১৬. এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষ—নারীর সমস্যার এ কি কোনও সমাধান?

রাজস্থানের কোর্টের রায় শুনে আমি নিজেই খানিকটা চমকে উঠেছিলাম। প্রচণ্ড নারী-বিরোধী ‌ঐতিহ্য আর সনাতন সংস্কৃতি যেখানে রমরমা, কী করে রাজস্থানের মতো একটি রাজ্যে, যেখানে নারীর স্বাধীনতা অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় অনেক কম, ঘোষিত হয় এই রায়, যে, স্বামীর অনিচ্ছাসঙ্গে্েবও প্রাপ্তবয়স্ক বিবাহিত মেয়ে প্রেমিকের সঙ্গে বসবাস করার অধিকার রাখে! অবিশ্বাস্য হলেও ঘটনাটি ঘটেছে। মঞ্জু নামের মেয়ে এখন বাস করছে তার প্রেমিক সুরেশের সঙ্গে, স্বামীর সঙ্গে নয়। হাই কোর্টের দুজন বিচারক জিসি মিশ্র এবং কেসি শর্মা এই রায় দেন, যে, মেয়েদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার অধিকার থাকা কারওরই উচিত নয়।

বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির গায়ে এই রায় বড় একটি আঘাত বটে। কোনও প্রতিষ্ঠানই এতকাল এত মারমার কাটকাট চলেনি, বিবাহ যেমন চলেছে। কোনও প্রতিষ্ঠানে চিড় ধরে, ভাঙে, আবার হয়তো টিমটিম করে কিছুদিন জ্বলে, একসময় ধপ করে নিভে যায়। বিবাহের টিমটিম নেই, নিভে যাওয়া নেই। হিপি আমলে সেই ষাটের দশকে একবার লালবাতি জ্বলেছিল বটে, সেও পুবে নয়, পশ্চিমে। পশ্চিমের ছেলে মেয়েরা বিয়ে করা বন্ধ করেই দিয়েছিল। সেই লালবাতি আশির দশকে এসে সুবজ হতে শুরু করলো। রক্ষণশীলতা পা পা করে ইওরোপের দিকে দৈত্যের মতো এগোলো। পুবে তো দৈত্যদের বরাবরই জয়জয়কার।

এই পুবে, এই ভারতবর্ষে বসে কিনা আজ শুনছি আদালত বলছে, ‘কোনও মেয়েকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কারও সঙ্গে বাস করার জন্য জোর করা উচিত নয়।’ সময় যেন হঠাৎ করে একশ বছর এগিয়ে গেছে। আসলে তো কিছুই এগোয়নি। রায়টি বরং এই সমাজের চরিত্রের সঙ্গে বদ্দ বেমানান। দেশের কোনও একটি আদালতে কোনও এক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিচারক হঠাৎ একটি চমৎকার রায় দিয়ে দিলেন, এই সমাজের কিছুর সঙ্গেই যে রায়টি মেলে না, তাতে নেচে ওঠার কিছু কি আছে? যে মঞ্জু আজ প্রেমিকের সঙ্গে বাস করছে, সেই মঞ্জু কি আদৌ একফোঁটা স্বস্তিতে আছে? তাকে লোকেরা অকথ্য ভাষায় দিন রাঙ্গির গালি গালাজ করছে না? সামনে পেলে পিটিয়ে তার লাশ ফেলে দেবে, হুমকি দিচ্ছে না? নষ্ট মেয়ে, খারাপ মেয়ে, অসতী, বেশ্যা এসব কি উঠতে বসতে বলছে না? আমরা খুব সহজে অনুমান করতে পারি, যে, ভয়ংকর নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কুঁকড়ে আছে মঞ্জু। এ অবস্থায় সে নিশ্চয়ই সামান্যও উপভোগ করতে পারছে না তার প্রেমের জীবন। সুরেশের প্রেমও কি বেশিদিন টিকে থাকবে! অন্যের ‘বিয়ে করা’ বউকে ঘরে তোলার জন্য তাকে কি কম বিদ্রুপ সইতে হচ্ছে! পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন নিশ্চয়ই ছি ছি করছে। মানুষ আর কদিন বাস করতে পারে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, আর ব্যঙ্গ বিদ্রুপের মধ্যে? মেয়েরা না হয় পারে, অভ্যেস আছে। সারাজীবন এসব সইতেই তাদের সারাজীবন শেখানো হয় । কিন্তু পুরুষ তো বুক ফুলিয়ে চলার জন্য যা দরকার সবই করবে। পুরুষ-সুরেশ অসুবিধে দেখলে প্রেমিকের খোলশ থেকে যে কোনও মুহূর্তে বেরিয়ে আসবে। সুরেশ যদি ত্যাগ করে মঞ্জুকে? মঞ্জু তখন কার আশ্রয়ে যাবে? হয় স্বামী-পুরুষটির কাছে ফিরে যাবে, নয়তো অন্য কোনও নতুন প্রেমিক-পুরুষের আশ্রয়ে। এছাড়া আর কী! নারীর সমস্যার এ কি সত্যিই কোনও সমাধান, যখন তাকে এক পুরুষের আশ্রয় থেকে আরেক পুরুষের আশ্রয়ে যেতে বাধ্য হতে হয়? তার চেয়ে নারীর যদি কারও আশ্রয়ের প্রয়োজন না হত, নিজেই নিজের জন্য সে যথেষ্ট হত! কারও করুণার তোয়াত্তা না করে যদি সে বেঁচে থাকতে পারতো, নিজের আত্মসম্মান এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে, দুর্বিনীত এবং দুঃসাহসী!

যে সমাজে একটি মেয়ের শিক্ষা , স্বাস্থ্য, সম্মান কিছুই জরুরি বিষয় নয়, মেয়ের ইচ্ছের কোনও মূল্য নেই, অন্যের ইচ্ছেয় বিশেষ করে পুরুষের ইচ্ছেয় জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি যাপন করতে হয় একটি মেয়েকে, সেখানে কোনও একটি রাজ্যের আদালতের রায় একটি মেয়ের জীবনের কী এমনই-বা পরিবর্তন করতে পারে! সমাজ তো আছে আগের মতোই, আগের মতোই নারীবিদ্বেষী।

তলিয়ে দেখলে মঞ্জুর তার স্বামীর কাছে থাকা, বা প্রেমিকের কাছে থাকা—একই জিনিস। দুজায়গাতেই সে আশ্রিতা। দুজায়গাতেই তাকে নিঃশর্তভাবে নিবেদন করতে হবে তার সর্বস্ব। পুরুষদের ইচ্ছে হলে মঞ্জুকে লাথি দেবে, ইচ্ছে হলে চুমু। মঞ্জুর বর্তমান ভবিষ্যত সবই নির্ভর করবে পুরুষের চরিত্র আর মেজাজ মর্জির ওপর। একটি মেয়ের জীবনে এর চেয়ে নিরাপত্রহীনতা আর কী আছে? মেয়েদের জীবনে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তাহীনতাটির নাম ‘পুরুষ’। পুরুষ যত ক্ষতি করতে পারে নারীর, পৃথিবীতে আর কেউ তত পারে না।

নারী যতদিন নিজের জন্য নিজের আশ্রয় না হয়, ততদিন নারী নিশ্চিতভাবেই নিরাপত্তাহীন। অনেকে, জানি খুব রুষ্ট হয়ে বলবে যে, সব পুরুষ তো মন্দ নয়, কত তো ভালো পুরুষ আছে। আছে, সে আমিও জানি। এই যে পুরুষের ভালোত্বের ওপর নারীকে নির্ভর করতে হবে, সেও তো এক অসহায়তা নারীর। পুরুষের ভালোত্ব যতদিন টিকে থাকে, ততদিন নারী নিরাপদ। মন্দ পুরুষ থেকে অমন্দ পুরুষে যাওয়া, সেই অমন্দ পুরুষ থেকে আরও অমন্দ পুরুষে, চরকির মতো পুরুষের দ্বারে দ্বারে কোলে কোলে ঘোরাই কি নারীর কম্ম? কেবল পুরুষের মন্দত্ব আর নির্মমতা নিষ্ঠুরতা অত্যাচার অনাচার থেকে নয়, পুরুষের ভালোত্ব, পুরুষের দান দক্ষিণা দয়া, পুরুষের করুণা কৃপা থেকে নিজেকে বাঁচানোও কিন্তু নারীর জন্য অত্যন্ত জরুরি। পুরুষের নিষ্ঠুরতার চেয়ে কম নিষ্ঠুর নয় পুরুষের করুণা বা কৃপা। এগুলো নারীকে মুগ্ধ আর মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। নারী প্রতিবাদ করার ভাষা হারিয়ে ফেলে। বোবা বোকা বধির হয়ে পুরুষের পায়ে পুষ্পাঞ্জলি দেয়, আরও বেশি মেগালোম্যানিয়াক মনস্টার করে তোলে ওদের।

নারী কবে সহায় হবে নিজের! নারীর কবে আর প্রয়োজন পড়বে না কোনও পুরুষের কৃপার বা করুণার। সেই দিনের স্বপ্ন আমি দেখি। স্বপ্ন দেখি নারী পুরুষের সম্পর্ক বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পরস্পরের সঙ্গে শে্রদ্ধার যে সম্পর্ক, সে রকম। মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ নেই বলেই শ্রেণী বৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্য, জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতার মতো কুৎসিত জিনিস দীর্ঘ দীর্ঘ বছর ধরে টিকে আছে। দিন যত যাচ্ছে, মানুষ যত শিক্ষিত হচ্ছে, বিত্তানের উন্নততর সুবিধে যত গ্রহণ করছে, তত উবে যাওয়ার কথা তাবৎ বৈষম্য, কিন্তু হচ্ছে উল্টোটি। মানুষ যেন আরও বেশি ধর্মান্ধ হচ্ছে, আরও বেশি কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আরও বেশি সংকীর্ণ।

প্রাণীজগতে নারীই একমাত্র, যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে বাস করে তার অত্যাচারীদের সঙ্গে। আর কোন্‌ প্রাণী তার অত্যাচারীকে প্রেম দেয়, সেবা দেয় নারী যেমন দেয়? নারীর সবচেয়ে সমস্যা যে তারা বুঝতে পারে না এবং তাদের বুঝতে দেওয়া হয় না যে পুরুষ তাদের আশ্রয় হওয়ার অর্থ নারীর কোনও সমস্যার সমাধান হওয়া নয়। পুরুষ আজ হয়তো আশ্রয় দিল, কাল দেবে না। আজ ভালোবাসলো, কাল বাসবে না। আজ বলবে তুমি সুন্দর, কাল বলবে তুমি কুৎসিত। আর যাকেই বিশ্বাস কর নারী, পুরুষকে কোরো না।

কোনও পুরুষ যদি বিশ্বাসযোগ্য হয়ও, তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে রাখার জন্য নারীকে সর্বস্ব ত্যাগ করতে হয়। বেশির ভাগ সময়ই সর্বস্ব বিসর্জন দিয়েও কোনও কিছু অর্জন হয় না নারীর। সামান্য অনুকম্পাও জোটে না অনেকের। এবং এটিকে কারও মনে হয় না অন্যায়।

শুভবুদ্ধিসম্পন্ন পুরুষের অভাব বড় প্রকট। পুরুষরা রাজনীতিতে অর্থনীতিতে ত্তানে বিত্তানে শিল্পে সাহিত্যে বাণিজ্যে কর্তব্যে বিরাট বিরাট অবদান রাখছেন, সমাজে নমস্য তাঁরা, তাঁরাও কিন্তু ঘরে এসে স্ত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন, নয় অন্য নারীসঙ্গে মেতে স্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন, নয় স্ত্রীকে স্রেফ নিজের সেবাদাসী হিসেবে ব্যবহার করেন। কাকে তবে বিশ্বাস করা যায়! যদি নমস্যদেরই না যায়! আসলে সত্যি কথা কী, বিশ্বাস জিনিসটি লটারির মতো। তুমি জানো না কাকে করা উচিত কাকে নয়। কে ঠকাবে, কে ঠকাবে না। নারীকে মানুষ হিসেবে যেহেতু পুরুষ শ্রদ্ধা করে না, তাই শেষে গিয়ে নারীকে ঠকতেই হয়। এবং এটিকে অতি স্বাভাবিক একটি ব্যাপার বলেই ভেবে নেওয়া হয়। কেউ অবাক হয় না। নারী যে এত ঠকে, এত মার খায়, তারপরও পুরুষকেই বিশ্বাস করে, পুরুষের কাছেই আশ্রয় চায়। নারী যদি নিজেকে বিশ্বাস না করে, তবে চিরকালই যুক্তিহীন-বুদ্ধিহীনের মতো পুরুষকে বিশ্বাস করা ছাড়া আর তার উপায় কী আছে। নারী তার সারা জীবন তার নির্বুদ্ধিতার জন্য যত শাস্তিই পায়, সবচেয়ে বড় শাস্তি তার এটিই যে পুরুষকে বিশ্বাস করতে হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *