১৬. আজ যদি কেউ আমাকে প্রশ্ন করে

আজ যদি কেউ আমাকে প্রশ্ন করে, শাজাহানের কোন ঐশ্বর্যে আমি সবচেয়ে লাভবান হয়েছি, তা হলে কোনো দ্বিধা না করেই বলব-কর্মীদের ভালোবাসা। একই কর্মক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা নিজেরই অজ্ঞাতে কেমন করে সৃষ্টি হয় বলা শক্ত। কিন্তু হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করা যায়, অনেকগুলো প্রাণ কখন একই সূত্রে গাঁধা হয়ে গিয়েছে।

সেই কারণেই বোধহয় আমি ভুলে গিয়েছিলাম, প্রথম জীবনে রোজি আমার বহু যন্ত্রণার কারণ হয়েছিল। ভুলে গিয়েছি, উইলিয়ম ঘোষ, গুড়বেড়িয়া, ন্যাটাহারিবাবুর সঙ্গে সামান্য কিছুদিন আগেও আমার পরিচয় ছিল না। অথচ আজ তাদের সম্বন্ধে আমি কত জানি।

ন্যাটাহারিবাবু বলেছিলেন, এ শর্মা হাতের গোড়ায় থাকতে কেন অযথা নিজের বুদ্ধির পাম্পটাকে খাটিয়ে মারেন? অধমকে একবার তু করে ডাক দেবেন! ব্যাপারটা কী জানেন, এটা যেবের মতন। মনে করুন আপনার কোনো বন্ধুকে পনেরো বছর ধরে জানেন; সে-ই তার এক জানাশুনোনা মেয়ের সঙ্গে আপনার বে-র সম্বন্ধ করলে। বে-র কদিন পরে দেখা যাবে, আপনার ওয়াইফ আপনার সম্বন্ধে বন্ধুর থেকে অনেক বেশি জেনে গিয়েছে। চাকরিটাও তো ‘বে’র মতন, আসলে বিবাহের চেয়ে বড় বলতে পারেন।

নাট্যহারিবাবুকে আমি ঘাটাইনি। কিন্তু তিনি ছাড়লেন না। আমাকে কাছে ডেকে ফিস্ ফিস করে বললেন, ব্যাপার কী মশাই? স্যাটা বোস দেখলাম ম্যানেজারের কাছে কিছুক্ষণের জন্যে ছুটি চাইছে। যে লোকটা এই বারো বছরের মধ্যে কখনও বাইরে যায় না, তার আজ হল কী? গতিক সুবিধে মনে হচ্ছে না। আমার ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় অভ্যেস নেই, সোজা বলে দিলাম।

ন্যাটাহারিবাবুকে বাধা দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তিনি তার আগেই বললেন, একটা জিনিস জেনে রাখবেন—ধোঁয়া, টাকা আর প্রেম কিছুতেই চেপে রাখা যায় না। ঠিক ফুটে বেরোবেই।

আমাকে প্রতিবাদের কোনো সুযোগ না দিয়ে তিনি হোটেলের কাজে অন্য ঘরে চলে গেলেন। আর আমার মনে হল, সত্যসুন্দরদা সত্যিই যেন আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছেন।

 

সত্যসুন্দরদা, এতদিন পরে, আজ আর স্বীকার করতে লজ্জা নেই, সেদিন সত্যিই সুজাতাদির উপর আমার হিংসে হয়েছিল। শাজাহানের প্রাচীন পন্থশালার এক অপরিচিত যুবককে আপনি উজাড় করে ভালোবাসা দিয়েছেন, তবুও যেন তার মন ভরেনি। সে আরও চেয়েছিল।

শাজাহানের সেই সন্ধ্যার কথা মনে আছে আপনার? ছাদের উপর একটা ইজিচেয়ার নিয়ে আপনি বসেছিলেন; একে একে আকাশে তারার দ্বীপগুলো জ্বলে উঠছিল। সেদিন আপনাকে যেন অন্যভাবে দেখেছিলাম। শাজাহানের কাউন্টারে যে একদিন আমাকে প্রথম অভ্যর্থনা করেছিল, সুখে দুঃখে যার আশ্রয়ে এতদিন আমি লালিত-পালিত হয়েছি, এ যেন সেই স্যাটা বোস নয়।

সত্যসুন্দরদা, আপনি যখন আমাকে অমনভাবে পাশে বসতে বলেছিলেন, তখন আরও ভয় পেয়েছিলাম। আপনি যেন কেমন শান্ত হয়ে পড়েছিলেন। জলভারে নম্র মেঘের মতো আপনার গতি যেন শ্লথ হয়ে পড়েছিল। আপনার মনের গাড়ি তখন যেন ইঞ্জিন বন্ধ করে কোনো ঢালু পথ দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছিল। আমি কোনো কথা না বলে, আপনার পাশে একটা মোড়ায় অনেকক্ষণ বলেছিলাম। আপনি হয়তো ভেবেছিলেন, আমি কিছুই জানিনা; অথচ আমাকে সত্যিই আপনি ভালোবাসতেন, আমাকে না জানিয়ে কিছুই করতে ইচ্ছে করছিল আপনার। |||||

||||| আপনি বলেছিলেন, তোমার সম্বন্ধে মিস্ মিত্রের খুব ভালো ধারণা। মিস্ মিত্র বলছিলেন, তোমার মুখের মধ্যে ছোটছেলের সারল্যের ছবি আছে।

আমি লজ্জা পেয়ে একটু হাসলাম। আপনি বললেন, ভদ্রমহিলাও খুব সরল। হোটেলে চাকরি করতে এসে এয়ার হোস্টেস তো কম দেখলাম না। কিন্তু এমন লাজুক স্বভাবের মেয়ে কেমন করে যে মধ্যগগনে যাত্রীদের মনোরঞ্জন করেন, জানি না।

আমি বলেছিলাম,এক একজনের স্বভাবেই এই স্নিগ্ধ সরলতা থাকে। ইচ্ছে করলেও কাটিয়ে ওঠা যায় না।

আপনার মনে বোধহয় কথাটা লেগেছিল। সুজাতাদিকে আপনি নিজের অজ্ঞাতেই কখন যেন শ্রদ্ধা করতে আরম্ভ করেছিলেন। প্রকৃত প্রেমের ভিত্তিভূমিই এই শ্রদ্ধা। আপনি বলেছিলেন, আজ বেশ বোকা বনে গেলাম। ভদ্রমহিলা যে অমনভবে প্রশ্ন করবেন, বুঝিনি। আমার উপর রেগে গিয়েই বললেন, এই হোটেলের বাইরেও যে একটা জীবন আছে, তা জানেন কী?

আমি বললাম, নিশ্চয়ই। সেখান থেকেই তো আমাদের কাস্টমাররা আসে, আবার সেখানেই তারা ফিরে যায়।

ভদ্রমহিলা তখন কী বললেন জানো? এমনভাবে জীবনটা নষ্ট করছেন কেন? এই হোটেলের ভূতটা আপনাদের ঘাড়ে পুরোপুরি চেপে বসেছে। আপনাদের পাল্লায় পড়ে ওই ছেলেটিরও ইহকাল পরকাল ঝরঝরে হয়ে যাচ্ছে।

আপনি উত্তর দেননি? আমি প্রশ্ন করেছিলাম।

আপনি বলেছিলেন, ভেবেছিলাম উত্তর দেব। কিন্তু পারলাম না। ভদ্রমহিলার সাহস যে এত বেড়ে যাবে ভাবিনি।

স্যাটা বোস উত্তর দিতে পারেননি শুনে সত্যই আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এমন যে হতে পারে তা যেন আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। অনেকদিন পরে সেদিন ভিক্টর হুগো পড়তে আমার বিস্ময়ের উত্তর পেয়েছিলাম : The first symptom of love in a young man is timidity;in a girl it is boldness. The two sexes have a tendency to approach and each assumes the qualities of the others.

মনে আছে সত্যসুন্দরদা বলেছিলেন, আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু আকাশের এই তারার ভার দিকে তাকিয়ে এখন সত্যিই মনে হচ্ছে, শাজাহানের বন্দিশালায় স্বেচ্ছা-নির্বাসনে আমরা পৃথিবীর অনেক আনন্দ এবং আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।

ঘড়ির দিকে তাকালেন বোসদা।বললেন, বলা যায় না, সুজাতা মিত্র এখানে এসে হাজির হতে পারেন।

ভালোই তো, তাহলে একহাত ঝগড়া করে নেওয়া যায়, আমি বললাম।

একটা সিগারেট ধরিয়ে বোসদা বললেন, আজ আবার নাইট ডিউটি।কিন্তু কাজে যেতে ইচ্ছা করছে না।

বললাম, আমি থাকতে যাবার দরকার তো নেই।

বোসদা বললেন, গত জন্মে নিশ্চয় বহুদিন মা-বাপকে অনেক রাত পর্যন্ত জাগিয়ে রেখেছিলাম, তাই এ-জন্মে ফলভোগ করছি। আবার তোমাকে জাগিয়ে, পরের জন্মের হিসেব খারাপ করে দিই আর কী!

বললাম, পরোপকার তো হবে। এখন আপনাকে সার্ভিস দিলে সামনের জন্মে এই শ্রীমান সারারাত ভোস ভোস করে নাক ডেকে ঘুমোতে পারবে।

বোসদা আমার কথা কানে তুললেন না। আস্তে আস্তে বললেন, এতদিন নিজের মনে হোটেলের মধ্যে ড়ুবে ছিলাম। আমার যে বাইরের একটা অস্তিত্ব আছে, একদিন আমিও যে বাইরে থেকে এখানে এসেছিলাম, তা ভুলেই গিয়েছিলাম।

 

আসতে পারি? ছাদের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে সুজাতা মিত্র প্রশ্ন করলেন। নিশ্চয়ই। এই বাড়ির ছাদ কিছু আমাদের রিজার্ভ সম্পত্তি নয়। বোসদা বললেন।

সিল্কের শাড়িটাকে দুরন্ত হাওয়ার হাত থেকে সামলাতে সামলাতে সুজাতা মিত্র আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি উঠে পড়ে নিজের জায়গা ছেড়ে দিলাম। ঘরের ভিতর চলে যাব ভাবছিলাম।

কিন্তু বোসদা বললেন, আমার ঘর থেকে মোড়াটা নিয়ে এসে বসো, আচ্ছা দেওয়া যাক।

সুজাতা মিত্র এবার দংশন করলেন : আপনার সঙ্গে আড্ডা! এখনি লাঞ্চ, ডিনার, ব্রেকফাস্ট আমদানি করে বসবেন।

কথার মধ্যে যা-ই আনি, আপাতত কি অসময়ে একটু চা আনাতে পারি? বোসদা এবার জিজ্ঞাসা করলেন।

সুজাতা মিত্র ছাড়লেন না। বললেন, হোটেলের স্টাফগুলো অনেক সুবিধে ভোগ করে। দেখলে হিংসে হয়। গেস্টরা খেতে পাক না পাক, এরা সব সময় সব জিনিস পায়! পেটুক লোকেরা সেই জন্যেই তো হোটেলের কর্মচারীদের হিংসে করে।

বোসদা হেসে বললেন, সব ছোট ছেলেই তো ওই জন্যে ভাবে বড় হয়ে সে চকোলেটের কারখানার কাজ করবে।

সুজাতা মিত্র এবার গম্ভীর হয়ে উঠলেন।যেমন আমি চেয়েছিলাম হাওয়াই জাহাজের চাকরি!

আমি ও বোসদা সুজাতা মিত্রের ছেলেমানুষীভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সুজাতা মিত্র বললেন, আমি তখন ইস্কুলে পড়ি। বোম্বাইতে থাকতাম। ট্রেনের রিজার্ভেশন না পেয়ে বাবা বোম্বাই থেকে প্লেনে কলকাতা আসবার ঠিক করলেন। আর সেই হল আমার কাল।

আমি বললাম, কেন?

শাড়ির আঁচলটা হাওয়ার অশোভন কৌতূহল থেকে সামলিয়ে সুজাতা মিত্র বললেন,প্লেনেউঠেই আমার জীবনের সব ধারা যেন অন্য খাতে বইতে আরম্ভ করল। সারাক্ষণ আমি পাইলটের ককপিটের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ক্যাপটেন লোকটি ভালো ছিলেন, মজা পেয়ে আমাকে আদর করে, ধৈর্য ধরে সব দেখালেন, গল্প করলেন।

বোসদা এবার ফোড়ন দিলেন,সেটা ক্যাপটেন তেমন উদার কিছু করেননি। এমন আকর্ষণীয় মহিলা পেলে, আমিও প্লেন চালানো অবহেলা করে, তার সঙ্গসুখ উপভোগ করতাম।

সুজাতা মিত্র রেগে গেলেন।অমন করলে গল্প বলব না। শুনছেন একটা ইস্কুলে পড়া বারো বছরের মেয়ে প্লেনে চড়েছে।

এর উত্তর বিদ্যাপতির থেকে কোটেশনে দিতে হয়। কিন্তু ভদ্রলোক সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী মহিলাদের সম্বন্ধে এত অপ্রীতিকর উক্তি করেছেন যে, চেপে যাওয়াই ভালো।

সুজাতা মিত্র বললেন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ হলেও হয়তো অত আনন্দ হত না। আমার অটোগ্রাফের খাতায় যখন ক্যাপটেন সই করে দিলেন, তখন মনে হল হাতের মুঠোর মধ্যে স্বর্গ পেয়েছি।

আমি বললাম, বাবা, আমি পাইলট হব।আমার কথার ওপর কথা বলবার মতো সাহস আমার বাবার ছিল না। অফিসে তার দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল, কিন্তু আমার কথার অবাধ্য হতেন না তিনি। বলতেন, তুমি আমার ছেলে এবং মেয়ে দুই-ই।

সুজাতা মিত্র এতদিনে আবার যেন অতীতের নীল দিঘিতে অবগাহনের সুযোগ পেয়েছেন। মধুর স্মৃতির অতলে ড়ুব দিয়ে সুজাতা মিত্র বললেন, শেষ পর্যন্ত অঙ্ক জিনিসটাই আমার কাল হল। মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও বাবা বলেছিলেন, তুমি মন দিয়ে লেখাপড়া করো, তারপর যে যাই বলুক, তোমাকে পাইলট করব।

কিন্তু ওই অঙ্ক জিনিসটা। পৃথিবীতে ভালো কিছু হতে গেলেই, প্রথমে আপনাকে প্রশ্ন করবে—অঙ্ক জানো? ইঞ্জিনিয়ার হতে চাও, বলবে অঙ্ক জানো? রোগের চিকিৎসার জন্যে ডাক্তার হতে চাও, তখনও অঙ্ক চাইবে। যা দিনকাল পড়েছে, তাতে ছবি আঁকা শেখার জন্যেও আর্ট স্কুলের প্রিন্সিপাল অঙ্কের নম্বর দেখতে চাইবে।

সুজাতা মিত্র বললেন,বাংলার প্রথম মহিলা পাইলট হওয়ার দুর্লভ সৌভাগ্য একটুর জন্যে হাতছাড়া হয়ে গেল। কিন্তু নাকের বদলে নরুন পেলাম। আমি বলেছিলাম, আমি কিছুতেই ছাড়বনা। আকাশে আমাকে উড়তে হবে।ককপিটে বসে বন্ধু তারাদের নিশানা করে মহাশূন্যে আমি সাঁতার কাটব। মা, বাবা, তোমাদের কিন্তু টিকিট লাগবে না। তোমরা নিজেদের সিটে বসে থাকবে, মাঝে মাঝে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করবে। মা বলেছিলেন, এতই যখন তোর ওড়ার নেশা, তখন কোনো পাইলটের সঙ্গে তোর বিয়ে দেবখন।

অন্যায় কিছু বলেননি তিনি, বোসদা বললেন।আপনার ঘর ঝাঁট দেবার জন্যে একটা বিনা মাইনের শিক্ষিত পাইলট চাকর পেতেন!

সুজাতা মিত্র রাগ করলেন।এমন ঝগড়াটে স্বভাব নিয়ে কী করে যে আপনি হোটেলে রিসেপশনিস্টের কাজ করেন।

জিজ্ঞাসা করুন এই শ্রীমানকে। ভূ-ভারতে সত্যসুন্দর বোসের মতো আর একটি রিসেপশনিস্টের জন্ম হয়েছে কিনা? বিলেতে জন্মালে এতদিনেক্লারিজের ম্যানেজার হতাম। আমেরিকায় জন্মালে ওয়াল্ডর্ফ এস্টোরিয়া হোটেলের বর্তমান ম্যানেজার বেচারার কী যে হত! কী হে শ্রীমান, আমার সাপোর্টে কিছু বলো।

আমি মনস্থির করতে পারছিলাম না। কিন্তু তার আগেই সুজাতা মিত্র অবলীলাক্রমে আমাকেও আক্রমণ করলেন—ভালো লোককে দলে টানছেন—শুড়ির সাক্ষী মাতাল!

এবার নিজেই হাসতে আরম্ভ করলেন সুজাতা।আমাকে বললেন, তুমি কিছু মনে করো না, ভাই। তোমাকে কিছু মিন করিনি।

আমি ইতিমধ্যে স্থির করে ফেলেছি, বোসদারই দোষ। বললাম, আপনারই দোষ। কথার মধ্যে আপনি কথা বলেন কেন?

বোসদা হতাশ হয়ে যেন মাথায় হাত দিয়ে বসলেন।দাউ টু টাস! একজন এয়ার হোস্টেসের সামান্য মিষ্টিকথায় ভিজে গিয়ে তুমি এতদিনের বিশ্বস্ত বন্ধুকে ডোবালে? অথচ তুমি বুঝলে না, হাওয়াই হোস্টেসরা আমাদেরই মতো জোর করে ট্যাবলেট খেয়ে হাসেন। হাসাই ওঁদের চাকরি অঙ্গ। যেমন পেটের যন্ত্রণায় পাগল হয়ে গেলেও হোটেলের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আমাদের দন্তকৌমুদী বিকশিত করতে হয়।

আমি বললাম, সুতরাং রিসেপশনিস্ট এবং এয়ার হোস্টেসেকাটাকাটি হয়ে গেল। যাকে বলে কিনা কাঠে কাঠে।

বোসদা মৃদু হাস্যে বললেন, কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছ, আমি যদি শুড়ি হই, তাহলে তুমি মাতাল। হোটেলে চাকরি করি, মদের লাইসেন্স আছে, সুতরাং শুড়ি তো বটেই। অথচ বেচারা তোমার স্টেনলেস স্টিলের মতো শুভ্র চরিত্রে এই মুখরা মহিলা অযথা কলঙ্ক লেপন করলেন।

আমরা সবাই এবার এক সঙ্গে শাজাহানের ছাদের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে হো হো হেসে উঠলাম। সুজাতার মিত্র বললেন,ক্যাপটেনের প্রতাপ কী সে আমরা জানি; আপনারা যেমন ম্যানেজার নামক বস্তুটিকে বোঝেন। কিন্তু তাতে আর হল কী-হতে চেয়েছিলাম ডাক্তার, হলাম নার্স-পাইলটের বদলে হাওয়াই হোস্টেস।

বোসদা গম্ভীর হয়ে বললেন, আমার এক মামা পুলিস সুপারিন্টেন্ডেন্ট হতে চেয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত অফিস সুপারিন্টেন্ডেন্ট হয়েছেন।

সুজাতা মিত্র বললেন, ব্যঙ্গ করছেন, কিন্তু কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে…।

আমরা আবার অট্টহাস্যে ভেঙে পড়তে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই কে যেন ছাদের আলোগুলো হঠাৎ জ্বালিয়ে দিল। মনে হল গুড়বেড়িয়া যেন হন্তদন্ত হয়ে আমাদের দিকেই ছুটে আসছে।

কে, গুড়বেড়িয়া? অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বোসদা বললেন।

হ্যাঁ হুজুর, আমাদের দিকে মাথা নত করে গুড়বেড়িয়া বললে। জানলাম মার্কোপোলো ডিনারের পরে আমাকে দেখা করতে বলেছেন।

আমি বললাম, ঠিক আছে।

গুড়বেড়িয়ায় এবার চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে তখনও মূর্তিমান গদ্যের মতো আমাদের কাব্যজগতে দাঁড়িয়ে রইল। মুখ তুলে গুড়বেড়িয়াকে বললাম, কী বাপার? গুড়বেড়িয়া আমতা আমতা করতে লাগল। সুজাতা মিত্র বোধহয় ব্যাপারটা বুঝলেন। বললেন, আচ্ছা, আমি তাহলে উঠি, আপনারা কথা বলুন।

আমি বাধা দিলাম আর বোসদা বললেন, শ্রীমান গুড়বেড়িয়া, পৃথিবীর গোপনীয়তম খবরও তুমি এই ত্রিমূর্তির কাছে দিতে পারো। দিদিমণি হাওয়াই জাহাজে আকাশের উপর উড়ে গিয়ে কত খবর নিয়ে আসেন। সে সব গোপন থাকে।

গুড়বেড়িয়া এবার সাহস পেয়ে জানালে, আমি যখন মার্কো সায়েবের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, তখন ইচ্ছে করলেই তার বিশেষ উপকার করতে পারি। এবং সেই বিশেষ উপকারের জন্যে শুধু সে নয়, আরও একজন-শাজাহানের হেড বেয়ারা পরবাসীয়া—আমাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। নীরব সাধনা এবং সুগভীর ধৈর্যে অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। পরবাসীয়ার মন গলেছে—তার কনিষ্ঠা কন্যার পাণিগ্রহণের জন্য তিনি শ্রীমান গুড়বেড়িয়াকে যোগ্য বলে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু ভাবী জামাতার ছুটি ও উন্নতির তদ্বিরের জন্য তার পক্ষে উচ্চতম কর্তৃপক্ষের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া পরবাসীয়া তার সুন্দরী, গৃহকর্মনিপুণা, গুণবতী কন্যার পাণিপ্রার্থী যুবকটির কৌশল এবং বুদ্ধিপ্রয়োগের ক্ষমতা পরীক্ষা করতে চান। বিবাহবিলাসী যুবক গুড়বেড়িয়া দুরুদুরু বক্ষে সুদুর উড়িষ্যার কোনো পল্লি থেকে সেই আদি অকৃত্রিম টেলিগ্রাম—মাদার সিরিয়াস, কাম হোম—পাঠাবার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু ভাবী শ্বশুর সম্মতি দিতে পারেননি। কারণ বিবাহহাৎসবে তারও উপস্থিতি প্রয়োজন এবং টেলিগ্রাম-পদ্ধতিতে ছুটি তিনি নিজেই নেবেন। একই উপায়ে শ্বশুর-জামাই-এ ছুটি নেওয়া এই শত্ৰুপরিবৃত পুরীতে বিশেষ বিপজ্জনক।

অপরিচিতা মহিলার সামনে বিবাহঘটিত আলোচনায় বিব্রত গুড়বেড়িয়া এবার দ্রুত পদক্ষেপে প্রস্থান করলে; বোসদা সানন্দে বললেন, ছাদের অধিবাসীদের আজ স্মরণীয় দিন। হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর, হবে জয়! তরুণ গুড়বেরিয়ার প্রাচীন স্বপ্ন সম্ভব হয়েছে।

সুজাতা মিত্র বললেন, আহা বেচারা।

বোসদা বললেন, ম্যানেজারকে বলে ওর ছুটি করিয়ে দিও। লোক কম আছে।সামনে আবার মিসেস পাকড়াশীর ব্যাংকোয়েট। কিন্তু তুমি বলো, দরকার হয় ছাদে আমরা দিন দশেক নিজেরাই সব করে নেব-বেয়ারা লাগবে না।

সুজাতা মিত্র বললেন, আপনারা দেখছি গুড়বেড়িয়ার গুণগ্রাহী।

বোসদা হেসে বললেন, অল দি ওয়ার্লড লাভ দি লাভার। গুড়বেড়িয়া বলেছিল—ওই মেয়ে ছাড়া বিয়ে করবে না।

বোসদা উৎসাহে এবার গুড়বেড়িয়াকে চিৎকার করে ডাকলেন। গুড়বেড়িয়া লিফটের কাছে একটা টুলে বসে ছিল। সায়েব ডাকতেই একটু চিন্তিত হয়ে আবার এসে সেলাম করল। বোসদা বললেন, তুমি বিয়ের বাজার করতে আরম্ভ করো। ছুটি পাবেই।

কৃতজ্ঞ গুড়বেড়িয়া আবার নমস্কার করল। তোমার বিশেষ কিছু ইচ্ছে করলে, জানাতে লজ্জা কোরো না। বোসদার এই আশ্বাসবাণীতে সাহস পেয়ে গুড়বেড়িয়া তার বহুদিনের একটি গোপন ইচ্ছা প্রকাশ করল। বিবাহ উপলক্ষে রঙিন রাঙতায় মোড়া একটা শাজাহান কেক সে নিয়ে যেতে চায়। প্রয়োজন হলে এক টাকা পর্যন্ত খরচ করতেও রাজি আছে।

বোসদা বললেন, জরুর। জুনোকে বলে তিন পাউন্ডের স্পেশাল ওয়েডিং কেক করিয়ে দেব। তাতে তোমার নাম লেখা থাকবে।

সৌভাগ্যসূর্যের এমন অভাবনীয় উদয়ে বিস্মিত গুড়বেড়িয়া বাকশক্তিরহিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বোসদা বললেন, বিয়ের পর বউমাকে কলকাতায় আনছ তো?

না, হুজুর। এখানে খরচ কত।

বোসদা বললেন, আমি তোমার ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। মমতাজে ডিউটি পড়লে রোজ বেশ কিছু টিপস পাবে।

গুড়বেড়িয়া চলে গেল। সুজাতা মিত্র বললে, এই একটি জিনিস-Tips!

বোসদা বললেন, আগে তাড়াতাড়ি সার্ভিসের জন্যে লোকে পয়সা দিত-To insure promptitude। আর এখন ইজ্জত রাখার জন্যে-To insure prestige। আর To insure peace, বেয়ারাদের মধ্যে টিপসের ভাগাভাগি খেয়োখেয়ি এড়াবার জন্যে, অনেক হোটেলে শতকরা দশ বা পনেরো ভাগ সার্ভিস চার্জ বসিয়ে বকশিস বন্ধ করে দিচ্ছে। আমাদের এখানেও মার্কোর ওই ব্যবস্থা চালু করার ইচ্ছে। মন মেজাজ ভালো থাকলে এতদিনে করেও দিতেন। জিমিটাকে দিয়ে কিছুই হবে না—একটা হতভাগা।

সুজাতা মিত্র আশ্চর্য হয়েই বোসদার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

 

তারাভরা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে আমার মন এক বিচিত্র অনুভূতিতে ভরে উঠল। কবে, কোথায়, কতদিন আগে আমরা জন্মগ্রহণ করেছিলাম; আর সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে আজ এই মুহূর্তে আমরা তিনজন শাজাহানের ছাদে এসে জড়ো হয়েছি।

সত্যসুন্দর বোসের জীবন-নদী আপন বেগেই এতদিন ছুটে চলেছিল। কোথাকার এক পরিচয়হীন মেয়ে অকস্মাৎ বহুজনের অরণ্য থেকে বেরিয়ে এসে একটা প্রশ্ন করেই সমস্যাকে জটিল করে তুলল—আপন মনে নেচে কোথায় চলেছ তুমি?

দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর যে অসংখ্য মানুষের দল শাজাহানের পান্থশালায় আতিথ্য গ্রহণ করেছে। তারা কেউ তো সাহেবগঞ্জের সত্যসুন্দর বোসকে সে প্রশ্ন করেনি।

সরলা বালিকার গভীর প্রশ্নে মুহূর্তের জন্য বিব্রত নদী উত্তর দিয়েছিল,–কেন? যৌবনের সেই উষালগ্নে কলেজকে প্রণাম করে যেদিন স্বেচ্ছায় এই অন্তত-যৌবনা পান্থশালায় আশ্রয় নিয়েছিলাম সেদিন থেকেই তো ছুটে চলেছি। আপন ছন্দে মত্ত হয়ে, জীবনের নদী আপন মনেই এগিয়ে চলেছে।

কিন্তু কোথায়?

তা তো জানি না। সত্যসুন্দরদার মা, তিনি তো কবে আর একটা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে সাহেবগঞ্জের হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সত্যসুন্দর বোস তখন ক্লাশ ফাইভে পড়েন। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো সে প্রশ্ন করতেন। বাবা? তিনি ব্যক্তিত্বের কঠিন আবরণের আড়ালে থেকে, মাসে মাসে মনি-অর্ডারে হোস্টেলের ঠিকানায় টাকা পাঠিয়েই কর্তব্য শেষ করেছেন।

সত্যসুন্দরদা যা আমাকেও কোনোদিন বলেননি, আজ তা প্রকাশ করলেন। জানেন, আমার এক সৎ মা আছেন।

তিনি বুঝি এই কোমল স্বভাবের রোমান্টিক ছেলেটির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কিছুই চিন্তা করেননি? সুজাতা মিত্র প্রশ্ন করলেন।

কোটি কোটি আলোক বৎসর দুরের তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে সাহেবগঞ্জের সত্যসুন্দর বোস অনেকক্ষণ বোবার মতো তাকিয়ে রইলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, সে ভদ্রমহিলাকে দোষ দিয়ে কী লাভ? আমার থেকে তার বয়স হয়তো মাত্র কয়েক বছর বেশি। নিজের অনিশ্চিত অন্ধকার ভবিষ্যতের চিন্তা করতে করতেই তিনি নিশ্চয় ব্যতিব্যস্ত।

আজ পৃথিবীর কোনো দেশের কোনো শহরেই সত্যসুন্দরদার আপন জন নেই। হোম অ্যাড্রেস বলেও কিছু নেই তার। কর্তব্যের মধ্যে বিধবা সৎ মাকে মাঝে মাঝে মনি-অর্ডারে টাকা পাঠান।

স্তব্ধতার গুমোট কাটিয়ে শাজাহানের বিষণ্ণ আকাশে হঠাৎ ভায়োলিনের করুণ সুর বেজে উঠল। আমাদের এই আনন্দের হাটে অমন ভাবে কে যেন প্রিয়জনবিরহে রাতের গভীরে সবার অলক্ষ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। প্রভাতচন্দ্র গোমেজ নিজের ঘরে বসে বসে সপ্তদশ, অষ্টাদশ কিংবা ঊনবিংশ শতাব্দীর কোনো হতভাগ্য সুরগুরুর চরণে সুরের প্রণাম নিবেদন করছেন। হান্ডেল, বাক, বীঠোফেন, সুবার্ট, সুম্যান, ভাগনার, ব্রাহাম, মোৎসার্ট, শোঁপা, মেন্ডেলসনের সুরের জগতে যেন কেবলই বেদনা। কোন সুদূর দেশের বহু শতাব্দীর আগের বেদনাধ্বনি এতদিন ইথারবাহিত হয়ে এই রাত্রে শাজাহানের শীর্ষদেশে পৌঁছেছে।

আমার পক্ষে বসে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠল। বেদনাহত, যন্ত্রণাকাতর, জীবনানন্দে বঞ্চিত সঙ্গীতের পাশ্চাত্য ঋষিরা যেন দ্বারে দ্বারে অপমানিত হয়ে ভিক্ষাপাত্র হাতে এবার আমার পর্ণকুটীরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। মন্ত্রমুগ্ধ সুজাতা মিত্র ও বোসদা পাথরের মতো বসে রইলেন। আমি চললাম গোমেজের ঘরের দিকে।

বিজলীবাতির স্তিমিত আলোকে প্রভাতচন্দ্ৰ আপন মনে ভায়োলিন বাজিয়ে চলেছেন। কে তুমি? বাণীর বরপুত্র, কার শাপে স্বর্গলোক থেকে ভ্রষ্ট হয়ে শাজাহানের নির্বাসনে এই নরকযন্ত্রণা ভোগ করছ? এই মুহূর্তে যে বিদেহী আত্মা তোমার অভিশপ্ত দেহের উপর ভর করে সঙ্গীতের মূৰ্ছনা তুলছেন তিনি কি ধনীপুত্র মেন্ডেলসন? না, দারিদ্র-লাঞ্ছিত শিশুপ্রতিভা মোসার্ট? তিনি কি দৃষ্টিহীন মৃত্যুপথযাত্রী জন সিবাস্টিয়ান বাক্‌? না, ভাগ্যহত বধির বীঠোফেন? অথবা ক্ষয়রোগগ্রস্ত মুমুর্ষ শোপা? আমি যে কিছুই জানি না। জানলে হয়তো তোমার যোগ্য সমাদর করতে পারতাম। মূক বধিরের সভায় তুমি যে সংগীত পরিবেশন করছ। দৃষ্টিহীনের দেশে তুমি যে দীপাবলীর আয়োজন করেছ।

শাজাহানের সামান্য সঙ্গীতজ্ঞ যেন এই মাটির পৃথিবীতে নেই। আঘাত, অপমান, অবজ্ঞা, দুঃখ, যন্ত্রণা, সব বিস্মৃত হয়ে তিনি পঞ্চেন্দ্রিয়ের দেহদীপধারে সুরধুনীর আরতি করছেন। আমি দেখলাম তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

কে? প্রভাতচন্দ্র আমার ছায়া দেখে চমকে উঠলেন। সঙ্গীতের সারস্বত কুঞ্জে মূর্তিমান ব্যাধের সুরের বিহঙ্গরা মুহূর্তে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

প্রভাতচন্দ্র আমার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললেন–No more noisy, loud word from me-such is my masters will. Henceforth I dead in whispers. The speech in my hart will be carried on in murmurings of a song.

কাব্যের দেবতা আজ যেন ক্ষমাসুন্দর চক্ষে শাজাহানের সামান্য কর্মচারীর উপর দৃষ্টিপাত করলেন। আমি ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলাম :

কোলাহল তো বারণ হল
এবার কথা কানে কানে
এখন হবে প্রাণের আলাপ
কেবল মাত্র গানে গানে।

প্রভাতচন্দ্র আবার ভায়োলিন তুলে নিলেন। সেখানে যে সুর বেজে উঠল তা সৌভাগ্যক্রমে আমার পরিচিত :

শুধু তোমার বাণী নয় গো,
হে বন্ধু, হে প্রিয়,
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার
পরশখানি দিয়ো।

প্রভাতচন্দ্র এবার চমকে উঠলেন। ডিনারের আর দেরি নেই। ভায়োলিনটা বিছানার উপর ফেলে রেখে, কোটটা হাতে নিয়ে, দরজাটা কোনোরকমে বন্ধ করে, দ্রুতবেগে তিনি নিচেয় নেমে গেলেন। ডিনারের আগে তার খেয়ে নেবার নিয়ম। আজ যে তাকে অনাহারে থাকতে হবে তা বুঝলাম।

তারাদের সাক্ষী রেখে সত্যসুন্দরদা ও সুজাতা মিত্র তখনও মুখোমুখি বসে রয়েছেন। আমি বললাম, মিস মিত্র, এবার কদিন আছেন?

সুজাতা মিত্র বললেন, কদিন মানে? আজ রাত্রেই বিদায় হচ্ছি।

আবার কবে আসবেন?

প্রায়ই আসতে হবে আমাকে। কদিন ছাড়াই আপনাদের জ্বালাতন করব।

বোসদা বললেন, আপনার জীবনের কথা ভাবলে হিংসে হয়।

হিংসেরই তো কথা! সুজাতা মিত্র উত্তর দিলেন। কেমন অদ্ভুত জীবন। হয় আকাশে, না হয় হোটেলে। রাতের অন্ধকারে সবাই যখন ঘুমোচ্ছে, আমি তখন কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে এরোড্রোম থেকে হোটেলের দিকে রওনা দিচ্ছি। ভোরবেলায় হোটেল ছেড়ে আবার এরোড্রোম। আজ এ-হোটেল, কাল আর-এক হোটেল, পরশুদিন আর-এক হোটেল।

বোসদা উত্তর দিলেন, সেই জন্যেই তো আরবদেশে বলে–Mortal, if thou wouldst be happy, change thy home often; for the sweetness of life is variety, and the morrow is not nine or thine.

সুজাতা মিত্র বললেন, আপনার সঙ্গে পড়াশোনা বা কোটেশনে পেরে ওঠা আমার কাজ নয়। আমি সামান্য এয়ারহোস্টেসঅ্যামপেনে ব্যাগেজ, টি, কফি, চকোলেট, আলকহলিক ড্রিংকস, ফ্লাইট এই সব বুঝি। হোটেলে কাজ করতে করতে এত পড়বার সুযোগ কেমন করে পান?

বোসদা হেসে বললেন, হোটেল তত পড়বারই জায়গা; কত উঠতি লোককে এখানে পড়তে দেখলাম! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বোসদা বললেন, আপনার অনেক দেরি করিয়ে দিয়েছি। ডিনার শেষ করে একটু গড়িয়ে নিন। মধ্যরাতে আবার তো রওনা দিতে হবে।

শাড়ির আঁচলটা ঝাড়তে ঝাড়তে সুজাতা মিত্র উঠে পড়লেন। বোসদা বললেন, শুভ রাত্রি।

রাগ করে সুজাতা মিত্র বললেন, অত ইংরিজি কায়দা আমার ভালো লাগে।

বোসদা গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলেন, বাংলা কায়দা অনুসরণ করলে বলতে হয় এসো। সেটা কি আপনি বরদাস্ত করবেন?

কপট ক্রোধে বোসদার দিকে তাকিয়ে, সুজাতা মিত্র এবার আমার সঙ্গে লিফটের দিকে এগিয়ে গেলেন। লিফটের সুজাতা প্রশ্ন করলেন, এখানে কতদিন আছেন?

বললাম, তেমন কিছু বেশিদিন নয়।

আর মিস্টার বোস?

উনি অনেকদিন। ওঁকে বাদ দিয়ে এই হোটেলের কথা ভাবা যায় না।

এমন মানুষ কেন যে হোটেলের চার দেওয়ালে বন্দি হয়ে নিজেকে খরচ করে ফেলছেন, সুজাতা মিত্র আপন মনেই বললেন।

লিফ্‌ট থেকে নামবার আগে সুজাতা মিত্র হেসে বললেন, আসি ভাই। আবার দেখা হবে।

নিজের ঘরে মার্কোপোলো বুঁদ হয়ে বসেছিলেন। আমাকে ঢুকতে দেখে মুখ তুললেন। বিছানায় বসিয়ে আমার পিঠে হাত রেখে এমনভাবে অভ্যর্থনা করলেন যে, কে বলবে তিনি ম্যানেজার এবং আমি সামান্য একজন রিসেপশনিস্ট? বললেন, লিজাকে তুমি কতদিন জানো?

বেশিদিন নয়। এই হোটেলে আসবার আগে কিছুদিন ওঁদের বাড়িতে রোজ ঝুড়ি কিনতে যেতে হত।

লিজা কিন্তু তোমাকে খুব স্নেহ করে। তোমার প্রশংসা করলে।

এই অকারণ ভালোবাসায় আমার জীবন-মরুভূমি বার বার শ্যামল সবুজ হয়ে উঠেছে। মানুষের ভালোবাসা পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি। বললাম, তিনি আমার বহু উপকার করেছেন।

মার্কো বললেন, লিজাকে আজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। পায়ের একটা এক্স-রে ছবিও তোলালাম। ডাক্তার বলেছেন সেরে যাবে। লিজা তোমাকে খবরটা দিতে বলেছে। আগামী কাল বিকেলে ওকে আবার ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যেতে হবে। অথচ জিমিকেও ছুটি দিয়েছি। ব্যাংকোয়েট হ-এর টি তুমি আর স্যাটা ম্যানেজ করতে পারবে না?

বললাম, আপনি লিজাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। বেচারা যা কষ্ট পায় দেখলে আমার চোখ দিয়ে জল আসে। আমরা টি পার্টি ম্যানেজ করে দেব।

মার্কো ধন্যবাদ জানালেন। কিন্তু তার মন ছাতাওয়ালা গলির সেই অন্ধকার বাড়িতে পড়ে রয়েছে। বললেন, কতদিন পরে লিজাকে দেখছি। ওর দেহ ভেঙে পড়েছে, কিন্তু ওর চোখ দুটোর দিকে তাকিয়েছ? ও-দুটো আজও হিরের মতো জ্বলে।

 

সাংস্কৃতিক সমিতির চা-পান সভা আমরা দুজনেই ম্যানেজ করছি। দলে দলে সম্মানিত অতিথিরা এবং উৎসাহী সভা-সভ্যরা আসছেন। আজ সমিতির ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। তাদের স্থায়ী উৎসাহদাত্রী মিসেস পাকড়াশীকে বিদেশ যাবার প্রাক্কালে অভিনন্দন জানানো হচ্ছে। এই সভায় সহযোগিতা করছেন কলকাতার আরও কুড়িটি প্রতিষ্ঠান—যাঁদের লক্ষ্য শিশুমঙ্গল, নারী জাতির উন্নতি, সামাজিক বৈষম্য দূর ইত্যাদি।

সভা আরম্ভের এক মিনিট আগে মাননীয় সভাপতির সঙ্গে শ্রীমতী পাকড়াশী সাদা ব্লাউজ এবং লালপেড়ে একটা সাদা খদ্দরের শাড়ি পরে ব্যাংকোয়েট হল্‌-এ হাজির হলেন। মিসেস পাকড়াশীর চোখে আজ কালো চশমা নেই; দৃষ্টিতে সেই সর্পিণীর ভয়াবহতাও নেই।

টেবিলে টেবিলে চা পরিবেশিত হচ্ছে। কেক, স্যান্ডউইচ, পেস্ট্রি প্রচুর পরিমাণে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। সভাপতি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, আজ কলকাতা, তথা বাংলাদেশ, তথা ভারতের পরম গর্বের দিন।নারীজাতিকে যে সম্মান এবং উন্নতির সুযোগ আমরা স্বাধীন ভারতবর্ষে দিয়েছি, তা ইংল্যান্ড আমেরিকাতেও সহজলভ্য নয়। পৃথিবীর মধ্যে আর কোনো নারী ইতিপূর্বে মিসেস পাকড়াশীর মতো আন্তর্জাতিক নৈতিক স্বাস্থ্য সম্মেলনের; সভানেত্রী পদে নির্বাচিত হননি। ভারতের নারী জাতির সনাতন আদর্শ মিসেস পাকড়াশীর মধ্যে মূর্তি পরিগ্রহ করেছে। ধনীর গৃহবধু হয়েও, তিনি প্রায় যোগিনী সাজেই সাধারণের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন কলকাতার নোংরাতম বস্তিতে পর্যন্ত তাঁকে হাসিমুখে যখন কাজ করতে দেখি তখন আমাদের ভগিনী নিবেদিতার কথা মনে পড়ে যায়। তবুও সেই বিদেশিনী মহিলার সংসার ছিল না। আর এই সাধ্বী মহিলা স্বামী এবং জাতি কারও প্রতি কর্তব্যে অবহেলা করেননি।

আরও অনেক বক্তৃতা হল। বোসদা কানে কানে বললেন, শুনে যাও!

মিসেস পাকড়াশী ঘোমটা সামান্য টেনে দিয়ে বললেন, আর পাঁচজনের মতো আমি সামান্য একজন গৃহবধূ। সেইটাই আমার একমাত্র পরিচয়। স্বামী পুত্রের সেবা করে যতটুকু সময় পাই, সারা দেশে আমার যে মা, ভাই, বোন ছড়িয়ে আছেন তাদের কথা ভাববার চেষ্টা করি। যে সম্মান বিদেশ থেকে আমাকে দেওয়া হয়েছে, তা আসলে আপনাদেরই সম্মান। আমি নিমিত্ত মাত্র। সম্মেলনের পরেই আমার চলে আসবার কথা। নিজের ঘরসংসার, স্বামী পুত্র ছেড়ে গৃহস্থ ঘরের বধু কদিনই বা বাইরে থাকতে পারি বলুন? কিন্তু আমাদের দেশের সাধারণ দুর্গতির কথা চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম—কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন দেশে নারীত্বের প্রতি কীভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হচ্ছে তা জেনে আসব।

সভায় এবার প্রচণ্ড হাততালি পড়ল। মিসেস পাকড়াশী এবার বললেন, পরিশেযে, ভারতের চিরন্তন নারীত্বের প্রতি দেশের মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমরা যেন কখনই না ভুলি স্বামীরাই আমাদের সব।লতারও প্রাণ আছে, গাছেরও প্রাণ আছে—কেউ ছোট নয়। তবু লতা গাছকে জড়িয়ে বড় হতে ভালোবাসে। আমরা সেভাবে স্বামীকে জড়িয়েই বড় হব।

সভা থেকে বেরোবার আগে বোসদার সঙ্গে মিসেস পাকড়াশীর চোখাচোখি হয়ে গিয়েছিল। যেন না দেখার ভান করে তিনি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।

ওঁদের বিদায় করে দিয়ে, ব্যাংকোয়েট হ-এ ফিরে এসে বোসদা বললেন, ওঁদের খবর শুনলে তো? এবার আমার খবর শোনো। এক নম্বর সুইটের সেই বিদেশি ছোকরাটির কথা মনে আছে তো? সেও অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। একই প্লেনে সেও প্যারিসে যাচ্ছে! পুওর মিস্টার পাকড়াশী!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *