দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
১৮৮৩, ১৮ই জুন
শ্রীযুক্ত নবদ্বীপ গোস্বামীর প্রতি উপদেশ
[শ্রীগৌরাঙ্গের মহাভাব, প্রেম ও তিন দশা ]
অপরাহ্ন। রাখাল, রাম প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে ঠাকুর মণি সেনের বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন। নবদ্বীপ গোস্বামী প্রসাদ পাওয়ার পর ঠাণ্ডা হইয়া বৈঠকখানায় আসিয়া ঠাকুরের কাছে বসিয়াছেন।
শ্রীযুক্ত মণি সেন ঠাকুরের গাড়িভাড়া দিতে চাহিলেন। ঠাকুর তখন বৈঠকখানায় একটি কৌচে বসিয়া আছেন আর বলিতেছেন, “গাড়িভাড়া ওরা (রাম প্রভৃতিরা) নেবে কেন? ওরা রোজগার করে।”
এইবার ঠাকুর নবদ্বীপ গোস্বামীর সহিত ঈশ্বরীয় কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নবদ্বীপের প্রতি) — ভক্তি পাকলে ভাব — তারপর মহাভাব — তারপর প্রেম –তারপর বস্তুলাভ (ঈশ্বরলাভ)।
“গৌরাঙ্গের — মহাভাব, প্রেম।
“এই প্রেম হলে জগৎ তো ভুল হয়ে যাবেই। আবার নিজের দেহ যে এত প্রিয় তাও ভুল হয়ে যায়! গৌরাঙ্গের এই প্রেম হয়েছিল। সমুদ্র দেখে যমুনা ভেবে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল।
“জীবের মহাভাব বা প্রেম হয় না — তাদের ভাব পর্যন্ত। আর গৌরাঙ্গের তিনটি অবস্থা হত। কেমন?”
নবদ্বীপ — আজ্ঞা হাঁ। অন্তর্দশা, অর্ধবাহ্যদশা আর বাহ্যদশা।
শ্রীরামকৃষ্ণ — অন্তর্দশায় তিনি সমাধিস্থ থাকতেন। অর্ধবাহ্যদশায় কেবল নৃত্য করতে পারতেন। বাহ্যদশায় নামসংকীর্তন করতেন।
নবদ্বীপ তাঁহার ছেলেটিকে আনিয়া ঠাকুরের সঙ্গে আলাপ করিয়া দিলেন। ছেলেটি যুবা পুরুষ — শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তিনি ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন।
নবদ্বীপ — ঘরে শাস্ত্র পড়ে। এ-দেশে বেদ একরকম পাওয়াই যেত না। মোক্ষমূলর ছাপালেন, তাই তবু লোকে পড়ছে।
[পাণ্ডিত্য ও শাস্ত্র — শাস্ত্রের সার জেনে নিতে হয় ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — বেশি শাস্ত্র পড়াতে আরও হানি হয়।
“শাস্ত্রের সার জেনে নিতে হয়। তারপর আর গ্রন্থের কি দরকার!
“সারটুকু জেনে ডুব মারতে হয় — ঈশ্বরলাভের জন্য।
“আমায় মা জানিয়ে দিয়েছেন, বেদান্তের সার — ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। গীতার সার — দশবার গীতা বললে যা হয়, অর্থাৎ ‘ত্যাগী, ত্যাগী’।”
নবদ্বীপ — ‘ত্যাগী’ ঠিক হয় না, ‘তাগী’ হয়। তাহলেও সেই মানে। তগ্ ধাতু ঘঞ্ = তাগ; তার উত্তর ইন্ প্রত্যয় — তাগী। ‘ত্যাগী’ মানেও যা ‘তাগী’ মানেও তাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ — গীতার সার মানে — হে জীব, সব ত্যাগ করে ভগবানকে পাবার জন্য সাধন কর।
নবদ্বীপ — ত্যাগ করবার মন কই হচ্ছে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমরা গোস্বামী, তোমাদের ঠাকুর সেবা আছে, — তোমাদের সংসার ত্যাগ করলে চলবে না। তাহলে ঠাকুর সেবা কে করবে? তোমরা মনে ত্যাগ করবে।
“তিনিই লোকশিক্ষার জন্য তোমাদের সংসারে রেখেছেন — তুমি হাজার মনে কর, ত্যাগ করতে পারবে না — তিনি এমন প্রকৃতি তোমায় দিয়েছেন যে, তোমায় সংসারে কাজই করতে হবে।
“কৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন — তুমি যুদ্ধ করবে না, কি বলছ? — তুমি ইচ্ছা করলেই যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হতে পারবে না, তোমার প্রকৃতিতে তোমায় যুদ্ধ করাবে।”
[সমাধিস্থ শ্রীরামকৃষ্ণ — গোস্বামীর যোগ ও ভোগ ]
“কৃষ্ণ অর্জুনের সহিত কথা কহিতেছেন — এই কথা বলিতে বলিতে ঠাকুর আবার সমাধিস্থ হইতেছেন। দেখিতে দেখিতে সমস্ত স্থির — চক্ষু পলকশূন্য। নিঃশ্বাস বহিতেছে কি না বহিতেছে বুঝা ঝায় না। নবদ্বীপ গোস্বামী, তাঁহার পুত্র ও ভক্তগণ অবাক্ হইয়া দেখিতেছেন।
কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইয়া ঠাকুর নবদ্বীপকে বলিতেছেন:
“যোগ ভোগ। তোমরা গোস্বামীবংশ তোমাদের দুই-ই আছে।
“এখন কেবল তাঁকে প্রার্থনা কর, আন্তরিক প্রার্থনা — ‘হে ঈশ্বর, তোমার এই ভুবনমোহিনী মায়ার ঐশ্বর্য — আমি চাই না — আমি তোমায় চাই।’
“তিনি তো সর্বভূতেই আছেন — তবে ভক্ত কাকে বলে? যে তাঁতে থাকে — যার মন-প্রাণ-অন্তরাত্মা সব, তাঁতে গত হয়েছে।”
“ঠাকুর এইবার সহজাবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছেন। নবদ্বীপকে বলিতেছেন:
“আমার এই যে অবস্থাটা হয় (সমাধি অবস্থা) কেউ কেউ বলে রোগ। আমি বলি যাঁর চৈতন্যে জগৎ চৈতন্য হয়ে রয়েছে, — তাঁর চিন্তা করে কেউ কি অচৈতন্য হয়?”
শ্রীযুক্ত মণি সেন অভ্যাগত ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবদের বিদায় করিতেছেন — কাহাকে এক টাকা, কাহাকে দুই টাকা — যে যেমন ব্যক্তি।
ঠাকুরকে পাঁচ টাকা দিতে আসিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলিলেন:
“আমার টাকা নিতে নাই।”
মণি সেন তথাপি ছাড়েন না।
ঠাকুর তখন বলিলেন, যদি দাও তোমার গুরুর দিব্য। মণি সেন আবার দিতে আসিলেন। তখন ঠাকুর যেন অধৈর্য হইয়া মাস্টারকে বলিতেছেন, “কেমন গো নেব?” মাস্টার ঘোরতর আপত্তি করিয়া বলিলেন, “আজ্ঞা না — কোন মতেই নেবেন না।”
শ্রীযুক্ত মণি সেনের লোকেরা তখন আম সন্দেশ কিনিবার নাম করিয়া রাখালের হস্তে টাকা দিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — আমি গুরুর দিব্য দিয়েছি। — আমি এখন খালাস। রাখাল নিয়েছে সে এখন বুঝুগগে।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে গাড়িতে আরোহণ করিলেন — দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে ফিরিয়া যাইবেন।
[নিরাকার ধ্যান ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ]
পথে মতিশীলের ঠাকুরবাড়ি। ঠাকুর মাস্টারকে অনেকদিন হইল বলিতেছেন — একসঙ্গে আসিয়া এই ঠাকুরবাড়ির ঝিল দর্শন করিবেন — নিরাকার ধ্যান কিরূপ আরোপ করিতে হয়, শিখাইবার জন্য।
ঠাকুরের খুব সর্দি হইয়াছে। তথাপি ভক্তসঙ্গে ঠাকুরবাড়ি দেখিবার জন্য গাড়ি হইতে অবতরণ করিলেন।
ঠাকুরবাড়িতে শ্রীগৌরাঙ্গের সেবা আছে। সন্ধ্যার এখনও একটু দেরি আছে। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে শ্রীগৌরাঙ্গ-বিগ্রহের সম্মুখে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন।
এইবার ঠাকুরবাড়ির পূর্বাংশে যে ঝিল আছে তাহার ঘাটে আসিয়া ঝিল ও মৎস্য দর্শন করিতেছেন। কেহ মাছগুলির হিংসা করে না, মুড়িইত্যাদি খাবার জিনিস, কিছু দিলেই বড় বড় মাছ দলে দলে সম্মুখে আসিয়া ভক্ষণ করে — তারপর নির্ভয়ে আনন্দে লীলা করিতে করিতে জলমধ্যে বিচরণ করে।
ঠাকুর মাস্টারকে বলিতেছেন, “এই দেখ, কেমন মাছগুলি। এইরূপ চিদানন্দ-সাগরে এই মাছের ন্যায় আনন্দে বিচরণ করা।”