তানা। বাটীর ভিতরে ধানের গোলা, উঠানে হাঁস, মুরগী দিবারাত্রি চরিয়া বেড়াইত। প্রাতঃকাল না হইতে হইতে নানা প্রকার বদমায়েশ লোক ঐ স্থানে পিল পিল করিয়া আসিত। কর্ম লইবার জন্য ঠকচাচা বহুরূপী হইতেন—কখন নরম—কখন গরম—কখন হাসিতেন—কখন মুখ ভারি করিতেন—কখন ধর্ম দেখাইতেন—কখন বল জানাইতেন। কাজকর্ম শেষ হইলে গোসল ও খানা খাইয়া বিবির নিকট বসিয়া বিদ্রির গুড়গুড়িতে ভড়র ভড়র তাঁমাক টানিতেন। সেই সময়ে তাঁহাদের স্ত্রী-পুরুষের সকল দুঃখ-সুখের কথা হইত। ঠকচাচী পাড়ার মেয়ে মহলে বড়ো মান্যা ছিলেন—তাহাদিগের সংস্কার ছিল যে তিনি তন্ত্রমন্ত্র, গুণকরণ, বশীকরণ, মারণ-উচ্চাটন, তুকতাক, জাদু, ভেল্কি ও নানা প্রকার দৈব বিদ্যা ভালো জানেন, এই কারণ নানারকম স্ত্রীলোক আসিয়া সর্বদাই ফুস-ফাস করিত। যেমন দেবা তেমনী দেবী—ঠকচাচা ও ঠকচাচী দু-জনেই রাজযোটক—স্বামী বুদ্ধির জোরে রোজগার করে, স্ত্রী বিদ্যার বলে উপার্জন করে। যে স্ত্রীলোক স্বয়ং উপার্জন করে তাহার একটু একটু গুমর হয়, তাহার নিকট স্বামীর নির্জলা মান পাওয়া ভার, এই জন্যে ঠকচাচাকে মধ্যে মধ্যে দুই-একবার মুখঝাম্টা খাইতে হইত। ঠকচাচী মোড়ার উপর বসিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন— তুমি হর রোজ এখানে ওখানে ফিরে বেড়াও —তাতে মোর আর লেড়কাবালার কি ফয়দা? তুমি হর ঘড়ি বলো যে বহুত কাম, এতনা বাতে কি মোদের পেটের জ্বালা যায়। মোর দেল বড়ো চায় যে জরি জর পিনে দশজন ভালো ভালো রেন্ডির বিচে ফিরি, লেকেন রোপেয়া কড়ি কছুই দেখি না, তুমি দেয়ানার মতো ফের—চুপচাপ মেরে হাবিলিতে বসেই রই। ঠকচাচা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হইয়া বলিলেন—আমি যে কোশেশ করি তা কি বলব, মোর কেত্না ফিকির-কেত্না ফন্দি—কেত্না প্যাঁচ—কেত্না শেস্ত তা জবানিতে বলা যায় না, শিকার দন্তে এল এল হয় আবার পেলিয়ে যায়। আলবত শিকার জল্দি এসবে এই কথাবার্তা হইতেছে ইতিমধ্যে এক জনা বাঁদী আসিয়া বলিল—বাবুরামবাবুর বাটী হইতে একজন লোক ডাকতে আসিয়াছে। ঠকচাচা অমনি স্ত্রীর পানে চেয়ে বলিল—দেখ্চ মোকে বাবু হরঘড়ি ডাকে—মোর বাত না হলে কোনো কাম করে না। মুইও ওক্ত বুঝে হাত মারবো।
বাবুরামবাবুর বৈঠকখানা বসিয়া আছেন। নিকটে বাহির সিমলের বাঞ্ছারামবাবু, বালীর বেণীবাবু ও বৌবাজারের বেচারামবাবু বসিয়া গল্প করিতেছেন। ঠকচাচা গিয়া পালের গোদা হইয়া বসিলেন।
বাবুরাম। ঠকচাচা ! তুমি এলে ভালো হল—লেটা তো কোনো রকমে মিট্চে না —মকদ্দমা করে করে কেবল পালকে জোলকে জড়িয়ে পড়ছি—এক্ষণে বিষয়-আশয় রক্ষা করবার উপায় কি ?
ঠকচাচা। মরদের কামই দরবার করা —মকদ্দমা জিত হলে আফদ দফা হবে। তুমি একটুতে ডর করো কেন ?
বেচারাম। আ মরি ! কী মন্ত্রণাই দিতেছ? তোমা হতেই বাবুরামের সর্বনাশ হবে তার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই—কেমন বেণী ভায়া কি বলো ?
বেণী। আমার মতে খানকে দু-খানা বিষয় বিক্রয় করিয়া দেনা পরিশোধ করা ও ব্যয় অধিক না হয় এমন বন্দোবস্ত করা আবশ্যক আর মকদ্দমা বুঝে পরিষ্কার করা কর্তব্য কিন্তু আমাদিগের কেবল বাঁশবনে রোদন করা—ঠকচাচা যা বলবেন সেই কথাই কথা।
ঠকচাচা। মুই বুক ঠুকে বলছি যেত্না মামলা মোর মারফত হচ্ছে সে সব বেলকুল ফতে হবে —আফদ বেলকুল মুই কেটিয়ে দিব—মরদ হইলে লড়াই চাই—তাতে ডর কি ?
বেচারাম। ঠকচাচা। তুমি বরাবর বীরত্ব প্রকাশ করিয়াছ। নৌকাডুবির সময়ে তোমার কুদরৎ দেখা গিয়াছে। বিবাহের সময় তোমার জন্যেই আমাদিগের এত কর্মভোগ, বরদাবাবুর উপর মিথ্যা নালিশ করিয়াও বড়ো বাহাদুরি করিয়াছ আর বাবুরামের যে যে কর্মে হাত দিয়াছ সেই সেই কর্ম বিলক্ষণই প্রতুল হইয়াছে। তোমার খুরে দণ্ডবৎ। তোমার সংক্রান্ত সকল কথা স্মরণ করিলে রাগ উপস্থিত হয়—তোমাকে আর কি বলি ? দূঁর দূঁর !! বেণী ভায়া উঠ এখানে আর বসিতে ইচ্ছা করে না।