আবার ফিরে আসি গল্পে।
মধ্যাহ্নসূর্য তখন অনেকখানি পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। বনের মধ্যে আর কিছুক্ষণ বাদেই ছায়া-ছায়া ধূসরতা নামতে শুরু করবে। সিমডেগাতে খেয়াল করে দেখেছি, পাহাড়ি অঞ্চলে সন্ধ্যা নামে ঝুপ্ করে, হঠাৎ। সমতল বাংলায় যেমন হয়, তেমন কোনো পূর্বপ্রস্তুতি নেই। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি পাথরটার দিকে, অতবড় জগদ্দল পাথর, যার ওজন অন্ততঃ একশো মণ, সেটা কি দু-চারজন মানুষ ঠেলে এতখানি সরাতে পারে? তাছাড়া জলধর পণ্ডা তো বলেই দিয়েছে এদিকে আজ কুলিরা কাজ করতে আসেনি। কী হচ্ছে এসব?
গাছটারই বা কী হল? মেজকর্তা, সার্ভেয়ার সাহেব বা অসিতবাবু হয়ত আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন না, ভাবতেন একটা বিশাল গাছ তো আর বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে না, নিশ্চয় আমি ভুল দেখেছি বা জায়গা ভুল করছি।
যদি না পাথরটার সরে যাওয়া তারা নিজের চোখে দেখতেন!
হঠাৎ আমার নজরে পড়ল একটা জিনিস। যেখানে গাছটা দেখেছিলাম সেখানে সেটা আর নেই, কিন্তু মাটিতে পড়ে আছে কয়েকটা বড় বড় গোল গোল পাতা। এরকম কোন গাছের পাতা আমি কখনো দেখিনি। অদৃশ্য হয়ে যাওয়া গাছটায় এই পাতাই ছিল বটে। কিন্তু সে কথা বললে কি মেজকর্তারা বিশ্বাস করবেন?
কী একটা কথা যেন এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে। এইরকম একটা ঘটনার কথা আমি কোথায় যেন শুনেছি। কোথায়? কোনো কিছু আবছা মনে পড়ছে, পুরোটা স্পষ্ট হচ্ছে না, এ বড় যন্ত্রণার ব্যাপার। জুতোর ভেতর একটু বেরিয়ে থাকা পেরেকের মত। কেবলই খ খচ্ করে।
সকলে ফিরে এলাম তাঁবুতে। কারোই মন ভাল নেই। একটা ব্যাখ্যার অতীত আশঙ্কার ছায়া পরিবেশে সংক্রামিত হয়ে গিয়েছে। বিকেলের আবছায়া এবার সত্যিই গাঢ় হয়ে নামার উদ্যোগ করছে। তাঁবুর সামনে টেবিল পেতে আমরা বসলাম। জলধর গেল কুলিদের সঙ্গে কথা বলতে। ডহরু ভারি দক্ষ কর্মচারী, চারদিকে যাই ঘটে যাক, সে নিজের কর্তব্য ভোলে না। তাকে কিছু বলার আগেই সে কাঠের ট্রেতে সকলের জন্য এনামেলের মগ ভর্তি চা নিয়ে এল।
চায়ে চুমুক দিয়ে মেজকর্তা বললেন—এটা বিংশ শতাব্দী। অপদেবতা-অভিশাপ–মাম্বো-জাম্বো আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কিন্তু এখানে কিছু একটা যে ঘটছে সেকথা ঠিক। হয়ত এর যুক্তিসিদ্ধ ব্যাখ্যা আছে, যেটা আমরা ধরতে পারছি না। অন্য সব ব্যাপার। ছেড়ে দিলেও অতবড় পাথরটার স্থান পরিবর্তন কীভাবে ব্যাখ্যা করব জানি না।
অসিতবাবু বললেন—পাখিরা আর ডাকছে না।
মেজকর্তা প্রথমে ভাল ধরতে পারলেন না। বললেন–আঁ?
-বলছি আজ দুপুর থেকে পাখির ডাক আর শোনা যাচ্ছে না। খেয়াল করেছেন?
মেজকর্তার কপালে চিন্তার রেখা পড়ল। এতক্ষণ ভদ্রলোক জিনিসটা ঠিকঠাক উপলব্ধি করতে পারেন নি, এবার পরিবেশের অস্বাভাবিক স্তব্ধতা মোটা চাদরের মত সবার চেতনার ওপর বিছিয়ে নেমে এল।
অসিতবাবু বোধহয় পাখি সম্বন্ধে পড়াশুনো করেন। তিনি বললেন—ব্যাপারটা খুব হালকাভাবে নেবেন না। বিহার-উড়িষ্যা-মধ্যপ্রদেশের এই সীমান্ত অঞ্চলে কম করে একশো বত্রিশ রকমের পাখি আছে। জঙ্গলে তাদের চিৎকারে কান পাতা যায় না। ভোরবেলা আর সন্ধের সময় এরা নিজের নিজের বাসায় ফিরে প্রাণভরে ডাকে। তাকে বলে ডন কোরাস আর ইভনিং কোরাস। এই তো সন্ধে নেমে আসছে, কই, কোনো পাখি ডাকছে না কেন?
নির্মল কাঞ্জিলাল বললেন—তাই তো! এটা তো ঠিক খেয়াল করিনি। সেইজন্যেই চারিদিকটা যেন কেমন কেমন লাগছে। শুধু পাখি কেন, পোকামাকড়ের ডাকও তো শোনা যাচ্ছে না। এটা কিন্তু সত্যিই অস্বাভাবিক। জঙ্গল কেন, শহরেও সন্ধেবেলা পোকা ডাকে–
আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে এল। দিনের বেলা উজ্জ্বল সূর্যালোকে এই অরণ্য তার সৌন্দর্য নিয়ে ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মত উদ্ভাসিত হয়ে থাকে। এখন নিকষ আলোকহীনতায় সেই অরণ্যই ছোটবেলায় বর্ষার রাত্তিরে মায়ের কোলে শুয়ে শোনা রাক্ষসপুরীর বাগানের বর্ণনার মত দেখাচ্ছে।
ডহরু লোহার একটা উজ্জ্বল পেট্রল বাতি জ্বেলে আমাদের টেবিলের ওপর বসিয়ে দিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা আলোকবৃত্তের বাইরে অন্ধকার পিছিয়ে গেল বটে, কিন্তু অন্য এক বিপদ দেখা দিল। একেবারে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার বরং তবু সহ্য করা যায়, তীব্র আলোর মধ্যে বসে একটু দূরের রহস্যময় অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকা বড় অস্বস্তিকর। এ বোধহয় মানুষের গভীরতম অবচেতনে লুকিয়ে থাকা অজানার প্রতি ভয়। আলোয় দেখতে পাওয়া একটুখানি পরিচিত নিরাপত্তা, তার বাইরে কী লুকিয়ে আছে কে জানে! অন্ধকারে ভয় কিছু নেই, অন্ধকার যা ঢেকে রাখে সেইটেতেই আসল ভয়।
মেজকর্তা সিগারেট ধরালেন। আমাদেরও দিলেন একটা করে। আগেই বলেছি বাইরে কাজ করতে এসে আমরা সবাই পদমর্যাদা ভুলে স্বাভাবিকভাবে মিশছি, নইলে যাকে টিমওয়ার্ক বলে (এই নতুন শব্দটা সম্প্রতি মেজকর্তার কাছেই শিখেছি) তা করা সম্ভব নয়। চুপচাপ বসে আমরা সিগারেট টানতে লাগলাম।
একটু বাদে জলধর ফিরে এসে সামনে দাঁড়াল। মেজকর্তা বললেন—কী হে? মুখ অত গম্ভীর কেন? কী হয়েছে?
—কর্তা, কুলিদের নিয়ে বিপদ হবে মনে হচ্ছে। ওরা ভয় পেয়েছে।
—সে তো আগেই বলেছ, আমিও আন্দাজ করেছি। কী বলছে ওরা?
—হুজুর, এসব লোক অনপড়, মূর্খ। ভূত-প্রেত-দৈত্য-দানবে বিশ্বাস করে। এই অঞ্চলের লোকেদের মধ্যে পাসাং মারা বলে এক অপদেবতার গল্প চালু আছে। সে নাকি বড় খারাপ দেবতা, অসুখ-বিসুখ মৃত্যু আর অমঙ্গল নিয়ে তার কারবার। এসব পাহাড় জঙ্গল তার অধিকারের মধ্যে। সে না চাইলে এখানে আমরা কাজ করতে পারব না। রাগ হলে পাসাং মারা বাতাসে গান ভাসিয়ে জানান দেয়। সেই গান আজ এখানে শোনা। গিয়েছে। এরপর নাকি পাহাড়ে পাহাড়ে কথা হবে। পাহাড় ক্রমশ পরস্পরের কাছে সরে এসে তাঁবুসুদ্ধ আমাদের পিষে মেরে ফেলবে। কর্তা, ওদের দিয়ে কাজ করানো মুশকিল হবে। ওরা ফিরে যেতে চাইছে।
—এতক্ষণ ধরে কি এই কথাই হচ্ছিল ওদের সঙ্গে?
—ওরা সবাই তো কথা বলে না। ওদের হয়ে সর্দার কথা বলছিল। মানুষগুলো সরল কর্তা, একবার ভয় পেলে বোঝানো কঠিন। তেমন তেমন বুঝলে আমি ওদের নিয়ে লরি করে চলে যাচ্ছি কাল, আবার নতুন লোকজন নিয়ে ফেরবার চেষ্টা করব। তার আগে আর একবার বোঝাবার চেষ্টা করে দেখি–
মেজকর্তা উদ্বিগ্ন মুখে বললেন-চেষ্টা করে দেখি মানে কী? এতবড় প্রজেক্টের সার্ভে হচ্ছে, যার ওপর কোম্পানীর ব্যবসা নির্ভর করছে—চেষ্টা করব মানে কী? এরা যদি সত্যিই শেষ পর্যন্ত কাজ করতে রাজি না হয় তাহলে নতুন কুলির দল ধরে আনতেই হবে। নইলে চলবে কী করে?
জলধর পণ্ডা বলল—হুজুর, এদের মধ্যে একতার ভাব খুব বেশি, একজন যদি কোন কাজ করতে নারাজ হয়, বাকি সবাই সেই একই বুলি ধরবে। একদিন দুদিনের মধ্যে গ্রামে গ্রামে খবর চলে যাবে। তেমন তেমন অবস্থা হলে কুলি পাওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়বে। দেখি, যদি সামান্য কিছু বাড়তি মজুরির কথা বলে এদের রাজি করানো যায়।
দুই আঙুলে টুকি দিয়ে মেজকর্তা সিগারেটের টুকরোটা দূরে পাঠিয়ে বললেনজলধর, একটা সত্যি কথা বলবে?
-কী আঁইজ্ঞা?
–তুমি নিজে এইসব ভূত আর অপদেবতা বিশ্বাস করো?
জলধর একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল—দিনের বেলা করি না হুজুর। কিন্তু রাত্তিরে করি–
মেজকর্তা হাসলেন। বললেন—আচ্ছা, ঠিক আছে। যাও–
জলধর আবার কুলিদের কাছে ফিরে গেল। নির্মল কাঞ্জিলাল বললেন–কুলিরা নারাজ হলে খুব বিপদ হবে। জলধর একটা কথা ঠিকই বলেছে, একটা দল অরাজি হলে। অন্যদলকে বোঝানো মুশকিল হয়ে পড়বে। কী করবেন মেজকর্তা?
মেজকর্তা বললেন—দেখা যাক, উই উইল ক্রস দি ব্রিজ হোয়েন উই কাম টু ইট। আগেই দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই।
ডহরুও আদিবাসী, কিন্তু সে আশ্চর্যজনকভাবে নির্বিকার এবং ভাবলেশহীন। জাতভাইদের ভয় এবং উত্তেজনা তাকে স্পর্শ করেছে কিনা বোঝা যায় না। নিঃশব্দে সে। নিজের কাজ করে চলেছে। রাত্তিরে খাওয়ার সময় দেখি শালপাতার থালায় ঘি-মাখানো মোটা মোটা হাতে গড়া রুটি, ঘন অড়হরের ডাল, আলু কুমড়োর তরকারি আর আচার। সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে ডহরু। খাওয়া-দাওয়া সেরে তাবুতে ঢুকে বিছানা আশ্রয় করলাম। ঘুম আসবার আগে অবধি দেখলাম অসিতবাবু আধশোয়া হয়ে ডায়েরি। লিখছেন।
অনেক রাত্তিরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। কত রাত্তির বুঝতে পারলাম না। বালিশের তলায় হাতঘড়িটা আছে বটে, কিন্তু এই ঘন অন্ধকারে তা দেখে কত রাত বোঝা যাবে না।
অন্ধকারের মধ্যেই চোখ মেলে অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে রইলুম। কিছুতেই আর ঘুম এলো না। ওপাশে অসিতবাবু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তাঁর মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
মনের ভেতর কেমন একটা অস্বস্তি। তাঁবুর বাইরে কী যেন একটা ঘটছে। অরণ্যে কোনো নিশাচর পাখি বা কীটপতঙ্গের ডাক নেই, পত্রমর্মর নেই। একবার কি বাইরে গিয়ে দাঁড়াবো? দেখব মধ্যরাত্রে অরণ্য কেমন আছে?
অসিতবাবুকে না জাগিয়ে নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। না, সবই তো ঠিক আছে। আসলে পাসাং মারার গল্প শুনে ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়েছি। সেজন্যই ঘুম আসছে না।
শুক্লপক্ষের রাত বটে, কিন্তু আকাশে সম্ভবত হালকা মেঘ ছেয়ে আছে। অতি আবছা একটা আলোর আভাস বাদ দিলে চারদিক ছায়ায় ডুবে আছে।
তাঁবুর ভেতরে ঢুকতে যাবো, হঠাৎ কী মনে হওয়াতে আবার একবার চারদিকে তাকালাম। কোথায় যেন খুব অস্পষ্ট একটা শব্দ হচ্ছে না? ঠিক শব্দ বলা যায় না হয়ত, বরং বাতাসে ভেসে ওঠা শ্রবণসীমার প্রান্তে অবস্থিত একটা স্পন্দন বলা যেতে পারে। যেন শুকনো শালপাতা খসে পড়ছে মাটিতে। কে যেন কার কানে কানে ফিসফিস্ করে কী বলছে।
তারপরেই চোখ বড় বড় করে ভাল করে তাকালাম। এ কী! দিনের বেলায় দেখা দূরের পাহাড়গুলো যেন অনেকটা কাছে এগিয়ে এসেছে না? কিন্তু তাও কি হতে পারে? আলো-আঁধারিতে আমার চোখে ধাঁধা লেগেছে হয়ত। কিন্তু না, আলো যতই কম হোক, চোখ কি এতবড় ভুল করবে?
হঠাৎ মনে পড়ল জলধর পণ্ডার কথা। কুলিদের সর্দার তাকে বলেছিল এরপর পাহাড়ে পাহাড়ে কথা হবে, পাহাড়েরা চারদিক থেকে ঘিরে ধরে আমাদের পিষে মারবে। পাহাড়েরাই কি তাহলে ফিসফিস শব্দে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে? আমাদের ঘুমের অবসরে একটু একটু করে এগিয়ে এসেছে কাছে? কী কথা বলছে পাহাড়ের দল? নিজেদের অধিকারে মানুষের অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ তারা যে পছন্দ করেনি সেই কথা জানাচ্ছে পরস্পরকে? বিকেলে যখন কুলি সর্দারের কথা শুনেছিলাম তখন বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এখন–
অবাক হয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না, তাঁবুর ভেতরে ফিরে এসে বিছানায় শুলাম। পাশে রাখা হাতব্যাগটায় টর্চ ছিল, এবার সেটা বের করে জ্বালিয়ে ঘড়ি দেখলাম। রাত আড়াইটে। অসিতবাবু পূর্ববৎ নিদ্রাচ্ছন্ন। আমিও মন থেকে দুশ্চিন্তা দূর করে ঘুমোবার চেষ্টা করলাম। যা হবার সে কাল সকালে উঠে দেখা যাবে। খামোকা রাত জেগে শরীর খারাপ করে লাভ কী?
আগেই বলেছি, উদ্বেগ আর অশান্তির ঢাপ কমানোর জন্য মনের একটা নিজস্ব ব্যবস্থা আছে। বয়লারের চাপের সমতা বজার রাখার ভালভের মত, চাপ নিতান্ত অসহ্য হলে মন খানিকটা আশঙ্কা অদ্ভুতভাবে ভুলে যায়, উপেক্ষা করে। আমারও একটু বাদেই ঘুম পেতে লাগল। ঘুমিয়ে পড়বার ঠিক আগের তন্দ্রাবেশঘন মুহূর্তে মনে পড়ল ওই গোল। গোল পাতাগুলোর কথা আমি কোথায় শুনেছি। উনিশশো পনেরো সালের এক বর্ষামুখর রাত, হুগলী জেলার রামজয়পুর গ্রামে সরসী চাটুজ্জ্যের বাড়ির বৈঠকখানায় আষাঢ়ে গল্প জমে উঠেছে। রাম গাঙ্গুলি বলছেন তার মামাবাড়ির গ্রামে ঘটা এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার। কাহিনী। সেই গ্রামের প্রান্তে নির্জন জলাভূমির ভেতর দেখা বিশাল বনস্পতি, বড় বড় গোল তার পাতা। আগের দিন ওইখানে ছিল না গাছটা, পরের দিন গিয়েও দেখতে। পাননি রাম গাঙ্গুলি। কেবল ওই একদিন। আকাশে দেখা গিয়েছিল অদ্ভুত আলো। গল্পটা শুনে এসে তারানাথের বাবা আদিনাথ চক্রবর্তী বলেছিলেন তারানাথকে। কী যেন নাম বলেছিলেন গাছটার? হ্যাঁ, বুদ্ধ নারিকেল। কত-কতদিন আগের কথা। উনিশশো পনেরো সালে রাম গাঙ্গুলি বলেছিলেন, এটা চল্লিশ বছর আগের ঘটনা, মানে সেদিন থেকে প্রায় সত্তর বছর কেটে গিয়েছে। ডাইনিদের চাতর বসেছিল জলার ভেতরের সেই ডাঙায়। ডাইনিরা উড়িয়ে নিয়ে এসেছিল সেই গাছ। অন্তত রাম গাঙ্গুলির তেমন বিশ্বাস ছিল। আজ আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়া ভাল কথা নয়।
দূরে বোধহয় কোথাও মেঘ ডাকল। ঝড়বাদল হবে নাকি? আকাশে তো মেঘ দেখে এলাম। রাত্তিরেই বৃষ্টি নামলে মুশকিল হবে, কারণ লরিতে ফোল্ডিং খাট থাকলেও আজ আমরা আর সেগুলো নামাই নি, মোটা ত্রিপল মাটিতে পেতে তার ওপর বিছানা করেছি। সামান্য ঢালুর ওপর তাঁবু, বৃষ্টি নামলে পাহাড়ের ওপর থেকে জল বন্যার মত নেমে এসে। সব ভাসিয়ে দেবে।
এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে গেল। পুরোপুরি ঘুমোনোর আগে আর একবার শুনলাম মেঘের ডাক। দূরশ্রুত দামামার মত।
পরদিন সকালে উঠে দেখি সত্যিই আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তবে তক্ষুনি। বৃষ্টি নামবে বলে মনে হল না। আর পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি দূরে দূরে যেখানে ছিল তারা সব সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। সকালের আলো ফুটে ওঠায় রাত্তিরের বুকচাপা ভাবটাও কেটে গিয়েছে।
খোলা জায়গায় পাতা টেবিলে গিয়ে আমরা সকলে বসলাম। পাঁচমিনিটের মধ্যে ডহরু চা বানিয়ে এনে সামনে রাখল। কিন্তু লক্ষ্য করলাম মেজকর্তা, অসিতবাবু বা নির্মল কাঞ্জিলাল কারোই মন তেমন ভাল নেই। অন্যদিন সকালে চা খেতে খেতে একটু গল্পগুজব বা হাল্কা আজ্ঞা হয়, আজ যেন সবাই মুখ ভারি করে বসে আছে। কী হল এদের?
চায়ের মগ খালি করে টেবিলে নামিয়ে রেখে বললাম—কী ব্যাপার বলুন তো অসিতবাবু? আপনাদের মুখ এত গম্ভীর কেন?
অসিত বিশ্বাস আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন, তারপর একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন—আচ্ছা, বুদ্ধ নারিকেল কাকে বলে?
আমি চমকে উঠলাম, দেখলাম নির্মল কাঞ্জিলালও চমকে উঠলেন। মেজকর্তা নাবুঝতে পারার দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
বললাম-কেন, একথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন? এ নাম কোথায় পেলেন আপনি?
অসিতবাবু বললেন—কাল অনেক রাত্তিরে একটা আশ্চর্য স্বপ্ন দেখলাম। যেন একলা একলা দুপুরবেলা আপনার দেখানো ওই জায়গাটায় গিয়েছি—এবং কী অদ্ভুত! সেখানে সত্যিই বিরাট একটা গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে। আকাশছোঁয়া উঁচু, বড় আর গোল পাতা সে গাছের। নিচে একখানা বিশাল পাথর। স্বপ্নেই আপনার কথা ভাবলাম, আপনি তো বলেছিলেন এই গাছটার কথা। দু-তিনটে পাতাও পড়ে আছে নিচে। ঠিক যেমনটি দুপুরে দেখেছি। মনে মনে ভাবছি-কী গাছ এটা? স্বপ্নের মধ্যেই কে যেন বলল—এর নাম বুদ্ধ নারিকেল। সবকিছু এমন স্পষ্ট দেখলাম যে, মনে হচ্ছিল আমি যেন জেগে জেগে বাস্তবে ব্যাপারটা দেখছি। বুদ্ধ নারিকেল বলে সত্যিই কোনো গাছ হয় নাকি? স্বপ্নটা যে এমনিতে খুব ভয়ের কিছু তা নয়। কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকে অকারণেই মনটা খারাপ হয়ে রয়েছে। কেন দেখলাম এমন স্বপ্ন কে জানে!
বললাম–মনের কোন গহন ক্রিয়ায় ওই স্বপ্ন দেখেছেন তা বলতে পারব না, কিন্তু বুদ্ধ নারিকেল বলে গাছ সত্যিই আছে। আমি দেখিনি কখনো, তবে বর্ণনা শুনেছি। কীভাবে কোথায় শুনেছি তা বলব এখন। খারাপ লাগছে এই ভেবে যে, বুদ্ধি করে দুএকটা পাতা নিয়ে রেখে দিলে পরে রাঁচি কলেজের কোনো বট্যানির প্রফেসারকে দেখিয়ে নিশ্চিত হওয়া যেত।
অযাচিতভাবে একটা বুদ্ধির কাজ করে ফেললে মানুষের মুখে যেমন একটা গৌরবের উজ্জ্বলতা ফুটে ওঠে, তেমনি মুখ করে অসিতবাবু বললেন-আমি রেখেছি।
–বলেন কী! বাঃ, তাহলে তো দু-একদিনের ভেতর ব্যাপারটা যাচাই করে নেওয়া যায়–
অসিতবাবু বললেন–পাতাগুলো আমার ব্যাগে রেখে দিয়েছি। দাঁড়ান, দেখাই–
তিনি উঠে তাঁবুর দিকে চলে গেলেন।
মেজকর্তা আর সার্ভেয়ার নির্মলবাবুর চোখমুখ এখনো গম্ভীর। ওঁদেরও কিছু বলবার আছে নাকি? ব্যাপার যেমন দেখছি তাতে কিছুই অসম্ভব নয়।
অসিতবাবু ফিরে এলেন। তার মুখে আত্যন্তিক বিস্ময়ের ছাপ।
বললাম—কী হল? পাতাগুলো কই?
তিনি বললেন–তন্নতন্ন করে খুঁজলাম, কিন্তু পাতাগুলো ব্যাগে নেই!