ষোড়শ পরিচ্ছেদ
ওসিআর ভার্সন। ভুল সংশোধন করা হয়নি।
উমা ছেলেমেয়ে পড়ায় সবসুদ্ধ ন’টি। এর কম পড়ালে কোন কাজ হয় না। কারণ মাইনে বেশি নয় কোথাও। সে ইংরেজী জানে না, ছেলেদের পড়ানো তার পক্ষে অসম্ভব, আজকাল সবাই চায় ছেলেদের ইংরেজী শেখাতে যেমন-তেমন ক’রে দু-পাতা ইংরেজী শিখতে পারলেই ভাল চাকরি মিলবে। মেয়েদের ইংরেজী শেখাটা এখনও তত চল হয় নি তবে বেশিদিন অচলও থাকবে না, শোনা যাচ্ছে এখনই কেউ কেউ শেখাতে শুরু করেছেন, আগেকার মত মেয়ে-ইস্কুল আর ফাঁকা পড়ে থাকে না। উমার চাড় আছে, লোক পেলে সে ইংরেজী শিখে নিতে পারে অল্পদিনেই। কিন্তু সে লোক কৈ? গোবন্দি সবে পাড়ার পাঠশালায় যেতে শুরু করেছে, তার সম্বল ফার্স্ট বুক। সে যেটুকু জানে সেটুকু উমা অবশ্য শিখে নিয়েছে কিন্তু সে ত অক্ষর পরিচয় মাত্র। অসহিষ্ণু উমা আরও এগিয়ে যাবার জন্য ছট্ফট করে পাঁচ-ছ বছরের বালকের আধার বুঝে পন্ডিত মশায় সাবধানে এগোন, উমার প্রয়োজন বুঝে তিনি ত আর ডিঙিয়ে চলবেন না! পূর্ণবয়স্কা উমা যেটা পাঁচ মিনিটে আয়ত্ত করতে পারে শিশুর তাই আয়ত্ত করতে লাগে পুরো এক সপ্তাহ।
মেয়ে পড়ানোর রেওয়াজ খুব বেশি না হ’লেও এখন অনেকেই সচেতন হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এ পাড়াটা বিশেষ এক শ্রেণীর বনেদী ‘কলকাত্তাই’ ব্যবসায়ীবহুল, এবং তাঁদের ধারণা মেয়েদের লেখাপড়া শেখালে লক্ষ্মী থাকবে না। এঁদের রীতিনীতি আচার- ব্যবহার এখনও সপ্তদশ শতাব্দীর প্রত্যেকটি প্রচলিত পথ অনুসরণ করে। এঁরা এগোতে চান না . লক্ষ্মী হারাবার ভয়ে। যদিও সে লক্ষ্মীকে তাঁরা তেমন ক’রে ধরে রাখতেও পারেন নি। কলকাতার এই বিশেষ ব্যবসায়ী সমাজ পেছিয়ে গেছেন নিজেদের আসন মারোয়াড়ীদের ছেড়ে দিয়ে 1
সে যাই হোক উমাকে একটু দূরে-দূরেও যেতে হয়। সদর রাস্তা পার হয়ে ওধারের দু-একটা গলিতেও। কিন্তু উমা আর ভয় পায় না। সে কেমন ক’রে বুঝেছে যে ভয় পেলেই ভয় চেপে ধরে। সে কারও নিষেধ বা সতর্কবাণীও শুনতে রাজী নয়। আজ যারা সতর্ক করতে আসছে তারা চরম দুর্দিনে কেউই এসে দেখবে না, অন্ধকার ঘরে বসে শুকিয়ে মরতে হবে সেদিন। তাই কি ঘরে বসেই মরতে পারবে? বাড়িটাও ত নিজেদের নয়। ভাড়া না দিলেই তাড়িয়ে দেবে। এক উপায় আছে সোজাসুজি গলায়
দড়ি দেওয়া কিন্তু সে পথ ত খোলা রইলই। শেষ পর্যন্ত না দেখে, অদৃষ্টের সঙ্গে শেষ যোঝা না যুঝে ও পথে যাবে না উমা। মহাভারতে সে পড়েছে আত্মহত্যা মহাপাপ মহাপাপ সে আর করবে না। গতজন্মে কি মহাপাপ করেছিল, কি চরম বঞ্চনা করেছিল আর কাউকে, তাই এ জন্মে এমন ভাবে বঞ্চিত হ’ল। সধবা মেয়ে রূপ-যৌবনের ভরা ডালি সাজিয়ে বসে রইল অথচ সে ডালি কারও পায়ে সঁপে দিতে পারলে না। এ জীবনে রইল অস্পর্শিত এ কুসুম রইল চিরদিনের জন্য অনাঘ্রাত। আবার এ জন্মে
মহাপাপ করতে রাজী নয় সে যত কিছু পাপ এ জন্মেই ধুয়ে-মুয়ে যাক।
ন’টি ছেলেমেয়ে পড়ায় কিন্তু মোট তাকে যেতে হয় ছ’টি বাড়িতে। এক বাড়িতে দু’টি, আর এক বাড়িতে তিনটি পড়ে একসঙ্গে। দুটি পড়ে এক ডাক্তারের ছেলেমেয়ে, তিনি দেন সোজাসুজি চার টাকাই। তিনটি পড়ে যেখানে দুটি মেয়ে একটি ছেলে
সে ভদ্রলোক কায়স্থ, কোন এক বড় বিলাতী কোম্পানীর মুচ্ছদ্দি, মোটা টাকা আয়– কিন্তু অত্যন্ত কৃপন তিনি ঐ তিনটি মিলিয়ে দেন চার টাকা। আর চারটি মেয়েকে আলাদা আলাদা পড়াতে হয়, দুজন দেয় দু’টাকা হিসেবে, বাকী দুজন দেয় এক টাকা করে।এরা ঐ বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে। সাহস ক’রে লক্ষ্মীকে অগ্রাহ্য করেছেন এদের অভিভাবকরা, সেজন্য কিছু সুবিধা যেন দাবীই করেন।
এত হাঙ্গামা করতে হত না সাদিক মিয়াদের বাড়ি পড়াতে রাজী হ’লে। ওদের বাড়িতেই মোট আট-নটি ছোট ছেলেমেয়ে- বৃদ্ধ সাদিক আজও বেঁচে আছেন, তিনি এমনও প্রস্তাব করেছিলেন যে উমাদিদির যদি ওখানে যেতে বাধা থাকে, তিনি তাঁর নাত-নাতনীদের এ বাড়িতে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারেন, কিন্তু রাসমণি তাতে রাজী হন নি। তিনি সাদিকের কাছে হাত জোড় করে বলেছিলেন, ‘আপনার নাতি নাতনীকে পড়িয়ে তার জন্য যদি হাত পেতে টাকা নিতে হয় ওকে ত তার চেয়ে লজ্জার কথা আর কিছু নেই, তার আগে ওর গলায় দড়ি দেওয়াই ভাল। তার ওপর সবই ত বোঝেন বাবা আপনি, ব্রাহ্মণের মেয়ে আপনাদের কাছে চাকরি করলে জাতে ঠেলবে শেষ পর্যন্ত। ওর আর ভয় কি– কিন্তু আমার অন্য মেয়ে ত আছে, তাদের সমাজও আছে, তাদের বিপন্ন করা কি ওর উচিত হবে?’
এর পর আর সাদিক পীড়াপীড়ি করতে পারেন নি। নসিবনের বিয়ে হয়েছে টেরিটিবাজারে এক ধনী দিল্লীওয়ালার ঘরে ওর স্বামীর ইচ্ছা তার ছোট বোনকে ও ভাইকে অর্থাৎ নসিবনের দেওর ও ননদকে বাংলা শেখায়। নসিবনদের গাড়িও আছে, সে বলেছিল উমাকে গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে যাবে এবং পৌঁছে দেবে কিন্তু তাও হয়ে ওঠে নি– ঐ একই কারণে। রাসমণি নসিবনের পিঠে হাত দিয়ে সস্নেহে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ব্যাপারটা। তাছাড়া অপরিচিত মুসলমান পরিবারের মধ্যে যাওয়ার অন্য বিপদ আছে। বিপদ না ঘটলেও দুর্নাম রটতে পারে।
অগত্যা উমাকে এই ছ’টি বাড়িতে ঘুরে ঘুরে পড়াতে হয়। নিজের বাড়িতে পড়ানো সম্ভব নয়–ঐটুকু-টুকু মেয়ে কেউই বাড়ির বাইরে যেতে দিতে রাজী নন। সব চেয়ে মুশকিল হয় সময় পাওয়া নিয়ে। বেলা বারোটা-একটা নাগাদ সংসারের কাজ সেরে বেরিয়ে পড়ে ফিরতে ফিরতে পাঁচটা-ছটা বেজে যায়। গরমের দিনে একটু দেরি
১৬৬
করলেও চলে, কারণ সন্ধ্যা হয় বহু বিলম্বে, শীতকালে যেন ঝপ্ ক’রে অন্ধকার হয়ে আসে চারদিকে, নিঃশ্বাস ফেলতেও অবকাশ পাওয়া যায় না। অন্ধকার হবার পর আর রাস্তায় থাকতে সাহস হয় না– থাকবার উপায়ও নেই। মধুলুব্ধ মধুকরের দল সর্বকালেই আছে। বেকার যুবকের সংখ্যা তখনও কম ছিল না। এখন বেকার থাকে বাধ্য হয়ে, কাজ পায় না বলে, তখন বেকার থাকত থাকলে চলত বলে। সে একটানা নিশ্চিন্ত বেকারী, যৌবন যতদিন থাকত ততদিন দুর্বৃত্ততা ও দুশ্চরিত্রতায় ভাঁটা পড়ত না। দিনের বেলাতেও তাদের সাহস খুব কম হবার কথা নয়–তবে এক্ষেত্রে উমার কিছু জোরও ছিল। রাসমণিকে এ পাড়ার অনেকেই সমীহ করতেন, তাঁর ইতিহাস সবাই জানতেন তাঁর চরিত্রের মাধুর্যের সঙ্গে দৃঢ়তার যে অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছিল তার পরিচয়ও কিছু কিছু পেয়েছেন অনেকে। সহানুভূতি ও শ্রদ্ধা দুইই তিনি আকর্ষণ করেছেন সমানে। সুতরাং বেশি কিছু ধৃষ্টতা করলে অভিভাবকদের কাছ থেকে চাপ আসবে তা সকলেই জানত। আর ভয় ছিল সার্দিক মিয়ার বলিষ্ঠ ছেলে ও নাতিগুলিকে। সেজন্যে দিনের বেলায় রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করায় অতটা ভয় ছিল না। কিন্তু রাত্রির কথা আলাদা। দিনের বেলা যা শুধু সাহস, রাত্রে সেইটাই দুঃসাহস।
――
অথচ মাইনে যাঁরা দেন তাঁরা দু টাকাই দিন আর এক টাকাই দিন –ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখেন সবাই। এক ঘণ্টা পড়াতেই হয় বড়জোর তা থেকে দু-পাঁচ মিনিট চুরি করা যায়। সুতরাং এক বাড়ি থেকে আর এক বাড়ি যায় সে ঊর্ধ্বশ্বাসে আস্তে চলার অভ্যাস তার এই ক-মাসের মধ্যেই যেন কোথায় চলে গেছে। তবু এক-একদিন শেষ বাড়ি থেকে বেরোতে (যদিও শেষের জন্যে সে ডাক্তারের বাড়িটাই রেখে দেয়, কারণ ঐটেই সব চেয়ে কাছে, তাছাড়া ওঁরা মানুষও খুব ভদ্র, তেমন দেরি হ’লে সঙ্গে ঝি দিয়ে বাড়িতে পৌঁছেও দেন) বেশ ঘোর হয়ে আসে চারদিকে।
একদিন এমনি তাড়াতাড়ি সারবার চেষ্টা সত্ত্বেও দেরি হয়ে গেছে। ঝি সেদিন গেছে কুটুম-বাড়ি তত্ত্ব নিয়ে, ডাক্তারের গৃহিণী প্রস্তাব করলেন, ‘আমার খোকাই না হয় এগিয়ে দিক তোমাকে। কী বলো গো মেয়ে?’
খোকা অর্থাৎ তাঁর তেইশ-চব্বিশ বছরের ছেলেটি। ওর চাউনিটা উমার ভাল লাগে না কোন দিনই–বিশ্বাস ক’রে তার সঙ্গে অন্ধকারে একা পথ চলার চেয়ে অদৃষ্টদেবতাকে বিশ্বাস করাই ভাল। উমা ঘাড় নেড়ে বললে, ‘না না কাকীমা এমনিই চলে যাবো, এইটুকু ত পথ।’
আমি
সে ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একরকম দৌড়তেই শুরু করলে। পথ খুব বেশি না হ’লেও দুটো গলি পেরোতে হয়। প্রথম গলি যেটা বেশি নির্জন, সেখানে একটা বাড়িতে এই সময় একদল বৃদ্ধ বসে আড্ডা দেন, সেইটাই উমার ভরসা কিন্তু গলিতে ঢুকে অনেকটা এগিয়ে এসে দেখল আজ সে রক খালি, বৃদ্ধের দল কোন অজ্ঞাত কারণে অন্যত্র কোথাও আড্ডা বসিয়েছেন কিংবা কেউই বাড়ি থেকে বেরোন নি। তখন আর ফেরা সম্ভব নয়– মনে মনে দুর্গা নাম জপ করতে করতে এগিয়ে চলল সে, কিন্তু ঠিক এই সময়েই মনে হ’ল তার পেছনে আর একটা পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে কে যেন তার পেছনে পেছনে আসছে। হয়ত সবটাই ভয়, নিছক ভয়
তবু পিছন ফিরে
১৬৭
সঙ্গে
– আর
তাকিয়ে দেখাও সম্ভব নয়। সে আরও জোরে, প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে লাগল তারই ফলে একেবারে মোড়ের কাছাকাছি এসে সজোরে ধাক্কা লাগল একটি পুরুষের অপরিচিত এবং পরপুরুষ ত অবশ্যই! দোষ সে লোকটিরও নয় কারণ সে ওপাশ থেকে আসছিল, তার পক্ষেও আগে থাকতে উমাকে দেখে সতর্ক হওয়া সম্ভব ছিল না। আতঙ্কে, আশঙ্কায়, লজ্জায়, ক্ষোভে উমা হয়ত অজ্ঞানই হয়ে পড়ত যদি না অত্যন্ত সুপরিচিত একটি কণ্ঠে বিস্ময়সূচক ধ্বনি কানে এসে বাজত –‘এ কি, তুমি ‘
বাকী প্রশ্নগুলোও শেষ করলে সে,
আর একটু থেমে
‘এখানে, এমন একা?’
মুহূর্ত কতক মাত্র
লোকটি শরৎ–তার স্বামী।
এই লোকটির সঙ্গে তার পরিচয় খুবই অল্পকালের, তাকে ভরসা করার মত, তাকে অবলম্বন করার মত নির্ভরতা বোধ করে, এমন কোন কারণেই নেই
তবু উমার তখনকার নিশ্চিন্ততা কল্পনা করার নয়। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চোখ বুজে সে দাঁড়িয়ে দম নেবার চেষ্টা করলে, কিন্তু দাঁড়াতে পারলে না কোনমতেই, এতগুলি পরস্পরবিরোধী প্রবল অনুভূতির সংঘাতে তার সমস্ত স্নায়ু যেন অবশ হয়ে গিয়েছিল সে প্রাণপণে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সামলাতে পারলেনা টলে ঠিক নয়, এলিয়েই পড়ল শরতের বুকের মধ্যে।
‘এই দ্যাখো
এ কি কান্ড? কী হ’ল তোমার?’
—
আনাড়ীর মত অপ্রস্তুতভাবে শরৎ ওকে ধরে ফেললে এবং পরস্ত্রীর মতই আড়ষ্ট ভাবে ধরে রইল।
উমা অবশ্য অল্পক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিলে। স্বামীর এই সামান্য আড়ষ্টতার মধ্যে যে তীব্র অপমান ছিল সেটাও ওর অবসন্ন স্নায়ুকে সক্রিয় ক’রে তুলতে কতকটা সাহায্য করলে হয়ত। সমস্ত পরিচিত ইতিহাস মনের মধ্যে লেপে মুছে গিয়ে, সবকিছু যুক্তি-তর্ক ছাপিয়েও যে আশ্বাস ও আশা স্ত্রীর মনে জাগা স্বাভাবিক সেইটাই হয়ত স্বামীর বুকে এলিয়ে পড়বার সময় উমার মনেও জেগেছিল, ভীত-ক্লান্ত স্ত্রীর অবস্থা দেখে সস্নেহেই বুকে আশ্রয় দেবে শরৎ– অন্তত কিছুকালের জন্য। পর হলেও মানুষ এমন সময় আশ্বাস দেয়, আশ্রয় দেয়।
হে ভগবান!
কণ্ঠস্বরে কোন দুর্বলতা না ফুটে ওঠে উমা একটুখানি চুপ ক’রে থেকে সহজভাবেই উত্তর দিলে, ‘বড্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম!’
–তা ত দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তু কেন? এমন সময় এই নির্জন গলি দিয়ে যাচ্ছিলেই বা কোথায়
অত দৌড়ে?’
‘বাড়ি যাচ্ছিলুম। সরো, পথ ছাড়–একেবারে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, আর দেরি করার সময় নেই।
‘থাক অমন করে আর দৌড়তে হবে না, চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’ চরম বিপদের দিনে লোকটার সঙ্গে দেখাও হয়ে যায় ত ঠিক! এত দুঃখের মধ্যেও কথাটা মনে করে হাসি পায় ওর। আহা–কি সম্পর্ক!
১৬৮
পাশাপাশি চলতে লজ্জাই করে। শরৎ একটু আগে আগে যায়
শরৎ আবারও প্রশ্ন করে, ‘কোথা থেকে আসছিলে?’
‘মেয়ে পড়িয়ে।’
‘কী– কী করে?’ চমকে দাঁড়িয়ে যায় শরৎ।
উমা পিছু পিছু।
‘পথের মধ্যে অমন ক’রে দাঁড়াতে হবে না। চলো। কেউ দেখলে কি মনে করবে। তোমাকে ত এ পাড়ায় কেউ চেনে না’
কণ্ঠস্বরে সামান্য একটু ব্যঙ্গই ফুটে ওঠে ওর।
শরৎ চলতে শুরু করে বটে কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যায়।
‘কিন্তু কী করছিলে তাই যে বুঝতে পারলুম না!
‘মেয়ে পড়াচ্ছিলুম, ছেলেমেয়ে পড়ানোর কাজ করি আমি এখন। এক টাকা দু টাকা মাইনে নটা ছেলেমেয়ে পড়াই। এই ছ-ঘন্টা খেটে ফিরছি। বুঝেছ— শরীর আর মনের কি অবস্থা? অন্য দিন এর চেয়ে আলো থাকতে থাকতে ফিরি
–
হয়ে গেছে বলেই ভয় পেয়ে ছুটছিলুম।’
গলার আওয়াজ তীক্ষ্ম হয়ে ওঠে উমার।
তবু শরতের অবিশ্বাস যেন যায় না।
‘তুমি বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছেলেমেয়ে পড়াচ্ছ? এই বয়সে? একা? সে কি!’
‘কেন, তাতে অবাক হবার কি আছে?’
তোমার তোমার এত পয়সার দরকার হয়েছিল?’
আজ দেরি
‘হওয়াটা কি অন্যায়? ততক্ষণে নিজেদের বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছেছে উমা। সদরের চৌকাঠে একটা পা দিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, ‘যার স্বামী ভরণপোষণ করার প্রতিজ্ঞা ক’রেও সে প্রতিজ্ঞা রাখতে পারে না, তার আর কি উপায় আছে বলতে পারো? কী আশা করেছিলে তুমি, আমার বিধবা মা আজীবন বসে খাওয়াবে, আর এত টাকা রেখে যাবে যে মা মরবার পরও বসে খেতে পারব? নাকি সোজাসুজি বেশ্যাবৃত্তি করলেই ভাল হ’ত? অবাক হয়ে গাছ থেকে পড়লে যে একেবারে! যে প্রশ্নগুলো আমাকে করছিলে সেগুলো আমার স্বামীকে ক’রে দ্যাখো না; তিনি কি বলেন?’
উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে উমা
‘চলো চলো, ভেতরে চলো
কথা কইতে কইতে।
তোমার গলার আওয়াজ যা চড়ছে, এখনই আশেপাশের বাড়ির জানলায় লোক এসে দাঁড়াবে।’ অপ্রতিভ ভাবে বলে শরৎ।
উমাও একটু লজ্জিত হয়ে দালানের মধ্যে ঢুকে পড়ে। পিছু পিছু শরৎ কয়েক পা এগিয়ে আসে।
‘বারোটায় বেরিয়েছি, ছটা বাড়ি ঘুরতে হয়েছে
আর সমানে বকতে হয়েছে
কতকগুলো ছেলেমেয়ের সঙ্গে। তার ওপর এই আতঙ্ক। দিনরাত দুটো শত্রু আছে রূপ আর যৌবন! এ যে আমি আর পারি না।’
উত্তর দেওয়া শরতের পক্ষে কঠিন হ’ত–কিন্তু দিতে তাকে হ’ল না।
‘কার সঙ্গে কথা কইছিস রে উমি?’
আলো হাতে ক’রে অবাক হয়েই নিচে নেমে আে
১৬৯
‘ওমা, এ যে শরৎ জামাই! এসো এসো। ওপরে এসো। কি ভাগ্যি!
‘না দিদি আজ থাক। হঠাৎ পথে দেখা হয়ে গেল ওর সঙ্গে–তাই–আমি বরং
কথাবার্তা অসংলগ্ন হয়ে পড়ে শরতের।
কমলা এসে একেবারে হাত ধরে ওর, ‘আমি তোমার দিদি হই ভাই– একদিন একটা কথা শোন। দু’মিনিট স্ত্রীর কাছে বসে গেলে কেউ তোমার নিন্দে করবে না। এসো, ওপরে এসো।
যাকে বলে যন্ত্রচালিতের মতই শরৎ ওপরে গিয়ে বসে। এবার আলোয় ভাল ক’রে তাকিয়ে দেখে উমা, বড়ই রোগা হয়ে গেছে শরৎ, কেমন যেন বুড়িয়ে গেছে এই বয়সেই। অমন সুন্দর মুখ গাল চড়িয়ে চামড়া কুঁচকে বিশ্রী হয়ে গেছে। কমলা ওদের বসিয়ে রেখেই ‘আসছি’ বলে বেরিয়ে গিয়েছিল। দুজনে একা। নিজের অজ্ঞাতসারেই কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, ‘এমন চেহারা হয়েছে কেন তোমার? অসুখ করেছিল নাকি?’
‘আমার? কৈ না তো!’ তারপর একটু চুপ ক’রে থেকে বলল, ‘খাটুনি বেড়েছে বেজায়। নিজে একটা ছোটখাটো প্রেস করেছি কিনা—- বড্ড খাটতে হচ্ছে। পুজি ত অল্প।’
তারপর দুজনেই চুপচাপ
খানিক পরে মাথা হেট ক’রে মেঝেতে আঙুল দিয়ে দাগ কাটতে কাটতে শরৎ বললে, ‘চারদিকে দেনা–নইলে তোমার খরচপত্র ত কতই বা তা অল্প দু-এক
টাকার দরকার আছে তোমার?’
‘না। নিজেই রোজগার করছি এইমাত্র ত শুনলে। স্বামীর কাছ থেকে ভিক্ষেটা আর নাই নিলুম। তাতে ত আর আমার অভাব ঘুচবে না।’
‘আচ্ছা তাহ’লে উঠি এখন।’ শরৎ সত্যিই উঠে দাঁড়ায়।
‘এখনই!’ চাপা আর্তস্বরে বলে ওঠে উমা, ‘বহু লোকে ত বিয়ে করা বৌ রেখে বেশ্যাবাড়ি যায়,—-তুমি, তুমি বেশ্যাকে ফেলে বিয়ে করা বৌয়ের কাছে দু দণ্ডও থাকতে পারো না!’
–
শরতের মাথাটা হেঁটই ছিল, আরও হেঁট হয়ে এল, অনেক ইতস্তত ক’রে যেন প্রাণপণ চেষ্টায় সে উত্তর দিলে, ‘স্ত্রী বলেই তোমার কাছে থাকতে চাই না। ভাল না বেসে, মেয়েমানুষের কাছে যাওয়া যায় স্ত্রীর কাছে যাওয়া যায় না। তার সঙ্গে ঘর ক’রে, তার হাতে ভাত খেয়ে, তোমার কাছে আসাটা তোমাকে কি আরও অপমান করা হ’ত না? আমি তোমার স্বামী হবার যোগ্য নই-স্বামী নইও –তা বলে তোমার মর্যাদা আমি জানি না এটা মনে করো না। যেখানেই থাকি, যে অবস্থাতেই থাকি, মনে মনে অহরহ ভগবানকে ডাকি, আমি যেন শীঘ্র যেতে পারি। তুমি বিধবা হ’লে তবু এই অপমানের হাত থেকে বাঁচবে
শেষের দিকে শরতের গলা কেপে গিয়েছিল, সেই কাঁপন-লাগা গলার সুর আর শেষের কথাগুলো তন্ময় হয়ে উপভোগ, হ্যাঁ উপভোগই করছিল উমা স্তব্ধ হয়ে
দাঁড়িয়ে প্রদীপটার দিকে তাকিয়ে ছিল সে
কেমন একটা বিহ্বল ভাবে। তাই কখন
যে শরৎ বেরিয়ে গেছে তাও যেমন টের পায় নি, কমলা ভগ্নীপতির জন্যে জলখাবারের থালা সাজিয়ে যখন ঘরে ঢুকল তখন সেটাও তেমনি টের পেলে না।
‘এ কি, জামাই চলে গেল! মুখপড়ি দুটো মিনিটও ধরে রাখতে পারলি নি!’
উমার কানে বোধ হয় এ অনুযোগও পৌঁছল না। সে তেমনি পাথরের মতই দাঁড়িয়ে রইল স্থির হয়ে।
দুই
উমার সে অভিভূত অবস্থা সারারাতের মধ্যেও কাটল না। সমস্ত রাত সে ঠায় জেগে কাটিয়ে দিল। অবশ্য সেটা এখন তার প্রায় প্রাত্যহিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাল করে ঘুম তার একদিনও হয় না। তবে আজকের ব্যাপারটার মধ্যে একটা বিশেষত্ব ছিল সে ঘুমোবার চেষ্টাও করে নি। সারারাত বসেই ছিল। কমলা মধ্যে ঘুমের ঘোরে একটু বিস্ময় প্রকাশ করেছে, ‘ওমা উমি, তুই এখনও বসে আছিস্?’ আর প্রতিবারই উমা তাকে আশ্বাস দিয়েছে, ‘এই যে শুই দিদি!’ কিন্তু শোবার চেষ্টাও করে নি। আজকের রাত ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।
শরতের শেষের কথাগুলোও কথাগুলোও ততটা নয় যতটা তার গলার আওয়াজ ওর সমস্ত মর্মমূলকে গভীর ভাবে নাড়া দিয়েছে। শেষের কথাগুলো বলার সময় তার গলা কেঁপেছিল, কণ্ঠস্বর হয়ত বা একটু গাঢ় হয়েই এসেছিল সে যে কতটা, বা কী, তখন ভাল ক’রে শোনা বা বিচার করার অবসর মেলে নি, এতই আকস্মিকভাবে অতর্কিতে ও স্বল্প সময়ের মধ্যে কথাগুলো বেরিয়ে এসেছিল শরতের মুখ দিয়ে
শুধু ওর চেতনার ওপর সেই কথাগুলোর এবং সুরের যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সেই স্মৃতিটুকুই এক অপূর্ব মাধুর্যের ইন্দ্রজাল রচনা ক’রে রেখেছে উমার মনের মধ্যে। মরুভূমির মধ্যে যে তৃষ্ণার্ত পথিক পথ হারিয়েছে সে পয়ঃ-প্রণালীর জল পঙ্কিল কিনা বিচার করে না। উমা জীবনে স্বামীর ভালবাসা কি সে স্বাদ পায়নি– অপরের মুখে তার একটা ঝাপ্সা আভাস পেয়েছে মাত্র– তবু তৃষ্ণা যে সহজাত, · তৃষ্ণার উগ্রতা ত কিছুমাত্র কম নেই তার জন্য! ঐ সামান্য গলা ভার হয়ে আসা, ঐসামান্য কাঁপনটুকুকেই তাই ওর অন্তরের সমস্ত তৃষ্ণা আঁকড়ে ধরেছে। গাঢ় অন্ধকারে আলোক- রেখাকে অনেক সময় মানুষ সত্যি সত্যিই হাত বাড়িয়ে ধরতে যায়, দৈহিক স্পর্শ করতে চায় ক্ষণকাল পূর্বের একটি কণ্ঠস্বরকেও তেমনি উমা শুধু সমস্ত মন দিয়ে নয়– বিভ্রান্ত বিমূঢ় অবস্থায় যেন মধ্যে মধ্যে হাত বাড়িয়েও ধরবার চেষ্টা করছিল।
—
অবশেষে একসময় দূরে টেগোর ক্যাসেলের পেটা ঘড়িতে ঢং ঢং ক’রে তিনটে বেজে যেতে উমা যতদূর সম্ভব নিঃশব্দে দোর খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। রাত-বিরেতে একা সোমথ মেয়ে ছাদে বেরনো নিষেধ ছিল, কমলা বার বার ব’লে রেখেছিল বাইরে বেরোতে হ’লে যেন ডেকে বেরোয়। কিন্তু আজ যেমন কমলাকে ডাকাও সম্ভব নয় তেমনি ঘরের এই ক্ষীণ সেজ্–এর আলোতে চুপ করে বিছানায় বসে থাকাও অসম্ভব।
কি বলবে কমলাকে, অসময়ে ডাকার কি কৈফিয়ত দেবে? তার চেয়ে ভরসা ক’রে একা বেরিয়ে পড়া ঢের সহজ। কি আর হবে, চোর ডাকাত কি আর রোজই সব সময় ওৎ পেতে আছে বাইরে? তাছাড়া মনের এ অবস্থায় কোন দ্বিতীয় ব্যক্তির কথা কি কণ্ঠস্বর সে শুনতে প্রস্তুত নয়। কি এক অপূর্ব অনাহত সঙ্গীত যেন মনের তন্ত্রীতে বেজে চলেছে, সেদিকে সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে কান পেতে আছে সে অন্য কোন পরিচিত কণ্ঠস্বরের আঘাত লাগলেই যেন সে তন্ত্রী ছিঁড়ে যাবে সে সুর কেটে যাবে!
ছাদের ঠান্ডা বাতাসে তার রাত্রিজাগরণক্লিষ্ট দেহ জুড়িয়ে গেল। ওর মুখে চোখে যেন কে একটা স্মিগ্ধ প্রলেপ মাখিয়ে দিলে। কৃষ্ণপক্ষের শীর্ণ চাঁদ নতুন বাজারের আড়ালে তখনও ঢলে পড়ে নি কিন্তু তার আলোও বিশেষ নেই। তা না থাক, অন্ধকারও তেমন জমাট নয় রাস্তার আলোর দুটো তিনটে রেখা যে পড়েছে বোসেদের তিনতলা বাড়ির দেওয়ালে, তারই আভায় বেশ পরিস্কার দেখা যাচ্ছে ছাদটা।
―
উমা এগিয়ে এসে আলসেয় ঠেস দিয়ে দাঁড়াল।
নিস্তব্ধতা ও শান্তি। বিরাট শহর ঘুমোচ্ছে। নিজের মনের দিকে কান পেতে থাকার অপূর্ব অবসর।
মল্লিকদের বাড়িতে কুক সর্দার হাঁক দিয়ে যাচ্ছে একটানা ভয়াবহ একটা আওয়াজ ক’রে ওদের চিড়িয়াখানার সারস দুটোও শেষ প্রহর ঘোষণা ক’রে ডেকে উঠল বিশ্রী কর্কশ কণ্ঠে। আগে আগে এসব আওয়াজে ভয় করত উমার। বিশেষত ঐ কুক সর্দারের একটানা গম্ভীর ডাকে–কিন্তু আজকাল আর করে না। এমন কি আজ সে শব্দে ওর চিন্তারও ব্যাঘাত হ’ল না। তেমনি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে একমনে উপভোগ করতে লাগল ওর নবলব্ধ অভিজ্ঞতার অপরূপ অভিনবত্ব। নিশীথ রাত্রির শান্ত নীরবতা ও স্নিগ্ধ অন্ধকার ওর সে জাগ্রত স্বপ্নের বরং যেন সহায়তাই করল খানিকটা
সকালে উঠে উমার আরক্ত চোখের দিকে চেয়ে কমলা বিস্মিত হ’ল না। হতভাগিনীর মনের অবস্থা সে বোঝে বৈকি। রাতে ঘুম না হওয়াই ত স্বাভাবিক। বিধবা হবার পর কত রাত সে নিজেও ত চোখে-পাতায় করতে পারে নি। তাই সে প্রশ্নও
করলে না।
কিন্তু সে সত্যিই বিস্মিত হ’ল আর একটু পরে। উমির হ’ল কি! ওর মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি! লক্ষ্য করতে করতে রীতিমত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল কমলা।
উমা বরাবরই ধীর স্থির শান্ত প্রকৃতির মেয়ে। ওর মধ্যে কোন চপলতা কখনও লক্ষ্য ক’রে নি কমলা। কিন্তু আজও অকস্মাৎ এমন লঘু হয়ে উঠল কেন?
সিঁড়ি উঠছে সে লাফিয়ে লাফিয়ে, কাজ-কর্ম করছে অন্যদিনের অর্ধেক সময়ে সে-কাজে যে অনেক ভুল ঘটছে তা বলাই বাহুল্য আর সব চেয়ে আশ্চর্য কথা, রান্নাঘরে কাজ করতে করতে সেদিকে কেউ নেই ভেবে গুনগুন ক’রে কি একটা
গানও গাইছে।
উদ্বিগ্ন হবারই কথা –বিশেত এই দীর্ঘকাল যে দেখেছে উমাকে–তার পক্ষে এই একেবারে অস্বাভাবিক আচরণে! কিন্তু একটু পরেই মনের মধ্যে দুই আর দুইয়ে চার মিলিয়ে পেয়ে কমলার মুখ সকৌতুক স্মিতহাস্যে সহজ হয়ে আসে। কাল বোন এবং
ভগ্নীপতির মধ্যে কি কথা হয়েছে সে জানে না। স্বাভাবিক সঙ্কোচে সে প্রশ্নও করে নি। কি দরকার ব্যথার স্থানে ঘা দিয়ে? তবে একটা কি কথা হয়েছে ওদের মধ্যে এটা ঠিক, যার ফলে উমার অমন স্তম্ভিত ভাব, অপলকদৃষ্টি কাল সে দেখেছে। কাল ভেবেছিল আরও দুঃখের আরও বেদনাদায়ক কিছু ঘটেছে– শরতের কথার মধ্যে আরও বেশি হতাশার আভাসই পেয়েছে উমা।
আজ প্রথম মনে হল যে, তা হয়ত নয়। হয়ত বা শরৎ তার ব্যবহারে একটু সহানুভূতি বা একটু স্নেহের ভাবই দেখিয়েছে। হয়ত বা
আজও প্রশ্ন করতে সঙ্কোচে বাধল কিন্তু আড়ে আড়ে যতই লক্ষ্য করলে কমলা ততই তার বিশ্বাসই দৃঢ় হ’ল। মনের মধ্যে দক্ষিণা বাতাস রয়েছে ওর তাই বাইরে ওর এই লঘু চপলতা। কোন্ বসন্তের স্পর্শ লাগল তা অনুমান করাও ত শক্ত নয়!
উমা আজ টেনে টেনে অনেক কাজ করল। বেশি ও বাড়তি কাজ। সবময়দা নিয়ে মাখাতে বসল কমলাকে। কোন নিষেধই শুনল না। বললে, ‘বিধবা হয়েছ ব’লে কি গায়ের ময়লা জমিয়ে রাখতে হবে নাকি?’ গোবিন্দকে অকারণ আদর করতে লাগল যখন-তখন। কথায় কথায় হাসিতে ফেটে পড়তে লাগল। ওর পক্ষে এটা এতই অস্বাভাবিক যে বুড়ী ঝিটা পর্যন্ত বিস্মিত হয়ে কমলার দিকে চাইতে লাগল বার বার। তার দৃষ্টিতে নীরব প্রশ্ন ব্যাপার কি?
ফলে কমলাও খুশী রইল সারাদিন।
কিন্তু সেদিন আরও অঘটন ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। সন্ধ্যের দিকে একটি ঝি-গোছের স্ত্রীলোক কড়া নেড়ে ফরসা ন্যাকড়ায় জড়ানো একটি পুলিন্দা দিয়ে বলে গেল, ‘আমাদের বাবু শরৎবাবু পাঠিয়ে দিয়েছেন বৌদির জন্য তেনার দিদির হাতে দিতে বলেছেন।’
—
ওদের ঝি গিরিবালা সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল লাফাতে লাফাতে। কথাটা এতই অবিশ্বাস্য যে বুঝতে কমলার বেশ খানিকটা সময় লাগল। তারপর যখন সত্যিই শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারল তখন সে ব্যাকুল হয়ে বললে, ‘ওরে তাকে ডাক ডাক সবটা শুনি। ওকে একটু জল খাওয়াতে হবে যে, কিছু পয়সা–’
কিন্তু ততক্ষণে সে মানুষটি উধাও হয়েছে। বোধ হয় সেই রকমই নির্দেশ ছিল শরতের। কমলা বিলাপ করতে লাগল, ওদের ঝি গিরিও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, ‘আমি ত তাকে চলে যেতে বলি নি বড়দি, দাঁড়াতেই ত বন্নু। বন্ধু যে এখানে তুমি খাড়া থাকো, আমি বড়দিকে খবরটা দিয়ে আসতিছি তা সেই বা কেমনতরো মানুষ, বলা নেই কওয়া নেই –যার জিনিস তার হাতে পঁওছাল কি না তার খবর নেই
ক’রে হওয়া?’
অমনি হুট
কমলা ওপরের ন্যাকড়াটা খুলতেই দেখলে একজোড়া কালোপাড় ভাল ফরাসডাঙার শাড়ি। খেলো হাটুরে কাপড় না বেশদামী শাড়ি। অন্তত ছ-সাত টাকা জোড়া হবে। শরৎ পাঠিয়েছে তার স্ত্রীর জন্য। আনন্দে চোখ ছলছল করতে লাগল কমলার।
তখন উমা ছিল না, পড়াতে গিয়েছিল। পড়িয়ে সন্ধ্যের আগে বাড়ি ফিরতে কমলা প্রায় ছুটতে ছুটতে গিয়ে খবরটা দিলে, ‘উমি উমি, শরৎ জামাই তোর জন্যে একজোড়া
১৭৩
কাপড় পাঠিয়েছে। বিলিতি কাপড় নয়, হেটো শাড়িও নয় বেশ দামী শাড়ি!’
‘কে, কে পাঠিয়েছে?’
প্রায় আর্তনাদের মতই শোনায় উমার প্রশ্নটা।
‘শরৎ জামাই। কে একটি মেয়েছেলে এসে দিয়ে গেল।’ আঘাত সয়েছিল উমা
আসল ফরাসডাঙার—
এতকাল অনায়াসেই। কিন্তু স্নেহের এই আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত নিদর্শনে ওর মনে বহু বিপরীতমুখী ভাবের যে প্রতিক্রিয়া হ’ল তা সে সইতে পারলে না। বিশেষত গতকাল সন্ধ্যা থেকে এই চব্বিশ ঘন্টা ওর মনের ওপর দিয়ে একটা অবর্ণনীয় ঝড় বয়ে গেছে, তার ফলে ওর স্নায়ু হয়ে পড়েছে আরও অবসন্ন, আরও ক্লান্ত। এই প্রচন্ড আঘাত সহ্য করার শক্তি আর তার নেই।
তারপরই
কী যেন একটা বলতে চেষ্টা করল উমা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই বলা হ’ল না সামান্য একটা অস্ফুট শব্দ হ’ল মাত্র, ঠোঁট দুটো কাঁপল থথর্ ক’রে দিদির বুকের ওপর ওর মূর্ছিত দেহটা এলিয়ে পড়ল।
তিন
কাশীতে আসার দিন পনরোর মধ্যেই রাসমণি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলেন। এর আগে কখনও তিনি এদিকে আসন নি, তাছাড়া বহুদিন ধরেই কলকাতার ঐ সঙ্কীর্ণ গলির মধ্যে, বিশেষ চারটে দেওয়ালে আটকে ছিলেন, কাজেই তাঁর উন্নতি দ্রুত হবারই কথা। তাছাড়া জল-হাওয়ার গুণ ত আছেই। ঘি-দুধ-আনাজ সবই সস্তা এবং সুস্বাদু। তার ওপর– গঙ্গা। এবং বিশ্বনাথ। অনেক দিন পরে যেন মনটাও তাঁর হালকা আর সহজ হয়ে ওঠে।
একটু সুস্থ হয়ে ওঠার পর থেকেই রাসমণি নিজে হেঁটে বিশ্বনাথ দর্শনে যেতে শুরু করলেন। আরও দিন পাঁচেক পরে বিকেলে রাণীভবানীর গোপাল-বাড়িতে কথকতা আর দশাশ্বমেধ ঘাটে রামায়ণ গান শোনা আরম্ভ হ’ল। এ এক নতুন জীবন I অনাস্বাদিতপূর্ব আনন্দ আছে এতে। রাসমণি এত আনন্দ কল্পনা করেন নি বহুকাল। কলকাতার বাড়িতে যে দুটি-তিনটি প্রাণী আছে তাদের চিন্তা যেন সেই বাড়িতেই সীমাবদ্ধ আছে, এতদূরে এসে পৌঁছয় নি।
কিন্তু শ্যামা ছট্ফট করে। হেম আছে সেখানে পড়ে। কে তাকে রেঁধে খাওয়াচ্ছে? নরেন এল কিনা কে জানে! এসে যদি হেমকে মারধোর করে– সে দুশ্চিন্তা ত আছেই। দু-একটা যা ঘটিবাটি আছে তাও হয়ত বেচে খাবে সে। তাকে ব’লে আসাও হয় নি। হাজার হোক স্বামী ত! বহুদিন তার দেখা পায় নি– সে কথাটাও মনে আছে বৈকি একবার যদি এসে ফিরে যায়-আবার হয়ত কতদিন আসবে,
অভাববোধটাও মধ্যে মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে।
তাছাড়া রাসমণি সম্বন্ধেও শ্যামা একটু হত
অস্বীকার ক’রে কোন লাভ নেই।
198
বিচিত্র কারণে তার
নে মনে। সে কথা
এই এক মাস সেবার সুযোগে, সহস্র অন্য প্রসঙ্গের ফাঁকে ফাঁকে বার বার কথাটাই পেড়েছে শ্যামা। রাসমণির হাতে ঠিক কতটা আছে, কতখানি ভরসা করা যেতে পারে তাঁর ওপর! কিন্তু প্রতিবারেই ঐ এক উত্তর পেয়েছে, বেশি নেই, তলা ছুঁয়ে এসেছে এবার। বড়জোর আর তিনচার বছর। তারও বেশি যদি বাঁচেন ত সিন্দুকের
বাসন বেচতে হবে হয়ত।
ঘুরিয় ফিরিয়ে সেই একই কথা। শোনে আর মনের মধ্যে একটা হিম-শীতল হতাশা অনুভব করে শ্যামা। রাসমণি মিছে কথা বিশেষ বলেন না তা সে জানে। টাকার কথায় এতকাল পরে মিছে বলবেন সেটা বিশ্বাস্য নয়। আর এই এত বার এত ভাবে জেরা ক’রে যখন একই উত্তর মিলছে, তখন সামান্য মাত্র সংশয়েরও অবকাশ কোথায়! পাকা মিথ্যাবাদীরাও এত জেরায় মিথ্যাকে জিইয়ে রাখতে পারে না।
হবে।
অর্থাৎ আশা-ভরসা আর কোথাও বিশেষ রইল না। যা করতে হবে তাকেই করতে
এই সত্যটাই যেমন একটু একটু ক’রে মনের মধ্যে দৃঢ়মূল হয়, তেমনি এই প্রবাসের ওপর বিতৃষ্ণা বাড়ে। বাড়ি ফেরবার জন্য ছটফট করে সে।
ঠিক সতরো দিনের মাথাতেই কথাটা পাড়ে, সে ‘মা, তাহ’লে ফেরার কথাটা কি ভাবছেন?
রাসমণি যেন চমকে ওঠেন। ফেরার কথা এরই মধ্যে? তিনি যে একে-বারেই না ফিরতে পারলে বাঁচেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রাঘবের দিকে চান।
‘এরই মধ্যে কি গো মেজদি! এই ত সবে দু হপ্তা হ’ল। শরীরটা মার সারুক একটু। এত তাড়াহুড়ো ক’রে ফিরিয়ে নিয়ে গেলে এত পয়সা খরচ সব বরবাদ হয়ে যাবে। সেখানে গিয়ে আবার পড়বেন। তার চেয়ে আর কটা দিন থাকো কাদায় গুন
ফেলে।
তারপর একটু থেমে বলেন, ‘আর দুদিন পরেই নাকি রামনগরের বেগুন উঠবে, শুনেছি একোটা বেগুন সাত-আট সের পর্যন্ত ওজন হয় আর তেমনি নাকি মিষ্টি। এখানে আবার সের দরে বিক্কিরি হয় এক পয়সা সের। সে বেগুন না খেলে জীবনই
এলে কত কান্ড করে, খেয়ে যাবে না?’
বৃথা! বড় কপিও উঠবে শীগিরি —
শ্যামা বেশ একটু বিঁধিয়েই জবাব দেয়, ‘তোমার কি বলো না বামুনদাদা, তুমি দিব্যি পরের পয়সায় বসে বসে ভালমন্দ খাচ্ছ, তোমার কি আর যেতে মন সরবে? কিন্তু আমি যে ছেলেমেয়ে ছেড়ে এসেছি সেখানে। দুধের বালক একা পড়ে রয়েছে– দু- দুটো নিত্য-সেবা, তার ওপর পড়াশুনো কী করছে কে জানে! যদি অসুখেই পড়ে?
এখানে ঐ এক ফোঁটা মেয়ে নিয়ে দিদিও হয়ত হয়রান হচ্ছে!’
রাঘব ঘোষালের বয়স হয়েছে, তার ওপর এদের বহুকাল দেখছেন। তিনি চটলেন না, বরং বেশ প্রশান্ত মুখেই জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ গো শ্যামা ঠাকরুন, তা সত্যি পরের পয়সায় এসেছি, ভালমন্দ খাচ্ছি—এমন কি আর এ কাঠামোয় জুটবে আবার? সে লোভ ত আছেই। তা তোমারও ত সেই কথাই ভাই। পরের পয়সা না হলে তোমারই কি আর আসা হত? তাছাড়া এটাও ভেবে দ্যাখো
যার পয়সা আর যার জন্যে এত
১৭৫
খরচা, তার দিকটাও ত দেখতে হবে। আর কটা দিন অন্তত না থাকলে এসে আর লাভ কি হল এত কান্ড ক’রে?’
শ্যামা গুম্ খেয়ে যায়।
রাঘব ঘোষাল বলেন, ‘মেয়ে তোমার ভালই আছে। এক যা ছেলে
তা ছেলের
কথা যদি বলো, দুঃখীর ঘরে জন্মেছে, দুঃখ ত ভোগ করতেই হবে। এই বয়সে ছেলে তোমার কী না করলে! এই কি আর ওর খেটে খাবার বয়স?’
শ্যামা সেদিন চুপ ক’রে গেলেও বেশিদিন চুপ ক’রে থাকে না, মধ্যে মধ্যেই তাগাদা লাগায় –‘মা, বাড়ি ফেরার কথা কি ভাবছেন?’
—
রাসমণি শেষ পর্যন্ত উত্ত্যক্ত হয়েই ওঠেন। কিন্তু তবু যেতেও মন সরে না। বহুদিন পরে একটু শান্তির মুখ দেখেছেন। নীল স্বচ্ছসলিলা গঙ্গা আর বিশ্বনাথ! জ্বালা জুড়োবার এই ত জায়গা। গঙ্গার জলে চোখের জল মিশে বিশ্বনাথের মাথায় পড়ে যখন, তখন সত্যিই প্রাণটা ঠান্ডা হয়ে যায়।
‘এক মাসের ভাড়া দেওয়া আছে যখন তখন এ কটা দিন অন্তত থেকে যাই। আর না হয় বেশী দিন ভাড়া না-ই দিলুম!’
অগত্যা শ্যামাকে বিরস বদনে চুপ ক’রে থাকতে হয়।
অবশেষে একদিন আঁধারে একটুখানি আলো দেখতে পায় শ্যামা।
রাঘব ঘোষালই একদিন খাওয়াদাওয়ার পর তামাক ধরাতে ধরাতে প্রশ্ন করেন, ‘তোর মেজ মেয়েটাকে লেখাপড়া শেখাবি না মেজদি? বয়স কত হ’ল? চার না পাঁচ? নাকি ওকেও অমনি মুখ্যু ক’রে রেখে বিয়ে দিয়ে সেরে দিবি?’
‘লেখাপড়া কোথায় শেখাব বামুনদাদা? ও বন-গাঁয়ে ওসব কথা কি কেউ শুনেছে? এক ঘরে পড়াতে পারি–নিজে যতটুকু জানি, কিন্তু তাই বা সময় কোথায় বলো?…. দুঃখের পেছনে দড়ি দেব, না ঐ করব?’
‘তা বটে!’
হঠাৎ শ্যামা বলে বসে, ‘আচ্ছা, ঐন্দ্রিলা উমির কাছেই দিনকতক থাক না মা ত কত পরের মেয়েকে লেখাপড়া শেখাচ্ছে, নিজের বোনঝিকে একটু পড়াতে পারবে না?’
রাসমণি চমকে ওঠেন।
‘উমির কাছে? ওর সময় কোথায়? বারোটায় যায় সন্ধ্যেয় ফেরে।’
13
‘সে ত আরও ভালো মা ঐ সময় আপনি একা থাকেন তবু হাতনুড়কুৎ একটু কাছে থাকতে পারে। মেয়ের আমার বয়স কম বটে –কিন্তু দুঃখীর ঘরের মেয়ে, শান্ত আছে অন্তত বায়না নিয়ে কাঁদবে না। তাছাড়া কাজকর্মও কিছু কিছু শিখেছে আদর দেবার মত ত আমার অবস্থা নয়।
আমার কাছে বয়স থেকেই খাটতে শেখে।
•
রাসমণি তবু চুপ করে থাকেন। নতুন ক’রে ঝঞ্ঝাটে জড়াতে যেন ইচ্ছা করে না।
আবার ভাবেন, সত্যি উমাটা বড় একা, তবু একটা ছোট ছেলেমেয়ে কাছে থাকলে তাঁকে নিয়েও দু দন্ড কাটে।
দু
১৭৬
‘কী বলেন মা?’
‘তোমার বাছা সব তাইতে তাড়া। একটু বিরক্ত হয়ে ওঠেন রাসমণি, ‘ভেবে দেখি। গিয়ে উমাকে বলি। তার মতামতও নিতে হবে ত! ঝুঁকি ত তারই।’
শ্যামা নিশ্চিন্ত হয়। উমাকে রাজী করানো এমন কিছু কঠিন ব্যাপার হবে না। ঐন্দ্রিলা তার সুন্দরী মেয়ে–গর্ভের সেরা। কোনমতে আর তিনটে বছর কাটলেই বিয়ের সম্বন্ধ করে ফেলতে হবে। ততদিন এদের মায়া পড়ে যাবে। এঁরাই কি আর ফেলতে পারবেন। বিয়ের খরচটা যেমন করেই হোক টানবেন।
মনে মনে হিসাব করতে বসে সে আরও কি কি সুবিধা হবে। এখানে থাকা তার ফলে ক্রমে বেশি অসহ্য হয়ে ওঠে।
কমলার চিঠি এসেছে কদিন আগে। তাতে নরেনের খবর আছে, আর আছে শরতের খবর। শরৎ নাকি একজোড়া কাপড় পাঠিয়েছে উমার জন্যে। হয়ত এতদিনে উমার দিকে মন টেনেছে। তা যদি হয়– উমা যদি স্বামীর ঘর করতে চলে যায় কোন অদূর ভবিষ্যতে
তার নিজেরই ছেলে-পুলে হতে শুরু হয় –তখন কি আর ঐন্দ্রিলাকে দেখবে সে! না শরৎ ওকে নিয়ে যেতেই দেবে!… নিজের অজ্ঞাতসারেই শঙ্কিত হয়ে ওঠে শ্যামা। তারই কপাল, নইলে এত দিন পরে ঠিক এই সময়েই শরৎ–
না না –ছিঃ ছিঃ! এ কি কথা ভাবছে সে! একমসময় চমক ভেঙে দারুণ লজ্জিত হয়ে পড়ে নিজের স্বার্থপরতার জন্যে। উমা সুখী হোক। তার জন্যে কিছু নয়। তার কপালে যা আছে তা আছেই। তা ছাড়া এখনই দু-একটা মাস কাটবে। ততদিনে উমার ত মায়া পড়ে যাবেই –চাই কি মায়েরও পড়তে পারে।
নরেন এসেছিল। কোথায় গেল কে জানে! আবার কবে আসবে!… জানালা দিয়ে ওপারে রামনগরের দিগন্ত-প্রসারিত ধূ-ধূ মাঠের দিকে চেয়ে স্বামীর কথা ভাবে শ্যামা।
চার
উমাকে রাজী করানোটা যত সহজ হবে ভেবেছিল শ্যামা, কলকাতায় ফিরে তার কাছে প্রস্তাবটা করতে দেখা গেল কাজটা মোটেই তত সহজ নয়। উমা প্রথমটা বুঝতে পারে নি শ্যামার মুখের দিকে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে ছিল। দ্বিতীয়বার কথাটা বুঝিয়ে বলতে সে একবার ঘাড় তুলে মার দিকে তাকাল। সে মুখ ভাবলেশহীন জপের মালা হাতে তিনি স্থির শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন জানালাটার দিকে . অর্থাৎ কোন দিকেই মেয়েকে প্রভাবিত করতে চান না। সেদিক থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দিদির দিকেও তাকাল উমা, তারপর মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বললে, ‘তুমি আমাকে মাপ করো ভাই, সে আমি পারব না।’
—
শ্যামা আর যাই হোক এমন সাফ জবাব আশা করে নি। সে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল বোনের দিকে।
>
‘পারবি না? সে কি? কেন? ভালই ত হত থাকলে বেশ কিছু সময় নিয়ে আস্তে আস্তে থেমে থেমে–কতকটা যেন অসংলগ্নভাবেই প্রশ্ন করে শ্যামা।
কলকাতার কাছেই 13
১৭৭
‘আমার ভালটা আমাকেই দেখতে দাও তোমরা। সে আর কারুর পক্ষেই কোন দিন দেখা সম্ভব নয়।’
কিন্তু কেন–তোর কি অসুবিধা হবে শুনি?’ এতদিনের সমস্ত জল্পনা-কল্পনা এই ভাবে হঠাৎ তাসের বাড়ির মত ভেঙে পড়বে! আশা-ভঙ্গের ক্ষোভে তীক্ষ্ম শোনায় শ্যামার কণ্ঠস্বর।
উমা বোধ হয় একটু কঠিন জবাবই দিতে যাচ্ছিল, হয়ত বলতে যাচ্ছিল যে ‘সুবিধাই বা কি হবে?’ কিংবা হয়ত বলতে যাচ্ছিল, ‘আমার সুবিধা-অসুবিধা আমি বুঝব, তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি?’ কিন্তু মুখ ফাঁক করেও থেমে গেল সে। খানিকটা চুপ করে থেকে বললে, ‘কি দরকার,ভগবান যখন ও ঝঞ্ঝাট আমাকে দেননি, তখন মিছিমিছি পরের হাঙ্গামায় জড়িয়ে কি হবে?’
‘ও কি তোর পর?’ কমলাও যেন একটু বিরক্ত হয়ে ওঠে উমার এই রূঢ় প্রত্যাখ্যানে।
‘নিজের সন্তান ত নয় দিদি। যত যত্নই করি সে ওরই সন্তান হয়ে থাকবে, তার ওপর আমার সত্যিকার অধিকার কোন কারণে কোনদিনই জন্মাবে না।
‘বেশ ত, তুই পুষ্যি নে ওকে।’ শ্যামা সাগ্রহে বলে।
তাতেও ঐ পুষ্যি শব্দটা লেগেই থাকবে চিরকাল। ওটা শুনলেই আমার ঘেন্না করে। না ছোড়দি, অশ্বত্থামার মত পিটুলি-গোলা খেয়ে দুধের স্বাদ আন্দাজ করার দরকার নেই আমার। সংসারের জন্যে ভগবান আমাকে পাঠাননি।’
এরপর সকলেই কিছুকাল চুপচাপ বসে থাকেন।
রাসমণির জপের মালা তেমনিই ঘোরে। তাঁর মুখ দেখে বোঝবার জো নেই তিনি কি চান।
খানিক পরে শ্যামা তার কৌশল বদলায়। ঈষৎ ক্ষুণ্নস্বরে বলে, ‘আর কিছু নয়– লেখাপড়াটা একটু শিখত। মার কাছে থাকলে আদব-কায়দাগুলোও রপ্ত হত। সুন্দর মেয়ে, একটু লেখাপড়া শেখালে ভাল ঘরে পড়তে পারত—-এই আর কি!’
কমলা এবার সোজাসুজি মাকে আক্রমণ করে, ‘মা, কি বলেন?’
রাসমণি শান্তভাবেই জবাব দেন, ‘আমি কি বলব বাছা, আমার ত ও ধকল সহ্য করার শক্তি নেই যে আমি জোর করে বলব রেখে যাও। যাকে করতে হবে সে নিজের সুবিধে-অসুবিধে বুঝবে–
ওর মধ্যে আমার কথা বলা ঠিক নয়।’
}
কমলার মন ইতিমধ্যে গলেছে, সে একটু জেদ করার মতই বললে, ‘কিন্তু মার কথাটাও তোর ভাবা উচি উমি, তুই ত চার-পাঁচ ঘণ্টা বাইরে থাকিস–সে সময় এত বড় বাড়িতে উনি একা থাকেন। ওঁর ত ঐ শরীর। তবু মেয়েটা কাছে থাকলে একটু মাথায় বাতাস করতে পারে, এক ঘটি জল গড়িয়ে দিতে পারে।’
উমা উঠে দাঁড়ায় একেবারে, ‘তোমাদের সকলের যখন ইচ্ছে তখন আর আমার মত নিচ্ছ কেন! বেশ, থাক ও। কিন্তু, দিদি, মা নিজেই কতদিন বলেছেন, পরের বাছা নাচাবে হাসাবে, কাঁদাবে না। শাসন করার অধিকার না থাকলে ছেলেমেয়ে মানুষ করা যায় না।’
১৭৮
শ্যামা ব্যস্ত হয়ে ওঠে, ‘শাসন তুই যা খুশি করা। ওমা সে কি কথা তুই ওকে কেটে দু’খানা করে ফেললেও আমি কিছু বলব না।’
‘তা হয় না ছোড়দি’, দাঁড়িয়েই জবাব দেয় উমা, ‘সে তুমিও জানো, আমিও জানি। বাজে কথা বলে লাভ কি! যত যত্নই করি সে কথা কেউ মনে রাখবে না, সামান্য যদি শাসন করি সেই দুর্নাম চিরকাল থাকবে। পরের সন্তান মানুষ করার ঐটুকু পুরস্কার! মা ত সামনেই বসে আছেন–ওরই মুখে এসব আমার শোনা। ওকেই জিজ্ঞাসা করো না।’
সে আর দাঁড়ায় না, ঘর থেকে বেরিয়ে যায় একেবারে।
এর পর হয়ত মেয়েকে নিয়ে যাওয়াই উচিত ছিল শ্যামার কিন্তু এতদিনের দারিদ্র্য তাকে যে সব মহৎ শিক্ষা দিয়েছে তার মধ্যে এইটি প্রধানঃ স্বার্থসিদ্ধি যেখানে উদ্দেশ্য সেখানে চক্ষুলজ্জা করার কোন অবসর নেই। সে উমার সমস্ত খোঁচা নীরবে হজম করে ঐন্দ্রিলাকে এখানেই রেখে গেল।
পাঁচ
একটানা দারিদ্র্যের মধ্যে শ্যামার দিন তেমনি একঘেয়ে ভাবেই কাটে। তেমনি প্রতিদিনের যুদ্ধ। পরের দিনের কথা ভেবে প্রায় প্রতি রাত্রেই তেমনি দুশ্চিন্তায় কণ্টকিত থাকা।
হেম পড়াশুনো করে নিয়মিত পুরুতগিরি করলে তার ইস্কুলে কামাই হয় অর্ধেক দিন। তাছাড়া সে ছেলেমানুষ, দশকর্মের কাজে অর্থাৎ বিয়ে-পৈতেতে তার ডাক পড়ে না। দুটো নিত্য-সেবা আর লক্ষ্মীপূজো ভরসা ত এই। ষষ্ঠীপূজো, মনসাপূজোতেও ইদানীং ডাকছে কেউ কেউ। হয়ত আর দু-এক বছর গেলে সরস্বতী পূজোতেও ডাকবে। কিন্তু সে দুরের কথা। খন্দ লক্ষ্মীপূজো কি মনসাপূজোতে কেউ কাপড় দেয় না। ষষ্ঠীপূজোও তাই বড়জোর দেড়হাতি লাল গামছা। শুধু নৈবিদ্যির চাল, কাটা ফল, বাতাসা এই ত পাওনা। আর চার পয়সা, বড়জোর দু আনা দক্ষিণে। তাও পৌষ ভাদ্র চৈত্র
এ ছাড়া নয়। ষষ্ঠীপুজোটাই নিয়মিত ছাড়া আকস্মিকও হয় ছেলেপুলে হ’লে, তবে তাতে হেমকে কেউ ডাকে না। লক্ষ্মীপুজো মনসাপূজোটাই ভদ্রপাড়ায় প্রায় ঘর-ঘর হয়, এবং সেই সময়ই পড়ে পুরুতের টানাটানি।
সুতরাং দীর্ঘকালব্যাপী টানা উপবাসগুলো বন্ধ হয়েছে মাত্র, আর কিছুই হয় নি। উঞ্ছবৃত্তি তেমনই চলছে। তেমনি পাতা কুড়োনো, ফল চুরি। পিকী প্রকাশ্যেই বলে, ‘বাববা, বামুনদিদি এক মাস ছিল না– বাগানে দুটো ফলের মুখ দেখেছিলুম। আবার তোমার কাশী যাওয়ার দরকার হয় না–হ্যাঁ, বামুনদি?’
এসব কথায় কান দিতে গেলে চলে না স্মিত-প্রসন্ন মুখে ও সপ্রতিভ ভাবেই ‘তাই ত! তা আর নয়!’ বলে, আর কথাটা পিঁকীর তরফে কি ঠাট্টা এই ভাবে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে।
এর ভেতর আর একটি সন্তানও হয়েছে শ্যামার। সেই সময়টা কয়েকবার ঘন ঘন এসেছিল নরেন– মঙ্গলা ঠাকরুন বলেন, ফল টানে। কারণ শ্যামা অন্তঃসত্ত্বা হওয়া
১৭৯
সংবাদটা শুনেই সেই যে সে অন্তর্হিত হয়েছে আর আসে নি। শুধু তাই নয়, বাসন- কোসন বেচেও হয়ত আঁতুড়টা তোলা যেত কিন্তু সে উপায়ও রেখে যায় নি। শেষবার যাবার সময় যা দু-একটা দানে বা সামাজিকে পাওয়া পেতলের বাসন ছিল–সমস্ত নিঃশেষ করে নিয়ে গেছে। কতকগুলো পুরনো বাসন শিবপুর বাজারে ঝালাতে দেবার নাম করে আগের দিন সরিয়ে ছিল, বাকী অর্ধেক অর্থাৎ নতুনগুলো শ্যামার স্মানে ও হেমের নিত্যসেবায় বেরিয়ে যাওয়ার অবসরে কখন নিয়ে সরে পড়েছে তা কেউই টের পায় নি। সে যে এই সামান্য পেতলের বাসন চুরি করবে তা শ্যামা কল্পনাও করে নি, নইলে হয়ত সাবধান হ’ত।
তাও–সবই যে গেছে, এতটা বুঝতে পারে নি। কিন্তু মঙ্গলা এসব ব্যাপারে পাকা মানুষ, তিনি চোখের পলকে সবটা অনুমান করে নিলেন, ‘অ বানি, তোর সেদিনের ফুটো বাসনগুলোর ঐ এক দুগ্গতি হয়েছে। দেখ্দ্ধে যা। একদিনে অত হাঁড়ি কলসী সরাতে পারবে না বলেই সেদিন ঐসব কথা বলে অদ্ধেক সরিয়েছে। ফন্দিটা কেমন খেলেছে! মিসে কম ফাজ! তা নইলে যে মানুষ সংসারের কুটি ভেঙ্গে দুখানা করে না, সে এখান থেকে দেড়কোশ দুকোশ রাস্তা ভেঙে শিবপুর যাবে তোর ফাটা বাসন ঘাড়ে ক’রে সারাতে! ক্ষেপেছিস তুই!’
কথাটা ঠিকই। এখন সেটা শ্যামাও বুঝতে পারে। তখনই কথাটা বিশ্বাস করা বাতুলতা হয়েছে।এত গরজ নরেনের হবে সংসারের জন্যে যে ভাঙা ফুটো বাসন ঘাড়ে করে যাবে শিবপুরের বাজারে! অথচ সেদিন যখন সে প্রস্তাবটা করেছিল তখন একটুও অসম্ভব শোনায় নি কথাটা, ‘কবে রাং-ঝাল-ও’ লা দয়া ক’রে আসবে সেই ভরসায় বসে থাকবি? তাছাড়া ও বেটারা ত গলাকাটা! দে বরং শিবপুরের বাজার থেকেই সারিয়ে আনি। কতক্ষণ আর লাগবে যাবো আর আসবো।’
নেব।’
―
পয়সাও বেশি চায় নি, গণ্ডা চারেক পয়সা দে এখন। বাকিটা পৈতে দেখিয়ে সেরে
পৈতে দেখিয়ে মানে–?’
‘বেশি পয়সা চাইলে প্রথমটা বলব বামুনের ছেলের কাছ থেকে বেশি নিস নি বাবা, যা দিচ্ছি তাই নে। তাতেও যদি না শোনে ত পৈতে ছিঁড়ে শাপ দেবার ভয় দেখানো। তারপর পয়সা চাইবে এমন কার বুকের পাটা আছে ও বাজারে তাই শুনি! হিন্দু ত হিন্দু– পৈতে ছিঁড়ে মন্যি দেবে শুনলে মুসলমানরা সুদ্ধ ভয় পাবে!
হা-হা ক’রে হেসেছিল নরেন
নিজের চতুরতায়।
শ্যামা আজও স্বামীকে বিশ্বাস করে, আশ্চর্য! বিশ্বাস করেই চার আনা পয়সা খুঁজে- পেতে বার করে দিয়েছিল। বড় ঘড়াটার জন্যে সব চেয়ে অসুবিধা হচ্ছিল– একেবারে একঘড়া জল আনলে নিশ্চিন্ত! নইলে ছোট ঘড়ায় বার বার জল আনতে কষ্ট হয়। যাওয়া- আসার মেহনত ত সমানই। একবারের কাজ তিনবারে করবার সময়ই বা কৈ ওর!
এমন কি সন্ধ্যাবেলা যখন খালি হাতে ফিরে এল নরেন তখনও এতটা সন্দেহ করে নি শ্যামা। ওকে ফিরে আসতে দেখেই সমস্ত সংশয় চলে গিয়েছিল মন থেকে। মুখেই বলেছিল, ‘কৈ গো আমার বাসন কৈ? বেচে খেয়ে এলে নাকি?’
Sto
হা-হা ক’রে হেসেছিল নরেন তাতেও, ‘বেড়ে বলেছিস ত! তোর ঐ ফুটোফাটা পেতলের-বাসন গোচ্ছার কে কিনবে তাই শুনি! কিনলেই বা ক পয়সা হবে? তা নয়, আজ যে শিবপুর বাজারে বারোয়ারী আজ কাল কেউ হাপর জ্বালবে না। পরশু সক্কালবেলা ক’রে রাখবে বলেছে–যখন হোক গিয়ে নিয়ে আসব।’
শ্যামা আশ্বস্ত হয়েছিল।
সত্যিই ত, ঐ ত কটা চাদরের ঘড়া আর হাঁড়ি– কীই বা তার দাম! আর বেচে দিলে ফিরে আসবেই বা কেন, তাহলে ত ঐখান থেকেই পালাত!
তাই- পরের দিনের চুরিটা যখন একটু একটু ক’রে ধরা পড়ল তখনও তার সঙ্গে আগের দিনের ঘটনার কোন যোগাযোগ দেখতে পায় নি শ্যামা। এখন মঙ্গলার কথাতেই সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল।
‘এখন আঁতুড় তুলবি না বাসন কিনবি, কী করবি কর্!’ এই বলে আর একদলা দোক্তা মুখ-গহ্বরে ফেলে নিশ্চিন্ত হয়ে বেরিয়ে যান মঙ্গলা।
কিন্তু শ্যামা ঘুমোতে পারে না। চেয়েচিন্তে সামান্য হয়– পুরো খরচা ওঠে কি ক’রে?
অবশেষে মাকেই চিঠি লিখতে হয়েছিল। মা চিঠির উত্তরও দেন নি, শুধু পাঁচটি টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, আর কমলা বোধ হয় মার কাছ থেকে শুনেই আর দুটি টাকা পঠিয়েছিল।
গোপনে
‘আহা–দিদিটার ও যদি অবস্থা ভাল থাকত!’ মনে মনে আক্ষেপ করে তাই শ্যামা– বলে, আঁটকুড়ো যে হয় তার পৌত্তুরটি আগে মরে! আমারও হয়েছে তাই, যে দয়া করতে পারত তার সর্বনাশ আগেই হয়ে ব’সে রইল। শুধু আমাকে দুঃখ দেবেন ব’লেই ভগবান এই কান্ড করলেন!’
জীবনের সমস্ত দিক যখন দিক্চিহ্নহীন নৈরাশ্যের কুহেলিকায় আচ্ছন্ন, ভবিষ্যতের কোন পথরেখা যখন কোন দিকে নেই, তখন অকস্মাৎ একটি সংবাদ শ্যামার কানে এসে পৌঁছল। ওর মনে হ’ল রাত্রির শেষ হয়েছে এবার, উষার স্বর্ণরেখা কুয়াশার ধূসর অনিশ্চিতকে দ্বিখন্ডিত ক’রে উজ্জ্বল পথের ইঙ্গিত দেবে।
শোনা গেল বার-দুই থার্ড ক্লাসে ফেল করবার ফলে অম্বিকাপদর ইস্কুলে যাওয়ার পর্ব শেষ হয়েছে, জমাই অভয়পদ ভাইকে নিজের অফিসে ঢুকিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ অম্বিকাপদ এখন রোজগেরে অফিসের বাবু!
এই ত পথ, সামনেই প্রসারিত। যে পথের শেষে প্রাচুর্য এবং নিশ্চিন্ত জীবনযাত্রা। অম্বিকাপদ অবশ্য হেমের চেয়ে তিন-চার বছরের বড়ই। কিন্তু তাতে কি, হেমও ত ফোর্থ ক্লাসে পড়ছে। আর-কটা মাস পরেই থার্ড ক্লাসে উঠবে। বিদ্যেতে ত এমন কোন তফাত নেই। অম্বিকাপদ যদি পারে সাহেবদের কাজ করতে, হেম কেন পারবে না? হেম বরং বুদ্ধিমান আর চট্পটে ঢের বেশি . অম্বিকাপদর চেয়ে।
জামাইকে একদিন ডেকে পাঠায় শ্যামা হেমকে দিয়েই। আজকাল বড় একটা জামাইকে সে ডাকে না, কারণ জামাই এলেই একটা কিছু হাতে ক’রে আসে। সব রকমের জিনিসই–কখনও বা একটা লণ্ঠন (অফিস থেকে সরানো), কখনও বা দুটো
আনাজ, কখনও বা খানিকটা কেরোসিন তেল।জিনিস যাই আনুক না কেন সবটাই প্রয়োজনে লাগে প্রয়োজন বুঝেই আনে জামাই–কিন্তু শ্যামার যেন কেমন লজ্জা করে। অভাব বুঝে জামাই সাহায্য করবে আর তাই হাত পেতে নিতে হবে, ছি! এখনও এটুকু আত্মসম্মানবোধ তার আছে।
জামাই এসে রান্নাঘরের দাওয়াতে পা ঝুলিয়ে বসল। হাতে একটা পুঁটুলি, তাতে দুটো নারকোল, খানিকটা ডেলা-পাকানো কেমন শক্ত গুড় (এ নাকি বড়বাজার অঞ্চলে পাওয়া যায়– আখের গুড়, গুড়ও ভালো– তবে একেবারে শুকনো ডেলা-পাকানো, এই যা। এ ওরা গোরুকে খেতে দেয়–এক পয়সা দু পয়সা সের) তার সঙ্গে খানিকটা মোটা তার। হেমকে উপলক্ষ ক’রে সংক্ষেপে শুধু বললে, ‘তোমাদের কাপড় শুকুতে দেওয়ার অসুবিধে হয় এই তার টাঙিয়ে দিয়ে যাবো বলে এনেছি– শোবার ঘরের জানলার সঙ্গে রান্নাঘরের চালের বাতায় দিব্যি টাঙানো যাবে।’
—
জামাইকে ডেকে পাঠিয়েছে শ্যামা একটু জলখাবারের আয়োজনও ক’রে রেখেছিল; চারখানা চন্দ্রপুলি আর দুটো পাকা কলা জামাইয়ের সামনে ধরে দিয়ে একটু দূরে ঘোমটা টেনে বসল শ্যামা। এত বড় জামাইয়ের সঙ্গে মাথার কাপুড় খুলে ভাল ক’রে কথা বলা যায় না বড্ডই লজ্জা করে।
জামাই অভ্যাস-মত একটা কলা আর দুটো মিষ্টি খেয়ে বাকিটা সরিয়ে রাখলে। যাই কেন দাও না অর্ধেকের বেশি সে খায় না। সেইটে হিসেব ক’রেই বেশি দিতে
হয়।
অদ্ভুত মানুষটি। আজও যেন শ্যামা জামাইকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। অমন রূপ– কখনও মাথা আঁচড়ায় না, কখনও দাড়ি কামায় না। গায়ে সেই এক জিনের কোট-হপ্তা অন্তর নিজে ক্ষারে কেচে নেয়। দশ-হাতি কাপড় পরলেও সর্বদা হাঁটুর ওপর গোটানো থাকে। বিয়ের পর দু-এক মাস অপেক্ষাকৃত একটু ভদ্র ভাবে আসা-যাওয়া করেছিল– তারপর থেকেই এই –এক বেশভূষা!
জলখাবার শেষ ক’রে অভয়পদ বার-দুই কেসে গলাটা সাফ ক’রে নিলে। ‘আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন মা?’
ঘোমটার মধ্যে থেকে ফিসফিস ক’রে হলেও আজ ছেলেমেয়ে কাউকে উপলক্ষ না ধ’রে সোজাসুজিই জামাইয়ের সঙ্গে কথা বললে শ্যামা, ‘বলছিলুম কি, আমাদের হেমের কোথাও একটা চাকরি-বাকরি হয় না? শুনলুম অম্বিকাপদকে কোথায় যেন ঢুকিয়ে দিয়েছ!’
একটু চুপ ক’রে থেকে অভয় উত্তর দিলে, ‘অম্বিকা ত যাহোক একটু লেখাপড়া শিখেছে–তাই ত ওকে কেরানীর চাকরিতেই ঢোকাতে পেরেছি। আমাদের এ কুলি- কামারীর কাজে আর জানাশোনা আপনার লোককে ঢোকাতে ইচ্ছা করে না।’
‘কিন্তু বাবা’, বেশ একটু গর্বের সঙ্গেই বললে শ্যামা, ‘হেমও ত কিছু কম লেখাপড়া শেখে নি। ও-ও ফোর্থ ক্লাসে পড়ছে– ক-মাস পরেই থার্ড ক্লাসে উঠবে। এই ত আমাদের অক্ষয়বাবু, খুব ভাল কি একটা চাকতি কারন উনি ত শুনেছি আরও কম পড়েছেন। অমন নাকি হয়?
‘আগে হ’ত–এখন আর অত সহজে হয় না। একটু ইংরেজি না বুঝলে সাহেবরা নিতে চায় না। এখন একটা পাস-করা ছেলেই যে গন্ডাগণ্ডা।
হ’ল?’
‘তা হ’ল বৈকি। চোদ্দ চলছে।’
–
হেমের কত বয়স
‘সেও এক ফ্যাসাদ। অত অল্পবয়সী ছেলেকে সাহেবরা কেরানীর টুলে বসাতে চায় না। আচ্ছা দেখি কি করতে পারি!’
সেদিন কোন আশ্বাস দিতে না পারলেও হপ্তা-তিনেক পরেই একদিন অভয়পদ এসে হাজির হ’ল। বাবুর চাকরি কিছু খালি নেই আর থাকলেও এতটুকু ছেলে, যে অফিসের কাজ কাকে বলে তাই জানে না, তাকে দিতে চাইছে না। একটা কাজ আছে ‘রংকলে’–লেবেল আঁটার কাজ মাত্র দশ টাকা মাইনে। দিতে চান ত দিতে পারেন। তবে একবার ঢুকে পড়তে পারলে চাই কি ওধারে কাজও শিখতে পারে– চোখ কান খোলা রেখে অফিসের কাজ ব্যাপারটা কি যদি বুঝে নেয় ত, ওদিকেও চলে যাওয়া শক্ত হবে না। ওখানে আমার জানাশোনা লোক আছে, ভেতরে ঢুকলে একটা হিল্লে হতে পারবে। কী বলেন?’
একটু ক্ষুণ্নই হল শ্যামা। নিজের ভাইয়ের বেলা অফিসের কাজ ঠিকই পাওয়া গেল। বিদ্যে ত সমানই, বয়সে একটু বড় এই যা। তার জন্যেই ওর ছেলের আর অফিসের চাকরি জুটল না? এসব ব্যাপারে শ্যামা অপর স্ত্রীলোকদের মত স্বাভাবিক ভাবেই অবুঝ। সে এমনও ভাবলে, তার ভাই যে হেমের চেয়ে এক ‘কেলাস’ অন্তত উঁচুতে পড়ত সেইটে বোঝাবার জন্যেই জামাই ইচ্ছে ক’রে ওকে অফিসের চাকরি দিলে না।
খানিকটা চুপ করে থেকে শ্যামা বললে, ‘সে জানি। ভাল চাকরি পাবার মত কি আর বরাত ক’রে এসেছে ও! দুয়োর কড়ি হাটে যায়– কাঁপাস তুলো উড়ে যায়! লোকে ত যাচ্ছে আর চাকরি পাচ্ছে বাবা– আমার হেম কি আর পাবে? তাহলে আমার পেটে আসবে কেন?
অভয়ের ভ্রূ দুটো একবার যেন নিমেষের জন্য কুঁচকে উঠল– কিন্তু সে সেই এক নিমেষই। শ্যামা তার আভাসও পেলে না।
সে-ও একটু চুপ করে থেকে বললে, ‘তবে এটা থাক। আর একটু বেয়েচেয়ে দেখি না হয়।’
শ্যামা যেন একেবারে ব্যাকুল হয়ে উঠল, ‘না না বাবা– তুমি আর ও বৃথা চেষ্টা করো না। সে কপাল ওর নয়। শেষে এটাও যাবে। যা পেয়েছ তুমি এখন তাইতেই ঢুকিয়ে দাও। আমি যে এধারে আর টানতে পারছি না!’
অভয় প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলে না। শাশুড়ীর মন্দভাগ্যজনিত আক্ষেপের কোন গূঢ়ার্থ সে বুঝল কি না, তাও তার আচরণে কোথাও প্রকাশ পেল না। কোনদিন কারও অভিমানে বিচলিত হবার মত স্বভাব ভগবান তাকে দেন নি। সে তার স্বাভাবিক শান্তকণ্ঠে শুধু বললে, ‘কাল সকাল সাড়ে ছটার মধ্যে খাইয়ে ওকে তৈরি রাখবেন,
কাল সকাল সাড়ে আমি সঙ্গে ক’রে নিয়ে যাবো।’
১৮৩
‘সাড়ে ছটায় তৈরি থাকবে?– কিন্তু তাহলে ওর নিত্য-সেবা?’
‘তার আগেই সেরে ফেলতে হবে। আটটায় হাজ্বরে– পাকা দেড় ক্রোশ পথ—- প্রথম দিন একটু আগে না গেলে চলবেও না। শুধু পৌঁছে দিলেই ত হবে না কাজ শুরু হবার আগে সাহেবের সঙ্গে দেখা করাতে হবে। তাছাড়া আমার অফিস আছে— কাল বলে-কয়ে এক ঘণ্টা ছুটি করিয়ে এসেছি, নটার মধ্যে আমাকেও পৌঁছতে হবে।’
অভয়পদ আর দাঁড়াল না।
‘
দেড় ক্রোশ পথ ভেঙে রোজ যাওয়া-আসা! আটটায় হাজ্বরে– মোটে দশ টাকা মাইনে! মাত্র চোদ্দ বছরের ছেলে তার!
একবার মনটা কেমন করল শ্যামার। ভাবলে জামাইকে ফিরে ডাকে, বলে– দরকার নেই; কিন্তু পারলে না। আর পারে না সে– আর একা এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া
সম্ভব নয়।
মঙ্গলা শুনে বললেন, ‘এ ত সুখবর রো বাম্নি। চাকরিতে একবার কোথাও ঢুকে পড়তে পারলেই হ’ল, যেমন-তেমন চাকরি দুধভাত। আজ দশ আছে, কুড়ি হতে কদ্দিন? এইবার তোর বরাত খুলল, আর কি দেখছিস? সওয়া পাঁচ আনা পূজো মানসিক ক’রে রাখ, আদুল সিদ্ধেশ্বরী-তলায় দিয়ে আসিস প্রথম মাসের মাইনে পেলে। আর আমাদেরও ঠাকুর- ঘরে কিছু পুজো দিস– বলতে গেলে ওঁর সেবা ক’রেই তোর হেমের এই উন্নতি।’
নিশ্চয়ই দেবে। ওরই মধ্যে থেকে একটা টাকা সরিয়ে সে সত্যনারায়ণও দেবে। দেবে বৈ কি। ওঁদের দয়াতেই ত–
সারারাত সেদিন ঘুম হ’ল না শ্যামার। মন কত কি আশা করে- আবার আশঙ্কাও হয়, ওর যা কপাল, হয়ত কিছুই হবে না, কোন উন্নতিই হবে না হেমের। মনকে শাসন করে, অত স্বপ্ন দেখবার এখন থেকে দরকার নেই। ওর যা কপাল, পোড়া শোলমাছ ধুতে গেলেও পালিয়ে যাবে–শ্রীবৎস রাজার মত।
কিন্তু মন সে শাসন মানে না। এক সময় লক্ষ্য করে মন আবার কখন নিজেরই অজ্ঞাতে স্বর্ণ-স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। তারও বাড়ি হবে, নিজস্ব বাড়ি- জমি বাগান পুকুর। কারও লাঞ্ছনা, কারও মুখনাড়া সইতে হবে না। নিজের বাড়িতে নিজের সংসারে নিজে সর্বময়ী কর্ত্রী। বৌ নাতি নাতনি –ভরপুর সংসার।
আবার যখন চমক ভাঙে নিজেরই কল্পনার বহরে নিজে লজ্জিত হয়। কোথায় কি তার ঠিক নেই– এখন থেকে অত আশা ভাল নয়। কী আছে তার অদৃষ্টে কে জানে!
এমনি আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বে সারারাত বসে কেটে যায় ওর। চারটের ভোঁ কানে যেতেই উঠে পড়ে ধড়মড়িয়ে। ছেলে অফিসের ভাত চাই, এখুনি রাঁধতে বসতে হবে।