১৬. আদালতের গড়িমসি চাল

আদালতের গড়িমসি চাল

আদালতের গড়িমসি নিয়ে বহু লোক ফরিয়াদ করেছে আর রোজ রোজ সেই নালিশ গুনতিতে বেড়েই চলেছে। ন্যায়বিচারের তলোয়ার এত ধীরে ধীরে নামে যে সন্দেহ হয় আদপেই সেটা নামবে তো নাকি কোপ পড়বে কোনও বেকসুরের উপর। আমি চাই পাঠকরা একবার পরদার পিছনে উঁকি মারুন, তা হলেই বুঝবেন কেন এত ইলজাম।

আমি খুশ-নাসিব যে আর্দালি হিসাবে আমার সুযোগ হয় বেশ কয়েকজন হাকিমের খিদমত খাটার। তাঁদের কাজের তারিকা আমি খুব খুঁটিয়ে নজর করি। এর থেকে আমার কিছুটা তালিমও হয়েছিল। একজন হাকিম চাইতেন, এর আগে যা কিছু হয়েছে সব উলটে দিতে। কারণ তাঁর মনে হত সেই কাজগুলো সবই বেকার। খোদ তাঁকে বাদ দিলে আর কেউ কোনও ঠিক কাজ করতে পারে না। ওয়াক্ত বরাবর কাজ করতে হবে এই রীতি-রেওয়াজ তাঁর না মঞ্জুর ছিল। উলটে তিনিই চশমা পরা সেরেস্তাদারকে সওয়াল করতেন, কিঁউ কোন আইন বা মুজিব (keon kon ayeen ba moojib)। তাঁর পরদাদার উমরের সেরেস্তাদার জবাব দিল হুজুর, জবিতা ইয়ে হ্যায়, খুদাবন্দ, সুদামত সে (zabitah yeh hyee, khodabund, shoodamt she) জবিতা বে দ-দ আইন দেখাও (zabitah be d-d ayeen dekhao) এইভাবে হুজুরের কাছে জমে থাকা মামলা আরও পিছিয়ে যেত। শুরু হত ইনডেক্স আর গাইড নিয়ে নাড়া ঘাঁটা। আহেলারা আবার এসবে তেমন দড় হত না। কারণ ইনডেক্স বা গাইডের কোনও তর্জমা নেই। দ্য কনসট্রাকশন অব রেগুলেশন যার উপর ভিত্তি করে দস্তুর-উল-উমুল (dustoor-ool-umul) খাড়া করা হয়েছে, হুজুরের মতে সে সব বাতিল করতে হবে কারণ সেগুলো নাকি আইনের বেবুনিয়াদ ধারা। সাহেবের এই খামখেয়ালি হালচালে চালু রেওয়াজটাই জট পাকিয়ে গিয়েছিল। পুরোটা আবার ঠিক হতে লেগেছিল পাক্কা তিরিশ বছর। আমি তো বলব যাঁরা কানুন বানিয়েছিলেন বেশক তাঁদের কিছু গাফিলতিও ছিল। কিন্তু তাঁদের সেই ভুল শুধরাতে যদি চল্লিশ বছর চলে যায় তা হলে সেটাও মেনে নেওয়া যায় না। বিশেষ করে হিন্দুস্তানের মানুষ যেখানে এত বেশি দস্তুর দিতে তৈরি। সিয়াসতের সব থেকে বড় গাফিলতি হচ্ছে মর্জি হলেই তার ফরমানদারেরা কানুন পালটে দিতে পারে। হর জেলায় কাজ হওয়ার কথা একই কানুনি তরিকায়। কিন্তু দেখবেন দুটো জেলার কাজে রকমফের হয়ে যাচ্ছে।

আরেক কিসমের হাকিম আছেন। এঁরা কেবল চশমার ফাঁক দিয়ে দেখেন আর আমলাদের কান দিয়ে শোনেন। কোনও আর্জি দাখিল হলেই তাঁদের একটাই জবাব, নিজের থেকে কোনও তজবিজ করবে না, তা হলেই নাকি মামলা বিগড়ে যাবে। এই ফরমানদারদের ওয়াস্তে একটাই জবাব, জাবিতা ইয়ে হ্যায়। হাকিমের এইরকম মেজাজ মর্জি হলে যে কোনও মামলাই বরবাদ। কোথায় নিজের বিচার বুদ্ধিমাফিক চলবেন তার বদলে তাঁরা চলেন কর্মচারীদের কথামতো। এক একটা সময় আসে যখন তাঁদের এই হাবভাব আর বরদাস্ত করা যায় না আর বাকি সময় তো তাঁরা কোনও কাজ করতে নারাজ। কোথায় কবে শোনা গেছে ফরমানদারের মর্জিমাফিক ঠিক হয় কোনও কাজ— ভাল না খারাপ। কর্মচারীদের উপর নজরদারি থাকবে কী থাকবে না সেটাও তাদের খেয়ালখুশি। কোনও কোনও জেলায় নজরদারি এত জবরদস্ত যে সিয়াসতেরই লোকসান। আবার কোনও জেলায় কাজটা এমন ঢিলেঢালা যে কর্মচারীরাই সেখানে বকলমে ফরমানদার।

কাজ ঠিকঠাক না হওয়ার আর একটা কারণ, আহেলা কর্মচারীরা কে কোন দপ্তরে কতদিন বহাল থাকবে সেটা তাদের না বলা। তা সে কর্মচারী সেরেস্তাদার হোক কিংবা কোতোয়াল, থানেদার বা মামুলি কোনও আর্দালি, হাল সবারই এক। যে হয়তো এতদিন আম আদমির দেখভালের কাজে জুড়ে ছিল তাকেই এক কথায় বরখাস্ত করা হল, কারণ কাজে গাফিলতি কিংবা হুজুরের তাকে নাপসন্দ। তখন কে শুনতে যাবে তার কথা বা আর্জি? আসলে সেই হচ্ছে সব থেকে বড় বেয়াকুব যে চায় কাজ করে সমাজের উপকারে আসতে। বেশির ভাগ কর্মচারীর তাই একটাই জবান, যতদিন জিন্দা আছি ততদিন মস্ত থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাব। দেখা যাবে পঞ্চাশজন কর্মচারীর ভিতর ঊনপঞ্চাশ জনই রেওয়াজ করে ফেলেছে যে তারা কোনও দস্তুরি ছাড়া কাজ করবে না। হাকিম যতই নজরদারি চালান এই রেওয়াজ খতম হওয়ার নয়। কে কোন দপ্তরে কতদিন কাজ করবে তারই তো কোনও হদিশ নেই। ফৌজদারি-দেওয়ানি আর মাশুল দপ্তরে হরদিন কেমন করে এই কামাই হয় তারই কিছু কিছু নমুনা আমি আপনাদের সামনে পেশ করব। জজ সাহেব আর হাইমান আলিশানদের একটা দায়িত্বই হল এইসব বজ্জাতি খতম করা। কিন্তু আমার মতো একটা মামুলি আর্দালিরও নজরে পড়েছে রোজকার এই বেয়াদবি।

একবার আমার মালিক নাজির সাহেবকে বলতে শুনেছিলাম, মাশুল দপ্তরের কোনও কর্মচারী যদি মাসে দশ রুপিয়া বেশি রোজগার করে তা হলে তাকে বরখাস্ত করা হবে। তাঁকে সেই কাজটা করার জন্য একটা দরখাস্ত জমা দিতে হবে জনাব আলিজা সাহেব কমিশনার বাহাদুরকে। কোর্ট অব ডিরেক্টরদের তো সরাসরি হুকুমই ছিল, কোনও বেবুনিয়াদ বা খুচরো ওজুহাতে পুলিশের থানেদারকে বরখাস্ত করা যাবে না। নাজিরই মনে হয় বলেছিলেন, কোনও থানেদারকে বরখাস্ত করতে হলে আগে পুলিশ কমিশনারকে সেই বরখাস্তের বয়ান দাখিল করতে হয়। আমি তাঁকে সওয়াল করলাম, এটাই যদি রেওয়াজ হবে তা হলে আপনার শালাবাবু আর লাল্লুপুতু খানকে কেমন করে বরখাস্ত করা হয়? তাদের খিলাফ তো একটাই নালিশ ছিল যে তারা ম্যাজিস্ট্রেট হুজুরের না-পসন্দ। নাজির সাহেব জবাব দিয়েছিলেন, মুঝে নেহি মালুম। যারা বরখাস্ত হল তারা পুলিশ কমিশনারকে আর্জি জানিয়ে ছিল, কোনও সুরাহা হয়নি। এবার জব্বর খান জানতে চাইল, মির বেশহর খানকে কী বলে থানেদার করা হল? সবাই জানত ও এক পাক্কা আফিমখোর আর মহা বেতমিজ। তা হলে কি ধরে নেওয়া হবে কোথাও একটা গাফিলতি আছে? নাজির দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর ধীরে ধীরে মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে জবাব দিলেন, আল্লা করিম তু হি জানতে হো! (Ullah kureem tooee jante ho!)

মফস্‌সল থানার দারোগা আর বরকন্দাজদের একটাই ফন্দি আঁটতে দেখা যেত, কী করে যে কোনও মামলায় ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুম ঠেকিয়ে রাখা যাবে। মামুলি কোনও মামলা হলে শুরুতেই নেওয়া হত ফরিয়াদির বয়ান তারপর জারি করা হত সাক্ষীদের হাজির হওয়ার জন্য সপিনা। আসামি চাইলে সাক্ষীদের দিতে পারত ঘুষ বা পারত তাদের গায়েব করে দিতে। নাজির তখন পালটা কৈফিয়ত দাখিল করত, সাক্ষী রুপোশ (Rooposh)। থানেদারের কাছে হুকুম যেত, এদের কাছারিতে হাজির করো। হুকুম শোনামাত্র থানেদারের কাজ ছিল সেই তরফকে হুঁশিয়ার করে দেওয়া। পরোয়ানা জারি হয়েছে তাদের খুঁজে আনার জন্য। অভিযুক্ত বা সাক্ষীরা সহজেই ঘুষ কবুল করলে পরোয়ানাটা চেপে রাখা হত এক-দুই সপ্তাহ। তারপর ম্যাজিস্ট্রেট হুজুরকে জানান হত সাক্ষীরা বে-পাত্তা আর তারা যদি কিছু ঠেকাতে ইনকার করত তখন পালটে যেত গপ্পো। আম-আদমির সামনে বেইজ্জত করে টেনে হিঁচড়ে তাদের হাজির করা হত হুজুরের দরবারে। কোনও কায়দায় অভিযুক্ত যদি সাক্ষীদের হাজিরা ঠেকিয়ে দিতে পারত তা হলেই কেল্লা ফতে। তখন মামলা হয়ে দাঁড়াবে খুবই মামুলি। হয় সঙ্গে সঙ্গে ফয়সালা না হলে বড় জোর এক-দু’মাস। কখনও যদি ম্যাজিস্ট্রেট হুজুর হুকুম করেন, সাক্ষীদের সম্পত্তি জব্দ করো তা হলেও সেই একই তামাশা। হয়তো কিছুই করা হবে না বা সম্পত্তি জব্দ হলেও তা আইন মোতাবেক ছয়-সাত মাস না কাটলে নিলামে চড়বে না। আমি তো কোনও ক্রোক করা সম্পত্তি নিলাম হচ্ছে বলে শুনিনি।

কোনও একটা দাঙ্গায় দুই তরফের আদমিরাই গ্রেফতার হল। তারা নিজেদের সাফাই দিতে কবুল করল সাক্ষীর নাম। আলবাত তাদের তলব করা হবে। এবার একটু ঘুরিয়ে তাদের জেরা করুন, তারাও কি ওই দাঙ্গায় জড়িয়ে ছিল? আসলে এই সব মামলায় কিছু খুঁজে পাওয়াটা খুব মুশকিল। দিনের পর দিন চলতে থাকবে মামলা। একজন-দু’জন করে খসে প়ড়বে সাক্ষী কেউ আবার উলটো সাফাই দেবে। হয়তো বলবে আসামিকে দিন কুড়ি আগে সে হাল চালাতে দেখেছে, তাই কেমন করে সে দাঙ্গা করবে? তাকে যখন সওয়াল করা হবে ঠিক কোন দিনটার কথা সে বলছে, জবাব মিলবে, সেটা তার জানা নেই। তা হলে দাঙ্গার সময় সে কী করছিল? সেই একই জবাব, আমি তো তখন হাজির ছিলাম না; আর কোনও দাঙ্গা-ফ্যাসাদ হয়েছে সেটাই তার অজানা। বেকার এই সওয়াল-জবাব। মামলা হপ্তার পর হপ্তা গড়িয়ে চলে। ম্যাজিস্ট্রেট চাইলেও জলদি কোনও ফয়সালা হওয়ার নয়। তেমন কিছু করলে আপিলের সামনে তাঁর সেই হুকুম পালটে যাবে।

১. সিয়াসত: সাম্রাজ্য

১. সপিনা: সমন, বিচারালয়ে হাজির হওয়ার আদেশ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *