১৫-২০. ম্যাকলাস্কিজ নোজ

দেখ রুরু ম্যাকলাস্কি’জ নোজ।

সামনের সিটে বসা গাড়ির জানলা দিয়ে দেখল অগ্নি রুরুকে। ড্রাইভার গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল অগ্নির নির্দেশে।

এ গাড়িতে রুরু, অগ্নি, নরেশ ও ব্রতীন আছে। অগ্নি ড্রাইভারের পাশে। আর ঘোষ সাহেবের গাড়িতে অরা, আর স্মিতা। চুমকিরও আসার কথা ছিল কিন্তু ওর মায়ের জ্বর তাই আসতে পারেনি ও। সামনের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়াতে পেছনের গাড়িও দাঁড়াল। ওরা সকলেই নামল গাড়ি থেকে। ঘোষ সাহেব তাঁর গাড়ির ড্রাইভারের পাশে বসেছেন। সবাই মিলে দেখল ম্যাকলাস্কিজ নোজ। ছবিও তুলল। নরেশ এবং স্মিতা। অপালা ক্যামেরা এনেছে কিন্তু সেটা এখনও স্যুটকেস থেকে বের হয়নি। থিতু হয়ে বের করবে।

হাজারিবাগেই যাবে ভেবেছিল কিন্তু ব্রতীনের এক বন্ধুর বাড়ি থাকাতে ম্যাকলাস্কিগঞ্জের-ই দিকে বেরিয়ে পড়ল ওরা। খুব ভোরে বেরিয়েছিল ওরা, কলকাতা থেকে সন্ধের আগে আগেই পৌঁছে যাবে বলে। এখান থেকে আর দশ-পনেরো মিনিট লাগবে পৌঁছোতে। গাড়ি নিয়ে না এলেও হত। এখন শক্তিপুঞ্জ ট্রেন হয়ে গেছে। দুপুরে কলকাতা ছেড়ে রাত দেড়টাতে ম্যাকলাক্সি পৌঁছোয়। আগে বলে রাখলে ট্যাক্সিও আসে স্টেশনে। অনেক গেস্ট হাউস হয়েছে এখন থাকার মতো।

ব্রতীন বলল, একটু উষ্ণতার জন্যে উপন্যাস পড়েই সব মানুষে আসেন এখানে।

অপালা বলল, ব্যারিস্টার ও লেখক সুকুমার বোস এবং তাঁর অল্পবয়সি পাঠিকা ছুটির জন্যে এ জায়গাটা রোমান্টিক ট্যুরিস্টদের টেনে আনে।

অরা ফিস ফিস করে অপালাকে বলেছিল, হাজারিবাগের সঙ্গে এই জায়গাটার অনেক-ই মিল আছে তবে অমিলও কম নেই।

–মন খারাপ করছিস কেন? অগ্নিদা তো বলেছেন, হাজারিবাগেও নিয়ে যাবেন আমাদের। তোদের বিক্রি হয়ে যাওয়া বাড়ি দেখাবেন। এখন তো কোডারমা স্টেশনে নেমে বড়হি হয়ে তিলাইয়া ড্যাম-এর পাশ দিয়ে হাজারিবাগে যাওয়া খুবই সহজ বলেই শুনেছি।

অরা বলল, আমরা তখন বগোদার হয়ে, সারিয়া হয়ে হাজারিবাগ রোড স্টেশনে নেমে আসতাম এবং যেতাম। তখন ঝুমরি তিলাইয়ার নাম শুনতাম বটে, তবে তিলাইয়া ড্যামের কাজ সবে আরম্ভ হয়েছে হয়তো তখন। আমরা খুব ছোটো ছিলাম। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন দামোদরের বাৎসরিক বান ঠেকাতে তিলাইয়া, পাঞ্চেত, মাইথন এইসব বাঁধ বানান ভারত সরকার আমেরিকান টেনিসি ভ্যালি কর্পোরেশনকে মডেল করে। প্রত্যেক ড্যামের সঙ্গেই ‘হাইডাল প্রোজেক্ট ছিল। প্রকান্ড প্রকান্ড জলাধার হওয়াতে প্রতিটি জায়গাতেই অনেক গ্রামকে সরিয়ে দিতে হয়েছিল। তারা সব গিয়ে অন্যত্র নতুন গ্রামের পত্তন করেছিল। বিরাট সব ক্রিয়াকান্ড।

তারপর বলল, তপন সিংহ ‘পঞ্চতপা’, নামের একটি ছবি করেছিলেন-না, এইরকম কোনো একটি বাঁধের প্রস্তুতির পটভূমিতে? মা ছবিটি দেখে এসে খুব উত্তেজিত হয়ে আমাদের গল্প করেছিলেন। তখন আমরা নীচু ক্লাসে পড়ি। ছবি দেখার অনুমতি ছিল না।

ব্রতীন পেছন থেকে ড্রাইভারকে বলল, একটু আস্তে করো ভাই। এই চড়াইটা থেকে নেমেই ডান দিকে একটা গেট পাবে–গেটটা একটু ভেতরে ঢোকানো। সেই গেটে হর্ন দিতে হবে।

সেই গেটে গাড়ি পৌঁছেলে ব্রতীন ডান দিক থেকে নেমে গেটের কাছে গিয়ে বলল, তালা খুলেই রেখেছে। তার মানে কেয়ারটেকার খবরটা পেয়েছে।

–তিনি এত তাড়াতাড়ি খবর পেলেন?

–জানি না, ইন্দ্রজিৎ হয়তো মিস্টার ক্যামেরনকে ফোন করে দিয়েছিল।

বাড়ির ভেতরে দুটো গাড়িই ঢুকে এল। অগ্নি বলল, রুরু, যা তো, গেটটা বন্ধ করে দিয়ে আয়। নইলে গোরু কী ছাগল ঢুকে বাগান নষ্ট করে দেবে। যদিও এখানে গোরু, ছাগল কমই আছে।

রুরু বলল, তারা সব এখন শহরে ভিড় করেছে।

গেট বন্ধ করে রুরু এরই মধ্যে বাড়িটা সার্ভে করে এসে বলল, বাড়িটা একটা পাহাড়ের চুড়োতে। পেছন দিকে পাহাড়টা অনেকখানি নেমে গিয়ে একটা উপত্যকাতে মিশেছে।

ব্রতীন বলল উপত্যকাতে শুনেছি মিস্টার ক্যামেরনের স্টার্ড-ফার্ম ছিল–ঘোড়া ব্রিডিং করাতেন উনি। সেই ফার্ম এখন বন্ধ করে দিয়ে, হোটেল খুলেছেন উনি স্টেশনের কাছে। ওখানেই আগে মিসেস কার্নি একটি হোটেল চালাতেন, একটু ভেতর দিকে। দু-কামরার হোটেল।

–তুই এত জানলি কী করে?

অগ্নি বলল।

–আমি যে, গত ত্রিশ বছরে বহুবার এসেছি এখানে। এখানের নাড়িনক্ষত্র সব আমার জানা। এখানে আমিও একটা ছোটোকটেজ কিনব ভেবেছিলাম। তখন জলের দর ছিল। এখন দাম বেড়ে গেছে।

–চল আমরা তিনজনে মিলে একটা কিনি।

নরেশ বলল।

–আমাদের কারোর-ই তো উত্তরাধিকারী নেই। কে দেখবে আমাদের পরে?

–তার চেয়ে ঘোষ সাহেব-ই কিনে ফেলুন একটা।

–আমার কি উত্তরাধিকারী আছে?

ঘোষ সাহেব বললেন।

রুরু বলল, তা নিয়ে চিন্তা করছ কেন অগ্নিকাকু। আমাকে দিয়ে দিয়ো।

সকলেই রুরুর কথাতে হেসে উঠলেন।

অরা বলল, বড়োদের কথার মধ্যে কথা বোলো না রুরু। দিন দিন তোমার ম্যানারস গোল্লায় যাচ্ছে। ওকে একটু শাসন করতে পারিস না তৃষা?

–আরে খারাপ-ই বা কী বলেছে রুরু?

ঘোষ সাহেবসুন্ধু ওঁরা সকলেই বলে উঠলেন একসঙ্গে।

ততক্ষণে বাড়ির কেয়ারটেকার মুখার্জিবাবু এসে নমস্কার করে দাঁড়ালেন। আদিবাসী পরিচারিকা জীরুয়াও এসে নমস্কার করল। একজন আদিবাসী কাজের লোক, জানি। ওর পুরোনাম জানি ওঁরাও।

ব্রতীন আর অগ্নি মুখার্জিবাবুকে আড়ালে ডেকে নিয়ে, তাঁর হাতে দু-হাজার টাকা দিয়ে বললেন, এটা রাখুন। ফুরিয়ে গেলে বলবেন। রাতে কী খাওয়াবেন আমাদের?

–যা বলবেন স্যার।

–আজ তো জোগাড়, যন্ত্র করতে সময় লাগবে। আমরাও সারাদিন জার্নি করে ক্লান্ত। আজ মুগের ডাল বানিয়ে চালে-ডালে খিচুড়ি করে দিতে বলুন। সঙ্গে কড়কড়ে করে আলুভাজা আর ডিম ভাজা। শুকনো লঙ্কাও ভাজতে বলবেন। কাল মুরগি ও ডিম নিয়ে আসবেন বেশি করে। এখানে হাট কবে? ভুলে গেছি।

-হাট কালকে।

–তবে তো আমরা কাল সকলেই হাটে যাব। তবে হাট লাগতে লাগতে তো দুপুর হয়ে যাবে।

-কাল তাহলে লাঞ্চে এগ-কারি, ডাল আর একটা সবজি ও স্যালাড করুন। ডিমের কারিতে বেশি করে কারি পাতা দিতে বলবেন। কিচেনের পাশেই তো গাছ।

-তা ঠিক। পাঁঠার মাংস আর শুয়োরের মাংস দুই-ই আনব কালকে হাট থেকে। আপনার কাজের মেয়েটি কি পর্ক-এর ভিন্দালু রাঁধতে পারবে?

–ভিন্দালু পারবে না হয়তো। এমনিই ওরা শুয়োরের মাংস যেমন করে খায়, ঝালটাল দিয়ে রাঁধে, তেমন করে রাঁধতে পারবে।

ব্রতীন বলল, ভিন্দালু না হয় আমিই রাঁধব।

অগ্নি বলল, এখানে ভালো মহুয়া পাওয়া যাবে মুখার্জিবাবু?

মুখার্জিবাবুর হয়ে ব্রতীন বলল, হ্যাঁ। হ্যাঁ।

–তাহলে মহুয়া আনবেন তো আজ-ই তিনবোতল। আমি ডক্টর করে নেব।

ব্রতীন বলল।

–ঠিক আছে।

–ডক্টর করবি কী করে?

অগ্নি বলল, আরে, বাড়ির মালিক ইন্দ্রজিৎবাবুকে একজন অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান সাহেব শিখিয়ে গেছিলেন।

–কী করে করতে হয়?

একটা তাওয়াতে লবঙ্গ আর চিনি লাল করে ভেজে, বোতলের মধ্যে ফেলে দিয়ে খুবভালো করে ঝাঁকিয়ে তারপর ছাঁকনি দিয়ে হেঁকে অন্য বোতলে ঢালতে হয়। তখন তার রং হয়ে যায় হুইস্কির মতো। আর খেতেও চমৎকার। যে জানে না, তাকে বিলিতি জিনিস বলে খাইয়ে দিলে সে মহা আহ্লাদ করে খাবে।

মুখার্জিবাবু বললেন, আমি তাহলে বেরুই একটু দোকানের দিকে। আপনারা চান করবেন তো? জল তোলার জন্যে আলাদা লোক আছে। কুয়ো থেকে জল এনে বাথরুমে দিয়ে দেবে। দু-টি বাথরুম আছে। গরম জল লাগলেও বলবেন দিয়ে দেবে আলাদা বালতিতে। বাইরে কাঠের উনুনে জল গরম হচ্ছে। সকালে আর রাতে দু-বেলাতেই হয়।

–ঠিক আছে।

নরেশ বলল, বড়ো বাথরুমটা মেয়েদের জন্যে ছেড়ে দেওয়া যাক। সঙ্গে একটি বড়ো ড্রেসিং-রুমও আছে। আর অন্যটা আমরা ব্যবহার করি।

–গিজার নেই বাথরুমে?

তৃষা এসে বলল।

-তা নেই কিন্তু গরম জলের কোনো অসুবিধে হবে না। মায়েদেরও বোলো চান করার আগে, বললেই বাথরুমের পেছনের দরজা দিয়ে এনে দেবে।

পেছনটাতে যা জঙ্গল। বাঘ ভাল্লুক ঢুকে পড়বে না তো! অগ্নি বলল, নারে মা। এই ব্রতীনকাকা বাড়ির মালিকের সঙ্গে কতবার এসে থেকে গেছে। এখানে। জায়গাটা অবশ্যই জঙ্গুলে। একসময়ে হয়তো সব জানোয়ার-ই ছিল। কিন্তু এখন শুয়োর আর ক-টি ভাল্লুক ছাড়া কিছু নেই। শেয়াল আছে অবশ্য। কী বল ব্ৰতীন?

-ঠিক-ই বলেছিস।

ওরা সকালে চানটান করে, সঙ্গে করে আনা চা, কুরকুরে, পোটাটো চিপস ইত্যাদি খেয়ে ফ্রেশ হয়ে বারান্দার সামনে চেয়ার পেতে বসেছে। ব্রতীন বলল সন্ধের পরেই মনোরম হয়ে যায় আবহাওয়া এখানে। কতরকম পাখি ডাকছিল শেষবিকেলে লক্ষ করেছিস? মনে হচ্ছিল বাড়িতে যেন পাখিদের ডাকাত-ই পড়েছে। ম্যাকলাস্কিগঞ্জে দু-একজনের বাড়িতে টেবিল পাখা আছে অথবা পেডেস্টাল ফ্যান-সিলিং ফ্যান প্রায় কারও বাড়িতেই নেই। এপ্রিলের মাঝামাঝি অবধি রাতে গায়ে চাদর দিয়ে শুতে হয়। বাইরে বসলেও পাতলা সোয়েটার বা চাদর লাগে। টাক থাকলে, টুপি। কখনোই ফ্যান লাগে না। বৃষ্টি নেমে গেলে আবার চাদরও চড়াতে হয়।

–কী কী দেখার জায়গা আছে এখানে? অপালা শুধোল।

–এখানে সব-ই তো দেখার জায়গা। চামা থেকে বাঁ-দিকে ঘোরার পরেই তো জঙ্গলে জঙ্গলে পথ। দু-পাশে পাহাড়। দেখলেন-না সব জায়গাই পিকনিক করার জায়গা। তবে বিশেষ পিকনিক স্পট হচ্ছে চাট্টি নদী। ভারি সুন্দর জায়গাটা। তবে বর্ষাকালে আরও সুন্দর হয়।

বলেই, রুরুর দিকে চেয়ে ব্রতীন বলল, জানো তো রুরু। চাট্টি নদীতে পিকনিক করতে যাওয়া, এক সাহেবের পেছন খুবলে নিয়েছিল এক ভাল্লুক। শখ করে বানানো নতুন ট্রাউজারের দেড় গিরে কাপড় খামচে নিয়েছিল। তোমার ট্রাউজারটাও তো দেখছি নতুন। চাট্টি নদীতে গেলে সাবধানে থেকো তুমি।

সকলেই হেসে উঠল ব্রতীনের কথা শুনে।

তারপর ব্রতীন বলল, আর একটি সুন্দর জায়গা ম্যাকলাস্কিগঞ্জ স্টেশন। কোনো উঁচু প্ল্যাটফর্ম নেই। গ্রাউণ্ড লেভেল-এর প্ল্যাটফর্ম। উলটোদিকে শালজঙ্গল। জানি না এখনও আগের মতো আছে কি না!

-শেষ কবে এসেছিলি তুই?

অগ্নি জিজ্ঞেস করল।

-তা বছর তিনেক তো হবেই।

অরা বলল, “একটু উষ্ণতার জন্যে”-তে ওই স্টেশনের কথাও পড়েছি।

–নয়নতারার প্রেমিক শৈলেন যেখানে আত্মহত্যা করেছিল?

অপালা বলল।

হুঁ। অরা বলল। আর শুধু কি তাই-ই? সেই প্ল্যাটফর্মে তো মিস্টার কাব্রালের মুন্ডুহীন ভুত রাতের বেলা টুপি হাতে পায়চারি করে।

তৃষা বলল, উরি বাবা।

ব্রতীন বলল, গভীর শুনশান রাতে তো স্টেশনে যাব না আমরা তাই কাব্রাল সাহেবের ভূত হয়তো দেখাতে পারব না কিন্তু মিসেস কার্নির চায়ের দোকানটা এখনও আছে। এদিকে বারকাকানা আর ওদিকে ডালটনগঞ্জ থেকে যে, দু-টি প্যাসেঞ্জার সকালে বিকেলে যাওয়া আসা করে এদিকে গোমিয়া, পত্রাতু, রায় এসব স্টেশন আর ওদিকের ডালটনগঞ্জ, ছিপাদোহর, লাতেহার, মহুয়ামিলন, ওইসব স্টেশন থেকে। তাদের যাত্রীরা নেমে গরম গরম চা আর নিমকি-শিঙাড়া খায় আজও, মিসেস কার্নির দোকান থেকে। মিসেস কার্নি যদিও দেহ রেখেছেন অনেক-ই দিন হল। তাঁর এক কর্মচারী মাজিদ এখন চালায় দোকানটি। তার চুলেও নিশ্চয়ই পাক ধরেছে এতদিনে।

ঘোষ সাহেব বললেন, যাই বলুন আর তাই বলুন মশায়, জায়গাটা এখনও একটা, আউট অফ-দ্যা-ওয়ার্ল্ড প্লেস রয়ে গেছে কোনো ফেয়ারি টেলস-এর বইয়ে বর্ণিত জায়গার মতো। অথচ রাঁচি থেকে মাত্র পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে।

ব্রতীন বলল, রাঁচি এখন রাজধানী হয়ে গেছে নতুন স্টেট ঝাড়খন্ড-এর। রাঁচিতে খুব-ই কনজেসশান হওয়াতে ম্যাকলাস্কির কাছেই নতুন রাজধানী তৈরি হচ্ছে। তাই এই জায়গাটা আর বেশিদিন এমন নির্জন থাকবে না। জমি বাড়ির দামও বেড়ে গেছে প্রচুর। আগে সব বাংলো বাড়ি ছিল, বহুবিঘা জায়গার ওপরে। এবারে হয়তো পাকা বাড়ি হতে শুরু হবে। মালটিস্টোরিড হবে। সর্বনাশ হবে ‘একটু উষ্ণতার জন্যে’র ম্যাকলাস্কিগঞ্জের।

অগ্নি বলল, শুনেছি সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরীর ছেলেবেলার কিছুটা কেটেছিল এখানে। তখন স্টেশনটির নাম ছিল আণ্ডাহল্ট। তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘ভারতবর্ষ এই আপ্তাহল্ট স্টেশন নিয়েই লেখা নাকি। যুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ টমিদের ব্রেকফাস্ট খাওয়ার জন্যে ট্রুপস ট্রেইন এখানে দাঁড়াত তাই মুখে মুখে স্টেশনের নাম হয়ে গেছিল আণ্ডাহল্ট।

ব্রতীন বলল, সেই সময়ে, মানে চল্লিশের দশকে, ফুটফুটে অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান মেয়েরা গোরুর গাড়ি চালিয়ে যেত, খেতে কাজ করত গান গাইতে গাইতে। এখানে চার্চ ছিল, ক্লাব ছিল। এখনও আছে ক্লাব, যদিও ছাগল চরে বেড়ায়। তবে চার্চ এখনও আছে। দিশি পাদরিরা আছেন সেখানে। তবে ক্রিশ্চান এখন আর খুব বেশি নেই হয়তো।

নরেশ বলল, কাল হাট আছে। মেয়েরা কি হাটে যেতে চান? আমরা পাঁঠা আর শুয়োরের মাংস কিনব। তরি-তরকারি যা পাব। মোরগা-আণ্ডা।

-থাকা তো হবে মোটে আড়াইদিন। আপনাদের ফিরিস্তি শুনে মনে হচ্ছে মাসখানেক-ই থাকা হবে বুঝি।

অরা বলল।

তারপর বলল, যেকোনো দেহাতি জায়গাতে হাট একটা অবশ্য দ্রষ্টব্য জায়গা। স্পেশালি টু হ্যাভ আ ফিল অফ দ্যা প্লেস। আমরা অবশ্যই যাব। হাজারিবাগের আশপাশের কত হাটে যেতাম ছেলেবেলাতে।

ব্রতীন বলল, একমাস থাকতেও অসুবিধে নেই। ইন্দ্রজিৎবাবু তো চান-ই যে, তার বাড়িতে মানুষে যান। গিয়ে থাকুন। তাঁর ছবির মতো একটি বাড়ি আছে শান্তিনিকেতনেও, অর্কিডে ভরা দারুণ বাগান। উনি প্রতি উইক-এণ্ডে সেখানেই যান। এখানে আজকাল আসতে প্রায় পারেন-ই না। আমরা একমাস ইচ্ছে করলে থাকতেই পারি। ওঁর কোনো অসুবিধে নেই।

নরেশ বলল, অসুবিধে আমাদেরও কারও নেই শুধু ঘোষ সাহেবের ছাড়া। তার তো মিনিটে হাজার। বহত-ই লস হয়ে যাবে।

থাকলে, তৃষা বলল, আমার নতুন চাকরিটাও যাবে।

রুরু বলল, কলেজে আমি ফেইল করব। মায়েরও তো স্কুল আছে। হেড মিস্ট্রেস না থাকলে স্কুল কি চলবে?

অগ্নি অপলাকে বলল, তাহলে দেখা যাচ্ছে আমরা তিনজন রিটায়ার্ড বন্ধু আর আপনিই কেবল মুক্ত পুরুষ ও নারী। আর সকলের-ই বন্ধন আছে।

অপালা বললেন, আমার থাকতে আপত্তি নেই আপনাদের সঙ্গে। ঘোষ সাহেব বললেন, আমারও তোমাকে ছেড়ে যেতে আপত্তি নেই। আমার কাজ তো সব করে কেষ্টা আর রাম, আর ড্রাইভার কালু সিং। আমি, অরা, তৃষা আর রুরু আমার গাড়ি নিয়ে ফিরে যাব। অগ্নিবাবু আর তাঁর বন্ধুরা থেকে যাবেন ওঁর গাড়ি নিয়ে। তোমরা থেকেই যাও না। বন্ধন-মুক্তি সবসময়েই ভালো, বিরহ যত দীর্ঘ হয়, ততই তো মিলন মধুরতর হয়। তাই না?

কাট…অরা বলল।

নীচু গলাতে বলল, তৃষা আর রুরুকে। তোমরা যাও-না, একটু হেঁটে এসো-না বাগানে, কতরকম বড়ো বড়ো গাছ আছে, দ্যাখো তো, কতগুলো গাছের নাম জান তোমরা?

ওরা দু-জনে উঠে গেল।

অগ্নি চাপাস্বরে বলল, এটা তোমার বাড়াবাড়ি অরা। তুমি একটু বাড়াবাড়ি রকমের কনসার্ভেটিভ। ওরা কি ছোটো আছে? তা ছাড়া আমাদের চেয়ে ওরা বেশি ছাড়া কম ম্যাচিয়োরড নয়। ওদের এমন করে ট্রিট করলে ওরা ইনসালটেড ফিল করতে পারে। দিস ইজ নট ডান।

অরা চুপ করে রইল। কোনো জবাব দিল না।

তারপরে অগ্নি নরেশকে বলল, তুই তো একটা দড়কচ্চা মেরে যাওয়া ব্যাচেলার। তুই মিলন-বিরহর কী জানিস রে?

সকলেই ওই কথাতে হেসে উঠল। একটু পরে অরা বলল, তোমার কথার জের টেনেই বলছি, জীবনে সব জিনিসের-ই সময় আছে। ওয়াল্ট হুইটম্যানের সেই কবিতাটি আছে-না?

–কোন কবিতার কথা বলছ অরা?

অগ্নি বলল।

–আরে! ওয়াল্ট হুইটম্যানের, Leaves of Grass-এ আছে না কবিতাটি?

–বলো না কোন কবিতা?

All Truths Wait, In All Things,
They Neither Hastern Their Own Delivery Nor Resist It,
They Do Not Need The Obsteric Forceps Of The Surgeon
তোমার উদ্ধৃত এই কবিতাটি তো আমার-ই বক্তব্যর পক্ষে গেল।

-যে-যেমন মানে করবে।

অরা বলল।

.

১৭.

বেশ কিছুক্ষণ পরে মুখার্জিবাবু বাজার নিয়ে ফিরে এলেন। হাতে টর্চ আর থলে। উনি অপরাধীর গলাতে বললেন, ওই জিনিসটা পাওয়া গেল না স্যার। কাল অবশ্যই পাওয়া যাবে।

–কোন জিনিসের কথা বলছেন উনি?

অপালা বলল।

-কাল পেলে বলব।

-আপনাকে টেস্ট করতে দেব।

ব্রতীন বলল।

–জিনিসটা কী?

–মহুয়া।

–ইস। ভদ্রলোকে মহুয়া খায়!

মুখ বিকৃত করে বলল অপালা।

–আমরা তো ভদ্রলোক নই। মানে, অগ্নি, আমি আর নরেশ।

–অনেক ভদ্রলোক-ই খায়। তার ওপরে আমি এমন করে Doctor করে দেব না।

-ভদ্রলোকেরা খেলেও খেতে পারে। কোনো ভদ্রমহিলা কখনোই খান না।

ঘোষ সাহেব বললেন, দেখলেন তো বুর্জোয়া অ্যাটিচ্যুড। সব ব্যাপারে একটা সুপিরিয়োরিটি কমপ্লেক্স।

রান্না ক-টা নাগাদ হয়ে যাবে মুখার্জিবাবু?

ব্রতীন জিজ্ঞেস করল।

–আমরা কি একটু সাহায্য করব গিয়ে?

অরা বলল।

-না, না, আজকে তো খিচুড়ি, ডিমভাজা আর আলুভাজা হচ্ছে। কোনো দরকার নেই।

–শুকনো লঙ্কা ভাজতে বলতে ভুলে যাবেন না যেন, মুখুজ্যেমশায়।

–আজ্ঞে না।

মুখার্জিবাবু চলে গেলে ব্রতীন বলল, কাল দুপুরেও আণ্ডাকারি, একটা ডাল আর একটা সবজি। কারিপাতা দিতে বলেছি ডিমের ডালনাতে বেশি করে। কিচেনের পাশেই দুটো গাছ আছে।

–কারিপাতা গাছ? কী দারুণ! চলো অপালা, দেখে আসি।

–উত্তেজনার কোনো কারণ নেই। কাল সকালে দেখলেই চলবে। এখানে আরও কত কী দেখার আছে। খয়ের গাছ, কুঁচফল-এর গাছ।

–কুঁচফলটা কী ফল অগ্নিকাকা! আঁশফলের মতো?

তৃষা বলল।

–দুর বোকা মেয়ে। কুঁচফল আগেকার দিনের স্যাকরারা সোনা ওজন করার সময়ে ব্যবহার করতেন, সোনা ওজন করতেন পেতলের হালকা ছোট্ট দাঁড়িপাল্লাতে। উজ্জ্বল, মসৃণ লাল আর কালো রঙের হয় ছোটো ছোটো ফলগুলো। শীতকালে হয়। এ বাড়িতেই আছে গাছ। শীতকাল হলে ফলও দেখতে পেতে।

নরেশ বলল, একটা কথা এখন-ই পরিষ্কার করে বলে দেওয়া ভালো।

-কী কথা?

–মহিলারা এখানে কিচেনে যাবেন না। কিচেন আপনাদের জন্যে আউট-অফ-বাউণ্ডস। অগ্নির ভাষাতে, ‘দড়কচ্চা মারা ব্যাচেলাররাই’ যা রান্না-বান্না করার তা করব। ঘোষ সাহেব সংসারী মানুষ। তা ছাড়া ডাকসাইটে ব্যারিস্টার। তাঁকেও রান্নাঘরে ঢুকতে দেওয়া হবে না। আপনাদের কোনো অসুবিধে হলে তখন-ই বলবেন।

ঘোষ সাহেবও বললেন, সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়’। সাতটা তো বাজতে চলল। দড়কচ্চা-মারা ব্যাচেলরেরা গ্লাস-টাস-এর বন্দোবস্ত করুন। শিভাস রিগ্যাল’-এর বোতল আছে চারটে আমার ব্যাগে।

–কোন ব্যাগে?

–ওই কালো ব্যাগটাতে। স্মিরনক ভদকাও আছে। একটি স্লাডিভারও আছে। বিয়ারও এনেছি। ফস্টার বিয়ার। বরফ হবে তো ফ্রিজে?

–এখানে ফ্রিজ নেই। গরমে তো বিশেষ কেউ আসেন না এখানে। আর শীতটা এমন-ই জব্বর পড়ে যে, তখন বরফের দরকার-ই হয় না। এখনও কুয়োর জল বরফের মতোই ঠাণ্ডা।

–যা করার তাড়াতাড়ি করুন মশায়। ন-টার সময়ে খিচুড়ি রেডি হয়ে যাবে। ফুট জুস, পেপসি, কেক সব আছে। মেয়েরা কে কী খাবেন?

ব্রতীন অরাকে বলল, আপনি কী খাবেন?

–কিছু না। একগ্লাস জল খাব শুধু।

নরেশ বাড়ির ভেতরে গেল সব বন্দোবস্ত করতে।

ব্রতীন গলা তুলে ডাকল তৃষা, রুরু তোমরা সব কোথায় গেলে? আরে, জঙ্গুলে জায়গা। টর্চ না নিয়ে যেয়ো না। সাপ বিছেতে কামড়ে দেবে।

–সাপ আছে নাকি এখানে?

অরা আতঙ্কিত গলাতে বলল।

–সাপ নেই মানে? সাপ, কাঁকড়া বিছে, কী নেই? তবে এখনও তো তেমন গরম। পড়েনি। গরমের সময়েই প্রকোপ বাড়ে।

–আপনারা কিছু মনে করবেন না ঘোষদা, আমি পা-টা তুলে বসছি।

বলে, একটা খালি চেয়ার টেনে নিয়ে তার ওপরে পা দু-টি তুলে বসল অরা।

ঘোষ সাহেব বললেন, আহা। এতদিন শুধু অরার মুখটিই দেখেছি। কী সুন্দর পায়ের পাতা দু-টি অরার। সাপ বা বিছের তো কামড়াতে ইচ্ছে করতেই পারে, আমার কিন্তু চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। সত্যি। পায়ের পাতা থেকে মাথার সিঁথি পর্যন্ত এমন সুন্দরী, কলকাতা শহরে অরার মতো আর আছেন কি না জানা নেই।

–আপনিও ফ্লার্ট করেন তা তো জানতাম না। আপনি আর ক-জন মহিলা দেখলেন জীবনে। মোটা মোটা মক্কেল আর টেকো-টেকো জজসাহেবদের দেখেই তো, জীবন কাটল আপনার।

অরা বলল।

সকলেই সে কথাতে হেসে উঠল। এমনকী ঘোষ সাহেব নিজেও।

নরেশ বলল, অরা দেবীর মাথার সিঁথি, মুখ আর পায়ের পাতা ছাড়া আর কিছু কি দেখেছেন আপনি?

অরা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, বড়ো বাজে রসিকতা করেন আপনারা।

নরেশ বলল, আমরা মানুষগুলোই তো থার্ড গ্রেড–তবে অগ্নি আর ঘোষ সাহেব আমাদের মধ্যে পড়েন না।

একটু পরে রুরু আর তৃষা কাছে এল।

-কী কী গাছ দেখলে?

–অন্ধকারে কি গাছ চেনা যায়? বেঁটে গাছ, লম্বা গাছ, সরু গাছ, মোটা গাছ এইসব-ই দেখলাম।

রুরু বলল, আমরা একটা করে কোক খাই অগ্নিকাকা? আর একটু কুরকুরে।

অরা বলল, ওসব বেশি খেয়ো না। ন-টাতে ডিনার সার্ভড হবে। খিদে নষ্ট হয়ে যাবে।

নরেশ, জানি ওঁরাওকে সঙ্গে করে গ্লাস, জলের বোতল এবং হুইস্কির বোতল নিয়ে এল। ভদকাও।

তারপর বলল, সোডা লাগবে কারও? আমি নিয়ে এসেছি দু-ক্রেট।

–এখানে যেন সোড়া পাওয়া যেত না?

ব্রতীন বলল।

-এখানে পাওয়া যাবে না? গাড়িতে জায়গা ছিল। ভাবলাম, যদি দরকার হয়। প্রাইট আর লিমকাও এনেছি। যদি কেউ ভদকা বা জিন-এর সঙ্গে খায়। আমার কাছে জিন আছে।

–টনিক এনেছিস নাকি?

ব্রতীন বলল।

–এ কি মুম্বই নাকি যে, পানের দোকানেও টনিক পাওয়া যাবে। বড়ো বড়ো ক্লাব ও হোটেল ছাড়া কলকাতাতে তো টনিক পাওয়াই যায় না।

-অপালা, আপনাকে কি, প্রাইট দিয়ে একটা জিন বানিয়ে দেব? অথবা ভদকা?

–নিতে পারি যদি অরা আর অগ্নিবাবু গান শোনান। এমন পরিবেশ। গান শোনার এমন জায়গা কি আর পাওয়া যাবে?

ব্রতীন বলল, তা তো শুনতেই হবে। এই আড়াই দিন শুধু গান-ই শুনব। রুরু বলল, গান ভালোবেসে গান।

–বাঃ! ভেরি গুড। রুরু কোকটা নিয়ে এসে তুই বাংলা ব্যাণ্ডের ‘গান ভালোবেসে গানটা দিয়েই শুরু কর আজকের সান্ধ্য আসর। গিটারটাও আনতে ভুলিস না।

–আচ্ছা, তৃষা গান গায় না কেন?

ঘোষ সাহেব বললেন।

-তৃষার গলাটা চাপা। কিন্তু গান ও খুব সুরেই গায় রুরু অথবা হর্ষদের-ই মতো। কিন্তু গাইতে একেবারেই চায় না। গানটা ভালোবাসার জিনিস, প্রাণের জিনিস, জোর করে কি কারওকে দিয়ে গান গাওয়ানো যায়? তাও এতবড়ো মেয়েকে?

–তা অবশ্য ঠিক।

ঘোষ সাহেব বললেন।

নরেশ বলল, দুটো ঘুঘু পাখি দেখিয়ে আঁখির মতো আরও কিছু গান কি আছে আপনার স্টকে, ঘোষ সাহেব?

-না মশাই। ওই এক এবং অদ্বিতীয়ম।

–তাহলে ওই গানটাই আর একবার শুনব।

সকলেই বলে উঠল, তাই সই।

যার যার গ্লাসে চুমুক দেওয়া হলে ব্রতীন বলল, তুই-ই শুরু কর অগ্নি।

–দাঁড়া দাঁড়া। একটা খাই। নইলে আমার গলা সুরে বলে না। আর দেখছিস তো অরা আছে। ও অসুরদের একেবারেই সহ্য করতে পারে না।

তারপর বলল, ফর আ চেঞ্জ এবং অরার হাজারিবাগের অনুষঙ্গ মনে করে ছোট্ট একটা ব্রহ্মসংগীত গাইব প্রথমে?

-ছোট্ট কেন? বড়ো গাইতেই বা ক্ষতি কী?

–যে, গানটি গাইব সেটি দিল্লির সুধীরচন্দ মশায় কিছু ব্রহ্মসংগীত আমাকে ক্যাসেট করে পাঠিয়েছিলেন, সেই ক্যাসেট থেকেই তোলা।

অপালা বলল, ইনি কোন সুধীর চন্দ? শান্তিনিকেতনে ছিলেন কি? অরূপ গুহঠাকুরতাদের ব্যাচ।

-হ্যাঁ। তাই তো। আপনি চিনলেন কী করে?

–শান্তিনিকেতনেই দেখেছি। তখন আমি পাঠভবনে পড়তাম। একেবারে পুটকি মেয়ে। ছিলাম।

-তাই?

অবাক হয়ে বলল অগ্নি।

তারপর বলল, সুধীরদা তো দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে নিজের বাড়িতে একটা গানের স্কুলও চালান।

অপালা বলল, শুনেছি উনি আপনাদের-ই মতো। ব্যাচেলর।

–সুধীরদা কোনো বিবাহিতা ছাত্রীকেই তুমি বলে ডাকেন না। সে কিশোরী হলেও ‘আপনি’ বলেন।

–কেন?

নরেশ বলল।

–হয়তো কোনো “তুমি-সম্বোহিত” বিবাহিতা মহিলা তাঁকে কখনো দাগা দিয়ে থাকবেন।

ব্রতীন বলল।

–সব জিনিসের-ই কেন হয় না। আর মাত্রাতিরিক্ত কৌতূহলও অশিষ্টতা।

–তাই না অপালা?

অরা বলল।

–সে তো বটেই।

–এবারে গানটা ধর অগ্নি।

অগ্নি গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে ধরল:

তাঁরে দূর জানি ভ্রম সংসার সংকটে
আছে বিভু তোমা হতে তোমারও নিকটে।
কেন তুমি নিরন্তর থাকো তা হতে অন্তর
ভাবো সেই পরাৎপর নিত্য অকপটে।
ভ্রম, সংসার সংকটে।

অরা বলল, বাঃ। এ গানটি এতবছরে কখনোই তো শোনাওনি।

–কখন শোনাব? তুলেইছি তো গতমাসে।

সকলেই বলল, ভারি সুন্দর।

নরেশ বলল, পুরো পরিবেশটা ব্রাহ্মসমাজ ব্রাহ্মসমাজ হয়ে উঠল যেন।

–উদ্ভট যত কথা নরেশের।

ব্রতীন বলল। তুই ব্রাহ্মসমাজে গেছিস কখনো?

–যাইনি? ভবানীপুরের গাঁজা পার্ক-এর কাছে টাবলুর মৃত্যুতে যে-উপাসনা হয়েছিল তাতে যাইনি? তুইও তো গেছিলি।

–আমি তো বহুবার-ই গেছি। তবে একদিন কোনো মৃতর স্মরণসভাতে গিয়েই তুই স্পেশালিস্ট হয়ে গেলি? ক-টি ব্রাহ্মসমাজ আছে তা জানিস?

–ব্রাহ্মসমাজের বিল্ডিং বলছিস?

–না রে, বিল্ডিং নয়। সমাজের কথা বলছি।

–না।

–সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ এবং নববিধান সমাজ।

–সেই জমায়েতে ব্রাহ্ম কেউ-ই ছিলেন না।

–একমাত্র অরা ছাড়া। তাও তো তার বিয়ে হয়েছিল হিন্দুর সঙ্গেই। কিন্তু এই অনধিকারীদের আলোচনাতে যে, একেবারেই নীরব ছিল।

নরেশ বলল, অতসব ডিটেইলস তো জানি না ভাই, তবে একথা বলব যে, ভবানীপুরের গাঁজা পার্কের কাছের বাড়িটির অবস্থা অতীব শোচনীয়। ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে এতবড়ো বড়ো এবং বড়োলোক মানুষ ছিলেন এবং এখনও আছেন অথচ এই বাড়িটির একটু সংস্কার সাধন কি করা যায় না? মনে হয়, ভেঙে পড়ে যাবে ক-দিন বাদেই।

তা বটে। ঘোষ সাহেব বললেন। ডা. বিধান রায় থেকে সিদ্ধার্থশংকর রায় থেকে সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, মানে অপর্ণা সেন-এর বাবা, ব্রাহ্ম, কে না ছিলেন বা আছেন?

অগ্নি বলল, এ প্রসঙ্গ থাক। এটা আমাদের এক্তিয়ার বহির্ভূত-ও বটে। অন্য প্রসঙ্গে যাওয়া যাক।

ঘোষ সাহেব বললেন, তা ঠিক।

অরা বলল, যে-গানটা গাইলে ওটি কার লেখা?

-–ওটি কালীনাথ রায়ের লেখা। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গানও আমি জানি।

–গেয়ে শোনান-না।

ঘোষ সাহেব বললেন।

–পরে হবে। এখন গাইলে ওভারডোজ হয়ে যাবে।

–তবে অন্য একটি গান শোনাতে পারি। অসাধারণ গান একটি।

–কী গান?

“কেন ভোলো মনে করো তাঁরে যে সৃজন পালন করেন এ সংসারে।” –উপনিষদের একটি বিখ্যাত শ্লোক “জবনো অপানিপাদো ইত্যাদির বাংলা তর্জমা করে নিমাইচরণ মিত্র মশায় সুরারোপও করেছিলেন।

অগ্নি তারপর বলল, আমরা কেবল রবীন্দ্রনাথকেই জানি। কিন্তু ঠাকুর পরিবারের অন্যান্য বহুমানুষ যে, সাহিত্যে, গানে, ছবি আঁকাতে অসাধারণ প্রতিভাবান ছিলেন, সে-খবর আমরা খুব কম জনেই রাখি। বহুবছর আগে, এক গ্রীষ্মসন্ধ্যাতে দিল্লির ‘মিরাণ্ডা’ হাউসের লন-এ একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন সুধীর চন্দ মশায়, “Other Tagores”-দের গান নিয়ে। তখন আমি ছেলেমানুষ। মায়ের সঙ্গে শুনতে গেছিলাম। এখনও সেই অনুষ্ঠানের স্মৃতি মনে জ্বলজ্বল করে। অসাধারণ!

ব্রতীন বলল, অপালাও শান্তিনিকেতনে পড়তেন জানলাম। আপনারাও কি ব্রাহ্ম?

অপালা মাথা নোয়াল, বলল, অরা তো জানে। ব্রাহ্ম হওয়াটা কি অপরাধের?

ব্রতীন লজ্জা পেয়ে বলল, না, না, ছিঃ ছিঃ অপরাধ কেন? গর্বের-ই। হিন্দুদের মধ্যে যাঁরা ক্রিম তাঁরাই তো ব্রাহ্মধর্মের পত্তন করেছিলেন একসময়ে। তাঁরাই হিন্দু সমাজের মাথা ছিলেন।

অগ্নি বলল, রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে কিন্তু লিখেছিলেন: “হিন্দু ধর্ম যদি মৃত হইত তাহা হইলে ব্রাহ্মধর্মকে প্রসবই করিতে পারিত না।”

ঘোষ সাহেব বললেন বাঃ। সবাই ভালো। কিন্তু ব্রাহ্ম মেয়েরা কি তাদের সমাজে ভালো ছেলে পায় না বিয়ে করার মতো? পেলেও, অনেক সময়েই পিসতুতো, মাসতুতো ভাইবোনকে বিয়ে করেন। তবে আমার নিজের অনেক ব্রাহ্ম বন্ধুবান্ধব আছে। তাদের একটি বিশেষ ক্যারেস্টারিস্টিক লক্ষ করেছি।

–কী?

–তাঁরা স্ত্রী ও বাড়ির ডাক্তারকে গোঁড়া হিন্দু ব্রাহ্মণ যেমন নারায়ণ শিলাকে মান্য করেন, ঠিক তেমন করেই মান্য করেন।

–কেন?

-–কেন জানি না।

–তবে এ নিয়ে একটি গবেষণা হওয়া দরকার। গবেষণা হলে, ডক্টরেটও কেউ হয়ে যেতে পারেন। আমেরিকাতে তো বাঁদরের গা কেন চুলকোয়? অথবা বকবকম বা পায়রা কেন করে এ নিয়েও ডক্টরেট হচ্ছে মানুষে। কামাচকাটকান, হুঁকান ইত্যাদি কত ভাষা নিয়ে গবেষণা করেও ডক্টরেট হচ্ছেন কতজনে। কেউ কেউ আবার বিলম্বিত ডক্টরেটও। শিবঠাকুরের দেশ বটে একটা।

–তাঁরা সব দু-কান-কাট্টান মানুষ।

সকলে ঘোষ সাহেবের কথাতে হেসে উঠলেন।

–এবারে এইসব পেটিফগিং ছেড়ে গানে ফেরা যাক। এসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ মানডেন ব্যাপার নিয়ে আলোচনা তো কলকাতাতে বসেও যেকোনো সময়েই করা যেতে পারে।

ব্রতীন বলল।

–তা ঠিক। এবারে কে গাইবে অপালা না অরা?

অগ্নি বলল।

অপালা বলল, অরা গাইবে। স্পাইট দিয়ে জিনটা বেশ উপভোগ করছি আমি। দারুণ পরিবেশ, না? ঝুপড়ি ঝুপড়ি গাছ থেকে কালো কালো বেড়ালের মতো ছায়াগুলো লাফিয়ে পড়েছে বাংলোর আলো-আঁধারি মাখা হাতার মধ্যে। সত্যিই মনে হচ্ছে, এখানে কাব্রাল সাহেব তাঁর মুন্ডুহীন ধড় নিয়ে টুপিটি হাতে করে যখন তখন দেখা দিলেও দিতে পারেন।

তৃষা আপত্তি করে বলল, অপালামাসি, ভালো হচ্ছে না কিন্তু, প্লিজ এসব টপিক বন্ধ করা।

–এই ইন্টারেস্টিং কাব্রাল সাহেবটি কে বটেন?

নরেশ বলল।

–এই কাব্রাল সাহেবের কথা ‘একটু উষ্ণতার জন্যে’ উপন্যাসেও আছে।

প্রশ্নটাকে এড়িয়ে গিয়ে ব্রতীন বলল, ইন্দ্ৰজিবুর কাছ থেকেই শুনেছিলাম যে, কাব্রাল সাহেবের বাড়িটিই সাহেবের মাইনিং এঞ্জিনিয়র জামাইয়ের কাছ থেকে কেনেন, সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ। আর তাঁর কাছ থেকে বছর পনেরো পরে কেনেন অপর্ণা সেন। পরে অপর্ণা সেন-এর কাছ থেকে কেনেন গুনেন মিত্র মশায়, লাইসি স্কুলের মালিক সোমনাথ মিত্রর বাবা। অপর্ণা সেন-এর মালিকানাধীন থাকার সময়ে ও বাড়িতে রাইফেলের গুলিতে একজনের মৃত্যুও ঘটে।

–খুন?

–তা বলতে পারব না। তবে অপর্ণার তৎকালীন স্বামী মুকুল শর্মার রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার বাবার কারবাইন রাইফেলের গুলিতেই নাকি মরে একজন।

–মুকুল শর্মা মানে কঙ্কনা সেন শর্মার বাবা?

–ইয়েস। অপর্ণার সেকেণ্ড হাজব্যাণ্ড।

–আর কল্যাণ রায় তা হলে কে?

–উনি থার্ড হাজব্যাণ্ড।

–অ।

–মানে? ঠিক কী ঘটেছিল?

নরেশ উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

–আমার তা জানার বা গোয়েন্দাগিরি করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। অ্যাকসিডেন্ট-ই হবে হয়তো। তবে যা শুনেছি ইন্দ্রজিৎবাবুর কাছে তাই বললাম। আমরা এসেছি আড়াইদিনের জন্যে বেড়াতে। এসব নিয়ে গসিপ করতে তো আসিনি।

–তা অবশ্য ঠিক।

–মিসেস বাসু, এবারে গানটা হোক।

বলেই, খালি হওয়া গ্লাসটা নরেশের দিকে এগিয়ে দিলেন ঘোষ সাহেব।

অরা ধরল,

অবেলায় যদি এসেছে আমার মনে দিনের বিদায়ক্ষণে।গেয়োনা, গেয়োনা, চঞ্চল গান ক্লান্ত এ সমীরণে…

অপালা বলে উঠল, সাধু! সাধু!

তার গলাতে উচ্ছ্বাসের একটু আধিক্য লক্ষ করা গেল। যা সচরাচর দেখা যায় না।

বলেই, অপালা তার গ্লাসটাও নরেশের দিকে বাড়িয়ে দিল।

বোঝা গেল যে, এই আরণ্যক সন্ধেটি খুব-ই এনজয় করছে অপালা।

নরেশ ওর গ্লাস জিন আর স্পাইটে ভরে দিয়ে বলল, ভালো লাগছে না মিসেস ঘোষ?

ঘোষ সাহেব নরেশের দিকে চাইলেন একবার। চাউনিতে কোনো অসূয়া ছিল না। মজা ছিল।

অপালা বলল, ব্যাপারটা কী জানেন?

–কী?

নরেশ একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল।

-Ambience! আপনি এক কাপকফি বাড়িতে খান আর এককাপ কফি খান ‘তাজ বেঙ্গল’-এর সুইমিং পুল-এর পাশের কফি শপ-এ বসে, দেখবেন, আকাশ-পাতাল তফাত। সেইরকমই এই যে, গান শোনাল অরা আমাদের রাতে ম্যাকলাস্কিগঞ্জে, এই পরিবেশে, এরসঙ্গে তুলনা করা যায় এরকম খুব কম জায়গার-ই। এক একটা গান, কোনো এক বিশেষ পরিবেশে, প্রতিবেশে শুনলে, তা আজীবন মনে গেঁথে যায়। রবীন্দ্রনাথের তরুণ সমালোচকেরা তাঁদের মূর্খামি এবং অকারণ ঔদ্ধত্যে যাই বলুন না কেন, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষিত বাঙালির মনে চিরদিন-ই বেঁচে থাকবেন, বিশেষ করে তাঁর গানে। যাঁরা এই সুধারস থেকে বঞ্চিত হলেন, তাঁদের অনুকম্পা করা ছাড়া আর কীইবা করা যায়।

-বাবাঃ! খুব কঠিন কঠিন শব্দের বাংলা বলছ তো তুমি আজ। হলটা কী? কী জিন দিয়েছিলেন মশাই আমার স্ত্রীকে?

নরেশ বলল, Booths Gin।

–অ!

নরেশ বলল, আপনি একেবারেই ঠিক বলেছেন অপালা। রবীন্দ্রনাথকে যাঁরা অস্বীকার করেন, তাঁদের বিসমিল্লাতেই কিছু গলদ অবশ্যই থেকে গেছে বলতে হবে। সে কথা তাঁরা স্বীকার করুন আর নাই-ই করুন।

-এরপরে কে গাইবে?

অপালা বলল, গা-না একটা গান, তৃষা।

–আমি পারি না।

–যা পারিস তাই গা-না। অরা বললেন।

–তাহলে একটা গান পুণেতে হর্ষদকে শুনিয়েছিলাম, সেটাই গাই, সবসুদ্ধ জানিই তো, সাড়ে তিনটে গান।

–আগেকার দিনে প্রত্যেক বাঙালি মেয়েকে বিয়ের আগে অন্তত পাঁচটি পুরো গান শিখতে হবে। তা কি জানো? তা তার গলাতে গান থাকুক আর নাই থাকুক। মেয়ে দেখতে যাঁরা আসতেন তাঁদের সামনে তো গাইতে হই এবং সেই পাঁচটিই গাইতে হত বাসরেও।

ব্রতীন বলল।

–কী টরচার বলুন তো!

ঘোষ সাহেব বললেন।

–নিশ্চয়ই। মেয়েটির ওপরে তো অবশ্যই।

নরেশ বলল।

–আমি শ্রোতাদের কথা বলছি।

সকলে হেসে উঠলেন ঘোষ সাহেবের এই কথাতে।

-গাও তৃষা।

অপালা বলল।

তৃষা ধরল,

তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে
তখন ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে।

.

১৮.

সকালে ঘুম থেকে আগে পরে উঠে কেউ চা খেয়ে, কেউ না খেয়েই হাঁটতে বেরিয়ে পড়েছিল বাড়িটির বাঁ দিকের পথে নামার দিকে নয়তো ডান দিকের পথে। ব্রতীন, নরেশ এবং অপালা একটি দলে, ঘোষ সাহেব, রুরু ও তৃষা অন্য দলে এবং অগ্নি আর অরা অন্যদলে। পলাশ এখনও ফুটছে। গাছে গাছে নতুন পাতা এসেছে। কোথাও বা পাতার রং গাঢ় সবুজ হয়ে গেছে, কোথাও এখনও কচিকলাপাতা সবুজ। ক্কচিৎ কুসুমের পাতাতে হালকা লাল আভা এসেছে। মাছের রক্ত-ধোওয়া জলের মতো লাল।

বাড়ির সামনেই পথের ওপরে একটা ছোট্ট পুকুর মতো আছে। এখন জল সামান্যই আছে। তারপাশে একটি বড়োগাছ বাজ পড়ে মরে গেছে। কী গাছ কে জানে?

ঘোষ সাহেব বললেন, তৃষা ও রুরুকে, এই গাছে বসে টিপনিস নামের এক সাহেব একটা চিতাবাঘ মেরেছিলেন। চিতাটা একটা বাছুর ধরেছিল। প্রথম রাতে কিছুটা খেয়ে পরদিন সন্ধেবেলা যখন বাকিটা খেতে এসেছিল তখন-ই মারেন টিপনিস সাহেব। বাঘটা খুব বুড়ো হয়ে গেছিল।

–তাই?

–হ্যাঁ। না হলে আর বলছি কী?

–কতদিন আগে?

–এই বছর পনেরো আগে।

–আপনি তো আঙ্কল এই প্রথমবার এলেন এখানে। আপনি জানলেন কী করে?

রুরু জেরা করল ঘোষ সাহেবকে।

ঘোষ সাহেব হেসে বললেন, সারমাইজ। বুঝলে না! অনুমানের মধ্যেই সত্য লুকিয়ে থাকে। এমন তো হতেই পারত, নাকি বলো?

ওরা হেসে উঠল।

তারপর বললেন, আসলে ব্রতীনবাবুর কাছে শুনেছি।

নিঃসন্তান ঘোষ সাহেব অরার ছেলেমেয়েদের খুব-ই ভালোবাসেন। এমনকী হর্ষদকেও মাঝে মাঝে ফোন করেন পুণেতে, সময় পেলে। সন্তানহীন মায়ের দুঃখ নিয়ে অনেক গল্প উপন্যাস লেখা হয়েছে সব ভাষার-ই সাহিত্যে কিন্তু সন্তানহীন পুরুষের দুঃখ নিয়ে খুব কমই লেখা হয়েছে। সময়ে ছেলেমেয়ে হলে তৃষা ও রুরুর মতো ছেলেমেয়ে ওঁরও থাকতে পারত। বিদেশ থেকে মক্কেলরা নানারকম চকোলেট এবং অন্যান্য উপহার নিয়ে আসেন ওঁর জন্যে। সঙ্গে সঙ্গে উনি ওদের তা চালান করে দেন। তৃষার আঠেরো বছরের জন্মদিনে অগ্নি ওকে একটি মোবাইল ফোন দিয়েছিল। আর কুড়ি বছরের জন্মদিনে একটা কম্পিউটার। রুরুর সতেরো বছরের জন্মদিনে রুরুকেও একটি কম্পিউটার উপহার দিয়েছেন ঘোষ সাহেব। যে দান বা উপহারে কোনো স্বার্থ’ নেই তার দাম-ই আলাদা। অগ্নিকে উনি মনে মনে ঈর্ষা করেন। কারণ উনি জানেন যে, তৃষা ও রুরু অগ্নিকে বাবার মতোই দেখে। উনি তো ওদের চেনেন যোধপুর পার্কে, ওরা ওঁর প্রতিবেশী হওয়ার পর-ই। মাত্র পাঁচ-ছ বছর হল। কিন্তু এই অল্পসময়েই উনি ওদের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছেন।

.

১৯.

–এগুলো কী ফল আঙ্কল?

রুরু বলল, একটা সাত-আট ফিট উঁছু গাছকে দেখিয়ে।

–এ গাছ চিনিস না রে বোকা। এর নাম আমলকী। ওই দেখ, ফলও ধরেছে। পাড়, পেড়ে খা। আমলকী খেয়ে জল খেলে মুখটা যে, কী মিষ্টি লাগে তা বলার নয়। আমাদের মামাবাড়ির বাগানে অনেক বড়ো বড়ো গাছ ছিল। জলপাই গাছ ছিল।

–যে জলপাই দিয়ে টক হয়, আচার হয়?

তৃষা বলল।

রুরু বলল। হ্যাঁরে।

ঘোষ সাহেব ভাবছিলেন, এরা কম্পিউটারে বসে ইন্টারনেট ব্রাউজ করে পৃথিবীর সব খবর নখদর্পণে রেখেছে কিন্তু জলপাই বা আমলকী গাছ চেনে না। কে জানে! হয়তো ধানগাছও চেনে না। পৃথিবীটাই বদলে গেছে এখন। বড়ো অল্পকদিনেই বদলে গেল। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের শৈশব নেই, কৈশোর নেই, ঘোষ সাহেবরা যাই জেনেছিলেন, ধীরেসুস্থে জেনেছিলেন, এত অল্পবয়সে অতকিছু জানতেন না তাঁরা। তাঁদের অতিসাধারণ সব ব্যাপারে কৌতূহল ছিল অপরিসীম, বিস্ময়বোধ ছিল, অতিসহজেই তাঁরা খুশি হতেন।

–পেড়েছিস? দাঁড়া! আমি রুমাল দিয়ে ভালো করে মুছে দিই। ধুলো পড়ে থাকবে আমলকীর ওপরে। নে, খা এবারে।

ঘোষ সাহেব বললেন।

তারপর বললেন, তুই যে-প্যান্টটা পরেছিস সেটা ভারি অদ্ভুত দেখতে। না ফুল না হাফ। আমাদের ছেলেবেলাতে কলকাতা পুলিশের ট্রাফিক কনস্টেবলরা এমন প্যান্টুলুন পরত।

–প্যান্টুলুন কী? বলুন প্যান্টালুন। ‘প্যান্টালুন’-এর দোকান দেখেননি?

–কী আর দেখলাম বল? দেখলাম তো শুধুই হাইকোর্ট। তা এই পেন্টুলুনের নাম কী? প্যান্টালুন?

–এগুলোকে বলে ‘বাহামাজ’। অগ্নিকাকু কিনে দিয়েছেন।

–তাই?

–তবে এরসঙ্গে হাফপ্যান্টের তফাত কী? আমরা তো খাকি-রঙা হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে। যেতাম আর ছিটের শার্ট।

-তফাত? তফাত হচ্ছে এই যে, এটাই আজকালকার ফ্যাশন। আর খুব দামি। অবশ্য মোটা কাপড়ে বানানো হয় বলে টেকেও অনেকদিন।

–অ।

ঘোষসাহেব বললেন।

 ঘোষসাহেবের বাবা ব্যারিস্টার ছিলেন না, অধিকাংশ সফল ব্যারিস্টারদের মতো। নিজের কৃতিত্বেই তিনি বড়ো হয়েছেন। এক বড়োলোক আত্মীয়র কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে বিলেতে গেছিলেন ব্যারিস্টারি পড়তে। দেশে ফিরে নিজের বাগ্মিতায় আর মেধায় ধীরে ধীরে পসার গড়ে তোলেন। হাইকোর্টে এখন মানুষে ওঁকে প্রথম পাঁচজনের মধ্যে গণ্য করে। গোপনে অনেক দানধ্যানও করেন। অনেক গরিব ছাত্রদের পড়াশোনার খরচ জোগান। তবে মানুষটা শুধু আইন-ই বোঝেন। সাহিত্য, সংগীত এসব নিয়ে তাঁর বিশেষ উৎসাহ নেই। ভারতীয় সংবিধানের ওপরে খুব বড় একটা কাজ হাতে নিয়েছেন। ইস্টার্ন ল হাউস থেকে বেরোবে শেষ হলে। বইটা বেরোলে সারাদেশে যে, হইহই পড়ে যাবে সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই।

ঘোষ সাহেব বললেন, কেমন লাগছে রে, জায়গাটা?

দা—রু-ণ।

সমস্বরে বলল, ওরা দু-ভাইবোন।

–‘প্রকৃতি’র একটা আলাদা প্রভাব আছে মানুষের মনের ওপরে। তোরা বড়ো অভাগা। তোদের জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির প্রায় কোনোই যোগাযোগ নেই। ছেলেবেলায়, আমরা থাকতাম কৃষ্ণনগরের নেদেরপাড়াতে। কত গাছপালা, মাঠ, ঘাট, চূর্ণি নদী। রানাঘাটের কাছে ছিল জলঙ্গী নদী। রাজবাড়িতে রাসের মেলা। তখন চারদিকে গাছপালা আর গাছপালাই ছিল। পাখি, প্রজাপতি আর ফুলেদের সঙ্গে ছিল আমাদের খুব ভাব। তোদের মতো কংক্রিটের জঙ্গলে তো বড়ো হয়ে উঠিনি আমরা। পাগলাচন্ডীতে খুব নাম করা ব্যারিস্টার শংকরদাস ব্যানার্জির বিরাট বাগান এবং খামারবাড়ি ছিল। ওঁর ছেলে শিবদাস ব্যানার্জিও ব্যারিস্টার। বাবাকে শংকরদাসবাবু খুব ভালোবাসতেন। বাবার সঙ্গে গিয়ে মাঝে মাঝেই উইকএণ্ডে সেখানে গিয়ে থাকতাম। উনি আসতেন কলকাতা থেকে। ওঁকে দেখেই তো, আমার ব্যারিস্টার হওয়ার ইচ্ছে জাগে মনে। ব্যারিস্টারি পাশ করে এসে আমি ওঁর জুনিয়রও ছিলাম অল্প কিছুদিন।

–চলুন আমরা ফিরি। অনেক তো হাঁটা হল। মা আর অপা কাকিমা কোথায় গেল?

–যার যেদিকে খুশি যাক না। শহরে সকলেই তো খাঁচার পাখি। একটু ইচ্ছেমতো ডানা মেলুক যার যেমন খুশি। তোদের অপা মাসিমা ভীষণ আমুদে, ফুর্তিবাজ। আমি তো ওকে কোনো কোম্পানিই দিতে পারি না। তাও তোর মা আর তোরা পাশে আছিস। ও একটু নিশ্বাস নিয়ে বাঁচে।

–কেন দিতে পারেন না মেসোমশাই?

–তোরা এখনও ছোটো। এখন বুঝবি না, পরে বুঝবি। জীবনে প্রত্যেক জিনিসের জন্যে একটা দাম ধরা থাকে। বুঝেছিস বড়ো বড়ো দোকানে জিনিসের ওপরে যেমন প্রাইস-ট্যাগ থাকে-না? আমাদের জীবনটাও তেমন-ই। পুরো মূল্য না দিয়ে কোনো কিছুই পাওয়া যায় না। আমি জীবনে অনেক টাকা, মান, সম্মান ও প্রতিপত্তি পেয়েছি। কিন্তু আমি যদি একজন সাধারণ আনসাকসেসফুল মানুষ হতাম, তবে বড়ো হতে গিয়ে যা-কিছু আমি হারিয়েছি, তা হারাতে হত না। তোদের সামনে মস্তবড়ড়া জীবন পড়ে আছে। আমি যা পারিনি তোরা যেন তা করতে পারিস। সবকিছুর মধ্যে একটা ব্যালান্স, একটা হারমনির খুবই দরকার। নইলে, মানুষের জীবন সার্থক হয় না।

ওরা দু-জনে চুপ করে শুনল। বাড়ির দিকে ফিরে যেতে যেতে। ঘোষ মেসোমশায়ের জন্যে ওদের কষ্ট হচ্ছিল।

ঘোষ সাহেব ভাবছিলেন, এতকথা ওদের বলে কী লাভ হল? ওরা ছেলেমানুষ। কত স্বপ্ন ওদের, কত মজা সামনে। এসব গভীর কথা বোঝার সময় এখনও হয়নি ওদের।

নিজেই বললেন, এই যে, তোদের এতকথা বললাম তাও এই প্রকৃতির-ই প্রভাবে। মানুষ আসলে প্রকৃতির-ই সন্তান। প্রকৃতির মধ্যে এলে তার মন পাপড়ি মেলতে থাকে। যে-কথা, যে-কাজ অন্য জায়গাতে করা যেত না, যা করার কথা ভাবাও যেত না, তাই করা যায়, ভাবা যায়। উই আর ওলওয়েজ ইন আওয়ার এলিমেন্টস হোয়েনেভার উই কাম টু নেচার।

তারপর বললেন, তোদের অগ্নিকাকা আর তার বন্ধুদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কী সুন্দর একটা জায়গাতে নিয়ে এল বলত কলকাতা থেকে মাত্র চব্বিশঘণ্টার মধ্যে।

তৃষা বলল, আমার তো কলকাতা থেকে বেরোলেই, নীল আকাশ দেখতে পেলেই, মন ভালো হয়ে যায়।

-নীল আকাশ তো ফ্ল্যাট থেকেও দেখা যায়।

রুরু বলল।

-সেরকম দেখা নয়। পথের দু-পাশের গাছগাছালি বাড়িঘর দিগন্ত অবধি যেখানে চোখ চলে যায় বাধাহীন, সেই আকাশের কথা বলছি।

তৃষা বলল।

–সেটা অবশ্য ঠিক।

রুরু বলল।

.

২০.

–এখানে বসবে একটু?

অগ্নি বলল, পথের বাঁ-পাশে মস্ত একটি কালো পাথরের চ্যাটালো শরীর দেখিয়ে। পাথর তো নয় যেন কোনো ভিল যুবকের বুক।

–বসবে? দেরি হয়ে গেলে ওঁরা কিছু মনে করবেন হয়তো।

অরা বলল।

–পৃথিবীর সব মানুষের মন বুঝেই তো বেঁচে এলে এতদিন। এবারে আমার মনটা একটু বোঝার চেষ্টা করো।

–ছেলেমেয়ে দুটোই বা কী করছে?

–কিছুই করছে না। অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন একজন মানুষের সঙ্গে আছে। বেশ কিন্তু মানুষটি। খাঁটি মানুষ। তোক দেখানো কোনো ভড়ং নেই। প্রফেশনাল টু হিজ বোনস। নিজের জগতে থাকা মানুষ। ভাবটা live and and let live,

–তা ঠিক। তবে অপা আর ঘোষ সাহেবের ম্যাচটা ফিটিং হয়নি।

–ক-জন স্বামী-স্ত্রীরই বা পুরোপুরি মিল থাকে। তুমি আর আশিস একসেপশনাল কেস ছিলে। তবে ওঁদেরও মানে, ঘোষ সাহেবদের ছেলেমেয়ে যদি থাকত তবে এই অমিলটা চোখে পড়ত না। ছেলেমেয়েরাই এসে দাম্পত্যের ফাঁকটা পূরণ করে দেয়।

–ওঁরা দুজনেই দুরকম। বেচারা।

–সংসারে বেচারা নয় কে? তুমি এবং আমিও কি বেচারা নই?

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে অরা বলল, ছেলেমেয়েদের বড়ো করে তোলার দায়িত্ব যদি, না থাকত, যদি আমাকে চাকরিও করতে না হত, তবে এরকম-ই কোনো জায়গাতে, অথবা হাজারিবাগের মতো, বাকিজীবনটা কাটিয়ে দিতাম।

–এ-জায়গাটা হাজারিবাগের চেয়েও সুন্দর। তোমার ছেলেবেলায় হাজারিবাগকে তো দেখিনি, বলতে পারব না, তবে তোমার সঙ্গে আলাপিত হতে যখন, আশিসের সঙ্গে গেছিলাম তখন জায়গাটাতে এই জায়গার চেয়ে ভিড় অনেক বেশি ছিল। এখানেও ভিড় আছে নিশ্চয়ই তবে সেটা স্টেশনের দিকেই হবে। রেলগাড়ি এলেই জায়গার নির্জনতা ছিঁড়ে খুঁড়ে যায়। হাজারিবাগে এখনও রেল লাইন যায়নি বলেই হয়তো এখনও জায়গাটার কিছু নিজস্বতা আছে।

–তা ঠিক।

–যে-জায়গাটাতে আমরা বসে আছি এখানের চারপাশে নাকি রাসেল স্ট্রিটের সাটনস সিডস থেকে অনেক প্যাকেট পুর্টোলাকার বীজ এনে বুদ্ধদেববাবু ছড়িয়ে দিতেন প্রতিবর্ষাতে। যাতে, বসন্ত শেষে বহুবর্ণ পুর্টোলাকাতে ছেয়ে যায় জায়গাটা। পেছনে চেয়ে দ্যাখো, একটা উপত্যকা আছে অনেক নীচে। পথের ডান দিকেও আছে উপত্যকা–ম্যাকলাস্কি’জ মোজ এর নীচে। সেখানে একটি গ্রামও আছে, যার নাম বাসারিয়া।

–তুমি এত জানলে কোথা থেকে?

–‘একটু উষ্ণতার জন্যে’ বইটি পড়ে এবং ব্রতীনের মুখে শুনে।

–বইটি আমার পড়া নেই।

–তোমাকে পড়াব কলকাতাতে ফিরে। পড়াব মানে, প্রেজেন্ট করব। কিছু বই থাকে, যা, বার বার পড়বার। যেকোনো ক্লাসিক সম্বন্ধেই এ কথা খাটে।

–তা ঠিক।

–ইচ্ছে করে, এখানে আমরা বাকিজীবনটা এই পাথরটার ওপরে বসেই কাটিয়ে দিই।

–ইচ্ছে তো কত কিছুই করে। সব ইচ্ছের আগুনকে হাওয়া করতে নেই, বিশেষ করে যেসব ইচ্ছে ভিজে গেছে, আগুন জ্বলার সম্ভাবনা নেই।

অরা বলল।

অগ্নি চুপ করে রইল।

তারপর বলল, অগ্নির ইচ্ছেতেও যদি আগুন না জ্বলে তবে তা বড়ো দুর্দৈবর-ই কথা বলতে হবে।

শব্দ না করে হাসল অরা।

তারপর বলল, চলো, উঠি। ওরা সকলেই ফিরে গেছে নিশ্চয়ই। ব্রেকফাস্ট খেয়ে তারপরে জায়গাটাকে ঘুরে দেখার জন্যে বেরোতে তো হবেই।

–হেঁটে তো দেখা যাবে না। বিরাট এলাকা। গাড়িতেই যেতে হবে।

–চলো, ওঠো।

–ব্রেকফাস্টে কী খাবে?

–দ্যাখো, এখানে আড়াইদিনের জন্যে এসে তুমি বা অপালা এসব নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামিয়ো না।

অগ্নি বলল।

তারপর বলল, তবে এসব রান্নাবান্নার ব্যাপারে আমি অপদার্থ হতে পারি কিন্তু ব্রতীন আর নরেশ খুব ভালো। তা ছাড়া, রান্নার লোকও তো আছে এখানে। আড়াইটা দিন, জাস্ট রিল্যাক্স করো। খাওয়ার সময়ে যা হয় পেলেই চলবে আমাদের সকলের।

-–ঠিক আছে। তুমি যা বলবে তাই হবে।

–একটু দাঁড়াও অরা। হঠাৎ-ই দাঁড়িয়ে ওঠা অরার পথরোধ করে বলল অগ্নি।

–একটু দাঁড়াও।

আবারও আকুতি করে বলল অগ্নি।

–কী হল আবার তোমার?

–তোমাকে একটা চুমু খাব?

অরা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে, মুখ নামিয়ে বলল, খাও।

চুমু অশনিসংকেতের সূত্রপাত। রক্তের মধ্যে তুফান তোলে চুমু। নিশ্বাস দ্রুততর হয়। চুমু থেকে দু-টি শরীর গড়িয়ে যেতে পারে অনেক খানাখন্দে। কিছুক্ষণ ফাঁদে-পড়া পাখির মতো ছটফটানির পরে অরা দু-হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল অগ্নিকে।

অস্ফুটে বলল অরা, আশিসের কাছে, আমার সন্তানদের কাছে ছোটো হয়ে গেলাম আমি।

–তুমি কোন যুগে যে, বাস করো। সত্যি! আজকের দিনে অভাবনীয়।

–কী করব!

–নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে অরা বলল, আমি যে আমিই! আমাকে ক্ষমা করো। তোমার কাছে আমি যে, কত অপরাধী হয়ে থাকি প্রতিটা মুহূর্ত তা তুমি কখনো জানবে না। এমন অবুঝপনা করে আমার দুঃখ আরও বাড়িয়ে না অগ্নি। তোমাকে তো বলেইছি আমি, যা দিতে পারি তা তত দিই-ই, সবসময়েই দিই, যা পারি না, তা চেয়ে তুমি আমাকে আরও বেশি অপরাধী কোরো না। প্লিজ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *