১৬. আমি কন্যা লীলাবতী

আমি কন্যা লীলাবতী, ভাইয়ের বোন ভাগ্যবতী।

আমার কোনো ভাই নেই। একটা ভাই ছিল। সে মারা গেছে। এখনো কি আমি ভাগ্যবতী? মানুষ আলাদা আলাদা ভাগ্য নিয়ে আসে না। একজনের ভাগ্যের সঙ্গে আরেকজনের ভাগ্য জড়ানো থাকে। একজনের ভাগ্যে ধ্বস নামলে, পাশের জনের ভাগ্যেও লাগে। আচ্ছা, এইসব আমি কী লিখছি? আর কেনইবা লিখছি? কে পড়বে আমার এই লেখা!

কেউ না পড়ুক, আমি আমার ভাইয়ের বিষয়টা গুছিয়ে লিখতে চাই। আমার মন বলছে, খুব গুছিয়ে বিষয়টা লিখলেই আমার মন অনেক হালকা হয়ে যাবে। কিন্তু লিখবটা কী? আমি তো তাকে সেইভাবে জানি না। তার জানাজা পড়ানো হলো শহরবাড়ির সামনের মাঠে। জানাজায় মেয়েরা অংশ নিতে পারে না। জানাজার পুরো ব্যাপারটা আমি দেখলাম জানোলা দিয়ে। আমার পাশে পরীবানু ও দাঁড়িয়ে ছিল। একবার ভাবলাম তাকে বলি, তোমার দেখার দরকার নেই। তোমার মন খারাপ হবে। তারপরই মনে হলো, সে যে অবস্থায় আছে তারচে খারাপ হবার তো কিছু নেই।

তবে পরীবানু শক্ত মেয়ে। সে কাদছিল, কিন্তু চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলছিল না। জানাজা প্রক্রিয়াটি সে দেখছিল যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে।

একটা নকশাদার খাটিয়ায় সাদা কাপড়ে মোড়ানো কফিন। তিনটা হ্যাজাক লাইট জ্বালানো হয়েছে। এর মধ্যে একটা নষ্ট। কিছুক্ষণ পর পর হ্যাজাকের সাদা আলো লাল হয়ে যাচ্ছে। খাটিয়ার চার মাথায় আগরবাতি জ্বলছে। আগরবাতির আলো জোনাকির মতো জ্বলছে নিভছে। বাতাস ছিল না বলে আগরবাতির ধোয়া সোজা উপরের দিকে উঠছে। চারদিকের গাঢ় অন্ধকারে সাদা ধোয়ার সুতা আকাশে মিশে যাচ্ছে, দেখতে খুবই সুন্দর লাগছে।

সারি বেঁধে সবাই দাঁড়িয়েছে। নামাজ শুরু হবার আগে বাবা বললেন, জানাজার নামাজের আগে মৃত ব্যক্তির সৎগুণ নিয়ে আলোচনা নবীর সুন্নত। নবীজি এই কাজটি করতেন। আপনারা আমার ছেলে সম্পর্কে ভালো কিছু যদি জানেন তাহলে কি একটু বলবেন?

সারি বেঁধে দাঁড়ানো লোকজন একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। গুনগুন শব্দও হচ্ছে। কেউ এগিয়ে আসছে না। বাবা বললেন, মিথ্যা করে কিছু বলবেন না। অনেক সময় মৃত ব্যক্তির প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যে মিথ্যা মিথ্যা ভালো ভালো কথা বলা হয়। দয়া করে কেউ মিথ্যাচার করবেন না।

কেউ এগিয়ে আসছে না। আমার খুবই রাগ লাগছে। আমি গুনে দেখেছি সর্বমোট একশ ষোলজন মানুষ আছে জানাজায়। এতজন মানুষের কেউ আমার ভাই সম্পর্কে একটা ভালো কথা বলবে না? কোনো সৎগুণই কি তার নাই? পরীবানু আমার কাঁধে হাত রেখেছে। সেই হাত থরথর করে কাঁপছে। পরীবানু। ভাঙা গলায় বলল, বুবু, কেউ কিছুই বলতেছে না কেন? কেন কেউ কিছু বলে না?

পরীবানুর ভাঙা গলা, তার শরীরের কাঁপুনি, আমার রাগ এবং দুঃখবোধ সব মিলিয়ে কিছু একটা হয়ে গেল— আমি জানালার পর্দা সরিয়ে উঁচু গলায় বললাম, আমি কিছু বলব। আমার গলার স্বর মনে হয় যথেষ্টই উঁচু ছিল। সবাই জানালার দিকে তাকাল। মওলানা সাহেবের ভুরু যে কুঁচকে উঠেছে তা আমি না দেখেও বুঝতে পারছিলাম। তিনি ফিসফিস করে বাবাকে কী যেন বললেন। খুব সম্ভবত তিনি বললেন– এইসব বিষয়ে মেয়েরা কিছু বলতে পারবে না। তারা থাকবে পর্দায়। মওলানা সাহেবের কথা না শোনা গেলেও বাবার কথা শোনা গেল। বাবা বললেন, মেয়েদের যদি কিছু বলার থাকে তারাও বলতে পারে। আমি তাতে কোনো দোষ দেখি না। মা তুমি বলো। পর্দার আড়াল থেকে বলো।

আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। আমি তো মাসুদের বিষয়ে কিছুই জানি না। আমি তাকালাম পরীবানুর দিকে। পরীবানু বলল, বুবু বলেন— সে জীবনে কোনোদিন কোনো মিথ্যা কথা বলে নাই।

আমি নিচুগলায় পরীকে বললাম, কথাটা বোধহয় ঠিক না। তুমি ভেবে বলো, যেটা সত্যি সেটা বলো।

পরীবানু বলল, বুবু, আপনাকে ভুল বলেছি, সে মিথ্যা কথা বলতো। তার মতো নরম দিলের মানুষ তিন ভুবনে ছিল না, কোনোদিন হবেও না। আপনি এই কথাটা বলেন।

আমি বললাম, আমার ভাই ছিল অতি হৃদয়বান একজন মানুষ।

পরীবানু বলল, তার বিষয়ে আরো অনেক কিছু বলার আছে বুবু, এখন মনে আসতেছে না।

আমি বললাম, থাক আর দরকার নাই।

মাসুদের কবর হলো বাড়ির পেছনে জামগাছের তলায়। পাশাপাশি দুটা জামগাছ— একটা বড়, একটা ছোট। গাছতলায় কবর দেয়ার কারণ হলো— গাছপালা সবসময় আল্লাহর জিকির করে। সেই জিকিরের সোয়াব কবরবাসী পায়।

স্বামীর কবরের কাছে যাওয়া পরীবানুর জন্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীরা না-কি স্বামীর কবরের কাছে যেতে পারে না। এতে পেটের সন্তানের বিরাট ক্ষতি হয়।

আমি পরিবানুকে বললাম, তোমার যখন ইচ্ছা হবে তুমি কবরের কাছে যাবে। এত নিষেধ মানার কিছু নাই। তবে রাতে যদি কখনো যেতে ইচ্ছা করে একা যাবে না। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে।

পরী বানু বলল, একা যাব না কেন?

আমি বললাম, ভয় পেতে পারো।

পরীবানু বলল, ভয় পাব কেন? যে জীবিত অবস্থায় আমাকে ভালোবেসেছে। সে মৃত অবস্থায় আমাকে কেন ভয় দেখাবে?

আমি বললাম, তোমার যদি একা যেতে ইচ্ছা করে তুমি একা যেও। অসুবিধা নেই।

পরীবানু প্রতি রাতেই মাসুদের কবরের কাছে যেত। বেশির ভাগ সময় আমি থাকতাম সঙ্গে। এক রাতে একটা ঘটনা ঘটল। শহরবাড়ি থেকে কবরে যেতে হলে বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বাঁশঝাড়ে ঢুকেছি। সেখান থেকে হঠাৎ কবরের দিকে চোখ গেল। দেখি একটা ছায়ামূর্তি কবরে হাঁটাহাঁটি করছে। ছায়ামূর্তি দেখতে অবিকল মাসুদের মতো। মাসুদ যেমন মাথা ঢেকে চাদর পরত ছায়ামূর্তির গায়ে সেরকম চাদর। আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। পরীবানু অস্ফুট শব্দ করে আমার হাত ধরে ফেলল। তারপরই চাপা গলায় বলল, বুবু, কিছু দেখেছেন?

আমি বললাম, চল ফেরত যাই। পরীবানু বলল, আপনি বাড়িতে চলে যান। আমি যাব না। আমি তার কাছে যাব। এই দেখেন আপনার ভাই হাত ইশারায় ডাকতেছে।

পরীবানুর গলার স্বর গম্ভীর। সে যে কবরের কাছে যাবে তা তার গলার স্বরেই বোঝা যাচ্ছে। শেষপর্যন্ত দুজনে মিলেই গেলাম। কবরের কাছাকাছি যাবার আগেই ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেল।

সেই রাতেই এই ঘটনা বাবার কানে পৌছল। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। বাবা খাটে পা তুলে বসেছিলেন। তার সামনে হুক্কা। তিনি নল হাতে বসে আছেন। হুক্কা টানছেন না। আমি তার সামনে দাঁড়াতেই তিনি ইশারা করলেন বসতে। আমি তার পাশে বসলাম। বাবা আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন– এইটা কি মাস জানো?

আমি বললাম, আশ্বিন মাস।

বাবা বললেন, আশ্বিন মাসে চাঁদের দশ তারিখ থেকে বিশ তারিখ গ্রামের মানুষ ভূত-প্ৰেত বেশি দেখে, এইটা জানো?

আমি বললাম, জানি না।

পাতার ফাঁকে এই জোছনা যখন আসে তখন মনে হয়। ভূত-প্ৰেত।

আমি বাবার কথা বুঝতে পারছিলাম না। তিনি প্রস্তাবনা শুরু করেছেন। মূল বক্তব্যে এক্ষুনি যাবেন, তার জন্যে অপেক্ষা করাই ভালো।

লীলা শোনো। জামগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আশ্বিন মাসের ১৩ তারিখে জোছনা নেমেছে। সেই জোছনায় ছায়া তৈরি হয়েছে। ছায়াটা পড়েছে কবরে। তোমরা সেই ছায়াটাকে মনে করেছ মাসুদ। মৃত মানুষ ফিরে আসে না। কায়া ধরেও আসে না, ছায়া ধরেও আসে না।

বাবার যুক্তি আমি সঙ্গে সঙ্গে মানলাম। এত পরিষ্কার চিন্তা গ্রামের মানুষ সাধারণত করে না। কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করার অভ্যাস না থাকলে চিন্তার মতো পরিশ্রমের কাজ গ্রামের মানুষজন করে না। এই মানুষটা করেন। ভালোমতোই করেন।

লীলা।

জি।

যদি একজন কেউ ভূত দেখে ফেলে তখন অন্যরাও দেখা শুরু করে। ভূত দেখা কলেরা রোগের মতো। একজনের হলে তার আশেপাশে দশজনের হয়। কাজেই তোমরা ভূত দেখাদেখি নিয়ে আলোচনা করবে না।

জি আচ্ছা।

কাল সকালে আমি জামগাছ দুটা কাটায়ে ফেলব। কবরের আশেপাশে গাছ থাকার প্রয়োজন নাই।

মনে হয় তার কথা বলা শেষ হয়েছে। তিনি তামাক টানা শুরু করেছেন। আমি চলে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালাম না, বসেই রইলাম। অতি নিঃসঙ্গ এই মানুষটার জন্যে মায়া লাগছে। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছে করছে। এত বড় ঘটনা ঘটে যাবার পরেও মানুষটার মানসিক শক্তি আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি। বড় ধরনের ধাক্কা তিনি খেয়েছেন। তার ছাপ আমি দেখতে পাচ্ছি। তিনি আগের মতো হেঁটে জঙ্গলা ভিটায় যেতে পারেন না। তাকে এখন লোকমান-সুলেমানের কাধে ভর দিয়ে যেতে হয়।

লীলা, তুমি কিছু বলতে চাও?

আমি বললাম, আপনি ভূত-প্ৰেত বিশ্বাস করেন না?

বাবা তামাক টানা বন্ধ করে আমার দিকে ফিরলেন।

আগে আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম, এখন বসেছি মুখোমুখি।

বাবা বললেন, মানুষ মরে ভূতপ্রেত হয়। এইসব বিশ্বাস করি না, তবে অন্য কিছু আছে।

অন্য কিছুটা কী?

ভূত-প্ৰেত জগতের জিনিস। আমি একবার দেখা পেয়েছিলাম। তুমি কি ঘটনাটা শুনতে চাও?

শুনতে চাই।

তোমার মাকে বিবাহের রাতেই ঘটনাটা বলেছিলাম। সে অত্যধিক ভয় পেয়েছিল।

আমি সহজে ভয় পাই না।

বাবা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি আমার মতো হয়েছ। আমার মধ্যে ভয়-ডর কম। সব মানুষের মৃত্যুভয় থাকে। আমার সেই ভয়ও নাই। মৃত্যু যখন হবার হবে। তার ভয়ে অস্থির হবার কিছু নাই।

আপনি ঘটনাটা বলেন।

আমার যৌবনকালের ঘটনা। বয়স কুড়ি-একুশ। তারচেয়ে কিছু কমও হতে পারে। তখন হলো টাইফয়েড। বাংলায় বলে সান্নিপাতিক জুর। তখন টাইফয়েড রোগের কোনো চিকিৎসা ছিল না। এই রোগ হওয়া মানেই মৃত্যু। আমার মৃত্যু হলো না, একত্রিশ দিনের মাথায় জ্বর ছাড়ল। শরীর অতি দুর্বল। দুই পা হাঁটলে মাথা ঘুরে। কিছু খেতে পারি না। হজম হয় না। দুইবেলা জাউ ভাত আর শিং মাছের ঝোল খাই। আমার দাদি তখন আমার স্বাস্থ্যু ঠিক করার দায়িত্ব নিলেন। তিনি হুকুম দিলেন, প্রতিদিন যেন আমাকে নদীর পাড়ে হাওয়া খেতে নিয়ে যাওয়া হয়। নদীর টাটকা হাওয়া রুচিবর্ধক। চারজন বেহাৱা পালকিতে করে আমাকে নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে পাটি পেতে দিয়ে দূরে গিয়ে গাজা ভাং খায়। সন্ধ্যা মিলাবার পর আমাকে নিয়ে ফিরে আসে। আমি নদীর দিকে তাকিয়ে শীতল পাটিতে শুয়ে থাকি।

জায়গাটা অতি নির্জন। আশেপাশে কোনো লোকবসতি নাই। নদীর ঐ পাশে ঘন বন। দিনের বেলায়ও শিয়াল ডাকে।

একদিনের ঘটনা। সন্ধ্যা হয়েছে। দিনের আলো সামান্য আছে। আমি শুয়ে আছি। বেহাৱা চারজন দূরে কোথাও গেছে। গাজ-টাজা খাচ্ছে হয়তো। আমার দৃষ্টি নদীর পানির দিকে। হঠাৎ দেখি পানিতে ঘূর্ণির মতো উঠেছে। এটা এমন কোনো বিশেষ ঘটনা না। নদীর পানিতে প্রায়ই ঘূর্ণি ওঠে।

হঠাৎ আমার গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম। দেখি নদীর ঘূর্ণি থেকে কে যেন মাথা ভাসায়ে দিয়েছে। প্রথমে চুল দেখলাম, তারপর মাথা। সেই মাথা পুরাপুরি মানুষের মাথা না। চোখ নাই। যাদের চোখ থাকে না তাদের চোখে কোটর থাকে। এর তাও নাই। চোখের জায়গায় মুখের চামড়ার মতো চামড়া। বাকি সব ঠিক আছে। নাক আছে, মুখ আছে, কান আছে। জিনিসটা বুক পর্যন্ত পানির উপর উঠল। তারপর কথা বলল। আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল— এই, মন দিয়ে শোন। পিতলের একটা ঘড়া মাটিতে পোতা আছে। তোকে দিলাম। তুই ভোগদখল কর। ঘড়াটা কই আছে নজর করে দেখ। তাকা আমার আঙুলের দিকে।

এই বলেই সে আমার দিক থেকে আঙুল সরিয়ে নদীর পাড়ের একটা অংশ আঙুল দিয়ে দেখাল। যেভাবে সে পানি থেকে আস্তে আস্তে উঠেছিল সেইভাবেই আস্তে আস্তে পানিতে ড়ুবে গেল। সারাক্ষণই আঙুল নদীর পাড়ের দিকে ধরে থাকল। আমি অজ্ঞান হয়ে পাটিতে পড়ে গেলাম। বেহারারা অজ্ঞান অবস্থাতেই আমাকে বাড়িতে নিয়ে গেল। আমার জ্ঞান ফিরে চার ঘণ্টা পরে। তখন আমার সারা শরীর দিয়ে বিজল বের হচ্ছে। বিজল চিন? বিজল হলো তৈলাক্ত জিনিস।

বাবা থামলেন। এখন তিনি আর আমার দিকে তাকাচ্ছেন না। তিনি আবারো মুখ ঘুরে বসেছেন। আমার সঙ্গে কথাবার্তা শেষ হয়েছে এরকম ভাব। আমি বললাম, আপনি তখন খুব অসুস্থ ছিলেন। শীতল পাটিতে শুয়ে থাকলেন। উঠে বসার মতো সামর্থ্যও ছিল না। আমার ধারণা। আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নটা আপনার কাছে সত্যি মনে হয়েছে। মাঝে মাঝে অনেক স্বপ্ন আমাদের কাছে সত্যি মনে হয়।

বাবা বললেন, তোমার কথার মধ্যে যুক্তি আছে। যুক্তির কথা আমার পছন্দ।

আমি বললাম, অন্ধ মানুষটা আপনাকে যে জায়গাটা দেখিয়েছিল সেই জায়গাটার কি আপনি খোঁজ করেছিলেন?

বাবা শান্ত গলায় বললেন, হ্যাঁ। পরের দিনই সেখানে গিয়েছি।

কিছু পান নাই?

বাবা শান্ত গলায় বললেন, খুঁড়াখুড়ি করি নাই।

কেন করেন নাই? আপনার কৌতূহল হয় নাই?

কৌতূহল হয়েছে, কিন্তু ভূত-প্রেতের কাছ থেকে কিছু নিতে ইচ্ছা করে নাই। তবে সেই জায়গা আমি পরে কিনে নিয়েছি। আমি মাঝে মাঝেই সন্ধ্যার দিকে ঐ জায়গায় বসে থাকি।

অন্ধ লোকটার দেখা পাওয়ার জন্যে?

হ্যাঁ, তবে তাকে লোক বলবে না। সে মানুষ না, অন্য কিছু।

আবার তার দেখা পেতে চান কেন?

আমি তাকে জিজ্ঞেস করব, সে কে?

সে কে এটা জেনে আপনার লাভ কী?

কোনো লাভ নাই। কৌতূহল মিটানো। মানুষ কৌতূহল মিটানোর জন্যে অনেক কিছু করে। শুধু যে মানুষ করে তা-না। পশুপাখি কীটপতঙ্গ সবাই কৌতূহল মিটাতে চায়। তুমি যদি সন্ধ্যাবেলায় একটা কুপি জ্বালাও, দেখবে অনেক পোকা আগুনে এসে পড়ে। তাদের কৌতূহল হয় আগুন জিনিসটা কী জানার। জানতে এসে মারা পড়ে।

আপনি আমাকে একদিন আপনার সঙ্গে নিয়ে যাবেন? জায়গাটা দেখব।

অবশ্যই নিয়ে যাব। কবে যাবে বলো। কাল যেতে চাও?

হ্যাঁ যাব।

 

আমি এখন আমার বাবার প্রসঙ্গে কিছু কথা বলি। তিনি শুরুতে আমার কাছে ছিলেন অতি দুষ্ট্র একজন মানুষ। যে তাঁর স্ত্রী-কন্যাকে দূরে ঠেলে দেয়— আরেকটি বিবাহ করে। সুখে যে ঘর-সংসার করে তা-না। স্ত্রীকে তালা আটকে বন্দি করে রাখে। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হবার পর মনে হলো— ভয়াবহ দুষ্ট্র মানুষদের একজন সম্ভবত তিনি না। ক্ষমতাধর মানুষদের দুর্বলতা তার মধ্যে আছে। বদরাগ, অহঙ্কার–এইসব বিষয় তাঁর কাছে চরিত্রের অহঙ্কার। দুর্বলতা না।

এখন মনে হচ্ছে মানুষটা ভাবুক প্রকৃতির। শুধু যে ভাবুক তা-না। তার মধ্যে চিন্তা করার দুর্লভ ক্ষমতা আছে। মানুষটির ভালোবাসার ক্ষমতাও প্রবল। তার ভালোবাসা আড়াল করার চেষ্টাটাও চোখে পড়ার মতো— আমি ভালোবাসব কিন্তু কেউ যেন তা বুঝতে না পারে।

এই মানুষটির মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ রহস্যময়তাও আছে। তাঁর মাথায় ঘুরছে। আশ্রম। সেই আশ্রমও তার কল্পনার আশ্রম। বিশাল একটা এলাকা থাকবে। সেই এলাকায় পশুপাখি নিজের মতো করে ঘুরবে কিন্তু কোনো মানুষ থাকবে না। মানুষ বলতে তিনি একা থাকবেন।

বাবা তার আশ্রম তৈরি করা শুরু করেছেন। আমি একদিন দেখে এসেছি। দুনিয়ার পাখি সেখানে। পাখি কেনইবা আসবে না? তাদেরকে ধান, কুড়া, সরিষাদানা আর কী কী যেন খেতে দেয়া হয়। অনেক গাছে দেখলাম মাটির কলসি উল্টা করে বাধা। যে সব পাখি বাসা বাধতে জানে না। তাদের জন্যেই এই ব্যবস্থা।

এই বিষয়টিকে কি আমি পাগলামি বলব? কিছু পাগলামি সব মানুষের মধ্যেই আছে। তবে বেশির ভাগ মানুষ এইসব পাগলামি প্রশ্ৰয় দেয় না। বাবা দেন। পাগলামি প্রশ্ৰয় দেয়ার ক্ষমতা আছে বলেই হয়তো দেন।

বাবার প্রসঙ্গে একটা অদ্ভুত গল্প এখন বলব। এই গল্পে আমার বিশেষ একটা ভূমিকা আছে। ঘটনাটা আমি কাছ থেকে দেখেছি।

নান্দিপুর থেকে একবার বাবার কাছে এক লোক এলো তার ছেলেকে নিয়ে। নান্দিপুর আমাদের এখান থেকে প্রায় ছয় ক্রোশ অর্থাৎ বার মাইল দূর। ছেলেটার বয়স দশ-এগারো। খুবই অসুস্থ। কয়েক বছর ধরে না-কি সে কিছুই খেতে পারে না। হজম হয় না। অতি সহজপাচ্য ভাতের মাড়, চিড়ার ক্যাথ এইসব তাকে খাওয়ানো হয়। এটাও সে হজম করতে পারে না। ছেলেটা রোগা কাঠি। দেখে মনে হয় পাঁচ-ছয় বছর বয়স। তার বাবা এই দীর্ঘ পথ তাকে ঘাড়ে করে এনেছে। ছেলের হাঁটারও ক্ষমতা নেই।

বাবা বললেন, আমার কাছে আসছ কী জন্যে? চিকিৎসার খরচা চাও?

ছেলের বাবা বলল, না। চিকিৎসার খরচার জন্যে আপনার কাছে আসি নাই। আপনি তারে একটু উতার (পানি পড়া) দেন।

আমি তারে উত্তর দিব? আমি কি পীর-ফকির?

আপনের দেওয়া উতার খাইলে তার রোগ সারব।

তোমাকে কে বলেছে?

লোকটা জবাব দিল না। মাথা গোজ করে ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বাবা লোকমান চাচাকে বললেন, এদেরকে যেন বাড়ির সীমানা থেকে বের করে দেয়া হয়।

তাই করা হলো। লোকটা কিন্তু গেল না। বাড়ির সীমানার বাইরে একটা আমগাছের নিচে ছেলেকে নিয়ে বসে রইল। শীতের রাত। তারা কাপড়চোপড় নিয়ে আসে নি। লোকটা শুকনো লতাপাতা জোগাড় করে আগুন ধরাল। আগুনের পাশে ছেলেকে নিয়ে জবুথবু হয়ে বসে রইল। অদ্ভুত এক দৃশ্য! রাত দশটার দিকে আমি বাবাকে গিয়ে বললাম, পানি পড়া চাচ্ছে, দিয়ে দেন। ছেলেকে নিয়ে চলে যাক।

বাবা বললেন, যে জিনিস আমি জানি না সেটা আমি কেন করব?

আমি বললাম, তাদের মনের শান্তির জন্যে করবেন।

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন, অন্যের শান্তি নিয়া আমি মাথা ঘামাই না। তুমি এই বিষয়ে আমার সঙ্গে দরবার করবা না।

এরা গাছতলায় বসে আছে।

থাকুক।

রাত এগারোটার দিকে বাবা বললেন, ঝাল মুরগির সালুন রান্না করো। পোলাও রান্না করো। ছেলেকে ডাক। এই ছেলে দিনের পর দিন বিস্বাদ জাউ ভাত খায়। পোলাউ দেখে মুখে রুচি আসবে। আরাম করে খাবে। তাতেই কাজ হবার কথা। দেখা যাক।

তাদেরকে যত্ন করে খাবার দেয়া হলো। বড় বড় জামবাটি ভর্তি মাংস। পোলাও-এর ডিসে ধোয়া উঠা কালিজিরা চালের সুগন্ধি পোলাও।

ছেলেটার নাম নসু। মিয়া। সে চোখ বড় বড় খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকল। বাবা বললেন, একে এলাচি লেবু দাও। পিয়াজ, কাঁচামরিচ দাও।

নসু মিয়া ভয়ে ভয়ে তার বাবার দিকে তাকাল। তার বাবা আগ্রহের সঙ্গে বলল, খাও গো বাপাধন। উনি যখন খেতে বলেছেন খ্যাও। বমি যদি হয়— হইব। নিশ্চিন্ত মনে খাও।

নসু ভরপেট খেল। তার কোনো সমস্যাই হলো না। সকালবেলা ডিমভুনা দিয়ে খিচুড়ি খেয়ে বাবার হাত ধরে বাড়ি রওনা হয়ে গেল।

ঘটনাটার মধ্যে কোনো আধ্যাত্মিক বিষয় নেই। কিন্তু পিতা এবং পুত্ৰ বিষয়টিকে ফকিরি ঘটনা হিসেবে ধরেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এরকম মনে করাই স্বাভাবিক। মানুষ অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করতে পছন্দ করে।

আমি নিজেও তো করি। আমার মা রমিলা যা বলেন বিশ্বাস করি। (সৎ মা না বলে মা বললাম। উনাকে আমার মা ভাবতেই ভালো লাগে) মাসুদের মৃত্যুর পর উনি খুবই চুপচাপ হয়ে গেছেন। সারাদিন বিছানার এক কোনায় গুটিসুটি মেরে বসে থাকেন। তবে সন্ধ্যার পর তার মধ্যে এক ধরনের ছটফটানি দেখা যায়। তিনি ঘরে বাতি দেবার জন্যে হৈচৈ শুরু করেন। চাপা গলায় তিনি বলতে থাকেন–বাতি দেও! সব ঘরে বাতি দেও। কোনো ঘর যেন বাকি না থাকে।

আমি তাঁকে একটা টর্চ লাইট কিনে দিয়েছি। পাঁচ ব্যাটারির টর্চ লাইট। টর্চ লাইটটা তিনি খুব পছন্দ করেছেন। চাপা গলায় বলেছেন, ভালো করেছ মা। অন্ধকারে ভয় লাগে।

কিসের ভয়?

আছে, বিষয় আছে। তোমার সব বিষয় জানার প্রয়োজন নাই। সব কিছু সবের জন্যে না।

আমার এই অপ্রকৃতস্ত মা পরীবানু বিষয়ে একটা ভবিষ্যতবাণী করেছেন। আমি মনেপ্ৰাণে তার কথা বিশ্বাস করছি। তিনি বলেছেন– এই মেয়েটার যমজ সন্তান হবে। একটা ছেলে একটা মেয়ে। দুই সন্তানসহ সে আবার এক স্বামীর সংসার করবে। সেই স্বামীর মতো ভালো মানুষ ত্রিভুবনে নাই। মেয়েটার জীবন অতি সুখে কাটবে।

আমি তাঁর কথা বিশ্বাস করি। মানুষের বিশ্বাস যুক্তি মানে না। আমার বিশ্বাসের পিছনেও কোনো যুক্তি নেই। যুক্তি দিয়ে হবেই বা কী? আমাদের চারপাশের যে জগৎ সেই জগৎ কতটা যুক্তিনির্ভর। এখন আমার ভাবতে ভালো লাগে, কেউ একজন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। কঠিন নিয়ন্ত্রণ। যিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন তার কাছেই সবকিছু সমৰ্পণ করা ভালো না? কী হবে চিন্তা-ভাবনা করে?

জোছনা রাতে আমি প্রায়ই একা একা মাসুদের কবরের কাছে যাই। চুপচাপ বসে থাকি। আমার ভালো লাগে। আমাকে ঢাকায় ফিরে যেতে হবে। পড়াশোনা শেষ করতে হবে–এইসব নিয়ে এখন আর মাথা ঘামাই না।

একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, আমার বিএ পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। রেজাল্টের খবরে বাবা আরো একবার বাঁশগাছের মাথায় হারিকেন টানিয়েছেন। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ হারিকেন দেখেছে। তারা জানতে এসেছে ঘটনা কী। তাদের প্রত্যেককেই বাবা বলেছেন–আমার মেয়ে পেতলের ঘাড়া ভর্তি সোনার মোহর পেয়েছে। বড় ভাগ্যবতী আমার এই মেয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *