1 of 2

১৬. ছেলের প্যান্ট সেলাই

ছেলের প্যান্ট সেলাই করতে বসেছেন জাহানারা ইমাম। একটা মাত্র কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে যাবে রুমী, তাতে দু’চারখানা জামা কাপড়ের বেশী ধরবে না, অথচ সে কতদিনের জন্য যাচ্ছে কে জানে! একটা প্রায় নতুন প্যান্টের কোমরের কাছে ভেতরের দিকের মুড়ির সেলাই খুলে ফেলে সেখানে ভরে নিলেন দশখানা একশো টাকার নোট, তারপর আবার এমন নিখুঁতভাবে সেলাই করলেন যাতে আর বোঝার উপায় রইলো না। নিজের কাজ দেখে খুশী হবার বদলে ঝর ঝর করে জল পড়তে লাগলো তাঁর চোখ দিয়ে।

রুমী আজ চলে যাবে। কিছুতেই আর তাকে বাধা দেওয়া যাবে না। প্রায় এক মাস ধরে রুমী তার মাকে বোঝাচ্ছে, মায়ের অনুমতি না নিয়ে সে যেতে চায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম করা ডিবেটার রুমী, তার সঙ্গে তার মা যুক্তি-তর্কে পারবেন কী করে! জাহানারা ইমামের সচেতন বিবেক রুমীর যুক্তিগুলি অগ্রাহ্য করতে পারে না, কিন্তু মায়ের প্রাণ যে মানতে চায় না। রুমী চলে যাবে, যদি আর না ফেরে!

ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র রুমী, আমেরিকায় ইলিনয়ে আই আই টি-তে সে অ্যাডমিশন পেয়ে গেছে, সেপ্টেম্বরে সেখানে যাবার কথা, আর মাত্র পাঁচ মাস বাকি। কিন্তু ভাই-বন্ধু-আত্মীয়-স্বজন যখন চতুর্দিকে অসহায়ের মতন মরছে, তখন রুমী শুধু নিজের কেরিয়ার গোছাবার জন্য কিছুতেই আমেরিকায় যেতে চায় না।

সত্যি সত্যি যে কতখানি অত্যাচার হচ্ছে আর কতটা গুজব, তা অনেকদিন ভালো করে বুঝতে পারেননি জাহানারা। পচিশে মার্চের পর কয়েকদিন ঢাকায় কোনো খবরের কাগজই বেরোয়নি, এখন দু’একটি কাগজ বেরুচ্ছে, তাও দু’পাতা, চারপাতা মাত্র, তাতে শুধু সরকারি ঘোষণা ছাড়া আর কোনো খবরই থাকে না। টি ভি, রেডিও আবার চালু হয়েছে, তারা মিলিটারির বেয়নেটের ভয়েই হোক আর যেকারণেই হোক, এখন আবার গাইছে পাকিস্তান সরকারের গুণগান, তাদের কথা শুনলে মনে হয় দেশের অবস্থা স্বাভাবিক। কিন্তু রুমীরা বলে, দেশের একটু নামকরা লোকদের জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে রেডিও টিভিতে ওদের মনোমত কথা বলাচ্ছে। দেখো আম্মা, একদিন তোমার কাছেও আসবে, তোমাকে দিয়েও রেডিওতে মিথ্যে কথা বলাবে।

অথচ কলকাতার রেডিও শুনেও পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না। সবাই এখন দরজা-জানলা বন্ধ করে আকাশবাণী শোনে। আকাশবাণীর খবর শুনলে মনে হয়, ঘোরতর যুদ্ধ চলছে। বাংলাদেশে, কোনো কোনো শহর অঞ্চল জয় করে নিয়েছে মুক্তিবাহিনী, এসবের কতখানি সত্যি? বেগম সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহিমকে খুন করেছে পাকিস্তানী সেনা, আবার গভর্নর টিক্কা খাঁ মুক্তিবাহিনীর হাতে খতম, এসব খবরও শোনা গেছে আকাশবাণীতে, কিন্তু সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহিম মোটেই মারা যাননি। কাগজে তাঁদের ছবি বেরিয়েছে। আর টিক্কা খান তো বহাল তবিয়তে বেঁচে রয়েছে। তাহলে ওদের খবর বিশ্বাস করা যায় কী করে?

রুমী বলে, দু’চারটে খবর ভুল হতে পারে। কিন্তু ইউনিভার্সিটির ডঃ জি সি দেব, মনিরুজ্জমান, এফ আর খান, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, শরাফত আলী এদের যে গুলি করে মেরে ফেলেছে, তাতে কি কোনো ভুল আছে? ঢাকার কত বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, তা তো তুমি নিজের চোখেই দেখেছো!

তবু সন্দেহ যায় না। আর্মি-পুলিশ মিলে দারুণ অত্যাচার করছে তা ঠিকই। কিন্তু এরকম তো পাকিস্তানে আগেও হয়েছে। শেখ মুজিব যখন তখন গ্রেফতার হয়েছেন কতবার। হাজার হাজার পলিটিক্যাল ওয়াকারদের জেলে ভরা হয়েছে, গুলি চালানো হয়েছে ছাত্রদের মিছিলে। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মিলিটারির কর্তাদের আলোচনা ভেস্তে যাবার পর জারি হয়েছে সামরিক শাসন। তারপর সব কিছু আবার ঠাণ্ডা। এবারেও কি তাই হবে না? রুমীরা বলছে স্বাধীনতার কথা? কী নিয়ে ওরা লড়বে?

যে-কয়েক ঘণ্টা কারফিউ থাকে না, সেই সময়ে জাহানারা নিজেই সাহস করে গাড়ি নিয়ে ঢাকা শহর ঘুরে দেখে আসেন মাঝে মাঝে। লালবাগ থেকে চকবাজারে গেলে দেখা যায়, প্রায় পুরো বাজারটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসলামপুর, শাঁখারিপট্টি, ওয়াইজ ঘাট, পাটুয়াটুলি, সদরঘাট, নবাবপুর সর্বত্র প্রায় একই দৃশ্য। চতুর্দিকে শুধু ধ্বংসের তাণ্ডব। কামানের গোলা দেগে মহল্লার পর মহল্লা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শাঁখারিপট্টিতে পচা লাশের গন্ধ, দরজা। জানলা ভাঙা যে কয়েকটি দোকানঘর এখনও কোনোক্রমে টিকে আছে, সেগুলোর গায়ে ঝুলছে নতুন চটের পদা, তার উপর সাঁটা কাগজে কী যেন লেখা। কৌতূহল দমন করতে না পেরে জাহানারা গাড়ি থেকে নেমে সেই লেখা পড়তে গিয়েছিলেন। তাতে আছে নতুন মালিকানার ঘোষণা। শাঁখারিপট্টির দোকানগুলো অবাঙালী মুশ্লিমদের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হয়েছে।

ক্রমে নিজেদের চোনাশুনো আত্মীয়-স্বজনদের মৃত্যু সংবাদ কানে আসতে লাগল। ঢাকা থেকে যারা পালিয়ে গিয়েছিল বুড়িগঙ্গার ওপারে জিঞ্জিরায়, সেখানে অনেকেই গুলি খেয়ে মরেছে। গ্রামের পর গ্রাম ঘিরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে মিলিটারি, সাধারণ যাত্রীবাহী নৌকোর ওপর হয়েছে মেশিনগানের গুলিবৃষ্টি। জাহানারার এক খালাতো ভাই ভিখু চৌধুরী মারা গেছে। সেইসঙ্গে তার বউ মিলি, সে বাড়ির বুড়ো বাচ্চা কেউ বাদ যায়নি। করটিয়ায় গ্রামের বাড়িতে পুরো একটি পরিবার সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে, চোখ মুখ ধুয়ে নাস্তা খাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল, হঠাৎ এসে হানা দিল সাক্ষাৎ যমদূতেরা। ধানমণ্ডিতে ভিখু চৌধুরীর দাদার বাড়িতে গিয়ে সব শুনে জাহানারা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। আর্মির লোকেরাও তো মানুষ। পশু তো নয়, তারা এত নিষ্ঠুর হয় কী করে? বিনা প্ররোচনায় বিনা দোষে নিরীহ নারী-পুরুষ শিশুদের তারা হত্যা করে কোন বিবেকে! অথচ সত্যি সত্যি যে এরকম ঘটছে, তাতে তো আর কোনো সন্দেহ নেই। গুলি লেগেছে খালা আম্মার তলপেটে, তবু তিনি কোনোক্রমে বেঁচে ফিরে এসেছেন, তাঁরই মুখে জাহানারাকে শুনতে হলো তাঁর ছেলে ভিখু চৌধুরী আর পরিবারের অন্যদের নিধনের বর্ণনা। এতে চোখের জল পর্যন্ত শুকিয়ে যায়!

নারিন্দা থেকে আতা ভাই একদিন এসে শোনালেন আরও সাঙ্ঘাতিক খবর। আজীবন ধর্মানুরক্ত, সদাপ্রসন্ন মানুষ এই আতা ভাই, তাঁকে জাহানারা কখনো রাগতে দেখেননি, তিনি এলেই বাড়িতে আনন্দের সাড়া পড়ে যেত, তিনি অনেক মজার মজার গল্প শোনাতেন। সেই মানুষটি আজ দারুণ উত্তেজিত ও বিচলিত, মনে হয় তিনি রাতের পর রাত ঘুমোননি, তাঁর হাত কাঁপছে। তিনি বললেন, বুঝলে জাহানারা, ওদের আর বেশীদিন নাই। ইসলামের নামে ওরা যা করছে তাতে খোদার আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠছে! মসজিদে বসে কোরান তেলাওয়াত করছিলেন কারীসাহেব, তাকে পর্যন্ত গুলি করে মেরেছে। খোদার ঘরে ঢুকে মানুষ খুন! মায়ের সামনে ছোট ছেলেকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। ছেলের সামনে মাকে বেইজ্জত করেছে। খোদাতালা সইবেন এত অত্যাচার?

রুমী বললো, শোনো আম্মা শোনো! এবার বিশ্বাস হয় তোমার? বুড়িগঙ্গা দিয়ে হাত পা বাঁধা ছেলেদের লাশ ভেসে যায়, আমরা প্রত্যেকদিন দেখি। গ্রামের মেয়েদের তুলে তুলে নিয়ে যাচ্ছে আর্মি। আবার কিছু কিছু লোককে ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের শরীর থেকে সিরিঞ্জে করে বার করে নেওয়া হচ্ছে সব রক্ত। অবিকল নাৎসীদের কায়দায়। আমার চেনা একজন ডাক্তারকে চোখ বেঁধে নিয়ে গিয়ে এই কাজ করিয়েছে। তুমি তার নিজের মুখে শুনতে চাও? আরও শোনো, ঢাকা শহরের সব ইয়ংম্যানদের নামের লিস্টি বানানো হচ্ছে, তাদের সবাইকে একদিন তুলে নিয়ে যাবে। এলিফ্যান্ট রোডের মোডের মাথায় দু’জন বিহারী মুসলমান সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, আমরা কখন কোথায় যাই না যাই, তার খবর রাখে। এর পরেও তুমি আমাকে বাড়িতে ধরে রাখতে চাও?

নিউজ উইক পত্রিকার কয়েকটা কাটিং গোপনে জোগাড় করে এনেছে রুমী। তাতে আছে। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলায় মুক্তি যুদ্ধের খবর। সীমান্তের কোথায় যেন মুজিবনগর হয়েছে, সেখান থেকে লড়াই চালাচ্ছে অস্থায়ী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার! লড়াই একটা চলছে ঠিকই, আর অস্বীকার করা যায় না।

হাজার হাজার তরুণ নেমে পড়েছে স্বাধীনতার সংগ্রামে, আর রুমী তাতে যোগ দেবে না, তা কী হয়? স্বাস্থ্যবান, টগবগে ছেলে রুমী, সে বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও সাহিত্যে খুব আগ্রহী, কবিতা মুখস্ত বলে গড়গড় করে, খেলাধুলোতেও ওস্তাদ, আবার ইতিহাস রাজনীতি নিয়েও মাথা ঘামায়। জাহানারা তাঁর দুই ছেলেকে কখনো স্বার্থপর হতে শেখাননি, তারা মিথ্যে কথা বলে না, সরল সুন্দর আদর্শে উজ্জ্বল তাদের মুখ।

রুমী যদি কারুকে কিছু না জানিয়ে, গোপনে বাড়ি ছেড়ে মুক্তি যুদ্ধে যোগ দিতে চলে যেত, তাহলে হয়তো জাহানার কোনোক্রমে তা মেনে নিতেও পারতেন। কিন্তু এ ছেলে সে ভাবে কিছুতেই যাবে না। সে তার মায়ের অনুমতি চায়। পিছুটান রেখে সে কী করে লড়াই করতে যাবে। সেইজন্য সে প্রত্যেকদিন তর্ক করে মায়ের সঙ্গে। একদিন তর্ক থামিয়ে সে হঠাৎ শান্ত গলায় বললো, ঠিক আছে, আম্মা তুমি যদি জোর করো, তাহলে আমি দেশ ছেড়ে আমেরিকাতে চলে যাবো। তোমাকে খুশী করার জন্য আমি পড়াশুনো করে বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো। কিন্তু আমার বিবেকের কাছে চিরকালের মতন অপরাধী হয়ে থাকবো, আম্মা, তুমি কি সত্যি তাই-ই চাও?

জাহানারা চোখ বন্ধ করে বলে উঠেছিলেন, না চাই না! ঠিক আছে, তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানী করে। যা তুই যুদ্ধেই যা!

রুমী অনুমতি পেয়েছে শুনে ছোটভাই জামী লাফিয়ে উঠে বলেছিল সেও যাবে! সেও দাদার সঙ্গে যুদ্ধে যাবে। তাকে অতিকষ্টে নিরস্ত করা হয়েছে এই বলে যে দুটি ছেলেই চলে গেলে এ বাড়ির ওপর সন্দেহ পড়বে, আমি তাদের বাপ-দাদাকেও ছাড়বে না।

প্যান্ট সেলাই করার পর চোখের জল মুছতে মুছতে জাহানারা রুমীর ব্যাগ গোছাতে লাগলেন। রুমী আমের আচার ভালবাসে, এক কৌটো আচার দিলেন ব্যাগ ভরে। একটুখানি গাওয়া ঘি দিলেন না, রাগ করবে রুমী। লাল স্ট্রাইপ শার্টটা ওর খুব প্রিয়, কিন্তু সঙ্গে নেবে না বলেছে, তার বদলে তিন চার খানা গেঞ্জি, গরমকালটা শুধু গেঞ্জি পরেই কাটিয়ে দেবে। ব্যাগের মধ্যে আগে থেকেই দু’খানা বই ঢুকিয়ে রেখেছে রুমী ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ আর ‘সুকান্ত সমগ্র”। যুদ্ধ করতে যাবার সময়েও তার কবিতার বই সঙ্গে রাখা চাই!

বইয়ের খুব শখ রুমীর। পঁচিশে মার্চের পর বাড়ি সার্চ হওয়ার ভয়ে অনেক কিছু সরিয়ে ফেলতে হয়েছে বাড়ি থেকে অনেক পত্র-পত্রিকা-ইস্তাহার পুড়িয়ে ফেলেছে রুমী। মার্কস, এঙ্গেলস, মাও সে তুঙ, রবীন্দ্রনাথ, চে গুয়েভারার বইগুলো সব একটা বস্তায় ভরে রেখে দেওয়া হয়েছে বাথরুমের দেওয়ালের পেছনে একটা গর্তে। প্রিয় বইগুলিকে ওভাবে রাখতে খুবই কষ্ট হয়েছিল রুমীর, কিন্তু উপায় তো নেই!

চারদিন আগে ছিল জাহানারার জন্মদিন। এ বছর জন্মদিন নিয়ে কোনোরকম ঘটা করার প্রশ্নই ওঠে না। অন্য বছর ছেলেরা মায়ের জন্মদিন নিয়ে খুব আনন্দ করে, আগের রাত্তিরেই জাহানারা বলেছিলেন, এবার কোনো স্পেশাল রান্নাও হবে না, বাড়িতে কারুকে ডাকাও হবে না।

তবু সকালবেলা অন্যান্য বছরেরই মতন দুই ছেলে দরজায় টোকা দিয়ে বলেছিল, আম্মা আসি?

প্রত্যেক বছর দুই ভাই, মা বিছানা ছেড়ে ওঠার আগেই দুটি সারপ্রাইজ গিফট দেয়, মাকে নিয়ে নানারকম মজা করে। এবার মায়ের চোখ অশ্রুসিক্ত, ছেলেদের মুখ থমথমে। রুমী চলে যাবে, সব ঠিক হয়ে গেছে।

এবারেও অবশ্য দুই ভাই দুটি উপহার এনেছিল। ছোটভাই জামী বাগান থেকে তুলে এনেছে একটি আধ-ফোঁটা কালো গোলাপ। আর রুমীর হাতে একটা পুরনো বই। রুমী বলল, জামী, তুই আগে বনি-প্রিন্সটা আম্মার হাতে দে।

তারপর সে বইটা মাকে দিয়ে বললো, আম্মা এই বইটা পড়লে তুমি মনে অনেক জোর পাবে। সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময় নাৎসীবাহিনী পোল্যাণ্ডে ঢুকে যখন অমানুষিক অত্যাচার চালাচ্ছিল, তখন পোলিশরা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, যে ভাবে গেরিলা লড়াই চালিয়েছিল, এটা তারই কাহিনী। নাৎসীরা ইহুদীদের মানুষ বলেই গণ্য করতো না, তাদের পোকা মাকড়ের মতন মেরেছে, পশ্চিম পাকিস্তানীরাও আমাদের মানুষ বলে গণ্য করে না, মুসলমান বলে গণ্য করে না। তুমি এই বইটা পড়ো, নাম-ধাম বদলে দিলে তোমার মনে হবে, এ যেন অবিকল বাঙলাদেশেরই কাহিনী।

বইটি লিয়ন ইউরিসের ‘মাইলা-১৮’।

কালচে গোলাপটা হাতে নিয়ে জাহানারার মনে হয়েছিল, এ যেন জমাটবাঁধা রক্তের রং। কত রক্ত ঝরিয়ে আসবে স্বাধীনতা? তিনি কেঁপে উঠেছিলেন।

রুমী এখনও ঘুমিয়ে আছে। কাল রাতে অনেকক্ষণ রুমীর চুলে বিলি কেটে দিয়েছেন জাহানারা। দুই ভাইয়ের ছোটবেলা থেকেই এই অভ্যেস, ঘুমোবার আগে মাকে চুলে বিলি কেটে দিতে হবেই। কে বেশীক্ষণ পাচ্ছে, আর কে কম, তা নিয়ে দু’জনে ঝগড়া করেছে। কতদিন! কাল জামী স্বেচ্ছায় বলেছিল, আজ আমায় দিতে হবে না, আজ আমার সময়টাও তুমি ভাইয়াকেই দাও!

জাহানারা আদর করছিলেন, আর রুমী আস্তে আস্তে শিস দিয়ে গাইছিল, একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি! মাত্র কিছুদিন আগেই এই ছেলে বিলিতি গান-বাজনার কী ভক্তই না ছিল!

না, চোখের পানি ফেলতে নেই, শেষ সময়ে মন দুর্বল হয়ে গেলে চলবে না। জাহানারা চোখ মুছে নাস্তার ব্যবস্থা করতে গেলেন।

ঘুম থেকে উঠে একেবারে স্নানটান সেরে নিয়ে রুমী খাওয়ার টেবিলে এসে ধীর স্বরে বললো, আম্মা, যাওয়ার সময় নাটকীয় কিছু করতে পারবে না কিন্তু। যেমন অন্যদিন আমরা বাড়ি থেকে বেরোই ঠিক সেই ভাবে যাবো। তুমি গাড়ি চালাবে। আমাকে সেক্রেটারিয়েটের সেকেণ্ড গেটের সামনে নামিয়ে দেবে। তারপর তোমরা চলে যাবে, পিছন ফিরে তাকাবে না একবারও।

জাহানারা ধরা গলায় বললেন, শুধু একটা কথা বল। তোর সাথে কে কে যাবে এবার? কোন দিকে এখন যাবি তোরা?

রুমী বললো, ওসব কথা জিজ্ঞেস করো না, আম্মা। ওসব বলা নিষেধ। জানো তো, আমি মিথ্যে কথা বলতে পারবো না।

রুমীর বাবা শরীফ টেবিলের অন্য প্রান্তে বসে কাগজের আড়ালে মুখ ঢেকে রয়েছেন। জাহানারার মতন তিনিও রুমীকে যেতে দিতে রাজি হয়েছেন, তবে তাঁর পিতৃহৃদয়ে যে কী তোলপাড় চলছে তা তাঁর মুখ দেখে বোঝা যায় না।

ক’দিন ধরে ঝড়বাদল হচ্ছে বিকেলের দিকে। আজও সকাল থেকেই আকাশ প্রায় অন্ধকার। রুমীর যাবার দিনটাই এরকম কেন? গাড়িতে উঠে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে জাহানারা মনে মনে বললেন, ইয়া আল্লা আজ যেন ঝড় বৃষ্টি না আসে!

এয়ার ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে, যেন অন্যদিনের মতনই কলেজ যাচ্ছে, এই ভঙ্গিতে পেছনের সীটে গিয়ে বসলো রুমী, তার পাশে তার বাবা, তাঁর হাতে এখনও খবরের কাগজ।

গাড়িটা খানিকদূর যাবার পর রুমী ঘাড় ঘুরিয়ে একবার একটা দোতলা বাড়ির দিকে তাকালো। তারপর সে বললো, আম্মা, বাবুল চৌধুরী যদি কিছু জিজ্ঞেস করে, তাকে কিছুই বলো না। অন্যদের যদি কিছু বলতে হয় তোত বলবে যে আমি কিছুদিন গুলসানের বাড়িটায় থাকবো।

দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবুল দেখলো রুমীকে। ওদের গাড়িটা এলিফ্যান্ট রোডে পড়ে বাঁক নিল। বাবুল তবু এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সেদিকে। রুমীর সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ায় সে দেখেছিল রুমীর চোখে অদ্ভুত এক চাঞ্চল্য। বুঝতে তার অসুবিধে হয়নি যে রুমীর জীবনে আজ একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। বাড়ি ছেড়ে যুদ্ধে যোগ দিতে যাচ্ছে ছেলেটা?

বাবুলকে দেখে রুমী অবজ্ঞায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ইদানীং রুমী তাকে দেখলেও কথা বলতো না। অথচ একসময় এই রুমী দু’বেলা আসতো তার কাছে। মাও সে-তুঙ-এর রেড বুকের ব্যাখ্যা শোনার কী উৎসাহ ছিল তার।

বাবুল আপন মনে একটু হাসলো। রুমীর মতন ছেলেরা অনেকেই ইদানীং তাকে এড়িয়ে চলে। এরা কী মনে করে তাকে, দেশদ্রোহী? চতুর্দিকে এখন একেবারে দেশপ্রেমের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কয়েক মাস আগেও যারা ছিল মার্কসবাদী, এখন তারা হঠাৎ বাঙালী হয়ে উঠেছে, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ নিয়ে উন্মত্ত।

অতি তরলমতি, ভাবালুতাপূর্ণ এই ছেলেরা। কখনো চোস্ত প্যান্ট পরে ফরফর করে ইংরেজি বলে আর আমেরিকান কায়দায় নাচানাচি করে, কখনো চীনা পন্থী হয়ে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে, আবার হুজুগে মেতে জাতীয়তাবাদের জোয়ারে ভেসে যায়। একটু ধৈর্য নেই! পাকিস্তান এখন যে পথে এগোচ্ছে, তাতে একদিন না একদিন এদেশে সর্বাত্মক বিপ্লব ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য, তখন শোষকশ্রেণীকে একেবারে ঝাড়েমূলে নির্বংশ করে দেওয়া যাবে। তার বদলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এরা এখন মেতে উঠেছে, স্বাধীন বাংলাদেশের নামে কী চাইছে এরা? এরা কি বোঝে না যে পাকিস্তান সত্যিই যদি দু’টুকরো হয় তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানী আর্মির বদলে আসবে আর একটি শোষকশ্রেণী।

বাবুলের বন্ধুরাও প্রায় কেউ আর যোগাযোগ রাখে না তার সঙ্গে। জহির, কামাল এদের পাত্তা নেই। এরাও ভয় পেয়েছে? ই পি আর এর বিদ্রোহ আর শখের মুক্তিবাহিনীকে দমন করবার জন্য সৈন্যবাহিনী নানা জায়গায় খুব অত্যাচার চালাচ্ছে তা ঠিক। কিন্তু জহির কামালরা কি জানে না যে একটা দেশের বিপ্লব শুরু হবার আগে অত্যাচার আর নিষ্পেষণ কত চরম অবস্থায় পৌঁছোয়! এই বোকারা কি বুঝছে না যে সমাজতন্ত্রী চীন পাকিস্তানের সেনা সরকারকে মদত দিয়ে তাদের আরও সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে!

ইউনিভার্সিটি বন্ধ, বাবুলের কোথাও যাবার জায়গা নেই। ঢাকার অবস্থা অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে, কিছু কিছু দোকান পাট, অফিস কাছারি খুলেছে, ইস্কুলগুলো জোর করে খোলাবার ব্যবস্থা হচ্ছে, কিন্তু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের সরকার এখনো বিশ্বাস করে না। দরকার নেই এখন পড়াশুনোর।

আলতাফ হঠাৎ ইণ্ডিয়ায় চলে গেছে। সেও যে কেন ভয় পেল, তা বোঝা যাচ্ছে না। ইণ্ডিয়ার প্রতি তার এতদিন বিদ্বেষ ভাবই ছিল। হোসেন সাহেবেরও পাত্তা নেই, তিনি বোধহয় পালিয়েছেন করাচীতে। ওদের কাগজটা কেন বন্ধ করে দিল কে জানে! বছর দুয়েক ধরে কাগজটা তো পাকিস্তান সরকারেরই তোষামোদ করে আসছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় ওরা শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহী, বিদেশের দালাল আখ্যা দিয়ে ছবি ছাপাতে প্রায় প্রতিদিন।

বাবুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মঞ্জুও তার ছেলেকে নিয়ে মামুনমামার সঙ্গে চলে গেছে ইণ্ডিয়ায়। বাবুল প্রায় জোর করেই মঞ্জুকে পাঠিয়েছে, জোর করেছিল এইজন্য যে মঞ্জুর প্রবল ইচ্ছে যাওয়ার, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারছে না, সেটা বুঝতে পেরেছিল বাবুল। ঢাকা শহরের বাড়ির মধ্যে থেকে মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে যাবে, এরকম অবস্থা কখনো আসেনি। মামুনমামাকে ভালোবাসে মঞ্জু, বাবুল তা জানে,’হয়তো, হয়তো কেন, নিশ্চিত সে ভালোবাসার মধ্যে কোনো নোংরামি নেই, শারীরিক সম্পর্ক নেই। কিন্তু এইরকম ভালবাসাও এক এক সময় এমন তীব্র হতে পারে, যাতে কোনো নারীর কাছে তার স্বামীর চেয়েও সেই ভালোবাসার মানুষটি অনেক বড় হয়ে উঠতে পারে। মামুনমামাকে ঈর্ষা করে না বাবুল, এই সব ঈর্ষাটির্ষা অতি খেলো ব্যাপার, কিন্তু প্রতিদিন বাড়ি ফিরলেই যদি দেখা যায় স্ত্রী কোনো একজন পুরুষের সঙ্গে, সে আত্মীয় হোক আর যেই হোক, গল্পে মেতে আছে, কিংবা তাকে খাতির যত্ন করছে, তাতে কোন স্বামীর ভালো লাগে? মামুন একজন টোটালি কনফিউজড মানুষ, তাকে অত ভক্তিশ্রদ্ধা করারই বা কী আছে, তাও ভেবে পায় না বাবুল!

যাক, কিছুদিন মামুনের সঙ্গে থেকে আসুক মঞ্জু, খুব কাছ থেকে দেখলে হয়তো মানুষটি সম্পর্কে তার মোহ কেটে যেতেও পারে। আশা করি ভারতে গিয়ে ওরা কোনো বিপদে পড়বে না। মঞ্জুর জন্য নয়, ছেলেটার জন্য মাঝে মাঝে বাবুলের মনটা উতলা হয়ে ওঠে। বাড়িতে একটা বাচ্চা থাকলে বাড়ি সরগরম থাকে, সুখু নেই বলেই বাড়িটা এখন নিঝুম মনে হয়।

এ বাড়িতে এখন আড়াইজন মাত্র মানুষ। নিচতলায় মনিরা থাকে একা। সিরাজুলকে পঁচিশে মার্চের পর একবার মাত্র দেখেছে বাবুল। তারপর থেকে সে উধাও সে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে নিশ্চিত। এই অবস্থায় মনিরার কি এ বাড়িতে থাকার কোনো মানে হয়? তাকে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবার প্রস্তাব দিয়েছিল বাবুল, কিন্তু এমন জেদী মেয়ে, কিছুতেই শুনবে না। সিরাজুল নাকি এখানেই মাঝে মাঝে তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। এই সব মুক্তিযোদ্ধা টোদ্ধাদের বিন্দুমাত্র উৎসাহ দিতে চায় না বাবুল, তার বাড়িতে থেকে সিরাজুল এসব কাজকর্ম চালাবে, এতে তার ঘোর আপত্তি আছে। কিন্তু মনিরাকে সে তো বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে পারে না।

সেফু নামে কিশোরী মেয়েটিকে মঞ্জু মাথার দিব্যি দিয়ে গেছে, সে যেন সাহেবকে ছেড়ে কোথাও না যায় কখনো। সেই সেফুই বাবুলের জন্য রান্না করে দেয়, গোসলের পানি গরম করে রাখে। গ্রীষ্মকালেও ঈষদুষ্ণ জলে বাবুলের স্নান করা অভ্যেস। দিনের মধ্যে সে আটবার চা খায়।

বারান্দা থেকে ঘরে এসে বাবুল হাঁক দিল, সেফু, এক কাপ চা দিয়ে যা।

একখানা বই খুলে বসলো বাবুল। বই পড়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। পড়তে পড়তে এক সময় চোখ ব্যথা হয়ে যায়। শুধু পড়াশুনো নয়, এবার একটা কমোদ্যোগে নামতে হবে। বুড়ো ভাসানীও ভারতে নিরাপদ আশ্রয় নিয়ে স্বাধীন বাংলার দাবি সমর্থন করে বসে আছেন। কিন্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে দলের পুরনো কমারা রয়ে গেছে এখনো কিছু কিছু। এইবার যোগাযোগ করতে হবে তাদের সঙ্গে। কাজ শুরু করতে হবে সম্পূর্ণ গোপনে, রুখতে হবে এই জাতীয়তাবাদের তরঙ্গ।

দু’দিন পরে সকালবেলা বাবুল সবে মাত্র বিছানায় শুয়ে দ্বিতীয়বার চা খেয়েছে, তখনও মুখ বোয়নি, সেফু হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো, সাব সাব, মিলিটারি আইছে! মিলিটারি!

বাবুল বই থেকে মুখ তুলে বললো, আইছে তো কী হইছে? তুই লাফাইতে আছেস ক্যান?

চোখ প্রায় কপালে তুলে সেফু বললো, আমাগো বাড়িতে আইছে, সাব। মনিরা আপার ঘরে ঢোকছে।

এবার বাবুল একতলায় হুড়ুম ধরাম শব্দ শুনতে পেল। সত্যি তার বাড়িতে আর্মি এসেছে? এরা জানে না যে স্বয়ং টিক্কা খানের সঙ্গে পরিচয় আছে তার।

.

খালি গায়েই নেমে এলেন বাবুল। এরই মধ্যে কয়েকজন সৈন্য মনিরার ঘর থেকে সব জিনিসপত্র টান মেরে ফেলে দিয়েছে বাইরে। একজন মনিরার চুলের মুঠি চেপে ধরে আছে।

সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই বাবুল ইংরেজিতে বললো, থামো! তোমরা কার হুকুমে এ বাড়িতে এসেছো? আগে মেয়েটিকে ছেড়ে দাও। আমি এখনই কর্নেল আনসারীকে টেলিফোন করছি।

কোনো উত্তর না দিয়ে একজন সৈন্য হাতের রিভলভার তুলে পর পর দুবার ফায়ার করলো, তারপর অন্যদের বললো, আব চলো!

হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল বাবুল। যন্ত্রণার চেয়েও মহা বিস্ময়ে সে ভাবলো, সে কি সত্যি মরে যাচ্ছে? মৃত্যু এই রকম? এত তুচ্ছ ভাবে মৃত্যু!

মনিরা চিৎকার করে কাঁদছে, বাবুলের নাম ধরে ডাকছে, তাকে রক্ষা করবার কোনো ক্ষমতাই নেই বাবুলের, ক্রমশই সব শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসছে তার কানে। বুজে আসছে চোখ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *