কাগজের কলকাতা
The ledger and the prospectus, the advertisement and the yellow journal, the world of paper, paper profits, paper achievements, paper hopes and paper lusts, the world of sudden fortunes on paper and equally grimy paper tragedies…Behold this paper city…
Lewis Mumford
.
পাণ্ডুলিপির কাল্পনিক জগৎ থেকে আমরা ছাপাখানার ‘বাস্তব’ জগতে এলাম। এ যেন গ্রাম থেকে শহরে আসা, অন্ধকার থেকে আলোয়। ছাপাখানা, ছাপা বই ও ছাপা কাগজের চাপে তমসাবৃত পাণ্ডুলিপি—যুগের ভূত—প্রেত—ব্রহ্মদৈত্যেরা মনোরাজ্যে ঘন ঘন আনাগোনা বন্ধ করল। পরম নিশ্চিন্ত পাণ্ডুলিপির রোমান্টিক পরলোক থেকে আমরা ছাপা কাগজের রিয়ালিস্টিক ইহলোকে এগিয়ে এলাম। কিন্তু পাণ্ডুলিপির অনুকরণ করেই ছাপাখানার সূত্রপাত হল। পাণ্ডুলিপির হস্তাক্ষরের মতন করে ছাপার হরফ তৈরি করা হল। ঠিক পাণ্ডুলিপির আকারে ও ধরনে বইও ছাপা শুরু হল। যেন ওরাং—ওটাং, শিম্পাঞ্জি ও গোরিলার স্তর থেকে মানুষের স্তরে আমরা উন্নীত হচ্ছি। চলার ঢঙে ও চেহারায় তার চিহ্ন রয়েছে। পাণ্ডুলিপি থেকে প্রথম যুগের ছাপাখানায় পৌঁছনোর সময় পাণ্ডুলিপির অনেক বৈশিষ্ট্য আমরা সঙ্গে করে এনেছি। পুঁথির আকারে খোলা পাতায় ‘বাংলা বই’ ছাপা কে শুরু করেছিলেন জানি না, তবে পুঁথির ধরনে ‘সংস্কৃত’ বই বোধহয় ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম ছাপাতে আরম্ভ করেন। মুদ্রাক্ষর যে হস্তাক্ষরের মতন হবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই, কারণ হস্তাক্ষর ছাড়া অক্ষরের আর দ্বিতীয় নমুনা কোথায় পাওয়া যাবে? তবে পাণ্ডুলিপির বিশেষ টানা টানা হস্তাক্ষর নকল করে প্রথম যুগে বাংলা ছাপার হরফ তৈরি করার চেষ্টা নিশ্চয়ই উল্লেখযোগ্য।
ইংরেজরা আসার অনেক আগেই পর্তুগিজরা আমাদের দেশে এসেছিলেন, সকলেই জানেন। গোয়া অঞ্চলে তাঁরা উপনিবেশ স্থাপন করেন এবং সেখানেই পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে বা ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তাঁরা ইয়োরোপ থেকে দু’টি মুদ্রাযন্ত্র নিয়ে এসে স্থাপন করেন। ১৫৫৪—৫৭ সালের মধ্যে দু’একখানি খ্রিস্টধর্মগ্রন্থ তাঁরা পর্তুগিজ ভাষায় রোমান হরফে সেই ছাপাখানা থেকে ছেপে প্রকাশ করেন। সুতরাং এই বইকেই ভারতবর্ষে ছাপা প্রথম বই বলতে হয়। ভারতবর্ষে ছাপা, কিন্তু বিদেশি ভাষায় ছাপা। ভারতীয় ভাষায় প্রথম বই ছাপা হয় কোচিনে, ১৫৭৭ সালে। একজন, স্পেনীয় পাদরি সাহেব মালয়ালম তামিল অক্ষর তৈরি করে সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ারের ‘ক্রিশ্চান ডকট্রিন’ বইয়ের অনুবাদ প্রকাশ করেন—নাম ‘ক্রীষ্ট্য বন্নকনম’। ভারতীয় ভাষায় প্রথম ছাপা বই হল ‘ক্রীষ্ট্য বন্নকনম’। ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’, বা ‘হরে কেষ্ট হরে কেষ্ট, কেষ্ট কেষ্ট হরে হরে’, করে নয়, ‘ক্রীষ্ট্য ক্রীষ্ট্য’ নাম করে আমরা এ দেশে প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছি এবং তাতে প্রথম বই ছেপেছি। বুদ্ধ, বিষ্ণু, মহেশ্বর আমাদের পাণ্ডুলিপিতেই খুশি ছিলেন। প্রথমে অবশ্য যিশুখ্রিস্ট পাণ্ডুলিপির কাছেই মাথা হেঁট করেছিলেন। ক্রুশবিদ্ধ হবার দু’এক বছরের মধ্যে সেন্ট টমাস তক্ষশিলায় গন্ডোফার্নিসের দরবারে এসেছিলেন যখন, তখন পাণ্ডুলিপির স্বর্ণযুগ। ছাপাখানা তখন স্বপ্নেরও অতীত। প্রায় দেড় হাজার বছর পরে, আকবর বাদশাহের যুগে আমরা ছাপাখানার মুখ দেখলাম, অবশ্য যিশুখ্রিস্টের কৃপায়। ভারতবর্ষে ছাপাখানা ও ছাপা বইয়ের জন্ম হল ‘কেষ্ট’ নাম করে নয়, ‘খ্রিস্ট’ নাম করে।
বাংলা দেশে ছাপাখানা ও বই ছাপা তার অনেক পরে আরম্ভ হয়। তারিখ নিয়ে বাড়াবাড়ি করে লাভ নেই। এইটুকু মনে রাখলেই হল যে, বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ১৭৭৮ সাল স্মরণীয় বৎসর, কারণ ১৭৭৮ সালে বাংলা ছাপার হরফের জন্ম হয় এবং হুগলি শহরে ছেনিকাটা বাংলা হরফে ছাপা আরম্ভ হয়। অবশ্য প্রথমে ছাপা হয় একখানি ইংরেজি বই—হলহডের A Grammar of the Bengali language, এবং এই ব্যাকরণে দৃষ্টান্তস্বরূপ কৃত্তিবাসি রামায়ণ, কাশীদাসি মহাভারত ও ভারতচন্দ্রর বিদ্যাসুন্দর থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা হয়। চার্লস উইলকিন্স এই বাংলা ছাপার হরফ তৈরি করেন এবং তাঁর সহযোগীরূপে কাজ করেন বাঙালি পঞ্চানন কর্মকার। পঞ্চানন নিজে যে বাংলা ছাপার হরফ তৈরি করেন তা উইলকিন্সের অক্ষরের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর হয়। আজও আমাদের বাংলা ছাপার অক্ষর পঞ্চানন কর্মকারের হাতে তৈরি অক্ষরের গড়ন ছেড়ে নতুন কোনো গড়ন বা ছাঁচে তৈরি হয়নি। ছাপাখানায় যাঁরা কাজ করেন বা ছাপাখানা চালান, তাঁরা অনেকেই বোধহয় এই বাঙালি কর্মকারের কথা জানেন না। যাকে আমরা আজকাল ‘টাইপ ফাউন্ড্রি’ বলি, পঞ্চাননই প্রথম সেই ফাউন্ড্রি তৈরি করেন বাংলা দেশে।
হুগলি শহরের এই প্রথম ছাপাখানার বিস্তারিত খবর কিছু জানা যায় না। তবে তার দু’বছর পরে ১৭৮০ সালে হিকি সাহেব তাঁর ‘বেঙ্গল গেজেট’ ছাপবার জন্য কলকাতা শহরে সর্বপ্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৭৮৪ সালে গ্লাডউইন সাহেব ‘দ্য ক্যালকাটা গেজেট’ প্রেস স্থাপন করেন। তারপর ‘দি অনারেবল কোম্পানিস প্রেস’, ‘দ্য ক্রনিকল প্রেস’, ‘ফেরিস এন্ড কোম্পানিস প্রেস’ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়, অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যেই। ব্যাকরণ, অভিধান, আইনের বইয়ের অনুবাদ—এই নিয়েই বাংলা ছাপাখানা ও ছাপা বইয়ের সূত্রপাত হয়। ছাপাখানা ও ছাপা বইয়ের উদ্যোক্তারা প্রায় সকলেই বিদেশি—হলহেড, ডানকান, এডমনস্টোন, ফরস্টার, আপজন ও মিলার। বাংলা ছাপাখানা ও ছাপা বইয়ের জন্য এই কয়েকজন বিদেশি সাহেবদের কাছে এবং আমাদের পঞ্চানন কর্মকারের কাছে আমরা বিশেষ ঋণী। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলা ছাপাখানা ও ছাপা বইয়ের এই ইতিহাস। পাণ্ডুলিপির আলো—আঁধারের রোমান্টিক যুগ তখনও একেবারে শেষ হয়নি। গ্রাম্য জীবন থেকে কলকাতা তখন সবেমাত্র নাগরিক জীবনে পদার্পণ করেছে। শহরের বেশে গাত্রোত্থান করছে কলকাতা। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়াতেও তাই আমরা কলকাতা শহরে পাণ্ডুলিপির বেশ প্রতিপত্তি দেখতে পাই। পেশাদার অনুলেখকরা তখনও বাড়ি—বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ছাপাখানার শব্দ তখনও কলকাতা শহরে খুব বেশি শোনা যায় না। মাটির গ্রাম থেকে ইঁট পাথরের শহর হয়ে উঠছে কলকাতা, তখনও কাগজের শহর হয়নি।
না—হওয়া আশ্চর্য নয়। কারণ যে বিদেশি সাহেবরা আমাদের দেশে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁদের দেশের শহরও অষ্টাদশ শতাব্দীতে কাগজের শহর হয়ে ওঠেনি, হতে শুরু হয়েছিল বলা চলে। যদিও উইলিয়াম ক্যাকসটন ১৪৭৭ সালে ইংলন্ডের প্রথম বই ছেপেছিলেন তাহলেও ইংরেজি ছাপাখানা ও ছাপা টাইপ ঠিক হতে আরও প্রায় তিনশো বছর লেগেছিল। তার ত্রিশ—চল্লিশ বছর আগে, ১৪৪০ থেকে ১৪৫০ সালের মধ্যে জার্মানিতে গুটেনবার্গ ছাপাখানা আবিষ্কারের পরে ছোট বই ছাপা হয়ে লোকের হাতে হাতে ঘুরতে থাকে। তাহলেও অষ্টাদশ শতাব্দীতেই আধুনিক ছাপাখানা ও ছাপার হরফের জন্ম বললে ভুল হয় না। বড় বড় ইংরেজ হরফ নির্মাতা এই সময় জন্মগ্রহণ করেন—ক্যাসলন, বাস্কারভিল জন বেল প্রভৃতি। এঁদের প্রত্যেকের নামে টাইপের নাম আজও আছে—ক্যাসলন টাইপ, বাস্কারভিল টাইপ ইত্যাদি। ১৭৩৪ সালে ক্যাসলন, ১৭৫০ সালে বাস্কারভিল নতুন টাইপ ডিজাইন তৈরি করেন। জন বেল অনেক পুরনো ইংরেজি ছাপার হরফ সংস্কার করেন। যেমন ইংরেজি পুরনো ‘এস’ (৪) অনেকটা লম্বা ‘এফ’ (f)—এর মতন ছিল। ইংরেজ আমলের ভারতীয় ইতিহাসের মূলগ্রন্থ (হলওয়েল, বোল্টস প্রভৃতি) যা এই সময় ছাপা হয়েছিল, তা—ও সব ওই পুরনো অক্ষরে ছাপা, পড়তে খুব অসুবিধা হয়। বেল সাহেব এইসব টাইপ সংস্কার করেন এবং বই ছাপার ডিজাইনও বদলান। ১৭৮৫ সালে তিনি তাঁর নতুন অক্ষর দিয়ে শেক্সপিয়রের গ্রন্থাবলির একটি সংস্করণ ছাপেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর এইসব সংস্কার ও আবিষ্কারের পর থেকেই ইংলন্ডে ছাপাখানার স্বর্ণযুগ আসে এবং বড় বড় শহর ক্রমে কাগজের শহরে পরিণত হতে থাকে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে।*
ইংলন্ডেরই যখন এই অবস্থা তখন আমাদের দেশে কলকাতা শহরে বাড়ি—বাড়ি ঘুরে যে দু’চারজন বৈষ্ণবী অনুলেখিকা পাণ্ডুলিপি কপি করে জীবিকা অর্জন করবেন, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। রামমোহন থেকে বিদ্যাসাগরের যুগ পর্যন্ত আমরা এই পাণ্ডুলিপি অনুলিখনের সংবাদ পাই, তারপর আর বিশেষ পাই না। অবশ্য রামমোহনের যুগ থেকে ছাপা শুরু হয়েছে, রীতিমতো না হলেও সবে শুরু হয়েছে। রামমোহন রায় যেটুকু প্রত্যক্ষ সামাজিক আন্দোলন করেছিলেন, তা—ও করা সম্ভব হত না, যদি না ছাপাখানা থাকত এবং বই ছাপা হত। ১৮১৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর তখনকার ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায় :
‘কলিকাতার শ্রীযুক্ত রামমোহন রায় সহমরণের বিষয়ে এক কেতাব করিয়া সর্বত্র প্রকাশ করিয়াছেন। তাহাতে অনেক লিখিয়াছে কিন্তু স্থূল এই লিখিয়াছে যে, সহমরণের বিষয় যথার্থ বিচার করিলে শাস্ত্রে কিছু পাওয়া যায় না।’
১৮১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর আর একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় :
‘সম্প্রতি মোং কলিকাতাতে শ্রীযুক্ত বাবু রামমোহন রায় পুনর্বার সহমরণ বিষয়ক বাঙ্গালা ভাষায় এক পুস্তক করিয়াছেন এখন তাহার ইংরেজি হইতেছে সেও শীঘ্র সমাপ্ত হইবেক।’
সহমরণ বিষয়ে বইগুলি যদি এইভাবে রামমোহনের পক্ষে ছাপিয়ে প্রকাশ ও প্রচার করা সম্ভব না হত, তাহলে তিনি তার বিরুদ্ধে কোনো সামাজিক আন্দোলন করতে পারতেন না, এবং সহমরণ প্রথা বন্ধ করাও ওই সময় সম্ভব হত না। বৈষ্ণবী অনুলেখিকাদের দিয়ে পাণ্ডুলিপি কপি করিয়ে কোনো সামাজিক আন্দোলন করা যায় না। পাণ্ডুলিপির যুগের সামাজিক আন্দোলন তাই অন্য উপায়ে ধর্মান্দোলনের ভিতর দিয়ে করতে হয়েছে এবং তা—ও কালেভদ্রে হয়েছে, খুব বেশি করা সম্ভব হয়নি। বিদ্যাসাগরের যুগের সামাজিক আন্দোলন যে অনেক বেশি জোরালো হয়ে ওঠে, তার অন্যতম কারণ এই ছাপাখানার বিস্তার এবং ছাপা বই ও পত্রিকার প্রচলন।
১৮২৪—২৫ সালে কলকাতা শহরে বিভিন্ন ছাপাখানায় ছাপা যেসব বইয়ের তালিকা সমসাময়িক পত্রিকায় দেখা যায়, তার মধ্যে অভিধান, ব্যাকরণ ও ধর্মগ্রন্থই প্রধান, তা—ও সংখ্যায় কুড়ি—বাইশখানা মাত্র। ছাপাখানার মধ্যে এই নামগুলি পাওয়া যায় :
‘কলুটোলায় চন্দ্রিকা যন্ত্রালয়
বহুবাজারে শ্রীলেবেণ্ডর সাহেবের ছাপাখানা
মির্জাপুরে সম্বাদ তিমিরনাশক ছাপাখানা
শাঁখারিটোলায় মহেন্দ্রলাল ছাপাখানা
মির্জাপুরে মুন্সী হেদাতুল্লার ছাপাখানা
আর্পুলির ছাপাখানা’
এরপর আরও পঁচিশ—তিরিশ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝির মধ্যে আরও অনেক ছাপাখানা স্থাপিত হয় এবং বটতলার ছাপাখানাও জাঁকিয়ে বসে। বটতলার প্রেস ও বটতলার স্বর্ণযুগও হল ১৮৪০ থেকে ১৮৭০ সাল। এই বটতলার অভিযানের সময় বোধহয় কলকাতা শহরের পেশাদার বৈষ্ণবী কপিস্টরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেন। গলিতনখদন্ত ছাপা, ‘শবল কাবল ভূষি ভূষি সে কাবল’ (সকল কারণ তুমি, তুমি সে কারণ) গোছের ছাপা হলেও, বটতলার ছাপা পাণ্ডুলিপির সমর্থক ও পেশাদার কপিস্টদের কাছে নাইটমেয়ারের মতন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কপি করতে বসলেই বোষ্টমি লেখিকারা হয়তো বটতলার ছাপাখানার দুঃস্বপ্ন দেখতেন। কারণ বড়তলার ছাপাখানার টাইপ যা—ই হোক, ছাপা যা—ই দাঁড়াক, তার দুঃসাহসের তুলনা হয় না। যে—কোনো বই হোক, চৈতন্যচরিতামৃত থেকে আজয়েব ছোলেমানি কাব্য পর্যন্ত, বটতলার প্রকাশকরা তা ছাপাখানায় ছেপে প্রকাশ করতেন। ছাপাখানার প্রথম যুগে আমাদের দেশের বড় বড় ধনী জমিদাররা অনেকে যে তার বিরোধিতা করেছিলেন, তারও প্রমাণ পাওয়া যায়। অর্থাৎ সাধারণ লোকের মধ্যে বিদ্যা ও জ্ঞান বিতরণ করতে তাঁদের আপত্তি ছিল, তা ছাড়া গোঁড়ামিও ছিল। ধর্মগ্রন্থ ছাপা হবে, এ তাঁরা ভাবতেও পারতেন না। তাই তাঁরা পাল্লা দিতে আরম্ভ করেছিলেন প্রেসের সঙ্গে। দলবদ্ধ হয়ে তাঁরা পেশাদার অনুলেখকদের দিয়ে ধর্মগ্রন্থ কপি করিয়ে দান করতে আরম্ভ করলেন। হঠাৎ এই সময় বোষ্টম—বোষ্টমি কপিস্টদের কিছু রোজগার বাড়ল বটে, কিন্তু পাল্লা দেওয়া সম্ভব হল না। বটতলার প্রকাশকদের অভিযানের সামনে জমিদারের পাণ্ডুলিপির ষড়যন্ত্র টিকল না। বটতলার জয় হল, তথা ছাপাখানার ও লোকসাধারণের।
বটতলার যুগের আগে কলকাতা শহরে বইয়ের দোকানও যে বিশেষ ছিল তা মনে হয় না। তার আগের প্রায় সমস্ত ছাপা বইয়ের বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, প্রকাশক বা গ্রন্থকার ক্রেতাদের কোনো বাড়ি থেকে বই কিনে আনতে অনুরোধ করছেন। যেমন: ‘ছয় তঙ্কা মূল্যে যাহার লইবার বাঞ্ছা হয় তবে মোং উত্তরপাড়ার শ্রীযুত দুর্গাচরণ মহাশয়ের বাটীতে অথবা মোং কলিকাতার শ্রীযুত দেওয়ান রামমোহন রায় মহাশয়ের সৈসোয়িটী অর্থাৎ আত্মীয় সভাতে চেষ্টা করিলে পাইবেন…’ (১৮১৮)। ‘যে মহাশয়ের লইবার বাসনা হইবে তিনি মোং কলিকাতায় শ্রীগঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের আপীসে কিংবা মোং শ্রীরামপুরের কাছারি বাটীর নিকটে শ্রীজান দেরোজারু সাহেবের বাটীতে তত্ত্ব করিলে পাইতে পারিবেন’ (১৮১৮)। ‘যে মহাশয়দিগের ঐ পুস্তক লইতে মানস হইবেক তাঁহারা মোং কলিকাতার জোড়াসাঁকোর পূর্বে জোড়া পুখুরিয়ার নিকট শ্রীযুত জয়কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাটীতে উপস্থিত হইয়া লইবেন। প্রতি পুস্তকের মূল্য জেলেদ সমেত লইলে ৪।।০ সাড়ে চারি টাকা দিতে হইবেক জেলেদ সমেত না লয়েন চারি টাকা দিলে পুস্তক পাইবেন।’
পরিষ্কার বোঝা যায়, বইয়ের দোকান তখনও চালু হয়নি কলকাতায়। প্রধান কারণ, পাঠকসংখ্যা এবং ছাপা বইয়ের সংখ্যাও এমন হয়নি বা বাড়েনি যে তা—ই নিয়ে ব্যবসায়ের জন্য দোকান খোলা যেতে পারে। যেসব ‘মহাশয়ে পুস্তক লইতে মানস’ হত, তাঁরা শ্রীরামপুর—উত্তরপাড়া পর্যন্ত দেরোজারু সাহেবের বাড়িতেও গিয়ে নিয়ে আসতেন। তাঁদের সংখ্যা খুব কম, হাতে গোনা যায়। মনে হয়, বটতলার যুগ থেকেই কলকাতা শহরে বইয়ের দোকান প্রথম চালু হতে থাকে—তা—ও চিৎপুর অঞ্চলে ও চীনাবাজারের, কলেজ স্কোয়্যারে নয়। গোলদিঘি তখনও গ্রন্থতীর্থ হয়নি।
.
বটতলার স্বর্ণযুগ থেকে কলেজ স্ট্রিটের স্বর্ণযুগ পর্যন্ত প্রায় একশো বছরের ইতিহাস। এই একশো বছরের মধ্যে কলকাতা শহর ধীরে ধীরে কাগজের শহরে পরিণত হয়েছে। আধুনিক মার্কিন শহরের দিকে চেয়ে বিখ্যাত সমাজবিরোধী লুইস মামফোর্ড যে কথা বলেছেন, আধুনিক কলকাতা শহরকেও নিঃসন্দেহে তা—ই বলা যায়। ইট—পাথরের কংক্রিটের কলকাতা শহরকে আজ কাগজের শহরই বলা উচিত। কারণ, ইটপাথর—কংক্রিটের দেয়ালও আজ ছাপা পোস্টার প্ল্যাকার্ড হ্যান্ডবিল বিজ্ঞাপন ইস্তেহারে আচ্ছাদিত। ছাপাখানার এ—ও এক আশ্চর্য কীর্তি। ছাপাখানার দৌলতে আমরা মানুষের চিন্তাধারাকে যেমন মুক্ত করেছি, তেমনি এক বিচিত্র ‘কাগজেও কালচার’ও সৃষ্টি করেছি। আমাদের এই আধুনিক কলকাতা কালচারকে বলা যায় কাগজের কালচার। ঘুম ভেঙে ছাপা খবরের কাগজ থেকে দিনের শুরু হয়, সারাদিন ছাপানো বই, কাগজ, ফাইল, চিঠি, স্মারকলিপি, ইস্তেহার বিবৃতির মধ্যে কেটে যায়, রাত্রেও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাগজের স্বপ্ন দেখি—কাগজের তাড়া তাড়া নোট, চমৎকার ছাপা কাগজের সব ক্যাশ—সার্টিফিকেট, বন্ড, শেয়ার—সার্টিফিকেট ইত্যাদি। কাগজের স্বপ্ন দেখতে দেখতে ভোর হয়, খবরের কাগজ বুকে করে উঠে বসি। যা কিছু চিন্তা করি কাগজে, যা কিছু বলি সবই কাগজে। স্বপ্ন, ভালবাসা, প্রেম, প্রতিশ্রুতি, আশা—আকাঙ্ক্ষা, কামনা, বাসনা সবই আজ ছাপা কাগজে রূপান্তরিত। মৃত্যুর পরেও কাগজের ছাপা অক্ষরে অমরত্ব লাভ করি, কাগজের অমরত্ব। মনে হয় এত কাগজ, এত বই, এত সংবাদপত্র, পত্রিকা, এত রেকর্ড, রিপোর্ট, চিঠিপত্র, বিবৃতি, ম্যানিফেস্টো, এত ফাইলের স্তূপ, কাগজের পাহাড়—এর স্থান হবে কোথায় শহরে? সমস্ত ছাপা কাগজ হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ টন ছাপা কাগজ যদি আবর্জনাস্তূপে পরিণত হয়ে আবার নতুন কাগজ তৈরির কাঁচামাল না হত, তাহলে এতদিনে আমরা কাগজের স্তূপের তলায় সমাধিস্থ হয়ে যেতাম। এই হল ‘কাগজ দর্শন’ বা ‘পেপার ফিলোজফি’—অর্থাৎ কর্মজীবনের ভূমিকা শেষ করে ভস্ম হয়ে উৎসমূলে ফিরে যাওয়া এবং নতুন কাগজ তৈরি হয়ে এসে আবার ছাপার বিচিত্র বেশ ধারণ করা। তারপর আবার আবর্জনা, আবার কাঁচামাল, আবার সাদা কাগজ। ছাপা কাগজ যদি সাদা কাগজ না হয়ে যেত, তাহলে এতদিনে এই কাগজের সভ্যতায়, কাগজের কলকাতা শহরে, আমরা কাগজের তলায় চাপা পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতাম। কাগজের কলকাতার ‘কাগজ কালচার’—এর বিশেষত্ব এইখানে, কাগজি বিশেষত্ব। শহর কলকাতার দিকে চেয়ে তাই মামফোর্ডের মতন বলতে ইচ্ছা হয়,
‘Behold this paper city!’।
.
* এ বিষয়ে যাঁরা বিস্তারিত ইতিহাস জানতে চান, তাঁরা আমার ‘জনসভার সাহিত্য’ গ্রন্থ পাঠ করতে পারেন।