১৫-১৬. শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পরে

শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পরেই রমার নাক ডাকার আওয়াজ শোনা যেতে লাগল। সুন্দরী মেয়েরাও যে কি বিশ্রী আওয়াজ করে নাক ডাকে তা যাঁরা স্বকর্ণে শোনেননি তাঁরা বোধহয় জানেন না।

আমার ঘুম আসছিল না। শুয়ে শুয়ে নানা কথা ভাবছিলাম। অনেক মাস পরে রমা আমাকে ওর শরীরে আসার জন্যে নেমন্তন্ন করেছিল আজ রাতে। যদি একে নেমন্তন্ন বলা চলে।

কিন্তু আমার ঘেন্না হয়েছিল।

ঘেন্নাটা রমার উপরে ত বটেই, ঘেন্নাটা পুরো ব্যাপারটার অশ্লীল প্রস্তাবনার উপরও হয়ত বা।

আমি জানি না অন্য পুরুষরা এ বাবদে কি ভাবেন, জানি না এ জন্যে যে, ব্যাপারটা এত ডেলিকেট ও ব্যক্তিগত যে তা নিয়ে কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গেও আলোচনা করার ইচ্ছা হয়নি কখনও।

মনে হয় যে, প্রত্যেকটি নারীই এক-একটি তারের বাজনার মত–তাদের সুরে বাজালে তারা ভরপুর সুরে বাজে–তারা রবিশঙ্করের সেতারের মত গমগমে সুরে বাজে–কিন্তু তা না হলে আলাপ, বিস্তার, ঝালা সবই তখন বেসুরো। যাদের রসজ্ঞান আছে, সুরুচি আছে, তাদের কাছে সুরের আর অসুরের মধ্যে তারতম্যটা অনেকখানি।

যাঁরা বাজাতে হবে বলেই বাজাতে ভালোবাসেন, এককথায়, যাঁরা কমপালসিভ বাজিয়ে, আমি তাঁদের দলে নই। যে-বাজনা আলাপের গভীর গম্ভীর অস্ফুট খাদ থেকে ঝালার চঞ্চল দ্রুতধাবমানা অস্থির আনন্দে শিহরিত অনুরণিত পঞ্চমে না পৌঁছয়, সে-বাজনা বাজাতে বা সেই বাজনায় সঙ্গত করতে আমি রাজি নই।

গানের সঙ্গে যেমন গায়কীর, সারেঙ্গীর সঙ্গে যেমন গায়কের, তেমন শরীরের সঙ্গে মনের পূর্ণ সমর্থন ও বোঝাবুঝি না থাকলে কারো শরীরে যাওয়ারই মানে নেই।

এতসব তত্ত্বকথা নিয়ে মাথা ঘামাতাম না আমি, এই সুকুমার বোস এ নিয়ে সোচ্চার চিন্তাও করত না। যদি না আমি ভুক্তভোগী হতাম; যদি না রমার এ ব্যাপারের অদ্ভুত শীতল ব্যাখ্যাহীন অশালীনতা আমাকে চিরদিন পীড়িত না করত।

শারীরিক সম্পর্ক ব্যাপারটাতে চিরদিনই গলদঘর্ম কর্তব্যকর্ম যা ছিল, তা আমারই ছিল; রমা চিরদিনই একজন মহান, প্রাচীনা মহিলার মত তার গর্বিতা, দয়াবতী, কড়িকাঠ-গোনা প্যাসিভ ভূমিকায় কয়েক মিনিটের আড়ষ্ট অভিনয় শেষ করে এয়ারকন্ডিশনার এবং দেওয়ালের নীরব টিকটিকিদের (যারা তার কৃতিত্বের একমাত্র সাক্ষী থাকত) কাছ থেকে প্রচণ্ড হাততালি আশা করত।

জানি না, হয়ত আমি এই সুকুমার বোস, অতিমাত্রায় রোম্যান্টিক, অতিমাত্রায় পারফেকশনিস্ট বলে এই ব্যাপারটাকে নিয়ে এমন মর্মান্তিক শীতল হেলাফেলা আমার কাছে ভণ্ডামিরই নামান্তর বলে মনে হত। যে ভণ্ডামি আমাদের দুজনকেই সুস্থ, স্বাভাবিক, খুশি জীবন থেকে পদে পদে বঞ্চিত করেছে।

আমি চিরদিনই ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে সম্মান করে এসেছি। কাউকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাঁধতে চাইনি আমার কাছে, কারো উপর নিজের ইচ্ছা জোর করে চাপাইনি, বদলে এইটুকুই শুধু আশা করেছি যে, অন্য পক্ষও আমাকে এই স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করবে না।

রমার চরিত্রটা এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ওকে বুঝতে পারি না।

ও এখন সীতেশের সঙ্গ চায়, অথচ সীতেশকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করতে চায় না। আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না, অথচ আমাকে স্বামী হিসেবে সমাজে প্রেজেন্ট করতে চায়। কোনো ইম্প্রেসারিও যেমন করে ঘোঘল পাশা যাদুকর বা স্বামী শ্রীমৎ হঠযোগীনন্দকে উপস্থিত করে, তেমন করে।

এই অবস্থাটা আমার পক্ষে নিতান্ত অস্বস্তিকর। একে মানিয়ে নেওয়া মুশকিল। আমার অসুখের আগে অবধি ছুটিই ছিল আমার সঙ্গে রমার মনোমালিন্যের একমাত্র কারণ। কিন্তু এবারে ছুটি সম্বন্ধে ওর এই ঔদাসীন্য আমাকে আশ্চর্য করেছে। কারণ এতে কোনো ভুল নেই যে, ছুটির সব খবরাখবর ওর নখদর্পণে। আমার মনে হয়, ওর মাইনে-করা অপেশাদার গুপ্তচর আছে এখন। তারা তাদের কাজে এমন দড় যে, সি আই-এর বড়সাহেব জানতে পেলে অবিলম্বে তাদের মোটা মাইনেয় বহাল করতেন।

অথচ তবু সব জেনেশুনেও ওর এই ঔদাসীন্য আমাকে অবাক ও ব্যথিত করেছে।

এই সব নানা কথা ভাবতে ভাবতে খাটে এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই।

হঠাৎ সীতেশের সঙ্গে দেখা। ঘুমের মধ্যে।

আশ্চর্য!

দেখলাম সীতেশ কেতুর-চোখেই সিগারেট ধরিয়ে রোদে এসে দাঁড়াল।

লালি এসে আমাদের দুজনের চা দিয়ে গেল।

সীতেশকে চা ঢালতে ঢালতে বললাম, তোরা হঠাৎ চলে এলি এখানে? খবর না দিয়ে?

সীতেশ হাসল। বলল, রমা বলল, চলো সরেজমিনে তদন্ত করে আসি।

আর তোর গার্লফ্রেন্ড সম্বন্ধে গুজবে কোলকাতার বাজার গরম।

তাই বুঝি? আমি বললাম। তারপর বললাম, তোর ব্যবসা কি বন্ধ করে দিয়েছিস না কি? কাজকর্ম নেই?

ও চমকে উঠল, বলল, ব্যবসা বন্ধ করব কেন? ব্যবসা চলছে।

আমি চুপ করে থাকলাম কিছুক্ষণ।

হঠাৎ সীতেশ বলল, রমা আসতে আসতে তোর কথা বলছিল। জানিস ত, শী ইজ ভেরী প্রাউড অফ উ্য।

আমি জবাব দিলাম না। তারপর বললাম, আর ডলি? তোর সম্বন্ধে ডলি প্রাউড না?  

ফুঃ। ও বলল, সিগারেটের ছাই ঝেড়ে। তারপর বলল, কি জানিস ত, ডলিকে ও যা চায় সবই আমি দিয়েছি–ওর বাইরে ওর কিছু চাইবার বা বোঝাবার নেই। ওকে নিয়ে আমার মস্ত সুবিধা এই যে, ও মনে করে ওর মত বুদ্ধিমতী মেয়ে পৃথিবীতে হয় না। এবং সেখানেই আমার সুবিধা। বুঝলি সুকুমার, মেয়েদের বাড়তে দিতে হয়, সব সময় জানবি, মেয়েরা গ্যাস-বেলুনের মত। ওদের মধ্যে গ্যাস পুরোপুরি দিয়ে দেবার পর তুই বারান্দার রেলিং-এ শুধু সুতোটা বেঁধে রাখ। দেখবি উপরে যে চড়েছে সে আর নামতে পাচ্ছে না। তুই নিজে সুতো টেনে না নামালে আর নামতে পাচ্ছে না–তখন তুই ইচ্ছেমত তলায় চরে-বরে খা।

আমি বললাম, তুই যেমন খাচ্ছিস?

ও আমার দিকে ঘুরে বলল, হাউ ডু য়্যু মীন?

আমি ওর বাঁ কানে হাত বুলিয়ে বললাম, তোর বাঁ কানটা ডান কানের চেয়ে বড় ছিল না? মনে আছে? এ নিয়ে কলেজের ছেলেরা ঠাট্টা করত। তোর এই বাঁ কানে পিস্তলের নলটা ঠেকিয়ে দিয়ে ট্রিগারটা টেনে দেব-ডান কানের ফুটো দিয়ে গুলিটা বেরিয়ে যাবে।

কি বুঝলি?

একটু থেমে বললাম।

সীতেশ অবিশ্বাসী গলায় বলল, হোয়াট?

আমি বললাম, চা খা। ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

সীতেশ অন্যমনস্ক গলায় চায়ে চুমুক দিল, বলল, কেন? তুই আমার সঙ্গে যুদ্ধ কর–অন্যভাবে পরাস্ত কর আমায়।

আমি বললাম, তোর সঙ্গে লড়বার মত যথেষ্ট সম্মান তোকে আমি দিতে রাজি নই। বিশ্বাসঘাতকদের সঙ্গে কেউ কখনও লড়ে শুনেছিস? বিশ্বাসঘাতকদের জাস্ট সাবড়ে দেওয়া হয়।

তোকে আমি ঘেন্না করি। রমার সঙ্গে তুই অন্তরঙ্গতা করেছিস বলে করি না, করি এই জন্যে যে তোকে আমি একদিন বন্ধুর মর্যাদা দিয়েছিলাম। তুই সেই সম্পর্কের অমর্যাদা করেছিস। তোর একমাত্র শাস্তি মৃত্যু। বন্ধুত্ব যে পৃথিবীর সব চেয়ে বড় প্রাপ্তি তা তুই কখনও বুঝিসনি। তা তুই শেষের দিনে জানতে পাবি।

.

ঘুম ভাঙল চোখে আলো পড়তে।

 তাড়াতাড়ি উঠলাম। বাড়িতে অনেক অতিথি।

বাবুর্চিখানার দিকে গিয়ে ব্রেকফাস্টের আয়োজন ঠিকমত করছে কিনা হাসান এবং লালি তা দেখে এলাম।

মুখটুখ ধুয়ে বাইরের রোদে পায়চারি করছি, দেখি, সীতেশ একটা চক্রা-বকরা ড্রেসিংগাউন গায়ে দিয়ে সিগারেটের টিন হাতে বেরিয়ে এল। দূর থেকে বলল, গুড মর্নিং।

আমি হাসলাম। বললাম, রাতে ঘুম হয়েছিল?

ও বলল, দারুণ। তারপর বলল, জায়গাটা বেশ। তবে একা একা থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোর মত পাগলরাই পারে।

শুধোলাম, তোরা আজই ফিরে যাবি?

ও বলল, ও ইয়েস, সার্টেনলি। লাঞ্চের ইমেডিয়েটলি পরেই।

 ইতিমধ্যে ডলি ও মাধুরীও গরম ড্রেসিংগাউন পরে বেরিয়ে এল। ডলি বলল, এই সুকুমার শীগগিরি চা–ভীষণ ঠাণ্ডা।

লালি চা নিয়ে এসেছিল–টি-কোজীতে কেটলি ঢেকে। চায়ের ট্রেটা বেতের টেবিলের উপর বসিয়ে রেখে গেল।

আমরা এক কাপ করে চা খেয়েছি এমন সময় রমা ভিতর থেকে চেঁচিয়ে বলল, বেয়ারা চায়ে লাও।

এখানে বেয়ারা কেউ নেই। যারা আছে তাদের প্রত্যেকের বাবা-মার দেওয়া একটা করে ভালো হোক খারাপ হোক নাম আছে। সেই নামেই আমি তাদের ডেকে থাকি। বেয়ারা বা বাবুর্চি কি আয়া বলে তাদের ডাকি না। কেউ ডাকলে কানে লাগে।

লালি যখন বেয়ারা বলে ডাকাতে বুঝতে পারল না, তখন আমিই এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে ঘরে গিয়ে ওকে দিলাম। আর যাই হোক, রমা এইখানে আমার অতিথি। ওর জন্যে হাতে করে চা-টা নিয়ে যেতে খারাপ লাগল না। বরঞ্চ ভালোই লাগল। মনে হল, আমি মার্টিন লুথার কিং-এর মত ক্ষমাময় কেউ হয়ে গেছি।

ও বলল, বাবাঃ কত ঢঙ। কি? লোকের সামনে ভালোবাসা দেখাচ্ছ?

আমি উত্তর না দিয়ে বললাম যে, চা-টা নিয়ে বাইরে এসো, বাইরে রোদ।

সীতেশ ওদের বলছিল, এইখানে একটা ওপেন-এয়ার বার থাকবে, আর ঐখানে বার-বি-কিউ হবে–ক্রিসমাস ইভে দুশো লোকের পার্টি দিতে বলব এখানে রমাকে। যদি তোমরা চাও ত এখানে একটা নাচের বন্দোবস্তও করা যেতে পারে। এবরিজিনালসদের দিয়ে।

আমি আসতেও সীতেশ বিন্দুমাত্র দমিত হল না। বলল, এসব জায়গা দলবেঁধে এসে হৈ-হুল্লোড় করার জন্যে–আদারওয়াইজ নো-গুড।

তিতিরগুলো ডাকছিল চতুর্দিক থেকে। টুনটুনি পাখি এসে রঙ্গনের ডালে দুলে দুলে অস্ফুটে কি কথা বলে চলে গেল বোঝা গেল না। বুলবুলিরা জোড়ায় জোড়ায় এদিকে ওদিকে ভরর-র-রর-র করে উড়তে লাগল। টিয়ার ঝাঁক রোজ সকালের রুটিন মত পেয়ারা বনে এসে বসে ডালে ডালে ঝাঁপাঝাঁপি করতে লাগল।

কিন্তু সীতেশের একতরফা বক্তৃতার জন্যে কোনো পাখির ডাকই আজ শোনা হল না।

মালু এসে সীতেশের গাড়িটা ঝাড়তে আরম্ভ করেছিল।

সীতেশ খেঁকিয়ে উঠল নেড়িকুত্তার মত। আমার দিকে ফিরে বলল, তোর লোকগুলো কি রে? মার্সিডিস গাড়িতে এরা জম্মে হাত দিয়েছে? এক্ষুনি রঙটার বারোটা বাজাত। গায়ে স্ক্র্যাচ পড়ে যেত। তারপরই বলল, যদি এখানে থাকিস আরো কিছুদিন ত এইগুলোকে ট্রেইন-আপ কর–এরকম সব জংলী লোক নিয়ে কাজ চলে?

আমি হাসলাম, বললাম, জায়গাটাও ত জংলী–এখানের মত জায়গায় আমাদের মত লোকের এ দিয়েই কাজ চলে যায়। তোদের মত লোকের জন্যে ত এ জায়গা নয়।

কিছুক্ষণ বিরতির পর সীতেশ বলল, বুঝলি সুকুমার, সেদিন তোর একটা গল্প পড়লাম, কোথায় যেন? কিছু মনে করিস না, তোর নায়কগুলো কেমন যেন মিনমিনে।

ডলি বলল, তার মানে?

সীতেশ বলল, মানে নায়ক নায়িকারা বাড়িতে গিয়ে পৌঁছল, নায়িকার স্বামী বাড়িতে নেই–ট্যুরে গেছে। নায়িকা তাকে থেকে যাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করল, কিন্তু নায়ক শুধু নায়িকার হাতে একবার হাত রেখেই চলে এল। আর কিছুই করল না।

তারপরই বলল, কিছু মনে করিস না, এর চেয়ে কোনো সীলি ব্যাপার ভাবা যায় না।

মাধুরী বলল সীতেশকে, ধরুন আপনিই যদি নায়ক হতেন ত কি করতেন?

সীতেশ হাঃ হাঃ করে হাসল অনেকক্ষণ, তারপর বলল, যা করতাম, তা নায়িকাই জানত, নায়িকা রেলিশ করত–তা কি অন্য লোককে বলে বেড়াবার?

ডলি খুব অপ্রত্যাশিতভাবে বলল, সুকুমারবাবুর নায়কদের কিন্তু আমি বুঝতে পারি। সীতেশ বলল, কি রকম? তাদের সম্বন্ধে তোমার কি ধারণা?

ডলি হেসে উঠল, বলল, তারা শুধু মনের কারবারী, তাদের শরীর নেই।

ওরা তিনজনেই সমস্বরে হো হো করে হেসে উঠল।

 আমার ভীষণ অস্বস্তি লাগতে লাগল। রমার উপর প্রচণ্ড রাগ হতে লাগল। রমা কোলকাতায় যা-ইচ্ছে-তাই করুক, তার যা প্রাণ চায়, আমি কখনও বাধা দিতে যাইনি। কিন্তু কতগুলো স্থূল শরীর-সর্বস্ব লোক সঙ্গে করে আমার এখানে আমার এই পাখি-ডাকা শান্তি বিঘ্নিত করার তার কোনোই অধিকার নেই। আজকে আর আমার উপর তার কোনো অধিকারই অবশিষ্ট নেই।

আমি বললাম, তোমরা চান-টান করে তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট খেয়ে নাও–আমি বাবুর্চিখানায় তাড়া দিয়ে আসি।

বাবুর্চিখানায় ওদের তাড়া দিয়ে আমি কারিপাতা গাছগুলোর তলায় দাঁড়িয়েছিলাম।

ওদিকে ফিরে যেতে আমার ইচ্ছা করছিল না। স্থূলতার প্রতিবাদ স্থূলতা দিয়ে হয় না, সে প্রতিবাদে আমি বিশ্বাসও করি না।

আমার হঠাৎ মনে হল, ডলি এবং মাধুরীও রমার সঙ্গে সীতেশের যে একটা সম্পর্ক আছে তা জানে এবং জেনেও সেটাকে রেলিশ করে। এমনকি ডলিও করে।

ওরা হয়ত সকলে যুক্তি করেই আমাকে অপমান করার জন্যে এখানে এসেছে। আমি চীৎকার করতে পারি কিনা, অপমানে কাঁদি কিনা, রেগে নীল হয়ে যাই কি না, তা ওরা বোধ হয় দেখতে এসেছে।

কিন্তু ওরা জানে না, রমাও জানে না যে, জীবনে আমি এক নিজের পেটের কারণে ছাড়া অন্য কোনো রক্তক্ষয়ী প্রতিযোগিতায় নামতে চাই নি। এক প্রতিযোগিতাতেই আমি ফুরিয়ে গেছি। আমি লড়ব না, প্রতিবাদ করব না জেনেও ওরা কেন আমার মুখে মদ ছোঁড়ে?

ওদের সঙ্গে আমি ডুয়েল লড়ব না, কখনও লড়ব না। না-লড়ার কারণটা ওরা কখনও বুঝবে না। আমি ওদের বুঝিয়ে বলতে, নিজের এই নিদারুণ অপমান সহ্য কেন করি তা ওদের বুঝিয়ে বলতেও রাজী নই।

পিছনের নালাটায় রোদ এসে পড়েছিল।

কতগুলো হলুদ প্রজাপতি ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছিল ওদিকে। মালুর কালো-রঙা মেয়ে কুকুরটা বসে রোদ পোয়াচ্ছিল। এমন সময় আশেপাশের বাড়ির কোনো একটা খয়েরী-রঙা মদ্দা কুকুর এসে তার পিছনে লাগল। কুকুরীটা প্রথমে বিরক্তি দেখাল, ঘ্যাঁক ঘ্যাঁক করল, তারপর কামড়াকামড়ি করল, সবশেষে পরাভূত অবস্থায় মদ্দা কুকুরটা প্রবৃত্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে পিছনের নালার অন্ধকারে নেমে গেল।

আমার হঠাৎ মনে হল, ডলি, সীতেশ এবং আরো অনেকে বোধহয় খুশি হত যদি সুকুমার বোসের নায়করা এই মদ্দা কুকুরটার মত হত। ওরা বোধ হয় একবারও বুঝতে পারে না, বুঝতে চায় না যে সুকুমার বোস, এই একজন সামান্য অখ্যাত লেখক মানুষদের নিয়েই লেখার চেষ্টা করে; কুকুরদের নিয়ে নয়।

মানুষদের জীবনেও এমন বহু প্রবৃত্তি আছে যা পশুদেরও আছে। কিন্তু আবার এমন কিছু মানুষদের আছে, যা পশুদের নেই; তা হচ্ছে মানুষের মন। বহু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পরিশীলিত হয়ে সে বস্তুটি আজ মানুষের জীবনের সবচেয়ে গর্বের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কি জানি, ঠিক বুঝতে পারি না।

যে-যুগে মানুষ চাঁদে যাচ্ছে সে যুগেই কি মানুষ মানুষের মনের এক বিশেষ অংশে মানবিক সত্তা বিসর্জন দিয়ে পাশবিক সত্তা অনুরোপণ করার চেষ্টা কচ্ছে?

হঠাৎ রমা বলল, এখানে কি করছ?

রমা বাবুর্চিখানার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল।

আমি বললাম, কিছু না।

রমা চান করে নিয়েছিল একেবারে। প্রসাধন করেছিল, দামী একটা বালুচরী শাড়ী পরেছিল, কানে মুক্তোর ইয়ার-টপ, গলায় মুক্তোর মালা। রমার চুলে রোদ এসে পড়েছিল।

পেঁপে গাছের পাতায় বসে শালিক ডাকছিল। রমাকে খুব সুন্দরী দেখাচ্ছিল।

রমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার হঠাৎ খুব ইচ্ছা করছিল দৌড়ে গিয়ে ওকে বুকের মধ্যে ধরি, ওকে বলি, আমার প্রথম জীবনের রমা, আমার জীবনের প্রথম নারী, প্রথম প্রেম রমা, তুমি ফিরে এসো, আমার কাছে ফিরে এসো তুমি দেখো আমরা দুজনে–আমি আর তুমি দুজনে মিলে আবার নতুন করে সব আরম্ভ করব, ঘর বাঁধব সুখের ঘর, ফিরে এসো রমা।

ভাবলাম বলি, আমি ছুটিকে ভুলে যাব, তাকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করব, শুধু তুমি আমার কাছে তোমার সম্পূর্ণতায়, তোমার উচ্ছলতায়, তোমার সাবলীল বাধাবন্ধনহীন শরীরে এবং নিষ্কলুষ মনে ফিরে এসো আমার কাছে।

ইচ্ছে হল, ওকে চুমু খেতে খেতে বলি, এসো ক্ষমা করে দিই আমরা দুজনে দুজনকে–পুরানো জীবন বাতিল করে এসো একটা নতুন জীবন শুরু করি। এখনও বেলা আছে, এখনও সকালের আশাবাদী রোদ আছে; এখনও পথ আছে ফেরার।

রমা আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল, বলল, তোমার রাতে ঘুম হয়নি?

 হুঁ। বললাম আমি।

 রমা বলল, আমি জানি তোমার কষ্ট আছে। কষ্ট হয় অনেক। কিন্তু তোমাকে কষ্ট পেতে হবে আরও। কারণ তুমি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ। কী কষ্ট দিয়েছ তুমি জানো না।

একটু থেমে ও বলল, আমি জানি আমি যা করেছি তা ভালো করিনি, কিন্তু তোমাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে হাতের কাছে ওর চেয়ে ভালো হাতিয়ার আর কাউকে পাওয়া গেল না।

আমি বললাম, আমার অপরাধ আমি জানি, কিন্তু তুমি একথা বলতে পারবে না যে, তোমাকে ঠকিয়ে আমি নিজেকে আনন্দিত করেছি। সেইসব পায়ে-দাঁড়ানোর দিনে তোমাকে যদি ঠকিয়ে থাকি ত সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও ঠকিয়েছি। যা করেছি সে ত তোমার জন্যেও করেছি। আমার একার জন্যে ত করিনি?

রমা ঘৃণার সঙ্গে বলল, করেছ করেছ। তুমি যশ চেয়েছিলে। তুমি বড় স্বার্থপর। তুমি নিজেকে ছাড়া জীবনে আর কাউকে ভালোবাসোনি। তুমি কোর্ট করেছ, মক্কেল সামলেছ, তোমার সিনিয়রের প্রতি সিনসীয়র হয়েছ, তারপরও তুমি লেখক হয়ে নাম করতে চেয়েছ। কিন্তু কেন? এত স্বার্থপর তুমি কেন?

আমি ছোটবেলা থেকে লেখক হতে চেয়েছিলাম। এ দেশে কারো ইচ্ছাই ইচ্ছা নয় ছিলো না। গুরুজনরা যা হতে বলেছিলেন, তাই-ই হতে হয়েছিল। নিজের মনের ইচ্ছাটা গুরুজনদের ইচ্ছা পূরণের পর বিকাশ করতে চেয়েছিলাম।

আর আমার ইচ্ছাটা? ইচ্ছা বলব না, বলব দাবী। আমার দাবী কি কিছুই ছিল না তোমার উপর? আমাকে কি তোমার লাইব্রেরীর তাকের রেফারেন্স বই ভেবেছিলে তুমি? ভেবেছিলে কোনোদিন কোনো মামলায় যদি প্রয়োজন হয় তবেই আমার পাতা খুলবে?

আমি চুপ করে রইলাম।

রমা সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল, এসে বলল, ঐদিকে চল, কুয়োতলার দিকে।

তারপর বলল, তোমার সঙ্গে এ কমাস ছাড়াছাড়ি থেকে বোধহয় ভালোই হল। তুমিও নিজেকে বুঝবার সুযোগ পাবে, আমিও পাব নিজেকে বুঝবার।

তোমাকে একটা কথা বলব? তোমার জন্য আমার ভীষণ কষ্ট হয়। একটা ঘিনঘিনে করুণা হয়, কারণ তুমি অনেক টাকা রোজগার কর অথচ নিজের হাতে তোমার পাঁচ পয়সা খরচ করার অবকাশ নেই। তুমি যশ পেয়েছ অথচ সেই যশের কোনো মূল্য নেই তোমার নিজের কাছে। নিজের জীবনের মূল্যে কাউকে যদি যশ পেতে হয়, ত যশের দাম কি? যারা সেই যশ চায় চাক, তুমি চেও না।

হাজার হাজার লোক বলল, তুমি দারুণ সওয়াল কর, বলল, তুমি দারুণ লেখো, তোমাকে চিঠি লিখল, তোমার ছবি চাইল, তাতে তোমার কি? যখন ভীষণভাবে একা থাকো–যখন তুমি ভীষণভাবে কাউকে চাও তখন তোমার কোনো পাঠিকা কি তোমাকে আমি যা দিই, দিতে পারি, তা দেবে?

দেবে না। কেউ দেবে না। তারা বড়জোর তোমার সঙ্গে রেস্টুরেন্টে খাবে, বন্ধুদের চোখ বড় বড় করে বলবে, এ্যাই জানিস, সুকুমার বোসের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ঠাট্টা করে বলবে, জানিস, আমার প্রেমে পড়েছে, হেড ওভার হীল। তারা বড়জোর টেলিফোন করে তোমাকে ন্যাকা-ন্যাকা কথা বলবে, তারা তোমার সত্যিকারের অভাব কখনও মেটাবে না; তোমাকে ভালোবাসবে না।

পাঠিকাদের ভালোবাসা পোশাকী ভালোবাসা, দামী শাড়ীর মতন, পার্টি শেষ হলে সযত্নে ন্যাপথলিন দিয়ে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে আলমারিতে তুলে রাখবে ওরা ওদের ভালোবাসা।

আমি চুপ করে ছিলাম। হঠাৎ রমাই বলল, আমি জানি, তুমি ছুটির কথা ভাবছ। মেয়েটা ভালো, হয়ত তোমাকে সত্যিই সে ভালোবাসে, কিন্তু আজকালকার অল্পবয়সী মেয়েরা ভালোবাসার কিছু বোঝে বলে আমার মনে হয় না। ওরা ওই গলায় ঝোলে, ঐ ঝুপ করে নেমে পড়ে দৌড় দেয়। এদের কোনো গভীরতা আছে বলে আমার মনে হয় না। তোমার জন্যে আমার খুব কষ্ট হয়–ভয় হয়, ছুটি যদি তোমাকে দুঃখ দেয়, সে দুঃখ তুমি সামলে উঠতে পারবে না। কারণ, তুমি আমার মত শক্ত নও।

আমি আগাগোড়া চুপ করেই ছিলাম। বললাম, আর সীতেশ? সীতেশ সম্বন্ধে তোমার কি ধারণা?

রমা হাসল। বলল, আমি জানতাম তোমার আত্মবিশ্বাস আছে, সীতেশ যে তোমাকে এমন পীড়া দেবে তা কখনও ভাবতে পারিনি আমি। তোমাদের এই পুরুষমানুষদের আমরা মেয়েরা মিথ্যাই ভয়-ভক্তি করি। তোমরা আসলে কাচের চেয়েও ঠুনকো। মাঝে মাঝে মনে হয়, তোমার আত্মবিশ্বাস যদি এতই কম, তাহলে জীবনে সাকসেসফুল হলে কি করে? কিসে ভর করে?

আমি বললাম, তুমি আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলে।

ও বলল, বলছি, তোমার বন্ধু সীতেশ একটি আস্ত সিলী-গোট। একটি বাবার পয়সায় বসে-খাওয়া আকাট বুড়ো-খোকা। তুমি জাস্ট দেখে নিও, ওর কি অবস্থা করি আমি। ও কেঁদে কুল পাবে না। ছুটি যেমন তোমাকে ভালোবাসে, আমি ওকে তেমনি করে ভালোবাসি। আজকালকার অল্পবয়সী মেয়েদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে- গিলটি-করা গয়নাকে কিভাবে সোনা বলে চালানো হয়, তাই শিখছি।

একটু থেমে বলল, তোমার কথা বলতে পারি না, কিন্তু আমার পার্ট দারুণ এনজয় করছি। ইটস্ গ্রেট ফান্। আই উইশ, তুমিও তোমার এই মিথ্যা এ্যাফেয়ারটা পুরোপুরি এনজয় করো।

রমার কথা ভালো করে আমার মাথায় ঢুকছিল না। আমার সব গোলমাল হয়ে গেল। আমি বোকার মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

রমা স্বগতোক্তি করল, বলল, টাইম ইজ আ গ্রেট হীলার। ছমাস ছাড়াছাড়ি না-থাকলে তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কোথায় দাঁড়াত আমি জানি না। আজ দারুণ লাগছে। মনে হচ্ছে আমাদের হানিমুনের কোনো সকাল। জানো সুকু, আমি জানি, আমি কনফিডেন্টলি জানি যে, তুমি আমার এবং চিরকাল আমারই থাকবে। আমার কাছ থেকে তোমাকে কেড়ে নেয় এমন কোনো শক্তি পৃথিবীতে নেই। ছুটিকে নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমার আত্মবিশ্বাস আছে। তোমারও যদি আমার সম্বন্ধে এই আত্মবিশ্বাসটুকু থাকত ত আমি খুশি হতাম। এ সম্বন্ধে তোমার আত্মবিশ্বাস না থাকাটা আমার পক্ষে অপমানকর।

ওরা বাইরের পেয়ারাতলায় ব্রেকফাস্ট ঠিকঠাক করে লাগাচ্ছিল, হঠাৎ রমা বলল, তুমি কাল রাতে রাগ করেছিলে? না?

আমি মুখ তুলে তাকালাম ওর দিকে। বললাম, না। রাগ করব কেন?

ও বলল, এখন যাবে?

ওর চোখ আনন্দে নেচে উঠল। এই রমাকে আমি চিনতাম না। হয়ত কখনও চিনতাম; কিন্তু ভুলে গেছিলাম।

ও বলল, বাথরুমের দরজা দিয়ে বেডরুমে চলে যাই। ওরা কেউ জানতে পারবে না–বলেই রমা আমাকে টেনে নিয়ে বেডরুমে দরজা বন্ধ করে দিল।

আমার মন চাইছিল না, কিন্তু রমার এমন একটা খুশির মুহূর্তকে আমি ফুঁ দিয়ে নিতে চাইনি।

তারপর আমার মনে নেই।

যা মনে আছে তা এই যে, অনেকদিন ভুলে যাওয়া, ফেলে-আসা কোনো নির্জন সুগন্ধী পাহাড়তলীতে আমার সুন্দরী যুবতী স্ত্রী রমার হাত ধরে আমি গিয়ে পৌঁছেছিলাম।

অনেকগুলি বিস্মৃতপ্রায় বোধ, অনুভূতি, অনেক আশ্চর্য অবাক আরাম আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। যে কোষাগারের নরম দরজা বহু বছর খুঁজে পাওয়া যায়নি, সেই কোষাগার হঠাৎ এই আলো-ঝলমল সকালে খুলে গেছিল। মণি-মাণিক্যে, হীরে-জহরতে চোখ ঝলসে উঠেছিল।

শরীর; দুটি বাত্ময় শরীর তাদের নিজেদের বিশেষ বিনোদনের বিভাসে স্বর্গরাজ্যের বীণার মত বাজছিল। ধূপের গন্ধ, ফুলের গন্ধ, আরতির শব্দ সমস্ত মিলে মিশে সেই পারিজাত-পাহাড়তলীর প্রথম সকাল এক বিস্মৃত ভরন্ত ভালোলাগায় ভরে দিয়েছিল।

দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর ওরা যখন গাড়িতে উঠছিল, রমা হঠাৎ আমাকে এক কোণে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল, কাল রাতে সীতেশের সঙ্গে যখন বাইরে গেছিলাম তখন সত্যিই কিন্তু ও পথ হারিয়ে ফেলেছিল। মাথার চুল আমি নিজেই এলোমেলো করে দিয়েছিলাম, হাত দিয়ে টিপ লেপটে দিয়েছিলাম। সীতেশ বলেছিল, ওরকম করছ কেন?

আমি বলেছিলাম চুলের মধ্যে পোকা ঢুকে গেছে।

তারপর বলল, যাইই করে থাকি তোমার মুখ দেখে বুঝেছিলাম তুমি যা মনে করবে ভেবেছিলাম, তাই ভেবেছ। তোমার মনটা বেশ ছোট, যাইই বল।

এক সময় সীতেশের বেগুনীরঙা মার্সিডিস ধুলো উড়িয়ে চলে গেল।

আমি অনেক, অনেকক্ষণ বাগানের চেয়ারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম।

মনে হলো, এই একদিন আমার উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেলো। ঝড়টা বসন্ত বাতাসের না শিলাবৃষ্টির এক্ষুনি তা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই।

.

১৬.

সকালবেলা মালুকে পাঠিয়েছিলাম দীপচাঁদের দোকানে রসদ আনতে। ও গেছে অনেকক্ষণ। রোদ বেশ তেতে উঠেছে। আমি গাছতলায় বসে, ব্রেকফাস্ট খাবার পর চিঠি লিখছিলাম, এমন সময় লালির ছোট মেয়ে দৌড়ে এসে খবর দিল, মালুকে ধরে কারা যেন খুব মারছে পিছনের মহুয়াতলার মাঠে।

লেখা ফেলে যত জোরে পারি দৌড়ে গেলাম। আমার সঙ্গে সঙ্গে লালিও এল উদভ্রান্তের মত। হাসান রান্নাঘরে পেঁয়াজ কাটছিল, পেঁয়াজ কাটা ছুরি হাতে ও-ও সঙ্গে দৌড়ে এল।

আমরা পিছনের উঁচু ডাঙ্গায় উঠে, একটা ঢিবির উপর দাঁড়িয়ে পড়ে ব্যাপারটা কি বোঝবার চেষ্টা করলাম।

মালু অনেক দূরে ছিল।

যে-মাঠে একসময় সর্ষেক্ষেত হলুদ হয়ে থাকত, এখন তা ফাঁকা, বিবাগী। বড় বড় ঝাঁকড়া মহুয়াগাছগুলোর নীচে অতবড় টাঁড়টা বুকের উপর পিটিসের এলোমেলো ঝোপ নিয়ে সকালের রোদে ধূ-ধূ দাঁড়িয়ে আছে।

দূরে দেখা গেল মালু আর বুধাই এদিকে হেঁটে আসছে।

 ওদের পিছনে সেই সাদা ভুতুড়ে বাড়ির কাছে একটা জটলা মত।

 দূর থেকে চেঁচামেচি ভেসে আসছে।

 মারামারি যা হবার তা শেষ হয়ে গেছে তখন।

লালি ও হাসান মালুর দিকে দৌড়ে গেল। আমি ঢিপিটাতে দাঁড়িয়ে ওদের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

ওরা এলে ব্যাপারটা জানা গেল।

মালুর একজোড়া হালের বলদ আছে। খরার সময় ওর খুব অভাব হওয়াতে বছরখানেক আগে ও এখানকার একজন লোকের কাছে বলদ দুটো জমা রেখে একশ ত্রিশ টাকা ধার নিয়েছিল। ধীরে ধীরে সেই টাকার মধ্যে আশী টাকা সে শোধ করে দেবার পর পঞ্চায়েতে দরবার করে ওর বলদ দুটো ফেরত নিয়ে এসেছিল। কথা ছিল, বাকি পঞ্চাশ টাকাও সে শোধ করে দেবে।

কিন্তু সব কথা রাখা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। মালুর পক্ষে ত সম্ভবই ছিল না। উপায় ছিল না।

হাটে-মাঠে যখনি মালুকে সেই লোকটি ও তার জোয়ান ছেলে দেখতে পেত তখনি গালাগালি করত। কিন্তু মালু মাথায় পাগড়ি ঝুলিয়ে, গায়ে গণ্ডারের চামড়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াত। ইচ্ছা থাকলে যে সে টাকাটা দিয়ে দিতে পারত না তা নয়, কিন্তু চট করে পারত না। সঞ্চয় বলতে, ওদের কিছুই থাকে না, তাই পঞ্চাশ টাকা দেওয়া মুখের কথা নয়।

কিন্তু তবুও প্রতি শুক্রবার মহুয়া খাওয়া মালুর ঠিকই ছিল। গালাগালি খাওয়ার পর বোধহয় মহুয়ার নেশাটা আরো জমত ভাললা। হয়ত নেশা করত, ভালো লাগার চেয়েও সবকিছু ভুলে থাকার জন্যেই বেশি করে।

এমনিভাবেই দিন কাটছিল। ওদের কর্তব্য ছিল গালাগালি দেওয়া এবং মালুর কর্তব্য ছিল তা ডানকান দিয়ে শুনে বাঁকান দিয়ে বের করে দেওয়া। এই নিষ্পাপ প্রক্রিয়ায় একপক্ষের গলার জোর বৃদ্ধি এবং অন্য পক্ষের শ্রবণেন্দ্রিয় তীক্ষ্ণ হওয়া ছাড়া অন্য কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি কারোরই হচ্ছিল না।

গোলমাল বাঁধল যখন হাটের মধ্যে সেই লোকটির জোয়ান ছেলে বুধাইর শাড়ি ধরে টানাটানি করতে লাগল। এরকম দু-তিনবার নাকি হয়েছিল। বধির মালুকে কিছু বলে লাভ নেই জেনে, ওরাও মেয়েটাকে নিয়ে পড়েছিল। হাটে হাঁড়ি-ভাঙার মত, হাটে ইজ্জৎ-নষ্ট করার অসাধু অভিপ্রায়ে ওরা নাকি দু-তিনদিন অমন করেছিল। কিন্তু জায়গাটা হাট বলে এবং ব্যাপারটার মধ্যে ভয়-দেখানোর ইচ্ছাটা যত প্রবল ছিল, প্রবৃত্তিটা তত ছিল না বলে, এবং বুধাইও ব্যাপারটা ইটস্ অল ইন দা গে বলে নেওয়াতে এত কিছু করেও মালুর কাছ থেকে টাকা ওরা ফেরত পায়নি।

তাই আজ মালুকে পথে একা পেয়ে বাপ-বেটা মিলে ওকে বেদম প্রহার করেছিল।

মালুর দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, রক্ত বেরোয়নি বটে কিন্তু ভীষণ মার খেয়েছে ও। মাথার পাশে, রগের কাছে রীতিমত ফুলে উঠেছে। এবং মালু এমনভাবে হাঁটছে যে, মনে হচ্ছে ও মহুয়া খেয়েছে।

সরল সাদা-মাটা নির্বিরোধী লোকটা ব্যাপারটার অভাবনীয়তায় একেবারে হকচকিয়ে গেছে।

এর প্রতিকার কিছু একটা করা উচিত।

প্রতিকারটা কিভাবে করা যায় তাই ভাবছিলাম। এর যোগ্য প্রতিকার হত, যদি ওদের টাকাটা শোধ দেওয়ার পর, মালুকে ওরা যেমন করে মেরেছে ওদের তেমন করে হাতের সুখ করে মারা যেত। কিন্তু সেটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সম্ভব নয়, আমার বদরক্তের দোষে।

মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরে জন্মে আমরা বই পড়তে শিখেছি, মনের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে তা কাগজে কলমে ফুলঝুরির মত উৎসারিত করতে শিখেছি। কিন্তু এক ধরনের লোক আছে, যাদের কাছে আমাদের এই ধরনের প্রতিবাদের কোনো দাম নেই, কোনো ফল নেই। তাদের কাছে এরকম প্রতিবাদ হাস্যকর ভীরুতা ছাড়া কিছুই নয়। তারা যেমন লাঠি দু হাতে ধরে কারো মাথায় সশব্দে বসানোকে তাদের অধিকারের সুস্থ বিকাশ বলে মনে করে, দুহাতে লাঠি ধরে তাদের মাথায় মেরেই শুধু তাদের তেমন শিক্ষা দেওয়া যায়। সেটাই তাদের একমাত্র শিক্ষা। অন্য কোনো ভাষা তারা বোঝে না।

যাই হোক, হাসানকে তক্ষুনি পাঠালাম। যারা মালুকে মেরে তাদের আমার সঙ্গে দেখা করতে বলতে। দেখা করতে বললেই যে তারা দেখা করবে এমন বিশ্বাস আমার ছিল না। কারণ আমি সেকালের জমিদার বা একালের এম-এল-এ নই, আমি কারোরই বিন্দুমাত্র ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখি না। আর ক্ষতিই যদি কেউ কারু না করতে পারে, না করার ক্ষমতা রাখে ত তাকে মানে কোন্ বোকা লোকে? ক্ষমতা মানেই ত আজকাল ক্ষতি করার ক্ষমতা।

কিন্তু হাসান এসে বলল যে, তারা আসছে আমার সঙ্গে দেখা করতে।

বুঝলাম, লোকগুলো আর যাই হোক, বোকা নয়। তারা আমাকে কোনোরকম খাতির দেখাবার জন্যে মোটেই আসছে না–তাদের সিকস্থ সেন্সে তারা বুঝে গেছে যে আমি যখন বাড়ির মালির সঙ্গে অন্য লোকের ঝগড়ায় নাক গলিয়েছি, তখন তার একটা মাত্রই মানে হতে পারে। মানে হচ্ছে, মালুর ধার আমি শোধ করে দেব।

মালুকে কোডোপাইরীন খাইয়ে, গরম চা খাইয়ে সুস্থ করলাম।

 কিছুক্ষণ পর ওরা দুজনে এবং ওদের বস্তীর আরো কজন লোক এসে হাজির হল গেটের সামনে।

ওদের ভিতরে আসতে বললাম।

দেখলাম, খুব শক্ত-সমর্থ চেহারার লোক দুটি।

হাসান বলল, এরা হাসানের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। অথচ হাসানের সঙ্গে এদের চেহারা ও কথাবার্তার কোনো মিল নেই। হাসান শান্ত, সভ্য এবং বিনয়ী এবং এই লোকদুটো উদ্ধত, উগ্র এবং দুর্বিনীত।

লোকদুটো এসে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল, শুধোল, কিসের জন্যে তাদের ডাকা হয়েছে? যেন আমার কাছে কৈফিয়ৎ চাইছে, এমন ভাব ঝরে পড়ল ওদের গলার স্বরে।

আমি বললাম, তোমরা ওকে মারলে কেন?

ওরা বলল, সেটা আমাদের ব্যাপার।

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।

 যারা সকলের সঙ্গে এবং কাছ থেকেই ভদ্র-সভ্য ব্যবহার করে, পায় ও প্রত্যাশা করে; তারা যখন কারো কাছ থেকে নিষ্প্রয়োজনীয় খারাপ ব্যবহার ও অধিকারহীন ঔদ্ধত্যের ধাক্কা খায় তখন তাদের মধ্যে বেশির ভাগ লোকই কুঁকড়ে যায়–হয়তো মনে ভাবে, এই খারাপত্বের সঙ্গে নিজেকে সমান করে কি হবে? তাতে নিজের সম্মানই নষ্ট হবে শুধু।

কিন্তু সুকুমার বোস চিরদিনই এইসব সিচুয়েশান দারুণভাবে রেলিশ করে এসেছে।

অসুখের পর, অনেকদিন নিরামিষ, ঘটনাহীন নিস্তরঙ্গ জীবনের পর হঠাৎ ভারী আনন্দ হল। মনে হল, অনেকদিন পর আমি একটা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলাম। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, কেবলমাত্র নিছক শারীরিক শক্তির ক্রুড নগ্ন প্রকাশের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড়াবার একটা সুযোগ পেলাম।

আমি বললাম, মালুর কাছে তোমাদের কত টাকা পাওনা আছে?

ওরা বলল, ছিল পঞ্চাশ টাকা, কিন্তু সুদে বেড়ে একশ পঞ্চাশ টাকা হয়েছে।

আমি অবাক গলায় বললাম, এক বছরে পঞ্চাশ টাকা সুদে বেড়ে একশ পঞ্চাশ টাকা হয় না।

ছেলেটা কোমরে হাত দিয়ে বলল, হয়। এখানের এইরকমই নিয়ম। এখানে এইরকমই হয়ে থাকে।

বললাম, মালু যদি টাকা শোধ না দিতে পারে?

তবে ওকে মারব, আবার মারব; দরকার হলে জান নিয়ে নেব।

অবাক হয়ে বললাম, জান নিয়ে নেবে? পুলিশ নেই?

ওরা হাসল। বলল, পুলিশ ত খিলাড়িতে থাকে। আসতে আসতে, খবর পাঠাতে পাঠাতে, অনেক ঘণ্টা। তাছাড়া কেউ কাউকে সাক্ষী রেখে ত খুন করবে না। ওসব পুলিশ-ফুলিশের ভয় আমরা পাই না-ওসব আপনাদের জন্যে, ভদ্রলোকদের জন্যে। আমরা ছোটলোক।

ওদের বললাম, শোনো, পুলিশের ভয় আমিও পাই না। তোমরা যদি নিজেদের ছোটলোক বলে বাহাদুরী করতে চাও ত জেনে রাখ, আমিও ছোটলোক। ভদ্রলোকের সঙ্গে ভদ্রলোক; ছোটলোকের সঙ্গে ছোটলোক।

ইতিমধ্যে লালি কি একটা কাজে এদিকে এসেছিল।

ওকে দেখতে পেয়েই ছেলেটা একটা অশ্লীল গালাগালি দিয়ে উঠল। গালাগালি দিতেই আমার মধ্যের গোপন প্রতিবাদকারী মানুষটা তার নিরুদ্ধ উৎস থেকে চকিত ফোয়ারার মত বাইরে এল। আমার অজানিতে আমার ডান হাতটা উপরে উঠে গিয়ে একটা প্রচণ্ড থাপ্পড় হয়ে ছোরাটার গালে পড়ল।

বদমাইস ছোকরা একবার চমকে উঠল, তারপরই বুনো শুয়োরের মত রাগে ফুলে উঠে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল।

যে দশ-পনেরো জন লোক আমাকে ঘিরে ছিল তারা এমন বেড়াতে-আসা, ছিপছিপে, চশমাপরা ভদ্রলোকের কাছ থেকে এতবড় একটা ছোটলোক কর্ম আশা করেনি।

তারা সকলেই ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

আমি বললাম, এখানে দাঁড়াও। আমি টাকা নিয়ে আসছি।

লোকগুলো স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইল।

আমি ভিতর থেকে পঁচাত্তর টাকা এনে বুড়োর হাতে দিলাম। বললাম, পঞ্চাশ টাকা ধার; পঁচিশ টাকা সুদ, এটাই বেশি। এর বেশি এক পয়সাও পাবে না। আমি সালিশী করতে ডেকেছি তোমাদের শুধু এই জন্যেই; তোমাদের বেশি দেব না।

তারপর বললাম, এই টাকা নিয়ে চলে যাও। ভবিষ্যতে, এদের গায়ে হাত দিও না। যদি দাও ত বুঝবে যে, আমিও তোমাদেরই মত থানা-পুলিশ বিশ্বাস করি না। তোমরা যদি করতে, তাহলে হয়ত করতাম। তোমরা যখন না-করাটাকে বাহাদুরী বলে মনে কর, আমিও তাই করি। শুধু একটা কথা জেনে যাও যে, যদি আমার কথা না-শোনো তবে পরিণাম ভালো হবে না। তখন জানতে পাবে যে, আমি তোমাদের চেয়েও বড় ছোটলোক; বুঝেছ?

লোকগুলো চলে গেল। ছোকরাটা যাওয়ার সময় বার বার আমার দিকে পিছন ফিরে দেখতে লাগল।

ওরা চলে যেতে লালি দৌড়ে এসে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বাবু এমন কেন করলেন? আমাদের জন্যে আপনি কেন এ ব্যাপারে জড়িয়ে পড়লেন? আমাদের এরকমই জীবন। এইরকম গালাগালি, মারামারির মধ্যেই আমরা ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছি, এইসব অসম্মান আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। এর জন্যে যদি আপনার কোনো বিপদ হয় তাহলে কি হবে। তাছাড়া কোনো সাহেব, কোনো বাবুরাই ত এমন করে আমাদের ছোটলোকদের ঝগড়ায় নিজেরা জােন না, কোথাওই জড়ান না, তাহলে আপনি কেন জড়ালেন?

আমি হাসলাম। বললাম, আমি ভদ্রলোক তোমাকে কে বলল?

তারপর লালিকে আমার জন্যে একটু চা নিয়ে আসতে বললাম।

হাসান এসে চুপ করে হাতের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইল আমার সামনে।

ওর সাদা উর্দির উপরে পেয়ারাগাছের কালো ছায়া কাটাকুটি করছিল। ওর কাঁচা-পাকা দাড়িতে রোদ পড়েছিল। হাসান বলল, ঐ ছোকরাটা গুণ্ডা, কাজটা আপনি ভালো করলেন না।

আমি হাসলাম, বললাম, তুমি আমাকে ভেবেছ কি? আমিও কি কম গুণ্ডা? আমার নাম সুকুমার গুণ্ডা। এক গুণ্ডা অন্য গুণ্ডাকে কি করবে?

ওরা চলে গেলে আমার ভীষণ ভালো লাগতে লাগল। সকালের রোদ, ছায়া, পাখির ডাক, চতুর্দিকের এই সুস্থ সবুজ শান্তি আমাকে বলতে লাগল, ঠিক করেছ সুকুমার, তুমি ঠিক করেছ।

অনেক অনেকদিন পর এই প্রায়শই বেঠিক জীবনে একটা যথার্থ ঠিক করায়, আমার মনের মধ্যের ছেলেমানুষ মনটা আনন্দে হাততালি দিয়ে আমাকে বাহবা দিতে লাগল।

ডান হাতের পাতাটা তখনও জ্বলছিল। থাপ্পড়টা সত্যিই প্রচণ্ড জোরে মেরেছিলাম। আমার হাতে এত জোর কিভাবে এল নিজেই তা ভেবে পেলাম না। হাতের পাতাটা তুলে চোখের সামনে মেলে ধরলাম।

লালি যখন চা নিয়ে এল, লালিকে শুধোলাম, ঐ লোকগুলো কোথায় থাকে?

লালি বলল, স্টেশানে যাবার পথের পাশেই ওদের বাড়ি। তাইত মালুকে ওরা পথের পাশে পেয়ে অমন মারল।

আমি বললাম, ঠিক আছে। এখন তুমি যাও।

চা খেতে খেতে হঠাৎ আমার ভয় ভয় করতে লাগল। যা একটু আগে করলাম, করে ফেললাম, সেটা ভালো করলাম না বলে মনে হতে লাগল।

হয়ত চিরদিনই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে একাই দাঁড়াতে হয়। আজকাল ত নিশ্চয়ই। এবং আজকাল অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গেলে বুক কাঁপে না এমন লোকের সংখ্যা বেশি নয়।

হঠাৎই রোদে বসে বসে চা খেতে খেতে আমার শীত করতে লাগল। বুঝতে পারলাম যে আমার ভয় করছে, ভয় করতে শুরু করেছে।

ভয় একবার মনের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করলে দেখতে দেখতে তা অতিকায় রূপ নেয়, সে যে-ভয়ই হোক না কেন। তাই ভয়কে বড় হবার আগেই তাড়িয়ে দেওয়া উচিত।

চা শেষ করে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠলাম, পিছনের গেট খুলে সেই মহুয়াতলার মাঠের দিকে চললাম।

আমার অন্য কোনো গন্তব্য ছিলো না। একমাত্র গন্তব্য ছিল ভয়ের বিপরীত মুখে।

গাছগুলো পেরিয়ে ঘরগুলোর পাশের রাস্তায় পড়লাম। আর একটু এগোলেই ওদের বস্তী। ভুতুড়ে বাড়িটা পেরিয়ে যখন ওদের বস্তীর পাশে এসেছি, তখন পথে কাউকে দেখলাম না। যখন একবারে বন্তীর সামনে চলে এসেছি তখন হঠাৎ সেই ছেলেটির সঙ্গে দেখা হল।

ও একটি বছর দেড়েকের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে উঠোনে একটি কাঠের গুঁড়ির উপর বসে ছিল। আমাকে দেখেই ও চমকে উঠল–মনে হল ও দাঁড়িয়ে উঠবে অথবা দৌড়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে আঘাত করবে। ওর চোখে আগুন জ্বলছিল।

আমি যেন ওকে ধর্তব্যের মধ্যে ধরিনি এমন ভাবে রাস্তা ধরে এগোতে থাকলাম। আমার চোখ ছেলেটার চোখে লেগে রইল। আমি যখন ওদের উঠোনের সীমানা প্রায় পেরিয়ে এসেছি, হঠাৎ আমার মনে হল, আমার বুকের অস্তস্তিকর ভয়টা হঠাৎ আমার বুক ছেড়ে উধাও হয়ে যেন ঐ ছেলেটির বুকেই সেঁধিয়ে গেল।

ছেলেটা চোখ নামিয়ে নিল, নিয়ে যেন একটু আগে কিছুই ঘটেনি, এইভাবে মাটির দিকে চেয়ে রইল।

এই নিঃশব্দ, অপ্রচারিত ভয়-জয়ের খবর আর কেউ জানল না।

 কেবল আমি জানলাম এবং আমাকে যে ভয় পাইয়েছিল, সে জানল।

অতদূর যখন এলামই, তখন ভাবলাম স্টেশানে একবার ঢুঁ মেরে যাই।

স্টেশানে পৌঁছেই দেখি সেখানে হুলুস্থুল কাণ্ড। আজ নাকি স্টেশান ইন্সপেকশান হবে। তাই এত তোড়জোড়।

সমস্ত প্ল্যাটফর্ম ঝাঁট দেওয়া হয়েছে। পয়েন্টসম্যান, গ্যাংম্যান সকলে একেবারে ঝকঝকে তকতকে পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমন কি মাস্টারমশাইও লুঙ্গি গেঞ্জী ছেড়ে, বোতাম-আঁটা কোট প্যান্ট পরে ত্রস্ত হয়ে আছেন। পানিপাঁড়ের জলের মগও ঝকঝকে করে মাজা হয়েছে। স্টেশান রুমের ভিতরে সব ছবির মত। সিংবাবু ফোন ধরে কোন স্টেশানকে যেন ক্রমাগত ডেকে চলেছেন আকুল হয়ে,- পত্রাতু বা বাড়কাকানা। মাঝে মাঝে তাঁর গলা শোনা যাচ্ছে–ম্যাকলাসকি, ম্যাকলাসকি, ম্যাকলাসকি।

মিসেস কার্নির দোকানও আজ ঝকঝক করছে। মাটির খুরি, কাপ-ডিস মস্ত গোছানো রয়েছে। ছেলেগুলো, যারা সিঙাড়া চপ ভাজে, তারাও সব জামাকাপড় কেচে পরেছে।

মিসেস কার্নিও একটা হালকা গোলাপি গাউন পরে, ভালো জুতো পরে, সংকটে-পড়া হিটলারের মত পিছনে হাত দিয়ে প্লাটফর্মে তাঁর দোকানের সামনে পায়চারি করছেন।

বাড়কাকানার দিক থেকে একটা কয়লা-বোঝাই ডিজেল ইঞ্জিনে-টানা মালগাড়ি এসে দাঁড়াল। ওয়াটারিং-পয়েন্টের কাছে তার মুখ রইল–আর তার লম্বা খয়েরী শরীরটা বিছিয়ে রইল ঐদিকের ক্যাবিন পর্যন্ত। এই ডিজেলগুলো এমন নিঃশব্দে চলে যে, যতক্ষণ না কাছে চলে আসে ততক্ষণ বোঝাই যায় না যে এল।

এখানের নীচু কাঁকর-ফেলা প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ডিজেল ট্রেনের দিকে চাইলে মনে হয় এক সারি একতলা খয়েরী বাড়িকে টেনে নিয়ে একটা দোতলা বাড়ি চলে যাচ্ছে। এরা সব সময় হুইসেলও বাজায় না। যখন বাজায় তখন মনে হয় মেঘলা দুপুরের কোনো বিরহী বাইসন বুঝি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেই ধাতব দীর্ঘশ্বাসের শব্দ চারিদিকের বন পাহাড়ে অনুরণিত হয়ে ফেরে।

আউটার পয়েন্ট ছাড়িয়ে বরাবর বেশ খানিকটা হেঁটে গেলে চট্টি নদীর ব্রিজ পড়ে। তার পাশে চট্টি নদীর দহ। সাহেবদের যখন খুব রবরবা ছিল তখন এখানে সাঁতার কাটতে এবং পিকনিক করতে আসতো সাহেব-মেমরা। এখন বড় একটা কেউ আসে না।

কিছুদিন আগে এই নদীর কাছেই একটা গুহার মধ্যে ভালুক ছানার ফটো তুলতে সাহায্য করতে গিয়ে গ্রুপ সাহেবকে ভাল্লুকে জখম করেছিল। তাঁর বন্ধু ক্যামেরা নিয়ে গেছিলেন, উনি বন্দুক নিয়ে তাঁকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন। যখন দুজনেই গুহার দিকে নিবিষ্টমনে তাকিয়েছিলেন, ভাল্লুক তখন পিছন থেকে এসে ওকে আক্রমণ করে জখম করে দেয়। কয়েকমাস ওকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।

মিসেস কার্নিকে খুব চিন্তিত ও ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। উনি কাছে আসতেই বললাম, কি হল? এত চিন্তা কিসের?

উনি টেনে টেনে বললেন, আমার এই দোকান এখানে থাকুক তা অনেকেই চায় না। অনেক ব্যবসায়ী আমার নামে মিথ্যামিথ্যি কমপ্লেন করেছেন যাতে আমার ভেণ্ডারলাইসেন্সটি বাতিল হয়ে যায়। অথচ কি করে যে আমি চালাই তা আমিই জানি। এই বাজারে রাঁচী থেকে ময়দা জোগাড় করতে হয়–তারপর রুটি বানিয়ে বিস্কিট বানিয়ে বাড়ি বাড়ি বিক্রী করা, তাও কোনো রকমে চলে যাচ্ছে একমাত্র খিলাড়ির কারখানার জন্যে।

আমি শুধোলাম, কেন? কারখানার জন্যে আপনার কি লাভ?

উনি বললেন, বাঃ, কারখানার ক্যান্টিনে নিয়মিত রুটি দিই যে আমি। সপ্তাহে একদিন করে নিজে যাই পেমেন্ট আনতে। আমি ত একদমই একা, আমার খুঁটি ত কেউ নেই, পয়সার জোরও নেই, তাই আমাকে কোনো অজুহাতে এখান থেকে উঠিয়ে দিতে পারলে কোনো ব্যবসায়ী এই স্টলে জাঁকিয়ে বসে ব্যবসা করতে পারে। ভগবান ছাড়া আমার সহায় কেউই নেই।

দেখতে দেখতে সারা স্টেশানে একটা হৈ হৈ রব উঠল। দেখবার মত দৃশ্য। দূর থেকে একটা ট্রলি আসতে দেখা গেল।

ট্রলির উপর লাল-নীল ছাতা। কুলীরা এক একবার নেমে পড়ে ঠেলছে এবং অত্যন্ত ক্ষিপ্রতায় তড়াক করে লাফিয়ে পিছনে উঠে পড়ছে।

খাকি হাফ-প্যান্ট পরা মোটাসোটা এক ভদ্রলোক শোলার টুপি মাথায় দিয়ে ট্রলি থেকে নামলেন–তার সঙ্গে রোগা রোগা দুজন ভদ্রলোক।

পরে আরো দুটি ট্রলি এল পর পর। ট্রলিগুলো সবই ডালটনগঞ্জের দিক থেকে এল। এরা কারা আমি জানি না, তবে এরা যে রেলের অফিসার তা বুঝলাম।

মাস্টারমশাই এগিয়ে এসে হ্যান্ডসেক করলেন এ-এস-এমরা সকলে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে ওদের কি সব দেখালেন। শুনলাম, এঁদের মধ্যে একজন খুব বড় অফিসার উনি কাছাকাছি কোন বড় স্টেশানে সেলুন-এ ক্যাম্প করে আছেন। সারাদিন ইন্সপেকশান করছেন এ অঞ্চলের স্টেশনগুলো।

ওরা স্টেশান রুমের মধ্যে ঢুকে কীসব কাগজপত্র চেক করলেন।

আমি মিসেস কার্নির দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে এইসব সাংঘাতিক ক্রিয়াকাণ্ড প্রত্যক্ষ করছিলাম।

যাঁরা ইন্সপেকশান করছিলেন–এই ছোট্ট মত জঙ্গল-ঘেরা স্টেশানটি, তাঁদের মুখ চোখ দেখে মনে হচ্ছিল এরা প্রত্যেকে এক একজন জেনারেল রোমেল-মরুভূমির মধ্যে যেন ট্যাঙ্ক-বাহিনী ইন্সপেকট করছেন।

ওঁদের মধ্যে একজন ভদ্রলোক ছিলেন, তিনিই বোধহয় বড়সাহেব। তাঁর মুখ দেখে তাঁকে বিলক্ষণ ভদ্রলোকই মনে হচ্ছিল। মিসেস কার্নির দোকানের সামনে ওরা যখন এলেন তখনও আমি উঠে দাঁড়ালাম না দেখে ওদের মধ্যে একজন বেশ কটমটে চোখে আমার দিকে তাকালেন।

আমার খুব মজা লাগল।

আমি শুধু ওর কেন, আমি যে কোন লোকেরই চাকরী করি না, আমি যে স্ব-নিয়োজিত একজন কর্মচারী একথা মনে পড়ে খুব ভালো লাগল। চাকরী, সে যতবড় চাকরীই হোক, তা চাকরীই। তাতে গ্লানি থাকেই–এ জীবনে সেই গ্লানি থেকে যে মুক্তি পেয়ে গেছি এ কথাটা নতুন করে মনে হয়ে ভালো লাগল।

সেই ভদ্রলোক চোখে চোখ পড়তেই হাসলেন, বললেন, ভালো?

আমিও হাসলাম, বললাম, ভালো।

 অথচ উনি আমাকে চেনেন না এবং আমিও ওকে চিনি না।

মনে হল, এমনি কোনো সুন্দর রোদ-ঝলমল সকালে কাউকে না চিনলেও, কারো কাছে কোনো কাজ না থাকলেও, একজন চেয়ে থাকলে এবং অন্যজনের কাজ ছেড়ে চোখ তোলার মত অবকাশ থাকলে নিশ্চয়ই এমনি করে ভালো বলা উচিত। ইংরিজী হ্যালোর চেয়ে আমাদের ভালো অনেক ভালো।

মনে মনে ভদ্রলোকের তারিফ করছিলাম। কারণ ভদ্রলোক এতবড় অফিসার হয়ে গিয়েও এখনও ভদ্রলোকই আছেন। এমনকি আজকাল বড় একটা দেখা যায় না।

সঙ্গের অন্য দুজন অফিসার প্যান্টের থলিয়া-সমান দু পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তাঁদের চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছিল বেশ ক্ষিদে পেয়ে গেছে। ওঁরা আর এই ইন্সপেকশানের ঝামেলায় থাকতে রাজী নন।

ওদিকের বড় স্টেশানে, মুরগী রান্না হয়েছে, কনট্রাকটরেরা সব দেব-দর্শনের জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন– খাতির, খিদমারী, হুজৌর, সেলাম ইত্যাদি, ইত্যাদি। সকাল থেকে ট্রলি চড়ে ক্ষিদে পেয়েছে খুব। পালামৌর স্বাস্থ্যকর হাওয়া লেগেছে চোখে মুখে। ঢের হয়েছে কাজ-কাজ খেলা, এখন ফিরে গিয়ে কোন্ড-বীয়ার খেয়ে হাপুস-হুঁপুস করে মুরগীর ঝোল আর ভাত খাবেন ওঁরা, তা না, বড়সাহেবের কাজ আর ফুরোয় না।

ওঁরা চলে যাবার সময় সেই ভদ্রলোক আবার হাসলেন। এবার আমি উঠে দাঁড়ালাম, দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে নমস্কার করলাম। উনি বড়সাহেব বলে নন; ভদ্রলোক বলে।

ওঁরা যেমন এসেছিলেন, তেমন লাউগড়-গড় গাড়িতে করলে চলে যেতেই সমস্ত স্টেশান আবার আগের রূপ ফিরে পেল। মেয়ে দেখতে এসে বরপক্ষের লোকজন বিস্তর মিষ্টি-সিঙ্গাড়া লুচি-মাংস ধ্বংস করে চলে যাবার পরক্ষণেই মেয়ের বাড়ির বসবার ঘরের অবস্থা যেরকম হয়, ঠিক তেমন।

মিসেস কার্নি, ওঁরা চলে যেতেই দু হাতে আমার হাত চেপে ধরলেন; বললেন, তোমার সঙ্গে যে বড়সাহেবের এত খাতির জানতাম না। তুমি আজ এখানে ঠিক এই সময়ে না এসে পড়লে কি হত জানি না। থ্যাঙ্ক-উ সো মাচ মাই বয়, উ্য ডোন্ট নো, হাউ গ্রেটফুল আই অ্যাম।

আমি কি জবাব দেব ভেবে পেলাম না।

 মিসেস কার্নি বললেন, বড়সাহেব বলছিলেন, তোমার ঘাবড়াবার কোনো কারণ নেই তুমি ভালো করে দোকানটা চালাও–যত ভালো করে পারো– তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ভাবে কোরো। আমি যতদিন আছি, তোমার উপর যাতে অন্যায় না হয়, দেখব। কথা দিলাম। এই অবধি বলেই, মিসেস কার্নি তাঁর ছোট্ট নরম ফুলের মত হাত দুটো দিয়ে আমার হাত আবার জড়িয়ে ধরলেন।

দেখলাম তাঁর চোখের কোণা দুটি চিকচিক করছে- দুঃখে নয়, স্বস্তির আনন্দে!

আমি অনেকক্ষণ সেই সাহসী যুবতী-বৃদ্ধার হাত দুঃখানি আমার হাতে ধরে থাকলাম– অনেকদিন আগে এক রাতে লণ্ঠনের আলোর সামনে বসে শোনা অনেক কথা মনে পড়ে গেল।

আমার হাতে হাত রেখে মিসেস কার্নির এখন কি ঘুমিয়ে থাকা অতীতের অন্ধ কার্নি-সাহেবের কথা মনে হচ্ছিল?

যখন স্টেশান থেকে চলে এলাম তখন মাস্টারমশাইকে দেখলাম না। ভালোমানুষ ঢিলে-ঢালা মাস্টারমশাই-এর তলপেটে মাড় দিয়ে ইস্ত্রী করা ট্রাউজারের অত্যাচার আর বুঝি সহ্য হচ্ছিল না। উনি নিশ্চয়ই বাড়ি গিয়ে ওগুলো ছুঁড়ে ফেলে আবার লুঙ্গি গেঞ্জী পরে স্বাভাবিক হচ্ছেন।

আজকে স্টেশানে শৈলেনকে একবারও চোখে পড়ল না। শুনলাম ও টৌড়িতে গেছে কাজে।

ফেরার পথে পোস্ট-অফিস ঘুরে গেলাম।

 ছুটির লেখা একটা চিঠি ছিল।

ঠিক করলাম, চিঠিটা ফেরার সময় ঝর্ণাতলায়, পাথরের উপর বসে পড়ব, মনে হবে, ছুটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। রোদ এসে কাটাকুটি খেলছে ওর উজ্জ্বল তরুণ অপাপবিদ্ধ মুখে–আর ও ওর অনাবিল মনের সমস্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমার সঙ্গে কথা বলছে।

মিসেস কার্নিকে সত্যি কথাটা বলিনি, বলিনি যে, তাঁদের বড়সাহেবকে আমি চিনি না। যদি আমার এই সত্য গোপনের জন্যে তাঁর মনে শান্তি দৃঢ় হয়, তাহলে সেটা না বলাই ভালো।

আজকের দিনটা খুব লাকি দিন বলে মনে হচ্ছে। কেন? তা যাঁরা কুষ্টিটুষ্টি গ্রহ-নক্ষত্র সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল তাঁরাই হয়ত বলতে পারতেন।

দেখতে দেখতে ঝর্ণাটার কাছে এসে পৌঁছলাম।

ঝর্ণায় নেমে পথের ডানদিকে ঝর্ণার ভিতরে ঢুকে গেলাম, গিয়ে রোদে পিঠ দিয়ে একটা পাথরে বসে ছুটির চিঠিটা খুললাম।

ছুটি লিখেছে, সুকুদা, দিন চারেক আগে ভোরের দিকে একটা খুব খারাপ স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেছিল আমার।

আমি দেখলাম, আপনি আমার ঘরে আমার খাটের সামনের চেয়ারে বসে আছেন। একটা সাদা ট্রাউজার আর নীলরঙা টেনিস খেলার গেঞ্জী পরে আছেন আপনি। আপনি আমাকে কি যেন জরুরী কথা বলতে এসেছেন।

আমি খাটের উপর সামনে দুপা মুড়ে দুহাতে আমার পা জড়িয়ে বসে আছি আপনার দিকে চেয়ে।

আপনি বলছেন, দ্যাখো ছুটি, তোমাকে আমি ভালোবাসি। একথা অস্বীকার করার নয় যে, তোমাকে আমি ভালোবাসি, তোমাকে চিরদিন ভালোবাসব। কিন্তু ছুটি, তুমি যা আমার কাছে চাও, তা আমি তোমাকে কখনও দিতে পারব না।

এই অবধি বলার পরই দেখলাম, আপনি মুখ নীচু করে ফেললেন, যেন আপনার কথা। বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

সে কথা শুনতে আমার কষ্ট হয়েছিল কি হয়নি সে প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর।

আমি মুখ তুলে বলেছিলাম, কেন? তাছাড়া, আমি আপনার কাছে ভালোবাসা ছাড়া আর কী চেয়েছি বলে আপনার ধারণা? আমি ত কখনও আপনার কাছ থেকে আর কিছু চাইনি, এমনকি স্ত্রী হিসেবে সামাজিক সম্মানটুকুও চাইনি। আপনার সমস্ত শর্ত মেনে নিয়ে, শুধু আপনার জন্যেই আপনাকে চেয়েছি। এ ছাড়া আর ত কিছু আমার চাইবার ছিল না।  

আপনি বললেন, সে কথা নয়। আমি শরীরের কথা বলছি। আমার প্রতি রমা ট্রু, আমি ওর প্রতি আনট্রুথফুল হতে পারি না। কিন্তু তোমাকে আমি ভালেবাসি ভালোবাসব।

আমি বললাম, ভালোবাসার এমন শবব্যবচ্ছেদের কথা ত আমার জানা ছিল না। আমি বিশ্বাস করি না কাউকে ভালোবাসলে তাকে শুধু মনের ভালোবাসাই বাসা যায়, শরীরের ভালোবাসা থেকে আলাদা করে। যে বলে, কাউকে শারীরিকভাবে না চেয়ে শুধু মনে মনে চেয়েই কেউ সার্থক হয়, সে মিথ্যা কথা বলে। আপনাকে কোনদিন আমার সামনে দেবদাসের অভিনয় করতে হবে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।

আমি দেবদাসের ভালোবাসায় বিশ্বাস করি না। সেই সব পার্বতীদের যুগে চলে গেছে। যদি আমি কাউকে ভালোবাসি ত তাকে পুরোপুরি ভালোবাসি। স্বামীর ঘরের ভাঁড়ার সামলে ধন্য ধন্য সতীলক্ষ্মীর মহিমা কুড়িয়ে আমার মৃত প্রেমিকের শবের উপর আছড়ে পড়ে আমি কারো সমবেদনা বা সহানুভূতি চাই না। আমি যা চাই, যতটুকু চাই, তা এই জীবনে; এই যৌবনেই চাই।

আপনি বললেন, তুমি আমাকে বুঝতে পারছ না।

আমি বললাম, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি। বললাম, ভবিষ্যতে আপনি আমার সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ না রাখলেই আমি কৃতার্থ হব। রমাদিকে শরীরের ভালোবাসা বাসবেন, আর আমাকে মনের–এমন একটা হাস্যকর অবিশ্বাস্য অনিশ্চয়তা-ভরা ভবিষ্যৎ-এ ভর করে আমি জীবনে বাঁচতে চাই না। আপনাকে আগেও বলেছি যে, অতীত বা ভবিষ্যতে আমি বিশ্বাস করি না, কখনও করব না। আমি শুধু বর্তমানে বিশ্বাসী।

আপনি তবুও বললেন, তুমি আমাকে ভুল বুঝছ; ভুল বুঝেছ, আমার কিছু বলার নেই।

এই বলে, আপনি উঠে চলে গেলেন।

 আমার ঘুম ভেঙে গেল।

আমি উঠে তিন-চার গ্লাস জল খেলাম, বাথরুমে গিয়ে ঘাড়ে মাথায় জল দিলাম, তবুও আমার ঘুম আসল না।

সকালের আলো যখন ফুটল তখন খুব ভালো লাগল একথা জেনে যে, যা শুনলাম, যা বললাম, সবই স্বপ্নের মধ্যে, সবই একটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়।

সুকুদা, আমাকে আমি যতখানি আত্মনির্ভর ও স্বাবলম্বী বলে জানতাম, আমি বোধহয় ততখানি নই। এই স্বপ্নটা আমাকে এমনভাবে নাড়া দিয়ে গেছে যে, সাইক্লোনের মত আমার পুরানো ও গর্বময় বিশ্বাসের মহীরূহগুলোকে এমন করে উপড়ে দিয়ে গেছে যে, আপনাকে এ চিঠি না লিখে পারছি না।

আপনি কেমন আছেন? এই মুহূর্তে কি করছেন? এ চিঠি পড়েই আমাকে জানাবেন।

আমার কেবলি মনে হচ্ছে, এ স্বপ্ন কেন দেখলাম।

মনে হচ্ছে, এ দুঃস্বপ্ন যদি কখনও সত্যি হয়, তাহলে সেদিন আমি কি ভাবে সেই সত্যকে গ্রহণ করব? আমার মধ্যে এমন জোর কি আছে? এমন শক্তি কি আছে যে, কাউকে ছাড়াই, কারো ভালোবাসা ছাড়াই আমি এই শীতার্ত পৃথিবীতে একা একা বাঁচতে পারব?

নিজের কোনো-কিছু সম্বন্ধে আমার কোনোদিনও সংশয় ছিলো না, ভয় ছিলো না। আমি বিশ্বাস করতাম যে, আমি একজন আধুনিক আত্মনির্ভরশীল নিজেতে-নিজেসম্পূর্ণ মেয়ে। আমাকেও কি কারো দানের উপর, কারো খেয়ালী দয়ার উপর নির্ভর করে বাঁচতে হবে? তেমন করে কি কখনও আমি বাঁচতে পারব? জানি না।

আমার বড় ভয় করে সুকুদা, আমার বড় ভয় করে।

আপনি এর মধ্যে হাতে সময় নিয়ে একদিন রাঁচীতে আসবেন। আপনার মুখোমুখি বসে অনেকক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছে করে। অনেক কথা জমা হয়ে আছে। ইতি–

আপনার ভয়-পাওয়া ছুটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *