১৬. কবি লোক পাঠিয়ে রাণুকে আনিয়েছেন

এবারেও কবি লোক পাঠিয়ে রাণুকে আনিয়েছেন কাশী থেকে। তার বাড়ির আর কেউ আসেনি।

রথী ও প্রতিমা তো যাবেই, কন্যা মীরাকেও সঙ্গে নিলেন কবি। জামাইটি মীরাকে কষ্ট দিচ্ছে। কোনও জামাইয়ের কাছ থেকেই জীবনে শান্তি পেলেন না কবি।।

রথী ও প্রতিমার এতদিন সন্তানাদি হয়নি বলে তারা একটি গুজরাতি শিশু কন্যাকে দত্তক নিয়েছে, তার নাম দেওয়া হয়েছে পুপে। মীরার মেয়ে বুড়িও সঙ্গে আছে এবং একজন ম্যানেজার। তাই গৌহাটি থেকে নেওয়া হল দুটো গাড়ি।

কবির গাড়িতে রাণুর স্থান সব সময় কবির পাশে।

সমতল ছাড়িয়ে গিরিপথের দুধারের শোভা বড় মনোরম। ভল্লুক বর্ণ মেঘ খেলা করছে ছোট ছোট পাহাড় শিখরে। কখনও রৌদ্র, কখনও ছায়ায় গাছগুলি বিভিন্ন রকমের সবুজ। পার্বত্য মানুষদের পোশাকে অনেক রকম রং, বাঙালিদের মতন সাদামাটা নয়। ফুটফুটে চেহারার কিশোর-কিশোরীরা মধু ভরা কলসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিক্রির আশায়।

রাণু হঠাৎ বলে উঠল, ওই দেখো না গিরির শিরে, মেঘ করেছে। গগন ঘিরে— আর করো না দেরি–

কবি বললেন, তোমার এটা মনে পড়ল? আমার যেটা মনে পড়ছে, তার সঙ্গে এখানকার প্রাকৃতিক কোনও যোগ নেই। কাজ থেকে ছুটি পেয়েছি, মানুষের ভিড় থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছি, তাই হঠাৎ মনে পড়ছে পুরনো একটা কবিতা। তুমি এটা পড়েছ? কর্ম যখন দেস্তা হয়ে জুড়ে বসে পূজার বেদি, মন্দিরে তার পাষাণ-প্রাচীর অভ্রভেদী চতুর্দিকেই থাকে ঘিরে; তারই মধ্যে জীবন যখন শুকিয়ে আসে ধীরে ধীরে, পায় না আলো, পায় না বাতাস, পাব না ফাঁকা, পায় না কোনো রস, কেবল টাকা, কেবল সে পায় যশ… তারপর কী যেন, ঠিক মনে পড়ছে না। একটু পরে আছে, সংগোপনে বহন করে কর্মরথে, সমারোহে চলতেছিলেম নিষ্ফলতার মরুপথে। তিনটে চারটে সভা ছিল জুড়ে আমার কাঁধ; দৈনিকে আর সাপ্তাহিকে ছাড়তে হতো নকল সিংহনাদ…

রাণু খিলখিল করে হেসে ফেলে বলল, তুমি নিজেকে নিয়ে খুব মজা করো ভানুদাদা! নকলসিংহনাদ! তারপর কী?

কবি বললেন, মিটিং হলে আমি হতেম বক্তা; রিপোর্ট লিখতে হত তক্তা তক্তা–

রাণু আরও হেসে গড়িয়ে পড়ল কবির কাঁধে।

কবি বললেন, মাথায় একটা নতুন লেখা গজগজ করছে। এখানে মিটিং নেই, আর কোনও কাজ নেই, মানুষজনের ভিড় নেই, শুধু লিখব আর গান গাইব।

রাণু বলল, আর?

কবি বললেন, আর হ্যাঁ, শ্ৰীমতী রাণু দেবীর সঙ্গে গল্প করব। অনেক গল্প।

তা অবশ্য হয় না। খ্যাতিমান মানুষদের পক্ষে নির্জনতা অতি দুর্লভ! কবি শিলং এসেছেন, সে খবর রটে গেলে মানুষ ভিড় করে দেখতে আসবে না? সভা সমিতি হবে না?

রথী খুব কঠোরভাবে নিয়ম করে দিয়েছে, সকাল, দুপুর আর সন্ধের পর কবির কাছে কোনও দর্শনার্থী আসতে দেওয়া হবে না, শুধু বিকেলের দু’ঘণ্টা তাদের জন্য বরাদ্দ।

নৈশ ভোজের আমন্ত্রণ গ্রহণ করা হবেনা, চা-পানের জন্য কোথাও কোথাও যাওয়া যেতে পারে।

 

বাড়িটিতে ঘরগুলি আকারে বেশ বড় বড়, কিন্তু ঘরের সংখ্যা বেশি নয়। অনেকগুলি চওড়া বারান্দা। দোতলায় সবচেয়ে প্রশস্ত কক্ষটি সাজানো হয়েছে কবির জন্য, পাশেরটি বৈঠকখানা। রাণু আর সকন্যা মীরা বারান্দার এক ধারের ঘরে, অন্য ধারের ঘরটিতে রথী ও প্রতিমা। বাচ্চাদুটি যাতে বারান্দায় হুটোপুটি না করে, সেই জন্য তাদের সবসময় সামলায় আয়া, একতলায় সরকারবাবু ও পাচক-ভৃত্যেরা।

কবির ঘরের একদিকে চওড়া পালঙ্ক, অন্যদিকে, জানলার কাছে লেখার টেবিল। সঙ্গে একটি ঝুল বারান্দা, সেখানে দাঁড়ালে দেখা যায় বাগান। এ বাড়ির চারদিকেই বাগান, আর সে বাগান পাইন গাছ দিয়ে ঘেরা। পাইন গাছগুলির ওপর দিয়ে একটু একটু পাহাড় দেখা যায়। বাগানে ফুলের অন্ত নেই।

রাণু বাগানে ঘুরে বেড়ায় আর অন্য সময় কবির ঘরেই থাকে। কবি যখন লেখায় নিমগ্ন হয়ে থাকেন, কথা বলেন না, রাণু তখন শুয়ে থাকে পালঙ্কে। কবি বাইরে কোথাও গেলেও এই ঘরটিতে থাকতেই তার ভাল লাগে।

রথী ও প্রতিমা এরকম দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু মীরার চোখে লাগে।

এক দুপুরে কবি গেছেন পাশের বাড়িটিতে, সেখানে থাকেন ময়ূরভঞ্জের মহারানি সুচারু দেবী। কেশব সেনের এই কন্যাটি কবির পূর্ব পরিচিত। রাণু যায়নি, সে শুয়ে আছে কবির খাটে।

মীরা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, ও কী রাণু, কী করছিস?

মীরার কণ্ঠে ভসনার সুর, কিন্তু রাণু কী দোষ করেছে বুঝতে পারল না।

মীরা বললেন, বড় হচ্ছিস, সেটা বুঝি খেয়াল থাকে না?

বড় হওয়াটাই কি তবে দোষের কিংবা সেটা সবসময় খেয়াল রাখতে হবে?

সে উঠে বসে সরল ভাবে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মীরাপিসি?

মীরা এবার রীতিমতো বিরক্ত ভাবে বলল, পুরুষ মানুষের বিছানায় ওভাবে শুতে হয়!

পুরুষ মানুষ? কবি পুরুষ মানুষ? পৃথিবীর সব মানুষ একদিকে, আর কবি অন্য দিকে। তিনি তো ভানুদাদা। কখনও ভানুদাদা এই খাটে শুয়ে থাকলেও রাণু তার পাশে শুয়ে কত কথা বলে যায়।

মীরা বলল, বাবামশাই লেখার সময় কাছাকাছি কেউ থাকুক, তা পছন্দ করেন না। উঠে আয়, ওখান থেকে উঠে আয়।

বড়দের কথার অবাধ্য হতে শেখেনি রাণু। সে উঠে চলে এল অন্য ঘরে। মুখ গোঁজ করে বসে রইল। তার কান্না এসে যাচ্ছে, মীরাপিসি তা দেখতে পেলে যদি আরও রাগ করে, তাই সে একখানা বই তুলে আড়াল করল মুখ।।

খানিক বাদে সিঁড়িতে পদশব্দ শুনে বোঝা গেল কবি ফিরেছেন।

আরও কিছুক্ষণ পর কবির উদাত্ত গলায় ডাক শোনা গেল, রাণু। রাণু কোথায় গেলে?

সে ডাক শুনে রাণু তাকাল মীরার দিকে।

মীরা অপলক ভাবে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে বলল, যা—।

রাণুকে দেখে কবি জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় ছিলে?

কারুর নামে নালিশ করতে নেই, তাই রাণু বলল, এই, এখানেই …

কবি বললেন, এই লেখাটা আমাকে এমন পেয়ে বসেছে, ফিরেই লিখতে বসে গেছি। হঠাৎ একসময় মনে হল, ঘরটা যেন বেশি ফাঁকা লাগছে, কী যেন নেই, গন্ধটাও অন্যরকম …

কবির চেয়ারের পেছনে এসে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে রাণু জিজ্ঞেস করল, তুমি এখন কী লিখছ ভানুদাদা?

কবি কলমটা নামিয়ে রেখে রাণুর দিকে ফিরে বললেন, অনেক অনেকদিন আগে, যখন তোমার এই ভানুদাদা ছিল ভানু সিংহ, তখন কিছু লিখতে বসলে কখনও কখনও নতুন বউঠান আমার পেছনটিতে এসে দাঁড়িয়ে ঠিক এইরকম ভাবে জিজ্ঞেস করতেন। এখন কী লিখছ তুমি? সেই দিনগুলি কি ফিরে এল? রাণু, এই লেখাটার জন্য তোমার কাছাকাছি থাকা যেন বেশি বেশি দরকার। এক একবার তোমার মুখখানা দেখি, আর অনেক কিছু মনে পড়ে যায়। এটা একটা নাটক।

রাণু বলল, নাটক? সেই যেটা লিখবে বলেছিলে? কী নাম দিয়েছ?

কবি বললেন, যক্ষপুরী, পরে হয়তো বদলেও যেতে পারে।

রাণু বলল, আমায় যে পার্টটা দেবে, সেটা বড় করে লিখবে কিন্তু!

কবি সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, তুমিই তো এই নাটকের প্রাণ। তুমি হিরোইন। তোমাকে নিয়েই লিখছি।

রাণু ভুরু তুলে বলল, আমাকে নিয়ে? জ্যান্ত মানুষদের নিয়ে বুঝি কিছু লেখা যায়?

কবি বললেন, লেখার মানুষগুলো যেমন জ্যান্ত হয়ে পড়ে, তেমনি জ্যান্ত মানুষেরাও লেখার মধ্যে চিরকালীন হয়ে যায়।

রাণু বলল, আমায় একটু পড়ে শোনাবে?

কবি বললেন, শোনাব। আরও কয়েক পৃষ্ঠা লেখা হোক। তোমার নাম দিয়েছি নন্দিনী। কেমন, পছন্দ?

রাণু ঘাড় কাত করে বলল, হ্যাঁ, এ নামটাও সুন্দর। সে কি কোনও রাজার নন্দিনী?

কবি বললেন, না, সে আকাশের। সে আলোর। সে মুক্ত বাতাসের। এই পৃথিবীতে যত কিছু সুন্দর, সে সব কিছুর নন্দিনী।

রাণু বলল, একদিন তোমার এই লেখা সারা পৃথিবীর মানুষ পড়বে। সবার আগে আমি তোমাকে সেই লেখাটা লিখতে দেখছি, আমার কী ভাল যে লাগছে!

কবি বললেন, তোমার সেই ভাল লাগাটা আমাকে স্পর্শ করে দাও!

বিকেল হলে দীনেশ সেনের বাড়ির ছেলেমেয়েরা রাণুকে ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য ডেকে নিয়ে যায়।

বাগান থেকে নানারকম ফুল তুলে নিয়ে রাণু কবিকে এনে দেখায়। রাণু অনেক ফুলের নাম জানে না, কবি সব ফুল চেনেন। জীবনে কত ফুল নিয়ে যে গান ও কবিতা লিখেছেন!

সেদিন সন্ধেবেলা রাণুর হাতে হলুদ রঙের এক জাতীয় ফুল দেখে তিনি বললেন, এটা কী ফুল বলো! ড্যাফোডিল, এ ফুল নিয়ে একটি বিখ্যাত ইংরিজি কবিতা আছে, জানো?

রাণু শুধু বাংলা নয়, ইংরিজি কবিতা পড়ে। সে বলল, ড্যাফোডিল এই ফুল বুঝি? কবিতাটা জানি, ওয়ার্ডসওয়ার্থের :

I wandered lonely as a cloud
That floats on high o’er vales and hills
When all at once I saw a crowd
A host, of golden daffodils…

শুনতে শুনতেই কবির মধ্যে শিক্ষক সত্তাটি জেগে উঠল। তিনি যে শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের ইংরিজি কাব্য পড়ান।

তিনি বললেন, কবিতাটির কী বৈশিষ্ট্য বল তো? ওয়ার্ডসওয়ার্থ, যিনি প্রকৃতির কবি হিসেবেই বিদিত, তিনি প্রকৃতি বর্ণনার মধ্যে অনিলেন অভিনবত্ব, প্রকৃতির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করলেন নিজেকে, I wondered lonely as a cloud… অর্থাৎ নৈর্ব্যক্তিক ভাবে দেখা নয়, কবি দাঁড়িয়ে আছেন প্রকৃতির মধ্যে। এবং শেষ ছত্রগুলি আরও বিস্ময়কর। এই প্রথম একজন কবি স্পষ্ট ভাষায় বললেন, প্রকৃতির মধ্যে থাকলেই প্রকৃতিকে পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করা যায় না। তা দেখতে হয় কল্পনার চোখ দিয়ে। শেষের লাইনগুলি ঠিক মনে পড়ছে, সেই যে কবি যখন একটা চেয়ারে বসে আছেন, কিছুদিন পরের কথা–

রাণু বলল, আমার মনে আছে :
For oft, when on my couch I lie
In vacant or in pensive mood,
They flash upon that inward eye
Which is the bliss of solitude
And then my heart with pleasure fills
And dances with the daffodils.

কবি বললেন, বাঃ, বেশ মুখস্থ করেছ তো। ওই যে বললেন, ইনওয়ার্ড আই, ভেতরের চোখ, ওই চোখ দিয়েই সত্য রূপ দেখা যায়।

রাণু বলল, ভানুদাদা, তুমি যখন শান্তিনিকেতনে পড়াও, আমি কখনও তোমার ক্লাসে বেশিক্ষণ বসিনি, অন্যদের সঙ্গে বসতে আমার ভাল লাগে না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, কী ভুল করেছি। তুমি কত সহজ করে বোঝাও, কত কী শিখতে পারতাম।

কবি বললেন, তোমাকে একা পড়াতেও আমার ভাল লাগবে। রসো, আগে এই নাটকটি শেষ করে নিই।

পরের দিন রাণু নিয়ে এল আর একরকম ফুল।

কবি রীতিমতো চমকে উঠে বললেন, এ কী, এ যে রক্তকরবী।

রাণু বলল, হ্যাঁ, একজন বলল। অনেক ফুটেছে। এই ফুল নিয়ে কোনও কবিতা নেই?

কবি বললেন, ইংরেজিতে কিছু আছে কি না জানি না। বাংলা কোনও লেখায় একসময় হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে।

রাণু বলল, ভাবছি, এই ফুলগুলো দিয়ে একটা মালা গাঁথব।

কবি বললেন, হ্যাঁ, মালা গেঁথে রেখে দাও। যাকে তাকে দিও না, রঞ্জনকে দিতে হবে।

রাণু বুঝতে না পেরে বলল, রঞ্জন? রঞ্জন কে?

কবি বললেন, সে আসবে, তার জন্য প্রতীক্ষায় থাকতে হয়।

কয়েকদিন পর মাঝ রাতেও রাণুর ঘুম এল না।

এক এক রাতে এমন হয়, ঘুম যেন নিরুদ্দেশে চলে যায়।

পাশের খাটে মীরা তার মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ আগে, রাণুর চোখ দুটি সম্পূর্ণ খোলা।

এ ঘরে মস্ত একটা দেয়ালঘড়ি আছে। তার পেণ্ডুলামের টিক টিক শব্দ যেন বড় বেশি শব্দ করছে।

ঘড়ির আওয়াজ বড় অদ্ভুত। দিনের অধিকাংশ সময়, এমনকী রাত্তিরেও তার আওয়াজ যেন খেয়ালই করা যায় না। আবার ঘুম না এলে মনে হয়, এই শব্দ আর সব কিছু ছাপিয়ে গেছে।

বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় ছটফট করার পর রাণু উঠে পড়ল। দাঁড়াল গিয়ে সামনের দিকের ঝুল বারান্দায়। তার অঙ্গে ঢোলা রাত-পোশাক।

সন্ধের পর খুব একচোট বৃষ্টি হয়েছে। এখন আকাশ নির্মেঘ। জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে বাগান। কোথাও কোনও শব্দ নেই। এ যেন আদিম পৃথিবীর রূপ। পাইন গাছগুলি দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের প্রহরীর মতো। বাগানের ফুলগুলি এখন আলাদা করে চেনা যায় না, শুধু পাওয়া যাচ্ছে একটা মিশ্রিত সুগন্ধ।

রাণু দেখল, কবির ঘরে এখনও বাতি জ্বলছে।

রাত তো কম হল না, দুটো-তিনটে হবেই। কবি এখনও লিখে চলেছেন? এমন করলে মানুষের শরীর টেকে?

পা টিপে টিপে রাণু চলে এল কবির ঘরের দরজার কাছে। ভেজানো দরজা, একটু ঠেলতেই খুলে গেল।

ঘরের দুদিকে জ্বলছে দুটো বাতি। লেখার টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছেন কবি। ঝরনা কলমটা খসে পড়ে গেছে নীচে।

রাণু নিঃশব্দে এসে কলমটা তুলে নিয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাকল, ভানুদাদা!

তিনবার ডাকের পরেই কবি সচকিত ভাবে মুখ তুলে বললেন, কে? ও, রাণু, এসো।

রাণু বলল, রাত অনেক হয়েছে, তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে। এমন ভাবে ঘুমোলে ঘাড় ব্যথা হয়ে যাবে যে। তুমি বিছানায় গিয়ে শোও। ওঠো, ওঠো।

কবি বললেন, ঠিক ঘুমিয়ে পড়িনি। আধা ঘুম আর আধো জাগরণের মধ্যে ছিলাম। এই অবস্থাটা বেশ মজার, অনেক কিছু দেখতে ও শুনতে পাওয়া যায়। আমি নাটকটার অনেক না-লেখা সংলাপ চরিত্রগুলির মুখ দিয়ে শুনতে পাচ্ছিলাম।

রাণু বলল, তা হোক, তবু তুমি এবার শুয়ে পড়ো।

কবি বললেন, হবে, হবে, শোওয়া তো আর পালাচ্ছে না। তুমি একটু বসো তো চুপটি করে। একটা গান শুনবে?

কবির চোখেমুখে ক্লান্তির চিহ্নমাত্র নেই।

রাণু সম্মতি জানাতেই তিনি গান ধরলেন :

তোমায় গান শোনাব, তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখো
ওগো ঘুম ভাঙানিয়া।
বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাকো,
ওগো দুখ জাগানিয়া।
এলো আঁধার ঘিরে
পাখি এল নীড়ে
তরী এল তীরে,
শুধু আমার হিয়া বিরাম পায় নাকো
ওগো দুখজাগানিয়া…

কবি একটু থামতেই রাণু বলল, দুখজাগানিয়া? শুনতে কেমন যেন লাগছে। দুঃখকে কি কেউ জাগায়?

কবি বললেন, তেমন দুঃখ তো পাওনি! বিশ্ববিধাতা তোমাকে তেমন দুঃখ যেন না দেন … তবু অনেক দুঃখে মানুষ পবিত্র হয়। নন্দিনীও বিশু পাগলকে জিজ্ঞেস করেছে, তুমি আমাকে বলছ দুখজাগানিয়া?

রাণু বলল, বিশুপাগল কে?

কবি বললেন, পরে বলছি। বাকিটা শোনো। তুমি যখন বাগানে খেলছিলে, আমি দেখছিলাম অলিন্দে দাঁড়িয়ে, তখনই মনে এল গানটা :

আমার কাজের মাঝে মাঝে
কান্না হাসির দোলা তুমি থামতে দিলে না যে।
আমার পরশ করে
প্রাণ সুধায় ভরে
তুমি যাও যে সরে
বুঝি আমার ব্যথার আড়ালেতে দাঁড়িয়ে থাকো
ওগো দুখ জাগানিয়া

গান শেষ হবার পরে দু’জনেই স্তব্ধ। কেটে যেতে লাগল পল, অনুপল।

তারপর রাণু বলল, ভানুদাদা। তবু আমি দুখজাগানিয়া কথাটার মর্ম বুঝতে পারছি না। আমি যে তোমার তুলনায় কত সামান্য।

কবি বললেন, না রাণু, তুমি সামান্য নও। হয়তো তুমি বুঝতেই পারো না, কতখানি মাধুর্য তুমি আমাকে দাও!

রাণু বলল, আমি আর কী দিই। আমি তো পাই। সাত রাজার ঐশ্বর্যের চেয়েও বেশি। আমি কি বুঝি না যে তুমি কত বড়, কত ব্যস্ত, কত কাজের মানুষ। তবু যে তুমি আমার ছেলেমানুষি সহ্য করো–

কবি রাণুর হাত ধরে বললেন, তুমি যে তুমিই ওগো, সেই তব ঋণ। আর কেউ বুঝবে না। তোমার ভালবাসা আমার কাছে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কারের চেয়েও বেশি।

রাণুর ভেতরে যে আচ্ছন্নতার ভাব এসেছিল, সেটা কাটিয়ে দিয়ে সে আবার উচ্ছল গলায় বলল, আ হা হা, এরপর চিন জাপান কিংবা কামস্কাটকা থেকে নেমন্তন্ন এলেই তুমি আবার উধাও হয়ে যাবে। কতদিনের জন্য কে জানে।।

কবি বললেন, তা হয়তো যাব। তবু তুমি থাকবে। তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম। রাণু, তুমি আমাকে নতুন বউঠানের স্মৃতি ফিরিয়ে দিয়েছ। আমি আবার সেই বয়েসের উৎসাহে মেতে উঠেছি।

রাণু বলল, ভানুদাদা, তুমি আমাকে অন্য কারুর সঙ্গে তুলনা করবে। আমি রাণু। তোমার নতুন বউঠানকে আমি চিনি না।

কবি বললেন, তা ঠিক। তুলনা করা উচিত নয়। থাক তবে ওসব কথা। এসো, তোমাকে নাটকটার কিছু অংশ পড়ে শোনাই। এইখান থেকে, নন্দিনী বলছে, বিশু পাগল, তুমি আমাকে বলছ দুখজাগানিয়া?

বিশুপাগল : তুমি আমার সমুদ্রের অগম পারের কি দূতী …

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *