কলকাতা ও শহরতলির বিচিত্র হাট-বাজার-বিপণি
কথায় বলে তিনশো বছরের কলকাতা। কলোনির বয়স সত্যিই তিনশোর বেশি না কম এ নিয়ে অহেতুক বিতর্কে ঢুকছি না। সেটা আমার প্রতিবেদনের বিষয়ও নয়। যেটা বলতে চাইছি— মোগল সাম্রাজ্যের পতন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতের শাসনভার গ্রহণ— ঠিক এই সময়টা দেশের মূল শহরগুলির মানচিত্র কলকাতাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। পরবর্তীতে দেশের রাজধানী দিল্লি থেকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করেন তদানীন্তন ব্রিটিশ শাসকবর্গ। তখন থেকেই ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কলকাতাতেও গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক কল-কারখানা। এ শহরটা বরাবরই শ্বেতাঙ্গ মহাপ্রভুদের অত্যন্ত পছন্দের জায়গা ছিল। অচিরেই তাঁরা কলকাতাকে ‘মিনিয়েচার লন্ডন’-এর চেহারা দিতে উঠে পড়ে লাগেন। এর ফলে কলকাতা ও তার চারপাশ ঘিরে গজিয়ে উঠতে থাকে অসংখ্য দোকান-বাজার-হাট। ব্রিটিশ শাসন অন্তে, কালগ্রাসে এর বহু কিছু হারিয়ে গেলেও টিকে রয়েছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান, এখনও। তার মধ্যে বিচিত্র কয়েকটির প্রসঙ্গ অবতারণা করব এই না-গল্পে। ভাল অথবা মন্দ লাগা পাঠকের বিচার্য।
হাট বসেছে শুক্রবারে
বালিগঞ্জ পদ্মাপারে নয়, খোদ কলকাতার বুকেই। বেহালা চৌরাস্তার মোড় থেকে বাস অথবা অটোয় মিনিট সাতেকের রাস্তা সরকার হাট সরশুনা মেইন রোডে। পিন কোড, আজ্ঞে হ্যাঁ— কলকাতা একষট্টি। বাসস্টপের নামকরণও হাটের নামেই। প্রতি শুক্রবার বিকেলে নিয়মিত বসে এই হাট। পত্তনি: ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বড়িশার জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পরিবারের আমলে এবং প্রত্যক্ষ সহায়তায়। হাটের বাইরেটা মনিহারি-প্রসাধনী দ্রব্য ও টুকিটাকি জিনিসপত্রের দোকান দিয়ে ঘেরা। এর মাঝখানে যে-কোনও গলি দিয়ে সেঁধিয়ে গেলেই হাটের মাঠ। ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে, হাঁকডাকে জমজমাট। ঠিকমত তাক করে চোখ চালালে হাতের নাগালে পেয়ে যাবেন সব এক্সক্লুসিভ পসরা। হিঞ্চে শাক, রস-টুসটুসে কামরাঙা, আঁশফল, ঢেঁকিশাক, তিলের খাজা, জাল লাগানো ঝুড়িতে খলবল করা চিতি কাঁকড়া (গা-মাখা মাখা ঝোলে কষিয়ে রাঁধতে পারলে এক কথায় সুপারলেটিভ!), ছোট কাচের বাক্সে বুড়ির চুল (সাহেবি কেতায় ‘ক্যান্ডিফ্লস’), বেতের বোনা ধামাকুলো, মাটির রাধাকৃষ্ণ— এ রকম আরও অনেক ম্যাজিক্যাল ক্রিয়েশন, যার নাগাল পায়নি শপিংমল-ফুডবাজার-স্পেন্সার্সের দল। কেনাকাটা করুন প্রাণ খুলে বেরিয়ে আসার আগে মাথায় টালির চাল আর জং-ধরা টিনের দরজা লাগানো কাতুবাবুর দোকানে একবার ঢুঁ মারতে ভুলবেন না। এই সব পেয়েছির দেশ অথবা দোকানে এখনও পাওয়া যায় কাঠের লাট্টু-লেত্তি, কাচের মার্বেল গুলি, রাঙাদিদি তরল আলতা, লক্ষ্মীর পাঁচালি, গোপাল ভাঁড়, মেয়েদের ব্রতকথা। বিকিকিনির ধকলে পেটে টান ধরলে পাশের মদনমোহন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের গরম কচুরি-তরকারি আর কমলাভোগ তো আছেই। হেলথ কনসাসরা নয় খনিজ জলের বোতলটা বাইরে থেকেই কিনে নেবেন।
পোষ্য পসরা
এও এক হাট তবে চরিত্রটা অন্যরকম। ‘আলপিন টু এলিফ্যান্টের’ পসরা এ হাটে বসে না। বসে পোষ্যের পসরা নিয়ে। আগে বসত উত্তর কলকাতা হাতিবাগানে। বর্তমান স্থান পরিবর্তিত হয়ে কিলোমিটার দেড়েক দূরে খালধারে, গ্যালিফ স্ট্রিটের ফুটপাথে, বছর দশেক হল। হাতিবাগান-গ্যালিফ স্ট্রিট ধরে এ হাটের বয়সও একশো ছুঁই ছুঁই। বসে রবিবার। কাকভোর থেকে বেলা দুটো আড়াইটে। বাড়িতে যা কিছু পোষেন অথবা পুষতে চান সব পাবেন এখানে। পাবেন পায়রা-হাঁস-মুরগি থেকে শুরু করে লাভবার্ড-বদ্রিকা-ককাটেল ফিঞ্চ এরকম আরও অজস্র নাম-না-জানা বিদেশি পাখি। খরগোশ-গিনিপিগ-সাদা ইঁদুর। খাঁচার ভিতর থেকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকা কুকুর-ছানার দল। স্পিত্জ, লাসা, জার্মান শেপার্ড, ডালমেশিয়ান… দেখলেই কিনতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু একটু সাবধানে। অনভিজ্ঞ খদ্দের বুঝলে গাবলু গুবলু নেড়ির বাচ্চাকে জার্মান শেপার্ড (অ্যালসেশিয়ান) বলে চালিয়ে দিতে এই বিক্রেতাদের জুড়ি নেই। এখান থেকে মাছের লাইনে ঢুকে পড়ার পর মনে পড়েই যেতে পারে ষাট দশকের সেই গান— ‘লাল নীল সবুজের মেলা বসেছে।’ চোখধাঁধানো রুপোলি রাজকীয় ‘অ্যাঞ্জেল’, রক্তলাল ‘সোর্ডটেল’, সোনালি-কমলা রঙের ‘গোল্ডফিশ’— ল্যাজটা রানির মাথায় দোলানো চামরের মতো, রামধনু রঙের ‘কোবরা গাপ্পি’… কাকে ছেড়ে কার কথা বলব। হাটের একেবারে শেষপ্রান্তে ক্যাকটাস থেকে রেডিমেড বনসাই হয়ে গোলাপ-গাঁদা-চিনে জবা… সব রকম ফুল ও ফলের পসরা সাজিয়ে বসেন বৃক্ষ ব্যাপারীর দল। এ ছাড়াও গাছ-মাছ-পশুপাখি পুষতে যা যা আনুষঙ্গিক উপকরণ লাগে সব পাবেন এখানে। কলকাতা ও তার আশেপাশে এই একই ধরনের হাট বসে গড়িয়া ব্রিজের কাছে বোড়াল রোড, বাইপাসের ধারে বানতলা আর আক্রা সন্তোষপুরের ব্যানার্জি হাটে— সোম, বুধ ও বৃহস্পতিবারে। সময় দুপুর দেড়টা থেকে বিকেল পাঁচটা। তবে গ্যালিফ স্ট্রিটের তুলনায় অর্থনৈতিক লেনদেন বা আয়তনে এগুলি নিতান্তই ছোট। তা সে ছোট হোক বা বড়— অদ্ভুত-সুন্দর-সজীব-রঙিন এই সব হাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে বেড়ালেও চোখ মন ভরে যায়। শুধু দুঃখ লাগে যখন দেখি এই একই জায়গায় অবাধে বিক্রি হচ্ছে টিয়া-চন্দনা-ময়না-ফুলটুসি-মুনিয়া-নেউল-কাঠবেড়ালী ছোট কচ্ছপ এমনকী শিকরে বাজের (স্প্যারো হক) মতো বিপন্ন এবং বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির প্রাণী যা ধরা, মারা, বিক্রি ভারতীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। প্রশাসন দেখে-শুনে নির্বিকার। নিয়ম মেনে ‘রুটিন রেইড’ করতে হয় করে বন দপ্তর। কিন্তু অবস্থা যে তিমিরে সেই তিমিরে। নিত্যদিন খবরের কাগজ-টিভি-ব্যানার-হোর্ডিং-এ এ নিয়ে যত জ্ঞানগর্ভ বাণী শুনি তার কণামাত্রও কাজে প্রতিফলিত হলে সুন্দরতর হয়ে উঠত এই সব সুন্দর না-মানুষী হাট। এটা প্রতিবেদকের বিশ্বাস।
অ্যান্টিক ফুটপাথ অথবা ‘যেখানে দেখিবে ছাই’…
মধ্য কলকাতায় রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড ধরে হাজি মহম্মদ মহসীন স্কোয়্যারের দিকটায় কখনও গেছেন সন্ধেবেলা? স্থানীয় নাম গোলতালাও। গেলে দেখবেন গোলতালাওয়ের ঠিক উলটো দিকে মার্কুইস স্ট্রিটের ফুটপাথে বসেছে অ্যান্টিক বাজার। এ লাইনের শৌখিন বা রসিক হলে পেয়ে যেতে পারেন উনিশশো তিন সালের দুষ্প্রাপ্য ওয়াইনের খালি বোতল, পেতলের দোয়াতদানি, হ্যামার মাস্টারের ব্রেড টোস্টার, ফরাসি ইজেল, বেলজিয়াম কাট গ্লাসের মদিরা পাত্র… আরও অনেক অনেক সব ‘অমূল্য রতন’। যেমন পেয়ে গেছিলেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষ, গহরজান বাইজির গানের রেকর্ড মাত্র সাড়ে সাত টাকায় সেই সত্তর দশকে। আফশোস একটাই, এই ‘অফিসিয়াল কোক’ আর ‘নাথিং অফিসিয়াল পেপসি’ সময়ে খুব দ্রুত ডাইনোসরে পরিণত হচ্ছেন শৌখিন সংগ্রাহক ক্রেতাকুল। ফলে সংকুচিত হতে হতে প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে মার্কুইস স্ট্রিটের অ্যান্টিক বাজার। এ আক্ষেপ রাখার জায়গা কই।
বাস্তুহারার খুকি…
ফুটপাথের ওপর উপুড় হয়ে বসে ফ্রক বাছছিলেন বৃদ্ধা। অল্প-বিস্তর ছেঁড়া-তালি মারা— রিফু করা আর অবশ্যই, পুরনো কাপড়ের ডাঁই থেকে। অনেক বেছেবুছে কিনলেন একটা। বিস্তর দরদাম করে। আঠেরো টাকায়। বছর পাঁচেকের নাতনির জন্য। দিদিমার পাশেই বসে। পাওয়ার আনন্দ-উত্তেজনায় ধকধক করছে চোখ। পুরনো জামাকাপড়ের ফুটপাথ বাজার। বসে কাকভোরে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ে লিবার্টি সিনেমার ফুটপাথে। শহর ঠিকঠাক ব্যস্ত হয়ে ওঠার আগে বাজার সাফ। পুরনো জামাকাপড় ছাড়াও বিক্রি হয় ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো— কেজি দরে। কিলো প্রতি তিন টাকা, নাকি কারখানায় মেশিনপত্র পোঁছার কাজে লাগে। দিদিমার নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম, হামিদা বেগম। সাকিন— আমহার্স্ট স্ট্রিট মাড়োয়ারি হাসপাতালের সামনে পলিথিন টাঙানো ফুটপাথের ঘর। মেয়ে পাঁচ বাবুর বাড়ি কাজ করে ফুরসত পায় না। জামাই পালিয়েছে বছর দুই হল। কেনাকাটা সেরে চলে যাচ্ছিলেন নাতনির হাত ধরে। সে তো নাচতে নাচতে চলেছে। মুখে বিশ্বজয়ের হাসি, যে হাসি দেখলে ‘সূর্য লজ্জা পায়।’ সেই কবে নাগরিক কবিয়াল লিখেছিলেন— ‘বাস্তুহারার খুকি মেটায় খেলার সাধ/ ঘাস উঠে যাওয়া ধূসর পার্কে শিশুর সাম্যবাদ।’ আমি নিশ্চিত নই সাম্যবাদ আসবে কিনা। কিন্তু যার কিড-জি নেই, কার্টুন নেটওয়ার্ক নেই, নেই কমপ্ল্যান গার্ল হওয়ার ন্যূনতম সুযোগ, নেই ডি পি এস-লা মার্টস— সেই খুকি খেলার সাধ অন্তত পুরনো ফ্রকে মেটাতে পারছে। থ্যাঙ্কস ফুটপাথ বাজার।
বটতলা, ক্ষীরের চপ আর নটি বিনোদিনী
বটতলা, বটতলার সাহিত্য-সাহিত্য করে হেদিয়ে মরেন নস্ট্যালজিক বাঙালি। ‘এখন আর নেই… এক্কেবারে হারিয়ে গেছে।’ এরকম কত কথাই তো শুনি গুণীজনের মুখে-গদ্যে-সাহিত্যে-প্রবন্ধে-সেমিনারে। এই প্রতিবেদক কিন্তু উলটো কথা বলছে। এখনও আছে বটতলা, বটতলার বই। রবীন্দ্র সরণি-নিমতলা ঘাট রোডের মোড় থেকে ট্রামলাইন ধরে সোজা বি কে পাল অ্যাভেন্যুর দিকে এগোলে হাতের বাঁ ফুটে ‘শাঁখা দিও না ভেঙে’, ‘বস্তির মেয়ে রাধা’, ‘রোগা স্বামীর দারোগা বউ’-এর হোর্ডিং-পোস্টার-ব্যানার সম্বলিত চিৎপুর যাত্রাপাড়া আর ঠিক তার উলটো ফুটেই গোটা তিনেক বইয়ের দোকান। এখনও পাওয়া যায়— ‘পতি পরম গুরু’ (বইয়ের প্রচ্ছদ: স্বামী খড়ম দিয়ে পেটাচ্ছে, রক্তাক্ত পতিব্রতা স্ত্রী তবু স্বামীর পা ধরে আছে), ‘রতিশাস্ত্র’, ‘বশীকরণ তন্ত্রসার’, ‘হরিদাসীর গুপ্তকথা’, ‘পঞ্চমুন্ডির আসন’, ‘ভূত পেত্নী শাকচুন্নি’, গোপাল ভাঁড়, গুপ্তপ্রেস-বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত-পি এম বাগচীর পঞ্জিকা আর অসংখ্য যাত্রাপালার বই। কিছু সংগ্রহ করার থাকলে করে ফেলুন তারপর আবার ফিরে আসুন মোড়ের মাথায়। ট্রামলাইন ধরে পেরিয়ে নিমতলা ঘাট স্ট্রিট ধরে এগোলে মিটার বিশেক দূরে হাতের বাঁদিকে ছোট্ট দোকান। কাচ লাগানো কাঠের শোকেস। বারকোশে সাজানো ক্ষীরের চপ, মালপোয়া, লবঙ্গলতিকা, গুটকে কচুরি, খেতে কেমন? কোনও কথা হবে না। দোকান থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্ব রামবাগান। কলকাতার প্রাচীনতম নিষিদ্ধপল্লী। দোকানের দুই মধ্যবয়সী মালকিনের মধ্যে একজনের কাছে জেনেছিলাম নটি বিনোদিনী, মানদাসুন্দরী দাসীদের মতো কিংবদন্তী শিল্পীদের অত্যন্ত প্রিয় ছিল এ দোকানের খাবার। চার পুরুষ ধরে চলে আসছে দোকানটি। আমি বলি কী একবার ঘুরে আসুন। ‘হরিদাসীর গুপ্তকথা’ কিনুন আর নাই কিনুন। ক্ষীরের চপ খান অথবা নাই খান— ইতিহাসকে তো ছুঁয়ে আসা যাবে।
নান কিং থেকে চৈনিক প্রাতরাশ
বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট থেকে টেরিটি বাজার। শরদিন্দুর ব্যোমকেশ বা জীবনানন্দের কবিতায় বারবার উঠে এসেছে এ এলাকা। চিনে পাড়া, সারি সারি জুতোর দোকান, চাইনিজ ডেন্টাল ক্লিনিক। এ এক অন্য কলকাতা। পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিনারাও অনেকে এ জায়গা ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন ট্যাংরা চায়না টাউন, হংকং, তাইওয়ান। তবু যাঁরা এখনও টিকে আছেন তাঁরাই জমিয়ে রেখেছেন ব্রেকফাস্ট বাজার। টেরিটি বাজারের উলটো ফুটে পোদ্দার কোর্টের ঠিক পিছনে। রোজ ভোর পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটা থেকে চালু হয়ে গুটোতে গুটোতে সাড়ে সাত আট, দু-তিন ঘণ্টার এই হাটে, ফুটপাথের ওপর রঙিন ছাতার নীচে বা খোলা আকাশের তলায় বিক্রি হচ্ছে গরম ধোঁয়া-ওঠা চিকেন-ফিশ-পর্ক স্যুপ। কন্টেনারে ভাপ ছাড়ানো মোমো, পর্ক ডাম্পলিঙ, চিকেন বান, সুইন কর্ন আর এক্লেয়ার নুডল স্যুপ। ভয়ংকর সুস্বাদু আর অবিশ্বাস্য রকম সস্তা। এখান থেকে দু’কুড়ি গজ দূরে কলকাতার আরও দুই ল্যান্ডমার্ক— পও চং আর নান কিং। প্রথমটি সসের দোকান। সস না বলে চিনা রান্নায় যা যা লাগে সেই সমস্ত রকম উপকরণ বিপণি বলাই ভাল। বয়স দেড়শো ছুঁই ছুঁই। এ দোকানে পাওয়া যায় চিলি-গার্লিক-টোম্যাটো সস আর পিউরি, চাইনিজ কুকিং ওয়াইন ও হার্বস… আরও অজস্র নাম না-জানা চিনা রান্নার উপকরণ। পও চংয়ের উলটো ফুটে একটু দূরেই ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে নান কিং। শহরের প্রথম চিনে রেস্তোরাঁ। যখন গড়পড়তা বাঙালি গণহারে চাউমিন-চিলিচিকেন খেতে শেখেনি। এলাকারই এক প্রবীণ সহনাগরিক হংম্যান বলছিলেন ঠাকুর পরিবারের অনেকেরই প্রিয় খাবার জায়গা ছিল এই নান কিং। লাল রঙের চিনা স্থাপত্যের বাড়ি। এখন ভগ্নপ্রায়। জানলা-দরজা খসে গেছে। শেষ দেখেছিলাম টিন দিয়ে ঘিরে ফেলা হচ্ছে এই ঐতিহাসিক সৌধ। শুনেছিলাম হাইরাইজ উঠবে। শহরের অনেক বাড়িকেই তো দেখি আজকাল ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত স্থানের মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে সেরকম একটা কিছু ভেবে দেখা যায় না কি? সরকার বাহাদুর কী বলেন?
সুর-সরণি
ওয়েলিংটন অধুনা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার থেকে ধর্মতলার দিকে গেছে লেনিন সরণি। আমি বলতাম সুর-সরণি। আজ আর বলি না। কারণ বছর পনেরো আগেও রাস্তার দু’পাশে ছিল সারি সারি রেকর্ডের দোকান। হার্ডবোর্ড কভারের মধ্যে রেকর্ডবন্দি প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়-মহম্মদ রফি-ন্যাট কিংকোল-শ্যামল মিত্র-এলভিস-বিটল্স্-গাইড-জুয়েল থিফ-ফুলেশ্বরী, আবা, ভেঞ্চারস… বাবার কেনা ফিলিপস ফাইভ থার্টি থ্রি রেকর্ড প্লেয়ারটার রসদ জোগান দিতে কতবার ফিরে ফিরে গেছি সুর সরণিতে। তারপর তো বাজারে এল ক্যাসেট-সিডি-ডিভিডি। দাঁত বসিয়ে দিল রেকর্ডের ঘাড়ে। জ্বালা সামলাতে বন্ধ হয়ে গেল একের পর এক দোকান। পুরো বেসুরো হয়ে গেল লেনিন থুড়ি সুর সরণি। দিন কয়েক আগে একবার গিয়েছিলাম ওই চত্বরে। মাত্র দুটি দোকান টিমটিম করে টিকে আছে এখনও। কথা হচ্ছিল ইউসুফ ভাইয়ের সঙ্গে। দুটি দোকানের একটির মালিক। কত রেকর্ড কিনেছি এই দোকানে…. গীতা দত্ত… মেরা নাম জোকার… বড়লোকের বিটি লো… সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়… নীল ডায়মন্ডস ডাবল অ্যালবাম… ‘ওহ দিন অওর নহী রহা বেটা। আব চালিশ রুপিয়া কা ডিভিডি মে পাঁচশো গানা শুননে কো মিলতা। কওন আয়েগা মেরা পাস।’ বলছিলেন সত্তর-পঁচাত্তরের ইউসুফ ভাই। শূন্য দৃষ্টি, সামনে ঘোর অন্ধকার। তবু কীসের এক কুহক মায়ায় আজও দোকান খোলেন নিয়ম করে। এরপর আর কথা হয় না। চলে এসেছিলাম। কানে বাজছিল— ‘ওহ দিন অওর নেহী রহা…।’
চোরবাজার
পার্ক সার্কাস, মল্লিকবাজার আর শেয়ালদা বউবাজারের মোড়ে। পুরনো শার্ট-প্যান্ট-ঘড়ি-জুতো-কাঠের ফার্নিচার— এরকম আরও অনেক বিকিকিনির পসরা নিয়ে এ বাজার। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে যৌবনের অনেকটা স্মৃতি। আজও টাটকা। সেটা সত্তরের শেষ। আশি আসব-আসব করছে। সবাই বেকার তখন। পকেটমানির অবস্থা শোচনীয়। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ, গানস অফ ন্যাভারোন আর শোলে তো সে কথা শুনবে না। অগত্যা ভরসা বন্ধুদের একজন। ধনী ব্যারিস্টারের সন্তান। বাড়িতে প্রচুর শার্ট-প্যান্ট। সব ব্র্যান্ডেড, নামী কোম্পানির— ডাবল বুল, চিরাগ দিন। যে সময়ের কথা বলছি তখনও বেয়ার, অ্যালান সলি, ভ্যান হিউজেনরা মার্কেটে খেলতে নামেনি। সে যাই হোক দুপুরবেলা বন্ধুর বাবা কোর্টে। মা ভাতঘুম। সুযোগ বুঝে গোটা পাঁচেক শার্ট-প্যান্ট আলমারি থেকে হাতিয়ে নিয়েই চলো পানসি চোরবাজার। প্রায়ান্ধকার, গলিতে গলিতে অল্প পাওয়ারের বাল্ব জ্বলা সব দোকান। শোকেসে শার্ট-প্যান্ট-পালিশ করা পুরনো জুতো-ঘড়ি, এইচ এম টি-শিকো (দলের এক অভিজ্ঞ সদস্যের মতে ওগুলো সব টানা অর্থাৎ চুরির মাল)। ওখানকার সব মালই চোরাই কিনা জানি না তবে আমাদেরগুলো যে চৌর্যবৃত্তির দ্বারা সংগৃহীত সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই। ফ্রিকোয়েন্ট সাপ্লায়ার হওয়ার ফলে দামও দিত মন্দ না। শার্ট পিছু পঁচিশ থেকে তিরিশ। প্যান্ট চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ। সে বড় সস্তা গন্ডার বাজার ছিল। গ্লোব নিউ এম্পায়ারে ফ্রন্ট স্টল পঁচাত্তর পয়সা। নিজামের রোল এক টাকা কুড়ি। গোল্ডেন ঈগল বিয়ার সাড়ে সাত টাকা। ময়দানে ফুটবলের টিকিট সত্তর পয়সা। ফলে ব্যাবসাপাতি সেরে বাজার থেকে বেরিয়ে আমরাই কে আর বিড়লাই বা কে?… আজ চিরাগ দিন-ডাবল বুল নেই, নেই সেই বন্ধুদের অভিযান। চোরবাজার কিন্তু আজও রয়ে গেছে এক উদ্দাম সময়ের নীরব সাক্ষী হয়ে।
ঋণ স্বীকার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবির সুমন, নিখিলচন্দ্র সেন প্রণীত ‘ব্যায়লার কথা’ আর অন্তর্জাল।