সদ্য অধিকার বোধের পাখায় ভর করে গাড়ি থেকে মাহজাবীনের সঙ্গে সঙ্গে ভাইয়ানও নেমে আসে। পেছন পেছন দরোজা পর্যন্ত আসবার উদ্যোগ দেখে সে বলে, আপনি অপেক্ষা করুন।
চুপসে গিয়ে ভাইয়ান গাড়িতেও ঢোকে না, সঙ্গেও যায় না। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝুলি থেকে ঠিকানা লেখা কাগজটা বের করে আবার নম্বর মিলিয়ে নেয় মাহজাবীন। তারপর ভারি আর চওড়া কালো কাঠের দরোজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়! দরোজার গায়ে কোনো বেল বোম নেই। তাহলে? হঠাৎ তার মনে পড়ে যায়, এখানে যারা আছে, তারা জোর করে দখল করে আছে। সে দরোজায় করাঘাত করে। সাড়া পাওয়া যায় না। আবার করাঘাত করে। অপেক্ষা করে।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত সাড়া পাওয়া যায় না। ভুল ঠিকানা নয় তো? কিম্বা বাড়িতে কেউ নেই? এত অভিনয় করে একটা উজবুককে পটিয়ে এতদূর আসাটাই বৃথা হয়ে গেল? পেছন ফিরে তাকায়। রাস্তার ওপারেই পুলিশ থানা। এতক্ষণ থানার নীল চৌকো ডোমবাতিটা চোখে পড়ে নি। এখন দেখেই কেমন ভয় করে মাহজাবীনের। থানার এত কাছে? এদের সাহস আছে বলতে হয়?
ক্যাঁচ করে শব্দ হতেই প্রায় লাফ দিয়ে উঠেছিল আর কী। তাকিয়ে দ্যাখে চওড়া দরোজার ভেতর থেকে একটুখানি ফাঁক করে ঘন দাড়িওয়ালা এক শ্বেতাঙ্গ উঁকি দিয়ে নিঃশব্দে তাকে দেখছে। দরোজা ভেতর থেকে সেফটি-চেন দিয়ে আটকান।
অনেকক্ষণ পর দাড়ির ফাঁকে হাসি বিচ্ছুরিত হয়।
কাহারো সাক্ষাতপ্রার্থী?
হাঁ। আমার ভগ্নী এখানে থাকে।
তাহার কী নাম?
ইয়াসমিন। মাত্র গতরাত্রি আসিয়াছে।
হাঁ, উহারা ত্রিতলে আছে।
সে ভেতরের চেন খুলে দেয়। মাহজাবীন ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তড়িৎ গতিতে দরোজা বন্ধ করে দেয় তরুণটি। তারপর মাহজাবীনের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিপাত করে নিঃশব্দে হাসে। বলে, আমাদের সাবধান থাকিতে হয়। মালিক জোর করিয়া ঢুকিতে পারে। পুলিশ আসিতে পারে। ঐরূপ আলামত দেখিলে আমরা দরোজা খুলি না। তোমার ভগ্নী অপেক্ষা তুমি সুন্দর। যাও, সিঁড়ি বাহিয়া ত্রিতলে সর্বদক্ষিণ দরোজায় ঘা দিবে। সেখানে আছে।
সিঁড়িগুলো অত্যন্ত চওড়া এবং বেশ উঁচু উঁচু। দরোজা জানালা অতিকায়, ছাদ গগনস্পর্শী প্রায়। বাড়ির ভেতরে ভ্যাপসা গন্ধ। বাড়ির প্রাচীনত্ব, অধিবাসীদের বিচিত্র রান্না, আর তামাকের ধোঁয়া মিলিয়ে গন্ধটা স্থির ঝুলে আছে। মাহজাবীন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে না ভেবে পারে না, ইয়াসমিন এখানে থাকবে কী করে? শুভাকাঙ্ক্ষার ক্ষীণ একটা জ্যোৎস্না তার ভেতরে বিকীর্ণ হতে থাকে।
তেতলায় উঠে একেবারে ডান দিকের দরোজা আধো খোলা দ্যাখে সে। কাছে এসে উঁকি দেয়। কয়েকজন তরুণ তরুণীকে দেখা যায়। ইয়াসমিনকে দেখা যায় না। তারা মাহজাবীনের দিকে ফিরে তাকায়। কিন্তু অবাক হয় না, কিম্বা চোখে কোনো প্রশ্ন আঁকে না। একটি মেয়ে আমন্ত্রণের হাসি নিয়ে ভেতরে আসতে ইশারা করে তাকে। দরোজা ঠেলে। ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় ইয়াসমিনকে। ছেড়া এক টুকরো কার্পেটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, চোখ বোজা, মনে হয় মৃত। বুকের ভেতরে ছাৎ করে ওঠে মাহজাবীনের। পা অবশ হয়ে যায়। ব্যাকুল চোখে সবার দিকে দৃষ্টিপাত করে।
সে ঘুমাইতেছে।
মাহজাবীন তাকিয়ে দ্যাখে, গিটার কোলে এক তরুণ। তার আরো চোখে পড়ে, শুধু ইয়ামিন নয় আরো তিন জন ঘুমিয়ে আছে। এক তরুণ তরুণী প্রায় নগ্নদেহে নিবিড় আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে ঘুমুচ্ছে। ঘরের এক পাশে গ্যারাফিন হিটার জ্বলছে। তার উত্তাপে উষ্ণ এবং সুখী মনে হয় যুগলদেহ। ক্ষণকাল আগের আশংকায় মাহজাবীন নিজেই ব্ৰিত বোধ। করে। সহজভাব হাসে সে।
মার্ক বলে, আমি মার্ক, তুমি ইয়াসমিনের ভগিনী।
হাঁ, এই ব্যাগ দিতে আসিয়াছি। দেরি করিতে পারিব না।
মার্ক পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে ঘুমন্ত ইয়াসমিনকে দ্যাখে।
মাহজাবীন বলে, না, জাগাইও না। বলিও আমি আসিয়াছিলাম।
মাহজাবীন আবার ঘুমন্ত যুগলকে দ্যাখে। তরুণীটির স্তন সৌষ্ঠব তাকে মুগ্ধ করে। আরেক যুবক যে ঘুমন্ত নয়, দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে, স্থির দৃষ্টিতে দেখছে মাহজাবীনকে, তার পরনে কেবল অন্তর্বাস। যুবকের ধবধবে উরু সে এর আগে এত স্বাভাবিকভাবে দেখে নি। ক্ষণকাল তার চোখ সেখানেও আটকে থক। তারপর সে বলে, বলিও সব ঠিক আছে।
নেমে আসে মাহজাবীন। একেবারে নিচে পৌঁছুতেই, হলের পাশে টুক করে একটা দরোজা খুলে যায়। দাড়িওয়ালা সেই তরুণ উঁকি দেয়। তাকে দেখেই মৃদু হাসে। যেন বলতে চায়, হয়ে গেল। এর মধ্যেই চললে? মাহজাবীন তাকে বলে, এক মিনিটের মধ্যেই আমি আবার আসিতেছি, সঙ্গে একজন বন্ধু থাকিবে। আপত্তি নাই তো?
তরুণ সম্মতি দেয়।
মাহজাবীন বেরিয়ে হাত তুলে ইশারা করে ভাইয়ানকে ডাকে। সে তখনও পথের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ইশারা পেয়ে দ্রুত পায়ে কাছে আসে সে।
কী ব্যাপার?
আলাপ করাইয়া দিব।
কার সঙ্গে? বলতে বলতে ভাইয়ান দূরে গাড়ির ভেতরে বারীকে একবার চট করে দেখে নিয়ে, উত্তরের অপেক্ষা না করেই মাহজাবীনকে অনুসরণ করে।
সেই রুশ সেফটি-চেন লাগিয়ে দরোজা ফাঁক করে এতক্ষণ দেখছিল, এখন দরোজা খুলে দেয়। তাকে দেখে একটু হকচকিয়ে যায় ভাইয়ান। তরুণ এখন নিঃশব্দে হাসে, সে আরো অপ্রস্তুত বোধ করে।
মাহজাবীন তাকে আশ্বস্ত করে বলে, বন্ধু।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে দুজন। ভাইয়ান ভ্যাপসা গন্ধটার জন্যে রুমাল বের করবে কি না চিন্তা করে। বদলে জিগ্যেস করে, এখানে কারা থাকে?
মানুষ।
তেতলায় পৌঁছে যায় ওরা। তেতলায় একেবারে ডান দিকের ঘরে ঢুকে জড়াজড়ি করে থাকা যুগলকে দেখে ভাইয়ানের চোখ কপালে উঠে যায়। মেঝের ওপর শুয়ে থাকা, বসে থাকা মানুষগুলোকে দেখে ভীষণ অপ্রতিভ বোধ করে।
মার্কের দিকে তাকিয়ে মাহজাবীন ক্ষমা প্রার্থনার নীরব হাসি নিবেদন করে। উত্তরে স্নান হাসে মার্ক।
ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারে না ভাইয়ান। তার দৃষ্টি এবার আবিষ্কার করে সবগুলো শাদার ভেতরে একটি বাদামি। ঘুমিয়ে থাকা ইয়াসমিন।
মাহজাবীন ইয়াসমিনের দিকে আঙুল তুলে ভাইয়ানকে বলে, ভালো করিয়া দেখিয়া লউন। আমার জেষ্ঠা ভগিনী। উহাকেই আপনার দেখিতে আসিবার কথা। পছন্দ করিবার কথা। আমাকে নহে।
হতভম্ব হয়ে যায় ভাইয়ান। ইয়াসমিনের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারে না।
মাহজাবীন তীব্র গলায় বলে, আর উহাকে দৃষ্টি দিয়া লেহন করিবেন না।
নিচে নেমে, পথে বেরিয়ে মাহজাবীন বলে, বজ্রাহত হইবার অভিনয় না করিলেও চলিবে। আপনার বন্ধুটির মতো আপনিও কন্যা দেখিয়া বেড়ান, বাংলাদেশের বাজারে বহু গাভী আছে।
গাড়ির কাছে এসে মাহজাবীন বলে, নাসরিন, বাহির হও।
তুমি কি আজই বায়োনিক উম্যান কিনিয়া দিবে?
বাহির হও।
মাহজাবীন সরাসরি না তাকিয়েও টের পায়, বসন্তমুখে কালো টেকো ডাক্তারটি কিছু না বুঝেই বোকা হয়ে গেছে, একবার তার দিকে, একবার ভাইয়ানের দিকে তাকাচ্ছে।
পাতাল রেলপথে বাড়ি ফিরে মাহজাবীন ঘোষণা করে, মাম, ভাবিও না। সে বিদায়। হইয়াছে।
মিস্টার আলি উদ্বিগ্নস্বরে জানিতে চান, কটু ব্যবহার করিস নি তো?
বুঝিলাম না।
জানিতে চাহিতেছি, রূঢ়ভাবে বিদায় দাও নাই তো? সে যে তোমাকে পৌঁছাইয়া দিল না?
সে চাহিয়াছিল।
ও। আশ্বস্ত হন আলি।
ড্যাডি, তোমার নিন্দা হইতে দিব না। বিদায় মুধর হইয়াছিল।