১৬। বায়ুযান

১৬। বায়ুযান

যে নীলনদ কয়েক দিন আগে যেন অজ্ঞাতে ইরতেনসেনুদের বিদ্রুপ করছিল সেই নদীই আজ তাদের বিরাট কর্মযজ্ঞে প্রাণস্থাপন করেছে। নীলনদ থেকে বেশ কিছু খাল কেটে জল নিয়ে আসা হয় নদীর অববাহিকার দু’পাশে। এই জল কৃষিতে সেচের কার্যে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু একটি খালের কর্মপদ্ধতি কেবল ভিন্ন।

এই খালটি এসে মিশেছে রাজপ্রাসাদের সামান্য দূরে অবস্থিত একটি মাঝারি আকারের নিলয়ে। এই নিলয়টি আসলে একটি স্নানাগার। শহরের উচ্চবিত্ত মানুষেরা এটি ব্যবহার করেন। নদীর জল খালের মাধ্যমে এসে এই স্নানাগারে প্রবেশ করে। তিনটি বেশ বড় আকারের কৃত্রিম জলাধারে জমা হয় এই জল। এই জলাধারের নীচের ছোট কক্ষে আগুন জ্বালিয়ে এর জলকে উষ্ণ রাখা হয় যাতে ধনীরা আরামে স্নান করতে পারেন।

খালটি থাকার কারণে এই জলাধারগুলির জল সদা প্রবাহিত, যাতে শরীর প্রক্ষালিত নোংরা জল এতে জমা না হয়, সেই জল স্নানাগার থেকে অন্য একটি পথে বেরিয়ে ভূগর্ভে মিশে যায়। সাতদিন আগে ফারাও- এর পক্ষ থেকে একটি আকস্মিক বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয় শহরে। তাতে জানানো হয় যে স্নানাগারটিকে এখন থেকে পরবর্তী নির্দেশ না আসা অবধি অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবেন না। ফারাওয়ের অতিথি অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনু তাদের কোনও এক ব্যক্তিগত প্রয়োজনে স্নানাগারটির অধিকারী হবে। এরপর শহরের মানুষ অবাক হয়ে দেখল এক অদ্ভুত কর্মকাণ্ডের সূচনা হয়েছে স্নানাগারটিকে ঘিরে এবং তার কয়েক পা দূরে নদীর তীরে।

স্নানাগারটির চারদিকে বিরাট আকারের অসংখ্য কলস রাখা। তাদের এক একটির মধ্যে অনায়াসে দু’জন মানুষ স্থান নিতে পারবে। অগস্ত্য এবারে তার শক্তি উৎপাদনকারী যন্ত্রটিকে আরও বড় আকারে তৈরি করেছে। কলসের মধ্যে রাখা আছে একটি তামা এবং একটি দস্তার পাত। এই দুটি পাতের মাঝখানে আছে কাঠের গুঁড়ো, কলসের নীচের অংশ থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি করে সরু তামার তৈরি তার। দুটি কলসকে রাখা আছে স্নানাগারের মুখ্যদ্বারের সামনে। এই দুই কলস থেকে বেরিয়ে এসেছে দুটি অপেক্ষাকৃত স্থুল তামার তার, তারগুলি স্নানাগারের ভিতরে ঢুকে গেছে।

স্নানাগারের একটি জলাধারের উপরে উল্লম্ব ভাবে রাখা আছে দুটি বেশ বড় আকারের লোহার পাত। এর মধ্যে একটি লোহার পাতের উপরে তৈরি করা হয়েছে একটি কক্ষ। এই কক্ষের কোন দরজা বা জানালা নেই, নিশ্ছিদ্র এই কক্ষের একটি মাত্র অংশে একটি ছোট ফাঁকা স্থান আছে, সেই খান থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি লম্বা ধাতব নল। নলটি এগিয়ে গেছে নদীর তীরের দিকে। সেখানে আরও এক আশ্চর্য কাণ্ড হচ্ছে। তার তদারকিতে আছে ইরতেনসেনু।

নদীর তীরের একটি বড় অংশকে ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে পঞ্চাশ জন স্ত্রী-পুরুষ মিলে দিবারাত্রি অক্লান্ত পরিশ্রম করে বানিয়েছেন একটি নরম কাপড়। কাপড়টির সুতো আসে ভারতবর্ষ থেকে। সাধারণত বস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এই সুতো। কাপড়টি দৈর্ঘ্যে প্রায় বারো মানুষ এবং প্রস্থে আট মানুষের সমান। বড় অদ্ভুত উপায়ে একে প্রস্তুত করা হয়েছে। মিশর দেশে এক প্রকারের বৃক্ষ পাওয়া যায়, যার স্থানীয় নাম মকোন

এই বৃক্ষের কাণ্ডে আঘাত করলে দুধের মতো সাদা আঠালো রস বেরিয়ে আসে। সেই রস শুকিয়ে গেলে যে পদার্থের জন্ম হয় তা ভীষণ ভাবে স্থিতিস্থাপক। মিশরীয়রা মকোন গাছের এই রস ব্যবহার করে আসবাবপত্র তৈরির কাজে। এই রসের মধ্যে কাপড়টিকে প্রথমে নিমজ্জিত করে রাখা হয়েছিল। এর ফলে কাপড়ের দু’দিকেই শুকিয়ে যাওয়া রসের দুটি পাতলা আস্তরন তৈরি হয়েছে। তারপরে সেটিকে আবার নিমজ্জিত করা হয় নেসের নামের আরেকটি বৃক্ষজাত রসে, এই রসের বর্ণ হালকা হলুদ এবং এর একটি ঝাঁঝালো গন্ধ আছে।

নেসেরের রস কাপড়ের গাত্রে শুকিয়ে যাওয়ার পর তার উপরে লাগানো হয়েছে মোম, গুঁড়ো চিনি এবং চুনামাটির মিশ্রন। এতে কাপড়টি বেশ শক্তপোক্ত তো হয়েইছে এবং তার সঙ্গে হয়েছে নিশ্ছিদ্র, আবার এর নমনীয় ভাবও নষ্ট হয়নি। কাপড়টির প্রান্তগুলিকে মোটা সুতো দিয়ে সেলাই করা হয়েছে এমন ভাবে যে সেটি ছোট হয়ে একটি বৃত্তাকার অংশে পরিণত হয়েছে। এই গোলাকার অংশের ব্যস এক হস্ত। এই অংশে স্নানাগার থেকে বের হওয়া ধাতব নলটি প্রবেশ করেছে।

কাপড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে একশোটি শক্ত রজ্জু। সেই রজ্জুগুলি এসে লেগেছে একটা আয়তকার চুপড়ির গায়ে। চুপড়িটি তৈরি করা হয়েছে প্যাপিরাস গাছের শুকনো কাণ্ড এবং খড় দিয়ে। এই চুপড়িতে অনায়াসে ছয়-সাতজন মানুষ পাশাপাশি বসতে পারবে। এটিই তাদের বায়ুযান।

গোটা কর্মকাণ্ডটি সম্পন্ন হতে সময় লাগল দশদিন। দশমদিনের সন্ধ্যাবেলায় অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনু ফারাও হাতসেপসুতের সাক্ষাৎপ্রার্থী হল।

‘থীবসের মানুষ অস্থির হয়ে উঠেছে ইরতেনসেনু। জনগনের মধ্যে আমি চর মারফত এই খবর প্রচার করেছি যে, এক আশ্চর্য জাদুবিদ্যা তুমি এবং অগস্ত্য রপ্ত করে এই দেশে এসেছ। সেই জাদু দেখাবার জন্যই এই কাণ্ড করা।’

‘তাদের কৌতূহল স্বাভাবিক ফারাও। তবে জাদুর জন্য তাদের আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।’ হাসিমুখে বলল ইরতেনসেনু।

‘আমাদের কার্য সমাধা হয়েছে। আপনার আশীর্বাদ পেলে আমরা আগামীকালই যাত্রা করতে পারি।’

‘অতি উত্তম, মহান দেবী হাথোর তোমাদের সহায় হোক। কখন যাত্রা শুরু করবে তোমরা?’

‘আগামীকাল ভোরেই। আমি, অগস্ত্য, উপল এবং বাকারি যাব।’

‘বাকারি?’

‘হ্যাঁ ফারাও। বাকারি নিজেই যেতে চেয়েছে। আমরা এখানে এসে পৌঁছনোর পর থেকে সে আমাদের প্রভূত সাহায্য করছে। তার মতে এই যাত্রায় মিশরের রাজপরিবারের একজন প্রতিনিধির অন্তত থাকা উচিত। সে হয়তো আমাদের ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। পুন্তের বৃক্ষ সে নিজ দায়িত্বে এই ভূখন্ডে ফিরিয়ে আনতে চায়। আমরা তার ভাবনায় কোন ভুল দেখি না। তাই তার প্রস্তাবে সম্মত হয়েছি।’

‘বেশ, তাই হোক তবে। তোমাদের আর কোনও কিছুর প্রয়োজন হলে জানিও আমাদের।’

‘না ফারাও, আপনার প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া এই বায়ুযানটি তৈরি করা একেবারেই অসম্ভব ছিল। যাত্রাপথের জন্য কিছু শুকনো খাবার এবং জল আমরা নিয়ে নিয়েছি।’

‘তবু একটি চিন্তা আমাকে পীড়িত করছে ইরতেনসেনু। তোমরা এই বায়ুযানে করে যদি নদীর উৎসে পৌঁছেও যাও তাহলেও ফিরবে কীভাবে? তোমাদের কথা মতো একমাত্র বায়ুর গতির অভিমুখেই এই যান চলতে পারে। ফেরার সময় বিপরীতমুখী বায়ুতে একে ব্যবহার করবে কী করে?’

‘আপনার এই চিন্তা অমূলক নয়। যদি ঈশ্বরের আশীর্বাদে আমরা পুন্ত নগরীতে পৌঁছে যাই তাহলে সেখানে আমাদের এই যানকে পরিত্যাগ করতে হবে। যাত্রাপথে উপল নদীর গতিপথ এবং অববাহিকার নকশা আঁকতে থাকবে। আমাদের আশা সেই নকশা ধরে আমরা ফিরে আসতে পারব।’

‘আশা?’

হাতসেপসুতের গলার স্বর হতোদ্যম শোনাল। ক্ষনিকের জন্য ইরতেনসেনুর মুখের আলো নিভে গেল, সে বলল, ‘হ্যাঁ ফারাও। এইটুকুর উত্তর এখনও আমাদের কাছে নেই। এখন যেকোন ভাবে পুন্ত নগরী পৌঁছনোই আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য।’

‘কিন্তু সেশেনুর অরণ্যের প্রবেশ করে আজ অবধি কেউই ফিরে আসেনি ইরতেনসেনু। অরণ্যের মধ্যে নদীর গতিপথ নির্দিষ্ট করলেও তোমরা ফিরতে পারবে?’

হয়তো শেষ বারের মতো ইরতেনসেনুর মুখখানি দেখছেন, এই আশঙ্কায় হাতসেপসুতের চোখে মুখে কাতরতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। তাঁর চোখের কোণে জলের ফোঁটা জমতে শুরু করল। ইরতেনসেনু এগিয়ে এসে তাঁর বাহু স্পর্শ করে বলল, ‘স্বয়ং দেবী হাথোরের আশীর্বাদ আমাদের সঙ্গে আছেন। বিজ্ঞান সব কিছুর উত্তর দিতে পারে না। আমার বিশ্বাস শুধুমাত্র বুদ্ধির বলে আমরা আজ এই স্থানে এসে পৌঁছতে পারতাম না। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আমাদের সহায়। বিপদে তিনিই আমাদের রক্ষা করবেন।’

অগস্ত্য এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার সে বলল, ‘এখন আমাদের বিদায় নিতে হবে ফারাও। শেষ মুহূর্তের কিছু কাজ এখনও বাকি রয়ে গিয়েছে। আগামীকাল ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে-সঙ্গেই আমরা যাত্রা শুরু করে দেব। তবে বিদায় নেওয়ার আগে আপনাকে একটি প্রশ্ন আমি করতে চাই। প্রশ্নটি এই যাত্রার সঙ্গে একেবারেই সংযুক্ত নয়, বলতে পারেন আমার অনুসন্ধিৎসু মনের অকারণ কৌতূহল থেকেই এর জন্ম। আপনি অভয় দিলে প্রশ্নটি করতে পারি আমি।’

‘অবশ্যই বলো।’

‘প্রশ্নটি প্রাক্তন মহামন্ত্রী সেনেনমুতের প্রসঙ্গে। আপনি নিশ্চয় বহু বছর ধরে তাঁকে চিনতেন।’

‘অবশ্যই, তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ সেই কবেকার। সেনেনমুত ত্রিশ বছর বয়সে এই দেশে আসেন। নিজের পরিচয় দেন এক ভিনদেশি নাগরিক হিসাবে, যে এই দেশে বসবাস করতে চায়। তখন আমার বয়স মাত্র পনেরো। ভিনদেশি হলেও সেনেনমুত মিশরীয় ভাষায় দক্ষ ছিলেন, দারুণ বুদ্ধিমানও ছিলেন। তাঁর কূটনৈতিক বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে আমার পিতা প্রথম তুতমোসে তাঁকে রাজমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ করেন।

‘পিতার মৃত্যুর পর আমার স্বামী দ্বিতীয় তুতমোসের রাজত্বকালেও একই পদের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সেনেনমুতের মতো প্রজ্ঞাবান এবং সৎ ব্যক্তি আমি এই জীবনে আর দুটি দেখিনি। আমি এক নারী হয়েও যে মিশরের ফারাও রূপে অধিষ্ঠিত হলাম, এটি সেনেনমুতের সাহায্য এবং বুদ্ধি ছাড়া সম্ভব ছিল না।’

হাতসেপসুতের কথায় অগস্ত্য কিছুটা অবাক হল। সেনেনমুত জন্মসূত্রে মিশরীয় ছিলেন না? এক ভিনদেশি? যেমন অগস্ত্য এবং উপল? যারা বিদর্ভে বসবাস করলেও তাদের জাতির উৎস অন্যত্র। এই চিন্তা মনে এলেই পীড়াবোধ করে অগস্ত্য, সেইসঙ্গে এক হীনমন্যতা যেন গ্রাস করতে চায় তাকে। তাই এই চিন্তার অঙ্কুরকে আর বাড়তে না দিয়ে পরের প্রশ্নটি করল সে, ‘আপনি সেনেনমুতকে তাঁর মৃত্যুর আগে দেখেছিলেন?’

এই প্রশ্নে রানির মুখশ্রী করুণ হয়ে এল। ‘রোগশয্যায় তাঁকে আমি দেখেছি।

‘ক্ষমা করবেন রানি। অনুমান করতে পারছি সেনেনমুতের মৃত্যু আপনাকে কতটা কষ্ট দিয়েছে। তবু একটি কথা আমার জানা প্রয়োজন।’

‘বলো।’

‘সেনেনমুতের কী রোগ হয়েছিল সেটা কী বলতে পারবেন?’

‘না, পারব না। থীবসের প্রধান বৈদ্যও বুঝতে পারেননি রোগটা।’

অগস্ত্য যেন এবারে একটু অবাক হল, ‘কী ধরণের উপসর্গ ছিল তাঁর?’

‘সেনেনমুত সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু হঠাৎই একদিন শুনি তিনি উদরের বেদনায় ভুগছেন, তাই সভায় আসতে পারেননি। এমন করে কয়েকদিন গত হওয়ার পর আমি তাঁর গৃহে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। সেদিন তাঁকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। গোটা দেহ গাঢ় হলুদ বর্ণের ছিল, যেন কেউ ভারতীয় হরিদ্রা লেপন করেছে তাঁর সর্বাঙ্গে।

‘শয্যা থেকে মাথা তুলতে পারছিলেন না। এর কিছুদিনের মধ্যে মারা যান সেনেনমুত। বাকারি সেই সময় দিনরাত জেগে পিতার সেবা করেছে, অমন সন্তান পাওয়া যে-কোনও পিতার কাছে সৌভাগ্যের। তুমি তার সঙ্গে কথা বলতে পারো। পিতার অসুস্থতার ব্যাপারে অবশ্যই আরও ভালো ভাবে বলতে পারবে।’

হাতসেপসুতের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসার সময় ইরতেনসেনু খেয়াল করল অগস্ত্যর চোখ মুখ থমথমে। কিছু পথ হেঁটে আসার পর সে রাস্তার মাঝে হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়ল, বলল, ‘আমি একটু আসছি। তুমি উপলের সঙ্গে আগামীকালের যাত্রার তদারকি করো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমাদের সঙ্গে যোগ দেব।’

ইরতেনসেনু এর প্রত্যুত্তরে কিছু বলার আগেই অগস্ত্য যন্ত্রচালিতের মতো পিছনে ফিরে হাঁটা লাগাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *