১৬. চিঠি লেখা বন্ধ করে শাহানা উঠে দাঁড়াল

মিতু,

তুই কেমন আছিস বল তো?

আমি জানি তুই আমার উপর খুব রাগ করে আছিস। তোর কত শখ আমরা তিন বোন মিলে গ্রামে এসে গিয়ে হৈ-চৈ করব। আমার জন্যে তোর শখ মিটল না। মিতু, খুব ছোটবেলা থেকেই আমি ঠিক করে রেখেছিলাম–এ জীবনে কাউকেই কখনো কষ্ট দেব না। দেইও না, শুধু তোর বেলাতেই ব্যতিক্রম হয়। কেন হয় আমি নিজেও জানি না। কেন তোকে আমি বারবার কষ্ট দেই? তুই আমার অতিপ্রিয় এই কারণেই কি? অতি প্রিয়জনদেরই কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে।

আজ আমার মনটা খুব খারাপ। এখানে একটা গানের আসর হল। হেলাফেলা ভাব নিয়ে গান শুনতে গিয়ে রীতিমত চমকে গেছি। প্রথমে কিছুক্ষণ বাজনা হল–গ্রাম্য কনসার্ট। একজন নেচে নেচে ঢোল বাজালেন, বাকিরা তাকে সঙ্গত করলেন। আমি বাজনা শুনে অভিভূত হয়েছি এটা বললে কম বলা হবে–আমার চিন্তাচেতনায় একটা ধাক্কা পড়েছে।

কনসার্টের পর শুরু হল গান। এই গ্রামেরই এক গায়ক মতি মিয়া গান শুরু করলেন। বেচারার চোখে কাজল, গায়ে হাস্যকর এক পাঞ্জাবি, যার হাতা ছেঁড়া। রিফু করে সে ছেঁড়া ঢাকা যায়নি। সে হাসিমুখে দর্শকদের মাথা নুইয়ে কয়েকবার সালাম করে গান শুরু করল–মরিলে কান্দিও না আমার দায়–সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে পানি এসে গেল। মিতু গানের এই প্রচণ্ড শক্তির কথা আমার জানা ছিল না। বাসায় রাতদিনই গান শুনি। ঘরভর্তি এল. পি.–সিডি ডিস্ক। গান শুনে কতবার অভিভূত হয়েছি–চোখে পানি এসেছে কিন্তু গ্রামের আসরের গ্রাম্য সেই গায়কের গান শুনে চোখে যে পানি এসেছে তার জাত আলাদা। এই গায়ক তার গান দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন–মানব জীবন ক্ষণিকের। ডাক্তার হিসেবে এই তথ্য আমার অজানা নয় তারপরেও মনে হল জীবনে এই তথ্যটির মর্ম প্রথম উপলব্ধি করলাম।

গান শুনতে শুনতে আমার কি ইচ্ছা হচ্ছিল জানিস? আমার ইচ্ছা হচ্ছিল চেয়ার ছেড়ে মঞ্চে উঠে যাই। গায়কের পাশে গিয়ে বসি। গায়ককে বলি–শুনুন, আপনি কোন দিন আমাকে ছেড়ে যেতে পারবেন না। আপনাকে আমৃত্যু আমার পাশে পাশে থাকতে হবে। আপনি কোনদিনও আর আসর করে গান গাইতে পারবেন না—বাকি জীবন আপনাকে গান গাইতে হবে শুধুই আমার জন্যে।

তুই কি ভাবছিস আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ঘোরের মত তৈরি হয়েছে তো বটেই। এই ঘোর সামাল দেবার ক্ষমতাও আমার আছে। যে মেয়ে দুদিন পর জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটিতে পিএইচ. ডি করতে যাবে সে এক অশিক্ষিত মূর্খ গ্রাম্য গায়ককে কখনো বলতে পারবে না–আপনি আমাকে ছেড়ে যেতে পারবেন না। বলতে পারা উচিতও বোধহয় না। ঐ গ্রাম্য গায়ক একটা বিদ্যা আয়ত্ত করেছেন। ঐ বিদ্যার ক্ষমতা সম্পর্কেও তার ধারণা নেই। ঐ বিশেষ বিদ্যাটির প্রতি ভালবাসা তার দিকে নিয়ে যাওয়া কোন কাজের কথা না।

কিন্তু মিতু, আমি এতই অভিভূত হয়েছি যে আমার মন শুধুই কাঁদছে–। বার বার মনে হচ্ছে, আমি যদি এই গ্রামের অশিক্ষিত দরিদ্র এক তরুণী হতাম–তাহলে কি চমৎকার হত! ছুটে যেতাম তার কাছে। হায় রে! আমার জন্ম হয়েছে অন্য জগতে–আমি রাজবাড়ির মেয়ে–ভীরু ধরনের মেয়ে, যার সাহস ঢাকা থেকে একা একা সুখানপুকুরে উপস্থিত হবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে যাবার ক্ষমতা যার নেই। প্রতিভার প্রাথমিক পর্যায় চারাগাছের মত। সতেজ ছোট্ট একটা চারাগাছ যে লক লক করে বেড়ে ওঠার জন্যে অপেক্ষা করছে। প্রাথমিক পর্যায়ে তাকে সযত্নে রক্ষা করতে হয়। তারপর এক সময় সে মহীরুহে পরিণত হয়, তখন আর তার কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই। আচ্ছা মিতু, আমি কি… না থাক।

মিতু, তুই চলে আয়। আমার খুব একা একা লাগছে। শরীরটাও ভাল নেই–গানের আসর থেকেই জ্বর জ্বর ভাব নিয়ে ফিরেছি। দেখতে দেখতে জ্বর বেড়েছে। শারীরিক অবস্থাও ঘোর তৈরির একটি কারণ হতে পারে…। তুই চলে আয় মিতু–তোকে নিয়ে দু-একদিন খুব বেড়াব, তারপর ঢাকায় চলে আসব। নিজের ভুবনে–নিজের জগতে। বাইরের কোন কিছুই তখন আর আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। আমরা আধুনিক মানুষ–কচ্ছপের মত শক্ত খোলে ভেতর থাকাই আমাদের জন্যে নিরাপদ।

কান্নার শব্দ আসছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কে যেন কাঁদছে। চিঠি লেখা বন্ধ করে শাহানা উঠে দাঁড়াল। মনে হচ্ছে নীতু কাঁদছে। এরকম করে সে কাঁদছে কেন? আশ্চর্য তো!

শাহানা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নীতু না, কাঁদছে পুষ্প। দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নীতু পুষ্পের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। নীতুর মুখ বিষণ্ণ।

শাহানা বলল, কি হয়েছে নিতু?

নীতু জবাব দিল না। শাহানা পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বলল, পুষ্প, কি হয়েছে?

পুষ্প বলল, কিছু হয় নাই।

অকারণে কেউ তো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে না। কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। কি হয়েছে তুমি কি বলতে চাও না?

পুষ্প নাসূচক মাথা নাড়ল। শাহানা লক্ষ্য করল, পুষ্পের ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

নীতু বলল, দাদাজান ওকে মেরেছেন। চড় মেরেছেন।

ও আচ্ছা।

নীতু বলল, ওকে চলে যেতে বলেছেন। ও চলে যাচ্ছে।

শাহানা নিজের ঘরে চলে এল। সমস্যা কিছু হয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে। নীতুর মুখ কঠিন হয়ে আছে। এই মুখ বিদ্রোহিনীর মুখ। সে নিজেকে সামলে রাখতে চেষ্টা করছে।

এমন মানসিক পরিস্থিতিতে চিঠিতে মন বসানো যায় না। শাহানা নিজের ঘরের বিছানায় বসল। সে ভেবেছিল, কিছুক্ষণের মধ্যে নীতু ঘরে ঢুকে পুরো ব্যাপারটা বলবে।

নীতু ঘরে ঢুকল না। কি হয়েছে কিছু জানা যাচ্ছে না। দাদাজান মেরেছেন, অকারণে নিশ্চয়ই মারেননি। একজন বৃদ্ধ সুস্থ মাথার মানুষ অকারণে শিশুর গায়ে হাত তুলবেন না। ব্যাপারটা কি?

ব্যাপারটা সামান্যই। ইরতাজুদ্দিন সাহেব বাংলোঘরের জানালা থেকে দেখেছেন পুষ্প নীতুর হাত ধরে হাঁটছে। কি সব বলছে, নীতু হেসে ভেঙে পড়ছে। তিনি পুষ্পকে ডেকে পাঠালেন। নীতুও সঙ্গে সঙ্গে এল। নীতুকে তিনি চলে যেতে বললেন। নীতু গেল না, দাঁড়িয়ে রইল। তিনি পুষ্পের চোখের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সহজ গলায় বললেন–কি রে, তুই নীতুর হাত ধরে হাঁটছিস কেন? এক ফোঁটা শরীরে এত সাহস! বলেই কারো কিছু বুঝবার আগে প্রচণ্ড চড় কষালেন। পুষ্প এর জন্যে, প্রস্তুত ছিল না বলে ছিটকে মেঝেতে পড়ে গেল। ইরতাজুদ্দিন আরো সহজ গলায় বললেন–কাঁথা বালিশ নিয়ে বাড়ি চলে যা। আর যেন তোকে ঐ বাড়িতে না দেখি।

 

এখন বিকেল। রোদ মরে এসেছে। নীতুর খুব একা একা লাগছে। পুষ্প নেই। সে তার মাদুর ও বালিশ না নিয়েই চলে গেছে। আপন মনে খানিকক্ষণ বারান্দায় হাঁটল, তারপর গল্পের বই নিয়ে বাড়ির পেছনের বাগানে চলে গেল। সেখানে। কাঁঠালগাছে বড় দোলনা টানানো হয়েছে। দোলনায় দোল খেতে খেতে গল্পের বই পড়া যায়। সঙ্গে আনা বই সব পড়া হয়ে গেছে। নীতু পুরানো একটা বই—জল দস্যু নিয়ে দোলনায় উঠে বসল। সন্ধ্যা পর্যন্ত গল্পের বই পড়ল।

সন্ধ্যা মেলাবার পর শাহানার ঘরে ঢুকে বলল, আপা, পুষ্প তো চলে গেছে, আজ রাতে আমি তোমার সঙ্গে ঘুমুব।

শাহানা বলল, আচ্ছা।

আমরা আর কদিন আছি আপা?

চারদিন। তোর কি চলে যেতে ইচ্ছা করছে?

না, চারদিন পরই যাব।

তোর কি মন বেশি খারাপ?

হুঁ।

ছাদে যাবি? চল ছাদে বসে গল্প করি। যাবি?

হুঁ যাব। দাঁড়াও, এক মিনিট। দাদাজানকে একটা কথা বলে আসি।

রাগারাগি করবি না তো?

না।

খবরদার! রাগারাগি করবি না। আমি কি আসব তোর সাথে?

উহুঁ।

ইরতাজুদ্দিন নামাজঘরে বসেছিলেন। মাগরিবের নামাজ শেষ করে তসবি টানছেন। নামাজঘরে মোমবাতি জ্বলছে। মশা তাড়াবার জন্যে ধূপ জ্বালানো হয়ছে। ধূপের গন্ধে গা কেমন কেমন করে। নীতু নামাজঘরে ঢুকল না। দরজা ধরে দাঁড়াল। ইরতাজুদ্দিন তসবি নামিয়ে রেখে বললেন, কিছু বলবি?

নীতু বলল, হ্যাঁ।

বল শুনি।

নীতু খুব স্পষ্ট করে বলল, দাদাজান, আপনি অকারণে পুষ্প মেয়েটাকে মেরেছেন। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। খুব অন্যায় করেছেন।

ইরতাজুদ্দিন শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, মানুষ হয়ে জন্মালে এইসব ছোটখাটো অন্যায় করতে হয়। পশুরাই শুধু কোন অন্যায় করে না। আমি তো আর পশু না। আমি মানুষ।

দাদাজান, অন্যায় করেছেন। আমি প্রচণ্ড রকম রাগ করেছি আপনার উপর। আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ মেয়েটিকে ডেকে ক্ষমা চাইবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এ বাড়ির কোন খাবার খাব না।

তাই নাকি?

হ্যাঁ তাই।

নীতু দরজার পাশ থেকে সরে এল। ইরতাজুদ্দিন ব্যাপারটার কোন গুরুত্ব দিলেন না। বাচ্চা একটা মেয়ের কথায় গুরুত্ব দেবার কিছু নেই। এক বেলা না খেলে কিছু। হয় না। তিনি আবারো তসবি টানতে লাগলেন।

নীতু ছাদে বসে শাহানার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করল। মজার মজার গল্প। একবার তাদের স্কুলে এক বানরওয়ালা বানরের খেলা দেখাতে এসেছিল–বানরটা হঠাৎ ছুটে এসে নাইন বি সেকশানে ঢুকে কি কাণ্ডকারখানা শুরু করল। তিথি নামে একটা মেয়ের গলা জড়িয়ে ধরল। মেয়ে চিঙ্কার দিয়েই অজ্ঞান। গল্প শেষ করে রান্নাঘরে ঢুকে রমিজের মা কি করে কুমড়ো ফুলের বড়া তৈরি করে সেটা আগ্রহ করে দেখল।

রাতে ঘুমুতে গেল না খেয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *