জলের অপর নাম যে কেন ‘জীবন’ এ কথা বোধ করি এমন করে উপলব্ধি করতে পারতো না পারুল যদি সে তার এই চন্দননগরের বাড়িটিতে একা এসে বাস না করতো, আর যদি না ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু চুপচাপ গঙ্গার জলের দিকে তাকিয়ে থেকে কাটাত।
এক গঙ্গার কতো রূপ, কতো রং, কতো রঙ্গ, কত বৈচিত্র্য! শুধু ঋতুতে ঋতুতেই নয়, দিনে রাত্রে, সকাল সন্ধ্যায়, প্রখর রৌদ্রের দুপুরে, ছায়া-ছায়া বিকেলে, শুক্লপক্ষে কৃষ্ণপক্ষে বদল হচ্ছে তার রঙের রূপের ভঙ্গিমার। এই অফুরন্ত বৈচিত্র্যের মধ্যে যেন অফুরন্ত জীবনের স্বাদ।
সেকালের তৈরি বাড়ি, ছোট হলেও ছোট নয়, একালের ফ্ল্যাটবাড়ির ছোটত্বের সঙ্গে তার ছোঁটত্বের তুলনাই হয় না। ফেলে ছড়িয়ে অনেকগুলো ঘর-বারান্দা, অকারণ অর্থহীন খানিকটা দালান, এই বাড়িতে শুধু একা পারুল তার নিতান্ত সংক্ষিপ্ত জীবনযাত্রার মধ্যে নিমজ্জিত, গলার সাড়া নেই কোথাও, নেই প্রাণের সাড়া।
তবু যেন পারুলকে ঘিরে এক অফুরন্ত প্রাণপ্রবাহ। নিঃসঙ্গ পারুল শুধু ওই জলের দিকে তাকিয়েই যেন অফুরন্ত সঙ্গের স্বাদ পায়, যেন অনন্ত প্রাণের স্পর্শ পায়।
পরিবর্তন মানেই তো জীবন, যা অনড় অচল অপরিবর্তিত, সেখানে জীবনের স্পন্দন কোথায়? অচলায়তনের মধ্যেই মৃত্যুর বাসা। জীবনই প্রতি মুহূর্তে রং বদলায়। তাই নদীপ্রবাহ জীবন-প্রবাহের প্রতীক। তবু নদীর ওই নিয়ত রূপবৈচিত্র্যের গভীরে যে একটি স্থির সত্তা আছে, পারুলের প্রকৃতির মধ্যে বুঝি আছে তার একাত্মতা। পাগল হয়ে সেই সত্তার গভীরে নিমগ্ন থেকে ওই রূপ-বৈচিত্র্যের মধ্য হতে আহরণ করে বাঁচার খোরাক, বাঁচার প্রেরণা।
অথচ পারুলের মত অবস্থায় অপর কোনো মেয়ে অনায়াসেই ভাবতে পারতো, আর কী সুখে বাঁচবো? ভাবতে, আর বেঁচে লাভ কী?
পারুল তা ভাবে না। নিঃসঙ্গ পারুল যেন তার জীবনের পাত্রখানি হাতে নিয়ে চেখে চেখে উপভোগ করে।
প্রতিটি দিনই যেন পারুলের কাছে একটি গভীর উপলব্ধির উপচার হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ায়।
পারুল যে কেবলমাত্র সেই দীর্ঘদিন পূর্বে মৃত অমলবাবু নামের ভদ্রলোকটির স্ত্রী নয়, পারুল যে মোহনলাল এবং শোভনলাল নামক দু-দু’জন ক্লাস ওয়ান অফিসারের মা নয়, পারুল যে বহু আত্মীয়জনের মধ্যেকার একজন নয়, পারুল একটি সত্তার নাম, সেই কথাটাই অনুভব করে পারুল। আর তেমনি এক অনুভবের মুহূর্তে মাকে মনে পড়ে পারুলের।
আগে পারুল মাকে বুঝতে পারতো না। পারুল তার মার সদা উত্তেজিত স্বভাবপ্রকৃতির প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে, পারুল তার মার ওই ডজনখানেক ছেলেমেয়ে বরদাস্ত করতে পারতো না। কিন্তু এখন পারুল যেন দর্শকের ভূমিকায় বসে মাকে দেখতে পায়।
পারুলের একটা নিঃশাস পড়ে। পারুল ভাবে মা যদি খুব অল্পবয়সে বিধবা হয়ে যেতো, তাহলে হয়তো মা বেঁচে যেতো।
হয়তো বকুলই পারুলকে এই দৃষ্টিটা দিয়েছে। বকুলই তার মার অপরিসীম নিরুপায়তার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছে কাল্পনিক চরিত্রের মধ্যে দিয়ে। সেই অবরোধের অসহায় যুগে প্রায় সব বাঙালী মেয়ের জীবনেই তো বকুল-পারুলের মায়ের জীবনের ছায়ার প্রতিফলন।
শুধু কেউ ছিল অন্ধ অবোধ, কেউ দৃষ্টিশক্তি আর বোধের যন্ত্রণায় জর্জরিত। পারুল তার মার সেই বোধ-জর্জরিত জীবনের জ্বালা দেখেছে।
তখন পারুল মার ওই জ্বালাটা নিয়ে মাতামাতি দেখে বিরক্ত হতো, এখন দূরলোক থেকে মমতার দৃষ্টিতে তাকায়।
পারুল এক এক সময় যেন মাকে এই গঙ্গার উপরকার বারান্দায় এনে বসায়, তারপর গভীর একটা নিঃশ্বাস উৎসর্গ করে মুক্তির কাঙাল সেই মানুষটার উদ্দেশে। পারুলের বিধাতা পারুলের প্রতি কিঞ্চিৎ প্রসন্ন বৈকি, তাই পারুলকে দীর্ঘদিন ধরে একটা স্থূল পুরুষচিন্তের ক্লেদাক্ত আসক্তির শিকার হয়ে পড়ে থাকতে হয়নি, যে আসক্তি একটা চটচটে লালার মতো আবিল করে রাখে, যে আসক্তি কোথাও কোনোদিকে মুক্তির জানালা খুলতে দেয় না।
কিন্তু এখন নাকি পালাবদল হয়েছে।
তা হয়েছে বটে! এখন শিকার শিকারী জায়গা বদল করেছে।
পারুলের হঠাৎ-হঠাৎ তার ছেলে দুটোর কথা মনে পড়ে যায়।
কিন্তু ও কি মুক্তির জানালা খুঁজে বেড়ায়? পারুলের ছেলেরা? না পরম পরিতোষে সেই এটা আঠা-চটচটে আসক্তির লালা গায়ে মেখে পড়ে থেকে নিজেদেরকে খুব সুখী সুখী মনে করে? হয়তো তাই।
হয়তো অধিকার-বোধে তীব্র তীক্ষ্ণ সচেতন, অথচ অভিমানার সেই এক প্রভুচিত্তের কাছে সমর্পিত-প্রাণ হয়ে থাকই ওদের আনন্দ। প্রভুর ইচ্ছায় নিজের ইচ্ছা বিলীন করার মধ্যেই ওদের জীবনের চরম সার্থকতা।
আপন সন্তানকেই কি সম্পূর্ণ পড়া যায়? হয়তো অনেকটা যায়, তবু সবটা নয়। অনেকটা যায় বলেই শোভনের জন্যে একটি গভীর বেদনাবোধ আছে। যেন বুঝতে পারে পারুল, শোভনের শাস্তিপ্রিয়তাই শোভনকে অনেকটা অসহায় করে রেখেছে।
এক এক সময় ভারী অদ্ভুত লাগে পারুলের। মনে হয় পারুল যেন অনেক দড়িদড়ার গেড়ো কেটে কি একটা ভয়ঙ্করের কবল থেকে হাত-কয়েক পালিয়ে এসে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচছে।
সেই ভয়ঙ্করটা কী? সমাজ? লোকসমাজ? বোধ হয় তাই।
লোকসমাজের মুখ চেয়ে পারুলকে আর এখন ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে হয় না। হঠাৎ কখন এক সময় পারুল ওই ‘লোকনিন্দে’ জিনিসটার মধ্যেকার পরম হাস্যকর দিকটা উপানি করে ফেলে ‘তেলি হাত ফসকে গেলি’ হয়ে গেছে।
এখন আর পারুলের শ্বশুরকুলের কেউ পারুল সম্পর্কে কোনো প্রত্যাশা রাখে না। বিধবা পারুল, ঝাড়া-হাত-পা পারুল, আত্মীয়স্বজনের সুখে-দুঃখে গিয়ে পড়ে বুক দিয়ে করবে এমন আশা কারুর নেই। পারুল যদি কারুর অসুখ শুনে দেখতে যায়, তাহলে সে বিগলিত হয়, পারুল যদি কারুর বিয়ের নেমন্তন্ন পেয়ে গিয়ে দাঁড়ায়, সে ধন্যবোধ করে।
না গেলেও কেউ কিছু মনে করে না, কারণ এখন সবাই ধরে নিয়েছে উনি এই রকমই। এখন আর পারুলের বেয়ানেরা পারুলের ছেলে-বৌয়ের প্রতি কর্তব্যহীনতা নিয়ে সমালোচনায় মুখর হন না, তারাও ধরে নিয়েছেন উনি তো ওই রকমই।
কিন্তু সবাই কি পারে এই মুক্তি আহরণ করতে?
পারে না। কারণ বন্ধন তত বাইরে নয়, বন্ধন নিজের মধ্যে। সেই বন্ধনটি হচ্ছে ‘আমি’। সেই আমি’টি যেন লোকচক্ষুতে সব সময়ে ঝকঝকে চকচকে নিখুত নির্ভুল থাকে, যেন তাকে কেউ ত্রুটির অপরাধে চিহ্নিত করতে না পারে, এই তো চেষ্টা মানুষের। আমি’টিকে সত্যকার পরিশুদ্ধ করে নির্ভুল নিখুত হবার চেষ্টা ক’জনেরই বা থাকে? ‘আমি’টিকে পরিপাটি দেখানো’র সংখ্যাই অধিক। ওই দেখানোর মোহটুকু ত্যাগ করতে পারলেও বা হয়তো সেই ত্যাগের পথ ধরে পরিশুদ্ধি এলেও আসতে পারে। কিন্তু ‘আমি’র বন্ধন বড় বন্ধন।
পারুলের হয়তো ও বন্ধনটা চিরদিনই কম ছিল, এখন আরো গেছে। কিন্তু এই বন্ধনহীন পারুলের সামনে হঠাৎ একটি বন্ধন-রজ্জু এসে আছড়ে পড়লো।
তা এক রকম আছড়ে পড়াই। কারণ ব্যাপারটা ঘটলো বিনা নোটিশে।
পারুল আজ সামান্য রান্নার আয়োজন করে নিয়ে সবে স্টোভটা জ্বেলেছে, হঠাৎ বাইরে দরজায় একটা সাইকেল-রিকশার শব্দ হলো, সঙ্গে সঙ্গে রিকশাওয়ালারই ডাক শোনা গেল, মাইজী, মাইজী!
তার মানে আরোহী ওকেই ডাক দেবার কাজটা চাপিয়েছে।
কে এলো এমন সময়? কে এলো পারুলের কাছে?
আর কেই বা, ছেলেরা ছাড়া? যারা কর্মস্থল থেকে কলকাতায় আসা-যাওয়ার পথে এক আধবেলার জন্যে এসে দেখা দিয়ে যায়, অথবা মাকে দেখে যায়।
কিন্তু তারা তো নিজেই আগে উঠে আসে। পিছু পিছু হয়তো রিকশাওয়ালাটা মাল মোট নিয়ে–
তবে কি কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে
তাড়াতাড়ি নিচের তলায় নেমে গেল পারুল।
আর নেমে গিয়েই থেমে দাঁড়িয়ে পড়লো।
সিঁড়ির জানলা থেকে রিকশায় বসা যে রোগা-রোগা মেয়েটাকে হঠাৎ শোভনের বৌ বলে ভুল হয়েছিলো, সে একটা অপরিচিত মেয়ে। তার পাশে একটি অপরিচিত পুরুষ-মূর্তি।
কিন্তু মেয়েটা কি একেবারেই অপরিচিত? কোথায় যেন দেখেছেন না?
আরে কী আশ্চর্য, মেয়েটা পারুলের পিতৃকুলের না? পারুলের ভাইঝি তো! তবু পারুল প্রশ্ন না করে পারলো না, কে?
আমি।
মেয়েটা নেমে এলো, যেন কষ্টে নিচু হয়ে একটা প্রণামের মতো করে বলে উঠলো, আমি হচ্ছি শম্পা। আপনার ভাইয়ের মেয়ে। পিসিকে, মানে ছোট পিসিকে অবশ্য আমি ‘তুমি’ করেই কথা বলি, কিন্তু আপনার সঙ্গে তো মোটেই চেনাজানা নেই, তাই আপনিই বলছি! যদি এখানে কিছুদিন থেকে যাওয়া সম্ভব হয় তো পরে দেখা যাবে। এখন কথা হচ্ছে থেকে যাওয়ার। …অদ্ভুত একটা পরিস্থিতিতে পড়ে চট করে আপনার এখানে চলে এলাম। কেন এলাম তা জানি না। আপনাকে তো চিনিও না সাতজন্মে, নেহাৎ পিসির লেখা খামে ঠিকানাটা ক্রমাগত দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল তাই।…এখন শুনুন ব্যাপার
আমাকে তুই তুমি’ই বল। পারুল হাসলো, আমি চটে যাবে না।
যাবে না তো? বাঁচলাম বাবা! এতক্ষণে কথা বলাটা সহজ হলো। শোনো, আমি না–যাকে বলে একটা অসুবিধেয় পড়ে, মানে বিরাট একটা অসুবিধেয় পড়ে, না ভেবে-চিন্তে তোমার এখানেই চলে এলাম, বুঝলে? না, একেবারেই যে ভাবিনি তা নয়, ভাবনা-চিন্তা করতে গিয়ে তোমার নামটাই মনে এসে গেল। এসেছি অবশ্য উপকারের আশাতেই, তবে উপকার করা না-করাটা তোমার ইচ্ছে। ওই যে ছেলেটাকে দেখছ না রিকশায়, ওর নাম সত্যবান দাস। মানে আর কি বুঝতেই পারছো–ব্রাহ্মণসন্তান-টন্তান নয়। আর মনে হচ্ছে, তোমরা যাক ভদ্দরলোক বলো ঠিক তাও নয়। মানে স্রেফ কুলি মজুর। তা সে যাই হোক, ওকেই বিয়ে করবো ঠিক করেছি, আর তাই ওর সঙ্গেই ঘুরছি-টুরছি, হঠাৎ আমার শ্রীযুক্ত বাবা, মানে আর কি তোমার ছোড়দা, কি করে এই ঘটনাটি টের পেয়ে একেবারে তেলেবেগুনে!..ও সে কী রাগ! এই হতভাগাটার সঙ্গে মিশলে এ বাড়িতে থাকা চলবে না– ইত্যাদি প্রভৃতি ..তা আমিও তো সেই বাবারই মেয়ে, আমিই বা কম যাবো কেন? বললাম–বেশ ঠিক আছে। ওকে যখন ছাড়তে পারবো না, তখন বাড়ি ছাড়লাম।…ব্যাস, চলে। এলাম, এদিকে ওই মহাপ্রভুর মেসের বাসায় এসে দেখি, বাবু দিব্যি একখানি একশো চার জ্বর করে কম্বল গায়ে দিয়ে পড়ে আছেন। বোঝ আমার অবস্থা! মেসের ঘর, আরো দু’দুখানা রুমমেট রয়েছে সেখানে ওই রুগীটাকে নিয়ে করি কি! বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম ওর ভরসায়, আর ও কিনা এই দুর্ব্যবহারটি করে বসলো! তাহলে উপায় কি? তা এই উপায়টিই মাথায় এসে গেল!..মানে আর কি, বিপদে পড়লেই পিসির কাছে যাওয়াটাই অভ্যাস তো? অথচ পিসি এখন তার মান্যগণ্য দাদার বাড়িতে। তখন মনে পড়ে গেল, আরও পিসি তো রয়েছে, তার কাছেই গিয়ে পড়া যাক!…অবিশ্যি সকলেই কিন্তু একই রকম হয় না। তুমিও যে ছোট পিসির মতই হবে তার কোনো মানে নেই। না-জানা না-চেনা এক লক্ষ্মীছাড়া ভাইঝি রাস্তা থেকে এক-গা জ্বরসুদ্ধ আর এক লক্ষ্মীছাড়াকে জুটিয় এনে তোমার বাড়িতে থাকবো গো বলে আবদার করলেই যে তুমি আহ্লাদে গলে থাকো থাকো করবে এমন কথা নেই, কিন্তু কী করব? একদম উপায় ছিল না। যা হোক একটা বিছানার ব্যবস্থা করতে দিলেই চলবে এই নিচতলারই একটা ঘরে। একে একটু শুতে দেওয়া দরকার। দেখছো তো কী রকম ঘাড় গুঁজে বসে আছে, গড়িয়ে পড়ে গেলেই দফা শেষ! কিছুতে আসতে চাইছিল, আমি প্রায় জোর করে–
ওর কথার স্রোতে ভেসে যাওয়া পারুল এতোক্ষণে সেই স্রোতের মাঝখানে নিজেকে একটু ঢুকিয়ে দেয়, আচ্ছা তোর ওসব কাহিনী পরে শুনবো, এখন নিয়ে চল ওকে। রিকশাওয়ালা তুমি বাপু দাদাবাবুকে একটু ধরো—
এতক্ষণে গাড়ির আরোহীও একটু চেষ্টা করে সোজা হয়ে বসে জড়িত গলায় বলে, না না, ধরাতে হবে না—
না হবে না! ভারী সর্দার! প্রবলা গার্জেন ওর একটা হাত চেপে ধরে নামতে সাহায্য করে বলে, তারপর রাস্তার মাঝখামে আলুর দম হও আর কি! চলো আস্তে আস্তে, রিকশাওলা সাবধান
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিচতলার বৈঠকখানা নামধারী চির-অব্যবহৃত ঘরটায় পড়ে থাকা চৌকিটার ওপর একটা বিছানা পেতে দিয়ে পারুলও ধরতে একটু সাহায্য করে, বলে, এখন নিচতলাতেই দিলাম বিছানাটা, জ্বর না কমলে তো সিঁড়ি ওঠা সম্ভব হবে না। স্বস্তি হয়ে শুলে ডাক্তারের ব্যবস্থা দেখবো?
ছেলেটা যেন শুয়ে বাঁচে।
পারুল একটা খবরের কাগজ নিয়ে বাতাস করতে করতে বলে, রিকশাওলা তুমি এক্ষুনি চলে যেও না, আমি একটু তোমার গাড়িটায় যাবো। বাজারের কাছে কোথায় যেন একটা ডাক্তারখানা আছে না? ডাক্তার বসেন তো?
যাক বাঁচা গেল বাবা! ধপ্ করে চৌকিটার একধারে বসে শম্পা। তারপর কাগজখানা তুলে নিয়ে নিজেই বাতাস খেতে খেতে বলে, দেখা যাচ্ছে আমার ঠাকুমা ঠাকুরুণের ছেলেগুলি যে মাটিতে তৈরী, মেয়েগুলি তা দিয়ে নয়। অবিশ্যি বড় পিসি, মেজ পিসির খবর জানি না, তবে তোমরা দুজনে লোক ভালো। এই, তুমি যে তখন বলছিলে তেষ্টা পেয়েছে, খাবে জল?
শুধু জল থাক, ডাব আছে, দাঁড়া, এনে দিই। তারপর ডাক্তার যা বলেন-, বলে উঠে যায় পারুল।
পারুলের পক্ষে কাজটা অভাবনীয় বৈকি। হঠাৎ এই পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াতে না হলে পারুল কি ভাবতে পারতো সে বাজারের মোড় পর্যন্ত গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনছে।
ভাবতে পারতো না, অথচ এখন সেই কাজটাই করে ফেললো সহজে অনায়াসে। মানুষ যে পরিস্থিতির দাস মাত্র, এতে আর সন্দেহ কি?
ওকে ওষুধপথ্য খাওয়ানোর পর শম্পা হাঁপিয়ে বসে পড়ে বলে, এতক্ষণ বলতে লজ্জা করছিল, কে জানে তুমি হয়তো ভাববে মেয়েটা কী পিশাচী গো, এই দুঃসময়ে কিনা নিজের ক্ষিদে পাওয়ার কথা মনে পড়লো ওর! কিন্তু এখন তো আর থাকতে পারা যাচ্ছে না!
ইস! আহা রে! পারুল লজ্জার গলায় বলে, ছি ছি! আমি কী রে? এটা তো তোর বলবার কথা নয়, আমারই উচিত ছিল তোকে আগে একটু জল খেতে দেওয়া।
উচিত আবার কী? অকস্মাৎ যা একখানা গন্ধমাদন পর্বত এনে চাপিয়ে দিলাম তোমার মাথায়!