আমার ইচ্ছায় নয়, তন্ময়ের প্রচেষ্টায় আমার জীবনে আবার মোড় ঘুরল। ডক্টর জ্যাকসন আমাকে দেখেই বললেন, মাই ডিয়ার ডটার, তুমি কালকেই অক্সফোর্ডে গিয়ে ডক্টর রবার্ট কিং-এর সঙ্গে দেখা করবে। হি ইজ লুকিং ফরোয়ার্ড টু সী ইউ অ্যান্ড টোনময়।
পরের দিনই আমি আর তন্ময় অক্সফোর্ড গেলাম। ডক্টর কিং সাদরে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। নিজে কফি তৈরি করে খাওয়ালেন। তারপর বললেন, যদি তোমার আপত্তি না থাকে তাহলে তুমি আমার ইউনেস্কো প্রজেক্টে কাজ করতে পারো। বাট ইউ উইল হ্যাভ টু লিভ ব্রিটেন।
আমি জবাব দেবার আগেই তন্ময় বলল, স্যার, তাতে কবিতার কোনো আপত্তি নেই; বরং ঘুরে-ফিরে কাজ করতে পারলে ও বেশি খুশি হবে।
দ্যা নাইস! সিগারেটে টান দিয়ে ডক্টর কিং বললেন, আমার মনে হয় কোবিটা উইল লাইক হার ওয়ার্ক।
আম বললাম, ইউনেস্কো প্রজেক্ট কাজ করা তো পরম সৌভাগ্যের কথা এবং এই সুযোগের জন্য আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।
অক্সফোর্ড থেকে ফিরে এসেই ল্যাভলেডিকে ফোন করে জানালাম, দুদিনের মধ্যেই বাড়ি ছাড়ছি। তারপর শাঁখা সিঁদুর না পরেই তন্ময়ের অ্যাপার্টমেন্টে উঠলাম। ওখানে থাকতে আমার আগ্রহ না থাকলেও অনিচ্ছা ছিল না। আমি জানতাম, তন্ময়ের সাহায্য দরকার। তাই কিছুটা স্বার্থপরের মতোই ওর আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ওর আস্তানায় গেলাম।
আর্য ফ্যাক্টরির কয়েকটা সুটকেশ সঙ্গে নিয়ে কলকাতা থেকে লন্ডন এসেছিলাম। উঠেছিলাম বাঙালি অধ্যাপক ডক্টর সরকারের বাড়িতে, কিন্তু এবার আমাকে প্রথমেই যেতে হবে প্যারিস। তারপর আশেপাশের দেশগুলিতে। থাকতে হবে হোটেলে বা অন্য কোনো অস্থায়ী আস্তানায়। মধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়ের পক্ষে বেশ চিন্তার ব্যাপার। চিন্তার আরো কারণ ছিল। লন্ডন বিদেশ হলেও সর্বত্র কলকাতার গন্ধ পাওয়া যায়। অভাব নেই ভারতীয়দের। পথেঘাটে, বাসে-টিউবে, দোকানে বাজারে সর্বত্র ভারতীয় দেখা যায়। সুতরাং নবাগত ভারতীয়কে এখানে বিপদে পড়তে হয় না, কিন্তু প্যারিস বা রোম বা ব্রুসেল্স-এ সে সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই তো তন্ময়ের সাহায্য সহযোগিতা আমার চাই-ই। এ সব কথা ভাবতে ভাবতে নিজের কাছেই নিজেকে হীন মনে হল।
চুপ করে বসেছিলাম। বোধহয় বেশ কিছুক্ষণ। তাই তন্ময় ঘরে ঢুকেই বলল, তুমি এখনও ওইভাবে চুপ করে বসে আছ।
আমি কোনো জবাব দিলাম না।
ও আবার জিজ্ঞাসা করল, কী এত ভাবছ?
আমি মুখ না তুলেই বললাম, তোমার কথা ভাবছি।
আমার কথা? ও বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ।
ও হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ আমার কথা ভাবার কী কারণ ঘটল!
এবার খোলাখুলিই বললাম, এখন তোমার সাহায্য দরকার বলে ঠিক তোমার কাছে চলে এলাম। আমি জানতাম না আমি এত স্বার্থপর!
তন্ময় খুব জোরে হেসে উঠল। বলল, তুমি স্বার্থপর আর আমি মহাপুরুষ, তাই না? ও একটু এগিয়ে এসে আমার দুটো হাত ধরে বলল, কবিতা, এ সংসারে আমরা সবাই স্বার্থপর; কেউ বেশি, কেউ কম।
আমি মুখ নীচু করেই বসে রইলাম।
দু-এক মিনিট পরে তন্ময় জিজ্ঞাসা করল, কফি খাবে?
এবার আমি বললাম, তুমি তো নিজেই রান্নাবান্না করে খাও; যে দু-চারদিন আমি আছি, সে কদিন আর তোমাকে কিছু করতে হবে না।
তারপর যদি সংসারী হতে ইচ্ছা করে?
হবে। আমার আপত্তির কী কারণ থাকতে পারে?
কিন্তু তোমার সম্মতি তো চাই।
তুমি সংসারী হবে, তাতে আমার কী ভূমিকা আছে? আমি দূর থেকে শুধু শুভেচ্ছা জানাব।
কিন্তু…।
না, আর কোনো কিন্তু শুনলাম না। আমি কফি তৈরি করে আনতেই তন্ময় বলল, তোমার নিশ্চয়ই কিছু কেনাকাটা করতে হবে।
হ্যাঁ।
আমাকে কী সঙ্গে থাকতে হবে?
ও সব দেশে চাকরি করতে গেলে বা ঘোরাঘুরির জন্য কি দরকার, তা তো আমি জানি। তাই তুমি সঙ্গে থাকলে ভালো হয়।
তাহলে চল, একটু পরেই বেরিয়ে পড়ি।
রান্না করব না?
কী দরকার? বাইরেই খেয়ে নেব।
না, না, আমি রান্না করি! একটু থেমে হেসে বললাম, বাইরের খাবার তো সব সময়ই খাও। দু-চারদিন না হয় আমার রান্নাই খেলে।
অযথা কেন কষ্ট করবে?
এতে কষ্টের কী আছে? রান্না করতে আমার ভালোই লাগে।
ঠিক আছে। তাহলে খাওয়া দাওয়া করেই বেরুব।
.
তন্ময় ছেলেবেলায় মাকে হারালেও আদর-যত্নের অভাব হয়নি ওর জীবনে। জ্যাঠার কোনো ছেলে না থাকায় তন্ময় বড়মার কাছে মাতৃস্নেহই পেয়েছে। বোধহয় একটু বেশিই পেয়েছে। এই সামান্য কিছু দিন মেলামেশা করেই জানতে পেরেছিলাম, পাঁচ রকম ভালো মন্দ খেতে ও ভালোবাসে। তাই তো যে কদিন ওখানে ছিলাম আমি অনেক কিছু রান্না করতাম। ও আমাকে বলত, তুমি অনেকটা বড়মার মতো রান্না কর। তাই তো এত বেশি খেলাম।
ওর কথা শুনে আমি হাসি। বলি, তাই কী হয়? তুমি ছাড়া আর কেউই আমার রান্নার প্রশংসা করল না।
না, না, কবিতা, তুমি সত্যি খুব ভালো রাঁধতে পারো। তাছাড়া তুমি ঠিক বড়মার মতো অনেক রকম রান্না কর। তন্ময় একটু থেমে বলে, বড়মাকে হারাবার পর এমন যত্ন করে আর কেউ খাওয়ায়নি।
আমার প্যারিস যাবার প্রস্তুতি আর এই রান্নাবান্না-গল্পগুজব করেই দিনগুলো বেশ কেটে যেত। রাত বারোটা, সাড়ে বারোটার আগে শুতে যেতাম না। প্রথম দিন অনেক আগেই খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছিল। আমাকে ক্লান্ত দেখে ও দু-একবার শুতেও বলল, কিন্তু আমি ইচ্ছা করেই দেরি করলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, তন্ময় নিশ্চয়ই এমন সুযোগ ছেড়ে দেবে না। এবং আমিও হয়তো ওকে বাধা দেব না, বা বাধা দিলেও ও গ্রাহ্য করবে না। যাই হোক গল্প করতে করতে অনেক রাত হল। তারপর তন্ময় আমার দুটো হাত ধরে বলল, যাও, শুতে যাও। অনেক রাত হয়েছে।
আমি বললাম, তুমি যাও। আমি একটু পরে শোব।
না, না, তুমি আগে শুতে যাও। আফটার অল তুমি আমার গেস্ট।
আমার মতো গেস্টকে অত সৌজন্য দেখাবার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি স্বচ্ছন্দে আগে শুতে যেতে পারো।
এবার তন্ময় বলল, আমি আলো অফ করে শুয়ে পড়লে তুমি তোমার ঘরে যেতে অসুবিধায় পড়বে।
আমি বুঝলাম, ও আমাকে ওর ঘরে শুতে বলবে না। একটু আশ্বস্ত হলাম ঠিকই কিন্তু সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। ভাবলাম, হয়তো মাঝরাতে আমার কাছে আসবে। হয়তো আমাকে বিরক্ত করবে কিন্তু কী আশ্চর্য, যে কদিন ওর কাছে ছিলাম তন্ময় আমাকে কোনো দিন এক মুহূর্তের জন্যও বিরক্ত করল না। এত যত্নে, এত সমাদরে ও আমার দেখাশোনা করল যে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। আমি মনে মনে ওকে শ্রদ্ধা না করে পারলাম না।
তন্ময়ের প্রতি এই শ্রদ্ধা নিয়েই আমি নতুন জীবন শুরু করার জন্য প্যারিস রওনা হলাম, কিন্তু এই শ্রদ্ধা দীর্ঘস্থায়ী হল না। আমি প্যারিস আসার মাস খানেক পরেই ব্রুসেলস্ থেকে তন্ময়ের চিঠি পেলাম-কবিতা, আমি ব্রুসেলস্-এ এসেছি। আগামী ন মাস এখানেই থাকব। মনে হয়, বিধাতা পুরুষ আমাকে তোমার কাছ থেকে বেশি দূরে রাখতে চান না। তাইতো অতলান্তিক পাড়ি দেবার আগে এখানে এলাম। শুক্রবার সন্ধ্যায় আসছি।
চিঠিটা পেয়ে খুশিই হলাম কিন্তু একটু দ্বিধায় পড়লাম। আমার একটাই ঘর। আলাদা বিছানার ব্যবস্থা করলেও এই এক ঘরেই থাকতে হবে! তন্ময় আমার এত উপকার করেছে যে ওকে হোটেলে থাকতে দেওয়া যাবে না। মনের মধ্যে অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকলেও তন্ময়কে কাছে পেয়ে ভালোই লাগল।
আমার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছেই তন্ময় আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, ভাগবানের বোধহয় ইচ্ছা নয় আমি তোমার থেকে দূরে থাকি।
আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলাম, ভগবানের নাম দিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা বলছ না তো?
আমার ইচ্ছা তো তোমার এই অ্যাপার্টমেন্টেই সারা জীবন কাটিয়ে দিই।
তাই নাকি?
এ ব্যাপারে আমার মনে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।
তোমার মনে দ্বন্দ্ব না থাকলেও আমার মনে তো থাকতে পারে।
খানিকটা স্যাম্পেন খাবার পর এ সব দ্বন্দু কোথায় উড়ে চলে যাবে, তার ঠিক-ঠিকানা পাবে না।
.
ভাই রিপোর্টার, তুমি তো জানো পৃথিবীর অন্যান্য সব মহানগরীতে নিঃসঙ্গ জীবন কাটানো সম্ভব হলেও প্যারিসে তা কল্পনাতীত। শুধু তাই নয়, এখানে সন্ধ্যার পর দুটি ছেলে বা দুটি মেয়েকে একসঙ্গে দেখাও যায় না। অনেকের কাছেই তা বিস্ময়ের। এবং কৌতূহলের।
শুধু তাই নয়, দু চার সপ্তাহ প্যারিস বাস করেই বুঝতে পেরেছিলাম, কোনো সময়ের পক্ষেই একা থাকা নিরাপদ নয়। তাইতো মনের মধ্যে যত দ্বন্দ্ব, যত ভয়ই থাকুক, উম্মত্ত নারীলোভ অপরিচিত পুরুষদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য তন্ময়কে কাছে পেয়ে খুশিতে ভরে গেলাম।
ওকে কফি খেতে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, বল, কী খাবে?
ও কফির পেয়ালায় প্রথম চুমুক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, আসতে আসতেই খাবার কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?
নটা বাজে। তাই ভাবছিলাম রান্না সেরেই গল্পগুজব করব।
ও হো হো করে হেসে উঠল। বলল, আজ শুক্রবার। কাল-পরশু ছুটি। আজকের এই সন্ধ্যায় কেউ বাড়িতে বসে থাকে?
তা জানি কিন্তু তুমি ক্লান্ত হয়ে এসেছ বলেই ভাবছিলাম আজ আর বেরুব না।
ও আমার কোনো কথা শুনল না। আমাকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
শুধু তন্ময়কে দোষ দেব না। ওর সঙ্গে সঙ্গে আমিও ভুলে গেলাম আমরা বাঙালি, ভা, তীয়। ভুলে গেলাম আমরা অবিবাহিত। আনন্দে উন্মত্ত হয়ে আমরা প্রায় নাচতে নাচতে ঘুরে বেড়ালাম। যত্র-তত্র-সর্বত্র। সাইড ওয়াক কাফেতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই এক বোতল ওয়াইন খেয়ে দুজনেই বেশ মদীর হয়ে উঠলাম। তারপর তন্ময় বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে সবার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। তারপর আরো ঘুরলাম, আরো ওয়াইন খেলাম। নাচ দেখলাম। তিন-চারটে কাফে থেকে কিছু কিছু খেয়ে ডিনারের পর্ব শেষ করলাম।
বোধহয় রাত দুটো-আড়াইটের সময় অ্যাপার্টমেন্টে ফিরলাম। তারপরের কথা আর লিখব। শুধু জেনে রাখ, পরের দিন অনেক বেলায় যখন ঘুম ভাঙল, তখন চোখের সামনে দুটি উলঙ্গ নারী-পুরুষের পেন্টিং দেখে বিস্মিত হলাম। মিনিট খানেকের মধ্যেই আমার বিস্ময় কেটে গেল। বুঝলাম, ওটা কোনো শিল্পীর সৃষ্টি নয়; সামনের আয়নায় আমার আর তন্ময়ের প্রতিচ্ছবি।
আজ এখানেই শেষ করছি।