আজকাল ফয়সল সাহেবের ঘুমের রুটিনে অদল-বদল হয়ে গেছে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েন। বেশ গাঢ় ঘুম। সেই ঘুমের স্থায়িত্ব কম। জেগে উঠেন মিনিট পাচেকের মধ্যে এবং জেগেই নিজের ওপর রেগে যান। ভয়ঙ্কর রাগ। কেন দীর্ঘদিনের এই ক্রীতদাস শরীর। তার কথা শুনবে না। মৃত্যু কি এসে যাচ্ছে? সে কি অপেক্ষা করছে বাইরে। দেখতে সে কেমন? ফয়সল সাহেবের মনে হল সে দেখতে অন্ধ ভিখারীদের মত। নোংরা পূতিগন্ধময় তার পোশাক। হাতে লম্বা লম্বা কালো নখ। সমস্ত গায়ে কুণ্ঠ–রোগীর ঘা। সেই ঘা থেকে লালাভ রস ঝরছে।
আজও ফয়সল সাহেব নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ নিয়ে জেগে উঠলেন। ঘড়ি দেখলেন সন্ধ্যা ছটা। হঠাৎ তার খটকা লাগল সন্ধ্যা না। সকোল? তার মাথা দুলতে লাগল। সময়ের জ্ঞান কি চলে যাচ্ছে? এ কেমন কথা? তিনি ভয় পাওয়া গলায় ডাকলেন, বীথি। বীথি!
বীথি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঢুকাল। সাদা একটা শাড়ি গায়ে। লাল একটা শাল ছড়িয়ে দিয়েছে শাড়ির উপর। শালের উপর মাথার ঘন কালো চুল এলিয়ে দিয়েছে। অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য এই সব দৃশ্য তিনি আর বেশি দিন দেখবেন না। একজন অচেনা-অজানা যুবক এই মেয়েটির হাত ধরে ছাদে হাঁটাহাঁটি করবে। অসহ্য। ফয়সল সাহেবের মুখে যন্ত্রণার ছাপ পড়ল।
তিনি মুখ কুঁচকে ফেললেন। বীথি ক্ষীণ স্বরে বলল, স্যার আমাকে ডেকেছিলেন?
হুঁ।
কী জন্যে?
এখন সকাল না। সন্ধ্যা?
বীথি বিস্মিত হয়ে বলল, সন্ধ্যা।
সন্ধ্যা হলে আলো নেই কেন?
বারান্দার বাতিটা জ্বালিয়ে দেব?
দরকার নেই, তুমি বস আমার পাশে।
বীথি বসল।
এত দূরে বসছ কেন? নাকি বুড়ো মানুষদের কাছে বসতে ভাল লাগে না? চেয়ারটা টেনে আরো কাছে নিয়ে এসো।
বীথি চেয়ার টানল। ফয়সল সাহেব বীথির ডান হাতের উপর নিজের হাত রাখলেন। বীথির কোনো রকম ভাবান্তর হল না। যে ভাবে বসেছিল ঠিক সে ভাবেই বসে রইল।
বীথি!
জি।
আমি এই বাড়িটা তোমার নামে লিখে দিয়ে যাব।
বীথি কিছু বলল না। ফয়সল সাহেব বললেন,
বার কাঠা জমির উপর বাড়ি। জমির ভ্যালুয়েশনই হবে তোমার বিশ লাখ টাকা। বাড়ির দাম আর ধরলাম না। কি কথা বলছি না কেন?
বীথি শান্ত স্বরে বলল, চা খাবেন স্যার? চা নিয়ে আসি?
না চা আনতে হবে না। বসে থাক চুপচাপ। হাত ধরে আছি বলে কী তোমার খারাপ লাগছে?
জি না স্যার।
ফয়সল সাহেব বীথির ফর্সা হাতের দিকে তাকালেন। কি ফর্সা হাত! কি নরম! এই কোমল পেলাব হাতের উপর তার হাতটাকে কি কুৎসিত দেখাচ্ছে। তার বুকের ভেতর একটি নিঃশ্বাস পাক খেতে লাগল। ভোগ করবার কত কি আছে পৃথিবীতে কিন্তু সময় এত অল্প। কিছুই ভোগ করা যায় না। সময় এত কম।
বীথি।
জি স্যার।
বাড়ি টা তোমাকে দান করে যাব। বুঝতে পারছ?
অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, বাতি জ্বেলে দেই?
বীথি উঠে গিয়ে বাতি জ্বালাল। এই মেয়েটি আরো সুন্দর হয়েছে। ঘন কালো চোখ; এত কালো চোখ হয় মেয়েদের?
বীথি।
জি।
চোখে কাজল দিয়েছ নাকি?
জি না।
তুমি যাচ্ছ কোথায়?
আপনার জন্যে কিছু খাবার নিয়ে আসি।
কিছু আনতে হবে না। যেখানে বসেছিলে সেখানে বসে থাক।
বীথি এসে বসল। ফয়সল সাহেব। আবার তার হাত তুলে নিলেন। সময় ফুরিয়ে আসছে। নখদন্ত নিয়ে অপেক্ষা করছে কুৎসিত মৃত্যু! সে তার অন্ধ চোখে তাকিয়ে আছে বারান্দার দিকে।
ফয়সল সাহেবের ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। বৃক্ষ বার বার তার যৌবন ফিরে পায়। প্রতি বসন্তে নতুন পাতা আসে তার গায়ে কিন্তু মানুষের যৌবন আসে একবার। কোথায় পড়েছেন এটা? কার লেখা? ওসমানের কোন বইতেই কি পড়েছেন? এমন একটি চমৎকার কথা তার অপদার্থ ছেলে কি করে লিখবে? নিশ্চয় অন্য কেউ লিখেছে। আজকাল কিছু মনে থাকে না।
বীথি।
জি।
ওসমানকে একটা টেলিফোন করে জিজ্ঞেস করত ‘বৃক্ষ বার বার তার যৌবন ফিরে পায়’ এই কথাটা সে তার কোন বইয়ে লিখেছে কিনা।
লিখেছেন। বইটির নাম হচ্ছে….
থাক নামের দরকার নেই; তুমি যাও বাতিটা নিভিয়ে দাও। আলো চোখে লাগছে।
বীথি আলো নিভিয়ে দিল।