১৬. ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে

ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। লক্ষণ ভালো না। খনা বলেছেন– ‘যদি বর্ষে আগনে, রাজা যান মাগনে।’ এখন অঘাণ মাস। বৃষ্টির কারণে ধুম করে শীত নেমে গেছে। মাওলানার বাড়ির উঠানে বৃষ্টির পানি। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। বিকেলের দিকে বৃষ্টি ধরে এসেছিল, এখন আবার জোরে নেমেছে। পানি বরফের মতো বিধছে। শরীর কাটা দিয়ে উঠছে।

বৃষ্টি মাথায় করে এক লোক মাওলানার উঠানে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর পায়ে গামবুট। মাথায় ছাতা। ছাতায় বৃষ্টি মানছে না। লোক গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, মাওলানা সাহেব আছেন?

কেউ জবাব দিল না। তবে ঘরে মানুষ আছে বোঝা যাচ্ছে। দুটা কামরাতেই বাতি জ্বলছে। লোক বারান্দা থেকে উঠানে উঠে এসে দরজায় ধাক্কা দিলেন।

মাওলানা সাহেব আছেন?

দরজা সামান্য ফাঁক করে যমুনা উত্তর দিল, উনি বাড়িতে নাই।

তোমার নাম যমুনা?

যমুনা ভীত ভঙ্গিতে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। লোক বললেন, আমি তোমাকে চিনি। তোমার কথা শুনেছি। মাওলানা সাহেব আমার পরিচিত। আমাকে ভেতরে ঢুকতে দাও। তোমার ভয়ের কিছু নাই।

যমুনা বলল, আপনার পরিচয়? পরিচয় জানতে চাও, না নাম জানতে চাও? একেক সময় একেক নাম নিয়ে চলাফেরা করি। তোমাকে মূল নামটাই বলি। আমার নাম জীবনলাল। জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়। আমাকে কি চিনেছ?

চিনেছি। আপনি ভিতরে আসেন।

আমাকে গা মোছার গামছা দাও। শুকনা কাপড় দাও। যে ঠাণ্ডা লেগেছে। ঠাণ্ডায় মারা যাব। আমার সঙ্গে চা পাতা আছে। চা বানাতে পার পার?

না।

জটিল রান্না না। গরম পানিতে পাতা ছেড়ে দেবে। পানিতে যখন রঙ ধরবে তখন ছেকে দিবে। চিনি দুধ থাকলে দিতে পার। না থাকলেও ক্ষতি নাই।

যমুনা অতি দ্রুত ব্যবস্থা করল। মাওলানার লম্বা পিরান এবং পায়জামা পরে জীবনলাল চৌকিতে বসে রইলেন। তাঁর সামনে মাটির মালশায় কাঠকয়লার আগুন। জীবনলাল আগুনে পা সেঁকছেন। তার হাতে গ্লাসভর্তি চা। শেষ মুহুর্তে তিনি চায়ে আদা দিতে বলেছেন। আদার সুঘ্ৰাণ আসছে।

জীবনলাল বললেন, অতি আরামদায়ক অবস্থা। কিন্তু মাওলানা কোথায়?

যমুনা বলল, উনি তাঁর স্ত্রীকে স্নান করাতে নিয়ে গেছেন।

বিবাহ করেছেন না-কি?

না। উনার মাথায় সামান্য দোষ হয়েছে। উনার ধারণা বিবাহ করেছেন। তার স্ত্রী আছে। স্ত্রীর সঙ্গে তিনি কথাবার্তা বলেন। মাঝে মাঝে রাতে স্ত্রীকে স্নান করাতে নদীতে নিয়ে যান।

আজও নদীতে নিয়ে গেছেন?

হুঁ।

অনেক রকম পাগলের কথা শুনেছি, এরকম শুনি নাই।

যমুনা বলল, বড়ই দুঃখী মানুষ। অনেকরাত পর্যন্ত জেগে থাকেন, স্ত্রীর সঙ্গে कश्री दब्लনা।

জীবনলাল বললেন, উল্টাও হতে পারে। হয়তো উনি আনন্দে আছেন। কল্পনার স্ত্রী বাস্তবের চেয়ে ভালো হবার কথা।

যমুনা বলল, আপনি কি রাতে এখানে থাকবেন?

না।

খাবেন না?

না। রাতে শশাংক পালের বাড়িতে খাব। এবং রাতেই চলে যাব। যমুনা তুমি বলো— আমাকে দেখতে কি একজন মাওলানার মতো লাগছে?

যমুনা বলল, লাগছে। আপনার দাড়ি আছে, মাওলানার পোশাক পরছেন।

ঘরে কি সুরমা আছে? সুরমা থাকলে চোখে সুরমা দেব।

সুরমা আছে। আতরও আছে।

যমুনা সুরমা এবং আতর। এনে দিল। জীবনলাল বললেন, আমি তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে এসেছি। আমার স্ত্রী হিসেবে তুমি বোরকা পরে যাবে। কোথায় যাবে সেটা বলব না।

যমুনা বলল, আপনার কথা বুঝতে পারছি না। আপনার সঙ্গে আমি কেন যাব? পরিষ্কার করে বলেন।

জীবনলাল হাই তুলতে তুলতে বললেন, পরিষ্কার করে বলতে পারব না। আমি সুরেনের একটা পত্র নিয়ে এসেছি। পত্র পড়লেই বুঝতে পারবে। তুমি যদি রাজি থাক, আমি ভোর রাতে রওনা হব।

যমুনা হতভম্ব গলায় বলল, কার চিঠি এনেছেন?

জীবনলাল বললেন, সুরেনের। সুরেনকে চেনো না? এই নাও চিঠি। অন্য ঘরে নিয়ে পড়। আমার সামনে পড়তে হবে না। চিঠি শেষ করে আমাকে আরেক গ্লাস চা দিও।

যমুনা সুরেনের চিঠি নিয়ে পাশের কামরায় চলে গেছে। তার হাত-পা কাঁপছে। বুক ধড়ফড় করছে। মনে হচ্ছে, সে যে-কোনো মুহুর্তে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। চিঠিটা পড়তে পারবে না। জগতে এত বিস্ময়কর ঘটনাও ঘটে!

সুরেন লিখেছে—

যমুনা,

তুমি জানো না। আমি বিপ্লবীদলে যোগ দিয়েছি। নানান কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত। তবে তোমার সব খবর পেয়েছি। যে ভয়াবহ সময় তুমি পার করেছ তা সমস্তই জানি। তখন কিছুই করতে পারছিলাম না। যে মাওলানা তোমাকে আশ্রয় দিয়েছেন তাকে আমার প্রণাম। যদি কখনো তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় তাহলে আমি অবশ্যই ভক্তিভরে তাকে প্ৰণাম করব।

তোমাকে সাধারণ নিয়মে বিবাহ করার অনুমতি আমি আমার পিতা-মাতা এবং জ্ঞাতি গোষ্ঠীর কাছ থেকে পাব না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ব্ৰাহ্মমতে তোমাকে বিয়ে করব। বিশ্বাস করো, অতীতে তোমার জীবনে কী ঘটেছে তা আমার মাথায় নাই। কোনোদিন থাকবেও না। বিয়ের পর আমরা দুইজনেই দেশমাতৃকার চরণে জীবন উৎসর্গ করব। তুমি জীবনলালের সঙ্গে চলে আসবে। বন্দে মাতরম।
সুরেন

একটা গুরুত্বপূর্ণ চিঠি মানুষ কতবার পড়ে? বেশ কয়েকবার। যমুনা একবারই মাত্র চিঠিটা পড়ল এবং চিঠি মুঠিবদ্ধ করে বৃষ্টির মধ্যে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল। তার শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে প্ৰচণ্ড জ্বর আসছে। কোনোকিছুই সে স্পষ্ট দেখতে পারছে না।

 

হরিচরণের কবরের পাশে হাঁটু গেড়ে যমুনা বসে আছে। মনে মনে বলছে, হরিকাকু, আমার জীবন যে এরকম হবে আমি জানতাম। আপনি আমাকে আশীৰ্বাদ করেছিলেন। সুরেনের চিঠি আপনাকে দেখানোর জন্যে আমি নিয়ে এসেছি। যমুনা কবরের দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে হাঁটু গেড়ে আছে। তার মাথার দীর্ঘচুল মাটিতে লুটাচ্ছে। তার শরীরে অঝোর ধারায় বৃষ্টির পানি পড়ছে। সে ঠিক করেছে, ভোরের আলো না ফোঁটা পর্যন্ত সে এইভাবেই থাকবে। একচুলও নড়বে না।

 

মাওলানা ঘরে ফিরেছেন। জীবনলালের সঙ্গে আগ্রহের সঙ্গে গল্প করছেন। জীবনলাল বললেন, যমুনা মেয়েটা হঠাৎ করে কোথায় চলে গেল? ডেকেও পাচ্ছি না। তার কাছে আরেক গ্লাস চা চেয়েছিলাম।

মাওলানা বললেন, সে তার ভাবির সঙ্গে গল্প করতেছে। মেয়েদের নিজেদের অনেক কথা থাকে।

আপনি আপনার স্ত্রীকে নদীতে স্নান করিয়ে এনেছেন?

জি জনাব। হঠাৎ শখ করেছে নদীতে স্নান করবে। মেয়েদের ছোটখাটো শখ মেটানো উচিত। এতে নবিয়ে করিম (দঃ) খুশি হন।

ভাই, কিছু মনে করবেন না। আপনার তো খুব ভালো চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন।

মাওলানা বললেন, আমার চিকিৎসা হওয়ার প্রয়োজন নাই জনাব। আমার শরীর ভালো আছে। শশাংক বাবুর চিকিৎসা দরকার, উনি বিরাট কষ্টে আছেন।

সবাইকে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়।

মাওলানা বললেন, আপনার কথায় সামান্য ভুল আছে। এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা কোনো পাপ করেন নাই। কিন্তু কঠিন কষ্টের ভেতর দিয়ে গিয়েছেন। আল্লাহপাকের অনেক ইচ্ছাই বুঝা মুশকিল। আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি অতি সীমিত। একটু বসেন, আপনার ভাবি সাহেব আমাকে ডাকে।

আমি কিন্তু কোনো ডাক শুনি নাই।

চুড়ির শব্দ করে ডেকেছে। মুখে কিছু বলে নাই। মেয়েদের গলার স্বর পরপুরুষের শোনা নিষেধ বলেই কথা বলে নাই।

জীবনলাল বললেন, বৌদি কী বলেন, শুনে আসুন।

মাওলানা চলে গেলেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত হলেন। হাসিমুখে বললেন, আপনার ভাবি সাহেব আপনাকে খানা খেতে বলেছেন। আয়োজন সামান্য। আলুভর্তা। ডিমের সালুন। বেগুন দিয়ে ডিমের সালুন সে ভালো রান্না করে।

জীবনলাল বললেন, বৌদির রান্না আমি আরেকদিন এসে খেয়ে যাব। আমাকে এখন শশাংক পালের বাড়িতে যেতে হবে। উনার সঙ্গে কিছু কথা আছে। খাওয়া-দাওয়া উনার ওখানেই করব।

আপনার ভাবি সাব মনে কষ্ট পাবেন।

আপনি বুঝিয়ে বলবেন। ভালো কথা, আমি আপনার জন্যে একটা উপহার এনেছি।

কী উপহার?

আপনাকে বলেছিলাম, ভাই গিরিশের বাংলা কোরান শরীফ আপনাকে দেব। নিয়ে এসেছি।

আলহামদুলিল্লাহ। কী বলেন! আপনার মনে ছিল? আমি নিজে ভুলে গিয়েছিলাম।

আমি ভুলি নাই। ভাই আমি উঠি। আপনি যমুনা মেয়েটিকে খুঁজে বের করুন। সকালে সে আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবে। তার অতি নিকট একজন তাকে গ্রহণ করেছেন। ব্ৰাহ্মমতে তারা বিবাহ করবে।

শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।

 

শশাংক পালকে দেখে জীবনলাল সত্যিকার অর্থেই দুঃখিত হলেন। জড় পদার্থের মতো একজন মানুষ। সমস্ত শরীরে পানি এসেছে। চোখ ঘোলাটে। কথাবার্তা সম্পূর্ণ এলোমেলো। ক্ষণে ক্ষণে মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। জীবনলাল বললেন, আমাকে চিনেছেন?

শশাংক পাল বললেন, কেন চিনব না? আপনি বিশিষ্ট চিকিৎসক। আমার চিকিৎসার জন্যে এসেছেন। ঠিকমতো চিকিৎসা করেন। পয়গাম পাবেন সোনার মোহর।

আমার নাম জীবনলাল। জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়।

নামে কিছু যায় আসে না। আপনার পরিচয় আপনার চিকিৎসায়। বৃক্ষকে জিজ্ঞাস করা হলো, বৃক্ষ তোমার নাম কী? বৃক্ষ বলল, ফলেন পরিচয়তে। অর্থাৎ ফলে পরিচয়। আপনার বেলাতেও তাই- আপনার পরিচয় চিকিৎসায়। চিকিৎসা কখন শুরু করবেন?

আগে রোগ নির্ণয় করি, তারপর চিকিৎসা।

অতি সত্য কথা। তবে রোগ নির্ণয়ের কিছু নাই। আমার রোগের নাম মৃত্যুরোগ। মৃত্যুরোগের চিকিৎসা নাই এইটাও জানি। শুধু ব্যবস্থা করে দেন একবেলা যেন আরাম করে খেতে পারি। জামাই পছন্দ চালের পোলাও, ঝাল দিয়ে রান্না কচ্ছপের ডিম, মুরগি মোসাল্লাম। ভরপেট খাব। তারপর তেঁতুলের টকা খাব জামবাটিতে এক বাটি। তেঁতুলের টিকে জিরাবাটা দিতে হবে। সামান্য গোলমরিচ। গৌরীপুরের মহারাজার বাড়িতে একবার খেয়েছিলাম। স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।

জীবনলাল বললেন, আপনার কি ধনু শেখের কথা মনে আছে?

শশাংক পাল বললেন, কেন মনে থাকবে না! উনি বিশিষ্ট ব্যক্তি- খান সাহেব।

এখন আরো বিশিষ্ট হয়েছেন। এখন তিনি খান বাহাদুর। বলুন মারহাবা।

শশাংক পাল বললেন, মারহাবা।

উনার পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়েছিল। গ্যাংগ্রিন আরাম হয়েছে। এখন তিনি ঠ্যাং কাটা খান বাহাদুর।

শশাংক পাল আনন্দিত গলায় বললেন, আপনি উনার চিকিৎসা করেছেন? আপনি তো মহাশয় ব্যক্তি। আমার চিকিৎসা শুরু করেন। আমার ধারণা আমার উদরি রোগ হয়েছে। যে চিকিৎসক খান সাহেব ধনু শেখকে আরোগ্য করেছে সে আমাকেও পারবে।

জীবনলাল বললেন, যত কঠিন রোগই আপনার হোক আপনাকে কিন্তু কাবু করতে পারে নাই। অন্যের জায়গা জমি দখল করে আরামে বাস করছেন। এই বিষয়সম্পত্তির মালিক কে বলুন তো দেখি?

শশাংক পাল বললেন, মালিক কেউ না। মানুষ সামান্য দিন ভোগ করতে আসে। কেউ ভোগ করতে পারে কেউ পারে না। যার জমি তারই থাকে।

কথা মন্দ বলেন নাই। জীবনের শেষ পর্যায়ে সবাই ভালো ভালো কথা বলে।

শশাংক পাল বললেন, ভালো ভালো কথা বলে না। সাধারণ কথাই বলে। অন্যদের শুনতে ভালো লাগে।

জীবনলাল বললেন, আপনি কিন্তু আমাকে ঠিকই চিনেছেন। চিনেও না চেনার ভান করেছেন। মৃত্যুর কাছাকাছি সময়েও আপনার বুদ্ধি ঠিক আছে। সচরাচর এরকম দেখা যায় না। এখন বলুন আমাকে চিনেছেন না?

হুঁ। আপনার বন্ধু শশী মাস্টার। তার কি ফাঁসি হয়েছে?

হয়েছে।

শশাংক পাল দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মানুষটা ভালো ছিল। নিজের মনে গান করত, নিশি রাতে কলের গান বাজাত। জীবনের আনন্দ কিছুই দেখল না। ফাঁসিতে ঝুলে পড়ল। ভালো কথা, আপনি কি আমাকে শাস্তি দিতে এসেছেন?

জীবনলাল বললেন, যে শাস্তি আপনি পাচ্ছেন তাই যথেষ্ট।

শশাংক পাল বলল, শুনে আরাম পেয়েছি। আপনাকে দেখে কলিজা নড়ে গিয়েছিল। ভাবলাম ধনু শেখ যেমন গুলি খেয়েছে, আমিও খাব।

জীবনলাল বললেন, আমার ক্ষুধা পেয়েছে। খাবারের আয়োজন করেন।

অবশ্যই। অবশ্যই খাওয়ার আয়োজন করব। সপ্ত ব্যঞ্জন থাকবে। নিজে খেতে পারি না তাতে কী। অন্যের খাওয়া আগ্রহ করে দেখি। কী খেতে চান বলেন? কচ্ছপের ডিম খাবেন? সংগ্রহ করে রেখেছি।

নিরামিষ খাব।

বিধবার খাবার খেয়ে কী করবেন? এখনো হজমের ক্ষমতা যখন আছে— আরাম করে খান। যখন হজমের ক্ষমতা চলে যাবে তখন ঘাস লতাপাতা খাবেন।

 

জীবনলাল খেতে বসেছেন। আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন শশাংক পাল। যেন অতি আনন্দময় দৃশ্য দেখছেন। শশাংক পাল বললেন, খবরাখবর কিছু বলেন, আপনার কাছ থেকে শুনি। গান্ধিজি না-কি ডিগবাজি খেয়েছেন?

জীবনলাল বললেন, ডিগবাজি খেয়েছেন কি-না জানি না, তবে অহিংস আন্দোলন থেকে উনার মন উঠে গেছে।

এটা ভালো না খারাপ?

সময় বলবে ভালো না খারাপ।

আরেকটা যুদ্ধ নাকি হবে?

হতে পারে। মানুষ যুদ্ধ পছন্দ করে। মুখে বলে শান্তি শান্তি। পছন্দ করে যুদ্ধ। তবে আনন্দের কথা, হিটলার সাহেব রাশিয়ার স্তালিনের সঙ্গে চুক্তি করেছেন। এরা কেউ কারো বিরুদ্ধে কোনো দিন যুদ্ধ করবে না।

বাহ ভালো তো।

দুই পররাষ্ট্র সচিব চুক্তিতে দস্তখত করেছেন। জার্মানির পক্ষে রিবেনট্রোপ, রাশিয়ার পক্ষে মালোটভ। চুক্তি সইয়ের দশদিনের মধ্যে দুই দেশ পোলান্ড আক্রমণ করে পোলান্ড ভাগাভাগি করে নিয়ে গেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগল বলে।

বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আমরা কার পক্ষে থাকব?

আমরা থাকব জাপানের সম্রাট হিরোহিতের পক্ষে। নেতাজির তাই ইচ্ছা। এশিয়ানরা থাকব এশিয়ানদের সঙ্গে।

শশাংক পাল বললেন, অবশ্যই। শরীরটা সুস্থ থাকলে আমি যুদ্ধে চলে যেতাম। সবই দেখা হয়েছে, যুদ্ধ দেখা হয় নাই। যুদ্ধ দেখার মধ্যেও মজা আছে। কী বলেন?

জীবনলাল হেসে ফেললেন।

শশাংক পাল বললেন, খেয়ে তৃপ্তি পেয়েছেন?

পেয়েছি।

ধূমপান করবেন? ভালো তামাক আছে। মেশক-এ-আম্বুরী।

জীবনলাল বললেন, ধূমপান করব না। আপনার আতিথেয়তায় আনন্দ পেয়েছি। আমি আপনাকে বিশেষ এক চিকিৎসার কথা বলতে পারি। চিকিৎসাটা করে দেখতে পারেন। রেইন ফরেষ্টের পিগমী জাতীয় মানব গোষ্ঠীর কেউ কেউ জীবনের শেষ চিকিৎসা হিসেবে এই চিকিৎসা করেন।

শশাংক পাল আগ্রহ নিয়ে বললেন, চিকিৎসাটা কী বলুন। যত অৰ্থ ব্যয় হয় হবে। চিকিৎসা করব। টাকা এখন আমার কাছে তেজপাতা।

জীবনলাল বললেন, এই চিকিৎসায় কোনো খরচ নাই। আপনাকে একটা স্বাস্থ্যবান গাছ খুঁজে বের করতে হবে। তারপর নগ্ন অবস্থায় এই গাছ জড়িয়ে ধরতে হবে। বারবার বলতে হবে— হে বৃক্ষ, তুমি আমার রোগ গ্রহণ করে আমাকে রোগমুক্ত কর।

কতবার বলতে হবে?

এর কোনো হিসাব নাই। দিনের পর দিন বলতে হবে। এক মুহুর্তের জন্যেও গাছের স্পর্শ থেকে দূরে থাকা যাবে না। কোনো খাদ্য খাওয়া যাবে না। পারবেন?

পারব। নগ্ন হওয়া লজ্জার বিষয়। মরতে বসেছি, এখন আর লজ্জা কী? আসছি নেংটা, যামু নেংটা। আপনি এখনি শুয়ে পড়বেন? আসুন আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করি। রাতে আমার ঘুম হয় না। আগে মদ্যপান করে ঘুমাতাম, এখন মদ্যপানও করতে পারি না। আফসোস।

জীবনলাল বললেন, আমি রাতে থাকব না, চলে যাব। মন দিয়ে আমার কথা শুনুন। জহির নামে কেউ যদি আসে তাকে বিষয়সম্পত্তি সব বুঝিয়ে দেবেন।

শশাংক পাল বললেন, অবশ্যই। অবশ্যই। মা কালীর চরণ স্পর্শ করে প্ৰতিজ্ঞা করলাম।

আমি কিন্তু আবার আসব।

যতবার ইচ্ছা আসেন। কোনো সমস্যা নেই। শশাংক পাল সারাজীবন এক কথা বলে।

 

হরিচরণের কবরের পাশে সকাল থেকেই জবুথবু হয়ে এক লোক বসে আছে। তার পা নগ্ন, চোখ রক্তাভ। মাথার চুল উসকু খুসকু। তার গায়ে হলুদ রঙের চান্দর। চাদরের প্রায় সবটাই মাটিতে। কাদায় পানিতে মাখামাখি হয়ে আছে।

মসজিদের নতুন মাওলানা দৃশ্যটা লক্ষ করছেন। তিনি একসময় এগিয়ে এলেন। কঠিন গলায় বললেন, তুই কে?

চোখ তুলে তাকাল। জবাব দিল না।

বোবা কালা না-কি? তোর নাম কী?

লাবুস।

তোর নাম লাবুস? হিন্দু?

মুসলমান।

দেখি চার কলেমা বল। শুনে দেখি মুসলমান কি-না। খৎনা হয়েছে?

লাবুস বলল, তুই কে?

মাওলানা করিম হতভম্ব। বদমাইশ তুই তুই করছে। এত বড় বেয়াদবি এর আগে তার সঙ্গে কেউ করে নাই। মাওলানা করিম বললেন, এখানে বসে আছিস কী জন্যে?

আমার ইচ্ছা।

আমি জুম্মাঘরের ইমাম। আমার সঙ্গে ঠিকমতো কথা বল।

তুই আগে আমার সঙ্গে ঠিকমতো কথা বল। আদবের সঙ্গে কথা বল।

মাওলানা করিম বললেন, তুই তো বিরাট বেয়াদব। তোকে আগে কখনো দেখি নাই। তুই কোন গ্রামের?

লাবুস বলল, আরেকবার আমারে তুই করে বললে টান দিয়ে তোর লুঙ্গি খুলে ফেলব।

কী বললি?

কী বলেছি তুই শুনেছিস। আমি বলেছি আরেকবার আমাকে তুই বললে আমি টান দিয়ে তোর লুঙ্গি খুলব। তারপরেও তুই করে বলেছিস। এখন লুঙ্গি খোলার টাইম।

লাবুস উঠে দাঁড়াল। গায়ের চাদর খুলে পাশে রাখল। মাওলানা করিম আর এক মুহুৰ্তও দেরি করলেন না। বোঝাই যাচ্ছে এই লোক পাগল। পাগলকে বিশ্বাস নাই। মাওলানা করিম উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছেন। একবারও পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন না। পেছনে তাকালে দেখতেন তাকে কেউ অনুসরণ করছে না। লাবুস আগের জায়গাতেই বসে আছে। মাটিতে ফেলে দেয়া চাদর এখন তার গায়ে।

মাওলানা করিম সোহাগগঞ্জ বাজারের কাছাকাছি এসে থামলেন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে তার বুক ধড়ফড় করছে। এখন তিনি লজ্জার মধ্যে পড়েছেন। অনেকেই তাকে দৌড়াতে দেখেছে। তাদের মধ্যে নানান প্রশ্ন জাগবে। কী উত্তর দেবেন? তার লুঙ্গি খুলে ফেলবে এই কথা তো বলা যাবে না। তাঁর এখন অনেক ইজ্জত। লোকজন তাকে মানে। খুৎবার সময় যে কঠিন বক্তৃতা দেন তা শোনে। দোজখের বর্ণনা তাঁর মতো কেউ দিতে পারে বলে তিনি মনে করেন না। তার সবচে’ বড়গুণ দোজখের বর্ণনা দিতে দিতে ভয়ে অস্থির হয়ে কেঁদে ফেলা। নকল কান্না না। আসল কান্না। এই দৃশ্য বান্ধবপুরের কেউ আগে দেখে নি। তাঁর নাম ফাটছে। জুম্মাবারে দূর দূর থেকে লোকজন নামাজ পড়তে আসছে।

প্রথমবারের মতো তিনি উরসের আয়োজনও করছেন। উরস হবে। মোহাম্মদ আহম্মদ সাহেবের (হরিচরণ) নামে। তিনি স্বপ্নে পেয়েছেন। কবরে শায়িত এই ব্যক্তি অনেক বড় মর্যাদার আসন পেয়েছেন। উরসের তারিখ পড়েছে ২ ফাল্লুন। বৃহস্পতিবার। উরস উপলক্ষ্যে বড় বড় আলেমরা আসবেন। বিয়ান হবে। পাক কোরানের তফসির করা হবে। খানা চলবে সারাদিন। রাত বারোটা এক মিনিটে আখেরি মোনাজাত হবে। মোনাজাত তিনি নিজে পরিচালনা করবেন।

যে মাওলানা অতি অল্পসময়ে বান্ধবপুরে এমন মর্যাদার আসনে চলে গেছেন তিনি লুঙ্গি খুলে ফেলার ভয়ে প্ৰাণপণে দৌড়াচ্ছেন এটা ভেবে মাওলানার চোখে পানি আসার মতো হলো। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, পবিত্র উরসের দিনে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বদমায়েশটাকে এমন শাস্তি দেয়া হবে যা সে বাকি জীবন মনে রাখবে।

 

হলুদ চাদর গায়ে অচেনা এক লোক হরিচরণের বাগানে ঘুরঘুর করছে। শশাংক পালের বিরক্তির সীমা রইল না। বাগানে বাইরের লোক যেন না চুকে এমন নিষেধ দেয়া আছে। তারপরেও হুট হাট করে লোকজন কীভাবে ঢুকে? শশাংক পাল লোকটিকে ডেকে পাঠালেন। কঠিন গলায় বললেন, নাম কী?

লাবুস।

বাগানে ঘুরঘুর কর কেন? কী চাও? মতলব কী?

কিছু চাই না। আমার কোনো মতলব নাই।

শশাংক পাল বললেন, ফালতু কথা বলব না। চেহারা দেখেই বোঝা যায় তুমি মতলব নিয়া আসছে। পিতার নাম কী?

সুলেমান।

শশাংক পাল কিছুক্ষণ পিটপিট করে লোকটির দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, তোমার আসল নাম কি জহির?

লোকটি বলল, একসময় নাম জহির ছিল। এখন লাবুস।

লাবুস নামই ভালো। সবেরে এই পরিচয় দিবা। জহির পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন নাই। তা বাবা তুমি দেশান্তরী ছিলা, সেইটাই তো ভালো ছিল। আবার কেন এসেছ?

একটা কাজ সমাধা করার জন্যে এসেছি। কাজ সমাধা করে চলে যাব।

ভালো, খুবই ভালো। যাতায়াতের খরচ আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে। কোনো অসুবিধা নাই। তা বাবা কী কাজ সমাধা করার জন্যে আসছ? আপত্তি না থাকলে তুমি আমারে বলে।

আমি আমার মাকে খুন করতে আসছি। তার নাম জুলেখা।

শশাংক পাল বললেন, তাকে চিনি। ভালোমতো চিনি। তাকে খুন করার বাসনা হওয়া স্বাভাবিক। আমি তার পুত্র হলে আমিও এই কাজ করতাম। সে বান্ধবপুরে নাই। কলিকাতায় থাকে। কলিকাতায় গিয়া খোঁজ নাও। রাহাখরচ আমি দিতেছি।

আপনি কেন দিবেন?

খুশি হয়ে দেব। তোমার পিতার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা আছে, সেই দাবিতে দিব। তাছাড়া আমার শরীর খারাপ। দুই একদিনের মধ্যে জংলি এক চিকিৎসা শুরু করব। মারি না বাঁচি নাই ঠিক। কিছু দান খয়রাত এই কারণে করতে মন চায়। তোমারে দুইশ’ টাকা দেই।

এত টাকা!

আচ্ছা যাও, আরো বাড়ায়া দিলাম। আড়াইশ’। তুমি আজই রওনা দিয়ে দাও।

 

ফাল্গুন মাসের দুই তারিখ মহা ধুমধামে উরশ শুরু হয়েছে। লালসালুর কাপড় দিয়ে পুরো অঞ্চল ঘিরে দেয়া হয়েছে। শত শত আগরবাতি জ্বলছে। দূর থেকে আতরের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মঞ্চ করা হয়েছে। মঞ্চে দু’জন মাওলানা বসে আছেন। তৃতীয় একজন মাওলানার আসার কথা, তিনি এখনো এসে পৌঁছান নি।

শিন্নি গ্ৰহণ করার আলাদা জায়গা করা হয়েছে। গরু শিনি দেয়া নিষেধ (হরিচরণ নাকি স্বপ্নে এরকম নির্দেশই দিয়েছেন) বলেই খাসি, মুরগি, হাঁস আসছে। একজন একটা মহিষ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। মহিষের বিষয়ে কী করা হবে সেই সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। প্রচুর লোকজন জড়ো হয়েছে, আরো আসছে।

 

হরিচরণের বাড়ির সামনেও কিছু লোকজন জড়ো হয়েছে। কারণ শশাংক পাল অদ্ভুত চিকিৎসা শুরু করেছেন। তার ধারণা এই চিকিৎসায় ফল হবে।

শশাংক পাল নগ্ন হয়ে হরিচরণের বাড়ির সামনের শিউলি গাছ জড়িয়ে ধরে বসে আছেন। তিনঘণ্টা পার হয়ে গেছে। দর্শনার্থীরা ব্যাপার-স্যাপার দেখে কিছুটা ভীত। সাহস করে কেউ কাছে আসছে না। শশাংক পাল সবাইকে ধমকাচ্ছেন— ভাগো। ভাগো। নেংটা মানুষ এর আগে কোনোদিন দেখো নাই? বদের দল।

মওলানা ইদরিসও দেখতে গেলেন। তার চোখে পানি এসে গেল। আহা বেচারা! তিনি ক্ষীণস্বরে বললেন, একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দিলে হয় না?

শশাংক পাল ধমকে উঠলেন, ঢাকাঢাকি চলবে না, জংলি চিকিৎসার এইটাই १छ्झ।

মাওলানা বললেন, কিছু আরাম কি বোধ হচ্ছে?

শশাংক পাল বললেন, এখনো কিছু বুঝতে পারছি না। বিষ পিঁপড়ায় কামড়াচ্ছে, এর একটা উপকার থাকতেও পারে।

বৃষ্টি হলে কী করবেন?

ভিজতে হবে, কিছু করার নাই। বাদ জংলিগুলা এই চিকিৎসা বের করেছে। থাপড়ায় এদের দাঁত ফেলে দেয়া দরকার ছিল।

শশাংক পাল চোখ বন্ধ করলেন। কথা বলে নষ্ট করার সময় তার নেই। গাছের কাছে প্রার্থনায় যেতে হবে। হে বৃক্ষ! আমাকে রোগমুক্ত কর।

নগ্ন একজন মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকতে লজ্জা লাগছে। মাওলানা অন্যদিকে তাকিয়ে বসে আছেন। মানুষটার জন্যে তার হঠাৎ করে বড় মায়া লাগছে।

সন্ধ্যার আগেই বৃষ্টি নামল। শশাংক পাল ভিজছেন। মাওলানাও ভিজছেন। শশাংক পাল মহাবিরক্ত হয়ে বললেন, আপনার ঘটনা। কী? আপনি কেন ভিজতেছেন? যান, বাড়িতে যান।

মাওলানা তারপরেও বসে রইলেন।

 

রাতের অন্ধকারে কুপকূপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কে একজন মাওলানা ইদরিসের বাড়িতে ঢুকেছে। কালো বোরকায় তার শরীর ঢাকা। মুখ খোলা, তবে মুখ ছাতায় ঢাকা। মহিলা বাড়িতে উঠে বাতি জ্বালাল। উঠানে রাখা কলসির পানিতে পায়ের কাদা মুছতে মুছতে নিচু গলায় গাইল—

যমুনায় জল নাই গো
জল নাই যমুনায়
আইজ রাধা কোনবা গাঙে যায়।

মহিলা কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে এসেছেন। তিনি পুঁটলি খুলে নতুন শাড়ি বের করলেন। শাড়ির রঙ কমলা। তিনি আয়নায় নিজেকে দেখে সামান্য হাসলেন। আর তখনি ছপছপ শব্দ তুলে উঠানে মাওলানা এসে দাঁড়ালেন। অভ্যাস মতো ডাকলেন, বউ!

বাড়ির ভেতর থেকে পরিষ্কার জবাব এলো, কী?

মাওলানা চমকে উঠলেন। চমকে উঠার কোনো কারণ নেই। স্ত্রী ঘরে আছে, ডাকলে সে তো জবাব দেবেই। কিন্তু…

মাওলানা বললেন, বৌ একটা ঘটনা ঘটেছে।

‘কী ঘটনা?’ বলে বাড়ির ভেতর থেকে জুলেখা বের হয়ে এলো। সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, ভেতরে আসেন, বলেন ঘটনা। কী? মন দিয়া শুনি।

মাওলানা অস্থির ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছে। সমস্যাটা বুঝতে পারছেন না।

জুলেখা বলল, এইভাবে তাকায়া কী দেখেন?

মাওলানা বিড়বিড় করে বললেন, বউ, আমার মাথায় কী জানি হয়েছে।

জুলেখা বলল, আমি খবর পেয়েছি। এখন আমি আপনার সঙ্গে আছি। আপনার মাথা আমি ঠিক করে দিব। ইশ, কী ভিজাই না ভিজেছেন! গরম পানি করে দেই, সিনান করেন।

মাওলানা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

 

সময় সেপ্টেম্বরের দুই তারিখ, ১৯৩৯, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড যুদ্ধ ঘোষণা করেছে জার্মানির বিরুদ্ধে। পৃথিবী অপেক্ষা করছে আর এক মহাযুদ্ধের জন্যে।

মানবজাতি অপেক্ষা পছন্দ করে না। তারপরেও তাকে সবসময় অপেক্ষা করতে হয়। ভালোবাসার জন্যে অপেক্ষা, ঘৃণার জন্যে অপেক্ষা, মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা, আবার মুক্তির জন্যে অপেক্ষা।

শশাংক পাল যেমন গাছ জড়িয়ে ধরে অপেক্ষা করেন, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ফাঁসির দড়ির দিকে তাকিয়ে বিপ্লবীরাও অপেক্ষা করেন। অপেক্ষাই মানবজাতির নিয়তি।

[প্রথম খণ্ড সমাপ্ত]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *