জাহানারার জ্বর এসেছে।
এমন কিছু না, থার্মোমিটার একশ হয়ত উঠবে না, কিন্তু তিনি বিছানায় পড়ে গেছেন এবং কাতরাচ্ছেন। মাথায় ঘূর্ণির মত হচ্ছে। মনে হচ্ছে তিনি নৌকায় বসে আছেন। নদীতে প্রবল ঢেউ উঠেছে। তিনি কেবলি ওঠা-নমা করছেন।
তিনি বিনুকে ডাকলেন। বিনু সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকাল। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কী হয়েছে? জ্বর এসেছে? তিনি জবাব দিলেন না। বিনুকে দেখে এখন তাঁর বিরক্ত লাগছে। সে জ্বর দেখার জন্যে হাত বাড়াতেই তিনি বললেন, গায়ে হাত দিও না তো। কেউ গায়ে হাত দিলে আমার ভাল লাগে না। বিনু বলল, ডাক্তারকে খবর দিব?
জাহানারা। থমথমে গলায় বললেন, ডাক্তারকে খবর দিতে হলে আমি খবর দিব। তোমাকে খবর দিতে হবে কেন? তুমি কে?
এ ধরনের অপমানসূচক কথা শোনার পর বিনুর দাঁড়িয়ে থাকার কথা না। কিন্তু সে দাঁড়িয়ে আছে। বিনু বলল, জ্বর মেপেছেন?
জাহানারা বললেন, না।
জ্বর মাপার থার্মোমিটার জাহানারার সাইড টেবিলের ড্রয়ারে থাকে। সেখানে পাওয়া গেল না। বিনু ব্যস্ত হয়ে থার্মোমিটার খুঁজছে। জাহানারা ভুরু কুঁচকে বিনুর দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর ইচ্ছা কঠিন কোনো কথা বলে বিনুকে আহত করা। কঠিন কথাগুলি মনে আসছে না। তাছাড়া তিনি চাচ্ছেনও না বিনু তাঁর ঘরে থাকুক। শুভ্র তার মার অসুখের খবর পেয়েছে। সে মাকে দেখতে আসবে। মায়ের বিছানার কাছে চেয়ার টেনে বসবে। মাতা-পুত্রের কথার মাঝখানে তৃতীয় কারোর থাকা छेद्धि ना।
জাহানারা বললেন, বিনু আমি বাঁচি না মাথার যন্ত্রণায়— তুমি কী খটখট শুরু করেছ? কী খোঁজ?
থার্মেমিটার।
তোমাকে ডাক্তারনী সাজতে হবে না। তুমি ঘর থেকে যাও। শুভ্রর সকালের চা আমার ঘরে পাঠাবার ব্যবস্থা কর। তাহলেই হবে।
বিনু বলল, উনি নেই। বের হয়ে গেছেন।
জাহানারা হতভম্ব হয়ে বললেন, ও কখন গেল?
দশ মিনিট আগে।
আমার শরীর খারাপ করেছে এটা কি সে জানে?
জ্বি জানেন। আমাকে বলে গেছেন ডাক্তার আনার ব্যবস্থা করতে।
আমাকে দেখে যাবার কথা তার মনে হল না?
উনার অফিসে কী-না-কী জরুরি কাজ আছে। চাচি আপনাকে এক কাপ আদা চা দেব?
জাহানারা যন্ত্রের মত বললেন, দাও।
তার হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে। এসব কী হচ্ছে? শুভ্ৰ জানে তাঁর জ্বর। তারপরেও সে ঘরে উঁকি না দিয়েই চলে গেল? এ রকম তো কখনো হয় নি। প্রথম হল। প্ৰথমের পরই দ্বিতীয় আসে, দ্বিতীয়র পরে আসে তৃতীয়। হচ্ছেটা কী? বিনুর সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে আলাপ করবেন? না, তা কেন করবেন? বিনু কে? বিনু কেউ না। তাদের ব্যক্তিগত কোনো কিছুর সঙ্গেই বিনুর যোগ থাকবে না। বিনু ছাড়া আর কে আছে যার সঙ্গে কথা বলা যায়! ঢাকা শহরে তাঁর আত্মীয়স্বজনের অভাব নেই। কোনো একটা খবর পেলেই এরা বীকে বাকে কাকের মত উড়ে আসে। চা-নাশতা খায়, বিজ্ঞের মত কথা বলে। অসহ্য।
বিনু চা নিয়ে ঢুকল। এক হাতে চা অন্য হাতে একটা থার্মোমিটার; জাহানারা বললেন, থার্মেমিটার কোথায় পেলে?
কিনিয়েছি।
আগেরটা পাওয়া যাচ্ছে না বলে ফন্ট করে নতুন কিনে ফেললে? অন্যের টাকা বলে মায়া নেই তাই না? সরকারি মাল, দরিয়ামে ঢাল।
বিনু কিছুই বলল না। প্রায় যন্ত্রের মতই থার্মোমিটার এগিয়ে দিল। জাহানারা থার্মেমিটার মুখে দিলেন। এখন তাঁর মনে হচ্ছে জ্বর চেপে আসছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। বমি ভাবও হচ্ছে। তবে খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার নৌকার দুলুনির মত অবস্থাটা আর নেই।
বিনু বলল, আপনার সঙ্গে একটা মেয়ে দেখা করতে এসেছে! আরেকদিন আসতে বলব?
জাহানারার ইচ্ছা করছে হাত বাড়িয়ে বিনু মেয়টার গালে একটা চড় মারেন। তাঁর মুখে একটা থার্মোমিটার ঢুকিয়ে সে ইচ্ছা করে প্রশ্নটা করেছে যাতে তিনি জবাব দিতে না পারেন। কী রকম বজ্জাত একটা মেয়ে! বজ্জাত মেয়েটার অস্থি মজ্জায়। এইসব মেয়েদের একমাত্র অষুধ হল সকাল বিকাল চড় থাপড় দেয়া।
জ্বর একশ এক। এমন কিছু বেশি না, কিন্তু জ্বর বাড়ছে। জাহানারা লক্ষ করলেন তাঁর নিঃশ্বাসের কষ্ট শুরু হয়েছে। এটা নতুন এক উপসর্গ। শরীর একটু খারাপ করলেই নিঃশ্বাসের কষ্ট শুরু হয়।
মেয়েটা কে?
আমি চিনি না।
আমার কাছে চায় কী?
জিজ্ঞেস করি নি।
জিজ্ঞেস করবে না কেন? না-কি জিজ্ঞেস করলে তোমার সম্মান যাবে? মানসম্মান নিয়েতো তালগাছের ওপর বসে আছ। এতদিন এখানে পড়ে আছ। কেউতো খোঁজ নিতেও আসে না। কীসের আশায় তুমি পড়ে আছ?
বিনু চুপ করে আছে। তার মুখ ভাবলেশহীন। কে কী বলছে বা বলছে না তা যেন সে শুনছে না। বা শোনার প্রয়োজন বোধ করছে না। জাহানারা বললেন, যাও মেয়েটাকে এখানে নিয়ে এসে।
আপনার শরীরটা খারাপ, তাকে বরং আরেকদিন আসতে বলি?
মাতব্বরি করবে না। মাতব্বরি আমার ভাল লাগে না। তাকে এখানে নিয়ে এসো।
এখানে আনার দরকার নেই। আপনি একটু কষ্ট করে নিচের বসার ঘরে চলুন।
এত কথা বলছি কেন? তাকে নিয়ে আসতে বললাম নিয়ে আস। হড়বড় করে এত কথার দরকার কী? বেশি কথা বলা অভ্যাস হয়ে গেছে? কথা না বললে পেটের ভাত হজম হয় না? অসুস্থ শরীরে আমি নিচে যাব? আমাকে কোলে করে কে নিয়ে যাবে–তুমি?
বিনু চলে গেল। জাহানারা খাটে হেলান দিয়ে বসলেন। অপরিচিত একটা মেয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। কে এই মেয়ে? শুভ্রর পরিচিত কেউ? মীরা নাতো? শুভ্র যার গলার হাসি রেকর্ড করে এনেছিল। কী যে পাগল ছেলে! মানুষ রাত জেগে ক্যাসেটে গান শুনে। এই ছেলে শুনে হাসি। একবার রাত তিনটায় খিলখিল হাসির শব্দে তাঁর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। শুভ্রর ঘর থেকে হাসির শব্দ আসছে। তিনি জানেন ক্যাসেটে রেকর্ড করা হাসি, তারপরেও ভয়ে তার হাত পা ঠাণ্ড হয়ে গিয়েছিল। নিশি রাতে মেয়েদের উঁচু গলার হাসি খুবই ভয়ঙ্কর। যেই কন্যা নিশিরাত্ৰিতে শব্দ করিয়া এবং শরীর দুলাইয়া হাসে, সেই কন্যা স্বামী ঘাতাকিনী। লক্ষণ বিচার বইতে এই কথা পরিষ্কার লেখা আছে।
জাহানারা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। কী সুন্দর মেয়ে! পাতলা ঠোঁট। বড় বড় চোখ। গায়ের রঙও কত ভাল। ধবধবে সাদা না, অন্যরকম সাদা! চুল লম্বা, সেই চুলে সামান্য খয়েরি আভা আছে। অতিরিক্ত ফর্স মেয়েদের চুলের রঙে সব সময় এই সমস্যাটা হয়। জাহানারা খুব আগ্রহ নিয়ে মেয়েটার চোখের মণির দিকে তাকালেন। অসম্ভব রূপবতীদের কোনো-না-কোনো সমস্যা থাকেই। দেখা যায় তাদের চোখে ট্যারা ভাব থাকে, চোখের মণি হয় কটা। দাঁতের সমস্যা তো থাকেই। দাঁত ফাঁক থাকে, গোঁজা দাঁত থাকে। এই মেয়েটার দাঁত কেমন বোঝা যাচ্ছে না, কারণ এখনো দাঁত দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা যেভাবে ঠোঁট চেপে আছে তাতে মনে হয় দাঁতে সমস্যা আছে। অনেক রূপবতী মেয়ে আছে যাদের সবই সুন্দর, দাঁতও সুন্দর; শুধু তারা যখন হাসে তখন মাঢ়ি বের হয়ে যায়। এ রকম কিছু নাতো?
জাহানারা আগ্রহ নিয়ে বললেন, মা বোস। এই চেয়ারটায় বোস।
মেয়েটা বসল। তিনি ভেবেছিলেন বসার সময় মেয়েটা সামান্য হলেও হাসবে, সেই সুযোগে তিনি মেয়েটার দাঁতগুলি দেখে ফেলতে পারবেন। তাঁর মনের খুঁতখুঁতনিটা দূর হবে। মেয়েটার দাঁত না দেখা পর্যন্ত তাঁর অস্থির ভাব যাচ্ছে না।
আমি কি তোমাকে চিনি?
মেয়েটা বলল, না, চিনেন না। তবে আমি আপনাকে চিনি।
জাহানারা মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। এইবার মেয়েটা হোসেছে। তার দাঁত ঠিক আছে। এবং গলার স্বরও সুন্দর। একটু ভারী। মনে হয় ঠাণ্ডায় বসে। যাওয়া গলা। তারপরেও ভাল। জাহানারা লক্ষ করলেন মেয়েটা খুব আগ্রহ নিয়ে ঘর দেখছে। সাজসজ্জা দেখছে। দেয়ালে টানানো ছবিগুলি দেখছে। জাহানারা বললেন, এইটা আমার ছেলের ছবি। শুভ্ৰ। ও যখন কলেজে। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে তখন তোলা ছবি।
আমি উনাকে চিনি।
তুমি কি তার সঙ্গে পড়?
জ্বি না। তোমার নাম কী মা?
নাম বললে আমাকে চিনতে পারবেন বলে মনে হয় না। আমার নাম আসমানী।
জাহানারা তাকিয়ে আছেন। তাঁর কাছে মনে হচ্ছে খাটটা দুলছে। খাটের দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শরীর দুলছে এবং মাথার ভেতরটা দ্রুত ফাঁকা হতে শুরু হয়েছে। বুক শুকিয়ে গেছে। পানির তৃষ্ণা হচ্ছে। কেউ যদি বরফ মেশানো এক গ্লাস পানি দিত! বিনু নেই কেন? সে থাকলে তার দিকে তাকিয়ে একটু ভরসা। পাওয়া যেত। তিনি কি ডাকবেন বিনুকে? আচ্ছা এই জন্যেই কি বিনু মেয়েটাকে শেবার ঘরে আসতে দিতে চায় নি? বিনু কি চিনতে পেরেছিল মেয়েটাকে? অবশ্যই চিনতে পেরেছে। গরম লাগছে কেন? মনে হচ্ছে তিনি জ্বলন্ত চুলার সামনে বসে আছেন। মুখে শীত লাগছে, কিন্তু পিঠের দিকে ঠাণ্ডা লাগছে।
আসমানী আরেকটু ঝুঁকে এসে বলল, আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?
জাহানারা জবাব দিলেন না; আসমানী বলল, আমি খারাপ মেয়ে। এখন চিনেছেন?
জাহানারা প্ৰায় ফিসফিস করে বললেন, তুমি এখানে এসেছ কেন? কী চাও তুমি?
কথা বলতে আসছি।
কী কথা তোমার?
আপনার কি শরীর খারাপ?
আমার শরীর খারাপ না ভাল তা দিয়ে তোমার দরকার নেই! তুমি এ বাড়িতে এসেছে কেন?
আসমানী হাসি মুখে বলল, আপনার স্বামী, আপনার ছেলে যদি আমাদের বাড়িতে আসতে পারে, আমরা আসতে পারব না কেন?
চাও কী তুমি?
কথা বলতে আসছি।
কার সঙ্গে কথা বলতে এসেছ?
আপনার সাথে। আপনি ছোট সাহেবের মা। আপনার সাথেই কথা বলা দরকার।
বল কী বলবে।
ছোট সাহেব প্রায়ই আমার কাছে যায়। এইটা আপনারে জানালাম।
তার যেখানে ইচ্ছা সে সেখানে যাবে। সে যদি নরকের কৃমির সঙ্গে সময় কাটাতে চায়, কাটাবে। আমাকে বলার দরকার নেই। তোমার এত বড় সাহস, তুমি আমাকে বলতে আস! জুতা দিয়ে পিটিয়ে আমি তোমাকে…
উত্তেজনায় জাহানারার কথা আটকে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। বিনু চলে এসেছে। সে দরজা ধরে দাঁড়িয়েছে। জাহানারা চাপা গলায় বললেন, বিনু লাথি দিয়ে এই হারামজাদি মেয়েকে রাস্তায় বের করে দাও। এত বড় সাহস!
বিনু আসমানীর দিকে তাকিয়ে বলল, উনার শরীর ভাল না। তুমি বাইরে এসে বস। কী কথা বলতে এসেছ আমাকে বল।
আসমানী খুবই সহজ গলায় বলল, আমার কথা বলা শেষ। এখন আমি চলে যাব। ছোট সাহেব যদি অন্য মানুষদের মত হত, আমি কিছুই বলতে আসতাম না। নষ্ট পুরুষ মানুষ ফূর্তি করার জন্যে খারাপ পাড়ায় যাবেই। এটা নতুন কী! কিন্তু ছোট সাহেব তো অন্যদের মত না। হঠাৎ একদিন যদি বলে, আসমানী আমারে বিবাহ করা। তখন কী উপায় হব? আপনার ছেলের বউ হিসেবে আমারে ঘরে নিবেন?
জাহানারা চেঁচিয়ে বললেন, বিনু এই হারামজাদি মেয়ে এইসব কী বলছে? সে এখনো কোন যাচ্ছে না?
আসমানী উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, যেটা সত্য সেটা বলতেছি। কিছু সত্য কথা আছে বলতে খারাপ লাগে, কিছু শুনতে ভাল লাগে। আমারটা সেই রকম।
জাহানারা বললেন, বের হ। এই মেয়ে তুই বের হ। তুই এই মুহূর্তে বের হ। বলতে বলতে জাহানারা খাট থেকে নামতে গেলেন। বিনু এসে তাকে ধরে ফেলল। তিনি শরীর এলিয়ে বিনুর কাঁধে পড়ে গেলেন। আসমানী এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে–তাকে ঘিরে যে নাটকটা তৈরি হয়েছে, সেই নাটক দেখে সে খুব মজা পাচ্ছে।
জাহানারার জ্বর খুব বেড়েছে। তার মাথায় অনেকক্ষণ ধরে পানি ঢালা হচ্ছে— জ্বর তেমন নামছে না। বরং যতই সময় যাচ্ছে চোখ ততই লালচে হয়ে আসছে। ডাক্তার এসে দেখে গেছেন। অষুধপত্র দেন নি। অষুধপত্র দেবার মত কিছু হয় নি। বুক পরিষ্কার, প্রেসার নরম্যাল।
বিনুর কাছে কোনো কিছুই নরম্যাল মনে হচ্ছে না। জাহানারা একবার বললেন, শুভ্রর বাবা কি এসেছে? বিনু চমকে উঠে বলল, কী বলছেন? জাহানারা চোখ বন্ধ করতে করতে বললেন, কিছু না। হঠাৎ মনে হল শুভ্ৰর বাবা বেঁচে আছে। শুভ্ৰ এর মধ্যে বাড়িতে টেলিফোন করে নি?
বিনু বলল, না।
ও যদি টেলিফোন করে, আমার অসুখের খবর দিবে না।
জ্বি আচ্ছা।
ঐ হারামজাদি মেয়ের কথাও কিছু বলবে না।
জ্বি আচ্ছা।
যদি কিছু বল— ঐ হারামজাদিকে আমি যেভাবে জুতাপেটা করে তাড়িয়েছি, তোমাকেও সেভাবে জুতাপেটা করে তাড়াব।
জ্বি আচ্ছা।
যে চেয়ারে ঐ হারামজাদি বসেছিল, সেই চেয়ারটা ডাস্টবিনে ফেলে দিতে বলেছিলাম, এখনো ফেলছ না কেন? আর শোন, তোমাকে না বললাম— আমার গায়ে হাত না দিতে। গায়ে হাত দিচ্ছ কেন?
টেলিফোনের রিং হচ্ছে। জাহানারা মাথা উঁচু করে বললেন, শুভ্ৰ টেলিফোন করেছে। বিনু, টেলিফোন ধর।
চবিনু টেলিফোন ধরল। শুভ্ৰই টেলিফোন করেছে। শুভ্ৰ খুশি খুশি গলায় বলল, কে, বিনু?
হ্যাঁ।
বিনু তোমার বিষয়ে আমার ইন্টারেস্টিং একটা অবজারভেশন আছে। অবজারভেশনটা হচ্ছে- টেলিফোনে তোমার গলা একেকদিন একেক রকম শোনায়।
ও।
কথাটা কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে?
বিশ্বাস হবে না কেন? আপনি নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা বলবেন না।
শুধু তোমার ব্যাপার না, আমি অনেকের ব্যাপারেই লক্ষ করেছি- একই টেলিফোন সেটে কথা বলছে তারপরেও গলার স্বর সকালে এক রকম, আবার দুপুরে এক রকম।
ও।
আমার ধারণা টেলিফোন লাইনে যে ভোল্টেজ থাকে তার ওঠানামাতে এটা হয়।
আপনি কি এই কথাগুলি বলার জন্যেই টেলিফোন করেছেন?
উঁহু। মার খবর জানার জন্যে টেলিফোন করেছি। এখন জ্বর কেমন?
কম।
মা কি আমার ওপর রেগে আছে?
রেগে থাকার মত কিছু কি করেছেন?
জ্বর শুনেও মাকে দেখতে যাই নি।
দেখতে যান নি কেন?
বিনু, আসলে কী হয়েছে শোন। আমি মাকে দেখার জন্যে ঘর থেকে বের হলাম। বারান্দায় এসে ভুলে গেলাম কী জন্যে ঘর থেকে বের হয়েছি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়িতে উঠে পড়লাম। তখন মনে পড়ল। কিন্তু তখন আর গাড়ি থেকে নামতে ইচ্ছা করল না। এই হল ঘটনা।
এখন আপনি কোথায়?
রাস্তায়। ড্রাইভারকে বলে দিয়েছি আমাকে নিয়ে শহরে ঘুরপাক খেতে। বৃষ্টি হচ্ছে তো। গাড়িতে বসে বৃষ্টি দেখতে ভাল লাগছে। আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি মোবাইল টেলিফোনে।
ও।
মোবাইল টেলিফোনটা আমার না। অসমানীর। ওর টেলিফোন যে পকেটে করে নিয়ে চলে এসেছি বুঝতেই পারি নি। সে বেচারি হয়ত কোথাও টেলিফোন না পেয়ে খুব টেনশন করছে। কারুক টেনশন।
বিনু শুভ্রর আনন্দময় হাসি শুনল।
হ্যালো বিনু!
জ্বি বলুন।
হঠাৎ মনে হল টেলিফোনের কানেকশন কেটে গেছে। মোবাইল সেটগুলির এই সমস্যা- জরুরি কথার মাঝখানে লাইন কেটে যাবে।
আপনিতো কোনো জরুরি কথা বলছেন না।
এই জন্যেইতো লাইন কাটছে না। আমি এখন কী করছি বলতো?
একটু আগেই আমাকে বলেছেন কী করছেন— গাড়ি নিয়ে ঘুরছেন। বৃষ্টি দেখছেন।
ফিফটি পারসেন্ট হয়েছে। আমি আসলে ডায়েরি লিখছি। আমি মাঝে মাঝে অদৃশ্য খাতায় অদৃশ্য কলমে ডায়েরি লিখি। বুঝতে পারছ?
জ্বি না।
আরেক দিন বুঝিয়ে দেব। আচ্ছান্ন শোন বিনু, আমাকে কি খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ হচ্ছে।
আমি খুবই আনন্দিত।
কেন?
কারণটা আমি জানি। কিন্তু তোমাকে বলব না। হ্যালো বিনু।
জ্বি শুনছি।
তোমার সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলে ভাল হত। কিন্তু আমি কথা বলতে পারছি না। মোবাইলের ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে। টিক টিক করে শব্দ হচ্ছে। শব্দটা শুনতে পােচ্ছ না?
পাচ্ছি।
হ্যালো বিনু!
জ্বি বলুন।
আমি খুব বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আজকের টেলিফোনটা করেছি। সেই সিদ্ধান্তটা তোমাকে জানানোর জন্যে।
বলুন আমি শুনছি।
বিনু কিছু শুনতে পেল না। শুভ্রর মোবাইল সেটের ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে।