১৬. ঐন্দ্রিলাকে চিঠি দিয়েছিলেন শ্যামা

পৌষ ফাগুনের পালা – দ্বিতীয় খণ্ড

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

অনেক আশা করে ঐন্দ্রিলাকে চিঠি দিয়েছিলেন শ্যামা। ভেবেছিলেন এত বড় প্রলোভনের পর সে আর একদিনও দেরি করবে না–চলেই আসবে। তিনি তাঁর মাপেই অর্থের মূল্য নির্ধারণ করেন। তাই মাসিক তিন-চার টাকা তাঁর কাছে কুবেরের ঐশ্বর্য মনে হয়েছিল। যদিও মনে মনে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্থির করে রেখেছিলেন, সে সব মাসে নিয়মিত ও টাকাটা না দিলেও চলবে–’দিই দিচ্ছি’ করে ওটা মধ্যে মধ্যে ফেলে দিলেই হবে। সেখানে তো আর কিছু জলে পড়ে নেই মেয়ে–শ্বশুরবাড়ি আছে, দুবেলা দু মুঠো ভাতও জুটছে–আর চাই কি পরনে একেবারে কিছু না থাকলে ন্যাংটো করেও রেখে দিতে পারবে না, নিজেদের লজ্জা নিজেদেরই ঢাকতে হবে। তাছাড়া–ঠিক অত দুঃখ কষ্ট হলে–মেয়ে পড়েই বা থাকতে চায় কেন? শ্বশুরবাড়ি থেকে নড়তে চায় না যখন, তখন সেখানে মাঝারি রকমের একটা কিছু ব্যবস্থা আছেই নিশ্চয়

কিন্তু এ সব হিসেবই তাঁর কতকটা কালনেমির লঙ্কা ভাগ হয়ে দাঁড়াল। এক এক করে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল-না এল ঐন্দ্রিলা আর না এল তার কাছ থেকে কোন চিঠি। এইবার চোখে যেন অন্ধকার দেখলেন একেবারে। এত বড় বাড়ি, বাগান, পুকুর সামলানো–একাধারে ঝি রাঁধুনীর কাজ, এই বয়সে আর যেন চলে না। খুব মনের জোর তাই একটা ধাধসের ওপর দেহটাকে যেন চাবুক মেরেই চালান কিন্তু নিজেই মনে মনে বেশ বুঝতে পারেন যে এভাবে মুমূর্ষু ঘোড়াকে জোর করে চালালে এক সময়ে সে এমন মুখ থুবড়ে পড়বে, যখন সহস্র চাবুকেও আর চালানো যাবে না। এমনিতেই তো দীর্ঘকালের দুঃখ দুশ্চিন্তা উপবাস আর কিছু করতে না পারলেও তাঁর কোমরটা ভেঙ্গে দিয়ে গেছে চিরকালের মতো, এখন আর সোজা হয়ে হাঁটতে কি দাঁড়াতে পারেন না। বেশ খানিকটা বেঁকে হুমড়ি খেয়ে চলতে হয় তাঁকে। সে সময় তাঁর পিঠটা ছিলে-চড়ানো ধনুকের মতোই দেখায়। সেভাবে চলা যদি বা যায় –কাজ-কর্ম করা খুব কষ্টকর। মধ্যে মধ্যে পিঠের নিচে একটা হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করেন পিঠটা ছাড়িয়ে নিতে চান তাও ঠিক পারেন না। এঁকেবেঁকে মুখটা বিকৃত করে অর্থাৎ বহু কষ্টে যা দাঁড়ায় সেটা ছিল ত্রিভঙ্গ গোছের একটা বাঁকাচোরা চেহারা। এমনি বেঁকে চলতেও কোমর ব্যথা করে কিন্তু আবার ঐভাবেও বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারেন না–শিরদাঁড়ায় কেমন একটা যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়, তাড়াতাড়ি আবার বেঁকে পড়েন স্বাভাবিক অবস্থায়।

তবুও এক রকম করে চলত হয়ত–যদি শুধু তাঁর আর কান্তির সংসার হ’ত। তরু আর তার দামাল ছেলেকে নিয়েই হয়েছে যত মুস্কিল। সবচেয়ে তরুকে সামলানোই অসম্ভব হয়ে পড়েছে তাঁর পক্ষে। দুর্দান্ত পাগল কিছু নয়–চেঁচামেচি বা ভাঙ্গাচোরা কিছু করে না কিন্তু একটু নজরের আড়াল করলেই বা একটু ফাঁক পেলেই চোখের নিমেষে এবং নিঃশব্দে একটা অকর্ম করে বসে। কাঁহাতকই বা অষ্ট-প্রহর চোখ রাখেন তার ওপর। দেহের এই অবস্থায় সংসারের কাজ সারতেই অনেক সময় চলে যায়। আজকাল তাঁর অত সাধের বাগানে জঞ্জাল জমে থাকে ডাঁই হয়ে পড়ে থাকে পাতা–তাই একটু হাত দেবার সময় পান না।

তবু ঐন্দ্রিলাকে গোড়াতেই কিছু লেখেননি। মেয়েকে চেনেন ভাল রকমই–তার কাছে একবার ‘নিনু’ হলে আর রক্ষা থাকবে না। একেবারে মাথার ওপর চড়ে বসবে সে। তার চেয়ে কনক অনেক ভাল। তাই কনককেই মিনতি করে চিঠি লিখেছিলেন একখানা। কনক এসেও ছিল–চিঠি পাওয়া মাত্রই। সে সময়টা সত্যি সত্যিই যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলেন শ্যামা। কনক নিজের ছেলে সামলেও রান্নাবান্না পাগল সামলানো সব করত- উনি নিশ্চিন্ত হয়ে বাইরের কাজ নিয়ে থাকতেন।

কিন্তু কনক মাস দুইয়ের বেশি থাকতে পারে নি। না পারার কারণ অনেক। কনক অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে–সেটা জানতেন না শ্যামা। তাঁকে কেউ বলে নি। এখানে আসবার পর টের পেলেন। জেরা করে জানলেন যে বেশ কয়েক মাস এগিয়ে গেছে ব্যাপারটা। অর্থাৎ এখানে বেশি দিন থাকলেই সাধ দেবার প্রশ্ন উঠবে। তারপরই দেখা দেবে প্রসবের নানাবিধ খরচা এবং ঝঞ্ঝাট। কে সে সব করবে এখানে! সেখানে নাকি হাসপাতালে ভাল ব্যবস্থা আছে–ওখানকার সকলে নাকি এ অবস্থায় হাসপাতালেই যায়। সেখানে এক পয়সা খরচ নেই, লোকজনেরও দরকার হয় না। এখানে যদি বা ঝঞ্ঝাট তিনি ঘাড়ে করতে চান–টাকা কি আর হেম বাড়তি দেবে এক পয়সাও? কনক আর তার ছেলে রয়েছে– কিছু তো বেশি খরচ হচ্ছেই, তার জন্যেও তো কিছু ধরে দেওয়া উচিত। কিন্তু সে ধার দিয়েই হাঁটে না হেম, আগেও যা দিত এখনও তাই পাঠায়। শ্যামার সেটা খুবই অন্যায্য বলে মনে হয়। এটা তাঁর কিছুতেই মনে পড়ে না যে, ওরা যখন সবাই এখানে ছিল তখনও হেম এই টাকাই দিত মাসে। বাইরে চলে গেছে বলে কমায় নি একটা টাকাও। বরং তারই উচিত, খানিকটা ফেরৎ পাঠানো কিম্বা কম পাঠাতে বলা। সে কথা যে শ্যামার মনে পড়ে না শুধু তাই নয়, ছেলের অবিবেচনার কথা নিয়ে প্রকাশ্যেই গজগজ করেন, কনককে শুনিয়ে শুনিয়ে-। কনক অবশ্য উত্তর দিতে পারত, দিলে শ্যামা বিব্রত বোধ করতেন এটাও ঠিক, কিন্তু সে কখনই কিছু বলে নি, আজ তার স্বামীর টাকা পাঠানো নিয়ে শাশুড়ীর সঙ্গে ঝগড়া করবে–তা সম্ভব নয়।

অবশ্য এসব ছাড়াও অন্য কারণ দেখা দিল।

হেমকে সেখানে হাত পুড়িয়ে খেতে হচ্ছে। কনক আসবার সময়ে পাশের কোয়ার্টারের মুখুজ্যেবাবুকে বলে এসেছিল, তাঁরা দেশে যেন কার শক্ত অসুখের খবর পেয়ে চলে এসেছেন, এখন শোনা যাচ্ছে আর যাবেনও না, এইখান থেকেই বদলির ব্যবস্থা করছেন। হেম এধারে যতই দুঃখ-কষ্ট করুক, সংসারের কাজ তাকে কিছু করতে হয় নি কোন দিন–এসব আদৌ অভ্যস্ত নয়। তার খুব কষ্ট হচ্ছে, অর্ধেক দিন নাকি খাওয়াই হয় না। ছাতু গুলে খেয়ে থাকে। ফলে পেট খারাপ হচ্ছে প্রায়ই। এখানে ছেলেটারও পেট ভাল থাকছে না। পশ্চিমের জল-হাওয়ায় অভ্যস্ত শিশুর শরীর এখানের এই জল আর শাকপাতা খাওয়ায় টিকছে না। তার চেহারা দেখে শ্যামাই শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। এর মধ্যেই দু’তিন দিন ফকির ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়েছে–আরও যদি খারাপ হয়ে পড়ে তখন বড় ডাক্তার ডাকতে হবে। এত কাণ্ড করে কে! অগত্যা তাঁকেই বলতে হ’ল ‘যাও’। কনকও ছেলের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েছিল–ছেলে আর স্বামী দুজনের জন্যেই–সেও আর দ্বিরুক্তি করল না। আবারও শ্যামা একা পড়লেন।

বরং আরও বেশি একা। কান্তি এর মধ্যে ঘুরে ঘুরে নিজেই একটা কাজ যোগাড় করেছে। ছাপাখানার কম্পোজিটারী কাজ–হরফের বিভিন্ন খোপ থেকে হরফ বেছে নিয়ে পর পর সাজিয়ে দেওয়া, যাতে তা থেকে ছাপ উঠলেই বইয়ের মতো পড়তে পারে লোকে। কান্তিরই কে এক পুরনো সহপাঠীর বাবার প্রেস, সেই ক’রে দিয়েছে–নইলে এও ওর পাবার কথা নয়। সেও কাজ জানে না কিচ্ছুই কখনও চোখে দেখে নি পর্যন্ত। সব নতুন করে শিখতে হবে। বদ্ধ কালা লোককে ইশারা ইঙ্গিতে শেখাবে এত গরজ কার? কান্তির বন্ধুর জিদেই এটা সম্ভব হ’ল। তাও প্রথম দু’মাস নাকি কিছুই দেবে না। তারপর থেকে চার মাস ট্রেনের মান্থলি টিকিটের ভাড়াটা পাওয়া যাবে শুধু। ছমাস পরে, যদি মোটামুটি কাজ শিখে নিতে পারে তো দশ টাকা মাইনে হবে। ওপর-টাইম খাটতে পারে তো ঐ হিসেবেই আর কিছু পাবে।

শ্যামা খুঁত্ খুঁত্ করেছিলেন, এই সামান্য আয়ের জন্যে ছ’মাস ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো–কী লাভ এতে! তিনি শুনেছেন যে সীসের হরফ ঘাঁটতে ঘাঁটতে নাকি অনেকের শক্ত ব্যারাম জন্মে যায়। লাভের মধ্যে কি একটা ব্যারাম নিয়ে ঘরে ফিরবে?…. কিন্তু কান্তি অনুনয়-বিনয় করে রাজি করাল তাঁকে। এতটা বয়স হয়ে গেল,–এক পয়সা রোজগার করতে শিখল না। বিধবা মেয়ের মতো ঘরে বসে খাচ্ছে–এমন ক’রে আর কত কাল চলবে। মা যতদিন আছেন ততদিন তবু দাদা টাকা পাঠাচ্ছে–এর পর? সে তো কোন লাইনেরই কাজ শেখে নি, রোজগার করবার তো কোন সম্ভাবনাই নেই কোন দিকে, এ যে একটা কাজ শিখতে পারছে এই তো বড় লাভ। ওর বন্ধুর কাছ থেকে ভাল ক’রেই খবর নিয়েছে সে–ভাল ক’রে কাজ শিখতে পারলে এ লাইনেও ভাল রোজগার হয়। ওদের প্রেসেই এক-একজনের চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ টাকা মাইনে আছে, ওপর-টাইম নিয়ে তারা ষাট সত্তর টাকা রোজগার করে মাস গেলে।

এসব কথার ওপর আর কিছু বলতে পারেন নি শ্যামা। ফলে এখন কান্তিও ভাত খেয়ে পৌনে সাতটার গাড়িতে বেরিয়ে যায়, ফেরে এক-একদিন রাত আটটা সাড়ে আটটায়। সে মাইনে করা লোক নয়, ওপর-টাইম খাটবার কথা নয় তার –কিন্তু কান্তি রাত অবধি থাকে নিজের গরজেই। যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ শেখবার সুযোগ, বিশেষত রাত্রের দিকে ‘কেস’ খালি পাওয়া যায় অনেক। সবাই তো ওপর-টাইম করে না, তাদের টুলে বসে কাজ করতে পারে। আগে আগে কেউ কাজ শেখাতে চায় নি, বরং যথেষ্ট অসুবিধেই সৃষ্টি করেছিল কিন্তু কান্তির বিনয়ে আর নেটিপেটি ভাবে অনেকেরই মায়া পড়েছে এখন। তাছাড়া সে নির্বিচারে সকলের ফাইফরমাশ খাটে–চা আনা, বেগুনি কিনে আনা, এটা ওটা হাতের কাছে এগিয়ে দেওয়া –কিছুতেই ‘না’ বলে না। সে যেন সকলেরই চাকর। তাছাড়া সে ইতিমধ্যে প্রুফ তোলার কাজটা শিখে নিয়েছে বলে দু’মাস পরে শুধু টিকিট ভাড়া নয়–পুরোপুরিই পাঁচ টাকাই বরাদ্দ ক’রে দিয়েছেন মালিক।

কিন্তু সে যা-ই হোক, শ্যামার কাছে ক্রমশঃ দুঃসহ হয়ে উঠেছে এই একান্ত নিঃসঙ্গতা। শুধু একা থাকা একরকম–তাঁর দু’দিন না খেলেও চলে যায়, কিন্তু আরও তিনটি প্রাণীর খাওয়ার প্রশ্ন আছে। আর রান্না খাওয়া থাকলে তার সঙ্গে রকমারি কাজও থাকবে। তার ওপর পাগল-চরানো। মল্লিক-গিন্নী বলেন, ছেলেটার বিয়ে দাও। মেয়ের অভাব হবে না–অমন অনেক গরিব-দুঃখী মেয়ে আছে যাদের বাপ-মা ঘাড় থেকে নামাতে পারলে বাঁচে।

মেয়ের অভাব হবে না তা শ্যামাও জানেন। তবু মন সায় দেয় না তাঁর। এখনও যে বলতে গেলে কিছুই রোজগার করতে শিখল না, তার মাথায় একটা সংসার চাপিয়ে ন্যাঞ্জারি ক’রে দেওয়া –মা হয়ে শত্রুতাই করা বলতে গেলে। তাছাড়া সে কান্তিও রাজি হবে না কিছুতে। সেটুকু ছেলেকে চেনেন ভাল রকমই।…..

না, সে কোন কাজের কথা নয়।

কাজের কথা যেটা–সেই মতোই কাজ করেছিলেন তাই। অনেক ভেবে চিন্তে অনেক হিসেব ক’রে ঐন্দ্রিলাকে চিঠি লিখেছিলেন। সাধারণত ঐন্দ্রিলা চিঠি লেখে না তাঁকে পূজোর সময় ছাড়া। এবারেও লেখে নি। লিখেছিল মহাশ্বেতাকে, অরুণের সঙ্গে যে তার দেখা হয়েছিল সেই খবরটা দিয়ে। মহার কাছ থেকে ঠিকানাটা নিয়ে শ্যামাই তাকে চিঠি দিয়েছিলেন–উপযাচক হয়ে। এটা তাঁর নিজের কাছেই অঘটন বলে মনে হয়েছিল– অপমান বোধ হয়েছিল খুব, নিতান্ত বাধ্য হয়েই এ কাজ করতে হয়েছিল–কোন দিকে কোন উপায় ছিল না বলেই।

ঐন্দ্রিলার কাছ থেকে যখন কোন উত্তর এল না–প্রায় তিন-চার সপ্তাহ অপেক্ষা ক’রে দেখে সীতাকে একটা চিঠি লিখলেন শ্যামা। সব অবস্থা খুলেই লিখলেন। এককালে তো এখানে সে যথেষ্ট আদর-যত্ন পেয়েছে, এখন তাঁর বিপদের দিনে কয়েকটা মাস এসে কি থাকতে পারে না সে? তিনি ওর চিঠি পেলেই আসবার গাড়িভাড়া পাঠিয়ে দেবেন কিম্বা বুড়ো-কেষ্ট কাউকে পাঠাবেন–এ প্রতিশ্রুতিও দিলেন। এবারেও তাঁর মনে হ’ল যে তাঁর তরফ থেকে এতখানি বদান্যতার প্রস্তাব যাবার পর আর সীতা না এসে পারবে না।

কিন্তু দেখা গেল যে, আবারও হিসাবে ভুল হ’ল তাঁর।

সীতা এল না। তবে তার কাছ থেকে জবাবটা পাওয়া গেল। সে-ই মার অসুখের খবর দিল। ডাক্তারবাবু তাকে চিঠি দিয়েছেন–বিশেষ কিছু লেখেন নি, শুধু খুব অসুস্থ, উত্থানশক্তি-রহিত এইটুকু জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে এও জানিয়েছেন যে, উতলা হবার কোন কারণ নেই, সে-রকম বুঝলে তিনিই জানাবেন। টেলিগ্রাম করবেন বা লোক পাঠাবেন। তবে মনে হয় যে তেমন কোন অবস্থা দেখা দেবে না, রোগী এখন আস্তে আস্তে ভালই হয়ে উঠছে।

মার খবর দিয়ে নিজের কথা লিখেছে সীতা। না আসবার কারণ জানিয়েছে খোলাখুলিই। লিখেছে–

‘এখন ইহারা আমার সঙ্গে মন্দ ব্যবহার করিতেছে না, বরং ভালই করিতেছে। আমার ছেলেকেও পাঠশালে ভর্তি করিয়া দিয়াছে! অবশ্য মার টাকাতেই আমাদের জামা- কাপড় প্রভৃতি যাবতীয় বাহিরের খরচা চলে। কিন্তু মার টাকা আসার তো কোন স্থিরতা নাই। মাঝে মাঝে দীর্ঘদিনই বন্ধ থাকে, সে সব সময়ে ইহাদের দয়াতেই দিন চলে। সে অবস্থায় এ আশ্রয় ছাড়া উচিত নয়। একবার চলিয়া গেলে–আর কোন দিন ঢুকিতে পাইব কি না সন্দেহ। বিশেষ যখন আপনার দুই-চারি দিনের ব্যাপার নহে, হয়ত বেশ কিছুকালই থাকিতে হইবে– তখন ইহাদের সহিত সম্পর্ক চুকাইয়াই যাইতে হইবে বলা যায়। আপনি আমাদের ভার লইতে চাহিয়াছেন কিন্তু আমার ছেলের লেখাপড়া শিখাইবার ভার কি আপনি লইবেন? এখানে থাকিলে–লেখাপড়া না শেখাক ইহারা নিজেদের গরজেই একটা কোন রোজগারের ব্যবস্থা করিয়া দিবে। আপনার ওখানে সেটুকুও হইবে না। তারপর–কিছু মনে করিবেন না–আপনি আর কদিন–পরে মামারা যদি দুইটা প্রাণীর ভার না বহিতে পারেন?…. অনেক ভাবিয়া দেখিয়াছি, আমার এখান ছাড়িয়া যাওয়া উচিত নয় কোনমতেই। আপনার কাছে আমাদের অনেক ঋণ, আপনার দুঃসময়ে কোনকাজে আসিতে পারিলাম না, সে জন্য লজ্জার সীমা নাই–কিন্তু নিতান্ত বাধ্য হইয়াই আমাকে এখানে থাকিতে হইতেছে। সকল দিক ভাবিয়া আপনি আমাকে মাপ করিবেন।’ ইত্যাদি–

আঁকা-বাঁকা লেখা, বানান ভুলে ভর্তি, কিন্তু বক্তব্যে কোন জড়তা কি অস্পষ্টতা নেই। বরং অদ্ভুত একটা দৃঢ়তাই লক্ষ করলেন শ্যামা। অমন ভালমানুষ ভিতু-ভিতু মেয়েটার মধ্যে এত শক্তি এত বুদ্ধি বিবেচনা কোথা থেকে এল কে জানে। বেশ একটু অবাকই হয়ে গেলেন শ্যামা ওর চিঠিটা পড়ে! .

কিন্তু মূল সমস্যাটা থেকেই গেল। হয়ত তার সমাধান কোনদিনই হয়ে উঠত না– অন্তত শ্যামার দ্বারা তো হতই না, কথাটা ভাবতেও পারতেন না তিনি–যদি না তাঁর গর্ভের সর্বাপেক্ষা নির্বোধ সন্তানটি এ-বুদ্ধিটা তাঁকে না দিত।

অনেকদিন এ-বাড়ি আসে নি মহাশ্বেতা। সেই অভয়পদর ভরাডুবি হবার পর থেকে বহুকাল আসে নি। মা টিকিরি দেবে, এই লজ্জাটাই সবচেয়ে প্রবল তার।’শত্তুর হাসবে’, ‘শত্তুরের কাছে চিরকালের মতো মুখখানা পুড়ল’–এই আপসোসটাই তার সবচেয়ে বেশি। সে ‘শত্তুরটা যে কে–অনেক ভেবেও এক শ্যামা ছাড়া কাউকে খুঁজে পেত না ওর ছেলেরা। সেই শত্তুরের কাছে টিটকিরি খাবার ভয়েই মহাশ্বেতা এ দিক মাড়াত না। শেষে একদিন নিজেই ডেকে পাঠিয়েছিলেন শ্যামা। ঘাটে পা পিছলে পড়ে গিয়ে মাজায় লেগেছিল খুব। ওঠবার সামর্থ্য ছিল না। সেইদিনই রাত্রে কান্তিকে পাঠিয়ে আনিয়েছিলেন মহাকে। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই এসেছিল, দুদিন ছিলও–তবে ঐ গোনা দুদিনই। শ্যামা একটু ওঠবার মতো হ’তেই আর থাকে নি।

বাপ্‌রে–কী বলছ! গুষ্টিটার ধকল কি কম! আমি না থাকলেই বৌটোর প্রেহারী, ওকে দিয়ে দু’টো লোকের কাজ করিয়ে নেবে। বলবে তোর শাশুড়ী নেই তো আমরা কি করব–সে যায় কেন! নাও দিকি–আমি যেন ওদের চোদ্দগুষ্টির পিণ্ডি জোগাবার ইজেরা নিয়ে রেখেছি। আর মুখপোড়া বৌটাও হয়েছে তেমনি বোকা, কাজে না বলতে জানে না। কত শিখিয়ে দিই–তেমন তেমন দেখলে পেট কামড়াচ্ছে বলে গিয়ে শুয়ে পড়বি কিম্বা বলবি বড্ড মাথা ধরেছে–বলি পেট কামড়ানো কি মাথাধরা এ তো ডাক্তারের বাবারও সাধ্যি নেই যে বলে হয় নি। এ তো আর রবারের নল-টিপে দেখার রোগ নয় গো–তা কে কার কড়ি ধারে। সেই ভূতের মতো খাটবে, বারোমাস তিনশ’ পঁয়ষট্টি দিন–

তারপর থেকে অবশ্য আসে মধ্যে মধ্যে। স্বামীর নির্বুদ্ধিতার জন্য বিলাপ করে, শাপ- শাপান্ত করে–যদিও সেটা কার উদ্দেশ্যে করা হয় তা ভালো বুঝতে পারেন না শ্যামা, তবে তার গূঢ়ার্থটা যে অভয়পদর কাছেই পৌঁছয় এ কথাটা বোঝাতে গেলে হিতে বিপরীত হয়, আরও চেঁচিয়ে কেঁদে কেটে অনর্থ করে। তাই আর ওকে বিশেষ ঘাঁটান না শ্যামা ‘শত্তুর হাসা’র কথা তিনিও শুনেছিলেন তাই এ কথাটাও মনে করিয়ে দেন না যে তিনি আগেই ওকে সতর্ক ক’রে দিয়েছিলেন বার বার। যা হবার তা তো হয়েই গেছে, এখন আর বলে লাভ কি। আবার হয়ত আসা বন্ধ করবে। এলে উপকার বই অপকার নেই, যতটুকুই থাকুক–পাঁচটা কাজ টেনে ক’রে দিয়ে যায়। শ্যামার কাছে এখন সেইটুকুই লাভ, নিজেকেই বোঝান মাঝে মাঝে –’ভাঙ্গা ঘরে জ্যোচ্ছনার আলো, যদ্দিন যায় তদ্দিন ভাল! যেটুকু করে তাই আমার উগার।’

মহাশ্বেতাই একদিন এসে বুদ্ধিটা দিলে। অন্য দিনের মতো নয়–সেদিন এল সেই আগেকার মতো–যেন লাফাতে লাফাতে। দূর থেকে আসার ধরন দেখেই বুঝেছিলেন শ্যামা যে আজ কোন বিশেষ বক্তব্য আছে। হয় কোন ‘মজার ঘটনা ঘটেছে’ (অন্তত মহাশ্বেতার কাছে মজার) কোথাও–নয় তো তাঁকেই কোন বুদ্ধি দিতে আসছে সে। সাধারণত এই বুদ্ধি দিতে আসাটা নিতান্ত বোকার মতোই হয়, সেই অভিজ্ঞতাতেই শ্যামা নিজেকেই একটু কঠিনভাবে প্রস্তুত করেছিলেন কিন্তু মহাশ্বেতার বক্তব্য শুনে এই প্রথম ‘তাঁকে স্বীকার করতে হ’ল যে তাঁর বড় মেয়ে ভাল মতলবই দিয়েছে!

মহাশ্বেতা এসে বাইরের রকে বসে ভাল ক’রে দম নেবার আগেই কথাটা পাড়ল, ‘বলি তুমি এত বোকা কেন গা! এই তো বুদ্ধি যোগাও এত লোককে নিজের বেলা মাথাটা খোলে না। একা এক হাতে নাটা-ঝাটা খাচ্ছ–মুখের রক্ত তুলে মরে যাচ্ছ–বড় মাসীদের আনিয়ে নাও না, তা’হলেই তো সব গোল চুকে যায়।’

‘বড় মাসীমাদের–?’ কথাটা ঠিক বুঝতে পারেন না শ্যামা, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন মেয়ের মুখের দিকে।

‘ওমা, ও বাড়ি তো ওদের ছাড়তে হবে, শোন নি? বাড়িও’লারা তো বাড়ি বেচে দিয়েছে, নোটিশ হয়েছে ওদের ওপর ঘর ছাড়তে হবে! নতুন বাড়িওলাদের বেরৎগুষ্টি, গোটা বাড়িটা না হলে সম্পষ্যি হবে না তাদের। এখন তো হন্যে হয়ে ঘর খুঁজে বেড়াচ্ছে বড়দা। তা ও ভাড়াতে আর কোথায় ঘর পাবে বলো, এতকাল ছিল কখনও তো এক পয়সা ভাড়া বাড়ায় নি, এখন যেখানেই যাচ্ছে শুনছে এতটি ভাড়া। অথচ আপিসেও নাকি টলোমলো অবস্থা, লোকজন সব ছাড়িয়ে দিয়েছে, কাজ কম–মাল বিক্কিরি হয় না, ওদের লাইনে নাকি আরও ভাল ভাল লোক এসেছে–তাদের জিনিস এদের থেকে ঢের ভাল। এদের এখন সে জিনিস করতে গেলে আরও এতটি টাকা ঘর থেকে ঢেলে নতুন নতুন যন্তরপাতি আনাতে হবে, তা ছেলেটা পেরস্তুত, বাপ মিসে রাজি নয়, বলে, যা করেছি এখন বসে খেতে পারব–ঘরের টাকা সব বার ক’রে দিয়ে যদি আর না তুলতে পারি? যদি নতুন মালও না চলে! এহকাল পরকাল দুই-ই যাবে! টাকা তো সব বাপ মিসের হাতে, সে সই না করলে তো উঠবে না, তাই ছেলেটাও কিছু করতে পারছে না। বড়দাকেও তো বলেছে যে, তুমি যদি ভাল চাকরি পাও অন্য কোথাও, খুঁজে নিয়ে সরে যাও–আমি তোমার ক্ষেতি করব না। কিন্তু বড়দাই বা আর এই বুড়ো বয়সে কোথায় যায় বলো! মাইনে কমিয়ে নিতে রাজি হয়ে চাকরিটা টিকিয়ে রেখেছে।… ওর সঙ্গে আজকাল যে আপিসে এসে প্রায়ই দেখা করে। ইচ্ছেটা যদি ওদের আপিসে ঢুকতে পারে কোনমতে, হাজার হোক সাহেবের আপিস, এ কোন কালে উঠবে না। কিন্তু এখন আর ও ঢোকাবে কী ক’রে বলো, এখন সব এল-এ বি-এ পাস করা লোক ফ্যা ফ্যা ক’রে বেড়াচ্ছে চোদ্দ গণ্ডা, তাদের ফেলে ওকে নেবে কেন। বলি দাদা তো আর গিয়ে নোয়া পিটতে পারবে না এই বয়সে। দিলে নেখাপড়ার কাজই তো দিতে হবে! তাছাড়া, এই ব্যাপারটার পর তোমার জামাইয়ের মুখটাও খুব আর নেই আপিসে!’

এক নিঃশ্বাসে সপ্তকাণ্ড রামায়ণের মতো দীর্ঘ বক্তব্য শেষ করে, বোধ করি দম নেবার জন্যেই থাকে মহাশ্বেতা। শ্যামাও এই প্রথম ফাঁক পান একটু তলিয়ে বুঝতে।

এ সবই শুনেছেন তিনি। দিদি চিঠিতেও লিখেছেন তাঁকে। বাড়ি ছাড়তে হবে অথচ বেশি বাড়িভাড়া দেবার সামর্থ্য নেই–সংসারই অচল হয়ে উঠেছে দিনকে-দিন–তাও লিখেছেন। কিন্তু তবু মহাশ্বেতা অবশ্য বেশিক্ষণ সময় দিল না তাঁকে। আবারও বলল, ‘কালই এসে ওকে বলেছে নাকি বড়দা যে, তোমাদের ওদিকে পাঁচ-সাত টাকায় যদি একটা ছোট-খাটো বাড়ি পাওয়া যায় তো তাই নয় দ্যাখো, না হয় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করব তোমাদের মতো। কলকাতায় এখন দশ-পনেরোটা টাকায় যে ঘর পাওয়া যায় সে একেবারে শুয়োর খোঁড়– তাতে ভদ্দরলোক থাকতে পারে না, ছেলেমেয়েগুলোও মরে যাবে সে সব ঘরে থাকলে।… কথাটা শুনেই তো মতলবটা মাথায় গেল গো, বলি ভাড়া নিতে চাও তাও নিতে পারো নইলে তোমার বাড়ি তো পড়েই আছে, না হয় থাকলই এসে, পর তো নয়। এলে তোমার অন্তত পাগল সামলাবার কাজ তো হবে। বড়-মাসী আর কিছু করতে পারুক না পারুক বসে মেয়েটাকে তো আগলাতে পারবে।’

হঠাৎ প্রশ্ন ক’রে বসেন শ্যামা, গলার আওয়াজটা তাঁর নিজের কাছেই তীক্ষ্ণ শোনায়, ‘একত্তরে?’

‘একত্তরে কেন গো–অতবড় রান্নাঘর পড়ে আছে তোমার, দাদা তো এস্তক নাগাদ শুয়ে গেল ওখানে–সেখানে আর একটা উনুন জ্বেলে তাদের রান্না তারা করতে পারবে না? তারা তাদের মতো খাবে, তোমরা তোমাদের মতো, তাহলে তো আর কোন গোল থাকবে না। শুধু থাকবে এক জায়গায় এই যা। তাতে তো তোমারই লাভ বেশি, বড়-বৌ থাকলে সে কি আর এক আধ দিন ছড়া-ঝাঁটগুলো দেবে না–না, ঘর দোরগুলো মুছবে না?

চুপ ক’রে বসে ভাবেন শ্যামা অনেকক্ষণ। মতলবটা মন্দ লাগে না বটে–তবে অসুবিধেও হবে কিছু কিছু! মেয়েগুলো বড় হয়েছে, কলকাতার মেয়ে, গাছপালা ছিঁড়েখুঁড়ে ফল-ফুলুরি তুলে নষ্ট করবে ঢের। তবু, সুবিধাটা তাঁর দিকেই বেশি। চাই কি তিনি না চাইলেও ভাড়া বলে কিছু দিতে পারে গোবিন্দ। আর যদি এক সংসারে খায়–খোরাকি বলে যত টাকাই ধরে দিক–তার মধ্যে থেকে কিছু বাঁচাতে পারবেনই তিনি।

তবু বলেন, ‘কিন্তু এই তো একটা ঘর, কোথায় সব থাকবে তাও তো বুঝতে পারছি না।’

‘কেন, বড়দা বৌদি এই বাইরের ঘরে থাকবে। কান্তিকে বরং রান্নাঘরে ব্যবস্থা ক’রে দাও। ঘরে তরু যেমন থাকে থাকবে, তুমি তো দালানেই থাকো নাতিকে নিয়ে, সেখানেই বড়মাসী শোবে এখন। জায়গার আবার অভাব, কলকাতায় কীভাবে আছে সব গিয়ে দ্যাখো না একবার।’

আরও কিছুক্ষণ মনে মনে তোলাপাড়া করবার পর পরামর্শটা ভালই লাগে শ্যামার। তিনি বলেন, তা তুই না হয় তাহলে জামাইকে বলেই দে, তাদের যদি কোন অসুবিধে না হয় তো এসে থাকুক। ভাড়া-ফাড়া দিতে হবে না, ঢের খেয়েছি দিদির, আজ আর এই আধখানা ঘরের জন্যে হাত পেতে ভাড়া নিতে পারব না। সেই টাকাটা জমিয়ে যদি গোবিন্দ এখানে মাথা গোঁজার একটা জায়গা করতে পারে তো করুক।’

মার এতটা সুমতি আশা করে নি মহাশ্বেতা, সে খুশি হয়ে তখনই উঠে পড়ল, ‘দেখি বলি গে আজ তোমার জামাইকে, পারে তো কালই গিয়ে খবরটা দিয়ে আসুক!…. ওকে আজকাল নড়ানোই মুশকিল, ঐ সর্বনাশের পর থেকে কোথাও যেতে চায় না–আমি ও বলি না, যা পোড়ানো পোড়ালে মুখখানা–আর ও মুখ না দেখানোই ভাল। ছি ছি! আমারই কি এ মুখ দেখাতে ইচ্ছে করে, জীবনেই যেন ধিকার এসে গেছে। রাস্তা দিয়ে আসি, মনে হয় রাস্তার লোক আমার দিকে চেয়ে হাসছে। বুদ্ধি, তোমরা সবাই বলতে বড় জামাইয়ের এ্যাতো বুদ্ধি ত্যাতো বুদ্ধি! বলে না –অতি বুদ্ধির গলায় দড়ি–তা ওরও হল তাই! হাত্তোর কপাল রে!’

বিলাপ করতে করতে চলে যায় সে। কিন্তু শ্যামা স্থির হয়ে বসেই থাকেন। কে জানে ভাল করলেন কি মন্দ করলেন। আবার হয়ত কী একটা নতুন ঝঞ্ঝাটে জড়িয়ে পড়ছেন মিছিমিছি–কিন্তু তিনিও আর পারছেন না, এটাও ঠিক। ঐন্দ্রিলাকে মেয়ের খরচ সুদ্ধ দিয়ে আনতে চেয়েছিলেন–সে খরচটা তো ষোল আনাই বাঁচবে চাই কি হাতে কিছু আসতেও পারে। এখন তো মনে হচ্ছে সুবিধে তাঁর দিকেই বেশি। তারপর কী দাঁড়ায় কে জানে। তাঁর যা ভাগ্য, শিব গড়তে গেলে বাঁদরই হয় বরাবর–এও হয়ত তাই হবে।

রানী-বৌকে তাঁর ভালই লাগে, ভাল মেয়ে। এলে উপকারই হবে। মধ্যে যে তার সম্বন্ধে বিদ্বেষ এসেছিল মনে, সে শুধু নিজের ছেলের জন্যেই। হেম যদি বড়-বৌদিকে নিয়ে অত বাড়াবাড়ি না করত তাহলে বলবার কিছু ছিল না। রানী-বৌয়ের দোষ তত নয়– যতটা দোষ তাঁর ছেলের। ছেলে এখন নেই–এই একটা সুবিধে, নইলে এখনও ভরসা পেতেন না। রানীর রূপ এখনও অগ্নিশিখার মতো আর তেমনি বুদ্ধি। তার কাছে কনক? চাঁদের কাছে জোনাকি!

আবার অবচেতনে একথাও মনে হয় এক-একবার, মন্দ হয় না, ভাতার-সোহাগী হয়ে বড্ড অহঙ্কার হয়েছে, খোঁতা মুখ যদি আর একবার ভোঁতা ক’রে দিতে পারেন তো খুব জব্দ হয়ে যায়!

অপরাহ্ন গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে গাছে-পালায় আব্‌ছা হয়ে, তবুও শ্যামা বসে থাকেন সেই এক ভাবে।

।।২।।

রানী-বৌকে অনেকদিন পরে দেখলেন শ্যামা। তার রূপ-লাবণ্য সম্বন্ধে পূর্বেকার ছবিটাই মনের মধ্যে ছিল, এখন তাকে দেখে একেবারে চমকে উঠলেন। চেহারা খারাপ হয়ে গেছে তা শুনেছিলেন, মহাশ্বেতা না কে যেন বলছিল তাঁকে, ‘সে দাবদলনী বড়বৌকে আর চিনতে পারবে না এখন দেখলে,’ সে কথাটা যে এমন মর্মান্তিকভাবে সত্য, তা কল্পনা করতে পারেন নি তিনি।

অমন ভরা-যুবতী মেয়েটা যেন আধপোড়া চেলা কাঠ হয়ে গেছে একেবারে। তেমনিই শীর্ণ, তেমনিই শ্রীহীন। সবচেয়ে অমন বসরাই গোলাপের মতো রংটা কী কালিই মেড়ে দিয়েছে সে চামড়ার ওপর। তিনিও এককালে ঐ রকমই ফরসা ছিলেন, এখন কালোও হয়ে গেছেন এটা ঠিক–তবু, সে কতখানি বয়সে এবং কত দুঃখকষ্টে, দেহের ওপর কতখানি অত্যাচারে। এ বয়সে অন্তত এ ‘ছিরিমূর্তি’ হয় নি তাঁর। শুধু দাঁতগুলো এখনও তেমনি আছে, তেমনি সাজানো সুন্দর–আর থাকার মধ্যে আছে চোখ দুটো, তাতে যেন এখনও তেমনি ভেলকি খেলে। মুখের সেই হাসিটুকুতে আর চোখের চাউনিতে শুধু ধরা যায় যে এ সেই রানী-বৌ, নইলে চেনবার আর কোন উপায় নেই তাকে।

প্রথম দেখে বেশ কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন শ্যামা, কোন প্রশ্ন করা তো দূরে থাক, মুখ দিয়ে কথাই সরে নি। রানী যখন হেসে প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী মাসীমা–চিনতে পারছেন না?’ তখন যেন সম্বিৎ ফিরল তাঁর। তিনি চিবুকে হাত দিয়ে চুম্বন ক’রে বললেন, ‘সত্যিই চিনতে পারি নি মা, এ কী হাল হয়েছে তোমার!

রানী ম্লান হাসল একটু। জবাব দিল না।

পরে কমলার মুখে কারণটা শুনলেন শ্যামা। এই ছেলেটা হবার পর থেকেই নাকি ভুগছে রানী-বৌ। কিছু হজম হয় না, হাগা-রোগ ধরেছে, তার ওপর প্রায়ই একটু-আধটু জ্বর হচ্ছে ইদানীং। তাইতেই দিন দিন অমন শুকিয়ে বৃষকাঠ হয়ে যাচ্ছে।

শুনে শ্যামা শিউরে উঠলেন, ‘তা হ’লে তো সুতিকা হয়েছে বলো! কোন ডাক্তার দেখাও নি?’

কমলা কপালে একটা হাতের ঘা মেরে বললেন, ‘ডাক্তার! এক কথায় পনেরো টাকা মাইনে কমে গেল, খেতে দেব ওদের না ডাক্তার দেখাব? তবু তো একটা বাঁচোয়া — বৌমার দূর দূর আঞ্জা, এতদিনে মোটে তিনটি, নইলে তেমন হ’লে তো এতদিনে এক ঘর ছেলে-মেয়ে হবার কথা।… না, ডাক্তার-ফাক্তার দেখানো হয় নি–ঐ পাড়ায় এক হোমিওপাথিক ডাক্তার আছে, এক আনা করে এক পুরিয়া ওষুধ নেয়, তাই এনে খাওয়ানো হয়েছিল কদিন–তা তাতে তো কিছুই হ’ল না। আর কি করব বলো!’

শ্যামা বললেন, ‘তা হাসপাতালে-টাসপাতালে নিয়ে গেলেও তো পারতে–কিম্বা ঝামাপুকুরের সেই কবিরাজখানায়? তারা খুব ভাল ওষুধ দেয় শুনেছি। এ সব ব্যারামে তো কবিরাজিই ভাল–সবাই বলে!’

‘সে তো বলে। কিন্তু নিয়ে যায় কে সেই তো কথা! আমি ওসব চিনিও না, তাছাড়া আমার ওরকম হুট্ করতে বেরোনো অব্যেসও নেই কোন কালে। এখন তো এমনিও পারব না, হাত-পা যেন সর্বদা কাঁপে, বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটাতে থাকে একটু চললেই। আবার বছর কতক ধরে শুরু হয়েছে, বর্ষা হলেই হাত-পা ফোলে একটু একটু–সে সময়টা বুক- ধড়ফড়ানিটাও বাড়ে। তা আমি তো ধরো কাজের বার সব দিক দিয়েই। কে নিয়ে যাবে, হাসপাতালে তো আর এক-আধ মিনিটে হবে না। তোমার খোকাটা থাকলেও হ’ত। হেম থাকলে তাকে বলতে পারতুম, সে একদিন আপিস কামাই করেও দেখিয়ে আসত!’

শ্যামা একটু অসহিষ্ণু ভাবেই বলেন, ‘তা আসলে যার করবার কথা–সেকি করে, তোমার গোবিন্দ!’

গোবিন্দ! তবেই হয়েছে। ওর আপিস সেই হয়েছে যাকে বলে–ভাত দেবার ভাতার নয়, নাক কাটবার গোঁসাই–তাই! এধারে মাইনে কমল, ওধারে কাজ বাড়ল। লোক তো বেশির ভাগই ছাড়িয়ে দিয়েছে–যা ঐ পুরনো আর বুড়ো-হাবড়া কজন আছে– জানে যে এরা কোথাও নড়বে না, কিম্বা নড়লেও কাজ পাবে না কোথাও তাই তাদের নিশ্চিন্তি হয়ে দু’পায়ে থ্যালাচ্ছে এখন। গোবিন্দ তো যায় আজকাল সেই সকাল আটটায়, ওর কাছেই চাবি থাকে, গিয়ে আপিস খুলতে হয়, আর একেবারে চাবি দিয়ে বাড়ি আসতে পায় — যার নাম ধরো সেই রাত সাড়ে আটটা নটায়। কাজ নেই নেই শুনছি, অথচ রোজই ওপর- টাইম। লোক কম বলেই নাকি ওপর টাইম দিতে হয় রোজ! এই তো ছেলের হাল–বলে সময়ের অভাবে বাজারই করতে পারে না–ডাল ডালের বড়া দিয়ে ভাত ঠেলতে হয়। ঐ করেই তো বৌটার আরও শরীর যেতে বসেছে।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শ্যামা প্রশ্ন করেন, ‘তা অন্য কোথাও কাজকর্ম জুটিয়ে নিতে পারছে না?’

কৈ আর পারছে। চিরদিনই তো জান–কুনো-মতো স্বভাব। মানুষজনের সঙ্গে ভাব- আলাপ থাকলে তো কাজ-কম্মের চেষ্টা হবে–সে রকম জানাশুনো লোকই বা কই?’

চুপ করে যান শ্যামা। তবে মনটা তাঁর খারাপ হয়েই থাকে।

এক সময় এই বড়বৌ সম্বন্ধে তাঁর বিদ্বেষের অন্ত ছিল না। ছেলেকে পর ক’রে নিচ্ছে ছলাকলায় ভুলিয়ে–এই কারণেই একটা বিতৃষ্ণার ভাব এসেছিল। সে ভাবটা আর নেই, সেদিক দিয়ে সব গ্লানি পরিষ্কার হয়ে গেছে তাঁর। বরং ছেলে এখন বৌয়ের কাছে একেবারে আত্মসমর্পণ করার পর তাঁর মনে হয় যে, এককালে বড়বৌদির বশ ছিল সেটা তবু শোভা পেত, সেইটেই স্বাভাবিক। কিসে আর কিসে। মার বহু-ব্যবহৃত উপমাটা মনে পড়ে তাঁর এই প্রসঙ্গে–শ্বেত চামরে আর ঘোড়ার লেজে! ছিঃ! ছেলের প্রবৃত্তিতে ঘৃণা বোধ হয় তাঁর। মনে হয়–রানীর মতো মেয়ের দ্বারা অভিভূত হ’লে কোন পুরুষকেই দোষ দেওয়া যায় না। তবে তাকে যে দেখেছে, তাকে যে ভালবেসেছে, সে আবার কনকের মতো বৌকে মাথায় তুলে নাচে কী ক’রে?

না, রানী সম্বন্ধে কোন অভিযোগ আর নেই তাঁর এখন। বরং সেই ফুটফুটে দেবীপ্রতিমার মতো ছোট্ট বউটি আর তার মুক্তোঝরা হাসি দেখে অকারণেই যে স্নেহ উদ্বেল হয়ে উঠেছিল একদা–সেই স্নেহেরই যেন খানিকটা আজ অনুভব করেন আবার। দুঃখ বোধ করেন, উদ্বেগ বোধ করেন বৌটার জন্যে। একথাও মনে হয় এক একবার, উদ্বেলিত স্নেহবোধের সেই সব দুর্বল মুহূর্তে যে, ক্ষমতা থাকলে তিনি নিজেই পয়সা খরচ করে বড় ডাক্তার দেখাতেন। অবশ্য সে ক্ষমতা সম্বন্ধে ধারণাটাও তাঁর খুব অস্পষ্ট, কত টাকা জমলে সেরকম ক্ষমতা হয়েছে তাঁর এটা স্বীকার করবেন, তা কখনও ভেবে দেখেন নি, এ রকম ক্ষমতা যে–তাঁর যতই কেন না টাকা জমুক হাতে–কখনই আসবে না, সেটাও বুঝতে পারেন না। দেখালে এখনই দেখাতে পারেন স্বচ্ছন্দে, বছরে অন্তত ত্রিশ-বত্রিশ টাকা সুদ তাঁর মারাই যায়; আসলও ডোবে গড়ে ঐ পরিমাণই।

যাই হোক–টাকা খরচ সম্ভব নয়, কারুর জন্যেই। যেটা সম্ভব সেইটেই করেন। সূতিকার অনেক টোটকা-টুটকি জানা আছে অনেকেরই–নিজে উদ্যোগী হয়ে পাড়াঘরে খোঁজ-খবর করে মাদুলি এবং খাওয়ার ওষুধ ইত্যাদি সংগ্রহ করেন। গোটা দুই-তিন মাদুলি পরিয়েও দেন। মাকড়দায় কে একজন স্বপ্নাদ্য ওষুধ দেয়–কেষ্টকে পাঠিয়ে তাও আনিয়ে নেন। আর, মনে হয়–কোটায় কতটা তা বলা মুশকিল–তবে–এ সবগুলো জড়িয়ে একটু উপকারও হয়। ওরই মধ্যে একটু যেন সুস্থ বোধ করে রানী, আগের লাবণ্যের শতাংশ না হ’লেও একটু চেকনাই ফিরে আসে আবার।

রানী তাঁকে আরও মুগ্ধ করে গুণে। ওর এ দিকটা জানা ছিল না শ্যামার। শরীর এত খারাপ হওয়া সত্ত্বেও সে এসেই বহু কাজ টেনে নিয়েছে শ্যামার হাত থেকে। ঘর দালান মোছা, উঠোন ঝাঁট, রান্নাঘর, রান্নাঘরের দাওয়া নিকোনা –কোনটাই করতে হয় না আর। সবচেয়ে বড় উপকার সে করেছে–তরুর জন্যে আর মোটেই মাথা ঘামাতে হয় না তাঁকে। তার ভার সম্পূর্ণই নিয়েছে রানী। তাকে জোর করে তুলে মুখে ধোওয়ানো, কাপড় ছাড়ানো, স্নান করানো, খাওয়ানো–সবই সে করে। সেদিক দিয়ে একেবারে নিশ্চিন্ত হয়েছেন শ্যামা। আগের মতো চোখ রাখতেও হয় না সদা-সর্বদা। সেটা দিদি এবং বড়বৌই করে। মেয়েগুলোও খানিকটা সেয়ানা হয়েছে, তারাও একটু গোলমাল দেখলেই শোরগোল তোলে।

অবশ্য টাকার দিক দিয়ে কোন সুবিধা হয় নি। নগদ কিছু হাতে পান নি শ্যামা। একত্র রান্না করার প্রস্তাবে গোবিন্দ রাজি হয় নি। সে বলেছে, কতকটা শ্যামাকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলেছে যে, ‘এক তরকারী খাই, শুধু আলু ভাতে ভাত খাই সেও ভাল–আতেলা আঝালা তিরিশ ব্যান্ননে আমার দরকার নেই। তাছাড়া মাসী কস্মিনকালে আলু কিনবে না–আলু ছাড়া আমার মেয়েরা এক গাল ভাতও মুখে তোলে না, সে তো জানই। না, ও যার যা তার তা থাকাই ভাল। এতকাল পরে খাওয়া নিয়ে অসরস করতে রাজি নই আমি।’

সুতরাং–সেই প্রথম দিনটা যা ওঁর সংসারে খেয়েছিল ওরা, তারপরই আলাদা উনুন পেতেছে রানী। কয়লার উনুন পেতেছে–পাতার জ্বাল কি কাঠের জ্বাল ওরা দিতে পারবে না। মাসে দু’মণ কয়লাই লাগে। গা-করকর করে শ্যামার–এই একটা টাকা তাঁকে দিয়ে স্বচ্ছন্দে পাতা জ্বালাতে পারত ওরা!

তবে কয়লার উনুন জ্বলে অনেকক্ষণ। ওদের রান্না হয়ে গেলে যা আঁচ থাকে তাতে প্রায়ই এটা-ওটা-ওটা করে নেন শ্যামা। নিজেকে আর বেলায় নতুন করে পাতার উনুন জ্বালাতে হয় না। তবুও, ওরা যে মধ্যে মধ্যে ওঁর পাতা কাঠ বেলদো ব্যবহার করে উনুন ধরাবার জন্যে–সেটা লক্ষ করে একটা অকারণ উষ্মাও অনুভব করেন। অত পাতা যে কখনও তাঁর শেষ হবে না, তা তিনি মানতে প্রস্তুত নন। যদি তিন বছর তিনি বিছানায় পড়েই থাকেন, কে অত গরজ করে পাতা কুড়িয়ে জড়ো করবে? জড়ো করেন বলেই এত দেখায়–নইলে কলসীর জল গড়িয়ে খেলে কদিন থাকে?

খাওয়া-দাওয়া একত্র হ’লে যে টাকাটা জমতে পারত সে টাকার ভরসা আর রইল না। শেষ একটু ক্ষীণ আশা ছিল, মাসকাবারে ভাড়া বলে অন্তত পাঁচটা টাকাও গোবিন্দ দিতে আসবে তাঁকে। উনি নিতে চাইবেন না অবশ্য, তবে গোবিন্দ হয়ত জোর করেই রেখে যাবে। কিন্তু গোবিন্দ সে দিক দিয়েই গেল না। মাস-কাবার হয়ে গেল, মাইনে যে পুরো না পেলেও কতক কতক পাচ্ছে (চিরদিনই তিন-চার কিস্তিতে মাইনে পায় সে –তা শ্যামা শুনেছেন, তবে প্রথম কিস্তিটাই বেশি)–তা ওদের বাজার-হাট, মাসকাবারী উটনো তোলা দেখে আঁচে-আন্দাজে বুঝতে পারেন। অবশেষে যখন পরের মাসের অর্ধেকও কাবার হয়ে গেল গোবিন্দ কোন উচ্চবাচ্য করল না, তখন তিনি বাইরে প্রকাশ না করলেও মনে মনে অপ্রসন্ন হয়ে উঠলেন।

‘কেন রে বাপু, খুব তো সাউখুড়ী করে বাড়িভাড়া করতে যাচ্ছিলি–তা সে টাকার গরম আমার বেলা বুঝি একেবারে ঠাণ্ডা বরফ হয়ে গেল! বলিহারী কপাল আমার। বিচার- বিবেচনা আমার বেলাই দেখি লোকের উঠে যায়!’ মনে মনে বলেন শ্যামা।

তবে ভেতরে ভেতরে যা-ই হোক বাইরে এ আশাভঙ্গজনিত অপ্রসন্নতা এমন কি ইশারা-ইঙ্গিতেও প্রকাশ করেন না তিনি। দিদিরা আসতে যে সুবিধাটুকু হয়েছে তাঁর, তার মূল্যও কম নয়–ওরা বাড়ি ভাড়া করে অন্যত্র চলে গেলে তাঁর এক পয়সাও আয় বাড়বে না–বরং এই সুবিধা-সুযোগটুকু থেকে তিনি বঞ্চিত হবেন–এ ব্যবহারিক জ্ঞান তাঁর খুব আছে। তরুর দিকটা ছাড়াও, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও অনেক সুবিধা হয়েছে তাঁর। কান্তি ডালের বড়া পোস্ত-চচ্চড়ি ভালবাসে–শ্যামা একা এ সব ঝঞ্ঝাট কোন দিনই পেরে ওঠেন না–এখন ওদিকে হ’লে তার জন্যে তোলা থাকে। এমন কি শ্যামাও পান কিছু কিছু প্রথম প্রথম ওটা ছিল নেমিত্তিক–পরে নিত্যকার ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। শ্যামা যেটুকু তরকারি রাঁধতেন সেটুকুও কমিয়ে দিলেন। আনাজের জন্যে চিন্তা নেই, থোড় ডুমুর ডাঁটা কাঁচকলা–এ তো বাগানে আছেই–শুষুনি কলমীশাক আমড়া এরও অভাব নেই। কিন্তু শুধু আনাজ দিয়েই তরকারি হয় না, তেলমশলা লাগে। যত কমই দিন, ফোড়ন চোঁয়াবার মতো একটু তেল আর অন্তত হলুদ-বাটা–এটা লাগেই। তরকারি কম রাঁধতে হ’লে সেইটেই লাভ। বরং সেই জন্যে, প্রসন্ন মনেই সে সব শাক-ডুমুর-ভাঁটা-আমড়া এদের ঘরে তুলে দেন। রবিবারে কান্তি বা গোবিন্দ বাড়ি থাকলে তিনি নিজেই গরজ ক’রে ছিপ নিয়ে বসতে বলেন, যা দু-একটা মাছ ওঠে। জানেন যে উঠলে এবং ওদিকে রান্না হ’লে তাঁর ছেলে বা নাতি বঞ্চিত হবে না। মাছ তুললে খরচা নেই তাঁর–পাড়ার লোক তো নিত্য চুরি করে বলতে গেলে–ফাঁক পেলেই–কিন্তু মাছ রাঁধতে গেলে এক গাদা তেল লাগে। সে তেল সাত আনা দরে কিনতে হয়।…. বরং এই সব সময়ে কান্তি যখন বড়মাসিমার দেওয়া তরকারি ও মাছ দিয়ে তৃপ্তি ক’রে খেয়ে ওঠে–তখন তাঁর ছোট ছেলেটার কথা মনে হয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে। কোথায় যে গেল হতভাগা ছেলেটা! বেঁচে আছে কিনা তাই বা কে জানে। মরে গিয়ে থাকে সে একরকম, কতগুলোকেই তো যমের মুখে দিলেন তিনি–অর্ধেকেরও বেশি দিয়েছেন ঠিক ঠিক হিসেব ধরলে–কিন্তু বেঁচে থেকে কোথাও চাকরের কাজ করছে কিম্বা চুরি ক’রে জেলা খাটছে কিনা–সেই চিন্তাই তাঁর বড়। …..

লাভ-লোকসান দুটো পাল্লা মিলিয়ে অনেকবার হিসেব ক’রে দেখেছেন শ্যামা, এরা আসাতে অনেক দিক দিয়েই সুবিধা হচ্ছিল তাঁর। সেই মনে করেই ছোটখাটো অসুবিধাগুলো গায়ে মাখছিলেন না, হাসি-মুখটা বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু কোথা থেকে তাঁর চিরশত্রু মেয়েটা আবার হঠাৎ ধূমকেতুর মতো এসে হাজির হয়ে সব গোলমাল ক’রে দিল।

সেই প্রথম চিঠি লেখার পর ঐন্দ্রিলার আর কোনও খবর তিনি করেন নি। সীতার কাছ থেকে চিঠি পেয়েও–সত্যিই খুব ভারি কোন অসুখ করেছিল ওর, এ তিনি বিশ্বাস করেন নি। মেয়ের না আসবার গা–এইটেই ভেবে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। আর, যত অসুখই করুক, এতদিন ধরে ভুগছে, এ তিনি একবারও ভাবতে পারেন নি। ভেবেছিলেন, ভাল চাকরি পেয়েছে সুখে আছে, তাই আর আসতে চায় না। তিনিও আর চান নি যে ও আসুক। বরং ওকে লেখাটাই একটা বিরাট ভুল হয়ে গিয়েছিল তাঁর এইটেই মনে করতেন ইদানীং। সত্যি সত্যিই এসে গেলে বেশ কিছু টাকা বেরিয়ে যেত হয়ত–অসতর্ক মুহূর্তের নির্মিত খালে যে শেষ পর্যন্ত কুমির ঢোকে নি, এতেই ধন্যবাদ দিতেন নিজের অদৃষ্টকে।

তবু দীর্ঘ দিন পর্যন্ত একটা আশঙ্কা ছিল, একেবারে সম্প্রতি, এই মাসখানেক হ’ল সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। সে যে এত কাল পরে সেই পূর্ব পত্রের সূত্র ধরে এসে হাজির হবে একদিন, তা একবারও মনে করেন নি। বিশেষত সে যেভাবে কাপড়-চোপড়ের বেশ একটি ডাগর পুঁটুলী নিয়ে এসেছে তাতে স্থায়ীভাবে ঢোকবার মতলব বলেই মনে হ’ল। তাতে আরও গা জ্বলে গেল তাঁর

মেয়ের প্রণামের বদলে বেশ একটু তীক্ষ্ণ কণ্ঠেই প্রশ্ন করলেন তিনি, ‘তারপর? হঠাৎ–? কী মনে করে?

মার কাছ থেকে খুব হৃদ্য অভ্যর্থনা পাবার আশা অবশ্যই করে নি ঐন্দ্রিলা–কিন্তু তাই বলে এমন আক্রমণাত্মক প্রশ্নের জন্যও সে প্রস্তুত ছিল না। সে একটু থতমতই খেয়ে গেল। তারপর বলল, ‘তার মানে? তুমিই তো–বা রে!’

‘ও, সেই চিঠি পেয়ে এ্যাদ্দিন পরে তুমি মায়ের উদ্‌গার করতে এসেছ। ….ওরে আমার গোপাল রে! ….বলে, এখন মরে লক্ষণ ওষুধ দেবে ঠিক-দুপুর বেলা! চিঠির উত্তর নেই কিছু নেই–আঠারো মাস পরে উনি এলেন আমার মাথা কিনতে!

‘চিঠির উত্তর দেব কী করে–আমি বলে মরা মরা বাঁচলুম। চিঠি পেয়েই তো চলে আসছিলুম–আসব বলেই তো কোন জবাব দিই নি–হঠাৎ অমন শক্ত অসুখটা ধরে গেল বলেই– ‘

‘তা সে তো আর আমি এখানে বসে হাত গুনব না বাছা!’ শ্যামার কণ্ঠে তিক্ততা যেন আরও উগ্র হয়ে ওঠে, ‘না কি আমার বিপদটা তোমার অসুখ জেনে চুপ করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে!’

ঐন্দ্রিলা যেন হঠাৎ অত্যন্ত অসহায় বোধ করে নিজেকে। মায়ের মতলবটা ঠিক ধরতে পারে না। সত্যি সত্যিই তাড়িয়ে দেবেন নাকি ওকে?

‘তার মানে–তুমি সে সব কথা এখন উল্টে দিতে চাও বলো!… আমি যে সোনার চাকরি ছেড়ে দিয়ে এলুম।’

‘তোমার চাকরি সোনার কি রূপোর তা তো আমি জানি না বাছা, অত খবরে আমার দরকারও নেই। সোনার চাকরি ছেড়ে আসবেই বা কেন আমার কাছে পেটভাতায় খাটতে? আর তা তুমি ছেড়ে আসও নি–এত বোকা তুমি নও। এলে তখনই আসতে, এই এ্যাদ্দিন পরে উদয় হ’তে না। আসলে তারা তাড়িয়ে দিয়েছে তাই মায়ের কথা মনে পড়েছে আবার!’

‘তাড়িয়ে দিয়েছে!’ অমরবাবুর অসহায় মুখখানা মনে পড়ে যেন চোখে জল এসে যায় ঐন্দ্রিলার, ‘তেমন লোক নয় তাঁরা। দেবতার মতো মনিব আমার, আসবার সময় চোখের জল ফেলেছে। আমিই বলে তোমার এমন ধারা শুনে তাদের দিকে না তাকিয়ে চলে এলুম। সেইটে আসাই দেখছি অন্যায় হয়েছে। তারা যে সেবা আর চিকিচ্ছে করেছে-

‘তা তোমার অন্যায়ই হয়েছে বাছা। একশ’বার হয়েছে। তোমার মতো ঝগড়াটে কুচক্করে লোককে যখন অমন হ্যাঁঙ্গালি-জ্যাঙ্গালি করে চিঠি দিইছি আসতে তখনই তোমার বোঝা উচিত কী রকম আতান্তর অবস্থা আমার! সে অবস্থাতে–একটা খবর পর্যন্ত না পেয়ে, তুমি চার মাস পরে কি চল্লিশ মাস পরে তোমার মর্জি মতো দয়া করে কবে একদিন আসবে, সেই ভরসায় বসে থাকব তোমার জন্যে–এটা ভাবা খুব অন্যায় হয়েছে!’

‘তা আমি কি মিথ্যে বলছি আমার অসুখের কথাটা? হয় না হয় জিগ্যেস করবে চলো না!’

‘আমার কী এত গরজ!’ শ্যামার কণ্ঠ তীক্ষ্ণতর হয়ে ওঠে, আর সত্যি-মিথ্যের কথা উঠছেই বা কেন? যদি সত্যিই হয়- তোমারও তো ভাবা উচিত ছিল যে, এতদিন পরে তাদের অত দরকার এখনও আছে কিনা একখানা পোস্টকার্ড লিখে অন্তত উদ্দেশ করি!’

‘তা হলে তুমি সে সব যা বলেছিলে কিছুই দেবে না বলো!’

প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে ঐন্দ্রিলা।

‘দোবই না তো! কিসের জন্যে দোব শুনি! তখন এলে সে কথা থাকত। তোমার মেয়েকেও তো চিঠি দিয়েছিলুম–তাদের দু-দুটো প্রাণীর ভার নিতে চেয়েছিলুম জন্মকালের মতো… তা তার পছন্দ হ’ল না, ঝেড়ে জবাব দিলে। ব্যাস্ চুকে গেল ন্যাটা! আমারও সম্পর্কের ঐখানে ইতি। আর কি তাদের মুখ দেখব ভেবেছ?…. তোমরা মায়ে-ঝিয়ে এলে না বলে তো আমি চুপ করে বসে থাকতে পারি না আর। আমাকে তো অন্য ব্যবস্থা করতে হবে! এদের সে বাড়ি ছাড়িয়ে সংসারটাই টেনে আনতে হ’ল এখানে, আবার আমি তোমার পেছনে এতটি খরচ করতে যাব কী জন্যে শুনি!’

মেয়ের চিঠির কথাটা ঐন্দ্রিলা জানে। সে ওখান থেকে সিধে মেয়ের কাছেই গিয়েছিল। সেখানে কদিন থেকে এখানে এসেছে সে। মেয়ের কাছে তাকেও চিঠি লেখার খররটা শুনেই আরও নিশ্চিত হয়েছিল। মায়ের দরকারটা খুবই বেশি, নইলে সীতার সব ভার নিতে চেয়ে আসতে বলতেন না।… এর মধ্যে বড়দাদা সংসার তুলে এখানে আসবে তা ভাবে নি সে।…

ঐন্দ্রিলা পাথরের মতো সেইখানেই বসে রইল–অনেকক্ষণ। একবার মনে হ’ল সে মেদিনীপুরেই ফিরে যায়। তা গেলে চিরকালের মতোই হিল্লে হয়ে যেতে পারে, তারও মেয়েরও। কিন্তু সে ঐ একবারই। সঙ্গে সঙ্গেই মনকে শাসন করল সে। না, আর না! সে সম্ভব নয় আর। যা আছে অদৃষ্টে হবে, না হয় চাকরিই একটা খুঁজে নেবে সে। তার অদৃষ্টই এই–মাঝে কটা মাস সুখভোগ, ওটা স্বপ্নে-দেখা ঘটন বলে ধরে নেওয়াই উচিত।

শ্যামা হ্যাঁ না আর কিছুই বললেন না। মহাশ্বেতার ভাষায়–আবাহনও না, বিসর্জনও না। ঐন্দ্রিলাকে চলে যেতেও বললেন না, ঘরের মধ্যে আসতেও বললেন না। ব্যাপারটা বিশ্রী দাঁড়াচ্ছে দেখে কমলাই এগিয়ে এলেন এবার। জোর করে ওকে ঘাটে পাঠালেন কাপড় কেচে আসতে। নিজেই গুড় গুলে একটু শরবত ক’রে দিলেন। তারপর চুপি চুপি ইশারা করলেন একেবারে কাজে লেগে যেতে। সে উদ্যোগী হয়ে রান্নাবান্না শুরু করলে শ্যামা আর কী বলবেন?

ঐন্দ্রিলাও সে ইঙ্গিতটাও বুঝল। নিজেই উঠে চাল মেপে নিয়ে ঘাটে চলে গেল ধুতে।

॥৩॥

ঐন্দ্রিলা এবার একটু ঘটা ক’রেই কাজকর্ম শুরু করল। রানীকেও কিছু করতে দেয় না সে, বলে, ‘ওমা, কেন, আমি থাকতে–। তোমার তো এই শরীরের হাল। ঘরটা দালানটা মোছা কি ঝাঁট দেওয়া, এটা আর আমার দ্বারা হবে না!’

রান্নাবাড়া ঘরের বাসি পাট সেরেও আজকাল সে এটা-ওটা ক’রে দেয় মায়ের। বাগানে ঠেকো দেওয়া, দু-একটা চারা নেড়ে বসানো, মাচা-টাচাগুলো মেরামত করা–এ সব আগে সে একদমই হাত দিত না, এখন নিজেই ঘুরে ঘুরে করে বেড়ায়। মনে হয় পাতা কুড়োতে বা নারকেলের-পাতা চাঁচাতেও তার আপত্তি নেই–নিহাৎ বড় স্পষ্ট তোষামোদ হয়ে পড়ে বলেই নিজে থেকে এগোয় না, শ্যামা একবার নিজে থেকে বললে তাও করতে পারে।

কিন্তু শ্যামা সেদিক দিয়েই যান না। মেয়েকে তিনি চেনে, তাকে একবার তাঁর তরফ থেকে তুচ্ছতম কাজে লাগালেও জোর পেয়ে যাবে সে। সেই একটা যে-কোন সুযোগেরই অপেক্ষা করছে, তাও তিনি জানেন। সেই সুযোগটাই তিনি দিতে রাজি নন। তার উপস্থিতিটাই যেন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে চান তিনি। একেবারে নিশ্চিদ্র রকমের উদাসীন থাকেন কন্যা সম্পর্কে। স্নান করে কাপড় ছাড়তে ছাড়তে মেয়ে যদি ঠাঁই করে ভাত বেড়ে না রাখে তাহলে নিজেই সে ভাত বেড়ে নেন, মেয়েকে বলেন না বেড়ে-দিতে, অথবা রানী কি কমলাকে দিয়েও বলান না।

তাঁর এতদূর কাঠিন্যের আরও কারণ ছিল। মেয়ের তরফ থেকে শুধু দাবি বা জোর পেয়ে যাওয়াই সব নয়।

সেটা কমলা বুঝতে পারেন না কিন্তু রানী বোঝে। বলে সে বুঝিয়ে শাশুড়ীকে। যদিও এত ছোট কথা বলতে তার মুখ রাঙা হয়ে ওঠে। কমলা দরিদ্র কিন্তু ছোট নন, রানীও তাই এত সঙ্কীর্ণতাতে অভ্যস্ত নয়।

ঐন্দ্রিলা আসার পর থেকে এদিকে পুরোদমে রান্নাবান্না শুরু হয়েছে। ইদানীং দুপুরে রান্নার পাট তুলেই দিয়েছিলেন শ্যামা; কান্তি ভোরে ভাত খেয়ে যায়, সেই সময়েই একেবারে ভাত রান্না করে নেন সকলের মতো। সে অবশ্য ভাতে-ভাতই খায় বেশির ভাগ, কোন দিন একটা তরকারি হয়ে যায়। তাই দিয়েই তরু আর তার ছেলেকে খাইয়ে দেন সকাল সকাল। নিজে যখন খেতে বসেন তখন ওদের উনুনে আঁচের অবস্থা দেখে একটা তরকারি কি একটু বাটি চচ্চড়ি বসিয়ে দেন। সেক্ষেত্রে তাই থেকেই একটুখানি ঢেলে রেখে দেন বিকেলের জন্যে। অর্ধেক দিন সেটাও চড়াতে হয় না। কমলাদের হেঁসেল থেকে যা পাওয়া যায় টুকটাক্ তাইতেই চলে যায়। রাত্রেও, ওদের রান্না সকাল করে চোকে। কান্তি আর তার নাতি বলাইয়ের সওয়াখানা প্রাণীর ভাতটা–এতটুকু ডাল কি একটা কাঁচকলা ভাতে দিয়ে ওদেরই মরা-আঁচে বসিয়ে দেন। অনেক সময় সে বসিয়ে দেবার কাজটাও রানীই সেরে দেয়। তরকারি সকালের না থাকলে আর করবার চেষ্টাও করেন না–ওধার থেকে কান্তির জন্যে যা তোলা থাকে–তাই ঢের। বৈধব্যের অজুহাতে তরুকে রাত্রে কিছুই খেতে দেন না প্রায়, নিজের সঙ্গে ওকেও তেল হাত বুলিয়ে চালভাজা বা ক্ষুদ ভাজার নাডু–এই দেন, সে কোন দিন খায়, কোন দিন খায় না। সব ছড়িয়ে ফেলে দেয়। ঐ ডবকা মেয়েটা অমন টাঙ্গিয়ে থাকে–তার সামনে নিজে রুটি নিয়ে খেতে বসতে কমলার লজ্জাই করে। তিনিই প্রায়ই বলেন ‘ওকে দুটো ভাত দিলেই পারো, পাগলের আর বিধবা সধবা কি, এমনি তো যার-তার পাত থেকে তুলে খাচ্ছেই–মিছিমিছি খাড়া উপোস দিয়ে রাখা–

শ্যামা সে কথা কানে তোলেন না। বেশি বললে জবাব দেন ‘সে নিজে থেকে তুলে খায় আমাদের অজান্তে–সে আলাদা কথা। কিন্তু তাই বলে বামুনের ঘরের বিধবা–তার পাতে আমি ভাত বেড়ে দিতে পারব না। আর লোকে জানলে কি বলবে, সে ভারি নিন্দে হবে পাড়া-ঘরে।’

কিন্তু ঐন্দ্রিলা আসাতে সব উল্টেপাল্টে গেছে। এখন রীতিমতো দুবেলাই রান্না হয়। ডাল হয় একদিন-দুদিন অন্তরই। তাছাড়া তরকারিও–যতই সেদ্দপক্ক রান্না হোক– থোড়-সড়সড়ি, শুষুনি শাকের ডালনা আর কচুর শাক–এক-আধ ফোঁটা তেল লাগেই। তাছাড়া ঐন্দ্রিলা খুব কমিয়েও শ্যামার মতো মিতব্যয় করতে পারে না। এর ওপর, আজকাল প্রায়ই সন্ধ্যের দিকে চাল-ডালের ক্ষুদ ভিজিয়ে সরুচাকলি করে সে–আসলে পরের বাড়ি থেকে রাত্রে খাওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে–শুধু দুগাল মুড়ি চিবিয়ে থাকতে পারে না। এ সবই বাজে খরচ মনে হয় শ্যামার। একটা মানুষ আসাতে একটা মানুষের অনুপাতে খরচা বাড়ে নি, অনেক বেশি বেড়েছে। হেঁসেলে রীতিমতো দুবেলা রান্না হচ্ছে দেখে ও হেঁসেল থেকেও বিশেষ কিছু আর আসে না–বরং ওদের, বিশেষত দিদিকে কিছু কিছু দিতেই হয়। অর্থাৎ ডবল লোকসান। এই সব নানা কারণেই বিরক্ত হয়ে থাকেন শ্যামা, মেয়ের উপস্থিতিটা একটুও পছন্দ হয় না তাঁর। …

শ্যামার এই কঠিন হয়ে থাকার কারণ সবটা না বুঝলেও––কিছু কিছু বুঝেছে ঐন্দ্রিলাও। সে এদিকের এত ছোট ব্যাপারটা তলিয়ে দেখে নি, বহু দিনের অনুপস্থিতিতে মার স্বভাবের অনেকগুলো কথা ভুলেও গেছে হয়ত। সে ভেবেছে যে সীতার জন্যে মাসকাবারে পাছে সে টাকা চেয়ে বসে–এই ভয়েই তিনি কিছুতে আমল দিতে চান না ওকে।

সেও কঠিন হয়ে ওঠে ভেতরে ভেতরে। সহজে ছাড়বে না সেও, এপার-ওপার দেখে নেবে। যদি যেতেই হয়, যদি চাকরি নিতেই হয় আবার–এদিকে এটা চূড়ান্ত কিছু করে যাবে।

কথাবার্তা দুজনে নেই বললেই হয়, যদিচ সেটা এমন কিছু নিয়মবাঁধা বা প্রতিজ্ঞা করা নয়। ঐন্দ্রিলা কথা কইলে শ্যামা জবাব দেন–যতটা সম্ভব সংক্ষেপে। ঐন্দ্রিলার এখানে আসবার ঠিক এক মাস পূর্ণ হতে সে গিয়ে বিনা ভূমিকাতেই কথাটা পাড়ল মার কাছে, ‘সে টাকাটা তো এবার দিতে হয়–পাঠাতে হবে আমাকে।’

তখনই তেতে ওঠেন না শ্যামা। তাঁর মুখের শিরাও কাঁপে না একটি। খুব সহজভাবেই প্রশ্ন করেন, ‘কিসের টাকা?’

‘ঐ সীতির জন্যে যেটা দেবে বলেছিলে–চার-পাঁচ টাকা। কিছুই হবে না তাদের– তবু, ওটুকুও না পাঠালে আতান্তরে পড়বে।’

‘সে তো তোমাকে সেই প্রথম দিনই বলে দিয়েছি বাছা যে, যে-সময়ে যে-অবস্থায় বলেছিলুম, সে সময়ে সে অবস্থায় এলে দিতুম। তুমি তা আসো নি, কখন আসবে আসবে কিনা–তাও লেখোনি। তার জন্যে আমাকে অন্য পথ খুঁজেতে হয়েছে। কাজেই সে কথা আর এখন তুলে কোন লাভ নেই। আর এ সমস্তই তো পরিষ্কার করে প্রথম দিনই বলে দিয়েছি। এক কথা একশোবার তুলে লাভ কি?’

শ্যামা স্পষ্ট স্পষ্ট কথা বললে কোন উষ্মা প্রকাশ পায় না তাঁর কার্যে। তিনি জানেন টাকা তাঁর সিন্দুকে, জোর করে কেউ নিতে পারবে না। মিছিমিছি মাথা গরম করবেন কেন? কিন্তু ঐন্দ্রিলাও দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুত হয়েই এসেছে। সে বলে, ‘অন্য উপায় তো তোমার বড়মাসীদের আনা। সে ওদের ওবাড়ি ছাড়তেই হ’ত, অন্য বাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না–এসে উঠেছে। তোমার জন্যে তার কোন ক্ষেতি স্বীকার করে আসে নি। আমি সব শুনেছি–একেবারে তো ছেলেমানুষ নই, অত সহজে আমাকে ভোলাতে এসো না!’

শ্যামা বলেন, ‘আমার কাউকেই ভোলাবার দরকার নেই বাছা, তেমনি আমাকেও না কেউ ভোলাতে আসে। আমি এক পয়সা দোব না। তোমাকে সেদিনই সে কথা পরিষ্কার বলে দিয়েছিলুম। তার জন্যে সতেরো গণ্ড কৈফিয়ৎ এখন তোমার কাছে দিতে আমি প্রস্তুত নই।

এর পর ঐন্দ্রিলার পক্ষে নিজ-মূর্তি ধারণ করাই স্বাভাবিক, আর তা-ই করে সে। কেঁদেকেটে চেঁচিয়ে লাফিয়ে মাথা খুঁড়ে শাপশাপান্ত করে হুলুস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে বসে। বহুদিন পরে আবার এ বাড়িতে লোক জড়ো হয়। কমলা তো কাঠ, রানীও অপ্রস্তুত। একবাড়ি বাইরের লোকের সামনে এই বিসদৃশ কাণ্ডতে সে যেন লজ্জায় মাথা তুলতে পারে না। এতকাল শুনেই এসেছে কিন্তু কোন ভদ্রলোকের মেয়ে যে এমন করতে পারে তা তার ধারণা ছিল না। হাজার হোক তারা ওর আত্মীয়–একথা পাড়ার সবাই জানে। আরও বিচলিত হয় এই কারণে যে, ঐন্দ্রিলার কঠিন কঠিন অভিসম্পাতগুলো নির্বিচারে তার বাচ্ছাদের উদ্দেশেও বর্ষিত হচ্ছে। এরা যেন জেনেশুনে যড়যন্ত্র করেই ওর মেয়ের সর্বনাশ করতে এসে বসেছে। পয়সাও’লা মাসীর মন যোগাচ্ছে। তবে ঐন্দ্রিলাও দেখবে কে কার ধন ভোগ করে। সেও সহজে মরছে না। মরবার হ’লে এবারেই মরে যেত, সেই ব্যামোই হয়েছিল তার। ভগবান অনেক রঙ্গ দেখাবেন বলেই সারিয়ে তুলেছেন!… ঐ সর্বনাশী বুড়ির ধন কাউকেই ভোগ করতে হবে না, ছেলে-মেয়ে নাকি-নাতনী জামাই-বৌ–যে যেখানে আছে গুষ্টিসুদ্ধ খেয়ে পয়সায় গেরো বেঁধে থাকবে যক্ষিবুড়ি। যদি এরা মনে করে থাকে যে মন যুগিয়ে এক পয়সাও ঐ গরো খুলে বার করতে পারবে তো প্রকাণ্ড ভুলই করেছে! উল্টে এই মতলব নিয়ে যারা তার অবীরে ছেলেমানুষ মেয়ে আর বাচ্ছা নাকিটার ন্যায্য পাওনা কেড়ে নিতে এসেছে–তাদের সর্বনাশ আগে হবে। ইত্যাদি–

কিন্তু এরা যতই বিচলিত হোক, যাঁর সর্বাধিক লাগবার কথা তিনিই সর্বাপেক্ষা নির্বিকার থাকেন। শ্যামার হাতের কাজ বন্ধ হয় না। এমন প্রশান্ত মুখে কাজকর্ম সব করে যান যেন তাঁর ধারে-কাছে কোথাও কোন চেঁচামেচি হচ্ছে না, যেন তাঁর বাড়িতে অন্তত কুড়ি-পঁচিশজন লোক এসে জড়ো হয় নি।

সেদিন ঐন্দ্রিলা রাঁধল না, সংসারের কোন কাজকর্ম, এমন কি বাসি পাটও করল না। করবে না তা শ্যামাও জনতেন। মরে মরে নিজেই সব সেরে নিলেন তিনি। পুরুষরা কাজে চলে যাবার পর ঘটনাটা ঘটেছিল, কান্তির ভাত তিনিই রেঁধে দেন চিরকাল। আজও রেঁধে দিলেন, তবে আজকাল বেলায় পুরো এক প্রস্থ রান্না হয় বলে আর সকলের ভাত সেই সাত-সকালে করে রাখেন না। তাই আজ স্নান করে এসে ভাতও চাপাতে হ’ল। অবশ্য ভাতে-ভাতই চাপালেন একেবারে। ছোট মেয়ে নাতিকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে চলে গেলেন। ঐন্দ্রিলার ভাতও নিয়েছিলেন, তবে ভাত বেড়ে ডাকতে গিয়ে গাল-বাড়িয়ে চড় খাবার মতো বোকা তিনি নন–হাঁড়িতে ভাত পড়ে রইল, ইচ্ছে হ’লে সে বেড়ে খেতে পারবে–এই পর্যন্ত।

ঐন্দ্রিলা অবশ্য উঠলও না, খেলও না অনেকটা চেঁচামেচি করার ফলে–তখন কিছু টের না পেলেও–পরে মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাইতেই ভয়ে সে চুপ করে গিয়েছিল একেবারে। আবার যদি সেই রকম হয়–ডাক্তার দেখানোর তো কোন প্রশ্ন‍ই ওঠে না, এখানে এমন কেউ নেই যে গরজ করে হাসপাতালেও দিয়ে আসবে! হাসপাতালে দিলেও বাঁচবে কি না সন্দেহ।

সারা দিন না খেয়ে বসে থাকার পর কমলাই জোর করে হাত ধরে পুকুরে নিয়ে গেলেন, নিজে মাথায় জল ঢেলে দিলেন। তারপর গিয়ে ভাতেও বসালেন। ভাত খেয়ে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল ঐন্দ্রিলা, তখনও তার মাথা ব্যথা করছে।

পরের দিন সকালে উঠে কিন্তু অন্য দিনের মতোই স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম শুরু করল আবার। কমলারা মনে করলেন সুবুদ্ধি হয়েছে, মিছিমিছি ঝগড়াঝাঁটি করে লাভ নেই বুঝতে পেরেছে–কিন্তু শ্যামা অত সহজে ভুললেন না। তিনি জানতেন এত সহজে হাল ছাড়বার পাত্রী তাঁর মেয়ে নয়। হাল ছাড়লে চলবে না ওর। নিশ্চয় বৃহত্তর কোন সংগ্রামের জন্য সে প্রস্তুত হচ্ছে। তিনি শঙ্কিত হয়েই রইলেন একটু।

আর, দু-একদিন যেতে না যেতে দেখা গেল তাঁর আশঙ্কাই ঠিক। এবার মাকে আঘাত করবার পরোক্ষ কিন্তু অভ্যর্থ পথটাই বেছে নিল ঐন্দ্রিলা। একেবারে যাকে বলে আদাজল খেয়ে লাগল কমলাদের পিছনে!

কমলা এসবে আদৌ অভ্যস্ত নন। তাঁরা বাড়িওলাদের সঙ্গে দীর্ঘকাল এক বাড়িতে বাস করেছেন, সেখানে তাদেরও নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাঁটি বা দেইজিঘাঁটা কচকচি না হ’ত, নয়–কিন্তু এ রকম অশান্তির অভিজ্ঞতা তাঁর নেই। এতটা অশান্তি যে একটা মানুষ সৃষ্টি করতে পারে এ তাঁদের কল্পনার বাইরে। কথায় যে এত ধার থাকে, তাও জানতেন না।

সত্যিই এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। উত্তর তিনি দিতে পারতেন না। দিতে পারত রানী–দু-একবার মোক্ষম উত্তরই দিয়েছে সে কিন্তু যুক্তি-তর্কে হার মানলে ঐন্দ্রিলা মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করত–চিৎকার ও গালিগালাজ। রানী তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী মেয়ে, কথা সেও সুনিপুণভাবে প্রয়োগ করতে পারে কিন্তু ইতরতায় সে পেরে ওঠে না ঐন্দ্রিলার সঙ্গে। কখনই করে নি, কমলার কাছে থেকে থেকে–ভুলেই গেছে সে যে, মানুষ এমন চিৎকার গালিগালাজ ও শাপ-শাপান্ত করতে পারে নিকট আত্মীয়কে।

আগে পুরুষদের বাড়ি থাকার সময়টা শান্ত হয়ে থাকত একটু, কিন্তু পরে সে সংযমও রইল না। গোবিন্দ ঠিক হেম নয়–চুলের ঝুঁটি ধরে দু-চার ঘা দেবে কি বাড়ি থেকে বার করে দেবে–সে ক্ষমতা তার নেই। ক্রমশ দিন এবং রাত্রি –দুই-ই দুবির্ষহ করে তুলল সে ওদের।

খবর পেয়ে একদিন মহাশ্বেতাও এল। আগে কোন্ দিন ওর কোন্ ছেলে যেন নিজে দেখে এবং শুনে গেছে এ বাড়ির অশান্তি, মাকে গিয়ে সে-ই বলেছে, ‘ওরে বাপরে, সে কী রৈরক্কার কাণ্ড! মেজমাসী দিন-রাত যেন দশবাই চণ্ডী হয়ে ধেই ধেই নাচছে! বড় দিদ্‌মা তো ঐ ভালমানুষ, সে ভয়ে মরে–এক কোণে বসে চোখের জল ফেলছে, বড়মামী সুদ্দু ঘরের কোণে কাঠ হয়ে বসে। সবচেয়ে দুদ্দশা মেয়েগুলোর, ভয়ে পাঙাশপানা হয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে শুধু। বড় মামী বলে ছেলেটা নাকি দিনে-রেতে একটি বার চোখের পাতা বুজুতে পারে না মাসির চিত্কারের ঠেলায়!

‘তা মা কিছু বলতে পারে না?’ মহাশ্বেতা ছেলের ওপরই তেড়ে ওঠে কতকটা, ‘অন্য সময়ে অন্যের বেলায় তো মার মুখ ছোটে খুব! টিট করতে পারছে না সে মেয়েকে?’

‘তুমি রেখে বসো দিকি! ঢিট করবে! মেজমাসীর যা অবস্থা–তেমন কিছু বলতে গেলে ঢিবঢিবিয়ে দেবে দিদ্‌মাকে। সেখানে আর দিদ্‌মার দাঁত ফোঁটাতে হচ্ছে নি। কুটুস কুটুস বাক্যি ঝাড়তে দাও–সে বেলায় দিদ্‌মা খুব আছে, এর সঙ্গে কী করবে? তুমিও যে ও নি বাপু–অনত্থক চাটটি গাল খেয়ে আসবে!’

সুপরামর্শ সন্দেহ নেই!… কিন্তু মহাশ্বেতার পক্ষে এই ধরনের পরামর্শ শুনে চুপ করে বসে থাকা হাত-পা গুটিয়ে–সম্ভব নায়। সে পরের দিনই মার বাড়ি ছুটল এবং বুঝিয়ে বলতেও গেল ঐন্দ্রিলাকে। কিন্তু ফল হল হিতে বিপরীত, ঐন্দ্রিলা একেবারে ফেটে পড়ল যেন, ‘অ. বড্ড প্রাণে লেগেছে, না? আমার মেয়েটা মরে যাক, শোকে দুঃখে আত্মহত্যে করুক, আর আমি নাতির হাত ধরে দোরে দোরে ভিক্ষে করে বেড়াই–এই চেয়েছিলে, না? সেই জন্যেই কুটনী-গিরি করে শত্তুরদের এনে বসিয়েছ! তোমাকে আমি চিনি না, মুড়কীমুখী শয়তান! বাইরে অমনি তোমার মতো ভালমানুষ ভিজেবেড়াল–ভাজা মাছটি উলটে খেতেও জানি নি–এমনি সেজে থাকতে পারি না বলেই তো আমরা মন্দ সকলের কাছে। তুমি কি কম কুচক্কুরে? তোমাকে আমি দস্তুরমতো চিনে নিয়েছি। মেয়েটার বে থেকে শয়তানি খেলছ আমার সঙ্গে। তোমাদের ও রাবণের ঝাড় গিয়ে দাঁড়ালে ওদের সাধ্যি কি ছিল ঐ ঘাটের মড়ার সঙ্গে বে দেয়! তা তো নয়–দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখেছিলে! বেশ জব্দ হচ্ছে, হোক!… কেন, তোমাদের কী এত শত্তুরতা করেছিলুেম আমি, কী এমন বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছিলুম? নাকি বুকে বাঁশ দিয়ে ডলেছিলুম তোমাদের! যে বার বার আমারই সব্বনাশ করতে চাইছ! এত দেখেও আশ মেটে নি, পাছে আমি একটু আশ্রয় পাই, পাচ্ছে অবীরে মেয়েটার একটু হিল্লে হয়–তাই এই কুকে শত্রুরদের এনে ঢুকিয়েছ কোটনা-গিরি করে!… ভাল হবে না, ভাল হবে না–এই বলে দিলুম। আমার সব্বনাশ করে মজা দেখবে ভেবেছিলে, নিজের সব্বনাশ তো তার আগে দেখতে হ’ল! এখনও চন্দ-সূর্যি উঠছে ভেবে রেখো, পরের মন্দ করতে গেলে নিজের মন্দ আগে হয়! বলি, এতটি তো ডুবল! বড়লোক হবে ভেবেছিলে, সব তো গৰ্ভস্রাবে দিয়ে বসে রইলে! ওতেও হবে না, আরও বাকি আছে বলে দিচ্ছি! আমার মতো হাত হয়ে আমার মতো কেঁদে কেঁদে বেড়াতে হবে রাস্তায় রাস্তায়!’ ….

‘ষাট! ষাট! ওমা এ কী সর্বনেশে কাণ্ড গো! কী হবে মা, হে মা সিদ্ধেশ্বরী রক্ষে করো মা! হে বাবা কুণ্ডুদের ঠাকুর, মা রাজাদের অন্নপূর্ণো–বাচ্ছাদের বাঁচিয়ে রাখো মা। হাতের নোয়াটুকু বজায় রাখো মা। বৌটাকে দিয়ে নিসিঁদুরের বেরতো নেওয়াবো মা। ….রাম রাম। বাবা, ঝকমারী হয়েছিল আমার এখানে আসা–’

বলতে বলতেই পা পা করে পিছিয়ে বেরিয়ে যায় মহাশ্বেতা। তার পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে, তবু বাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়তেই শুরু করে বলতে গেলে–একেবারে সিদ্ধেশ্বরীতলায় গিয়ে প্রথম দম নেয়।

সেখানে অনেকবার নিজের নাক-কান মলে, মন্দিরের রকে নাক-খত দিয়ে কেঁদে পূজো মানসিক করে তবে খানিকটা সুস্থ হয় সে। বাড়ি যেতে যেতে বহুবার আপন মনে প্রতিজ্ঞা করে নেয়, ‘বাবা, এই নাক কান মলা, খেঁদি থাকতে আর যদি কোন দিন ওবাড়িমুখো হই! এবার গেলে আমায় নাম বদলে রাখে যেন সকলে!

।।৪।।

অবশেষে রানী নিজেই ঘর খুঁজতে বেরোয়। মাত্র কিছুদিন আগেই হেমের চিঠি পেয়েছে সে; হেম খুশি হয়ে লিখেছে, ‘তুমি এসে আমাদের বাড়িতে আছ, এ যেন ভাবতেই পারছি না! মনে হচ্ছে এতদিনে আমাদের বাড়ি কেনা সার্থক হ’ল।’ বড়মাসিমার অনেক খেয়েছি অনেক নিয়েছি আমরা,–অসময়ে যে এইটুকুও কাজে আসতে পারলুম–এইটেই ভাগ্য বলে মনে হচ্ছে। তোমাদের চিঠি পেয়ে পর্যন্ত ছটফট করছি, এক-বার সকলে মিলে থাকব কটা দিন–তা কিছুতেই ছুটি পাওয়া যাচ্ছে না। বহু লোক এ সময়ে ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে আছে, আর কাউকে ছুটি দিতে চাইছে না শালারা।’…. আরও অনেক কথা লিখেছে। চিঠি পড়তে পড়তে রানীর মনটা চলে গিয়েছিল সেই সুদূর অতীতে, তার প্রথম বিবাহিত জীবনে, মুগ্ধ ভক্ত যখন নিঃশব্দে নীরব দুটি চোখে প্রীতির অর্ঘ্য সাজিয়ে বসে থাকত শুধু, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। প্রেম?…. না, প্রেম নয় তা রানী জানে। শুধুই মুগ্ধতা, শুধুই তন্ময়তা। সেইটেই আরও ভাল লেগেছিল সেদিন। আজ শরীর ভেঙে আসছে যখন– আরও বেশি করে যেন মনে পড়ছে হেমের কথাটাই। অমনি একটি চিরন্তন ভক্ত দরকার এখন–যার ওপর ভরসা করা যায়, যে স্বার্থের বা প্রয়োজনের খাতিরে ভালবাসে নি, ভাল লেগেছিল বলেই ভালবেসেছিল।

হেমের বাড়ি, তাদের আশ্রয়ে থাকতে পারলে বোধ হয় ভালই হ’ত। রানীদের যা অবস্থা, তাতে পাঁচ-সাতটা টাকা ভাড়া বাঁচলেও যথেষ্ট উপকার হয়। কিন্তু তা হ’ল না, হওয়া সম্ভব নয়। এখানে থাকলে তার ছেলেমেয়েরা বাঁচবে না। ঐন্দ্রিলার যা বিষ তাদের সম্বন্ধে- –ও সব করতে পারে! বিদ্বেষে আর ঈর্ষায় যেন পাগল হয়ে গেছে। মাসী কিছু বলছেন না, ভালই করছেন–যদি একটা কথাও বলেন তাদের দিক টেনে, কি ওকে বকাবকি করেন, বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার কথা তোলেন–তাহলে নির্ঘাৎ ও বিষ দেবে রানীর বাচ্ছাদের।

বাপ রে! ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।….

গোবিন্দকে দিয়ে কিছুই হবে না। অনেক বলেছে রানী, কান্নাকাটিও করেছে কিন্তু কিছু ফল হয় নি। গা-ঝেড়ে উঠে কষ্ট করে বাড়ি খোঁজা–তার দ্বারা হয়ে ওঠে নি। এর মধ্যে দুটো রবিবার রানী ওকে ঠেলে বিকেলে বাইরে পাঠিয়েছিল, ঘোষালদের বাড়ি আর চৌধুরীদের বাড়ি বসে আড্ডা দিয়ে ফিরে এসেছে, বলেছে, ওদের সব বলে রেখেছি, তেমন সুবিধে-মতো পেলেই খবর দেবে।’ সুতরাং ওর ভরসায় থাকা বৃথা। ও বাড়ির বড় ঠাকুরজামাই ওদের চিরকালের ভরসা, আগে হ’লে মুখের কথা খসালেই হ’ত, এতদিনে বাড়ি খুঁজে ওদের বসিয়ে দিয়ে আসতেন সেখানে–কিন্তু ইদানীং বড্ড ভেঙে পড়েছেন যেন–তাঁকে ফরমাশ করতেই মায়া হয়।

না, রানীকেই এ ব্যবস্থা করতে হবে। এখানে করাও সুবিধা, এ কলকাতা শহর নয় যে, পাড়া-ঘরে বেরোলে নিন্দে হবে। সেখানে পথ-ঘাটও চেনা যায় না, হকচকিয়ে যেতে হয়। তাছাড়া আলাপই বা কার সঙ্গে ছিল তাদের? এখানে–সকল বাড়ি বয়ে সেধে এসে আলাপ করে যায়। আলাপ করে গেছেনও অনেকে–চটখণ্ডী-গিন্নী, মল্লিক-গিন্নী, জীবন চাটুয্যের মা, অনেকেই দুবার-তিনবার এসে গেছেন এর মধ্যে। এখন তাঁদের বাড়ি একবার বেড়াতে যেতে কোন বাধা নেই, বরং যাওয়াই উচিত।

সে একদিন দুই মেয়েকে শাশুড়ীর হেপাজতে রেখে ছেলে কোলে করে বেরিয়ে পড়ল। কমলা খুবই বিস্মিত হলেন–এ রকম দুঃসাহস তাঁর ধারণারও অতীত–কিন্তু বাধাও দিলেন না। শ্যামাও আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন–সঙ্গে সঙ্গেই এ বেড়াতে যাওয়ার আসল কারণটা অনুমান করে নিলেন তিনি, মনও খারাপ হয়ে গেল খুব–কিন্তু তবু লজ্জায় কোন প্রশ্ন করতে পারলেন না। অথচ এ যা হাড়াই-ডোমাই কাণ্ড নিত্য চলেছে বাড়িতে–তার পর যদি ওরা অন্যত্র উঠে যাবার কথা ভাবে তো ওঁদের দোষ দেন কী করে? অনেক ভেবেছেন শ্যামা, কদিন ধরেই ভাবছেন, অথচ এই কাণ্ড বন্ধ করারও কোন পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। একমাত্র ভরসা সেই আশার আলোটিকে প্রাণপণে আঁকড়ে আছেন তিনি–টাকার অভাব হ’লে ওকে চাকরি খুঁজতেই হবে। এবং চাকরি পেলে চলে যেতে হবে। মেয়েকে টাকা না পাঠালে চলবে না অন্তত ঐন্দ্রিলা না পাঠিয়ে থাকতে পারবে না। চাকরি ছাড়া সেই নগদ টাকা পাওয়ার অন্য পথও কিছু নেই। এই একটি মাত্র সুযোগ ওর হাত থেকে অব্যাহতি পাবার যাতে কোনমতে না ফসকে যায়, সেজন্যে শ্যামার হুঁশিয়ারিরও শেষ নেই। আজকাল কোমরে একটা ঘুন্সী করেছেন। সিন্দুকের চাবি সেখানেই বেঁধে রাখেন দিন-রাত। ও যা মেয়ে, চুরি করার চেষ্টাও কিছুমাত্র বিচিত্র নয় ওর পক্ষে।

রানী প্রথম দিন বেরিয়েই বাড়ির সন্ধান করল একটা। ভাড়া একটু বেশি, দশ টাকা চাইছে–তবে ছোট হ’লেও প্রায় নতুন বাড়ি। এখান থেকে কাছেও বটে, এই দক্ষিণ পাড়ায়। কিন্তু তার চেয়েও একটা ভাল সন্ধান দিলেন চটখণ্ডীগিন্নী, ঐ দক্ষিণপাড়াতেই একটা ছোট্ট বাড়ি বিক্রি আছে। গোটা দুই ঘর, একটা চালা রান্নাঘর, জমি অবশ্য খুবই কম, চার-পাঁচ কাঠার বেশি হবে না, কিন্তু একটা পুকুরের একটু অংশ আছে ঐ সঙ্গে, আয় তার যেমনই হোক। বছরে একবার মাছ তুললেও খাজনাটা চলে যাবে–ওদের একটা কাঁচা ঘাট আছে ওদের দিকে, সেইটেই বড় লাভ। পুকুরসরা কেউ বন্ধ করতে পারবে না। দাম কম, হাজার টাকা চাইছে, হয়ত তাড়াতাড়ি বায়না করলে আট-নশ’তেও হয়ে যেতে পারে। কারণ ওপক্ষে একটু গরজ আছে। বাড়িটা অবশ্য নতুন নয়–তবে একেবারে ভাঙা-ঝরঝরেও নয়, এখন একটু চুনকাম করিয়ে নিয়েই বসবাস করতে পারবে ওরা, বছর দু-তিনের মধ্যে হাত না দিলেও চলবে।

রানী আশা-নিরাশায় কণ্টকিত হয়ে ফিরল সংবাদটা নিয়ে। এত সস্তায় বাড়ি, এ তাদের কল্পনাতীত। এও যদি না হয় তাহ’লে এ কাঠামোতে আর হবে না। কিন্তু এই টাকাটাও কি তোলা যাবে? হাতে তো ওদের কিছুই নেই, তবু এ প্রলোভন ছাড়তেও যেন ইচ্ছে করে না। মনে হয় এ দৈবের যোগাযোগ, নইলে আজই বেরিয়ে এ খবরটা পাবে কেন?

রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর কথাটা তুলল। কমলাও ছিলেন। সব শুনে গোবিন্দ হতাশাব্যঞ্জকভাবেই ঘাড় নাড়ল, ‘নাঃ, ও আর ভেবে লাভ নেই, অত টাকা কোথায় পাব? কে দেবে?’

ব্যাকুল হয়ে ওঠে রানী, ‘ওগো অত সহজে হাল ছেড়ো না। তুমি যেন একেবারেই এলিয়ে দিয়ে আছ। এই তো অবস্থা–একটা মাথাগোঁজার জায়গা থাকলেও তবু বল-ভরসা থাকে খানিকটা। হঠাৎ যদি তোমার চাকরি যায়–কি কোন বিপদ-আপদই হয়, মাসকাবারে বাড়ি ভাড়া টানতে না পারলে তো মাল-পত্তর ক্রোক করে রাস্তায় বার করে দেবে, সেটা ভেবে দেখেছ? এ তবু বুঝলুম, খাই না খাই বুকে হাত দিয়ে পড়ে রইলুম, কেউ বলবার নেই।… একটু ভাবো!’

‘কী ভাবব বল’, গোবিন্দ একটু ঝেঁঝেই ওঠে, ‘আমার হাতে পাই-পয়সাও নেই– পোস্টাপিসের একটা খাতায় বোধ হয় একটা টাকা পড়ে ছিল, সে কী হয়েছে তাও জানি না। ধারও কেউ দেবে না। এখন তোমরা পারো, হাতে কিছু থাকে ভাবো, ভেবে দ্যাখো ভাল করে!’

কোনপ্রকার অপ্রীতির সূত্রপাত দেখলেই কমলা সিঁটিয়ে ওঠেন। তিনি একটু ভয়ে ভয়েই বললেন, ‘তা হ্যাঁরে, আমার সেই টাকাটা–তার কি কোন গতি হবে না?’

এই টাকাটার ইতিহাস আছে। বিধবা হবার পর প্রায় ষোলশ’ টাকার মতো–সব গহনা ও জিনিসপত্র বেচে–কমলা গোবিন্দর মনিবের কাছেই রাখেন, টাকাটা খাঁটিয়ে মাসে মাসে সুদ হিসেবে তিনি যে টাকাটা দিতেন তাইতেই সংসার চালাতেন কমলা। অবশ্য তখনও তিনি মনিব হন নি, গোবিন্দর বন্ধুর বাবা, এই হিসেবেই জমা দিয়েছিলেন। তারপর গোবিন্দ চাকরিতে ঢোকার পর বিয়ে-থা ব্যাপারে কিছু কিছু আসলও নিয়েছে- কিন্তু কতটা কি নিয়েছে তার কোন ভাল হিসেব বোধ করি কোন পক্ষেই নেই। সে সুদও বন্ধ হয়ে গেছে দীর্ঘকাল। সুদে মাইনেয় মিশে সবটাই তালগোল পাকিয়ে গেছে।

গোবিন্দ মুখ কালি করে অন্যদিকে ফিরে জবাব দেয়, ‘সে রকম তো কোন লেখা-পড়া করে রাখো নি, একটা হাতচিটে কি খত–ওরা বলে সব শেষ হয়ে গেছে। অথচ আমার যা হিসেব মনে পড়ে–যত দফায় যা নিয়েছি, তাতে এখনও পাঁচশ’র ওপর পাওনা। সুদের কথা তো বাদই দাও, সুদ তো বলতে গেলে আমার মাইনে বন্দোবস্ত হবার পর থেকেই আর দেয় নি। আমি নিজে একদিন কর্তাকে বলেছিলুম, তিনি বললেন, আমার তো মনে হচ্ছে কিছু পাওনা নেই, তবু একবার মনে করে দেখব। আর সুদ বাপু, সত্যি কথা বলতে কি, সুদ ধরেই তোমার মাইনে বন্দোবস্ত করেছিলুম, নইলে কি তোমার অত টাকা মাইনে হয় তখন!… এরপর আর কি বলব বলো!’

‘ওমা, তা বলবি নি–অতগুলো টাকা জলে যাবে?’

‘জলে তো গেছেই, লেখা নেই পড়া নেই–কী নিয়ে লড়ব!’

চুপ করে থাকে সকলেই। একটা হিম হতাশা অনুভব করে রানী, বুকের মধ্যেটায় যেন কেমন ব্যথা করতে থাকে তার। আশাভঙ্গে এমন দৈহিক কষ্ট হয় তা এর আগে সে কোন দিন অনুভব করে নি।

খানিকটা পরে বলে, আচ্ছা, আমার এই গহনাগুলো বেচলে কত হবে? সবই যদি খুলে দিই–হাতের পেটিজোড়াটা রেখে?’

‘ছাই হবে? কীই বা আছে। কত কাল ভাঙ্গা হয় নি, সবই তো ক্ষয়ে ঝিঁঝির- পাত হয়ে গেছে। সব গলালেও দশ ভরি হবে কিনা সন্দেহ!’

‘তা দশ ভরির দাম কত? সেদিনও তো নিতাই সেকরা এসেছিল মার সঙ্গে দেখা করতে–বলে গেল বাইশ টাকা ভরি।’

‘হ্যাঁ–বাইশ টাকা কিনতে। বেচতে গেলে আঠারো টাকার বেশি কেউ দেবে না।’

আবারও সেই অস্বস্তিকর স্তব্ধতা।

কমলা, কতকটা ভয়ে ভয়েই বলেন শেষ পর্যন্ত, ‘তা ওদের কাছে ধার বলে চাইলেও কি কিছু দেবে না? হিসেবটার কথা তোল্ না আর একবার। এধারে তো মাইনে দিলে কমিয়ে–অথচ মুখের রক্ত তুলিয়ে ছাড়ছে! তোরই কি এত গরজ, তুই গেলে তোর মতো অত বিশ্বাসী লোক ঐ মাইনেয় পাবে ওরা?

‘দেখি। একবার বলব না হয়।’ কতটা মুখ গোঁজ করে উত্তর দেয় গোবিন্দ।

পরের দিন দুপুরে রানী বলে, ‘মা, ওঁর দ্বারা ওসব বলাবলি হবে না। মানুষ চিনি তো। একের নম্বরের মুখচোরা। আপনি একবার কর্তার কাছে যান!

‘ওমা, আমি যাব কি সেখানে।’ চমকে যেন ভয় পেয়ে ওঠেন কমলা।

‘তাতে দোষ কি। এখন আপনিই তো প্রায় বুড়ো হয়ে গেছেন–তিনি তো আরও বুড়ো শুনেছি। একদিন তো নিজে গিয়েই টাকা দিয়ে এসেছিলেন। আপনি গিয়ে জোর করে বলবেন যে আমার হিসেবে ছশ’ টাকা পাওনা হয়, এত বছরের সুদ সব মিলিয়ে আটশ’ টাকা করে দিন! আমি শোধ বলে লিখে দিয়ে যাচ্ছি।… ওঁর দ্বারা এক পয়সাও আদায় হবে না।’

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে কমলা বলেন, ‘সে হয়ত গোবিন্দ রাগ করবে কি–কি করবে। রাজিও হবে না হয়ত–গেলে তো ওকে নিয়েই যেতে হবে–’

‘না, তাহলে আপনার যাওয়াই হবে না। আমি ও বাড়ির ঠাকুরজামাইকে গিয়ে বলে আসব। তিনিই নিয়ে যাবেন। আর দেরি করবেন না মা–আপনার পায়ে পড়ি। এখন ভাড়াবাড়িতে উঠে গিয়ে দশ টাকা করে ভাড়া গুণলে–আর এমন টাকা জমাতেও পারবেন না যে, কোনদিন মাথা গোঁজার মতো একটু কিছু করবেন।

‘কিন্তু–’, কেমন এক রকম ভিত অসহায়ভাবে পুত্রবধূর মুখের দিকে চেয়ে কমলা বলেন, ‘তাতে কোন দোষ হবে না তো?’

‘দোষ হওয়া-হওয়ির কি আছে। আপনার হক্কের পাওনা আপনি চাইতে যাচ্ছেন। দেওয়া না-দেওয়া তাঁদের ভদ্রতা। তা বলে আপনি কি ছোট হচ্ছেন? ও কারুর কথা শুনবেন না। উনি হয়ত রাগ করবেন কিন্তু টাকাটা–যদি দুশোটা টাকাও উদ্ধার হয়- সেও ওঁরই উপকার। আপনি রাজি হোন মা। দোহাই আপনার।’

অগত্যা কমলাকে রাজি হতে হয়। কোনদিনই কারুর কোন অনুরোধ-উপরোধ ঠেলতে পারেন না তিনি। আর এ তো নিজের ছেলের বৌ। ঘরণী গৃহিণী বলে নয়–বৌয়ের বুদ্ধি দূরদৃষ্টি এবং বিচার-বিবেচনার বহু পরিচয় বহুবারই পেয়েছেন তিনি। ও যা বলে ভালর জন্যেই বলে, আর তাতে ভালই হয়–এ বিশ্বাস তাঁর আছে।

রানী সত্যিই একদিন খুঁজে খুঁজে মৌড়ী চলে গেল। বিকেলের দিকে বড় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গেল, সন্ধ্যের মধ্যে ন্যাড়ার সঙ্গে ফিরে এল। সৌভাগ্যক্রমে সেদিনই গোবিন্দর রাত হয়েছিল ফিরতে–এ ব্যাপরটা সে টেরও পেল না।

সব শুনে অভয়পদ রাজি হয়েছে কমলাকে নিয়ে যেতে। বহু ছুটি তার পচে যায়, একদিন ছুটি নিয়েই সে যেতে পারবে, কোন অসুবিধা হবে না। রানী ফিরল প্রায় লাফাতে লাফাতে। অভয়পদ অফিস কামাই করে এ কাজ করবে তা কেউ আশা করে নি

পরের দিনই কমলা গেলেন। একে তো অত বড় জামাইয়ের সঙ্গে যাওয়া–তায় অপরিচিত বাড়িতে, অপরিচিত একটা লোকের কাছে। গোবিন্দর মুখেই শুনেছেন যে বুড়ো কর্তা আজকাল অফিসে বড় একটা আসতে পারেন না। বাড়িতেই বসে হিসেব-নিকেশ দেখেন। অফিস হলেও না হয় কথা ছিল, বাড়িতে যদি মেয়েরা বেরিয়ে আসে, তারা যদি বলে, কি দরকার, কেন, কী বৃত্তান্ত? কি জবাব দেবেন তিনি। যাবার সময়-বরাবর ভয়ে যেন দিশেহারা হয়ে গেলেন তিনি, একবার বলেই ফেললেন, ‘তুমিও না হয় চলো বৌমা, আমি–আমি যদি না সব গুছিয়ে বলতে পারি?’

কিন্তু পরক্ষণেই বুঝলেন তা সম্ভব নয়। রানীও সেই কথা বলল। সেটা ভাল দেখায় না। তাছাড়া ছেলেমেয়েদের দেখবে কে। অভয়পদর আসবার কথা–একেবারে কিছু না- বলা ভাল দেখায় না বলে–গত রাত্রে শ্যামাকেও একটু আভাস দিয়েছে রানী, তাতে শ্যামা আরও গম্ভীর হয়ে গেছেন। তাঁকে ছেলেমেয়ে দেখতে বলার সাহস আর ওর নেই।

অবশ্য কমলা যতটা ভেবেছিলেন ততটা কিছু হ’ল না। কমলাকে এতকাল পরে নিজে আসতে দেখে বুড়ো কর্তা একটু অপ্রস্তুতই হয়ে পড়লেন। আর সেই অবস্থাতেই কিছু পাওনা আছে, সেটা একবার স্বীকার করে ফেললেন। তারপর অবশ্য কতকটা সামলে নিলেও বলা কথা ফেরাতে পারলেন না–সুদ আর আসল হিসেবে মোট তিনশ টাকা তিনি দিতে প্রতিশ্রুত হলেন। তবে কমলাকে লিখে দিতে হবে যে আর কোন দাবি-দাওয়া তাঁর থাকবে না।

রানী আগেই শিখিয়ে দিয়েছিল, এরপর কমলা আর দুশটি টাকা ধার দেবার কথা তুললেন। গোবিন্দ লেখাপড়া করে দেবে–সুদ তারা দিতে পারবেন না, তবে মাসে মাসে গোবিন্দর মাইনে থেকে দশ টাকা করে কাটিয়ে দেবে। কী ভেবে তাতেও রাজি হয়ে গেছেন কর্তা, কথা রইল যেদিন দরকার তার আগের দিন খবর দিলে টাকাটা তিনি পুরোপুরি গোবিন্দর হাতে দিয়ে দেবেন।

গোবিন্দ প্রথমটা শুনে বিশ্বাস করতে পারে নি। তার মার এত সাহস হবে এবং বুড়ো কর্তাও এত সহজে টাকা দিতে রাজি হবে–এর কোনটাই বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু যখন বুঝল কথাটা সত্যি তখন সেও একটু উৎসাহিত হয়ে উঠল। রানীর সব গহনা খুলে দিল সে, সোনা-বাঁধানো এক জোড়া পাতলা পেটি ছাড়া, এটি তার মার চিহ্ন বলেই শুধু খুলল না; নইলে তাও দিত হয়ত। সব গহনা গালিয়ে দেখা গেল, গোবিন্দর অনুমানের চেয়ে কিছু বেশিই ছিল ওজনে, সব সুদ্ধ তিনশ টাকার মতোই পাওয়া গেল।

রানী ইতিমধ্যেই চটখণ্ডীদের গিন্নীকে নিয়ে সে বাড়ির মালিকের কাছে গিয়েছিল। অনেক টানা-হেঁচড়া অনেক দরদস্তুরের পর আটশ’ টাকাতেই রাজি হয়েছেন তিনি। একরকম অসাধ্যসাধনই বলতে হবে–চটখণ্ডী-গিন্নীর বাক-চাতুর্য এবং রানীর মিষ্টি হাসি ও অনুনয়-বিনয়েই এটা সম্ভব হল। তবে তিনি একটি শর্ত করলেন, দুদিন পরেই ভাল দিন আছে, সেইদিন অন্তত দুশ’টি টাকা দিয়ে বায়না করতে হবে। তবেই ও দামে ছাড়বেন তিনি। রানি তাতেই রাজি হয়ে এল। কর্তাকে বলে টাকা আনতে দেরি হবে, গহনা বেচার টাকা থেকেই সে বায়নার টাকা দিয়ে এল। বায়না লেখাপড়া করিয়ে দিলেন মল্লিক-গিন্নীর মেজ ছেলে। গিন্নী নিজেই বললেন, ‘তুমি ভেবো না বৌমা, ও আমার উকিল নয় বটে তবে তাবড়-তাবড় উকিলের নাক কাটতে পারে। ওকেই বলেছি, সার্চ করিয়ে রেজেস্ট্রারি করিয়ে সব ঠিক করে দেবে। বলি মল্লিকদের এতবড় সম্পত্তিটা ওই বজায় রেখেছো তো গা। আইন-কানুন সব ওর হাতের তেলোয়!’

অবশ্য মল্লিক-গিন্নীই বাড়িটা সম্বন্ধে একটু খুঁতখুঁত করেছিলেন প্রথমটায়। ও বাড়ি নাকি তাঁর দেখতাই এই তিনবার হাতবদল হ’ল। যে যে নিয়েছে কারুরই ভাল হয় নি। এর আগের লোকটি বাড়ি কেনার সঙ্গেসঙ্গে বৌ একটা ছেলে মরেছিল। তারপরেও অবিশ্যি তিন-চার বছর ছিলেন তিনি কিন্তু কাজ-কারবারে কী গোলমাল হয়ে শেষে বেচে যেতে বাধ্য হলেন। অথচ এখন নাকি তাঁর আবার খুব বোলবোলাও হয়েছে। বিয়েও করেছেন আর একটা। এ লোকটার অনেক বিষয় ছিল, রেস খেলে সব উড়িয়েছে। এইটি ছিল, তাও তো গেল।…ও বাড়ি নেওয়া কি ঠিক হচ্ছে তাদের?

রানী উড়িয়ে দিয়েছে কথাটা, ‘জুয়াড়ি রেস খেলে যথাসর্বস্ব উড়িয়েছে, এটাও নষ্ট করবে, এ তো জানা কথা মাসীমা, তার জন্যে বাড়ির দোষ কি! আর বৌ মরা–’, একটু মুকি হেসে বলেছে, ‘সে তো ভাল কথাই, আপনারা দাঁড়িয়ে আর একটা বিয়ে দিয়ে দেবেন। ভাগ্যবানের বৌ মরে মাসীমা, তার জন্যে আপসোস কি? তবু মাথাগোঁজার জায়গাটা তো হয়ে রইল!’

‘ষাট! ষাট! ও কথা বলো না মা, বৌ মলে ঘাটের মড়ারও বে হয় জানি–কিন্তু তোমার মতো বৌ আর পাবে কি আমাদের ছেলে!’

আট শ’ টাকা বাড়ির দাম, আট শ’ টাকার মতো অবশ্য সংস্থান হয়েছে। কিন্তু আরও কিছু চাই। সার্চ করার খরচা আছে, রেজেস্ট্রি আছে, বাড়ি চুনকামের খরচা আছে। খুব কম করেও অন্তত আর একশটি টাকা প্রয়োজন। এটা আসবে কোথা থেকে?–গোবিন্দ প্ৰশ্ন করল। শেষে কি ঘটিবাটি বেচতে হবে? তাতেও এত টাকা উঠবে কিনা সন্দেহ। বাসন বেচতে গেলে সিকির সিকি দামও মেলে না।

রানী অবশ্য আগেই জানে। টাকা তো আরও লাগবেই ঢের। কথাটা নিয়ে অনেক ভেবেওছে সে। একটা জোর তার ছিলই মনে মনে–সেই জোরেই এতদূর এগিয়েছে। কিন্তু কাউকেই বলে নি সেটা, নিজের অন্তরের নিভৃততম কোণে সেই আশ্বাসটিকে লালন করছিল সযত্নে। হেম–হেমকে সে লিখলে নিশ্চয়ই টাকাটা দেবে সে–এটা রানী জানত। কিন্তু অতটা জানত বলেই বোধ হয় শেষ মুহূর্তে কেমন একটু সঙ্কোচে বাধল। ওটা তো আছেই–কিন্তু অন্যত্র চেষ্টা শেষ করার আগে ওদিকে সে হাত বাড়াবে না।

এবার রানী বলতে গেলে চরমতম দুঃসাহসেরই পরিচয় দিলে। শ্যামাকে গিয়েই ধরলে সোজাসুজি, বাড়ি কেনার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে জানিয়ে একশটি টাকা ধার চাইলে। একেবারে গোড়াতেই বলে দিলে, ‘শুধু হাতে ধার নিচ্ছি মাসীমা, আপনি বরং দেড় টাকা করেই সুদ নেবেন।’

প্রথমটা শ্যামা মনে মনে বেঁকে দাঁড়িয়েছিলেন। ওরা বাড়ি করে চলে যাওয়া মানে তাঁর আবার সেই দুরবস্থা। ঐন্দ্রিলার কবলে গিয়ে পড়া। তখন হয়ত সত্যি সত্যিই টাকা দিয়ে তাকে আটকাতে হবে। নিজের অনিষ্ট যাতে হবে তার খরচ তিনি কেন যোগাবেন শুধু শুধু? থাক না–যেখানে পারে নিক না! তিনি কেন নিজের ক্ষতির পথ নিজে প্রশস্ত করে নেবেন?

কিন্তু তারপরই বুঝলেন–এ মেয়ে সহজ নয়। যখন এত কাণ্ড করে বাড়ি এবং বাড়ি কেনার টাকা যোগাড় করতে পেরেছে তখন একশ’টা টাকার জন্যে কিছু ওর সব আটকে থাকবে না। যেমন করেই হোক যোগাড় করে নেবে। মাঝখান থেকে তিনি কেন অপ্ৰিয় হন–? আর সুদটাও খুব কম দিতে চাইছে না। কী লাভ অসরস ক’রে–মনকে বোঝান নিজেই।…

চুপ করে আছেন শ্যামা, মনে মনে তোলাপাড়াই করছেন। রানী সেটাকে ভুল বুঝল। সে একেবারে ওঁর একটা পা চেপে ধরল, ‘দোহাই মাসীমা, ইনিও আপনার সন্তান, আপনিও এককালে পরের দোরে কম দুঃখ পান নি, আপনি বুঝবেন। এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে বাস করা–যদি একটু মাথা গোঁজার জায়গা হয় আপনার দয়ায় তো আপনার একটা সৎ কাজই হয়ে থাকবে।’

‘ওমা ছি ছি, এর জন্যে পায়ে হাত কেন মা!’ একটু যেন অপ্রতিভই হয়ে পড়েন শ্যামা, ‘ধার দিচ্ছি, সবাইকেই দিই––তোমাদের কেন দোব না?… তা নয়, তবে আমার তো নিজের কিছু নেই মা তা তো জানই, যা নাড়াচাড়া করি–দুই মেয়ের টাকা। গোবিন্দকে ব’লো একটা হ্যাণ্ড নোট যেন দেয়–আর বাড়ি রেজেস্টারি হয়ে গেলে পাঠাখানা যেন আমার কাছেই রেখে দেয়, যতদিন না টাকাটা শোধ হয়।’

নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল রানী। শেষ অবধি যে হেমের কাছে হাত পাততে হ’ল না– এইটেই পরম লাভ মনে হচ্ছে। যে ভালবাসে সত্যি-সত্যিই, তার কাছে হাত পেতে টাকা নেওয়া? ছিঃ, সে বড় অপমান। ….

প্রথমটা ঐন্দ্রিলা অতটা বুঝতে পারে নি। কি একটা ব্যাপার চলছে এই পর্যন্ত তারপরই, যখন জানল যে ওরা বাড়ি কিনছে– দরদস্তুর সব ঠিক হয়ে গেছে তখন থেকেই আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে গেল। সে ঝগড়াঝাঁটি গালাগালি–কিছুই রইল না আর, যেন সে মানুষই নয়। শেষের দিকে–বাড়ি সার্চ করা, রেজেস্ট্রি করানো, মেরামত ইত্যাদিতে প্রায় দেড় মাসেরও বেশি সময় লেগে গেল ওদের–ঐন্দ্রিলা আবার গায়ে পড়েই ওদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু, করে দিল–এমন কি নিজে সেধে ওদের অর্ধেক কাজ ক’রে দিতে লাগল। গৃহপ্রবেশের দিন নিজেই ভোরবেলা উঠে গিয়ে পূজোর যোগাড় ক’রে দেওয়া, রান্না করা, ওদের খাওয়ানো–সব কাজ একা হাতেই করল একরকম।

ওর এই পরিবর্তনের কারণটা স্থুল–বুঝতে না পারার কথা নয়–এরাও বুঝল– শ্যামাও বুঝলেন। চলেই যখন যাচ্ছে–যখন তার জেদই বজায় রইল, তখন আর শত্রুতা কি? এবার তো মার আর গতি রইল না তাকে ছাড়া। তাকেই ধরে রাখতে হবে–হয়ত সীতার জন্যে কিছু টাকা দিয়েও।

কিন্তু ঐন্দ্রিলাকে যে শ্যামার তখনও কিছু চিনতে বাকি ছিল–সেটা বুঝলেন তিনি রানীদের গৃহ প্রবেশের কদিন–সাতদিন না আটদিন পরে। যেভাবে সে এসেছিল সেইভাবেই হঠাৎ একদিন দুপুর বেলা খাওয়া-দাওয়ার পর তার নিজস্ব পোঁটলাটি বগলে ক’রে বাইরের রকে যেখানে শ্যামা বসে পাতা চাঁচছিলেন সেইখানে এসে বলল, ‘তাহলে চললুম। সুখে থাকো। আপদবালাই ঝগড়াটি অলক্ষ্মী বিদেয় হয়ে যাচ্ছি। ভগবানকে বলো আর যেন এমুখো না হতে হয়।… কাছেই রইলুম অবিশ্যি, এই হাওড়ায় বাজে-শিবপুরে চৌধুরী-গিন্নীর ভাগ্নীজামাইয়ের বাড়ি। …ঠিকানার দরকার হয় তো ওখানেই পেতে পারবে।’

এই বলে, স্তম্ভিত শ্যামা ব্যাপারটা কি ঘটছে তা ভাল করে বোঝবার আগেই, দূর থেকে রকে মাথা ঠেকিয়ে একটা প্রণাম ক’রে ধীরে সুস্থে বেরিয়ে গেল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *