জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা
জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা বা বিএনআরের প্রথম পরিচালক ছিলেন জনৈক পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার এফ আর খান। খুব বেশি দিন তিনি ছিলেন না। কোনো একটা অভিযোগে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এক যুগ সময়কালে বিএনআরের পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন কবীর চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ও হাসান জামান। ওবায়দুল্লাহ কবি ও সিএসপি অফিসার। কবীর চৌধুরী ও হাসান জামান শিক্ষাবিদ ও লেখক। তখন কবীর চৌধুরী ছিলেন সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ। বরিশাল বিএম কলেজ থেকে গভর্নর মোনায়েম খান তাঁকে তাঁর নিজ জেলা ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে অধ্যক্ষ করে নিয়ে আসেন। মৌলিক লেখার চেয়ে অনুবাদেই তার আগ্রহ ছিল বেশি। ১৯৬৯-এর মার্চ থেকে ‘৭২-এর জুন পর্যন্ত তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন (তখনো মহাপরিচালকের পদ সৃষ্টি হয়নি)।
হাসান জামান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের রিডার। তিনি ছিলেন ইসলামপন্থী ও পাকিস্তানবাদী। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। বেশ কয়েকটি বইয়ের তিনি ছিলেন। রচয়িতা, যেমন ইসলাম ও কমিউনিজম, সমাজ সংস্কৃতি সাহিত্য, Basis of the Ideology of Pakistan প্রভৃতি। তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক হলেও তিনি ছিলেন একজন মেধাবী শিক্ষাবিদ। চল্লিশের দশকে। তিনি ছিলেন মুসলিম জাতীয়তাবাদী পাকিস্তান আন্দোলনের একজন নিবেদিত কর্মী।
পঞ্চাশের দশকে মুসলমান লেখকদের মধ্যে যারা ‘পাকিস্তানি তমদ্দুন’, ‘পাক বাংলা সাহিত্য’ প্রভৃতি তত্ত্বের প্রবক্তা ছিলেন, হাসান জামান তাঁদের একজন। তাঁদের বক্তব্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা সাহিত্য মূলধারার বাংলা সাহিত্যের মতো হবে না, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যের মতোও হবে না, তা হবে পাকিস্তানের নীতি আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ‘পাক-বাংলা সাহিত্য’। অন্য কথায় ‘মুসলমান বাংলা সাহিত্য’। সে সাহিত্যের বিষয়বস্তু শুধু নয়, তার ভাষা, উপমা-উৎপ্রেক্ষা-অলংকার সবই হবে মূলধারার বাংলা সাহিত্য থেকে অন্য রকম। আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের অব্যবহিত আগে এক আলোচনা সভায় খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন এক প্রবন্ধে বলেন, ‘আমাদের সাহিত্যে উপমা-প্রয়োগের যে ধারা চলছে তার পরিবর্তন দরকার, কারণ সেগুলো রাঢ়-বাংলার সংস্কৃতির অনুসারী ও পাকিস্তানি তমদ্দুনের পরিপন্থী।
[‘পাক-বাংলা সাহিত্য উপমা’]
১৯৫৮ সালে, সামরিক শাসন জারির আগে, আমেরিকার রকফেলার ফাউন্ডেশনের অর্থানুকূল্যে ঢাকায় এক বড় আকারের সাহিত্যবিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগকে। ওই সেমিনারে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, খান সারওয়ার মুর্শেদ, নূরুল হোসেন, হাসান জামান, কবীর চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, কবি আবুল হোসেন, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আসকার ইবনে শাইখ প্রমুখ। সেকালে ইসলামপন্থী ও সেকুলারপন্থীদের মধ্যে বিশেষ বিভাজন ছিল না, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধেরও অভাব ছিল না।
ভাষা আন্দোলনের আট মাস পরে ‘৫২-র অক্টোবরে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে এক ‘ইসলামী সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল পাকিস্তানে সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীভূত করার অভিপ্রায় এবং সুষ্ঠু ইসলামভিত্তিক চিন্তা-প্রবাহ সৃষ্টি করা। সম্মেলনের সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ এবং আবদুল গফুর। সম্মেলনের লক্ষ্য সম্পর্কে ঘোষণা করা হয় :
‘আমরা যদি পাকিস্তানকে “ইসলামী রাষ্ট্র” হিসাবে গড়ে তুলতে চাই তবে প্রথমে “ইসলামী রাষ্ট্রের স্বরূপ” সম্বন্ধে আমরা পরিষ্কার ধারণা করে নেব। আমরা আধুনিক দুনিয়ার বিভিন্ন মতবাদ ও সমস্যাবলীর তুলনায় ইসলামকে যাচাই করে নিতে চাই। ইসলামই যে শ্রেষ্ঠতম মানবকল্যাণকর আদর্শ তা আমরা কোনো গোঁজামিল না দিয়ে বুঝে নিতে ও অন্যদের বুঝিয়ে দিতে চাই।’
[সাঈদ-উর রহমান, পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পৃ. ২৯-৩০]
ওই সম্মেলনের সাহিত্য-সভার আলোচনায় যারা প্রবন্ধ পাঠ করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন, কবি শাহাদাৎ হোসেন, মুহাম্মদ বরকতুল্লাহ, সৈয়দ আলী আহসান, হাসান জামান প্রমুখ। হাসান জামানের প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘ইসলামী তমদ্দুন’। তিনি প্রবন্ধে ‘ইসলামের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সংস্কৃতি পুনর্নির্মাণের আহ্বান জানিয়ে বলতে চান ইসলামের মূল ভাব ও মূল্যবোধ মানবিক ও সর্বজনীন। তাই সমাজ জীবনে তার প্রয়োগ ‘মঙ্গলজনক। সম্মেলনে কেউ কেউ সরকারের মৃদু সমালোচনাও করেন এবং বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের জন্য তারা সরকারকে সমালোচনা করেননি, তারা সরকারকে সমালোচনা করেছিলেন ইসলামী আদর্শ যথেষ্ট পরিমাণে বাস্তবায়ন না করায়। তখন খাজা নাজিমুদ্দীন ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক দুই সরকারপ্রধানই পূর্ব বাংলার নেতা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই লক্ষ করা যায়, রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে তথা শাসকদের চেয়ে পূর্ব বাংলার একশ্রেণির কবি শিল্পী-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ ছিলেন বেশি ইসলামপন্থী। তারা ভুলে গিয়েছিলেন পূর্ব বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং বাংলা সংস্কৃতি হিন্দু মুসলমানের সমন্বিত সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতিতে হিন্দু-মুসলমান-আদিবাসী সব ধর্মের উপাদানই আছে।
পূর্ব বাংলার সাহিত্যের মেজাজ ও চারিত্র পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্য থেকে ভিন্ন হবে তা স্বাভাবিক– সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে শুধু নয়, ‘৪৭-এর পর ভিন্ন রাষ্ট্রীয় সত্ত্বার কারণেও। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার কারণে দুই বাংলার সাহিত্যের ভিন্নতা জোর করে সৃষ্টির চেষ্টা সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর। দুই বাংলার মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্য বিভাজন চিরকালই ছিল, একই বাংলা ভাষায় সবাই কথা বললেও। পূর্ব বাংলার সাহিত্যকে নিষ্প্রয়োজনে ইসলামীকরণের চেষ্টা তখনকার তরুণ লেখকেরা সমর্থন করেননি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখ কবি ও কথাশিল্পী মূলধারার বাংলা সাহিত্যের লেখক, তাঁরা ‘পাক-বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির চেষ্টা করেননি। অবশ্যই তাদের ভাষা ও শৈলী পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের থেকে সামান্য পরিমাণে হলেও আলাদা।
বিএনআরের শেষ ও নিন্দনীয় পরিচালক ছিলেন হাসান জামান। তিনি ছিলেন সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের পৃষ্ঠপোষক। তিনি ছিলেন হিন্দুবিরূপ, রবীন্দ্রসংগীত বিরোধিতার প্রশ্নে তিনি ও তাঁর অনুসারীরা সরকারকে সমর্থন দেন যখন জসীমউদ্দীন, মুহম্মদ কুদরাত-ই-খুদাসহ পূর্ব বাংলার প্রধান কবি-সাহিত্যিকেরা সরকারি নীতির তীব্র বিরোধিতা করেন।
বিএনআর একেবারেই রাজনীতিনিরপেক্ষ শিল্প-সাহিত্য-দর্শনসংক্রান্ত বহু বই পুস্তিকা যেমন বের করেছে, তেমনি তার মূল কাজ ছিল আইয়ুব প্রবর্তিত ‘মৌলিক গণতন্ত্র বিষয়ে প্রচারমূলক বই-পুস্তিকা প্রকাশ করা। বিশেষ করে, এমন কিছু বই বের করেছে, যা সাম্প্রদায়িকতা দোষে দূষিত। পাকিস্তানের নতুন প্রজন্মের তরুণেরা অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করতেন। তাঁরা ৪৭-পূর্ব সময়ের হিন্দু জমিদার মহাজনদের নিপীড়ন শোষণের বিষয়টিকে অতীতের একটি অধ্যায় হিসেবেই বিবেচনা করেছেন– বর্তমানের হিন্দুরা তার জন্য দায়ী নন। কিন্তু পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার সেই অতীতকে অব্যাহত স্মরণ করিয়ে দিতে চেষ্টা চালিয়ে যেত। অত্যাচারী ও শোষক হিসেবে মুসলমান জমিদারেরা কিছুমাত্র কম ছিলেন না তা সবাই জানেন।
পাকিস্তান আমলের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান, তাঁরা এদিকেও ছিলেন ওদিকেও ছিলেন। তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, আবার প্রয়োজনে সরকারের মৃদু সমালোচনাও করেছেন। বিএনআরের দরজা সবার জন্যই ভোলা ছিল। মফস্বলের বহু অখ্যাত কবি-লেখকের গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধের বই প্রকাশ করেছে। হাসান জামান লেখকদের প্রাপ্য টাকা পাণ্ডুলিপি গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরিশোধ করতেন। তাতে বহু অসচ্ছল লেখক আর্থিকভাবে উপকৃত হয়েছেন। বই প্রকাশিত হওয়ায় লেখক হিসেবে তারা পেয়েছেন পরিচিতি, একজন অবহেলিত লেখকের জন্য তা বড় প্রাপ্তি।
খ্যাত-অখ্যাত এমন লেখক খুব কমই ছিলেন ষাটের দশকে, কবীর চৌধুরী ও হাসান জামানের সময় বিএনআর থেকে যাদের বই প্রকাশিত হয়নি। ১৯৬৮-৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় বিএনআর নিয়ে যখন সমালোচনা হচ্ছিল, তখন হাসান জামান আত্মরক্ষার জন্য চাতুর্যের আশ্রয় নেন। পত্রিকায় ফলাও করে বিরাট এক বিজ্ঞাপন দেন এই মর্মে যে ‘বিএনআর কাদের বই প্রকাশ করে গর্বিত। দেখা গেল, প্রগতিশীল শিবিরের অনেক লেখক আছেন তাঁদের মধ্যে। (অবশ্য ওই তালিকায় আহমদ শরীফ এবং সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নামও ছিল, কিন্তু তাদের কোনো বই বিএনআর থেকে প্রকাশিত হয়নি, অথবা তারা কোনো পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে রয়্যালটির টাকাও নেননি।)
উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের উদ্গাতা মওলানা ভাসানী যখন আইয়ুবের ‘দুর্গ জ্বালিয়ে দেওয়ার’ ডাক দিয়ে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন শুরু করেন, তখন একদিন উন্মত্ত জনতা নবাব আবদুল গনি রোডে বিএনআর কার্যালয় জ্বালিয়ে দেয়। (রেলভবনের পাশে)। টেবিল-চেয়ার-আলমারি পুড়ে ছাই হয়। অনেক ভালো ভালো রচনার পাণ্ডুলিপিও ভস্মীভূত হয়। গুদামে যেসব বই ছিল, সেগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং আধা-পোড়া বই কয়েক দিন রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। অনেক বই ছাপা হয়েছিল নিউজপ্রিন্টে। ১০-১২টি বই আমি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিলাম। ওই সময় একদিন উত্তরবঙ্গ থেকে আসা একজন লেখককে হাইকোর্টের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখি। কারণ জিজ্ঞেস করে জানি, তিনি ইতিহাসমূলক একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছিলেন, একটা চেকও পেয়েছেন, বইটি ছাপা হচ্ছিল, কিন্তু সব শেষ।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করা হাসান জামানের পিএইচডি থিসিস ‘Rise of the Muslim Middle Class in India and Pakistan’ একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
হাসান জামান ও তাঁর গোত্রের সবাই তাদের বিশ্বাসে অনড় ছিলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের সাবলীলভাবে বিরোধিতা করেছেন। বাংলাদেশের মানুষের আবেগ ও স্বপ্ন উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। নিয়তির পরিহাস এই যে তার বড় ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুজ্জামান এবং তাঁর ছেলে ও ভাগনে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন। ১৯৭৮-তে হাসান জামান সৌদি আরবে মারা যান।