১৬. অজন্তা ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকল

ফরিদা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কে?

দরজার পাশ থেকে কে যেন সরে গেল। ফরিদা বললেন, ভেতরে এস অজন্তা। অজন্তা ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকল। তার গায়ে স্কুলের পোশাক, হাতে বই-খাতা এবং পানির ফ্লাস্ক। বলল, স্কুলে যাচ্ছ? অজন্তা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মাকে সে খুব ভয় পায়।

তুমি আরেকটু কাছে আসি তো। তোমাকে ভাল করে দেখি। অজন্তা পায়ে পায়ে এগিয়ে এল। ফরিদা বললেন, তুমি আগের চেয়ে একটু লম্বা হয়েছ তাই না?

হুঁ।

কত লম্বা হয়েছ জানো সেটা? মেপেছ কখনো?

না।

তাহলে বুঝলে কী করে লম্বা হয়েছ?

জামাটা ছোট হয়েছে।

তাই তো, জামা ছোট হয়েছে। আজ তোমার বাবাকে বলবে কাপড় কিনে যেন দরজির দোকানে দিয়ে আসে।

আচ্ছা।

তুমি কী স্কুলে যাবার আগে রোজই আমার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাক?

অজন্তা জবাব দিল না। মাথা নিচু করে ফেলল।

আমি বেঁচে আছি কিনা তাই দেখ, ঠিক না?

অজন্তা কথা বলল না, মাথাও তুলল না। তার খুব অস্বস্তি লাগছে। মাকে কেন জানি একই সঙ্গে ভয় লাগে এবং ভাল লাগে।

ফরিদা বললেন, আমি আরো মাসখানিক বেঁচে থাকব।

অজন্তা এবার চোখ তুলে তাকাল। তার চোখে স্পষ্ট শংকার ছায়া। ফরিদা বললেন, তোমাকে আগেভাগে বললাম যাতে মনে মনে তৈরি হতে পার। এখন যাও।

অজন্তা দরজা পর্যন্ত যেতেই ফরিদা বললেন, তোমার বাবাকে বলবে আজ যেন সে তোমাকে স্কুলে দিয়ে বাসায় চলে আসে। তার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে। বলবে মনে করে। আর নিচে খটখট শব্দ হচ্ছে কিসের দেখ তো। শব্দ আমার সহ্য হয় না। তবু সবাই মিলে এত শব্দ করে। ফরিদা চোখ বন্ধ করে ক্লান্ত শ্বাস ফেললেন।

দবির সাহেবের খুব অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। ফরিদা তাকে কী বলতে চায় এটা তিনি ঠিক আঁচ করতে পারছেন না। তিনি মেয়েকে কয়েকবারই জিজ্ঞেস করলেন সে কী বলেছে জরুরি কথা?

অজন্তা বলল, হুঁ।

কী এমন জরুরি কথা তা তো বুঝলাম না।

অজন্তা বলল, বাবা তুমি কী মাকে ভয় পাও?

দবির সাহেব লজ্জা পেয়ে গেলেন। ভয় পান না। এত বড় মিথ্যা মেয়েকে সরাসরি বলতে পারেন না। তার এই মেয়ে খুব বুদ্ধিমতী হয়েছে।

অজন্তাকে স্কুলে নামিয়ে চিন্তিতমুখে দবির সাহেব বাসার দিকে রওনা হলেন। তার কেবলি মনে হতে লাগল, ফরিদা নিশ্চয়ই তিথির কথা তুলবে।

তিথি প্রসঙ্গে ফরিদা এখন পর্যন্ত তাকে কিছুই বলেনি। যদিও তিনি নিজ থেকে হড়বড় করে অনেক কিছু বলেছেন। ফরিদা চোখ বড় বড় কবে শুনেছে। কিছুই বলেনি। এটা ফরিদার স্বভাব। কোনো–একটা ঘটনা ঘটে যাবার অনেক দিন পর ফরিদা সেই প্রসঙ্গে কথা বলবে। মনে হয় দীর্ঘদিন সে ঘটনা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। এক সময় স্থির সিদ্ধান্তে আসে। তখন কথা বলে। আজো কী সে কোনো সিদ্ধান্তে এসেছে?

আসব ফরিদা!

ফরিদা হেসে ফেলে বললেন, আমার ঘরে আসতে তো আগে কখনো অনুমতি নিতে না। আজি নিচ্ছে কেন? এস, বাস। দবির উদ্দিন শুকনো গলায় বললেন, তোমার শরীর কেমন?

ভালই। খুবই ভাল।

দবির উদ্দিন চিন্তিত মুখে ফরিদাকে লক্ষ্য করলেন–আজ তাকে অন্য রকম দেখাচ্ছে। চোখে-মুখে অস্বাভাবিক এক উজ্জ্বলতা। ফরিদা বললেন,

আমি আর মাসখানিক আছি।

কী বললে বুঝলাম না।

আমি আর মাসখানিক তোমাকে বিরক্ত করব তারপর তোমার মুক্তি।

দবির উদ্দিন অস্পষ্ট স্বরে বললেন, কী যে তুমি বল।

ফরিদা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, এখন পর্যন্ত আমি কী কখনো আজেবাজে কথা কিছু বলেছি?

দবির উদ্দিন হ্যাঁ-না কিছু বলতে পারলেন না। ফরিদা মৃদু হাসলেন। পর মুহূর্তেই হাসি গিলে ফেলে বললেন, কী করে বুঝলাম এক মাস আছি তা তো জিজ্ঞেস করলে না।

কী করে বুঝলে?

আমার দুই বান্ধবীর কথা তোমাকে বলেছি না? কাল শেষরাতে তারা আমার ঘরে এসেছিল। এসে বসল। আমার পায়ের কাছে। তখন রাত চারটা দশ। আমার মনে আছে, ওরা ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘড়ি দেখলাম। ওরা বলল, ফরিদা তোকে ছাড়া আমাদের কেমন জানি একলা লাগে। তুই চলে আয়। আমরা তোকে নিতে এসেছি। আমি বললাম, আমার নিজেরো এখানে থাকতে আর ভাল লাগছে না। তোরা এসেছিস ভালই হয়েছে। তবে এখানকার কাজকর্ম গুছিয়ে তারপর যাব। তোরা এক মাস পরে আয়। তারা বলল, আচ্ছা।

দবির উদ্দিন বললেন, এইসব হচ্ছে স্বপ্ন। স্বপ্নে মানুষ কত কিছু দেখে, স্বপ্ন নিয়ে মাথা ঘামানো ঠিক না।

তুমি সব সময় বাজে কথা বল। আমি কী বলছি শোন এটা স্বপ্ন না।

আচ্ছা বেশ, স্বপ্ন না।

আমি আমার মেয়েটার জন্যে চিন্তা করি। আমি মারা যাবার পর সে খুব কষ্টে পড়বে।

কষ্টে পড়বে না। ওকে আমি কী পরিমাণ ভালবাসি এটা তুমি জানো না।

জানি। জানব না কেন। তুমি অজন্তার নামে এই বাড়িটা লিখে দাও। দলিল-টলিল করবে মিউটেশন করবে। সব ঝামেলা এক মাসের মধ্যে শেষ করবে।

তার কোনো দরকার আছে?

না থাকলে বলছি কেন।

তুমি যা চাও তাই হবে।

ফরিদা চোখ বন্ধ করে ফেললেন। এতক্ষণ এক নাগাড়ে কথা বলে তিনি সম্ভবত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। চোখ মেললেন অনেকক্ষণ পরে। দবির উদ্দিন বললেন, আমি কী এখন চলে যাব? জরুরি কিছু কাজ ছিল।

আর খানিকক্ষণ বাস। তোমাকে আরো একটা কথা বলা প্রয়োজন। আজই বলে ফেলি।

বল।

তিথিকে নিয়ে তুমি যে বের হয়েছিলে এতে আমি রাগ করিনি। মানুষ ফেরেশতা নয়। তুমি দিনের পর দিন একা কাটিয়েছ। শরীরের একটা দাবি তো আছেই। আমি কিছু মনে করি না।

তিথির সঙ্গে কথা বলা ছাড়া আমি…

জানি। তবে কথা বলার বাইরে কিছু হলেও কোনো ক্ষতি ছিল না। এই ব্যাপারটা আমার নিজেরই দেখা উচিত ছিল। দেখতে পারিনি।

দবির উদ্দিন ক্ষীণ গলায় বললেন, এই প্রসঙ্গটা থাক।

থাকবে কেন? লজ্জা পাচ্ছ?

হুঁ।

লজার কিছু নেই। তুমি তাকে নিয়ে বের হতে যদি লজ্জা না পাও কথা বললো লজ্জা পাবে কেন? তাছাড়া তোমাকে লজ্জা দেবার জনোও বলছি না। ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা উচিত তাই আলোচনা করছি।

বেশ আলোচনা কর।

দবির উদ্দিন মাথা নিচু করে ফেললেন, ফরিদা এই দৃশ্য দেখে কেন জানি হেসে ফেললেন।

তুমি কী আমাকে পাশ ফিরিয়ে দিবে? এখন আর নিজে নিজে পাশ ফিরতে পারি না।

দবির উদ্দিন স্ত্রীকে পাশ ফিরিযে দিলেন। ফরিদা বললেন, তুমি যখন লজ্জা পাচ্ছি তখন ঐ প্রসঙ্গ থাক। তোমাকে লজ্জা দিতে ইচ্ছা করছে না। বরং অন্য একটা প্রসঙ্গে কথা বলি।

বল।

আমি সংসারের খরচ থেকে কিছু টাকা আলাদা করে রাখতাম এটা তুমি নিশ্চয়ই জানো?

জানি।

পরশু হিসাব করলাম। আমার ধারণা ছিল অনেক টাকা হয়েছে। আসলে অনেক হয়নি। অল্পই জমেছে…

তোমার টাকার দরকার থাকলে বল আমি তোমাকে দিচ্ছি।

কথা শেষ করার আগেই তুমি কথা বল কেন? বড় বিবক্ত লাগে। যা বলছিলাম শোন, আমি পরশুদিন দেখি মাত্র এগার হাজার তিনশ তেত্ৰিশ টাকা জমেছে। এই টাকাটা দিয়ে কী করা যায় বল তো?

কী করতে চাও?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না। বুঝতে পারলে কী তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম?

অজন্তাকে দিয়ে দাও।

না। ওকে যা দেবার তুমিই দেবে, আমি এই টাকাটা তিথিকে দিতে চাই।

দবির উদ্দিন এই কথায় তেমন বিস্মিত হলেন না। তার কেন যেন মনে হচ্ছিল ফরিদা এই কাজটিই করবে। তিনি বললেন, ও তোমার টাকা নেবে না।

কেন নেবে না?

তা জানি না। তবে সে যে নেবে না। এইটুকু জানি।

আমারও তাই ধারণা। তবে ও যেন নেয়। সেই ব্যবস্থা সহজেই করা যায়।

কী ভাবে?

আমি মরবার পর তুমি তাকে বল টাকাটা আমি তার জন্যে রেখে গেছি তাহলে সে একটা সমস্যায় পড়বে। জীবিত মানুষের কথা আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি মৃত মানুষের কথা পারি না। তাছাড়া আমি তাকে একটা চিঠিও লিখে রেখে যাব। তুমি খুব দামী কিছু কাগজ কিনে এনো তো।

দামী কাগজ লাগবে কেন?

শেষ চিঠিটা দামী কাগজে লিখতে ইচ্ছা করছে।

বেশ, আনব দামী কাগজ। এখন তাহলে উঠি?

না, আরেকটু বস।

ফরিদা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন। দবির উদ্দিন অস্বস্তি বোধ করছেন তার কাছে ফরিদার দৃষ্টি খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। তার চোখ তো এত উজ্জ্বল কখনো ছিল না। ফরিদা বললেন, চিঠিটা লিখব কী করে বল তো? আমি তো হাতই নাড়তে পারি না।

আমি লিখে দেব।

ফরিদা হাসলেন। প্রথমে মৃদু স্বরে, পরক্ষণেই সেই হাসি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। দবির উদ্দিন হাসির কারণটা ধরতে পারলেন না। তার কাছে মনে হচ্ছে এই হাসি স্বাভাবিক মানুষের হাসি না। একজন অসুস্থ মানুষের হাসি।

ফরিদা বললেন, তুমি আমার হাতটা একটু ধর তো, দেখি কী ভাবে হাত ধর।

কী বললে?

আমার হাতটা একটু ধর।

দবির উদ্দিন, ফরিদার হাতে হাত রাখলেন। রোগশীর্ণ পাণ্ডুর হাত। নীল শিরাগুলি পর্যন্ত ফুটে রয়েছে। ফরিদা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, কারণে-অকারণে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, তুমি কিছু মনে করো না।

ফরিদার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *