১৬. অমরত্ব বিষয়ে প্লাতনের তত্ত্ব

১৬. মরত্ব বিষয়ে প্লাতনের তত্ত্ব

ফায়েদ (Phaedo)-র নামে প্রচলিত কথোপকথনটি কয়েকটি কারণে কৌতূহলোদ্দীপক। এই কথোপকথন সাতেসের জীবনের শেষ কয়েক মুহূর্তের বিবরণ দিয়েছে : হেমলক (hemlock) পান করার ঠিক পূর্ব মুহূর্ত থেকে তাঁর জ্ঞান হারানো পর্যন্ত। এটা প্লাতনের মানুষের আদর্শ উপস্থিত করেছে, সে মানুষ সর্বোচ্চ মাত্রায় জ্ঞানী এবং উত্তম ও তিনি মৃত্যভয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। প্লাতনের বিবরণ অনুসারে মৃত্যুর মুখোমুখি যে সক্রাতেসকে পাওয়া যায় নৈতিক দিক দিয়ে তা প্রাচীন ও আধুনিক যুগ-উভয় যুগেই গুরুত্বপূর্ণ। খ্রিষ্টানদের ক্ষেত্রে বাইবেলে বর্ণিত ক্রুশবিদ্ধ যিশুর যন্ত্রণা এবং ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার যে গুরুত্ব, অ-খ্রিষ্টান পৌত্তলিক অথবা স্বাধীন চিন্তক দার্শনিকদের কাছে ফায়েদ-রও সেই গুরুত্ব। কিন্তু জীবনের অন্তিম মুহূর্তে সাতেসের অবিচলিত থাকা তাঁর অমরত্বে বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত এবং ফায়েদ-র গুরুত্ব শুধুমাত্র শহীদের মৃত্যুর জন্য নয়, এতে রয়েছে এমন কতকগুলো মতবাদ যেগুলো পরে খ্রিষ্টধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিল। সেন্ট পল এবং অন্যান্য ফাদারদের ধর্মতত্ত্ব অনেকটাই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এ থেকেই গৃহীত এবং প্লাতনকে অগ্রাহ্য করলে এটা প্রায় বোঝা যায় না।

ক্রিত (Crito) নামে আগেকার একটি কথোপকথন থেকে জানা যায়- সক্রাতেসের কয়েকজন বন্ধু এবং শিষ্য, সাতেসের থেসালি (Thessaly)-তে পালিয়ে যাওয়ার একটি পরিকল্পনা করেন। আথিনীয় শাসকরা সম্ভবত সক্ৰাতেস পালিয়ে গেলে খুশিই হতেন এবং এই প্রস্তাবিত পরিকল্পনার সাফল্যের সম্ভাবনা ছিল যথেষ্ট। সাতেস কিন্তু কোনো কিছুতেই রাজি হননি। তাঁর বক্তব্য ছিল আইনের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতেই তাঁকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে এবং শাস্তি এড়ানোর জন্য আইন বিরুদ্ধ কোনো কাজ করা অন্যায় হবে। তিনি প্রথমে যে ঘোষণাটি করলেন তাকে আমরা পাহাড়ের উপরে দেওয়া ধর্মোপদেশের সঙ্গে (Sermon on the Mount-Bible) জড়িত করি-কোনো লোকের কাছ থেকে যতটা অন্যায় আচরণই আমরা পেয়ে থাকি না কেন, সে অন্যায়ের জন্য আমরা তার প্রতি অন্যায় আচরণ করব না।

তারপর তিনি কল্পনা করছেন, তিনি যেন আথিনার আইনগুলোর সঙ্গে কাহোপকথন করছেন। সেখানে তাঁরা বলছেন, পুত্রের পিতাকে কিংবা দাসের প্রভুকে দেয় সম্মানের মতো আইনকর্তাদের সম্মান দেওয়া উচিত নয়, বরং উচিত তার চাইতে বেশি সম্মান দেওয়া। তাছাড়া আথিনীর রাষ্ট্রকে পছন্দ না হলে প্রতিটি নাগরিক আথিনা ছেড়ে চলে যেতে পারেন। নিম্নলিখিত শব্দগুচ্ছ দিয়ে এক লম্বা বক্তৃতার উপসংহার করছে আইন।

সক্রাতেস, তাহলে আমাদের কথা শোন- যারা তোমাকে মানুষ করেছে। প্রথমে জীবন এবং সন্তানদের কথা ভেবে পরে ন্যায়ের কথা ভেবো না কিন্তু প্রথমে ভাব ন্যায়ের কথা- যাতে পাতালপুরীর রাজপুত্রদের কাছে তোমাকে ন্যায়পরায়ণ প্রমাণ করা যায়। কারণ, ক্রিত যা বলছে তাই যদি তুমি কর তাহলে তুমি কিংবা তোমার নিজের যে কোনো লোক ইহজীবনে বা অন্য জীবনে অধিকতর সুখী কিংবা পবিত্র কিংবা ন্যায়পরায়ণ হবে না। এখন তুমি চলে যাবে নির্দোষ অবস্থায়, তুমি হবে একজন দুঃখভোগী কিন্তু দৃষ্কৃতকারী নয়, তুমি আইনের বলি হবে না, বলি হবে মানুষের। কিন্তু তুমি যদি অগ্রসর হও অন্যায়ের বদলে অন্যায় করে এবং আঘাতের বদলে আঘাত দিয়ে, আমাদের সঙ্গে তুমি যে শর্ত এবং চুক্তি করেছ সেই চুক্তি ভঙ্গ করে এবং যাদের সামান্যতম ক্ষতি তুমি করতে চাও না অর্থাৎ তোমার নিজের, তোমার বন্ধুদের এবং তোমার দেশের ও আমাদের-তাদের তুমি যদি ক্ষতি কর তাহলে আমরণ আমরা তোমার উপর ক্রুদ্ধ থাকব ও আমাদের ভ্রাতারা অর্থাৎ পাতালপুরীর বিধান তোমাকে গ্রহণ করবে শক্ররূপে। কারণ, তারা জানবে যে, তুমি আমাদের ধ্বংস করার জন্য যথাসাধ্য করেছ।

সক্রাতেস বলেছেন, রহস্যবাদীর কানে যেরকম বাঁশি বাজে সেরকমই আমার কানে গুনগুনিয়ে এই কণ্ঠস্বর বাজছে। সুতরাং তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন দেশে থাকা এবং মৃত্যুদণ্ড গ্রহণ করা তাঁর কর্তব্য।

ফায়েদ-তে আছে, শেষ সময় উপস্থিত? তার শৃঙ্খলগুলো খুলে নেওয়া হলো এবং তার বন্ধুদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে অনুমতি দেওয়া হলো। তিনি তাঁর ক্রন্দনরতা স্ত্রীকে দূরে পাঠিয়ে দিলেন যাতে তার দুঃখ সক্রাতেসের আলোচনায় কোনো ক্ষতি না করে।

সক্রাতেস শুরু করলেন যে, যদিও দার্শনিকতাসম্পন্ন মানুষ মৃত্যুভয়ে ভীত হয় না বরং মৃত্যুকে সাদর আহবান জানায়, তবুও তিনি আপন প্রাণ হরণ করেন না। কারণ তা বেআইনি মনে করা হয়। তাঁর বন্ধুরা প্রশ্ন করলেন আত্মহননকে কেন বেআইনি মনে করা হয় এবং তাঁর অফীয় মতানুসারী উত্তর একজন খ্রিষ্টধর্মবিশ্বাসীর সম্ভাব্য বক্তব্যের। প্রায় অনুরূপ। একটি মতবাদ কানে কানে গোপনে বলা আছে- মানুষ এক বন্দী, দরজা খুলে পালানোর অধিকার তার নেই। এটা একটা বিরাট রহস্য এবং এ রহস্য আমি ঠিক বুঝতে পারি না। তিনি বলছেন, তিনি মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্কের তুলনা করেছেন মালিকের সঙ্গে তার গোধনের। তোমার বঁড়টি যদি নিজেকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার স্বাধীনতা নেয় তাহলে তুমি ক্রুদ্ধ হবে। সুতরাং হয়তো এ কথা বলায় যুক্তি আছে যে মানুষের অপেক্ষা করা উচিত এবং যতক্ষণ না ঈশ্বর নিজে থেকে ডেকে নেন আত্মহত্যা করা উচিত নয়, যেমন-তিনি এখন আমাকে ডাক দিয়েছেন। মৃত্যুর জন্য তার দুঃখ নেই, কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন প্রথমত, আমি অন্য দেবতাদের কাছে যাচ্ছি যারা জ্ঞানী এবং উত্তম (এ বিষয়ে আমি এ ধরনের অন্য কোনো বস্তু সম্পর্কে যে রকম নিশ্চিত হওয়া যায় সেরকম নিশ্চিত) এবং দ্বিতীয়ত, (যদিও শেষ ব্যাপারটাতে আমি অতটা নিশ্চিত নই) আমার যাত্রা বিগত মানুষদের দিকে, যাদের ছেড়ে যাচ্ছি তাদের চেয়ে যারা ভালো। আমার বেশ খানিকটা আশা আছে যে, মৃত্যুর পরেও তাদের জন্য কিছু অবশিষ্ট থাকে সেগুলো মন্দের জন্য নয়, সেগুলো উত্তমের জন্য।

সক্রাতেস বলছেন, মৃত্যু হলো দেহ এবং আত্মার বিচ্ছিন্নতা। এখানে আমরা এলাম প্লাতনের দ্বৈতবাদের ছত্রছায়ায় ও বাস্তবতা এবং আভাস, ধারণা এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু, যুক্তি এবং ইন্দ্রিয়ানুভূতি, আত্মা এবং দেহ। এই জোড়গুলো পরস্পর সংশ্লিষ্ট ও প্রতিটি জোড়াই, প্রথমটি দ্বিতীয়ের চাইতে উত্তম-বাস্তবতা এবং উত্তমত্ব-উভয় দিকেই। এই দ্বৈতবাদের স্বাভাবিক ফল কঠোর তপশ্চর্যাকারীর প্রখর নৈতিকতাবোধ। খ্রিষ্টধর্ম এই মতবাদকে অংশত গ্রহণ করেছে, কিন্তু কখনোই সম্পূর্ণ গ্রহণ করেনি। বাধা ছিল দুটি। প্রথমটি হলো, প্লাতনের কথা সঠিক হলে দৃশ্যমান পৃথিবীর সৃষ্টি একটি দুষ্কর্ম মনে হতে পারে এবং এর স্রষ্টা কখনোই উত্তম হতে পারেন না। দ্বিতীয়টি হলো, কৌমার্যকে মহত্তর মনে করলেও গোঁড়া খ্রিষ্টধর্ম কখনোই বিবাহকে নিন্দা করতে সাহসী হয়নি। মানিকীয়দের মতবাদ দুদিক থেকেই অনেক বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।

মন এবং জড়বস্তুর পার্থক্য দর্শন, বিজ্ঞান এবং সাধারণ মানুষের চিন্তাধারায় একটি সাধারণ আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর উৎপত্তি কিন্তু ধর্মীয় এবং শুরু হয়েছিল দেহ ও আত্মার পার্থক্য দিয়ে। আমরা দেখেছি, অফীয়রা ঘোষণা করলেন তাঁরা পৃথিবী এবং তারকাখচিত আকাশের সন্তান। পৃথিবী থেকে আসে দেহ, আকাশ থেকে আসে আত্মা। এই তত্ত্বই প্লাতন প্রকাশ করতে চান দর্শনের ভাষায়।

ফায়েদ-তে সক্ৰাতেস তৎক্ষণাৎ তাঁর মতবাদের কঠোর তপশ্চর্যাভিত্তিক নিহিতার্থ বিকাশ করতে অগ্রসর হন কিন্তু তাঁর তপশ্চর‍্যা মধ্যপন্থী এবং সুভদ্র। তাঁর বক্তব্য এই নয় যে, একজন দার্শনিক সাধারণ আনন্দ সম্ভোগ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করবেন। কিন্তু দার্শনিকটি কখনোই তার দাস হবেন না। দার্শনিক কখনোই খাদ্য এবং পানীয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হবেন না বরং তিনি যা প্রয়োজন সেটা খাবেন, উপবাস করার কথা তিনি বলেননি। আমরা শুনেছি সক্ৰাতেস যদিও মদ সম্পর্কে নিস্পৃহ ছিলেন তবু কখনো মত্ত না হয়েও যে কোনো লোকের চাইতে বেশি মদ্যপান করতে পারতেন। মদ্যপানকে তিনি নিন্দা করেননি, নিন্দা করেছেন মদ্যপানের আনন্দের। একইভাবে প্রেমের আনন্দের প্রতি দার্শনিক নিস্পৃহ থাকবেন কিংবা ভালো পোশাক, ভালো জুতো কিংবা দেহের বা নিজের সাজগোজ নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। তিনি সম্পূর্ণভাবে আত্মার চিন্তায় নিরত থাকবেন, দেহের চিন্তায় নয়। যতটা সম্ভব তার প্রার্থনা হবে দেহ থেকে পলায়ন করে আত্মার দিকে যেতে।

এটা স্পষ্ট যে, এই মতবাদ জনগণের ভিতরে প্রবেশ করলে পরিণত হবে কঠোর তপশ্চর্যার মতবাদে কিন্তু ঠিকমতো বলতে গেলে এর উদ্দেশ্য কঠোর তপশ্চর‍্যা নয়। দার্শনিক ইন্দ্রিয়ভোগ পরিত্যাগ করতে বিশেষভাবে সচেষ্ট হবেন না কিন্তু তিনি চিন্তা করবেন অন্যান্য বিষয় নিয়ে। আমি এমন অনেক দার্শনিককে জানি যারা খেতে ভুলে যেতেন এবং শেষ পর্যন্ত খেতে বসে বই পড়তেন। প্লাতন যা করা উচিত মনে করতেন এই দার্শনিকরাও তাই করতেনঃ তাঁরা ঔদরিকতা কোনো নৈতিক প্রচেষ্টায় পরিহার করছেন না কিন্তু তাঁদের অধিকতর আকর্ষণ অন্যদিকে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় দার্শনিকদের উচিত বিয়ে করা, সন্তান উৎপাদন করা এবং তাদের মানুষ করা-সেটা তারা করবেন একইরকম অন্যমনস্কভাবে কিন্তু নারী মুক্তির পরে এটা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্সানথিল্পে (Xanthippe-সাতেসের স্ত্রী) যে বদমেজাজী মহিলা ছিলেন তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই।

সক্রাতেস আরও বলছেন, দার্শনিকরা চেষ্টা করেন আত্মার সঙ্গে দেহের যোগাযোগ ছিন্ন করতে কিন্তু অন্যরা ভাবেন যদের আনন্দের বোধ নেই এবং যারা দৈহিক সুখের অংশভোগী নন তাঁদের বেঁচে থাকা মূল্যহীন। মনে হয়, প্লাতন অনবধানে এই বাক্যের সাহায্যে কিছু নীতিবাগিশদের বিরোধিতা করতে চেয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল একমাত্র দৈহিক আনন্দেরই মূল্য আছে। এই সমস্ত নীতিবাগিশদের মত ছিল যারা ইন্দ্রিয়সুখ চান না তারা নিশ্চয়ই সুখ সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করছেন এবং নিষ্পাপ জীবনযাপন করেছেন। এই ভ্রম অবর্ণনীয় ক্ষতি করেছে। মন এবং দেহের পার্থক্য যদি মেনে নেওয়া যায় তবে শ্রেষ্ঠ এবং নিকৃষ্ট আনন্দানুভূতি দুই-ই মানসিক-উদাহরণ, হিংসা, নানাবিধ নিষ্ঠুরতা এবং ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা। মিলটনের শয়তান দৈনিক কষ্টের ঊর্ধ্বে উঠেছিল এ ধ্বংসকার্যে আত্মনিয়োগ করেছিল-এ থেকে সে যে আনন্দ লাভ করত তা ছিল সম্পূর্ণ মানসিক। বহু বিখ্যাত ধর্মযাজক ইন্দ্রিয়সুখ পরিত্যাগ করেছিলেন এবং অন্যদের সম্পর্কে সাবধান না হওয়ার ফলে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষাই তাদের প্রভু হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তাঁরা ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা এবং অত্যাচার করেন এবং বলার সময় বলতেন এ কাজ তারা করেছেন ধর্মের জন্য। আমাদের আধুনিককালে হিটলার ছিলেন এই ধরনের, তাঁর সম্পর্কে সমস্ত সংবাদ থেকেই জানা যায় তাঁর কাছে ইন্দ্রিয়সুখের কোনো গুরুত্ব ছিল না। দেহের স্বেচ্ছাচার থেকে মুক্তি মহান হতে সাহায্য করে কিন্তু সেই মহত্ত্ব মহান পাপ কিংবা মহান পুণ্য-দুটোই হতে পারে।

এটা কিন্তু প্রসঙ্গান্তর, আমাদের অবশ্যই এখন প্রত্যাবর্তন করতে হবে সক্রাতেসের প্রসঙ্গে।

এখন আমরা আলোচনা করব ধর্মের বৌদ্ধিক দিক নিয়ে, এটা প্লাতন (সঠিকভাবে কিংবা বেঠিকভাবে) সাতেসের উপর আরোপ করেন। আমাদের বলা হয়েছে জ্ঞানার্জনে দেহ বাধাস্বরূপ এবং চক্ষুকর্ণের সাক্ষ্য নির্ভুল নয়ঃ সত্যিকারের অস্তিত্ব যদি আত্মার কাছে আদৌ প্রকাশিত হয় তাহলে সেটা হয় চিন্তায়, ইন্দ্রিয়ে নয়। এই মতবাদের নিহিতার্থ এক মুহূর্তের জন্য চিন্তা করা যাক। এর অর্থ হবে ইতিহাস, ভূগোল সমেত সমস্ত পরীক্ষামূলক এবং অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞান সম্পূর্ণ বর্জন করা। আথিনা বলে কোনো স্থান ছিল আমরা জানতে পারব না কিংবা জানতে পারব না সক্রাতেস বলে কেউ ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সময়কার সাহসিকতা-এ সমস্তই আভাসিত জগতের অঙ্গ। একমাত্র দর্শন এবং শ্রবণের মাধ্যমেই এসব সম্পর্কে কোনো কিছু জানতে পারি এবং খাঁটি দার্শনিক দৃষ্টি ও শ্রবণকে অগ্রাহ্য করেন। তাহলে তাঁর রইল কী? প্রথমত, যুক্তিবিদ্যা এবং গণিত, কিন্তু এগুলো প্রকল্প মাত্র এবং বাস্তব জগৎ সম্পর্কে নির্ভুল, দৃঢ় বক্তব্যের সপক্ষে কোনো যুক্তি এ থেকে পাওয়া যায় না। পরবর্তী ধাপ-এবং এটাই চূড়ান্ত-এটা নির্ভর করে উত্তম সম্পর্কিত ধারণার উপর। এই ধারণায় উপনীত হয়ে দার্শনিকের জেনে নেওয়া উচিত যে, যা উত্তম সেটাই বাস্তব এবং তা থেকে সিদ্ধান্ত করা সম্ভব হবে যে, ধারণার জগই বাস্তব জগৎ। পরবর্তী দার্শনিকরা বাস্তব এবং উত্তমের পরিচয় প্রমাণ করার জন্য যুক্তি দেখিয়েছেন কিন্তু মনে হয় প্লাতন অনুমান করেছিলেন যে এটা স্বপ্রকাশ। তাঁকে বুঝতে হলে আমাদের এই অনুমান সমর্থন করতে হবে, অবশ্যই প্রকল্প হিসেবে হলেও।

সক্রাতেস বলেন, মন যখন আত্মসমাহিত এবং শব্দ, দৃষ্টি, বেদনা বা আনন্দের দ্বারা বিক্ষিপ্ত নয় এবং দেহ থেকে মুক্ত হয়ে সত্যিকারের অস্তিত্বের দিকে ধাবমান, চিন্তাই তখন শ্রেষ্ঠ এবং এই অবস্থার দার্শনিক দেহকে অসম্মান করেন। এই বিন্দু থেকে সক্রাতেস চলে গেছেন ধারণা, আকার কিংবা সার (essence) সম্পর্কিত আলোচনায়। রয়েছে পরম ন্যায়, পরম সৌন্দর্য ও পরম শ্ৰেয় কিন্তু সেগুলো দৃষ্টিগোচর নয়। এবং আমি শুধু এগুলোর কথা বলছি না কিন্তু বলছি পরম মহত্ত্ব, পরম স্বাস্থ্য এবং শক্তি ও সব বস্তুরই সার অথবা সত্যিকারের ধর্মের কথা। এই সমস্তই শুধুমাত্র দেখা যেতে পারে বৌদ্ধিক দৃষ্টিতে। সুতরাং যতক্ষণ আমরা দেহে অবস্থান করি এবং আত্মা দেহের মন্দ গুণ দিয়ে সংক্রামিত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সত্য সম্পর্কিত জ্ঞানের আকাক্ষা তৃপ্ত হবে না।

জ্ঞানার্জনের পদ্ধতি হিসেবে এই দৃষ্টিভঙ্গি বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাকে স্বীকার করে না। পরীক্ষাকারীর মন আত্মসমাহিত নয় এবং শব্দ কিংবা দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া তার লক্ষ্য নয়। প্লাতন যে পদ্ধতি সুপারিশ করেছেন তা দিয়ে দুধরনের মানসিক ক্রিয়া করা যেতে পারে- গণিত এবং রহস্যবাদী আত্মজ্ঞান। প্লাতন এবং পুথাগোরীয়দের ভিতরে এই দুটি কেন অত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এটাই তার ব্যাখ্যা।

যারা পরীক্ষামূলক জ্ঞানে বিশ্বাসী তাঁদের মতে বহির্জগতের বাস্তবতার সংস্পর্শে আসার মাধ্যম হলো দেহ কিন্তু প্লাতনের মতে এটা দ্বিগুণ মন্দ, এটা এমন একটি বিকৃতি সৃষ্টিকারী মাধ্যম যা দিয়ে আমাদের দৃষ্টি কাঁচের মাধ্যমে অস্পষ্ট দেখার মতো হয়ে যায়। তাছাড়া দেহ হলো কামনাবাসনার উৎস যা আমাদের জ্ঞানান্বেষণ এবং সত্য দর্শন থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। কিছু উদ্ধৃতি দিলে ব্যাপারটি স্পষ্ট হবে।

এমনকি শুধু যদি খাদ্যের প্রয়োজনের কথাই ধরি তাহলেও আমাদের দেহ অশেষ যন্ত্রণার উৎস দেহের রোগের আশঙ্কা রয়েছে, এর ফলে আমাদের প্রকৃত সত্তার অন্বেষণে বাধার সৃষ্টি হয়। দেহ আমাদের প্রেম, লালসা, ভয় এবং নানা কল্পনা ও অসীম মূর্খতা দিয়ে পূর্ণ করে রাখে। আসলে লোকে যেমন বলে সেরকমই আমাদের কাছ থেকে চিন্তার ক্ষমতা কেড়ে নেয়। যুদ্ধ, মারামারি এবং দলাদলি কোথা থেকে আসে? দেহ এবং দেহজাত লালসা ছাড়া আর কোথা থেকে? অর্থের আকাঙ্ক্ষা থেকেই যুদ্ধ হয় এবং দেহের কারণে ও দেহের সেবায় অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজন হয় আর এই সমস্ত বাধার দরুন আমরা দর্শনশাস্ত্রের জন্য কোনো সময় দিতে পারি না। শেষ ও নিকৃষ্টতম ব্যাপার হলো আমাদের চিন্তা করার মতো অবসর থাকলেও দেহ এসে তাতে বাধা দেয়, ফল হয় চাঞ্চল্য এবং বিভ্রান্তি এবং আমরা এমন বিক্ষিপ্ত চিত্ত হয়ে যাই যে, আমরা সত্যকে দেখতে পাই না। অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে, কোনো বিষয় সম্পর্কে সত্য জ্ঞান লাভ করতে হলে আমাদের দেহকে ত্যাগ করতে হবে- আত্মাকে নিজের মধ্যেই বিভিন্ন বস্তু পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং একমাত্র তাহলেই কাম্য প্রজ্ঞা লাভ করতে পারি। সেই প্রজ্ঞা শুধু আমরা জীবিত অবস্থায় ভালোবাসি তাই নয়, ভালোবাসি মৃত্যুর পরেও। কারণ, যদি দেহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলে আত্মার শুদ্ধ জ্ঞান লাভ সম্ভব না হয়, তবে সেই জ্ঞান যদি আদৌ লাভ করতে হয় তা হবে মৃত্যুর পর।

এভাবে দেহজনিত সমস্ত মূর্খতা পরিহার করে আমরা খাঁটি হব এবং খাঁটির সঙ্গে মিশব এবং নিজেরাই সর্বত্র অমলিন আলোককে জানতে পারব-সে আলোক সত্যের আলোক ছাড়া কিছু নয়। কারণ, যে অশুদ্ধ সে বিশুদ্ধের কাছে যাওয়ার অনুমোদন পাবে না…। তাছাড়া দেহ এবং আত্মার বিচ্ছিন্নতা ছাড়া বিশুদ্ধিকরণ কাকে বলে?……এবং এই বিচ্ছিন্নতা দেহ থেকে আত্মার মুক্তিকে বলা হয় মৃত্যু …এবং প্রকৃত দার্শনিকরা, শুধুমাত্র তারাই, অবিরত আত্মার মুক্তির অনুসন্ধান করছে।

একটি সত্য মুদ্রা রয়েছে যার বিনিময়ে সমস্ত পদার্থই দেওয়া চলে–তান নাম হলো প্রজ্ঞা।

মনে হয়, রহস্যবাদের প্রতিষ্ঠাতারা বহুদিন আগে যখন একটি চিত্রের সাহায্যে বলেছিলেন যে, যারা অপবিত্র অবস্থায় অদীক্ষিত হয়ে পাতালে প্রবেশ করে তারা নোংরা কাদায় শুয়ে থাকবে কিন্তু যারা যেখানে দীক্ষিত এবং পবিত্র হয়ে প্রবেশ করে তারা বাস করবে দেবতাদের সঙ্গে, তখন তারা অর্থহীন কথা বলেননি, কারণ, রহস্যশাস্ত্রে বলে ধ্বজপতাকা অনেকে বহন করে কিন্তু খুব অল্পসংখ্যকই রহস্যবাদী। আমার মতে এর অর্থ প্রকৃত দার্শনিক।

এই ভাষার সমস্তটা রহস্যবাদী এবং রহস্যশাস্ত্র থেকে আহরিত।

শুদ্ধতা একটি অীয় ধারণা, এর অর্থ প্রধানত আচার-অনুষ্ঠানভিত্তিক কিন্তু প্লতনের কাছে এর অর্থ দেহের এবং দৈহিক প্রয়োজনের দাসত্ব থেকে মুক্তি। অর্থলিপ্সা। যুদ্ধের কারণ এবং অর্থের প্রয়োজন শুধুমাত্র দেহের সেবার জন্য তাঁর এই বক্তব্য বেশ কৌতূহলজনক। এই মতের প্রথম অংশ মার্কস-এর মত থেকে অভিন্ন কিন্তু দ্বিতীয় অংশটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গির অংশ। প্লাতনের ধারণা, চাহিদা যদি সর্বনিম্নে নামিয়ে আনা যায় তাহলে মানুষ খুব অল্প অর্থেই বেঁচে থাকতে পারে এবং এ কথা নিঃসন্দেহে সত্য। তাঁর আরও ধারণা, দার্শনিকদের কায়িক শ্রমের দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া উচিত, সুতরাং তাদের জীবনযাপন করতে হবে অপরের উপার্জিত বিত্তের উপর। অতি দরিদ্র রাষ্ট্রে কোনো দার্শনিক না থাকবারই সম্ভাবনা। পেরিক্লেস-এর যুগে আথিনীয় সাম্রাজ্যবাদ আথিনীয়দের পক্ষে দর্শনশাস্ত্র পাঠ সম্ভব করেছিল। বিস্তৃত অর্থে বলা যায় বৌদ্ধিক সম্পদ, অধিক পার্থিব পণ্যদ্রব্যের মতোই ব্যয়সাপেক্ষ এবং তাদের মতোই সেগুলো অর্থনৈতিক অবস্থা নিরপেক্ষ নয়। বিজ্ঞানের জন্য প্রয়োজন পাঠাগার, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগার, দূরবীক্ষণ যন্ত্র, অণুবীক্ষণ যন্ত্র ইত্যাদি। তাছাড়া বিজ্ঞানীদের ভরণ-পোষণ চলে অপরের পরিশ্রমে। কিন্তু রহস্যবাদীর কাছে এ সমস্তই মূর্খ। ভারত কিংবা তিব্বতের এক সাধুর কোনো যন্ত্রপাতি লাগে না, তিনি কৌপীন পরেন এবং শুধুমাত্র ভাত খান ও সামান্য দানে তাঁর ভরণ-পোষণ চলে, কারণ, লোকে তাকে জ্ঞানী ভাবে। প্লাতনের দৃষ্টিভঙ্গির এটাই যৌক্তিক বিকাশ।

ফায়েদ-র কথায় ফিরি ও মৃত্যুর পর আত্মার জীবিত থাকার ব্যাপারে সেবিস সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং সক্রাতেসকে যুক্তি দেখাতে বলেন। সাতেস যুক্তি দেখাতে শুরু করেন কিন্তু মানতেই হবে যুক্তিগুলো খুবই দুর্বল।

প্রথম যুক্তি হলো, যে সমস্ত বস্তুর বিপরীত বস্তু রয়েছে সেগুলো সৃষ্টি হয় তার বিপরীত বস্তু থেকে এই বক্তব্য আমাদের আনাক্সিমান্দ্রেসের মহাজাগতিক ন্যায্যতা সম্পর্কীয় দৃষ্টিভঙ্গি স্মরণ করিয়ে দেয়। জীবন এবং মৃত্যু বিপরীত এবং অবশ্যই একের অপরকে সৃষ্টি করতে হবে। এর থেকে মনে হয় মৃতদের আত্মা কোনো এক জায়গায় অবস্থান করে এবং যথাসময়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে। সেন্ট পলের কথায়, মৃত না হলে বীজ অঙ্কুরিত হয় না, মনে হয়, এ কথা ঐরকমই কোনো একটি তত্ত্বের অংশ।

দ্বিতীয় যুক্তি, জ্ঞান হলো স্মৃতি, সুতরাং জন্মের আগে আত্মার অস্তিত্ব অবশ্যই ছিল। জ্ঞান যে স্মৃতি এ তত্ত্ব প্রধানত সমর্থিত হয় আমাদের কতকগুলো ধারণা থেকে যে ধারণা অভিজ্ঞতাপ্রসূত নয়, যেমন নির্ভুল সমতা। আমাদের আসন্ন সমতার অভিজ্ঞতা রয়েছে কিন্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগুলোর ভিতর পরম সমতা কখনোই পাওয়া যায় না, অথচ পরম সমতা বলতে কী বোঝায় সেটা আমরা জানি। যেহেতু আমাদের এই জ্ঞান অভিজ্ঞতাপ্রসূত নয় সেইজন্য এই জ্ঞান নিশ্চয়ই আমরা পূর্বজন্ম থেকে এনেছি। অন্যান্য ধারণা সম্পর্কেও এই একই যুক্তি প্রযোজ্য। সুতরাং সার এর অস্তিত্ব এবং আমাদের সেটা বোঝার ক্ষমতা প্রমাণ করে জ্ঞানসম্পন্ন আত্মার পূর্ব অস্তিত্ব।

জ্ঞান পূর্বস্মৃতি- এই যুক্তি আরও বিস্তৃতভাবে বিকাশলাভ করেছে মেনন (৮২ff) তে। এখানে সক্ৰাতেস বলছেন, শিক্ষাদান বলে কিছু নেই, আছে শুধু স্মৃতি। এই যুক্তি প্রমাণ করার জন্য তিনি মেনো-কে দিয়ে একজন দাস বালককে ডাকিয়ে জ্যামিতিক সমস্যা সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। সাতেসের মতে, বালকটির উত্তর থেকে বুঝতে পারার কথা যে, সে সত্যিই জ্যামিতি জানে যদিও এতদিন পর্যন্ত সে তার অধিকৃত জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। ফায়েদ-র মতো মেনোতেও একই সিদ্ধান্ত করা হয় অর্থাৎ আত্মা পূর্ব অস্তিত্ব থেকে জ্ঞান নিয়ে আসে।

এ বিষয়ে বলা যেতে পারে যে, প্রথমত এই যুক্তি পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান সম্পর্কে একেবারেই প্রযোজ্য নয়। দাস বালকটি ঘটনাগুলো ঘটার সময় উপস্থিত না থাকলে পিরামিড নির্মাণের কাল অথবা ট্রয় অবরোধের সত্যতা তাকে স্মরণ করানো সম্ভব নয়। শুধুমাত্র সেই সমস্ত জ্ঞান যেগুলোকে অনুভব নিরপেক্ষ বলা হয় বিশেষ করে যুক্তিশাস্ত্র এবং গণিতশাস্ত্র-সম্ভবত সেগুলো অনুভব নিরপেক্ষভাবে প্রতিটি মানুষের ভিতরে বর্তমান। প্রকৃতপক্ষে, এ ধরনের জ্ঞানকেই (রহস্যবাদী অন্তদৃষ্টি ছাড়া) প্লাতন সত্যিকারের জ্ঞান বলে স্বীকার করেছেন। দেখা যাক, গণিতশাস্ত্র বিষয়ে এটা কতটা যুক্তিসহ।

সমতা সম্পর্কীয় ধারণা নিয়ে বিচার করা যাক। আমাদের অবশ্যই মানতে হবে যে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগুলোর ভিতরে নির্ভুল কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের নেই, আমরা শুধু আসন্ন সমতা দেখতে পাই। তাহলে আমরা পরম সমতার ধারণা কোথায় পাই? না কি এই ধরনের কোনো কল্পন হয়তো আমাদের নেই?

একটি বাস্তব ব্যাপার বিচার করা যাক। মিটারের সংজ্ঞা হলো এক বিশেষ তাপমাত্রায় প্যারিসে রক্ষিত একটি দণ্ডের দৈর্ঘ্য। অন্য কোনো দণ্ডে সম্পর্কে যদি বলি যে, তার দৈর্ঘ্য নির্ভুলভাবে এক মিটার তাহলে তার অর্থ কী হবে? তার কোনো অর্থ থাকবে বলে আমার মনে হয় না। আমরা বলতে পারি- বর্তমানকালে বিজ্ঞানের নির্ভুলতম মাপন পদ্ধতিতে আমাদের দণ্ডটি প্যারিসে রক্ষিত মানক মিটারের চাইতে দীর্ঘতর কিংবা হ্রস্বতর বলে প্রতীত হয় না। যথেষ্ট পরিমাণ হঠকারী হলে আমরা এর সঙ্গে একটি ভবিষ্যদ্বাণী জুড়ে দিতে পারতাম। আগামীতে মাপন পদ্ধতির কোনোরকম পরিশীলনে এই ফলাফলের তারতম্য হবে না। কিন্তু তবুও এটা একটা পরীক্ষাভিত্তিক বিবৃতি। তার অর্থে এই যে, পরীক্ষামূলক সাক্ষ্য যে কোনো মুহূর্তে এই বক্তব্যকে অপ্রমাণ করতে পারে। আমি মনে করি না প্লাতনের বক্তব্য অনুযায়ী পরম সমতা সম্পর্কীয় ধারণা আমাদের আছে।

কিন্তু যদি আমাদের থাকেও তবু এটা স্পষ্ট যে, একটি বিশেষ বয়স হওয়ার পূর্বে কোনো শিশুরই এরকম ধারণা থাকা সম্ভব নয়, যদিও এই ধারণা প্রত্যক্ষভাবে অভিজ্ঞতা আহরিত নয়। তবুও এ কল্পন অভিজ্ঞতার দরুনই উদ্ভাসিত। তাছাড়া, পূর্বজন্মের অস্তিত্ব যদি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অস্তিত্ব না হতো তাহলে সেই পূর্বজন্ম এই জন্মের মতোই এই ধারণা সৃষ্টি করতে অক্ষম হতো। আমাদের পূর্ব অস্তিত্বকে যদি অংশত অতি অনুভূতিসম্পন্ন বলে মনে করা যায় তাহলে বর্তমান জন্ম সম্পর্কে সেইরকম অনুমান করা হবে না কেন? এই সমস্ত যুক্তির ভিত্তিতে প্লাতনের যুক্তি ভেঙে পড়ে।

স্মরণ সম্পৰ্কীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠিত মনে করে সেবিস বলেছেন, প্রয়োজনের প্রায় অর্ধাংশ প্রমাণিত হয়েছে বুদ্ধির কাছে অর্থাৎ জন্মের আগে আমাদের আত্মার অস্তিত্ব ছিল- বাকি অর্ধেক অর্থাৎ আত্মার অস্তিত্ব যে মৃত্যুর পরে জন্মের আগের মতোই থাকবে তার প্রমাণ এখনও প্রয়োজন। তদনুসারে সক্রাতেস এই ব্যাপারে নিজেকে নিয়োগ করেন। তিনি বলছেন যে, প্রতিটি বস্তু তার বিপরীত থেকে জন্মগ্রহণ করে এ সম্পর্কে যা বলা হয়েছিল তা থেকেই সিদ্ধান্ত করা যায় যে, মৃত্যু অবশ্যই জীবন সৃষ্টি করবে, ঠিক যেমন জীবন সৃষ্টি করে মৃত্যু। কিন্তু তিনি আর একটি যুক্তি উপস্থিত করেন, দর্শনশাস্ত্রে এই যুক্তির ইতিহাস দীর্ঘতম যা জটিল শুধুমাত্র সেটাই বিঘটিত হতে পারে। এবং ধারণাগুলোর মতো আত্মারও সরল, নানাবিধ অংশ নিয়ে গঠিত হয়। মনে করা হয়, সরল বস্তু অনাদি অথবা অনন্ত অথবা অপরিবর্তনীয়। এখন সার বস্তু অপরিবর্তনীয়-উদাহরণস্বরূপ, পরম সৌন্দর্য সবসময়ই অভিন্ন অথচ সুন্দর বস্তুগুলো অবিরত পরিবর্তনশীল। সুতরাং দৃষ্টিগোচর বস্তুগুলো কালনির্ভর কিন্তু দৃষ্টি বহির্ভূত বস্তুগুলো চিরন্তন। দেহ দৃশ্য কিন্তু আত্মা অদৃশ্য সুতরাং আত্মাকে চিরন্তন বস্তুর শ্রেণিভুক্ত করা উচিত।

আত্মা চিরন্তন হওয়ায় চিরন্তন বস্তু চিন্তনের ব্যাপারে সে খুব পারঙ্গম, যেমন সার কিন্তু ইন্দ্রিয়ানুভূতির মতো ব্যাপারে পরিবর্তনশীল বস্তুর জগৎ সম্পর্কে চিন্তা করতে গেলে সে বিভ্রান্ত হয়, নিজেকে হারিয়ে ফেলে।

আত্মা যখন দেহকে অনুভূতির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে, বলা যায় দর্শনেন্দ্রিয়, শ্রবণেন্দ্রিয় কিংবা অন্য কোনো ইন্দ্রিয়কে ব্যবহার করে (কারণ দেহের মাধ্যমে অনুভব করার অর্থ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করা) …..তখন দেহ তাকে আকর্ষিত করে পরিবর্তনসম্ভব অঞ্চলে এবং সে বিচরণ করে ও বিভ্রান্ত হয়। বিশ্ব তার চতুস্পর্শ্বে ঘুরতে থাকে এবং পরিবর্তনকে স্পর্শ করলে সে মাতালের মতো হয়ে যায় …..। কিন্তু ফিরে আত্মস্থ হলে সে চিন্তা করে এবং তারপর প্রবেশ করে অন্য জগতে- সেই অঞ্চল বিশুদ্ধতার, চিরন্তনের, মৃত্যুহীনের ও অপরিবর্তনীয়ের। এগুলোই তার স্বজন, এদের সঙ্গেই সে চিরজীবী হয়ে থাকে যখন সে আত্মস্থ, তখন সে অবাধ কিংবা বাধাপ্রাপ্ত নয়, তারপর প্রমাদপূর্ণ চালচলন পরিবর্তন করে এবং অপরিবর্তনীয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে নিজেও অপরিবর্তনীয় হয়। আত্মার এই অবস্থাকেই বলা হয় প্রজ্ঞা।

প্রকৃত দার্শনিকের আত্মা জীবিত অবস্থায় দেহের অধীনতা মুক্ত হলে মৃত্যুর পরে অদৃশ্য জগতে প্রবেশ করবে এবং দেবতাদের সংসর্গে শান্তিতে বাস করবে। কিন্তু যে অপবিত্র আত্মা দেহের প্রণয়ে লিপ্ত ছিল সে প্রেত হয়ে কবরে কবরে ঘুরে বেড়াবে অথবা তার চরিত্র অনুযায়ী গাধা অথবা নেকড়ে বাঘ কিংবা বাজপাখির মতো কোনো পশুর দেহে প্রবেশ করবে। যে ব্যক্তি দার্শনিক না হয়েও ধার্মিক ছিল সে হবে একটি মৌমাছি বা বোলতা কিংবা পিঁপড়ে কিংবা কোনো সঙ্গপ্রিয় ও সামাজিক জীব।

শুধুমাত্র প্রকৃত দার্শনিকরা মৃত্যুর পর স্বর্গে যান। যে দর্শনশাস্ত্র পাঠ করেনি কিংবা লোকান্তরকালে যে সম্পূর্ণ শুদ্ধ ছিল না তাকে দেবতাদের সংসর্গে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না, যেতে দেওয়া হয় শুধু জ্ঞানপ্রেমীদের। তাই যারা দর্শনশাস্ত্রের প্রকৃত ভক্ত তাঁরা দৈহিক লালসা পরিত্যাগ করেন। তাঁরা যে দারিদ্র কিংবা অপমানকে ভয় করেন তা নয়, কিন্তু তারা এ বিষয়ে সচেতন যে আত্মাকে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল অথবা আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছিল দেহের সঙ্গে-দর্শনশাস্ত্র যতক্ষণ না তাকে গ্রহণ করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে বাস্তব অস্তিত্বকে শুধুমাত্র কারাগারের গরাদের ফাঁক দিয়ে দেখতে পায়, অন্তরে বা নিজের ভিতর দিয়ে দেখতে পায় না…. এবং লালসার কারণে নিজের কারাদণ্ডলাভের প্রধান সহায়ক হয়। দার্শনিকের হতে হবে মিতাচারী, কারণ প্রতিটি আনন্দ এবং প্রতিটি বেদনা এক এক ধরনের পেরেক এবং আত্মাকে দেহের সঙ্গে যুক্ত রাখে, শেষ পর্যন্ত আত্মা দেহের মতোই হয়ে যায় এবং বিশ্বাস করে দেহ যাকে সত্য বলে সেটাই সত্য।

এই স্থানে সিম্মিয়াস (Simmias) পুথাগোরীয় মতবাদ উল্লেখ করেন, সেই মতবাদ অনুসারে আত্মা একটি ঐকতান এবং তিনি নাছোড় হয়ে বলেন-বীণা ভেঙে গেলে কি ঐকতানের অস্তিত্ব থাকতে পারে? সক্রাতেস উত্তর দেন যে, আত্মা ঐকতান নয়, কারণ ঐকতান জটিল কিন্তু আত্মা সরল। তাছাড়া, তিনি বলছেন, আত্মা একটি ঐকতান-এ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অতীত অস্তিত্ব সম্পর্কিত মতবাদ খাপ খায়নি। অতীত অস্তিত্ব স্মৃতি সম্পর্কিত মতবাদ দিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল, কারণ, বীণার আগে ঐকতানের অস্তিত্ব থাকতে পারে না।

সক্রাতেস নিজের দার্শনিক বিকাশের একটি ইতিহাস দিয়ে শুরু করেন, সে ইতিহাস অত্যন্ত আকর্ষণীয় কিন্তু প্রধান যুক্তির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়। তিনি ধারণা সম্পর্কিত মতবাদ ব্যাখ্যা করতে থাকেন এবং তার ফলস্বরূপ সিদ্ধান্তে আসেন, ধারণাগুলোর অস্তিত্ব রয়েছে এবং অন্যান্য বস্তু ধারণাদের মধ্যে অংশগ্রহণ করে ও তাদের থেকেই সেগুলোর নামকরণ হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি মৃত্যুর পর আত্মার পরিণতির বিবরণ দেন- যারা ভালো তারা স্বর্গে যায়, যারা মন্দ তারা নরকে যায় আর যারা মাঝামাঝি তারা যায় বিশোধনাগারে।

তার অন্তিমকাল এবং বিদায় শুভেচ্ছার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। তাঁর শেষ কথাগুলো হলো-ক্রিত, আসক্লেপিয়স (Asclepius)-এর কাছে আমার একটি মোরগ ধার আছে, তুমি মনে করে ধারটা শোধ করবে? রোগমুক্তি হওয়ার পর লোকে আসক্লেপিয়সকে একটি মোরগের দাম দেয় এবং সক্রাতেসও জীবন জ্বরের আক্ষেপ থেকে মুক্ত হয়েছেন। ফায়েদ-র সিদ্ধান্ত, তাঁর সমকালীন সমস্ত মানুষের তুলনায় তিনি ছিলেন জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ, ন্যায়নিষ্ঠায় শ্রেষ্ঠ এবং সর্বোত্তম।

প্লাতন বর্ণিত সক্রাতের পরবর্তী বহু যুগ ধরে দার্শনিকদের প্রতিরূপ ছিলেন। নৈতিক দিক দিয়ে তাঁর সম্পর্কে আমাদের কী ভাবা উচিত? (প্লাতন যে মানুষটির বর্ণনা দিয়েছেন আমি শুধু তার কথা বলছি)। তাঁর গুণগুলো সুস্পষ্ট। পার্থিব সাফল্যে তিনি উদাসীন, ফলে তিনি এমনই ভয়শূন্য যে, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রশান্ত, মার্জিত ও রহস্যপ্রিয় ছিলেন। অন্য সব কিছু থেকে তাঁর কাছে সত্য বলে যা প্রতিভাত হয়েছে তার সম্পর্কে তিনি অধিকতর যত্নবান ছিলেন। তাঁর কিন্তু গুরুতর কয়েকটি দোষও রয়েছে। তর্কের ক্ষেত্রে তিনি অসৎ ও কুতার্কিক এবং তাঁর একান্ত চিন্তনে তিনি নিজের প্রিয় সিদ্ধান্তগুলো প্রতিষ্ঠা করার জন্য বুদ্ধিকে ব্যবহার করেন কিন্তু নিস্পৃহভাবে জ্ঞান অন্বেষণের জন্য। বুদ্ধিকে ব্যবহার করেন না। তাঁর মধ্যে একটি আত্মতৃপ্ত ভাব এবং আবেগ সম্পর্কে আন্তরিকতার অভাব আছে যা নিম্নশ্রেণির পাদ্রির কথা মনে করায়। দেবতাদের সঙ্গে অনন্তকাল সুখভোগ করবেন এ কথা বিশ্বাস না করলে মৃত্যুর মুখোমুখি তাঁর সাহস আরও উল্লেখযোগ্য হতো। পূর্বসূরির তুলনায় তার চিন্তন বৈজ্ঞানিক ছিল না কিন্তু তিনি নিজস্ব নৈতিক মান অনুসারে ব্রহ্মণ্ডকে মনোজ্ঞ প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এটা সত্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা এবং নিকৃষ্টতম দার্শনিক পাপ। আমরা বিশ্বাস করতে পারি মানুষ হিসেবে তিনি সাধুদের সংসর্গ লাভ করতে পারেন কিন্তু দার্শনিক হিসেবে তাঁর বৈজ্ঞানিক সংশোধনাগারে বহুদিন থাকা প্রয়োজন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *