1 of 2

১৬. খাওয়া দাওয়া শেষ করতেই

 ষোল

খাওয়া দাওয়া শেষ করতেই দুপুর গড়িয়ে গেল। শেষ পাতে দই দেখে একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল অর্ক। কাল রাত্রের নিয়ে আসা মিষ্টিও ছিল সঙ্গে। এসব সচরাচর তাদের বাড়িতে হয় না। পরিবেশন করার সময় মাধবীলতাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। রবিবারের মেনু ডিমের ঝোল, একটা তরকারি আর ভাত। দুটো ডিম নিয়ে এসে একটা পুরো অর্কর জন্যে বাকিটা দুজনে আধাআধি। এটা এখন নিয়মের মত। সে বাড়ি ফেরার আগেই করে রেখেছিল নিশ্চয়ই কিন্তু দই কখন এল? হয়তো যখন কল-পায়খানায় গিয়েছিল তখনই মা নিয়ে এসেছে। খেতে বসে অর্ক আড়চোখে মায়ের দিকে তাকিয়েছিল, মাকে আজ অন্যরকম লাগছে।

অনিমেষ আর অর্ক পাশাপাশি বসে, মাঝখানে খাবার, উল্টো দিকে মাধবীলতা। বাঁ হাতে হাঁড়ি থেকে এক হাতা ভাত তুলে ছেলের থালায় ঢেলে দিয়ে মাধবীলতা বলেছিল, ‘অনেকদিন আমরা মাংস খাইনি, না?’ সামনের রবিবার আনিস তো খোকা।’

অনিমেষ খেতে খেতে মুখ তুলে তাকিয়েছিল, তারপর হেসে বলেছিল, ‘মাংসের দাম কত জানো?’ মাধবীলতা নিজের পাতে খাবার নিয়ে অন্যমনস্ক গলায় বলেছিল, ‘কত আর হবে। একদিন তো খাবো!’

অর্ক বলেছিল, ‘রবিবার খুব লাইন পড়ে ঠাকুরের দোকানে।’

মাধবীলতা এক গালে ভাত রেখে জবাব দিয়েছিল, ‘খুব ভোরে উঠিস।’

অর্কর হঠাৎ মনে হয়েছিল আজ ঘরের চেহারাটা একদম বদলে গিয়েছে। এত শান্তির ছাপ ওই মানুষগুলোর মুখে সে কি কখনো দেখেছে? কি করে এমন হল? মায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করার পর থেকেই এই ঘরটা অন্যরকম হয়ে গেল। তার মানে খুব অল্প পেলেই মানুষ তার কষ্ট ভুলে যেতে পারে। তাই তো? মাধবীলতা ঝুঁকে দই-এর ভাঁড়টা বাঁ হাতে যখন আনছিল তখন অর্ক দেখতে পেল মায়ের ডান দিকের জামা অনেক খানি ফেঁসে গিয়েছে। পাঁজরের চামড়া দেখা যাচ্ছে। সে আচমকা বলে বসল, তুমি ছেঁড়া জামা পরেছ কেন?’

চকিতে আঁচল টেনে ঢেকে ঢুকে ঠোঁট কামড়ে মাধবীলতা বলল, ‘ছেঁড়া কোথায়?’ বলে অনিমেষকে আড়চোখে দেখে নিল।

‘তুমি জানো তুমি ছেঁড়া জামা পরেছ।’ অর্ক দই দিয়ে ভাত মাখছিল।

‘ঠিক আছে, তুই আমাকে নতুন জামা যখন কিনে দিবি তখন আর পরব না। আর ভাত নিবি? তুমিও একটু নাও।’ মাধবীলতা প্রসঙ্গ ঘোরাতে চেয়েছিল।

অর্ক সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষকে সজাগ করেছিল, ‘বাবা আর নিও না তাহলে মা না খেয়ে থাকবে।’

অনিমেষ হয়তো নিতে চাইছিল কিন্তু কথাটা শোনামাত্র ঢেকুর তুলে বলেছিল, ‘আমার পেটে আর এক ফোঁটা জায়গা নেই।’

মাধবীলতা হেসে ফেলল। তারপর খেতে খেতে বলেছিল, ‘কাঁকুড়গাছিতে সরকারি ফ্ল্যাট নাকি পাওয়া যাচ্ছে। বিয়াল্লিশ টাকা ভাড়া।’

অনিমেষ শব্দ করেছিল গলায়, ‘দূর। ওই টাকায় পাখির খাঁচাও পাওয়া যায় না।’

মাধবীলতা বলেছিল, ‘তবু আমি একবার দেখে আসব। আমাদের একজন টিচারের নাকি হোল্ড আছে। আচ্ছা, সুদীপকে বললে ও ব্যবস্থা করে দিতে পারে না?’

‘কে সুদীপ?’ অনিমেষের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। এই সময়টাই তার কাছে খুব পীড়াদায়ক। মাধবীলতা একটা মগে জল আর খালি সসপ্যান এগিয়ে দিত ওর মুখ ধোওয়ার জন্যে। কিন্তু ইদানীং সেটা নিজের কাছেই বিশ্রী ঠেকে। এখন পাতে ডান হাত ধুয়ে নিয়ে খাট ধরে সোজা হয়ে ক্রাচে ভর করে বাইরে যেতে হয় কুলকুচি করার জন্যে। মাধবীলতা বলেছিল, ‘ওঃ, তুমি এত ভুলে যাও। য়ুনিভার্সিটির সুদীপ মন্ত্রী হয়েছে। তুমি বললে নিশ্চয়ই শুনবে।’

অনিমেষ হেসেছিল, ‘তুমি সত্যি অদ্ভুত।’

‘মানে?’

‘যার পকেটে একটা টাকা থাকে সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাঁড়ের চা খায়, চিনে বাদাম ছাড়িয়ে খেতে খেতে হাঁটে। তার পকেটে এক লক্ষ এলে সে আর কখনই ভাঁড় হাতে নিতে পারে না। তুমি কোন ধনী মানুষকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাদাম খেতে দেখেছ? এটা তার দোষ নয়। পরিবেশ কিংবা ক্ষমতাই তাকে এমন আচরণ করায়। সুদীপ যদি কিছু করে তাহলে অনুকম্পাবশত করবে। তোমার সেটা ভাল লাগবে?’

মাধবীলতার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। ছেলে বসে আছে দেখে বলেছিল, ‘তুই বসে আছিস কেন, যা হাত ধুয়ে আয়।’

অর্ক জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তোমাদের বন্ধু মন্ত্রী?’

অনিমেষ মাথা নেড়েছিল, ‘পরিচিত, ওকে বন্ধু বলে না। এতে অবাক হবার কিছু নেই।’

‘উনি নকশাল ছিলেন?’

এবার মাধবীলতা এবং অনিমেষের চোখাচোখি হয়েছিল, অনিমেষ হেসেছিল, ‘না।’

মাধবীলতা একটু অবাক হয়েছিল, ‘তোর তাহলে ওসব মনে আছে।’

‘কেন থাকবে না। তবে সি পি এম করলে বাবা এতদিনে মন্ত্রী হয়ে যেত, না!’

বলে উঠে হাত ধুতে চলে গেল অর্ক।

‘কি বুঝছ? ছেড়ে দাও এসব।’ মাধবীলতা বলল, ‘যেকথা বলছিলে, আমার এখন যা চাই তা আদায় করে নিতে হবে। ওসব চক্ষুলজ্জা নিয়ে অনেক দূরে সরে থেকেছি। কেউ যদি আমার আড়ালে কিছু বলে তাতে কি এসে যায় যদি কাজ হয়? আমার সামনে না বললেই হল। আমি আর ওসব কেয়ার করি না।’

অনিমেষ চমকে উঠেছিল, ‘তুমি খুব বদলে যাচ্ছ।’

বদলে যাচ্ছে কি না তা মাধবীলতা জানে না কিন্তু এখন মেঝেতে পাতা শীতলপাটিতে শুয়ে মনে হল এতদিনে যা যা ও করে এসেছে সব ঠিক করেনি। শুধু সয়ে যাওয়ার কোন মানে হয় না। কেউ আমার রুচির মূল্য না দিলে অভিমানে সরে থাকার কোন যুক্তি নেই। আজকে একটুর জন্যে বিরাট ভুল হয়ে যাচ্ছিল। অন্তত আজকের দিনে অর্ক কোন অন্যায় করেনি তবু সেই একই অভিমানে ওকে বোঝার চেষ্টা সে প্রথমে করেনি। তার পরেই ওর স্নেহ প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর ছেলেটা কেমন বদলানো ব্যবহার করছে। অন্তত এই মুহূর্তে ওর বই নিয়ে বসা স্বাভাবিক নয়। অর্কর পিঠের দিকে তাকাল মাধবীলতা। খালি পিঠ, পরিষ্কার এবং ভরাট। ছেলেটা সত্যি বড় হয়ে গেল। পড়ার কথা সে বলেনি। পাটিতে গড়াগড়ি দিতে দিতে বই টেনে নিয়েছে। মাধবীলতার মনে হল ওরও কিছু দোষ আছে। আমরা কতগুলো নিয়ম নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছি রুচি এবং শোভনতার দেওয়াল দিয়ে। আমরা চাই সবাই তার মধ্যে আটকে থাকুক। অন্যথা হলেই সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল বলে ভয় পাই। কিন্তু আজ সামান্য আদর এবং স্নেহের স্পর্শ পেতেই ছেলেটার একরোখা ভাবটা চলে গেল। হয়তো সাময়িক, হয়তো আজ বিকেল পর্যন্ত এটা থাকবে কিন্তু তাও তো হল!

দরজায় শব্দ হল। বই মুড়ে রেখে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘কে?’

‘একজন ডাকছে।’ গলাটা ন্যাড়ার বলে মনে হল অর্কর। উঠে দরজার দিকে পা বাড়াতে গিয়ে সে মায়ের দিকে তাকাল। মাধবীলতার চোখ এখন তার দিকে। অনিমেষ খাটে শুয়ে রয়েছে চোখ বন্ধ করে, ঘুমোয়নি যে তা নড়াচড়ায় বোঝা যাচ্ছে। অর্কর অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে মনে হল কিলা খুরকিরা এলে ন্যাড়া ‘একজন ডাকছে’ বলত না। অতএব এই ডাকে সাড়া দেওয়া মানে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে যাওয়া নয়। সে মাধবীলতাকে বলল, ‘কে ডাকছে দেখে আসি।’

মাধবীলতা কোন কথা বলল না কিন্তু তার ঠোঁটে যে হাসি ফুটছিল তাকে কোনমতে সামলালো। অন্য সময় হলে অর্ক এই দ্বিধা দেখাতো না। দরজা খুলে অর্ক বলল, ‘কেউ নেই।’ তারপর কয়েক পা হেঁটে অনুদের বাড়ির সামনে এসে ফিরে যাচ্ছিল। শালা, হারামিরা এইভাবে ভড়কি দিয়ে মজা পায়। কিন্তু তার সঙ্গেই যে কেউ বাতেলা করতে সাহস পাবে! অর্ক চারপাশে তাকাল। ঠিক তখন অনুপমা সেজেগুজে দরজা খুলে মাটিতে পা রাখল। চোখাচোখি হতে কেমন একটা লাজুক লাজুক হাসি হেসে এগিয়ে গেল রাস্তার দিকে। ওর ছোট্ট ভাইগুলো ড্যাবডেবিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে দিদির যাওয়া দেখতে লাগল। ওপাশ থেকে ন্যাড়া চিৎকার করে উঠল, ‘তোমাদের একজন ডাকছে।’

অর্ক দেখতে পেল। একটা পাঁচিলের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে ন্যাড়া বিড়ি খাচ্ছে। খালি গা কিন্তু অশৌচের চিহ্ন রয়েছে। হঠাৎ অর্কর মনে পড়ল, ওদের মা নেই। কিন্তু অনুপমার সাজগোজ দেখে কেউ সে কথা বলবে না। অমন সেজে ও কোথায় গেল! অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায়?’

‘বাইরে, চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।’

নিমুর চায়ের দোকানের সামনে আসামাত্র ড্রাইভারটাকে চিনতে পারল অর্ক। এই লোকটাই গতরাত্রে এসেছিল। গাড়ি পাল্টে গিয়েছে কিন্তু লোক একই। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমাকে খুঁজছেন?’

মাথা নেড়ে লোকটা জানাল, সাহেব তাদের নিয়ে যাবার জন্যে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। আর বার বার বলে দিয়েছেন যেন অর্ক তার মাকে সঙ্গে নিয়ে যায়। খুব জরুরী দরকার। ফেরার জন্যে চিন্তা করতে হবে না।

অর্ক খুব অবাক হল। বাবার ছোটকাকা এত ভদ্রলোক! কিন্তু মাকে নিয়ে যেতে বলছে কি জন্যে! সে লোকটাকে দাঁড়াতে বলে পিছু ফিরছিল এমন সময় চায়ের দোকান থেকে ডাক ভেসে এল, ‘আবে অক্ক!’

এই সময় নিমুর দোকান ফাঁকা থাকে। নিমুর ছেলে চা বানাচ্ছে। পেছনের বেঞ্চিতে আধশোয়া হয়ে বিলু তার দিকে তাকিয়ে। বিলুকে দেখেই বুকের ভেতর খচ করে উঠল। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি বলছিস?’

‘এদিকে এস দোস্ত।’

অর্ক ঈষৎ বিরক্ত হয়ে দোকানে উঠে বলল, ‘তাড়াতাড়ি বল, কাজ আছে।’

‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি। গাড়িটা কার? লেকটাউনের মাগীটার?’

‘আই বিলু, মুখ সামলে কথা বল!’

‘যাঃ বাবা। এতেই দিল বাম্প করল! ওই মেয়েছেলেটাকে পেয়ে সেদিন আমাকে কি হাম্পুটাই না দিলি। ভদ্দরলোকের ছেলে ভদ্দরলোকের সঙ্গেই মিশে যায়, তাই না?’

বিলু উঠে বসল, ‘তোকে আমি দোস্ত ভেবেছিলাম।’

‘আমি তাই আছি। অনেক সময় উপায় থাকে না—।’ অর্ক ওকে শান্ত করার জন্যে বলল।

‘মাল খিঁচেছিস?’

‘কার কাছ থেকে?’

‘হাসপাতাল পার্টির কাছ থেকে।’

‘না। আমি আর যাইনি।’ তারপর জুড়ে দিল, ‘হয়তো অ্যাদ্দিনে টেঁসে গেছে।’

‘না। দিব্যি বেঁচে আছে। ওর বউটা মনে হয় খুব কান্নি খায়। আমি আজ হাসপাতালে গিয়েছিলাম তোর খোঁজে।’ বিলু হাসল।

‘আমি যাইনি সে তো দেখেছিস। যাক, আমি তোর সঙ্গে পরে দেখা করব, লোকটা দাঁড়িয়ে আছে।’ অর্কর ভাল লাগছিল না। বিলু যখন হাসপাতালে গিয়ে বিলাস সোমের খোঁজখবর নিয়েছে তখন ওকে বিশ্বাস নেই।

‘গাড়িটা কার?’

‘আমার ছোটদাদুর।’

‘আই বাপ! তারা এত বড়লোক।’

‘আমরা নই। বাবার ছোটকাকার গাড়ি ওটা। এর আগে কোনদিন দেখিনি। তুই খোঁজ নিলে দেখবি তোরও কোন না কোন আত্মীয় খুব বড়লোক কিন্তু তাতে তোর কি এসে গেল।’ অর্ক চটজলদি কথাগুলো বলে গেল।

‘দূর বে। আমার সব বড়লোক আত্মীয় পাকিস্তানে, অ্যাদ্দিনে হয়তো তারা মিয়া সাহেব হয়ে গিয়েছে। টিকিটগুলো দে।’ হাত বাড়াল বিলু।

‘কিসের টিকিট?’ বলেই মনে পড়ে গেল অর্কর। সেই সিনেমার টিকিটগুলো। কোথায় রেখেছিল সে। দুটো জায়গা তার বাছা আছে ঘরে। সে মাথা নাড়ল, ‘দিয়ে যাচ্ছি। তুই তো এখানে আছিস।’

বিলু বিস্মিত ভঙ্গী করল, ‘সেকি রে! তুই আমাকে বিশ্বাস করে ছেড়ে দিবি? যদি টিকিট ঝেড়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে যাই!’

‘সে তোর ধর্ম।’ কথাটা বলে ফিরে আসছিল অর্ক, খপ করে বিলু ওর হাত চেপে ধরল, ‘গুরু, এত বড় কথা যখন তুমি বললে তখন আর আমার কোন রাগ নেই। তোমার সঙ্গে একটা জরুরী কথা আছে। ন্যাড়ার মায়ের শ্রাদ্ধ লাগাতে হবে। কিলা চাইছে ও সেকেটারি হবে, আমি সেটা চাইছি না। তুমি হবে?’

‘কিসের সেক্রেটারি?’

‘বাঃ, চাঁদা তুলতে হবে না? ন্যাড়াদের তো পয়সা নেই। চাঁদা তুলে ফাণ্ড করতে হবে, শ্রাদ্ধের আগে চব্বিশ ঘণ্টা কীর্তন লাগাতে হবে। হেভী খরচ। কিলা সেকেটারি হলে আমরা ভোগে যাব। তুমি যদি আমার সঙ্গে হাত মেলাও তাহলে কিলাকে ফুটিয়ে দিতে পারব।’ বিলুর গলা খুব আন্তরিক।

‘ঠিক আছে, পরে কথা বলব।’

‘পরে নয়। আজ বিকেলেই মিটিং।’

‘ঠিক আছে।’

হাত ছাড়িয়ে অর্ক গলিতে ঢোকার মুহূর্তে আড়চোখে দেখল ড্রাইভারটা তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বিলুর কথা কি ওর কানে গিয়েছে? কে জানে?

খবরটা শোনামাত্র মাধবীলতা উচ্চারণ করল, ‘সেকি!’

‘হ্যাঁ। খুব জরুরী দরকার বলছে।’

‘আমার সঙ্গে আবার কি দরকার!’

‘তা জানি না। গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ড্রাইভার।’

মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল, ‘কি ব্যাপার বলো ত?’

অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘কি করে বলব। ছোটকাকাকে বোঝা খুব মুশকিল।’

‘আমি কি করব?’

‘যা ভাল বোঝ।’ অনিমেষ হাসল।

‘বাঃ, তোমার ছোটকাকা, তুমি বলবে না? তাছাড়া ওসব হোটেল মোটেলে আমার যাওয়া অভ্যেস নেই। অস্বস্তি হয়। তার চেয়ে থোকা তুই গিয়ে জেনে আয়।’ এই সমাধানটা মাধবীলতার নিজেরই ভাল লাগল।

হঠাৎ অর্কর মনে হল মায়ের সঙ্গে রাস্তায় বের হলে বেশ হয়। অনেক, অনেকদিন সে মায়ের সঙ্গে কোথাও যায়নি। আজ যখন এই রকম সুযোগ এসেছে। সে বলল, ‘কিন্তু ওঁর বোধহয় তোমার সঙ্গেই দরকার। আমি তো সঙ্গে আছি, তুমি চল।’

‘দূর পাগল। তেমন প্রয়োজন হলে তিনিই আসতেন।’ মাধবীলতা শেষ করতে চাইল।

‘না মা, তুমি চল। বেশ ঘোরা যাবে গাড়ি করে।’ আবদারে গলা অর্কর।

মাধবীলতা কৃত্রিম বিস্ময়ে অনিমেষকে বলল, ‘দ্যাখো, বুড়োধাড়ীর কাণ্ড।’

অনিমেষ বলল, ‘বলছে যখন, যাও না ঘুরেই এসো।’

‘সেকি!’

‘সেকি বলছ কেন? অনেক দিন, অনেকদিনই বা বলি কেন, কোনদিনই তো কোথাও বেড়াতে গেলে না! অর্ক সঙ্গে আছে, চিন্তা করার কিছুই নেই।’

অনিমেষের কথা শেষ হওয়ার আগেই মাধবীলতার মুখে সিঁদুর জমছিল। এত বছর ধরে শুধু ঘর দোকান আর স্কুল ছাড়া অন্য কোন জীবন যে তার নেই এটা নিজেরই খেয়াল ছিল না। অথচ অনিমেষ সেই কথাটা মনে করেছে জানতে পেরে—একে কি আনন্দ বলে, কে জানে, তাই হল। অন্যদিকে তাকিয়ে মাধবীলতা বলল, ‘তোমাকে ফেলে আমি বেড়াতে যাব, অদ্ভুত কথা।’

‘তুমি বেড়াতে যাচ্ছ ভাবছ কেন? প্রয়োজনে যাচ্ছ।’ অনিমেষ বোঝাল।

‘ছেলেমানুষী কর না।’

অর্ক বুঝতে পারছিল বাবাকে ফেলে মা যাবে না! সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘আচ্ছা মা, বাবাও তো আমাদের সঙ্গে যেতে পারে!’

মাধবীলতার যেন খেয়াল হল, ‘ও, হ্যাঁ, তাই তো! তুমি তো মোড় অবধি ক্রাচ নিয়ে হেঁটেছিলে। তুমি গেলে আমি যেতে পারি।’

মাধবীলতার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকাল অনিমেষ, ‘তুমি পাগল হয়েছ। আমার মত বিকলাঙ্গ মানুষ বাড়ির বাইরে যাবে!’

‘চমৎকার। তুমি ক্রাচ নিয়ে গলিতে গিয়ে গাড়িতে উঠবে আর হোটেলের সামনে নামবে। আমরা তো আছি।’

‘তারপর সিঁড়ি ভাঙ্গবো কি করে?’

‘সিঁড়ি ভাঙ্গতে হবে কেন? লিফট নেই? অতবড় হোটেলে লিফট না থেকে পারে? না, আর আপত্তি করো না। এত বছর ধরে তুমি তো বন্দী হয়েই আছ, আজ যখন সুযোগ এসেছে তখন আর আপত্তি করো না। আমি তো রোজ নানান কাজে বাইরে যাচ্ছি, তোমার তো তাও হয় না।’

অনিমেষ ক্রমশ বোধ করছিল আকর্ষণ তীব্র হচ্ছে। এই ঘর এবং গলিতে দিনের পর দিন আটকে থেকে সে একসময় ক্লান্ত হয়েছিল এবং এখন আর সে বোধ বেঁচে নেই বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু অর্ক এসে বলা মাত্র সে মনে মনে বিষন্ন হয়ে পড়েছিল। ছোটকাকা শুধু মাধবীলতাকে যেতে বলেছে? ওঁর তো তার কথাই আগে বলা উচিত ছিল। হয়তো ভেবেছেন সে হাঁটতে পারবে না কিন্তু ভদ্রতাও তো এটাই করতে বলে। তার মানে ছোটকাকা তাকে বাতিলের দলে ফেলে দিয়েছেন। অভিমান, এতক্ষণ যা ছিল চাপা, তা তীব্র হল, ‘উনি তোমাকে যেতে বলেছেন লতা, আমাকে নয়। তাই আমার যাওয়া অশোভন।’

মাধবীলতা বলল, ‘তুমি যে যেতে পার তা বোধহয় ওঁর মনে আসেনি।’

‘সেই জন্যেই আমার যাওয়া উচিত নয়।’

‘তাহলে তুই একা ঘুরে আয় খোকা।’

অর্ক বুঝতে পারছিল আবার পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে। সে মাথা নাড়ল, ‘তোমরা দুজনেই চল। ড্রাইভার তো ঠিকঠাক নাও বলতে পারে।’

অনিমেষ যেন চট করে কথাটা ধরল, ‘কেন, ড্রাইভার তোকে শুধু মাকে নিয়ে যেতে বলেনি? এতে ঠিক বেঠিকের কি আছে?’

‘শুধু মাকে নিয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু বলেনি।’ অর্ক সত্যি কথা বলতে পেরে খুশি হল, ‘বলেছিল মায়ের সঙ্গে খুব দরকার। তার মানে শুধু মাকে নিয়ে যেতে হবে, তা নয়।’

মাধবীলতা বলল, ‘ওই তো! তুমি মিছিমিছি ভাবছ। চল, সবাই মিলে ঘুরে আসি। তোমাদের দুজনকে নিয়ে আমি কখনও বেড়াতে যাইনি।’

মাধবীলতা যে মুখ করে তার দিকে তাকাল তা অনেকদিন দ্যাখেনি অনিমেষ। মুহূর্তেই সব অভিমানের ধুলোয় যেন ঝড়ের ছোঁয়া লাগল, ‘বেশ, যখন বলছ।’

সাদা হ্যাণ্ডলুমের পাঞ্জাবি আর পাজামা অনিমেষের পরনে। দুই বগলে ক্রাচ। এত পরিষ্কার জামাকাপড়ে আজ ওকে খুব রোগা দেখাচ্ছে। হাত দুটো শরীরের তুলনায় বড় বেশী ভারী। মাধবীলতা সাদা ব্লাউজের সঙ্গে সাদা শাড়ি মিলিয়েছে। অবশ্য পুরো সাদা নয়, মাঝে মাঝে হালকা নীলের নকশা রয়েছে। এখনও খোঁপা বেঁধে পরিষ্কার মুখে সিঁদুরে-টিপ পরলে ওকে চমৎকার দেখায়। অনিমেষ ঠাট্টা করল, ‘তোমার টিপের আঠা ঠিক আছে তো?’

‘বাঃ, এটা নতুন। কেন, খারাপ লাগছে?’

সাদা প্যান্টের ওপর লাল গেঞ্জিশার্ট পরে অর্ক চুল আঁচড়াচ্ছিল, বলল, ‘দারুণ।’

মাধবীলতা হাত তুলল, ‘ইয়ার্কি হচ্ছে মায়ের সঙ্গে, না?’

অর্ক হেসে উঠল, ‘বাঃ, তুমি সুন্দরী, এটা তো সত্যি কথা।’

‘আবার?’

‘বাবা, বলো তো। এই বস্তিতে মায়ের চেয়ে সুন্দরী আর কেউ আছে?’

অনিমেষ কিছু বলার আগেই মাধবীলতা বলল, ‘ও, তুই বুঝি এই সব দেখে বেড়াস আজকাল। অনেক গুণ হয়েছে দেখছি। চল, তোমরা বাইরে যাও, আমি আসছি।’

অনিমেষ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অর্কর পাশাপাশি ঈশ্বরপুকুর লেনে বেরিয়ে এল। অর্ক লক্ষ্য করল এখনও মোক্ষবুড়ি গলিতে বসেনি। কিন্তু আর যত বউঝি ইতস্তত ছড়িয়ে ছিল তারা অবাক হয়ে অনিমেষকে দেখছে। তাদের চোখে যে ব্যাপারটা নতুন তাই বিস্ময়ের। এর ওপর যখন মাধবীলতা খোঁপা ঘোমটায় ঢেকে ওদের পেছনে চলে এল তখন বিস্ময় আরও বাড়ল। অর্কর মনে হচ্ছিল, পাবলিক যেন সিনেমা দেখছে। মাধবীলতা বলল, ‘অত তাড়াতাড়ি পা ফেলা ঠিক নয়।’

অনিমেষ কিছু বলতে যাচ্ছিল এই সময় চিৎকারটা তীরের মত ওদের বিদ্ধ করল। আর এই প্রথম অর্কর মনে হল এই শব্দগুলো মা বাবার সামনে শোনা যায় না। চিৎকার করছিল ন্যাড়া। মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে শরীর বেঁকিয়ে শব্দগুলো ছুঁড়ছিল, ‘কোন শালা খানকির বাচ্চা তোমার দোকানে আর চা খায়, অমন চায়ের কাপে আমি—’ তার পরেই অনিমেষদের দেখতে পেয়ে যেন বাকি শব্দ গিলে ফেলল সে। ওদিকে নিমু তখন আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, ‘মেরে তোর হাড় ভেঙ্গে দেব বদমাস ছেলে। মা মরার পর বিনিপয়সায় চা দিয়েছিলাম বলে জমিদারি পেয়েছ? আজ পয়সা চেয়েছি বলে খিস্তি হচ্ছে। শালা সেদিনের মাল আজ খিস্তি করছে!’

ন্যাড়ার ছেড়ে দেওয়া শব্দগুলো কানের পর্দায় গম গম করছে। অর্ক ছুটে গিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘এই ন্যাড়া, মুখ খারাপ করবি না!’

ন্যাড়া শরীর মোচড়ালো, ‘যা বে। আমার সঙ্গে লাগলে আমি ছেড়ে দেব না।’

‘ন্যাড়া!’ রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল অর্কর। পেছন থেকে মাধবীলতার চাপা গলা সে শুনতে পেল, ‘আঃ, কি হচ্ছে!’

অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে অর্ক ওদের নিয়ে গাড়িটার সামনে চলে আসতেই ড্রাইভার দরজা খুলে দিল। অত্যন্ত সাবধানে অনিমেষকে গাড়িতে তোলা হল। দুই হাতে ভর দিয়ে পেছনের আসনে অনিমেষ ঠিকঠাক বসলে ক্রাচ দুটো তুলে দিয়ে মাকে উঠতে বলে পেছন ফিরে তাকাল। ছোটখাটো ভিড় জমেছিল সেটা যত না ন্যাড়ার বচন শুনতে তার চেয়ে এদের যাত্রা দেখতে। বিলু নেমে এসেছিল দোকান থেকে। মাকে আড়াল করে পকেট থেকে টিকিট বের করে ওর হাতে চালান করে দিল অর্ক, ‘সবগুলো আছে। তুই যা ইচ্ছে তাই করিস। আমি এর মধ্যে নেই।’ কথাটা বলেই সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসতেই ড্রাইভার ইঞ্জিন চালু করল। গাড়ি যখন ন্যাড়ার পাশ দিয়ে যাচ্ছে তখন অর্ক মুখ বের করে বলল, ‘দাঁড়াও, ফিরে আসি, তোমার হচ্ছে।’

সঙ্গে সঙ্গে মাধবীলতা বলল, ‘মানে? তুই ওকে বলার কে?’

‘বাঃ, তাই বলে তোমাদের সামনে খারাপ কথা বলবে!’

‘আমাদের তো বলছে না।’

‘কিন্তু শুনতে হচ্ছে তো। ওকে আমি শিক্ষা দেব।’

‘ঠাস করে চড় মারবো। এখন আমরা সঙ্গে আছি বলে খুব গায়ে লাগছে না? দিনরাত রকে বসে যখন ওগুলো বমি করিস তখন খেয়াল থাকে না কারো না কারো মা বোন এসব শুনছে। এখন বোঝ কেমন খারাপ লাগে। ন্যাড়াকে মারবি, তোর ওই গুণ্ডা বন্ধুদের মুখ বন্ধ করতে পারবি? কিছু বলতে হবে না ন্যাড়াকে। নিজেকে ঠিক রাখ, তাই যথেষ্ট।’

অর্ক গুম হয়ে বসেছিল। মায়ের প্রত্যেকটা কথাই যে সত্যি তা বুঝতে পেরে আরও অসহায় লাগছিল । গাড়ি তখন বেলগাছিয়া ব্রিজে উঠে এসেছে। ডান দিকে তাকিয়ে অনিমেষ বলে উঠল, ‘ওইটে কি? পরেশনাথের মন্দির, না?’

মাধবীলতা বলল, ‘হ্যাঁ।’ তার পরে হেসে বলল, ‘অ্যাই রামগরুড়ের ছানা, এদিকে তাকা।’

অর্ক গম্ভীর হতে গিয়ে হেসে ফেলল, ‘তুমি নিজেকে রামগরুড় বলছ।’

হাসিটা বিস্তারিত হল, ‘বাঃ, মাথায় বুদ্ধি আছে দেখছি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *