১৫. হিশামুদ্দিন সাহেব বাথরুমে ঢুকে কল ছাড়লেন

হিশামুদ্দিন সাহেব বাথরুমে ঢুকে কল ছাড়লেন

হিশামুদ্দিন সাহেব বাথরুমে ঢুকে কল ছাড়লেন তখন হঠাৎ তার মনে হলো ভূমিকম্প হচ্ছে। পৃথিবী দুলছে। অস্পষ্ট কাঁপুনি। আশ্চর্য কাণ্ড! সেই কঁপুনি তার শরীরের প্রতিটি কোষে ঢুকে যাচ্ছে। শরীরও কপিছে। ব্যাপারটা কী? তিনি এক হাতে বেসিনে ধরে ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলালেন। ভূমিকম্পের সময় ঘরবাড়ি ছেড়ে ফাঁকা জায়গায় ছুটে যেতে হয়। তার পা থেমে গেছে–তিনি বাথরুম থেকে বেরোবার আশা ছেড়ে দিলেন। বের হওয়া এখন অসম্ভব। তাকে যেতে হবে দরজা পর্যন্ত। দরজার লক। খুলতে হবে। অথচ পা জমে আছে। ভূমিকম্পের দুলুনি আরো বাড়ছে। তার শরীরের দুলুনিও বাড়ছে। তিনি ভাঙা গলায় ডাকলেন–চিত্ৰলেখা! চিত্ৰলেখা! নিজের গলা থেকে আওয়াজ বের হচ্ছে কি না তাও তিনি বুঝতে পারছেন না। চারদিক থেকে ঝমােঝম শব্দ হচ্ছে। সবাই যেন টিনের থালাবাসন হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। তিনি আবারো ডাকলেন চিত্ৰলেখা! চিত্ৰলেখা! কেউ কি আযান দিচ্ছে। তিনি আযানের শব্দও শুনছেন।

মহাপ্রাকৃতিক বিপদে মানুষ। আযান দেয়। আযান কে দিচ্ছে? মোতালেব?

বাথরুমের দরজায় ধাক্কা পড়ছে। কে যেন মিষ্টি গলায় ডাকছে—বাবা দরজা খোল। দরজা খোল। কে ডাকছে? চিত্ৰলেখা? তার গলা তো এমন না। মনে হচ্ছে দশ বছরের কোনো বালিকা।

বাবা তোমার কী হয়েছে?

ভূমিকম্প হচ্ছে রে মা।

দরজা খোল ত বাবা।

আমি নড়তে পারছি না রে মা।

খোলা কল দিয়ে ছড়াছড় শব্দে পানি পড়ছে। বাথরুমের আলো উজ্জ্বল হচ্ছে। আবার কমে যাচ্ছে। হিশামুদ্দিন বুঝতে পারছেন তার বাথরুমের দরজার পাশে অনেকেই ভিড় করেছে। দরজায় শব্দ হচ্ছে। তারা বোধহয় দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টা বাদ দিয়ে তাদের উচিত–নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নেয়া। ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুৰ্যোগের সময় কারো দিকে তাকাতে হয় না। পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, স্ত্রী কারো দিকেই না। শুধু নিজেকে বীচানো। তার মধ্যে দােষের কিছু নেই। প্রকৃতি মানুষের ডিএনএ কোষে এই ব্যাপারটা ঢুকিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতির মমতা তার সৃষ্টির জন্যে। প্রকৃতি জানে মহাবিপদের সময় যদি একে অন্যকে বাচানোর চেষ্টা করতে থাকে তাহলে কেউ বাঁচবে না। কাজেই প্রকৃতি এই বিধান ডিএনএ-তে ঢুকিয়ে দিয়েছে। যে বিধানে ভয়ঙ্কর বিপদে মানুষের সব চিন্তা নিজের দিকে কেন্দ্রীভূত হয়। কিন্তু এরা এমন করছে কেন? এরা কেন ছুটে গিয়ে মাঠে কিংবা ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়াচ্ছে না। টিনের থালা বাসন পেটানোরও বা অর্থ কী। আনন্দের কোনো ব্যাপার তো না যে ঘণ্টা বাজাতে হবে?

বাথরুমের দরজা ভাঙা হয়েছে। দরজার ওপাশে উদ্বিগ্নমুখে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। মোতালেব, রহমতউল্লাহ, চিত্ৰলেখা। চিত্ৰলেখা বাথরুমে ঢুকে বাবার হাত ধরল। পানির ট্যাপ বন্ধ করল। হিশামুদিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে বিব্রত গলায় বললেন, ভূমিকম্প হচ্ছে। চিত্ৰলেখা বলুল, ভূমিকম্প হচ্ছে না। তোমার শরীর খারাপ করছে। মনে হয় প্রেসার সাডেন শুট করেছে। তুমি কি আমার হাত ধরে ধরে হাঁটতে পারবে? নাকি তোমাকে কোলে করে নিতে হবে?

হাঁটতে পারব।

তাহলে এস।

পা আটকে গেছে। পা নাড়াতে পারছি না।

কোনো অসুবিধা নেই। আপাতত পা না নাড়ালেও চলবে। তোমাকে কোলে করে নেবার ব্যবস্থা করছি।

হিশামুদিন সাহেব খুবই বিস্মিত হচ্ছেন। কল বন্ধ করা হয়েছে অথচ এখনো পানি পড়ার ছড়াছড় শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে শব্দটা মাথার ভেতর ঢুকে পড়েছে। অনন্তকাল এই শব্দ মাথার ভেতর হতেই থাকবে। একঘেয়ে শব্দের জন্যে হিশামুদ্দিন সাহেবের কেমন ঘুমাও পেয়ে গেছে। যন্ত্রণাময় ঘুম। প্রবল জ্বরের সময় এ ধরনের ঘুম পায়; ঘুম হচ্ছে অথচ শারীরিক সব যন্ত্রণা টের পাওয়া যাচ্ছে। সবার কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে–এ রকম।

হিশামুদ্দিন সাহেব শুয়ে আছেন তার নিজের খাটে। ঘর অন্ধকার। জানালার সব পরদা টেনে দেয়া। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। দিনের শুরুটা ঠাণ্ডা। ফ্যানের বাতাসে তার শীত শীত লাগছে। গায়ে একটা পাতলা চাদর দিয়ে দিতে কি চিত্ৰলেখাকে বলবেন? শীত শীত ভাবটা খুব যে খারাপ লাগছে তা না। মাঝে মাঝে একটু শুধু কাঁপন লাগছে–এই যা।

শরীরটা এখন কেমন লাগছে বাবা?

ভালো।

তোমার ব্লাডপ্রেসার এখন অনেকখানি কমেছে। তবে পালস রেট এখনো হাই–মিনিটে ৯৮, তবে রেগুলার হয়েছে–আগে খানিকটা ইরেগুলারিটি ছিল। তোমাকে আমি টাংকুলাইজার দিয়েছি। এতে ঘুম হবে কিংবা তন্দ্রার মতো হবে। তোমার থরো চেকাপের একটা ব্যবস্থা আমি করছি। পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা তুমি নাড়াতে পার কি না। একটু দেখ তো।

হিশামুদিন পায়ের বুড়ো আঙুল নাড়লেন। চিত্ৰলেখা বলল, গুড। এখন ব্রেকফার্স্ট কর। হালকা কিছু খাও। দুধ সিরিয়েল, আধা কাপ ফলের রস। এক কাপ আগুনগরম চা।

তুই তো সত্যিকার ডাক্তারদের মতো কথা বলছিস।

আমি সত্যিকারেই ডাক্তার। আমি এখন একটু বের হব। এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরব। তোমার কানে যে যন্ত্রণা হচ্ছিল সেটা কি এখনো হচ্ছে?

না।

একসেলেন্ট! কাঁপছ কেন? তোমার কি শীত লাগছে?

একটু মনে হয় লাগছে।

গায়ে চাদর দিয়ে দেব?

না।

আমি রহমতউল্লাহকে তোমার নাশতা দিয়ে যেতে বলেছি।

কটা বাজে?

এখন বাজছে আটটা পঁয়ত্ৰিশ।

আজ এগারটার সময় একটা জরুরি অ্যাপায়েন্টমেন্ট আছে।

শুধু আজ না, আগামী এক সপ্তাহ তোমার কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। তুমি বিছানায় শুয়ে রিলাক্স করবে। গল্প করবে। বইটই পড়বে।

আজ এগারটায় যে অ্যাপিয়েন্টমেন্ট সেটা ক্যানসেল করা যাবে না।

সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করা যায় না। মৃত্যুর সঙ্গে যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেটাকেও পেছনের ডেটে সরানোর জন্য আছি আমরা— ডাক্তাররা।

সেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট কিন্তু ক্যানসোল হয় না।

আজ হয় না একদিন হবে। মানুষ অমরত্বের কৌশল জেনে যাবে। এজিং প্রসেস—বৃদ্ধ হবার প্রক্রিয়াটা জানার চেষ্টা হচ্ছে–যেদিন মানুষ পুরোপুরি জেনে যাবে ব্যাপারটা সেদিনই দেখবে মৃত্যু জয় করার চেষ্টা শুরু হবে।

ভালো।

তিন হাজার সনের মানুষের অমর হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

হিশামুদ্দিন সহজ গলায় বললেন, তিন হাজার সনের মানুষ তাহলে খুব দুঃখী মানুষ। মৃত্যুর আনন্দ থেকে তারা বঞ্চিত।

চিত্ৰলেখা অবাক হয়ে বলল, মৃত্যুর আবার আনন্দ কী?

হিশামুদিন হাসিমুখে বললেন, আনন্দ তো মা আছেই। আমরা জানি একদিন আমরা মরে যাব এই জন্যেই পৃথিবীটাকে এত সুন্দর লাগে। যদি জানতাম আমাদের মৃত্যু নেই তাহলে পৃথিবীটা কখনো এত সুন্দর লাগত না।

তুমি ফিলোসফারদের মতো কথা বলছি বাবা।

আর বলব না। ক্ষিধে লেগেছে নাশতা দিতে বল। আর শোন দুধ সিরিয়েল খাব না। দুধ-চিড়া খাব। দুধ-চিড়াও না–দই-চিড়া। পানিতে ভিজিয়ে চিড়াটাকে নরম করে টক দই, সামান্য লবণ, কুচিকুচি করে আধটা কাচামরিচ. এটা হচ্ছে আমার বাবার খুবই প্রিয় খাবার।

তুমি যেভাবে বলছ আমারও খেয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। এক কাজ করলে কেমন হয়। আগামীকাল আমরা এই নাশতাটা খাব–আজ আমার মতো খাও।

আচ্ছা।

আমি চলে যাচ্ছি, রহমতউল্লাহ ঠিক দশটার সময় দুটা ট্যাবলেট দেবে তুমি হাসিমুখে খেয়ে নেবে।

আচ্ছা হাসিমুখেই খাব।

হিশামুদ্দিন সাহেব নাশতা খেলেন। রহমতউল্লাহ তাকে খাটে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ভীত চোখে তাকিয়ে আছে। সাধারণত তিনি তার নাশতা বা খাবার একা একা খান। কেউ পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে অস্বস্তি লাগে। আজো লাগছে। কিন্তু তিনি কিছু বলেন না।

রহমতউল্লাহ।

জ্বি স্যার।

কাল দই-চিড়া খাব।

জ্বি আচ্ছা স্যার।

দই-চিড়া আমার বাবার খুবই প্রিয় খাবার।

জ্বি আচ্ছা।

হিশামুদিনের ভুরু কঁচকে গেল। তিনি ঠিক কথা বলছেন না। দই-চিড়া তার বাবার প্রিয় খাবার না। গরিব মানুষদের কোনো প্রিয় খাবার থাকে না। খাদ্যদ্রব্য মাত্রই তাদের প্রিয়। তার বাবা যখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন কিছু খেতে পারতেন না। তখন বলেছিলেন, দই-চিড়া দে। দই-চিড়া বলকারক, খেতেও ভালো। সেই দই-চিড়ার ব্যবস্থা হয় নি। তার বাবার বিচিত্র ধরনের অসুখ হয়েছিল। অসহ্য গরম লাগত। কাপড় ভিজিয়ে গায়ে জড়িয়ে হাওয়া করেও সেই গরম কমানো যেত না। রাতে ঘরে ঘুমোতে পারতেন না। বারান্দায় হাওয়া বেশি খেলে বলে বারান্দায় শুইয়ে রাখা হতো। এক রাতে অবস্থা খুব খারাপ হলো। কবিরাজের কাছ থেকে মকরধ্বজ এনে খাওয়ানো হলো। সেই ওষুধের নাকি এমনই তেজ যে খাওয়ামাত্র মরা রোগী লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে। মকরধ্বজ খাওয়ার পর তার অবস্থা আরো খারাপ হলো, তিনি ছটফট করতে লাগলেন। মাঝে মাঝে ছটফটানি কমত–তিনি তখন বলতেন— আমার শরীরটা পুড়ে যাচ্ছে। আরো জোরে হাওয়া কর। আরো জোরে। রাত দুটার দিকে তার জুলুনি বোধহয় একটু কমল। তিনি ক্লান্তভঙ্গিতে বললেন-আজ মৃত্যু হবে কি না বুঝতে পারছি না। চাঁদনী রাত ছিল। মরণ হলে খারাপ ছিল না। শরীরের জ্বলুনিটা কমত। জ্বলুনি আর সহ্য হয় না।

দুৰ্ভগাদের কোনো ইচ্ছাই পূর্ণ হয় না। তার শেষ ইচ্ছাও পূর্ণ হয় নি। তিনি মারা যান। পরের রাতে। সে রাতে আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল। চাদ বা তারা কোনোটাই ছিল না।

আচ্ছা তিনি কি তার বাবাকে গ্লামারাইজড করছেন না? একটা দুষ্ট প্রকৃতির লোককে দুঃখী, মহৎ এবং সুন্দর মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। ব্যাপারটা আসলে সে রকম না। তার বাবা ছিলেন চোর, অসৎ প্রকৃতির মানুষ, সৰ্বরকম দায়িত্ব জ্ঞানহীন একজন দুর্বল মানুষ। দুর্বল মানুষদের চরিত্রও দুর্বল থাকে। তার চরিত্রও দুর্বল ছিল। তার খারাপ পাড়ায় যাতায়াত ছিল। খারাপ পাড়ার একটি মেয়েকে তিনি বিয়েও করেছিলেন। সেই মেয়েকে তিনি অবশ্যি ঘরে আনেন নি। তবে সেই নষ্ট মেয়ের গর্ভের একটি সন্তানকে ঘরে স্থান দিয়েছিলেন। এই ঘটনা চিত্ৰলেখাকে বলা হয় নি, হাসানকেও বলা হয় নি। তিনি পাশ কাটিয়ে গল্প বলছেন। এটা ঠিক হয় নি।

রহমতউল্লাহ!

জ্বি স্যার।

তুমি হাসানকে একটু খবর দাও। জ্বি আচ্ছা স্যার।

পান দিতে বল। চা খেয়ে মুখ মিষ্টি হয়ে গেছে। জর্দা ছাড়া পান।

জ্বি দিচ্ছি।

একটা পাতলা চাদর আমার গায়ে দিয়ে দাও। শীত লাগছে।

ফ্যান বন্ধ করে দিব স্যার?

ফ্যান বন্ধ করতে হবে না।

হিশামুদ্দিন চোখ বন্ধ করলেন। বেশ ভালো ঠাণ্ডা লাগছে। তার বাবা মৃত্যুর সময় অসহ্য গরমে ছটফট করেছেন। আর তিনি নিজে হয়তো শীতে কাপতে কাঁপতে মারা যাবেন। তার বাবার কোনো সাধই পূর্ণ হয় নি। তার নিজের প্রতিটি সাধ পূর্ণ হয়েছে। তিনি যদি চান তার মৃত্যু হবে জোছনা দেখতে দেখতে তাহলে হয়তো-বা কৃষ্ণপক্ষের রাতেও পূৰ্ণচন্দ্ৰ দেখা যাবে।

স্যার!

হুঁ।

পান এনেছি স্যার।

পান খাব না নিয়ে যাও। আরেকটা পাতলা চাদর গায়ে দাও। শীত বেশি লাগছে।

জ্বি আচ্ছা স্যার।

তোমার দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। তুমি চলে যাও।

রহমতউল্লাহ চলে গেল না। ঘরে থেকে বের হয়ে গেল ঠিকই। তবে দাড়িয়ে রইল দরজার ওপাশে। মনে হয় তার প্রতি চিত্ৰলেখার এ ধরনের নির্দেশ আছে।

হিশামুদ্দিন চোখ বন্ধ করে আছেন। পানিতে ডুবে যারা মারা যায় সমগ্র জীবনের ছবি তাদের চোখের ওপর দিয়ে ভেসে যায়। খাটে শুয়ে যাদের মৃত্যু তাদের চোখের ওপর দিয়ে কিছু কি ভাসে? যাপিত জীবনের খণ্ডচিত্ৰ?

রহমতউল্লাহ আবার ঘরে ঢুকেছে৷ তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে লজ্জিত এবং কিঞ্চিত ভীত।

কিছু বলবে?

হাসান সাহেবকে খবর দেয়া হয়েছে স্যার।

ভালো। ভেরি গুড। সে এলে তাকে সরাসরি এখানে নিয়ে আসবে।

জ্বি আচ্ছা।

আপা এই ওষুধ দুটা দিয়ে গেছেন। দশটার সময় আপনাকে খাওয়াতে বলেছেন।

আচ্ছা দাও।

হিশামুদিন ট্যাবলেট দুটা গিলে ফেললেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ঝিমুনির মতো এসে গেল। তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন।

 

হাসান অনেকক্ষণ থেকে বসে আছে। তাকে চা-স্যান্ডউইচ দেয়া হয়েছে। বলা যেতে পারে খানিকটা আদর-যত্ন করা হচ্ছে। অন্য সময় এরচে’ দীর্ঘ সময় বসে থাকলেও চাটা কিছুই দেয়া হয় না। হিশামুদ্দিন সাহেব খুব অসুস্থ এই খবরটা তাকে দেয়া হয়েছে। অসুস্থতার ফলে তাকে এখানে ডেকে আনার কারণটা সে ধরতে পারছে না। গুরুতর অসুস্থ মানুষ লইয়ারদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। বিষয়-সম্পত্তির বিলি ব্যবস্থা করে। কেউ কেউ মওলানা ডেকে এনে তওবা করেন। পরকালে নিৰ্ভয়ে যাবার ব্যবস্থা করেন। তবে তওবার ব্যাপারটা নিম্নবিত্তের মানুষদের ক্ষেত্রেই বেশি ঘটে। হিশামুদিন সাহেবদের মতো অকল্পনীয় বিত্তের মানুষরা তওবা করেন না।

হাসান সাহেব!

হাসান প্ৰায় লাফিয়ে উঠল। হিশামুদ্দিন সাহেবের মেয়ে চিত্ৰলেখা দরজা ধরে দুয়েছে। মেয়েটিকে আজ খুব বিষন্ন লাগছে। বাবার অসুখের ব্যাপারে সে হয়তো চিন্তিত।

ম্যাডাম স্নামালিকুম। আমাকে ম্যাডাম ডাকবেন না তো— শুনতে কুৎসিত লাগে। আমাকে নাম ধরে ডাকবেনা–চিত্ৰলেখা। কোনো সমস্যা নেই। চা খাওয়া হয়েছে?

জ্বি।

বাবা অসুস্থ শুনেছেন বোধহয়?

জ্বি।

অসুখ যতটা সহজ ভেবেছিলাম তত সহজ না। বেশ জটিল। আমি বেশ চিন্তিত বোধ করছি। ভালো কোনো ক্লিনিকে তাকে ট্রান্সফার করলে ভালো হত। আমি ক্লিনিক খুঁজে বেড়ালাম। কোনোটাই পছন্দ হচ্ছে না। ক্লিনিকে সুযোগ-সুবিধা কী আছে জানতে চাইলে ওরা বলে–এসি আছে, কালার টিভি আছে, ফ্রিজ আছে, ইন্টারকমের ব্যবস্থা আছে। চিকিৎসার ব্যবস্থা কী তা বলে না।

স্যারের কী হয়েছে?

ব্লাডপ্রেসার খুব ফ্লাকচুয়েট করছে। পালস ইরেগুলার। তার এখন দরকার কনসটেন্ট মনিটরিং।

কোনো হাসপাতালে কি ভর্তি করাবেন? ঢাকা মেডিকেল কলেজ বা পিজি?

এখনো বুঝতে পারছি না। আজ দিনটা দেখে আগামীকাল ডিসিশান নেব। আপনি আসুন। বাবার ঘুম ভেঙেছে তার সঙ্গে কথা বলুন।

উনি আমাকে কেন ডেকেছেন বলতে পারেন?

লাইফ ক্টোরি সম্ভবত বলবেন।

এখন কি উনার কথা বলা ঠিক হবে?

আমি তাতে কোনো অসুবিধা দেখছি না। কথা বলে তিনি যদি আনন্দ পান তাহলে কথা বলাই উচিত। উনি যে গুরুতর অসুস্থ তা আমি তাকে বুঝতে দিতে চাচ্ছি না। আমার কথা বুঝতে পারছেন তো?

জ্বি।

বাবা যে আপনাকে গল্প বলেন তার পেছনের কারণটা কি আপনি ধরতে পেরেছেন?

জ্বি না।

বাবা যা করছেন তা হচ্ছে এক ধরনের কনফেসন। খ্রিষ্টানরা যখন কোনো অপরাধ করে তখন তারা পাদ্রীদের কাছে কনফেসন করে। বাবা যা করছেন তা হচ্ছে এক ধরনের কনফেসন।

উনি তো কোনো অপরাধ করেন নি।

অপরাধ না করেও কেউ কেউ নিজেকে অপরাধী ভাবে। বাবার মা-বাবা, ভাইবোন হতদরিদ্র ছিলেন। অনেকেই মারা গেছেন বিনা চিকিৎসায়। যারা বেঁচে আছেন তাদের অবস্থা শোচনীয়। অথচ মাঝখান থেকে বাবা হয়ে গেলেন বিলিওনিয়ার। এই কারণেই তিনি হয়তো নিজেকে অপরাধী ভাবেন। মানুষ অতি বিচিত্ৰ প্ৰাণী হাসান সাহেব। কী, ঠিক বলছি না?

জ্বি।

আপনার কথাবার্তা দেখছি–জ্বি এবং জ্বি নাতে সীমাবদ্ধ। হড়বড় করে কথা বলা অভ্যাস করুন তো। হড়বড় করে যারা কথা বলে তাদের মন সব সময় প্রফুল্প থাকে। এটা হচ্ছে রিসেন্ট ফাইন্ডিং নিউজউইকে উঠেছে।

হাসান চুপ করে রইল। চিত্ৰলেখা বলল, বাবার অপরাধবোধের আরেকটা বড় কারণও আছে। তিনি তার আত্মীয়স্বজনদের কোনো সাহায্য করেন নি। কেউ কেউ সাহায্যের জন্যে এসেছিল তাদের দূর দূর করে তাড়িয়েছেন।

বাবার অনেক কিছু আমি বুঝতে পারি না। এই ব্যাপারটিও পারি না।

বুঝতে বোধহয় চেষ্টাও করেন নি।

ঠিক বলেছেন, চেষ্টাও করি নি। আমার উচিত ছিল বাবার আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, আমি সেটাও করি নি। বাবা যেমন পৃথিবীতে একা আমিও একা। আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে–কিন্তু আমার কথা বলার মানুষ নেই। এই যে আপনার সঙ্গে কথা বলছি–আমার ভালো লাগছে। কেন ভালো লাগছে বলুন তো?

বলতে পারছি না।

কারণ আপনি বাবার খুব পছন্দের মানুষ। কী করে বললাম বলুন তো?

বুঝতে পারছি না।

কাল রাতে খেতে বসে বাবা হঠাৎ বললেন, হাসানকে একদিন আমাদের সঙ্গে খেতে বলি। আমি বললাম, বেশ তো বল। উনি তৎক্ষণাৎ বললেন— না থাক। বাবার সমস্যা কী জানেন? তার সমস্যা হচ্ছে–তিনি যাদের পছন্দ করেন তাদের কখনো তা জানান না। তার পছন্দ এবং অপছন্দ দুটা ব্যাপারই খুব গোপন। আমি বোধহয় বকবক করে আপনার মাথা ধরিয়ে দিয়েছি। চলুন বাবার ঘরে যাই।

হাসানকে দেখেই হিশামুদ্দিন বললেন, তোমার কী হয়েছে হাসান?

হাসান হকচাকিয়ে গেল। সে রোগীর ঘরে ঢুকেছে। রোগী তাকে দেখে বলছেন তোমার কী হয়েছে।

কিছু হয় নি স্যার।

তোমাকে মৃত মানুষদের মতো দেখাচ্ছে।

আমি ভালোই আছি স্যার। আপনি কেমন আছেন?

আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি ভালোই আছি-কিন্তু আমার মেয়ের মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভালো নেই। ডাক্তাররা যখন রোগীর সামনে অতিরিক্ত রকমের হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করে তখন বুঝতে হয়-সামথিং ইজ রং। দাঁড়িয়ে আছ কেন? বস।

হাসান বসল। হিশামুদ্দিন সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন–আমার বাবা প্রসঙ্গে নানান সময় তোমাকে নানান কথা বলেছি। আমার কথা শুনে শুনে তার একটা ছবি নিশ্চয়ই তোমার মনে তৈরি হয়েছে। ছবিটা কেমন?

স্যার ছবিটা খুবই সুন্দর। আপনার বাবাকে আমার অসাধারণ মানুষ বলে মনে হয়।

হিশামুদ্দিন শান্ত গলায় বললেন, তিনি খুবই সাধারণ মানুষ। ভণ্ড টাইপের মানুষ। মিথ্যাবাদী, চোর, স্বার্থপর, অলস… যে কটি খারাপ গুণ মানুষের থাকা সম্ভব সবকটি তার মধ্যে ছিল। খারাপ পাড়ার একটি মেয়েকে তিনি বিবাহ করেছিলেন–সেই ঘরে তার একটি ছেলে হয়েছিল। ওই মহিলা বাবাকে এক পর্যায়ে ছেড়ে চলে যান। আমি কী বলছি তুমি মন দিয়ে শুনছ তো?

জ্বি স্যার শুনছি।

বাবা ওই মহিলার গর্ভজাত সন্তানকে নিজের কাছে নিয়ে যান। কিন্তু তাকে দু চোখে দেখতে পারতেন না। তার অন্য সন্তানরাও তাকে দেখতে পারত না। কেউ তার সাথে রাতে ঘুমোত না। সে ঘুমোত একা একা। সে জ্বরে ছটফট করলে কেউ এসে মাথায় হাত দিয়ে জ্বর দেখত না। বাবার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত সেই ছেলেটা সারাজীবন করেছে। তোমার বুদ্ধি কেমন হাসান?

আমার বুদ্ধি স্যার মোটামুটি পর্যায়ের।

মোটামুটি পর্যায়ের বুদ্ধি দিয়েও তুমি আশা করি বুঝতে পারছি সেই ছেলেটি কে। পারছি না?

জ্বি স্যার পারছি।

এখন বল তোমাকে এমন মলিন দেখাচ্ছে কেন? তোমার সমস্যা কী?

তেমন কোনো সমস্যা নেই স্যার।

সমস্যা থাকলে বলতে পার। বিত্তবান মানুষরা নিজের সমস্যার সমাধান করতে না পারলেও অন্যের সমস্যার সমাধান করতে পারেন।

হাসান কিছু বলল না, চুপ করে রইল। একবার তার ইচ্ছা করছিল বলে ফেলে–স্যার আমাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিন। বলতে লজ্জা লাগল। একজন অসুস্থ মানুষকে চাকরির কথা বলা যায় না। লিটনের কথা কি সে স্যারকে বলবে? নিজের কথা বলা না গেলেও অন্যের কথা নিশ্চয়ই বলা যায়।

আমার এক বন্ধুর জন্যে কি স্যার আপনি একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন?

তোমার বন্ধু?

জ্বি স্যার। খুব ভালো ছেলে।

কী করে বুঝলে খুব ভালো ছেলে?

আমি তাকে স্কুলজীবন থেকে দেখছি। ও খুব কষ্টে আছে। বিয়ে করে খুব ঝামেলায় পড়েছে।

চাকুর বাকরি নেই বিয়ে করে ফেলল? ও তো বোকা। বোকাদের সমস্যার সমাধান করতে নেই। বোকাদের সমস্যা নিজের ঘাড়ে নিলে কী হয় জান হাসান?

জ্বি না।

তখন নিজের সমস্যার সঙ্গে বোকার সমস্যাও যুক্ত হয়।

হাসান চুপ করে গেল। হিশামুদ্দিন বললেন, তোমার বন্ধুর নাম কী?

লিটন।

ভালো নাম কী?

হামিদুর রহমান।

পড়াশোনা কী?

এম. এ. পাস করেছে।

কত টাকা বেতনে চাকরি হলে তোমার বোকা বন্ধুর সমস্যার সমাধান হয়?

মাসে হাজার পাঁচেক টাকা পেলেই ওরা মহাখুশি হবে। একটা কিছু পেলেই হয় স্যার।

তুমি একটা কাগজে তার নাম-ঠিকানা লিখে মোতালেবের কাছে দিয়ে যাও।

স্যার। থ্যাংক য়্যু।

হাসান লক্ষ করল হিশামুদিন সাহেব হাসছেন। এই মানুষটাকে সে খুব কম হাসতে দেখেছে। উনি হাসছেন কেন?

হাসান!

জ্বি স্যার।

তুমি বরং আজ যাও। এখন আবার কেন জানি মাথাটা ঝিমঝিম করছে।

স্যার আমি কাল এসে খোঁজ নিয়ে যাব।

কাল এসে খোঁজ নিতে হবে না। তোমার সঙ্গে যেমন কথা আছে তেমনি আসবে বুধবার বিকেল তিনটায়।

জ্বি আচ্ছা স্যার।

পরের বুধবার বিকাল তিনটায় এসে হাসান জানতে পারল, হিশামুদিন সাহেব আজ দুপুরের আগে মারা গেছেন।

বাড়িভর্তি মানুষ। কম্পাউন্ডের ভেতরে এবং বাইরে প্রচুর মানুষ। হাসান গেট থেকেই বিদেয় হলো। একবার মুহুর্তের জন্যে তার ইচ্ছা হলো সে চিত্ৰলেখার সঙ্গে দেখা করে–সাত্ত্বনার দুটা কথা বলে। পর মুহূর্তেই মনে হলো সান্ত্ৰনার কথা সে জানে না। এবং চিত্ৰলেখার মতো মেয়েদের সান্ত্বনার দরকার নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *