১৬. ইসলামের মাঝে শত্রু
আওরঙ্গজেব মৃদু হেসে তাঁর বিশ্বস্ত গুপ্তচরবাহিনী প্রধান ওয়াজিম খানকে বললেন, ‘ওয়াজিম খান, ওদের সেনাবাহিনী ছেড়ে যে লোকটি পালিয়ে এসেছে, তাকে এখানে নিয়ে এস। আর তাকে আশ্বস্ত কর তার কোনো ভয় নেই। তুমি তাকে যে কথা দিয়েছ তা আমি অবশ্যই রাখবো।’ সে যত দ্রুত সম্ভব সর্বাধিনায়কের লাল তাঁবু থেকে বের হয়ে গেল। ওয়াজিম খান তাঁকে ইতোমধ্যে তার বিশ্বাসঘাতক ছেলের সাথে সম্ভাজির সুবিধাজনক মিত্রতার কথা জানিয়েছে। এখন সে কথা তিনি এবং তাঁর সেনাপতিরাও আবার শুনবেন।
ছয়মাস আগে বোরহানপুর থেকে বের হয়ে তিনি তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে কোনো বাধা ছাড়াই দাক্ষিণাত্যের ভেতরে গোদাবরি নদীর তীর পর্যন্ত পৌঁছেছেন। এখন সেখানেই সেনাবাহিনীসহ তাঁবু গেড়েছেন। কিন্তু আসলে কি অর্জন করেছেন? কেবল তার লোকজনের চরম পরিশ্রান্তি আর কোষাগার খালি হয়েছে। আকবর, সম্ভাজি আর তার সৈন্যরা রুক্ষ পাহাড়ি এলাকায় লুকিয়ে রয়েছে আর সরাসরি যুদ্ধ না করে মাঝে মাঝে চোরাগোপ্তা হামলা করে পালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি তার গুপ্তচরেরাও কোনো কিছু খুঁজে আনতে পারে নি। তবে এবার মনে হচ্ছে ওয়াজিম খান ভয় দেখিয়ে আর প্রতিশ্রুতি মিলিয়ে যে ধরনের কাজ করে থাকে, তা কাজে লেগেছে। ঠিক এরকম করা হয়েছিল তাহাব্বুর খানের সাথে। সে এখন উত্তর কাশ্মিরে একটি অখ্যাত চৌকিতে অপরাধবোধে পীড়িত বিবেক নিয়ে ক্রমশ নির্জীব আর ক্ষীণ হয়ে দিন কাটাচ্ছে।
একটু পরই সুন্দর করে দাড়ি ছাঁটা হালকা-পাতলা গড়নের একজন যুবককে নিয়ে ওয়াজিম খান হাজির হল। সে আওরঙ্গজেবকে কুর্নিশ করতেই ওয়াজিম খান বললো, “জাঁহাপনা, এ হচ্ছে ফিরোজ বেগ। কয়েকদিন আগেই সে আপনার ছেলের সাথে ছিল।
‘ওঠ ফিরোজ বেগ। এখানে সবাই তোমার পরিচয় জানে না। সবাইকে জানাও তুমি কে আর বিশ্বাসঘাতক আর নীচ আকবরের কাছে তোমার কী অবস্থান ছিল।’
‘আমি আপনার পুরোনো সহকারী কোষাধক্ষ্য মোহাম্মদ বেগের একমাত্র পুত্র। আমাদের পরিবার আপনার পূর্বপুরুষ বাবরের সাথে ফারগানা থেকে এদেশে এসেছে।
আওরঙ্গজেব মাথা নাড়লেন। মোহাম্মদ বেগের জীবনের শেষ বছরগুলো নিশ্চয়ই খুবই কষ্টকর হত, যদি তার ছেলে সহযোগিতা না করতো। এব্যাপারে ওয়াজিম খানের চালাকির চাবিকাঠি এখানেই ছিল। তারপর তিনি বললেন, ‘বিদ্রোহী শিবিরে তোমার কী ভূমিকা ছিল।
‘আমি একজন উপদেষ্টা ছিলাম। সম্ভাব্য মিত্র খোঁজার জন্য আকবর মাঝে মাঝে আমাকে তার দূত হিসেবে বিদেশিদের কাছে পাঠাতেন।’ কথাটা বলার সময় ফিরোজ বেগের গলার স্বর একটু ইতস্তত করছিল, তার কথা ঠিকমতো শোনা যাচ্ছিল না।
বল, আর কোন দায়িত্ব ছিল তোমার? আওরঙ্গজেব জানতেন, ফিরোজ বেগের ব্যাপারে ওয়াজিম খান প্রথমে তখনই খোঁজখবর নিতে শুরু করে, যখন জানা গিয়েছিল যে, সে আওরঙ্গজেবের একজন সেনাপতিকে ঘুষ দিয়ে হাত করার চেষ্টা করছিল। কারও আনুগত্য দোদুল্যমান হয়ে যেতে পারে ভেবে, তিনি তাদেরকে বুঝতে দিয়েছিলেন যে, আকবর যে কারও সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে এ সম্পর্কে তিনি সজাগ। ফিরোজ বেগ বললো, অনেক সময় আমি আপনার রাজদরবারের কারও কারও সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পরবর্তীতে ওয়াজিম খানকে সাহায্য করেছিলাম তাদের নাম প্রকাশ করতে, যারা আপনার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে যাচ্ছে। এটা আমি শপথ করে বলতে পারি, জাঁহাপনা।’
‘আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি।’ কথাটি বলে আওরঙ্গজেব তার চারপাশে বসা সেনাপতিদের দিকে তাকালেন, কিন্তু মাত্র কয়েকজন তার চোখে চোখে তাকাতে পারলো। তারপর তিনি আবার ফিরোজ বেগের দিকে ঘুরে বললেন, ‘এখন আকবরের শিবিরের খবর কী বল?
‘আপনি অগ্রসর হতেই ওরা দাক্ষিণাত্যের পাহাড়ি এলাকার আরো ভেতরে ঢুকে যেতে বাধ্য হচ্ছে, আর এতে গত কয়েক মাসে আকবর আর সম্ভাজি, একে অপরের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে উঠছেন। বিশেষত সম্ভাজির অতিসর্তকতা দেখে আকবর ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিলেন…’
‘তুমি কী করে তা জানলে?
এবার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়ে ফিরোজ বেগ বেশ জোরালো গলায় বললো, ‘মাত্র ছয় সপ্তাহ আগে আমি একটি গোপন সমরসভায় উপস্থিত ছিলাম। সেখানে আকবর আর সম্ভাজিসহ মোট বারোজন উপস্থিত ছিল। সেখানে আকবর প্রস্তাব করলেন, দাক্ষিণাত্যের পাহাড়ি এলাকা থেকে বের হয়ে আপনার এলাকায় গিয়ে আপনার সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হতে। এছাড়া তিনি আরো মিত্র খোঁজার জন্য ওদেরকে আহ্বান করলেন। এমনকি তিনি আমার নাম উল্লেখ করে বললেন, রাজপুতদেরকে আবার তার সাথে যোগ দেবার জন্য উৎসাহিত করতে আমাকে সেখানে পাঠানো যেতে পারে। তিনি প্রবল উৎসাহ দেখিয়ে ওদের সামনে একটি চিত্র তুলে ধরলেন, দ্রুত এগিয়ে ওদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে আপনার বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে আর এভাবে সহজ জয় পাওয়া যাবে। তবে এ প্রস্তাবে সম্ভাজি একটু সন্দিহান ছিলেন। তিনি আকবরকে প্রশ্ন করলেন যে, কতজন মিত্র তিনি নিশ্চিত করতে পেরেছেন, আর তিনি যুদ্ধ বিজয়ের ব্যাপারেও নিশ্চয়তা চাইলেন, কারণ তার সৈন্যদেরকে যদি অতিপরিচিত পাহাড়ি এলাকার আশ্রয় ছেড়ে উষ্ণ সমতলভূমি আর মরু এলাকায় যেতে হয়, সেক্ষেত্রে যুদ্ধে জয়লাভের নিশ্চয়তা কতটুকু আছে। তাছাড়া সেখানে তারা শক্তিশালী আর ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মোগল সেনাবাহিনীর সামনে অরক্ষিত হয়ে পড়বে। আকবর তাকে উত্তরে বললেন, হিন্দুস্তানের সকল মানুষের স্বার্থে আপনার কাছ থেকে মোগল সিংহাসন কেড়ে নেওয়ার মিশনের প্রতি তার বিশ্বাস থাকতে হবে।
‘সম্ভাজি হেসে বললেন, “আপনার এই মহান ব্রতের কারণে আপনি সামনে এগোতে চাচ্ছেন কিন্তু এতে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না, আমি কেন যাব। কেন আমি একটি মাত্র ঝুঁকির কারণে আমার বাবার সকল অর্জন নষ্ট করবো? তিনি বাস্তবতার কথা চিন্তা করে সবকিছু পরিকল্পনা করেছিলেন। আমার হয়তো আমার বাবার মতো সামরিক কুশলতা নেই, তবে আমি জানি তিনি কখনও আপনার এধরনের প্রস্তাবে রাজি হতেন না, আর আমিও হবো না। আমাদেরকে ছোট ছোট নিশ্চিত পদক্ষেপ নিতে হবে।”
আকবর প্রতিবাদ করলেন, কিন্তু এতে তো অনেক সময় লেগে যাবে।’
সম্বাজি উত্তরে বললেন, ‘সময় আমাদের অনুকূলে আছে। আমরা আপনার বাবার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। যতই দিন যাবে ততই তিনি জনগণের কাছ। থেকে দূরে সরে যাবেন আর এতে আমাদের কাজও সহজ হয়ে আসবে। আমরা যদি তার সেনাবাহিনীকে বেশিদিন এখানে আটকে রাখতে পারি, তাহলে তাদের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়বে আর এর খরচ চালাতে গিয়ে তাঁকে খাজনার বোঝা বাড়িয়ে দিতে হবে।
এভাবে তর্কাতর্কি করতে করতে এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে সম্ভাজি আকবরকে তার বোকামি আর অপরিণামদর্শী আশাবাদের জন্য দোষারোপ করলেন। তখন আপনার শান্তস্বভাবের ছেলে গর্জে উঠলেন, “আমি তো লড়াই না করবার স্বপক্ষে যুক্তি না দেখিয়ে অন্তত লড়াই করতে তো চাচ্ছি। এতে রেগে গিয়ে সম্ভাজি আকবরের দিকে ছুটে গিয়ে তাকে একটা ঘুষি মারলেন। আকবর একপাশে সরে গিয়ে তার ঘুষি এড়িয়ে তাকে জাপটে ধরে মাটিতে ফেলে মল্লযুদ্ধ শুরু করলেন। তারপর ওরা সেখানে ছোট ছেলেদের মতো মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে লড়ে যেতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই মিলে তাদেরকে আলাদা করলাম। পরে ওরা নিজেদের মধ্যে মিটমাট করলেন। তবে সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে করলেন, কেননা ওরা বুঝতে পেরেছিলেন, ওদের পরস্পরের সহায়তার প্রয়োজন আছে। তবে সম্ভাজি শক্তিক্ষয়ের যুদ্ধ এড়িয়ে চলার নীতি অনুসরণ করে চললেন আর দাক্ষিণাত্য থেকে বের হয়ে মাঝে মাঝে সংক্ষিপ্ত হামলা ছাড়া অন্যকোনো কিছু করার ব্যাপারে অনীহা দেখালেন। আকবর এতে আরো হতোদ্যম আর নিরাশ হয়ে পড়লেন। প্রকৃতপক্ষে তার মন এত খারাপ হয়ে গেল যে, তিনি পারস্যে গিয়ে শাহের সহায়তা কামনা করার কথা বলতে শুরু করলেন, যেরকম আপনার পর্বপুরুষ হুমায়ুন করেছিলেন। এমনকি তিনি প্রস্তাব করলেন, আমাকেই দূত হিসেবে পাঠাবেন।
আওরঙ্গজেব উত্তরে বললেন, যদি আমার ছেলে পারস্যে যায় তবে সে নিজেকে আরো বিশ্বাসঘাতক হিসেবে প্রমাণ করবে। তবে একথাটা শুনে ভেতরে ভেতরে একটু আশ্বস্ত হলেন যে, আকবর হয়তো হিন্দুস্তান থেকে পালিয়ে যাবে। এতে তিনি একটা উভয়-সঙ্কটে পড়ে গিয়েছিলেন যে, ধরা পড়লে তাকে কোতল করা হবে কি-না। তবে সে যদি দাক্ষিণাত্যে রয়ে যায় তবে অবশ্যই করবেন। তবে আরেকদিকে হিসেব করছিলেন, শাহ আর আকবরের মৃত মায়ের শক্তিশালী পারসিক সম্পর্ক কতটা কাজ দেবে আর ওরা একসাথে মিলে তার সদা অশান্ত উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে অসন্তোষ সৃষ্টিতে কতটুকু ইন্ধন জোগাতে পারবে। যাইহোক এসব চিন্তা একপাশে সরিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “আমার সেনাবাহিনী এড়িয়ে আকবর আর সম্ভাজি কিভাবে অর্থ আর সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র আর রসদ জোগাড় করছে? ‘ওরা বিজাপুর আর গোলকুন্ডার সাহায্য পাচ্ছে, জাঁহাপনা। বিজাপুরিরা মারাঠি সৈন্যদেরকে তাদের এলাকা দিয়ে আসা-যাওয়ার নিরাপদ পথ দিচ্ছে আর আপনার সেনাবাহিনী ওদের পিছু নিলে ওদেরকে আশ্রয় দিচ্ছে। এর বিনিময়ে ওরা আপনার এলাকা থেকে লুটপাট করে যা পায়, তার একটি অংশ বিজাপুরিরা পেয়ে থাকে। আর গোলকুন্ডিরা তাদের কয়েকটি হীরার খনি থেকে হীরা পাঠিয়ে স্থানীয় বে ঘোড়া কেনার অর্থ জোগাড় করছে। আর উপকূলের নতুন একটি বন্দর স্থাপনা–বোম্বে (মুম্বাই) হতে ইংরেজদের কাছ থেকে সর্বাধুনিক কামান আর গাদা বন্দুক কিনছে। গোলকুন্ডিরা মারাঠিদেরকে আপনার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার প্রথম ব্যুহ মনে করে।
আওরঙ্গজেব তার চেয়ারের হাতলে একটা ঘুষি মেরে বললেন, ইসলামের অনুসারীদের মধ্যে কী কোনো সংহতি নেই?
‘দুই শাসকই মনে করেন সম্ভাজির চেয়ে আপনি ওদের বড় ভীতি। এছাড়া ওরা ওদের নিজেদের জীবন কিংবা প্রতিবেশীদের প্রতি তাদের রাজ্যের নীতি আমাদের ধর্মের রীতি অনুযায়ী পরিচালিত করে না। ওরা অন্য বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।
‘তার মানে কী বলতে চাচ্ছ তুমি?
তার পূর্ববর্তী অনেক শাসকের মতো গোলকুন্ডার শাসক আদিল হাসান ধর্মীয় অনুশাসন মানার বিষয়ে অত্যন্ত শিথিল। তিনি লাম্পট্য ব্যবহারের সুযোগ দেন আর নিজের প্রতিটি কামনা-বাসনা মেটাতে গিয়ে তার সম্পদ উড়িয়ে হৈচৈ করে আনন্দোপভোগ করে দেশকে উচ্ছন্নের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। দূতিয়ালির কাজে হায়দারাবাদে একবার গিয়ে আমি নিজের চোখে যা দেখেছি তার একটা উদাহরণ দিতে পারি। শুক্রবার পবিত্র দিন হলেও আদিল হোসেন তার বেলকনি থেকে একটি অনুষ্ঠান উপভোগ করছিলেন। সংক্ষিপ্ত আর আঁটোসাটো স্বচ্ছ চোলি আর গায়ে সেঁটে থাকা পায়জামা পরা প্রায় এক হাজার নর্তকী উঠানে ঢুকলো। গোলকুন্ডি ঢোলকের তালে তালে ওরা যখন নিতম্ব ঠেলে চক্রাকারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচতে শুরু করলো, তখন আদিল হাসানের নির্দেশে বড় বড় পিপায় তাড়ি এনে মাঠের প্রত্যেক কোণে রাখা হল। সেখান থেকে তাড়ি জগে ঢেলে মাঠের চতুর্দিকে বসা তার কিছু প্রিয় সেনাপতি আর সভাসদদের পরিবেশন করা হল। ওরা সাথে সাথে সেই কড়া তাড়ি খেতে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
‘অন্ধকার হতেই পরিচারকরা লম্বা লম্বা মোমবাতি জ্বেলে দিল আর ঢোলকের বাজনা আরো উত্তাল হয়ে উঠলো। আর এদিকে মেয়েরা গান অন্যান্যরাও গাইতে শুরু করলো, আর কিছু কিছু মেয়ে বুকে হাত রেখে উচ্ছঙ্খল ভঙ্গি করতে লাগলো। কামনায় উত্তেজিত হয়ে কিছু পুরুষ মাঠে নেমে পড়তেই মেয়েরা চোলি পুরোপুরি খুলে ঘামে ভিজে চকচক করা বুক উন্মুক্ত করে দিল। একটু পরই কিছু নারী-পুরুষ নির্লজ্জভাবে সবার সামনে দেহমিলন করতে লাগলো। আর অন্যরা উঠানের মাঝখানে যে ফোয়ারা ছিল সেখানে লাফাতে শুরু করলো। ফোয়ারাতেও তাড়ির বন্যা ফেলে সয়লাব করা হয়েছিল। এরকম লালসাপূর্ণ দৃশ্য আমি আর কখনও দেখিনি, জাহাপনা। এমনকি আদিল হাসানও ওদের সাথে যোগ দিলেন। তিনি আর তার এক পত্নী বেলকনিতে দাঁড়িয়ে জড়াজড়ি করা শুরু করলেন–’
যথেষ্ট হয়েছে গোলকুন্ডার কেচ্ছা! এ ধরনের অধার্মিক অনৈতিক ঘটনার বিশদ বর্ণনা দেওয়ার আর দরকার নেই। এখন বল বিজাপুরিরা কেন সম্ভাজি আর আকবরকে সাহায্য করছে?
‘ওদের রাজা সিকান্দার একজন দুর্বলচিত্তের যুবক আর ওদের কোষাগার প্রায় শূন্য হয়ে যাওয়ায় শাসক পরিবারের নিজেদের মধ্যে বিভেদ দিন দিন গুরুতর হতে শুরু করেছে। বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন দলের বেশিরভাগই তাদের অভ্যন্তরীণ বিবাদে মারাঠিদেরকে সম্ভাব্য মিত্র এবং সেই সাথে আপনার বিরুদ্ধে একটি প্রতিরক্ষা শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে। আপনার বিরুদ্ধে আকবর আর মারাঠিদের লড়াইয়ে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য ওরা নিজেদের মধ্যে প্রতযোগিতা করছে, যাতে এর বিনিময়ে তাদের সমর্থন লাভ করে। সিকান্দার নিজে বিশ্বাস করেন তার ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য মারাঠিদের সহায়তাই তার জন্য শ্রেষ্ঠ উপায়।
আওরঙ্গজেব এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “এই শাসকরা এখন শিখবে হঠাৎ গজিয়ে উঠা এক বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গী হওয়াটা ঠিক নয়। আমি ঠিক করেছি আমরা বিজাপুর আর গোলকুন্ডা বিজয় করবো। এর ফলে বিধর্মী পাহাড়ি ইঁদুর সম্ভাজি আর আমার বিশ্বাসঘাতক ছেলে তাদের সহায়তা হারাবে আর সেই সাথে আমাদের সাম্রাজ্যের পরিধিও বেড়ে যাবে।
সাথে সাথে আওরঙ্গজেবের কয়েকজন সেনাপতি সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো, ‘আল্লাহু আকবর। আওরঙ্গজেব জিন্দাবাদ। সম্রাট দীর্ঘজীবী হোন! অন্যরাও তাদের সাথে সুর মিলিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচু করে তার সিদ্ধান্তকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাল।
পুরো আলোচনার সময় মুয়াজ্জম তার বাবার চেয়ারের পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শোরগোল থেমে যাবার পর তিনি ধীরে ধীরে বললেন, ‘বাবা, আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে দক্ষিণে আমার অভিযানের অগ্রগতি কিরকম ধীরগতির ছিল। যদিও আপনি মনে করেন এর বেশিরভাগ আমার দোষে হয়েছে, তবে আমি তা সত্যিকার বিশ্বাস করি না। ঐ এলাকাটি অত্যন্ত রুক্ষ। আর সম্ভাজির প্রতি বিশ্বস্ততার ব্যাপারে মারাঠিরা সবাই প্রচণ্ডভাবে ঐক্যবদ্ধ। আর ওরা বেশ কয়েকবার প্রমাণ করেছে যে, ওরা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। আর সে হিসেবে ওরা বিজাপুর এবং বিশেষত গোলকুন্ডারও যোদ্ধা। আমার মনে হয় বিজয় নিশ্চিত করতে হলে আমাদেরকে একটি বড় ধরনের সেনাবাহিনীর ব্যবস্থা করতে হবে–এমনকি সম্ভাজির বিরুদ্ধে অভিযানে যে সেনাদল এখন রয়েছে তার চেয়েও বড়। এ ধরনের একটি সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলতে বেশ সময়ের প্রয়োজন আর হয়তো খাজনার পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দিতে হবে। আর এতে প্রজাদের কষ্ট বেড়ে যাবে আর ওদের মধ্যে আরো অসন্তুষ্টি দেখা দিতে পারে।
‘মুয়াজ্জম, তুমি সবসময় কেন এরকম ভয়ে ভয়ে থাক? তুমি নিশ্চয়ই আমাকে ভাল করেই জান, সুতরাং বুঝতেই পেরেছ, বিজাপুর আর গোলকুন্ডার শাসকদের বিরুদ্ধে আমার এই ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ আর ওদেরকে হটিয়ে দিয়ে সাম্রাজ্যের পরিধি বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি যেরকম হঠাৎ করে নেওয়া মনে হচ্ছে, আসলেই তা নয়। বেশ কিছুদিন থেকেই আমি ওয়াজিম খানের গুপ্তচরদের কাছ থেকে যেসব খবর পাচ্ছিলাম, তার সাহায্যে ওদের বিরুদ্ধে আমাদের সেনাবাহিনীর তুলনামূলক শক্তি যাচাই করেছি। কাজেই আমি তোমাকে আশ্বস্ত করছি বর্তমানে আমাদের যে সেনা আছে তা এরজন্য যথেষ্ট।
তারপর ছেলের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার বললেন, প্রথমে বিজাপুরের বিরুদ্ধে আক্রমণ করবে যে মূল সেনাবাহিনী, তার নেতৃত্ব থাকবে কেবল আমার হাতে। তবে আমি তোমাকে একটা সুযোগ দেব, যাতে তুমি নিজেকে আবার যোগ্য প্রমাণ করতে পার। তুমি একটি প্রাথমিক অভিযানে নেতৃত্ব দিয়ে গোলকুন্ডা দুর্গ, তাদের সেনাবাহিনীর শক্তি আর তাদের মনোবল পরীক্ষা করে দেখবে।’
*
কামান টেনে আনার সময় তার ধাতব তীক্ষ্ণ শব্দ আওরঙ্গজেবের মাথার চারপাশে প্রতিধ্বনি করতে লাগলো। মাটির যে প্রতিরক্ষা বাঁধ গড়ে তোলা হয়েছিল, সেখান থেকে কেবল কামানের নলগুলো বের হয়ে রয়েছে। তারপর ওরা বিজাপুর দুর্গের পাথরের বুরুজের দিকে কামান দাগার জন্য প্রস্তুত হল। একবার গোলা ছোঁড়ার পর কামানের পেছন দিকের যে ধাক্কা হয়, তা সামাল দিতে গোলন্দাজ সেপাইরা মোটা রশি দিয়ে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করলো। ঘামে ভেজা শরীরের কোমর পর্যন্ত জামা খুলে ওরা কঠোর পরিশ্রম করছিল। তারপর বারুদ আর গোলা লম্বা নলের ভেতরে ভরলো। এরপর ওরা ধরাধরি করে কামানটি তুলে নিয়ে এর ভারী সামনের অংশটি গোলা ছোঁড়ার অবস্থানে রাখলো।
বিজাপুর দুর্গ অবরোধ করা শুরু করার পর গত ছয় সপ্তাহে বেশি গরম হয়ে যাওয়ার কারণে কিংবা এর ঢালাইয়ের কোনো সমস্যা থাকায় কয়েকবার কামানের নল ফেঁটে গিয়েছিল। গোলন্দাজ সৈনিক আর ঢালাই কারখানার কারিগরদেরকে তাদের কাজ সঠিকভাবে জানতে হবে। তারপরও কামানের সামনের অংশ নতুন করে তৈরি করে, অতিরিক্ত লোকজনদের প্রশিক্ষণ দিয়ে, তারপর বর্ষার পর ভারী ভারী কামান আর অন্যান্য জিনিসপত্র দাক্ষিণাত্যের পাহাড়ি এলাকা দিয়ে টেনে আনা মানে বিজাপুর আর গোলকুন্ডা বিজয় করে তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে করতে প্রায় একবছর লেগে যাবে। এরপরই তিনি আকবর আর সম্ভাজির দিকে মনোযোগ ফেরাতে পারবেন।
একবার কামানের গোলা ছোঁড়ার পর হাওয়ায় ধোঁয়ার কুণ্ডলি সরে যেতেই তিনি কামান ছোঁড়ার ছিদ্রসহ বিজাপুরের দেয়াল আর তার উপরে উঁচু প্রাসাদের বিখ্যাত সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি গম্বুজগুলো দেখতে পেলেন। শহরের দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় কামানের গোলার আঘাতে গর্তের মত দাগ দেখা গেলেও দেয়ালটি প্রায় অক্ষতই রয়ে গেছে। মূল ফটকের দালান যেস্থানে রয়েছে সেই জায়গার দেয়ালটিতে অনেক গোলা ছোড়লেও কোনো হেরফের হয় নি। এখান থেকেই এঁকেবেঁকে একটি ঢালু পথ শহরের দিকে চলে গেছে। শক্তিশালী দেয়াল ছাড়াও বিজাপুরের চারপাশ ঘিরে একটি দুর্গপরিখা রয়েছে। পরিখাঁটি অর্ধেক গভীরতা পর্যন্ত পানি ভরা। এছাড়া মোগলদের হামলার কথা শুনে পরিখার সামনে বেশকিছু জায়গার ঘাস আর ঝোঁপঝাড় পুড়িয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে। এর ফলে কোনো হামলাকারী এগোলে দেয়াল থেকে কামানের গোলা আর গাদা বন্দুকের গুলিও সহজে ছোঁড়া যাবে। অগত্যা গাদা বন্দুকের পাল্লা এড়াতে তাকে তার কামানগুলো আরো পেছনে বেশ দূরে স্থাপন করতে হয়েছিল। এর ফলে সবচেয়ে বড় কামান থেকে গোলা ঘোড়লেও দূরত্বের কারণে পাথরের দেয়ালে আঘাত করার আগে এর শক্তি কমে যাচ্ছিল। বিজাপুরিরা শহরে খাদ্য আর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে মজুদ করার যথেষ্ট সময় পেয়েছিল। আর বৃষ্টির পানি থেকেও যথেষ্ট পরিমাণে পানি ধরে রাখতে পেরেছিল। ওরা কেবল মাঝে মাঝে আওরঙ্গজেবের সৈন্যদের দিকে গোলা ছোঁড়তো,যখন নিশ্চিত হত যে লক্ষভেদ করতে পারবে। আর এতে ওদের গোলাবারুদেরও অপচয় হচ্ছিল না। গোলকুন্ডা কিংবা মারাঠিরা সাহায্য পাঠাবার আগে তাকে বিজয় লাভ করতে হলে একমাত্র সামনাসামনি আক্রমণ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
তিনি ঘুরে ওয়াজিম খানের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কোনো ধারণা আছে ফটকের সামনে যে পরিখাঁটি আছে সেটা কিভাবে ভরাট করে আমরা একবার ফটকের দিকে আক্রমণ চালাতে পারি?
‘আমার প্রথম ভাবনা হল জাহাপনা, এ ধরনের কোনো প্রচেষ্টা করতে হলে আমাদেরকে অন্ধকার কিংবা ধোঁয়ার আড়ালে কাজ করতে হবে।
ধোয়া যথেষ্ট নয়, আর এটা বাতাসের মর্জির উপর নির্ভর করে। তবে অন্ধকার তো হবেই।’
কয়েকদিন পরই পূর্ণিমা। আমাদের মনে রাখতে হবে পূর্ণিমার আলো আমাদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করবে।’
‘আমিও তাই ভাবছি। আশা করি এর আগেই কাজ শুরু করতে পারবো।
ওয়াজিম খান কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললো, জাহাপনা, পরিখাঁটি একটা কঠিন বাধা, তবে আমার কাছে একটা ফন্দি আছে। একসাথে কাজ করে আমরা অনেকবার পুরস্কারের শক্তির প্রমাণ পেয়েছি। ধনী-গরিব সকলেই অর্থের জন্য লালায়িত। শিবির স্থাপন আর মাটির কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমাদের সাথে অনেক বেকার মজুর রয়ে গেছে। ওরা গরিব আর প্রায় অনাহারেই রয়েছে। আমরা ওদেরকে আর কোনো কাজই দিতে পারছি না। ওদেরকে যদি বলি এক ঝুড়ি মাটি পরিখার পানিতে ফেললে কয়েকটি মুদ্রা। পাবে তাহলে কেমন হয়?
চমৎকার বলেছ! তুমি যেরকম বলেছ, ওদেরকে দেওয়ার মতো কোনো কাজ আমাদের হাতে নেই সেক্ষেত্রে এ প্রস্তাবটি দিতে ক্ষতি কী? আর আমার মনে হয় তোমার কথাই ঠিক, ওদেরকে আমাদের শিবির থেকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার দরকার নেই। তার চেয়ে বরং অর্থপুরস্কার দিলে ওরা খুশি মনেই জীবন বাজি রেখে কাজটা করবে। তবে একাজে সফলতা পেতে গেলে একসাথে অনেক জনকে অন্ধকারে এগিয়ে যেতে হবে।’
অবশ্যই। আর ওদেরকে দেয়াল থেকে কেউ দেখে ফেললে, সেক্ষত্রে তাদেরকে গোলন্দাজ আর বরকন্দাজদের সহায়তা দিতে হবে। অবশ্য দেখা তো যাবেই।
‘একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক। আগামীকাল মধ্যরাতের পরপরই এই অভিযান শুরু করবো। এই সময়ের মধ্যে ওরা যথেষ্ট পরিমাণে মাটি কেটে জোগাড় করে রাখতে পারবে।
ছত্রিশ ঘণ্টা পর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আওরঙ্গজেব ভাবলেন, ওয়াজিম খান ঠিকই বলেছে। টাকার লোভে কয়েক হাজার শ্রমিক ঝুড়িভর্তি মাটি নিয়ে সমবেত হয়েছে। এদের সাথে কিছু স্থানীয় বাসিন্দাও যোগ দিয়েছে। অনেকেই কেবল নেংটি পরে খালি পায়ে এসেছে। আর সবার মুখ শুকনো। কয়েকজন লোক একটু সামনেই রাখা সিন্দুকভর্তি মুদ্রাগুলোর দিকে তাকাচ্ছিল। সফল হলে যে ওরা পুরস্কার পাবে তার প্রমাণ হিসেবে কড়া পাহারায় খোলা সিন্দুকগুলো সমবেত শ্রমিকদের একটু সামনেই সাজিয়ে রাখা হয়েছিল।
তার পরিকল্পনাটি ঘোষণা করার পর তিনি সেনা-নায়কদের সাথে বিষয়টি একটু ভালো করে সাজিয়ে নিয়েছিলেন। প্রথম সারির মজুররা পরিখা থেকে অর্ধেক দূরত্বে খোলা মাঠে মাটি ফেললে অর্থ পাবে। এতে বরকন্দাজরা আত্মরক্ষার জন্য মাটির নিচু দেয়াল পেয়ে ছুটে গিয়ে সেখান থেকে শত্রুর উদ্দেশ্যে গুলি ছোঁড়ে ওদেরকে সহায়তা দেবে। সেই সাথে কামান থেকেও গোলা ছোঁড়া হবে। পরবর্তী সারির মজুররা পরিখা পর্যন্ত তিন-চতুর্থাংশ দূরত্ব পার হয়ে মাটি ফেলবে, যাতে বরকন্দাজরা আরো সামনে এগোতে পারে। এরপর তৃতীয় এবং এর পরের সারির মজুরেরা সরাসরি পরিখাতে মাটি ফেলবে। এর পর প্রতি সারিতে দুইশোজন করে মোট বারোটি সারির মজুর বাকি থাকছে, যারা সবাই পরিখাতেই মাটি ফেলতে পারবে।
আওরঙ্গজেব তাঁর এক সেনাপতির দিকে তাকিয়ে বললেন, কাজ শুরু করার নির্দেশ দাও।’ কয়েকমিনিট পর লম্বা সরু পায়ে প্রথম সারির মজুররা মোগল শিবির এলাকা থেকে ছুটে বের হল। বেশিরভাগই মাথায় মাটিভর্তি ঝুড়ি নিয়ে ছুটছিল আবার অনেকেই দুজন করে বড় একটা বেতের ঝুড়িতে মাটি নিয়ে ধরাধরি করে ছুটছিল। অন্ধকারে যত দূর দেখা যায়, তিনি দেখতে পেলেন প্রথম সারির লোকগুলো পরিখার প্রায় একচতুর্থাংশ দূরত্ব পার হয়েছে। এমন সময় বিজাপুরের দেয়ালে মশাল জ্বলে উঠলো। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই গাদা বন্দুকের ফট ফট শব্দের সাথে বিজাপুরি কামানের গোলা বর্ষণ শুরু হল। সাথে সাথে তাঁর নিজের গাদা বন্দুকধারী আর কামান থেকেও প্রত্যুত্তর দেওয়া শুরু হল।
ঘন ঘন কামানের গোলার আলোয় তিনি দেখলেন কিছু শ্রমিক মাটিসুদ্ধ ঝুড়ি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেছে। দু-একজন আবার উঠে মোগল শিবিরের দিকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফেরার চেষ্টা করলো। বাকিরা মাটিতে স্থির হয়ে পড়েছিল কিংবা মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছিল। যারা অক্ষত ছিল তাদের মধ্যে কয়েকজন মাথার ঝুড়ি ফেলেই ঘুরে ছুটে পালাল। তারপরও অনেকে পুরস্কারের লোভে মাটির ঝুড়ি নিয়ে ধোয়া আর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ছুটছিল। ওরা ঠিকই অধের্ক পথ পর্যন্ত গিয়ে মাটি ফেলে পেছন দিকে ঘুরলো। অন্ধকারে ছোট ছোট দলে মোগল বরকন্দাজরা কালো পোশাক পরে নিচু হয়ে মজুররা ঝুড়ির মাটি ফেলে যে, ছোট ছোট মাটির স্তূপ তৈরি করেছিল তার পেছনে অবস্থান নেবার জন্য ছুটতে শুরু করলো। কালো পোশাকের দরুন অন্ধকারে ওদেরকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না। মাটিবহনকারী দ্বিতীয় দলটি দ্রুত ছুটলো। কয়েকজন শ্রমিক মাটিতে পড়ে থাকা প্রথম সারির শ্রমিকদের শরীরের সাথে ধাক্কা খেয়ে হোঁচট খেয়ে পড়লো। তবে বেশিরভাগই কামানের গোলা কিংবা গাদা বন্দুকের গুলির আঘাতে পড়ে গেল। তৃতীয় আর চতুর্থ সারিটি প্রচণ্ডবেগে ছুটতে শুরু করলো। আরো অনেকে পড়ে গেল, তারপরও বেশ কয়েকজন সামনের দিকে ছুটে গেল। মাত্র কয়েকজন সামনে যেতে রাজি হল না। পরিখার কিছুদূর পর্যন্ত ওরা এগোতে পারলো, অন্ধকার আর ধোঁয়ার কারণে আওরঙ্গজেবের দেখতে কষ্ট হচ্ছিল, তবে ভালই অগ্রগতি হচ্ছিল।
*
চারদিন পর আওরঙ্গজেব একা তার লাল তাবুতে বসে প্রাতরাশ করছিলেন। তার পরিকল্পনা আংশিক সফল হয়েছে। সেই প্রথম রাতে প্রায় একশো শ্রমিক পরিখায় মাটি ফেলতে পেরেছিল। কথামতো তিনি তাদের সকলকে পুরস্কারের মুদ্রা দিয়েছিলেন আর সেই সাথে প্রথম দুই সারির শ্রমিকেরাও মাটি ফেলার জন্য পুরস্কার পেল। ওদের প্রচেষ্টায় পরিখার গেঁজলা উঠা পানিতে একটি ছোট ঢিবির মতো দ্বীপ তৈরি হল। পরবর্তী রাতে তিনি পুরস্কার দ্বিগুণ করে আবার মাটি নিয়ে শ্রমিক পাঠিয়েছিলেন। এদের সাথে কয়েকটি হাতি কাঠের গুঁড়ি টেনে নিয়ে গিয়েছিল পরিখায় ফেলার জন্য। তবে এবার বিজাপুরিরা তৈরি ছিল। এবার খুব কম শ্রমিক পরিখা পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিল। আর একটি ছাড়া আর সমস্ত হাতি কামানের গোলার আঘাতে মরে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। এই হাতিগুলোর মৃতদেহ এখন পরিখার কিনারায় মাটিতে পড়ে রয়েছে। যে হাতিটি পরিখা পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিল, সেটা পেটে কামানের গোলার আঘাতে আহত হয়ে উল্টে পরিখার পানিতে পড়ে গিয়েছিল। সর্বত্র মানুষ আর হাতির লাশের দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে এসেছে। তবে আহতদের গোঙানিও কমে এসেছিল। তিনি কাউকে উদ্ধার করতেও নিষেধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, কেননা উদ্ধার প্রচেষ্টায় আরো প্রাণহানি হতে পারে।
খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে তিনি তাঁবুর ভেতরে পায়চারি শুরু করলেন। সূর্য মাথার উপরে উঠে যাওয়ায় তাবুর ভেতরে একেবারে হাওয়া নেই। পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে? এই মুহূর্তে ধৈর্য ধরে ক্ষুধা আর তৃষ্ণায় প্রতিপক্ষদের দেহ আর মন দুর্বল হয়ে পড়ার জন্য অপেক্ষা করে দেখতে হবে আর পথে গুপ্তচর বসাতে হবে যাতে সাহায্যকারী সেনা এগিয়ে আসার সাথে সাথে শিবিরে খবর দিতে পারে। এছাড়া আর কিছুই করার নেই।
একজন কোরচি ঢুকে মাথা ঝুঁকিয়ে বললো, “ওয়াজিম খান আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন, জাহাপনা।
প্রায় সাথে সাথেই ওয়াজিম খান ঢুকলো। এক টুকরা সাদা কাপড় দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে সে বললো, ‘জাহাপনা, বিজাপুরের প্রধান ফটকের চারপাশে একটু উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে।
কি ধরনের উত্তেজনা?”
‘দুই-তিনজন বিজাপুরি পরিখার পাশে তাদের তীরে বের হয়ে এসেছে। আর মনে হচ্ছে পরিখা পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওরা একটা ভেলা বয়ে এনেছে।
আওরঙ্গজেব ওয়াজিম খানকে পাশ কাটিয়ে তাঁবুর বাইরে বের হতে হতে বললেন, ‘আমাদের লোকদের গোলাগুলি করতে নিষেধ কর।
দুজন লোক ভেলায় চড়ে পরিখা পার হয়ে আসছে। এত দূর থেকে দেখেও তাদেরকে দূত মনে হচ্ছে। এর একমাত্র অর্থ বিজাপুরিরা কোনো শর্ত নিয়ে আলোচনা করতে আসছে। দূত পাঠানো মানেই তাদের মনোবলের উপর একটা প্রচণ্ড আঘাত আর বিজাপুরবাসীরা দেখছে যে তাদের শাসকের চরম বিজয়ের প্রতি কত কম আস্থা রয়েছে। আওরঙ্গজেব বললেন, যদি ওরা সত্যিই দৃত হয়ে থাকে তবে ওদেরকে জানাও আমি কোনো শর্ত নিয়ে আলোচনা করবো না, তবে বিজাপুর আত্মসমর্পণ করলে ওদের প্রতি দয়াশীল হব। কোনো হত্যাযজ্ঞ হবে না, কোনো ভাল মেয়েকে ধর্ষণ করা হবে না, কোনো ঘরবাড়ি লুট করা হবে না।’ ওয়াজিম খান তার নির্দেশ জানাতে মোগল শিবিরের সামনের দিকে চলে গেল। আওরঙ্গজেব ঘুরে তাবুর দিকে চললেন, তিনি তাঁর মনের খুশি চেপে রাখতে পারছিলেন না। তবে অতি কষ্টে চেপে রাখলেন, কেননা বিজাপুরিদের আসল উদ্দেশ্য না জানা পর্যন্ত তাকে বাইরে উল্লাস প্রকাশ করা চলবে না। এতে তাঁর লোকজন তাকে বোকা আর। অপরিপক্ক মনে করবে।
দুপুরের দিকে তাঁবুর ছাউনির ভেতর থেকে আওরঙ্গজেব দেখলেন দুই জন লোক বিজাপুরের প্রতিরক্ষা বেষ্টনীর ভেতর থেকে বের হল। ওদেরকে অনুসরণ করে দশজন তোক একটি নৌকা বয়ে নিয়ে এল। নৌকাটি ওরা দুর্গন্ধময়, জঞ্জাল আর রক্ত ভরা পরিখার পানিতে নামাল। তারপর সাদা পোশাকপরা একজন হালকা-পাতলা লোক বের হয়ে নৌকার মাঝখানে একটি নিচু টুলে বসলেন। এরপর দশজন লোক লগি ঠেলে নৌকাটি মোগলদের দিকে ঠেলে নিয়ে চললো। তীরে পৌঁছে পাতলা লোকটি মরা হাতির ফুলে ওঠা দেহের কাছে এসে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছি, তবে সাথে সাথে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। এ নিশ্চয়ই সিকান্দার। সবুজ পাগড়িপরা দুইজন মোগল সেনা তার দুই পাশে অবস্থান নিল। তারপর তাকে পথ দেখিয়ে গলেপচে যাওয়া লাশের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে নিয়ে এল। শকুনের দল বাঁকা ঠোঁট দিয়ে লাশের মাংস ছিঁড়ে ভোজে ব্যস্ত ছিল। দশ মিনিট পর সিকান্দার আওরঙ্গজেবের তাবুর কাছে এলেন। আওরঙ্গজেব যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন, তার পাঁচগজ দূরত্বে এসে তিনি থামলেন, তারপর দুহাতে একটি রত্নখচিত সোনার লাঠি ধরে তার দিকে হাত বাড়িয়ে মিহি তবে পরিষ্কার কণ্ঠে বললেন, ‘বিজাপুর এবং এর সমস্ত এলাকা আপনার হাতে সমর্পণ করে দেবার প্রমাণ হিসেবে আমি এই লাঠিটি, যা আমার পূর্বপুরুষের শাসকদণ্ড ছিল তা আপনার হাতে তুলে দিচ্ছি।’ কথাগুলো বলার সময় তিনি মাথা নিচু করলেন।
আওরঙ্গজেব লক্ষ করলেন, সিকান্দারের ডান হাতে ভারী পট্টি লাগানো রয়েছে, আর সেখান থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ে পট্টির কাপড় লাল হয়ে যাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘আমাদের গাদা বন্দুকের গুলি কি আপনাকে আত্মসমর্পণ করার জন্য শিক্ষা দিয়েছে?
না, গতরাতে আমার একজন চাচা, ইকবাল খান আমাকে ছুরি মেরে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। আমার দেহরক্ষীদের সাহায্যে আমি তার সাথে লড়াই করে তাকে থামাই। তিনি এখন মৃত। তবে আমার হেকিম যখন ক্ষতটি পরিষ্কার করে পট্টি লাগাচ্ছিলেন তখন আমি বুঝলাম তিনিই শেষ লোক নন যে এই ধরনের চেষ্টা করবে। ঈর্ষা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে যে বিভক্তি করার প্রচেষ্টা চলছে, তাতে বিজাপুরের পতন হবেই। আপনার শুনতে খারাপ লাগতে পারে, তবে আমি আমার জীবনকে নিজের কাছে অনেক প্রিয় মনে করি সিংহাসনের চেয়েও মধুর–আমি অনেকদিন এই জীবন উপভোগ করতে চাই। সেজন্য আমি বুঝতে পেরেছি যে, প্রকৃতির নিয়মবিরোধী আর নিকট আত্মীয়দের হাত থেকে আমার জীবন নিরাপদ হবে, যদি আমি নিজেকে আর আমার রাজ্য এখুনি আপনার হাতে তুলে দেই। যদিও আপনি একজন আগন্তুক এবং আমার দেশের মানুষের শত্রু, তারপরও আমি আমার অবিশ্বস্ত পরিবার আর যুদ্ধরত আত্মীয়দের চেয়ে এখানে নিরাপদ থাকবো। আওরঙ্গজেব তার পেছনে দাঁড়ান ওয়াজিম খানের দিকে তাকালেন। বিজাপুরি রাজপরিবারের যেসব সদস্যদের কাছে বার্তা পাঠান হয়েছিল ইকবাল খান তাদের একজন। ওদের কাছে প্রস্তাব করা হয়েছিল, যারা মোগলদের সহায়তা করবে তাদেরকে যথেষ্ট পুরস্কারসহ ভাল পদ দেওয়া হবে। কেউ উত্তর দেয় নি, তবে ইকবাল খান মনে হয় তার কথা শুনেছিল। তার কার্যকলাপ আর এর ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে তার মৃত্যুর কারণে মোগলরা তাদের বিজয় নিশ্চিত করতে পারলো, প্রতিশ্রুতি মোতাবেক কোনো পারিতোষিক দিতে হল না।