কলকাতার প্রাচীন চিত্র
এশিয়ায় প্রসারণমুখী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যর প্রাণকেন্দ্র উদীয়মান কলকাতা শহরে, অষ্টাদশ শতাব্দীর চতুর্থ পর্ব থেকেই, বিদেশি চিত্রশিল্পীরা আসতে আরম্ভ করেন। উদ্দেশ্য, বিশুদ্ধ শিল্পচর্চা নয়, ছবি এঁকে কিছু অর্থ উপার্জন করা। শিল্পীদের মধ্যে সকলেই প্রায় ‘পোর্টেট’ ও ‘ল্যাণ্ডস্কেপ’ পেইন্টার। কয়েকজন শিল্পীর কথা উইলিয়াম হিকি তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন যেমন তরুণী ইহুদী শিল্পী ইসাক (১৭৭৮), টমাস হিকি (১৭৮৪), খুড়ো-ভাইপো টমাস ও উইলিয়াম ড্যানিয়েল (১৭৮৬-৮৭), জর্জ চিনারি (১৮০৭-৮) এঁরা প্রধানত বিখ্যাত ইংরেজ পুরুষ-মহিলাদের মূর্তিচিত্র আঁকতেন। কলকাতার এদেশীয় নব্যধনিকরাও অনেকে এঁদের দিয়ে মূর্তিচিত্র আঁকিয়েছেন।
কলকাতার পথঘাট বাড়িঘর ইত্যাদির দৃশ্য যাঁরা এঁকেছেন তাঁদের মধ্যে টমাস ড্যানিয়েল (Thomas Daniell), চার্লস ডয়িলি (Charles Doyly), উইলিয়াম হজেস (William Hodges), জেমস বেইলি ফ্রেজার (James Baillee Fraser),উইলিয়াম উড (William Wood), অন্যতম। ড্যানিয়েল বারোটি কলকাতার ছবি এঁকেছিলেন (১৭৮৬-১৭৯৮), তার মধ্যে কয়েকটি ছবি এই গ্রন্থে মুদ্রিত হয়েছে। অন্যান্য ছবির মধ্যে সুপ্রীম কোর্ট, মেয়র্স কোর্ট ও রাইটার্স বিলডিং, সেন্ট জনস চার্চ প্রভৃতি উল্লেখ্য। অষ্টাদশ শতাব্দীর কলকাতার চিত্র টমাস ড্যানিয়েল ও উইলিয়াম হজেস এঁকেছেন বেশি (হজেসের একটি ছবি এই গ্রন্থের ১ম খণ্ডে মুদ্রিত হয়েছে) এবং ছবিগুলির মধ্যে কেবল চিৎপুর এসপ্ল্যানেড চৌরঙ্গি প্রভৃতির আঞ্চলিক দৃশ্য নয়, তদানীন্তন কলকাতার প্রাত্যহিক জীবনধারা, লোকজন, পথঘাট, এমনকি পশুপাখির পর্যন্ত পরিচয় পাওয়া যায়।
উনিশ শতকের কলকাতার ছবির মধ্যে চার্লস ডয়িলি (একটি ছবি এই গ্রন্থের ১ম খণ্ডে মুদ্রিত), ফ্রেজার (একটি ছবি ১ম খণ্ডে মুদ্রিত)ও উডের ছবি উল্লেখ্য। ডয়িলির ছবির মধ্যে ধর্মতলার গির্জা, সেন্ট পলস গির্জা, চড়ক পূজার শোভাযাত্রা, কিউ স্ট্রীট থেকে সদর বোর্ড অফ রেভিনিউর আফিস, এসপ্লানেড থেকে চৌরঙ্গি ইত্যাদির তৎকালের পরিচয় পাওয়া যায়। ফ্রেজারও এসপ্লানেড, টাউনহল, সেন্ট জনস চার্চ, সেন্ট অ্যানড্রুজ চার্চ, চাঁদপাল ঘাট, ট্যাঙ্ক স্কয়ার গবর্ণমেন্ট হাউস, বোটানিকাল গার্ডেনস প্রভৃতির ছবি এঁকেছেন। শিল্পী উডের Twenty-eight Engravings of Calcutta (১৮৩১) কলকাতার আঞ্চলিক চিত্রের দিক থেকে উল্লেখ্য এইজন্য যে এই চিত্রাবলীর মধ্যে ১৮২০-৩০-এর কলকাতার বাবুঘাট থেকে ধর্মতলা চৌরঙ্গি এবং সেখান থেকে পি.জি. হাসপাতাল পর্যন্ত রাস্তাঘাট ও বাড়িঘরের দৃশ্য দেখা যায়। সলভিনস (Balt Solvyns) নামে একজন বিখ্যাত শিল্পী আঠার শতকের শেষ দশকে কলকাতার আসেন এবং এদেশের নানারকমের লোকজনেরও উৎসব-পার্বনের ছবি আঁকেন। তাঁর এই ছবিগুলি Les Hindous, 1807-12, চিত্রগ্রন্থে সংকলিত হয়। সলভিনসের একটি ছবি ‘সরকারবাবু’ এই গ্রন্থের ১ম খণ্ডে মুদ্রিত হয়েছে।
কিন্তু বিদেশি শিল্পীদের আঁকা দৃশ্যচিত্রগুলির একটা বড় ত্রুটি হল, এগুলির অধিকাংশই ইংরেজপল্লীর মধ্যে সীমাবদ্ধ, চৌরঙ্গি, এসপ্ল্যানেড, ট্র্যাঙ্ক স্কয়ার, সার্কুলার রোড ইত্যাদি হল অন্যতম বিষয়বস্তু। কয়েকটি মাত্র চিৎপুর অঞ্চলের (যেমন ড্যানিয়েলের) ছবি ছাড়া, স্থানীয় এদেশীয় লোকজনের বসতি অঞ্চলের কোনো ছবি বিদেশি শিল্পীরা আঁকেননি বলা চলে। না আঁকার একটি বড় কারণ এই হতে পারে যে তাঁরা কলকাতা শহর বলতে ‘White twon’ মনে করতেন, ‘Black town’ কে কলকাতা বলে গণ্য করতেন না। যদি তাঁরা এদেশীয় সাধারণ মানুষের বসতি অঞ্চল, এমন কি উদীয়মান ও প্রতিষ্ঠিত নব্যধনিকদের ঘরবাড়িসহ পরিপার্শ্বের চিত্র কিছু আঁকতেন, তাহলে ছবি হিসেবে তার সমাদর ছাড়াও সামাজিক ইতিহাসের প্রাথমিক উপাদান হিসাবে সেগুলি গণ্য হত। দুঃখের বিষয় তা তাঁরা আঁকেন নি। তাই তাঁদের ছবিগুলি থেকে কলকাতা শহরের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় না, একটা খণ্ডিত অসম্পূর্ণ চিত্র পাওয়া যায় মাত্র। স্বভাবতঃই এই ছবিগুলি দেখে ইয়োরোপ ইংলণ্ডের শ্বেতাঙ্গরা মনে করতেন, ইংরেজ শাসকরা কত কীর্তিমান এবং তাঁদের কীর্তির চেয়েও তাঁরা মহৎ, কারণ তা না হলে সাত সমুদ্র তের নদী পারের এই কলকাতাতে তাঁরা এমন অনুপম প্রাসাদপুরী করে গড়ে তুলতেন না এবং বিদেশি শিল্পীরা সকলে তার একঘেয়ে চিত্র এমনভাবে আঁকতেন না।
একথা সত্য যে কলকাতা ‘প্রাসাদপুরী’। কিন্তু তার চেয়েও বৃহত্তর ঐতিহাসিক সত্য হল কলকাতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনকালের ঔপনিবেশিক শহর এবং এদেশের ক্রীতদাস থেকে আরম্ভ করে গৃহভৃত্য ও কুলিমজুরদের কুৎসিত বস্তিবহুল যমপুরী। এই যমপুরীর বাসিন্দাদের কথা, অন্যান্য বহুবিধ বিষয়ের সঙ্গে, এই গ্রন্থে সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে, যদিও সেকালের শিল্পীরা রঙতুলির সাহায্যে তার চিত্র আঁকেননি।