শফিক অফিসে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিল। নীলু এসে বলল, এখানে তোমার একটা সই লাগবে।
কিসের সাই?
লাগে, কিন্তু স্বামীর দরখাস্তে স্ত্রীর কোনো সিগনেচার লাগে না-অদ্ভুত निহাभ-दकानूনা!
শফিক গম্ভীর স্বরে বলল, তোমার সুইডেনের ব্যাপোর?
হ্যাঁ। আমাদের অফিসের এক জন কলিগ দশ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট আনিয়েদেবে।
খুব কাজের লোক মনে হয়।
খুবই কাজের। আমাকে একটা টিভি কিনে দিয়েছেন এক হাজার টাকা কম দামে।
বলেই নীলুজিবে কামড় দিল। টিভির কথাটা এখন সে বলতে চায় নি! এটা ছিল সবার জন্যে একটা সারপ্রাইজ। আজ সন্ধ্যায় হসমাইল সাহেবের টিভি নিয়ে আসার কথা।
শফিক বলল, টিভি কিনছ নাকি?
হুঁ।
কই, আগে তো কিছু বল নি।
তোমাদের একটা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।
ঘরে আসবে কবে?
আজই আসবে। সন্ধ্যাবেলা নিয়ে আসার কথা।
নীলু উজ্জ্বল চোখে হাসল। মনোয়ারা বাইরে থেকে ডাকলেন, শুনে যাও তো বৌমা।
কয়েক দিন ধরেই তিনি বেশ গম্ভীর হয়ে আছেন। কথাবার্তা বলছেন না। কিন্তু আজ যে-কোনো কারণেই হোক মেজাজ ভালো।
কী ব্যাপার মা?
আজ অফিসে না গেলে হয় না?
কেন মা?
আছে একটা ব্যাপার।
মনোয়ারা মুখ টিপে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলেন। নীলু কিছু বুঝতে পারল না।
কী মা, না গেলে চলে?
হ্যাঁ, চলবে না কেন? বীণাদের বাসা থেকে টেলিফোন করে দেব। ব্যাপারটা কী?
শাহানাকে দেখতে আসবে।
দেখতে আসবে মানে?
সাড়ে তিনটার সময় আসবে, ছেলের এক চাচী আর ছেলের মা।
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তার শাশুড়ি বিয়ের আলাপ আলোচনা অনেক দিন থেকেই করছেন, এটাকে সে কখনোই গুরুত্ব দেয় নি। মায়েরা মেয়ে একটু বড়ো হলেই বিয়ে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করে। এটাও সে-রকমই ভেবেছিল। এখন মনে হচ্ছে সে-রকম নয়। নীলু বলল, কই মা, আমি তো কিছু জানি না।
জানার মতো কিছু হলে তবেই না জানবে। তোমার খিলগাঁয়ের মামাশ্বশুর সম্বন্ধ আনলেন। ওরা এক জন অল্পবয়েসী মেয়ে চায়, তবে সুন্দর চায়। আর কিছুনা।
এখন বিয়ে দিলে তো পড়াশোনা হবে না।
বিয়ে না দিয়েই যেন কত পড়াশোনা হচ্ছে! কোনো মতে ম্যাটিক হয়েছে আই. এ. আর পাশ হবে না। তুমি যাও তো, শাহানাকে বলে আস। আজ কলেজে যেতে হবে না।
ছেলে কী করে?
ছেলে রাজপুত্রের মতো। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। বাবা রিটায়ার্ড ডিসটিক জজ। বিরাট বড়োলোক। ছেলের ছবি আছে আমার কাছে, দেখবো?
নীলু মন থেকে কোনো আগ্রহ দেখাতে পারছিল না, কিন্তু আগ্রহ না দেখলে তিনি অসন্তুষ্ট হবেন। নীলু দেখতে গেল। ছবি দেখে স্বীকার করতেই হল, ছেলেটি অত্যন্ত সুপুরুষ-ব্যাদের দেখলেই মনে হয়, আহ, না জানি কোন মেয়ের সঙ্গে এর বিয়ে হবে!
মনোয়ারা বললেন, ছবি কেমন দেখলে মা?
ভালো।
শুধু ভালো?
ছেলে তো খুবই সুন্দর, করে কী?
মনোয়ারা গালভর্তি করে হাসলেন। নীলু আবার বলল, ছেলে কী করে?
তোমার ধারণা, ছেলে যখন এত সুন্দর, তখন নিশ্চয়ই মাকাল ফল। আমারও সে-রকম ধারণা ছিল। ছেলে কিন্তু খুব ভালো। ওকালতি করছে। ভালো প্রাকটিস।
বয়স তো তাহলে অনেক বেশি।
না, বয়স বেশি না। এ বছরই বারে জয়েন করেছে। তুমি যাও তো বৌমা, শাহানাকে কলেজে যেতে নিষেধ করা। ওকে কিছু বলবে না। জানতে পারলে কানাকাটি চেঁচামেচি শুরু করবে।
শাহানা কলেজে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিল। নীলুকে দেখে অবাক হয়ে বলল, তুমি আজ অফিসে যাও নি ভাবী?
না।
কেন?
ভালো লাগছে না।
তাহলে আমিও আজ কলেজে যাব না।
ঠিক আছে, না গেলো।
মা বকাবকি করবে।
তা হয়তো করবেন।
করলে করুক। আমি কলেজে যাব না। আজ। তুমি মাকে একটু বলে আস। আমার মাথা ধরেছে কিংবা কিছু একটা হয়েছে।
শাহানা হৃষ্টচিত্তে ঘুরে বেড়াতে লাগল। কলেজে যেতে হচ্ছে না-এতে সে দারুণ খুশি। তার ধারণা ছিল মা কিছু বলবেন, কিন্তু তিনি কিছু বলছেন না। এ-রকম সৌভাগ্য তার খুব বেশি হয় না। সে টুনীকে সঙ্গে নিয়ে ছাদে বেড়াতে গেল।
আনিসের ঘরের দরজা খোলা। শাহানা উঁকি দিল।
কি করছেন আনিস ভাই?
তেমন কিছু না। এস ভেতরে।
শাহানা ভেতরে ঢুকল না। আনিস হাসিমুখে বলল, নতুন একটা চাইনীজ টিক, শিখেছি দেখবো?
না।
শাহানা দরজার সামনে থেকে সরে এল। আনিস বেরিয়ে এল সঙ্গে সঙ্গে।
এই যে শাহানা, তাকাও এদিকে? কি আছে হাতে? আহ, চুপ করে আছ কেন, বাল।
কিছু নেই।
গুড। এই দেখি হাত বন্ধ করলাম।
আনিস মুঠি খুলল। চমৎকার একটি গোলাপ তার হাতে। শাহানা রাগী গলায় বলল, আবার আপনি আমাদের টবের গোলাপ ছিঁড়েছেন?
গোলাপ ছিঁড়েছি কি না-ছিঁড়েছি সেটা পরে, আগে বল ম্যাজিকটা কেমন?
এই ম্যাজিকটা শেখার পর আপনি আমাদের টবের সবগুলি গোলাপ নষ্ট করেছেন। এটা ছিঁড়েছেন আজ সকালে কেমন মানুষ আপনি, বলেন তো।
আচ্ছা যাও, আর ছিঁড়ব না। কথা দিচ্ছি।
গোলাপ কি আর আছে যে ছিড়বেন? সবই তো শেষ করে ফেলেছেন। আপনার একটু মায়াও লাগে না, না?
আনিস লজ্জা পেয়ে গেল। গোলাপ গাছগুলি শাহানার খুব প্রিয়। সব তুলে ফেলা ঠিক হয় নি। শাহানার যারাগ! পড়তে সময় লাগবে। আনিস মৃদুস্বরে বলল, গোলাপটা নাও শাহানা।
আমার দরকার নেই।
টুনী হাত বাড়াল। শাহানা তাকে একটা ধমক দিল। কড়া গলায় বলল, এদিকে আয়, নিতে হবে না। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে মনোয়ারা ডাকছেন শাহানাকে। শাহানা আষাঢ়ের আকাশের মতো মুখ করে নিচে নেমে গেল।
আনিস গোলাপ নিয়ে প্রাকটিস চালাল খানিকক্ষণ। ফুলটা প্রকাণ্ড। একে ঠিকমতো পাম করা মুশকিল। কিন্তু প্রাকটিসের একটা মূল্য আছে। হাত অভ্যস্ত হয়ে আসছে। এখন সে অনায়াসে ফুলটি লুকিয়ে রাখতে পারে। গোলাপ তৈরির ম্যাজিকে সে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ হতে চায়। যেখানেই সে হাত দেবে, সেখানেই তৈরি হবে একটি রক্ত গোলাপ।
দশটার মতো বাজে। আনিসের তেমন কিছু করার নেই। শরাফ আলির কাছে গেলে কেমন হয়? ফুলের এই ম্যাজিকটি শরাফ আলির কাছ থেকে শেখা। তাকে অবশ্যি কখনোই পাওয়া যায় না। তাকে ধরার একমাত্র কৌশল হচ্ছে বারবার যাওয়া। কিন্তু শরাফ আলি যে জায়গায় থাকে, সেখানে বারবার যাওয়া সম্ভব নয়, এবং যাওয়া ঠিকও নয়।
প্রথম বার গিয়েছিল বদরুলের সঙ্গে। নওয়াবপুর রোডের এক গলিতে বদরুল ঢুকে পড়ল। নর্দমার পাশ দিয়ে যাবার রাস্তা। পচা গন্ধে গা গোলাতে শুরু করল। গলির ভেতর তস্য গলি। নবাবী আমলের বাড়িঘর সেদিকে। যে-কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়ার কথা, কিন্তু ভেঙে পড়ছে না। অধিকাংশ বাড়িরই দরজা-জানালা নেই। মোটা চট ঝলছে। দিনের বেলাতেও কেমন অন্ধকার অন্ধকার ভাব।
আনিস ঘাবড়ে গিয়ে বলল, কোথায় নিয়ে এলেন বদরুল ভাই?
আসল জায়গা।
আসল জায়গা মানে?
সন্ধ্যা না হলে বুঝবে না। ঢাকা শহরের এটা খুব-একটা খান্দানী অঞ্চল।
তারা একটি দোতলা জরাজীর্ণ লাল ইটের দালানের সামনে দাঁড়াল। বদরুল গলা উঁচিয়ে ডাকতে লাগল, শরাফ আলি ভাই আছেন? শরাফ আলি ভাই। কেউ কোনো সাড়া দিল না। বদরুল নিচু গলায় বলল, পামিংয়ের আসল লোক। ওস্তাদ আদমি। তবে শালা মারাত্মক খচ্চর।
বহু ডাকাডাকির পর নীল লুঙ্গি পরা বড়োমতো এক জন লোক বেরিয়ে এল। কাঁচা ঘুম থেকে উঠে এসেছে। তাকাচ্ছে চোখ লাল করে। বদরুল দাঁত বের করে বলল, শরাফ ভাই, ভালো আছেন?
হুঁ।
ঘুমাচ্ছিলেন নাকি?
হুঁ।
আনিসকে নিয়ে এলাম। আপনার কাছে। বলেছিলাম তো তার কথা আপনাকে। খুব বড়ো ঘরের ছেলে। আপনার কাছ থেকে দু-একটা কৌশল শিখতে চায়। সাধ্যমতো টাকা পয়সা খরচ করবে। কয়েকটা পামিং যদি
আরেক দিন আসেন।
আপনাকে তো শরাফ ভাই পাওয়া যায় না। এসেছি। যখন একটু বসি, আলাপ-পরিচয় হোক।
আরেক দিন আসেন। সাইল ভালো না।
শরাফ আলি দ্বিতীয় কোনো কথার সুযোগ না দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। বদরুল আরো খানিকক্ষণ ডাকাডাকি করল, কিন্তু লাত হল না। শরাফ আলির সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়।
ফেরবার পথে বদরুল বলল, এই লোক অনেক কিছু জানে। ম্যাজিক শিখতে হলে এর সঙ্গে লেগে থাকতে হবে। জায়গাটা খারাপ। তোমাকে ঘন ঘন। এখানে আনা ঠিক না, তবে গরজটা যখন তোমার।
লোকটা কেমন?
শরাফ মিয়ার কথা বলছ? এই শ্রেণীর লোক যতটা ভালো হতে পারে ততটাই। বেশিও না, কমও না।
শরাফ মিয়াকে আনিসের মনে ধরল। অসাধারণ পামিং জানে লোকটা। চোখের পলকে সিগারেটের প্যাকেট লুকিয়ে ফেলল। হাত উন্টে পান্টে দেখাল, হাতে সিগারেটের প্যাকেট নেই। কিন্তু হাতেই আছে-দর্শকের চোখে পড়ছে না। অপূর্ব কৌশল্য! আনিসের বিস্ময়ের সীমা রইল না। সে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার পক্ষে কি শেখা সম্ভব?
শরাফ মিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, সম্ভব না।
কেন, সম্ভব না কেন?
এসব ভদ্রলোকের কাজ না। ছোটলোকের কাজ। ভদ্রলোকের হাতের তালু ইচ্ছামতো নরম হয় না।
চেষ্টা করে দেখতে পারি।
হুঁ, তা পারেন।
প্রথম দিনেই গোলাপ লুকিয়ে রাখার কৌশল শিখিয়ে দিল। ভারি গলায় বলল, ফুলের বোঁটাটা ধরতে হয় আঙুলের ফাঁকে। ফুলটা এক বার থাকবে হাতের তালুর দিকে, এক বার থাকবে পিঠের দিকে। এইটা করতে হয় চোখের পাতি ফেলতে যত সময় লাগে তার চেয়েও কম সময়ে।
কত দিন লাগবে শিখতে?
তিন-চাইর বছর। এর বেশিও লাগতে পারে।
বলেন কি?
ম্যাজিক ভদ্রলোকের কাজ না। ছোটলোকের কাজ।
আনিস অবশ্যি চার মাসের মাথাতেই ব্যাপারটা মোটামুটি ধরে ফেলল। শরাফ মিয়া নির্লিপ্ত স্বরে বলল, আপনার হইব। কিন্তু কী করবেন। এইসব শিইখ্যা? লাভ কী?
কোনো লাভ নেই?
না, কোনো লাভ নাই। এক সময় রাজা-বাদশারা ছিল, এরা এইসব জিনিসের কদর করত। এখন রাজাও নাই, বাদশাও নাই। সব ফকির। ফকিরের দেশে ম্যাজিক চলে না।
এই গলির ভেতর ঢুকতে আনিসের সব সময় একটু গা ছমছম করে। সব সময় মনে হয় সবাই বোধহয় বিশেষ দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। একবার ঢুকে পড়লে এই অস্বস্তিটা কেটে যায়, তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে অস্বস্তি লাগে। অনেক দিন ধরে সে আসা-যাওয়া করছে এদিকে, তবু অস্বস্তির ভাবটা কাটছে না।
পানের দোকানের বেঁটে বুড়োটি আনিসকে দেখে পরিচিত ভঙ্গিতে হাসল, ভালো আছেন ভাইস্যার?
ভালো।
শরাফ ভাইয়ের কাছে যান?
হুঁ।
আচ্ছা যান। নিশ্চিন্তে যান। কেউ আপনেরে কিছু কইব না। বলা আছে সবেরে।
শরাফ মিয়াকে পাওয়া গেল না। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর রেশম জানালা খুলে বলল, বাসায় নাই।
কখন আসবেন?
জানি না।
মেয়েটা দরজা বন্ধ করে দিল। আনিস দাঁড়িয়ে রইল। শরাফ মিয়া অনেক সময় ঘরে থেকেও বলে দেয় বাসায় নেই। ঘণ্টাখানিক বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করলে এক সময় নিজেই বের হয়ে আসে। চক্ষুলজ্জায় পড়েই আসে সম্ভবত।
আনিস সিগারেট ধরাল।
জানালা খুলল আবার। রেশমা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, এক বার তো কইলাম নাই। বাড়িত যান। কেন খালি ঝামেলা করেন?
আর দাঁড়িয়ে থাকার অর্থ হয় না। আনিস হাঁটতে শুরু করল। রেশমা খুব সম্ভব শরাফ মিয়ার মেয়ে। অবশ্যি এই অঞ্চলে সম্পর্কের ব্যাপারটা খুব জোরালো নয়। মেয়ে নাও হতে পারে। রেশমার চেহারার সাথে কোথায় যেন শাহানার ছাপ আছে। তবে শাহানার মুখ গোল, এই মেয়েটির মুখ লম্বাটে। আনিস লক্ষ করেছে, এ মেয়েটি তাকে সহ্যই করতে পারে না। কিংবা কে জানে এ অঞ্চলের কোনো মেয়েই হয়তো পুরুষ সহ্য করতে পারে না। সহ্য করতে না পারাটাই স্বাভাবিক।
পানের দোকানের সামনে আসতেই বুড়ো লোকটি বলল, শরাফ ভাইরে পাইছেন?
না। বাসায় নেই।
বাসাতেই আছে। আবার যান।
আবার যেতে ইচ্ছা করছে না। আর গেলেও কোনো লাভ হবে না। রেশমা বিরক্ত স্বরে চেঁচাবে, বাসাত নাই।
শীতের দিনের রোদে এক ধরনের তীক্ষ্মতা আছে। দুপরের দিকে এই রোদ গায়ে সূচের মতো বিধতে থাকে। আনিসের রোদে হাঁটতে ইচ্ছা করছিল না। রিকশা নিয়ে গুলিস্তান চলে যেতে ইচ্ছা করছে। সেখান থেকে কল্যাণপুরের বাস ধরা যাবে। কিন্তু পকেটের অবস্থা ভালো না। এই অবস্থায় বিলাসিত প্রশ্রয় দেয়া যায় না। তাছাড়া হেঁটে যাবার অন্য একটা মজা আছে। হঠাৎ দুএক জন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিশিয়ানের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। যেমন এক দিন কুদ্দুসকে পাওয়া গেল।
কুদ্দুস পুরানো ঢাকা অঞ্চলে খুঁজলি বিখ্যাউজ এবং কান পাকার ওষুধ বিক্রি করে। সবকটি ওষুধ স্বপ্নে পাওয়া এবং ওষুধগুলি দেয়া হয় বিনা মূল্যে। কারণ যিনি এই ওষুধ স্বপ্নে পেয়েছেন, তিনি বিক্রি নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন।
তবে নামমাত্র হাদিয়া নেয়া হয়। ওষুধ তৈরির খরচ জোগাড় করার জন্যেই। অন্য কোনো কারণে নয়। কুদ্দুস ওষুধ বিক্রির আগে লোক জড়ো করবার জন্যে ম্যাজিক দেখায়। অসাধারণ সেসব ম্যাজিক। প্রথম শ্রেণীর পামিংয়ের কৌশল। একটি লোককে চারদিক থেকে সবাই ঘিরে আছে এবং সে এর মধ্যেই একের পর এক দেখিয়ে যাচ্ছে–দড়ি কাঁটার খেলা, পিংপংয়ের খেলা, চমৎকার সব তাসের খেলা! একটি খেলা তো বারবার দেখার মতো। কুদ্দুস একটি হরতনের বিবি নোয় হাতের মুঠোয়। কুদ্দুসের সহকারী ন বছরের ফজল ঘন ঘন ড়ুগড়ুগি বাজায়। কুদ্দুস তাঁর ভাঙা গলায় বলে, দেখেন ভাই দেখেন, বিবি সাবরে দেখেন। রাজার ছিল চাইর বিবি। এই বিবির কদর নাই। খাওন পায় না। মনে দুঃখু। দিন যায়। আর বিবি দুবলা পাতলা হয়।
কথার সঙ্গে সঙ্গে হরতনের বিবির তাসটা ছোট হতে শুরু করে। ফজল ড়ুগড়ুগি বাজায় প্রচণ্ড শব্দে। তাস ছোট হতে হতে এক সময় মিলিয়ে যায়। অপূর্ব একটি খেলা কত সহজেই-না দেখাচ্ছে লোকটি।
আনিস অনেক দিন ধরেই খুঁজছে কুদ্দুসকে। আগে তাকে প্রায়ই পুরানো ঢাকায় দেখা যেত, এখন দেখা যাচ্ছে না। জায়গা বদল করেছে বোধহয়। এই শ্ৰেণীর লোকরা যাযাবর শ্ৰেণীর হয়। এক জায়গায় থাকতে পারে না বেশি।
আনিস নিজেও কি এক দিন তাদের মতো হবে? রাস্তার পাশে তাকে ঘিরে থাকবে লোকজন। ছোট্ট একটি অপুষ্ট শিশু চোখে পিচুটি নিয়ে প্রাণপণে ড়ুগড়ুগি বাজাবে। এবং সে দেখাবে তার বিখ্যাত গোলাপ তৈরির খেলা। খেলা শেষ হবার পর বিক্রি করবে।–কালিগঞ্জের বিখ্যাত দাঁতের মোজন-যা নিয়মিত ব্যবহার করলে মুখে দুৰ্গন্ধ, মাড়ি ফোলা, দাঁতের পোকা, কিছুই থাকবে না। আসেন ভাইসব, ব্যবহার করে দেখেন-কালিগঞ্জের বিখ্যাত দন্ত-বান্ধব নিম টুথ পাউডার।
মনোয়ারা দুপুরের পর থেকেই অস্থির হয়ে পড়লেন। নীলু মনে-মনে বেশ বিরক্ত হল। শাহানাকে বিয়ে দিতে কোনো রকম সমস্যা হবার কথা নয়। তার মতে রূপবতী মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। ভালো ভালো সম্বন্ধ আসবে। কিন্তু মনোয়ারা এমন করছেন, যেন মেয়ে গলায় কাঁটা হয়ে বিধে আছে। আজ সাড়ে তিনটায় সেই কাঁটা সরানোর প্রথম ধাপটি শুরু হবে।
বৌমা, শাহানাকে দেখলাম কামিজ পরে ঘুরঘুর করছে। ওকে একটা শাড়ি পরতে বল।
শাড়ি পরার দরকার কী মা? ওরা তো আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়ে দেখতে আসছে না।
মনোয়ারা রেগে গেলেন, যা করতে বলছি, করি। ওকে ভালো দেখে একটা শাড়ি পরাও। চুলে তেল দিয়ে চুল বেঁধে দাও।
এসব করতে গেলেই শাহানা সন্দেহ করবে। সন্দেহ করলে করবে। তারপর ধরুন মা, কোনো কারণে ওদের পছন্দ হল না, তখন তো শাহানা খুব শক পাবে।
মনোয়ারা বিরক্ত স্বরে বললেন, চাকরি নেবার পর থেকে তুমি বৌমা খঙুে বেশি কথা বলছি। তুমি গিয়ে ওকে শাড়ি পরতে বল! তুমি না বললে আমি বলব।
নীলু, শাহানার খোঁজে গেল। শাহানা নিজের ঘরে গল্পের বই নিয়ে বসেছে। এবং ঘন ঘন চোখ মুছছে। ভাবীকে দেখে অপ্রস্তুও ভঙ্গিতে হাসল।
টুনী কোথায় শাহানা?
বাবার সঙ্গে ঘুমুচ্ছে। কত বললাম আমার সঙ্গে এসে ঘুমাতে। তা ঘুমাবে না।
তুমি একটু ওঠ তো শাহানা। আমার সঙ্গে যাবে এক জায়গায়।
কোথায়?
ছবি তুলব।
তোমার সেই পাসপোর্টটির ছবি?
না, পাসপোর্টের ছবি তোলা হয়েছে। তুমি আর আমি দু জনে মিলে তুলব। কালার ছবি।
কেন?
স্মৃতি রাখবার জন্যে। দু দিন পর বিয়ে হয়ে কোথায় কোথায় চলে যাবে!
সব সময় ঠাট্টা ভালো লাগে না।
ওঠ শাহানা। ভালো দেখে একটা শাড়ি পর।
জামদানিটা পরব?
না, জামদানি ফুলে থাকবে। সিস্কের শাড়িটা পর।
শাহানা খুশি মনে উঠে এল। শাড়ি পরল। চুল বাধল। সবুজ রঙের ছোট্ট একটা টিপ পরল। কপালে। আয়নায় নিজেকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল।
ভাবী, চোখে কাজল দেব?
কাজলের তোমার দরকার নেই।
কেমন লাগছে আমাকে?
তুমি হচ্ছ পৃথিবীর সেরা রূপসীদের এক জন। কোনো ছেলে তোমাকে এক বার দেখলে সারা রাত বিছানায় ছটফট করবে।
তুমি ভাবী। খুব অসত্যের মতো কথা বল। ভালো লাগে না।
সাজগোজ সারাতে সারণেই মেহমানবা এসে পড়লেন। দু জন বয়স্কা মহিলা। তাঁরা থাকলেন খুব অল্প সময। চা-টা কিছুই খেলেন না। কথাবার্তাও কিছু বললেন না। কালোমতো মহিলাটি :ே বললেন, তোমাকে মা আমি আগে দেখেছি। গুলশান মার্কেটে বিছানার চাদর কিনিছিলো।
কথাটা ঠিক নয়। নীলু কখনো গুলশান মার্কেটে যায় নি। কিন্তু সে কোনো প্রতিবাদ করল না। শাহানার সঙ্গে তাদের তেমন কোনো কথাবার্তা হল না। ফর্সা এবং অসম্ভব ধরনেবা মোটা মহিলাটি বললেন, খুব সাজগোজ কবেছ। দেখি–
আমরা ছবি তুলতে যাচ্ছি।
কোন স্টুডিওতে যাচ্ছ? এলিফেন্ট রোডের দিকে গেলে চল, আমি নামিয়ে দেব।
জ্বি-না। আমরা এই কাছেই যাব। হেটে যাওয়া যায়!
ভদ্রমহিলার আচার-আচরণ দেখে কিছুই বোঝা গেল না। সাড়ে চারটায় তাদের এক জায়গায় দাওয়াত আছে, তাড়াহুড়া করে চলে গেলেন। মনোয়ারার মন খারাপ হয়ে গেল। মেয়ে ওদের পছন্দ হয় নি। পছন্দ হলে চলে যাবার জন্যে এত ব্যস্ত হয়ে উঠত না। চা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কাঁপে চুমুক পর্যন্ত দিল না। ভদ্রতা করে হলেও কাঁপে একটা চুমুক দেবার দরকার ছিল। কালো মহিলাটি সারাক্ষণই নাক উঁচু করে ছিল। কপাল কুঁচকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকাচ্ছিল।
নীলু, শাহানাকে নিয়ে ছবি তুলতে গেল সন্ধ্যার আগে আগে। দুটি ছবি তোলা হল। একটিতে নীলু এবং শাহানা। অন্যটিতে শুধু শাহানা। অনেকগুলি টাকা খরচ হল শুধু শুধু। ছবি ভালো আসবে কিনা কে জানে। স্টুডিওর মালিক এক জন বুড়ো লোক। সে চোখেই দেখে না ছবি তুলবে কী?
ফেরবার পথে শাহানা বলল, চল ভাবী, ফুচকা খাই। এখানে একটা ফুচকার গাড়ি আছে।
কোথায়?
আরেকটু সামনে যেতে হবে। চল যাই। ফুচকা খাবার পর আমরা একটু হাঁটব, কী বল?
সন্ধ্যাবেলা শুধু শুধু হাঁটব কেন? আর এখানে হাঁটার জায়গা কোথায়?
তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে তাবী। হাঁটতে হাঁটতে কথাটা বলব।
এখনই বল।
শাহানা শান্ত স্বরে বলল, তুমি ভাবী। খুব কায়দা করে শাড়ি পরিয়েছ। সাজগোজ করিয়েছ। ঐ মহিলা দুটি আমাকে দেখতে এসেছিলেন। ঠিক কিনা বল।
ঠিক।
আমি তো ভাবী তোমার মতো বুদ্ধিমান নই, সহজে কিছু বুঝতে পারি না। ওরা যে আমাকে দেখতে এসেছিলেন, সেটা বুঝলাম। এই অল্প কিছুক্ষণ আগে।
নীলু হাসল। কিছু বলল না। শাহানা বলল, তোমরা আমাকে বিয়ে দেবার যত চেষ্টাই কর না কেন লাভ হবে না।
তুমি বিয়ে করবে না?
যদি করি, করব আমার পছন্দমতো ছেলেকে।
এমন কেউ কি পছন্দের আছে?
শাহানা জবাব দিল না। তার ফর্সা গাল লাল হয়ে উঠেছে। শেষ সূর্যের আভায় বড়ো সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। নীলু বলল, ছেলেটা কে শাহানা?
শাহানা মাথা নিচু করে বলল, আমি যাকে বিয়ে করব সে খুবই সাধারণ একজন মানুষ। তোমরা কেউ তাকে পছন্দ করবে না।
আমরা পছন্দ করব না, এমন কাউকে তুমি কেন বিয়ে করবে?
কারণ আমি তাকে পছন্দ করি।
ছেলেটি কে–আনিস?
শাহানা জবাব দিল না। তার ভাসা ভাসা ঘন কালো চোখে জল চিক-চিক করতে লাগল। নীলু হালকা গলায় বলল, নিয়ে চল তোমার ফুচকার গাড়িতে। বেশি দূর নাকি?
পরবর্তী এক সপ্তাহে খুব দ্রুত কিছু ঘটনা ঘটল।
সোমবার
বাসায় টিভি এল। বার ইঞ্চি চমৎকার একটা টিভি। হোসেন সাহেব শিশুদের মত হৈচৈ শুরু করলেন। সন্ধ্যা থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত টিভির সামনে থেকে নড়লেন না। মনোয়ারা কয়েক বার বললেন, এ রকম করছ, যেন টিভি কোন দিন চোখে দেখ নি।
প্রথম দিকে মনে হচ্ছিল টিভি আনার ব্যাপারটা মনোয়ারা ঠিক পছন্দ করছেন না। কিন্তু ফিরোজা বেগমের গানের সময় তিনিও খুব আগ্রহ করে সামনে বসলেন। শুধু শফিক এল না। হোসেন সাহেব রাত দশটার খবরের সময় উঁচু গলায় ডাকলেন, আস সবাই, খবর হচ্ছে—খবর। যেন খবরটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, এটা শুনতেই হবে। শফিক তখনই শুধু বসল। খানিকক্ষণ। হোসেন সাহেব সারাক্ষণই বলতে লাগলেন, এত সুন্দর রিসিপশন আমি কোনো টিভিতে দেখি নি। আর কী সুন্দর সাউণ্ড!
মঙ্গলবার
মনোয়ারাকে অবাক করে দিয়ে ফর্সা ও মোটা মহিলাটি বুড়ো এক ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে সকালবেলা উপস্থিত হলেন। তাঁরা দীর্ঘ সময় কথা বললেন হোসেন সাহেবের সঙ্গে! শফিকের অফিসে যাওয়া হল না। তাদের কথাবার্তায় নীলুর ডাক পড়ল না। মনোয়ারা শুধু অত্যন্ত উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলে গেলেন, ওদের শাহানাকে পছন্দ হয়েছে। সেদিনই বিকেলে একটি বিশেষ সময়ে নীলুকে যেতে হল নিউমার্কেটে। নীলুর সঙ্গে শাহানা। নীলুর ভান করতে হল যে সে বই কিনছে। শাহানা সারাক্ষণই অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে রইল এবং এক সময় বলল, যার আমাকে দেখার কথা, সে কি দেখেছে?
নীলু অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, দেখাদেখির কোনো ব্যাপার এর মধ্যে নেই। বই কিনতে এসেছি, বই কিনে চলে যাব।
কেন আমাকে মিথ্যা কথা বলছ ভাবী? কালো সুট পরা লোকটি এসেছিল আমাকে দেখতে।
খুব সুন্দর না ছেলেটা?
শাহানা জবাব দিল না। নীলু বলল, এমন চমৎকার ছেলের কথা শুধু গল্প উপন্যাসেই পড়া যায়। শাহানা গম্ভীর হয়ে রইল। সে রাতে ভাত খেল না। তার নাকি মাথা ধরেছে।
নীলুর মনে হল বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে আর এগোন ঠিক না। কিন্তু ঘটনাগুলি ঘটছে খুব দ্রুত। এক সময় আর ফেরা যাবে না। রাতের বেলা সে শফিককে বলল, শাহানার এই বিয়েতে মত নেই।
শফিক বিরক্ত হয়ে বলল, ওর মতামতটা চাচ্ছে কে?
যে বিয়ে করবে, তার কোনো মতামত থাকবে না?
ধর যদি অন্য কোনো ছেলের প্রতি তার কোনো দুর্বলতা থাকে, তখন?
কী যে বাজে কথা বল।
ও যে-রকম মেয়ে, কোনো একটা কাণ্ডটাণ্ড করে বসতে পারে। কিছুই করবে না। আমি কথা বলব ওর সাথে।
কখন?
এখনই ডাক। কথা বলছি।
থাক, আজ আর না বললেও হবে।
আজ অসুবিধাটা কী?
মাথা ধরেছে, শুয়ে আছে।
তুমি বল, আমি ডাকছি। প্লীজ, আজ না। যা বলার অন্য এক দিন বলো।
বৃহস্পতিবার
সন্ধ্যাবেল ফস মোটা মহিলাটি অনেককে নিয়ে এলেন। তাদের সঙ্গে প্রচুর মিষ্টি। তারা শাহানার হাতে হীরে বসান একটি আঙটি পরিয়ে দিলেন। মনোয়ারা বললেন, মা, ইনাকে সালাম কর। শাহানা বাধ্য মেয়ের মতো সালাম করল।
সেই রাতেই শফিক শাহানার সঙ্গে অনেক সময় ধরে কথা বলল। নীলু সেই আলোচনায় থাকল না। কিন্তু লক্ষ করল, শাহানার মনের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। অন্ধকার ভাবটা আর নেই।
সহজভাবে টিভির সামনে এসে বসল। গানের ভুবন অনুষ্ঠানটি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখল। সেখানে এক জন শিল্পীকে একটি মাছি বড়ো বিরক্ত করছে। বারবার মাছিটি গিয়ে বসছে তার নাকে। শিল্পী নির্বিকার থাকতে চেষ্টা করছেন, পারছেন না। দৃশ্যটি দেখে শাহানা অন্য সবার মতোই হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ল। নীলুর মনে হল, শাহানাকে নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। এই বিয়েতে সে সুখীই হবে।
অনেক রাতে শাহানা নীলুকে বলল, ভাবী, আঙটিটাি কি পরে থাকব, না খুলে বাক্সে তুলে রাখব?
বাক্সে তুলে রাখার দরকার কী?
এত দামী আঙটি হাত থেকে খুলে পড়ে যায় যদি!
না, পড়বে না। আঙটিটা তোমার পছন্দ হয়েছে শাহানা?
শাহানা কিছু বলল না। নীলু নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যাক, তোমার কল্যাণে হীরা দেখা হল। আমি হীরা আগে দেখি নি।