হযরত ঈসা (আ)-কে আসমানে উঠিয়ে নেয়ার বর্ণনা
আল্লাহ তাআলা কর্তৃক ঈসা (আঃ)-কে রক্ষা এবং ইয়াহুদী ও নাসারাদের তাঁকে শূলে চড়াবার মিথ্যা দাবি প্রসঙ্গ এ প্রসংগে আল্লাহর বাণী :
এবং তারা চক্রান্ত করেছিল, আল্লাহও কৌশল করেছিলেন, আল্লাহ কৌশলীদের শ্রেষ্ঠ। স্মরণ কর, যখন আল্লাহ বললেন, হে ঈসা! আমি তোমার কাল পূর্ণ করছি এবং আমার নিকট তোমাকে তুলে নিচ্ছি এবং যারা কুফরী করেছে তাদের মধ্য হতে তোমাকে পবিত্র করছি। আর তোমার অনুসারীদেরকে কিয়ামত পর্যন্ত কাফিরদের উপর প্রাধান্য দিচ্ছি। অতঃপর আমার কাছে তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তারপর যে বিষয়ে তোমাদের মতান্তর ঘটছে। আমি তা মীমাংসা করে দিব। (আলে-ইমরান : ৫৪-৫৫)
আল্লাহ আরও বলেন :
এবং তারা লানতগ্রস্ত হয়েছিল তাদের অংগীকার ভংগের জন্যে, আল্লাহর আয়াতকে প্রত্যাখ্যান করার জন্যে, নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার জন্যে এবং আমাদের হৃদয় আচ্ছাদিত, তাদের এই উক্তির জন্যে। বরং তাদের কুফরীর কারণে আল্লাহ তাতে মোহর মেরে দিয়েছেন। সুতরাং তাদের অল্প সংখ্যাক লোকই বিশ্বাস করে। এবং তারা লানতগ্রস্ত হয়েছিল তাদের কুফরীর জন্যে ও মারিয়ামের বিরুদ্ধে গুরুতর অপবাদের জন্যে। আর আমরা আল্লাহর রাসূল মারয়াম-তনয় ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি— তাদের এই উক্তির জন্যে। অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি, ক্রুশবিদ্ধও করেনি, কিন্তু তাদের এরূপ বিভ্রম হয়েছিল। যারা তার সম্বন্ধে মতভেদ করেছিল, তারা নিশ্চয়ই তার সম্বন্ধে সংশয়যুক্ত ছিল; এ সম্পর্কে অনুমানের অনুসরণ ব্যতীত তাদের কোন জ্ঞানই ছিল না। এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করেনি, এবং আল্লাহ তাকে তাঁর নিকট তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। কিতাবীদের মধ্যে প্রত্যেকে তার মৃত্যুর পূর্বে তাকে বিশ্বাস করবেই এবং কিয়ামতের দিন সে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে। (নিসা : ১৫৫-১৫৯)
উপরোক্ত আয়াতসমূহ দ্বারা আল্লাহ মানুষকে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি হযরত ঈসা (আ) কে নিদ্রাচ্ছন্ন করার পরে আসমানে তুলে নেন— এটা সন্দেহাতীতভাবে বিশুদ্ধ মত। ইয়াহুদীরা ঐ যুগের জনৈক কাফির বাদশাহর সাথে ষড়যন্ত্র করে তাকে যে নির্যাতন করতে চেয়েছিল, আল্লাহ তা থেকে তাকে মুক্ত করেন।
হাসান বসরী ও মুহাম্মদ ইসহাক বলেন, ঐ বাদশাহর নাম ছিল দাউদ ইব্ন নুরা। সে ঈসা। (আ)-কে হত্যা ও ক্রুশবিদ্ধ করার হুকুম দেয়। হুকুম পেয়ে ইয়াহুদীরা শুক্রবার দিবাগত শনিবার রাত্রে বায়তুল মুকাদ্দাসের একটি কক্ষে ঈসা (আ)-কে অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে যখন হত্যার উদ্দেশ্যে তারা কক্ষে প্রবেশ করে তখন আল্লাহ তাআলা কক্ষে বিদ্যমান ঈসা (আ)-এর অনুসারীদের মধ্য হতে একজনের চেহারাকে তাঁর চেহারার সদৃশ করে দেন এবং ঈসা (আ)-কে বাতায়ন-পথে আকাশে তুলে নেন। কক্ষে যারা ছিল তারা ঈসা (আ)-কে তুলে নেয়ার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছিল। ইতিমধ্যে বাদশাহর রক্ষীরা কক্ষে প্রবেশ করে ঈসা (আ)-এর চেহারা বিশিষ্ট ঐ যুবককে দেখতে পায়। তারা তাকেই ঈসা (আ) মনে করে ধরে এনে শূলে চড়ায় এবং মাথায় কাটার টুপি পর্যায়। তাকে অধিক লাঞ্ছিত করার জন্যে তারা এই ব্যবস্থা গ্ৰহণ করে। সাধারণ নাসারা, যারা ঈসা (আ)-এর ঘটনা প্রত্যক্ষ করেনি, তারা ইয়াহুদীদের ঈসা (আ)-কে ক্রুশ বিদ্ধ করার দাবি মেনে নেয়। ফলে, তারাও সত্য থেকে স্পষ্ট ও চূড়ান্ত বিভ্রান্তির অতল তলে নিক্ষিপ্ত হয়। সেই জন্যে আল্লাহ বলেন, কিতাবীদের প্রত্যেকেই তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর প্রতি বিশ্বাস করবে। অর্থাৎ কিয়ামতের পূর্বে শেষ যুগে ঈসা (আঃ) যখন পৃথিবীতে পুনরায় আসবেন তখন তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যুর পূর্বে তখনকার সকল কিতাবীরাই তাঁর প্রতি বিশ্বাস আনবে। কেননা তিনি পুনর্বাের পৃথিবীতে আসবেন এবং শূকর বধ করবেন, ক্রুশ ধ্বংস করবেন, জিযিয়া কর রহিত করবেন এবং ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দীন কবুল করবেন না। তাফসীর গ্রন্থে সূরা নিসায় এই আয়াতের ব্যাখ্যায় এ প্রসংগে যাবতীয় হাদীস আমরা উল্লেখ করেছি এবং এই কিতাবে ফিতান ও মালাহিম (কিয়ামত— পূর্ব বিপর্যয় ও মহাযুদ্ধ) অধ্যায়ে মাসীহুদ দাজ্জাল প্রসংগে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। দাজ্জালকে হত্যার জন্যে ইমাম মাহদীর অবতরণ প্রসংগে যত হাদীস ও রিওয়ায়ত আছে, সবই সেখানে বর্ণনা করা হবে। এখানে আমরা ঈসা (আ)-কে আসমানে উঠিয়ে নেয়া সম্পর্কে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।
ইব্ন আবি হাতিম ইব্ন আব্বাস (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেন, আল্লাহ যখন ঈসা। (আ)-কে আসমানে তুলে নিতে ইচ্ছা করলেন তখন ঘটনা ছিল এই যে, বায়তুল মুকাদাসের একটি কক্ষে ঈসা (আ)-এর বারজন হাওয়ারী অবস্থান করছিলেন। তিনি মসজিদের একটি ঝরনায় গোসল করে ঐ কক্ষে শিষ্যদের নিকট যান। তাঁর মাথার চুল থেকে তখনও পানি ঝরে পড়ছিল। তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি আছে, যে তার প্রতি ঈমান আনার পর বারো (১২) বার আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। এরপরে তিনি তাদের নিকট জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কে রাজী আছে যাকে আমার গঠনাকৃতি দ্বারা পরিবর্তন করা হবে এবং আমার স্থলে তাকে হত্যা করা হবে, পরিণামে আমার সাথে সে মর্যাদা লাভ করবে? উপস্থিত শিষ্যদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ এক যুবক দণ্ডায়মান হলেন। ঈসা (আঃ) তাকে বললেন, বাস। এরপর তিনি দ্বিতীয় বার একই আহবান জানান। এবারও ঐ যুবকটি দণ্ডায়মান হলেন। ঈসা। (আ) তাঁকে বসতে বললেন। তৃতীয়বার তিনি আবারও একই আহবান রাখেন। ঐ যুবক দাঁড়িয়ে বললেন, এ জন্যে আমি প্ৰস্তৃত। ঈসা (আ) বললেন, তাই হবে, তুমিই এর অধিকারী। অতঃপর যুবকটির গঠনাকৃতিকে ঈসার গঠনাকৃতি দ্বারা পরিবর্তন করে দেয়া এবং মসজিদের একটি বাতায়ন পথে ঈসা (আ)-কে আসমানে তুলে নেয়া হয়। এরপর ইয়াহুদীদের একটি অনুসন্ধানকারী দল ঈসা (আ)-কে ধরার জন্যে এসে উক্ত যুবককে ঈসা (আ) মনে করে ধরে নিয়ে আসে ও তাকে হত্যা করে এবং ক্রুশবিদ্ধ করে। জনৈক শিষ্য ঈসা (আ)-এর প্রতি ঈমান আনার পর বার বার বিশ্বাসঘাতকতা করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বনী ইসরাঈল তিন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে; যথাঃ
১. আল-ইয়াকুবিয়্যাঃ এই দল বিশ্বাস করে যে, এতদিন আল্লাহ স্বয়ং আমাদের মাঝে বিদ্যমান ছিলেন, এখন তিনি আসমানে উঠে গিয়েছেন।
২. আল-নাসিতুরিয়্যা : এই দলের বিশ্বাস হল, আল্লাহর পুত্র আমাদের মধ্যে এতদিন ছিলেন, এখন তাঁকে আল্লাহ নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন;
৩. আল মুসলিমুন : এই দলের মতে ঈসা (আ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহর যতদিন ইচ্ছা ছিল ততদিন তিনি আমাদের মধ্যে ছিলেন। এখন তাকে আল্লাহ নিজের সান্নিধ্যে উঠিয়ে নিয়েছেন। উক্ত তিন দলের মধ্যে কাফির দুই দল একত্রিত হয়ে মুসলিম দলের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখে; ফলে মুসলিম দল নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চলার পর আল্লাহ মুহাম্মাদ (সা)-কে রসুলাররূপে প্রেরণ করেন। ইব্ন আব্বাস (রা) বলেন, এই দিকে ইংগিত করেই কুরআনে বলা হয়েছে পরে আমি মুমিনদেরকে শক্তিশালী করলাম তাদের শক্ৰদের মুকাবিলায়; ফলে তারা বিজয়ী হল (৬ সাফ : ১৪)। এ হাদীসের সনদ ইব্ন আব্বাস (রা) পর্যন্ত বিশুদ্ধ এবং মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ। ইমাম নাসাঈ আবু কুরায়বের সূত্রে আবু মুআবিয়া থেকেও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইব্ন জারীর মুসলিম ইব্ন জানাদার সূত্রে আবু মুআবিয়া থেকে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়া আরও অনেক গ্রন্থকার এ হাদীস স্ব-স্ব কিতাবে উল্লেখ করেছেন। এ হাদীসটি সবচেয়ে দীর্ঘায়িতভাবে বর্ণনা করেছেন মুহাম্মদ ইব্ন। ইসহাক। তাঁর বর্ণনায় এসেছে, ঈসা (আঃ) আল্লাহর নিকট তাঁর মৃত্যুকে পিছিয়ে দেয়ার জন্যে দোয়া করতেন, যাতে তিনি রিসালাতের দায়িত্ব পূর্ণ করতে পারেন। দাওয়াতী কাজ সম্প্রসারণ করতে পারেন এবং অধিক পরিমাণ লোক যাতে আল্লাহর দীনে প্রবেশ করতে পারে। কথিত আছে, হযরত ঈসা (আ)-এর সান্নিধ্যে বারজন হাওয়ারী ছিলেন; (১) পিতর, (২) ইয়াকুব ইব্ন যাবদা (সিবদিয়), (৩) ইয়াহনাস (যুহান্না) ইনি ইয়াকুবের ভাই ছিলেন (৪) ইনদারাউস (আন্দ্ৰিয়), (৫) ফিলিপ, (৬) আবরো ছালমা (বর্তলময়), (৭) মথি, (৮) টমাস (থিম), (৯) ইয়াকুব ইব্ন হালকুব (আলকেয়), (১০) তাদাউস (থদেয়), (১১) ফাতাতিয়া শিমন ও (১২) (ইয়াহুদা ইস্কারিযোৎ) ইউদাস কারিয়া ইউতা ঈ- এই শেষোক্ত ব্যক্তি ইয়াহুদীদেরকে ঈসা। (আ)-এর সন্ধান দিয়েছিল। ইব্ন ইসহাক লিখেছেন, হাওয়ারীদের মধ্যে সারজিস নামক আর এক ব্যক্তি ছিল যার কথা নাসারারা গােপন রাখে। এই ব্যক্তিকেই মাসীহর রূপ দেয়া হয়েছিল। এবং ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু নাসারাদের কিছু অংশের মতে যাকে মাসীহর রূপ দেয়া হয় ও ক্রুশে বিদ্ধ করা হয়, তার নাম জাভাস ইব্ন কারিয়া ইউতা।
যাহহাক… ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আঃ) শামউনকে তার স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন এবং ইয়াহুদীরা জাভাসকে হত্যা করেছিল -যাকে ঈসার অনুরূপ আকৃতি দেয়া হয়েছিল। আহমদ ইব্ন মারওয়ান বলেন, মুহাম্মদ ইব্ন জাহ্ম ফাররা থেকে শুনেছেনকুরআনের আয়াত— তারা চক্রান্ত করেছিল আর আল্লাহও কৌশল অবলম্বল করেছিলেন এবং আল্লাহ কৌশলীদের শ্রেষ্ঠ। এ সম্পর্কে ফারুরা বলেছেন যে, ঈসা (আ) দীর্ঘ দিন তাঁর খালার নিকট থেকে দূরে থাকার পর একদিন খালার বাড়িতে আসেন। তাঁর আগমন দেখে রাস আল জালুত নামক ইয়াহুদী সেখানে উপস্থিত হয় এবং ঈসা (আ)-এর বিরুদ্ধে লোকজনকে জমায়েত করে। ফলে বহু লোক জমায়েত হলো আর তারা দরজা ভেংগে ফেলে এবং রাস আল-জালুত ঈসা (আ)-কে ধরে আনার জন্যে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে। আল্লাহ ঈসা (আ)-কে তার দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখেন। কিছু সময় পর সে বেরিয়ে এসে বলল, ঈসাকে ঘরের মধ্যে দেখতে পেলাম না। রাস আল জালুতের সাথে ছিল নাংগা তলোয়ার। এ দিকে আল্লাহ তাকেই ঈসার রূপে রূপান্তরিত করে দিয়েছিলেন। উপস্থিত সবাই বলল, তুমি-ই তো ঈসা। সুতরাং তারা তাকে ধরে হত্যা করল ও শূলে বিদ্ধ করল। এদিকে ইংগিত করেই আল্লাহ বলেছেন: তারা তাকে হত্যা করেনি, ক্রুশবিদ্ধও করেনি; কিন্তু তাদের এইরূপ বিভ্রম হয়েছিল। ইব্ন জারীর … ওহাব ইব্ন মুনাববিহ থেকে বর্ণনা করেন যে, ঈসা (আ) সতের জন হাওয়ারী সহ এক ঘরে প্রবেশ করেন। এ অবস্থা তাদেরকে ঘেরাও করে ফেলে। যখন তারা দেখে ইয়াহুদীরা ঘরের ভেতর প্রবেশ করে তখন আল্লাহ তাদের সকলের চেহারাকে ঈসা (আ)-এর চেহারার মত করে দেন। এ দেখে বনী ইসরাঈলরা বলল, তোমরা সবাই যাদু করে আমাদেরকে ধোকা দিচ্ছি। হয় আসল ঈসাকে আমাদের নিকট বের করে দাও, নচেৎ তোমাদের সবাইকে হত্যা করব। তখন ঈসা (আ) সাখীদেরকে বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আছ, যে নিজের প্রাণের বিনিময়ে আজ জান্নাত ক্ৰয় করবে। এক ব্যক্তি বললেন, আমি রাজি আছি। এরপর সে ব্যক্তি বনী-ইসরাঈলদের সম্মুখে এসে বললেন, আমিই ঈসা। বস্তৃত ঐ ব্যক্তিকে আল্লাহ ঈসা। (আ)-এর আকৃতি দান করেছিলেন। তখন তারা তাকে ধরে হত্যা করল ও ক্রুশবিদ্ধ করল। এ জন্যই বনী-ইসরাঈলরা বিভ্রান্ত হয় ও ধারণা করে যে, তারা ঈসা (আ)-কেই হত্যা করেছে। অন্যান্য খ্ৰীষ্টানরাও এই একই ধারণা পোষণ করে এবং বলে ঈসাকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ ঐ দিনই আল্লাহ ঈসা (আ)-কে আসমানে তুলে নিয়েছিলেন।
টীকাঃ বন্ধনীযুক্ত নামগুলো বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটির প্রকাশিত ইনজীল শরীফ থেকে গৃহীত।
ইব্ন জারীর … ওহব থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ যখন ঈসা (আঃ)-কে জানিয়ে দেন যে, অচিরেই তুমি দুনিয়া থেকে নিস্কৃতি পোচ্ছ তখন তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হন। এ সময় তিনি হাওয়ারীগণকে দাওয়াত করেন। তাদের জন্যে খাদ্য প্রস্তুত করেন। তাদেরকে জানিয়ে দেন যে, রাত্রে তোমরা আমার নিকট আসবে, তোমাদের কাছে আমার প্রয়োজন আছে। হাওয়ারীগণ রাত্রে আসলে ঈসা (আ) তাদেরকে নিজ হাতে খানা পরিবেশন করে খাওয়ান। আহার শেষে নিজেই তাদের হাত ধুয়ে দেন ও নিজের কাপড় দ্বারা তাদের হাত মুছে দেন। এ সব দেখে হাওয়ারীগণ আশ্চর্যান্বিত হলেন এবং বিব্রত বোধ করলেন। ঈসা (আ) বললেন, দেখ, আমি যা কিছু করব কেউ যদি তার প্রতিবাদ করে তবে সে আমার শিষ্যদের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং আমিও তার কেউ নই। তখন তারা তা মেনে নিলেন।
আর ঈসা (আ) বললেন, আমি আজ রাত্রে তোমাদের সাথে যে আচরণ করলাম, তোমাদের আদর্শ হয়ে থাকে। তোমরা জান যে, আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম। সুতরাং তোমরা একে অপরের উপর নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করবে না;। বরং নিজেকে অপরের চাইতে ছোট জ্ঞান
করলাম। তোমরাও ঠিক এই ভাবে করবে। আর তোমাদের কাছে আমার যে প্রয়োজন তা হল, তোমরা আমাকে সাহায্য করবে, আমার জন্যে আল্লাহর নিকট দোয়া করবে এবং মনে প্ৰাণে দোয়া করবে যেন তিনি আমার মৃত্যকে পিিছয়ে দেন। ঈসা (আঃ)-এর কথা শোনার পর হাওয়ারীগণ যখন দোয়া করার জন্যে প্রস্তুত হলেন এবং নিবিষ্ট চিত্তে দোয়া করতে বসলেন, তখন গভীর নিদ্ৰা তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। ফলে তারা দোয়া করতে সমর্থ হলেন না। ঈসা (আঃ) তাদেরকে ঘুম থেকে জাগাবার চেষ্টা করেন এবং বলেন, কী আশ্চর্য, তোমরা কি মাত্র একটা রাত আমার জন্যে ধৈর্যধারণ করতে ও আমাকে সাহায্য করতে পারবে না? তাঁরা বললেন, আল্লাহর কসম, আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না যে, আমাদের এ কী হল? আমরা তো প্রতি দিন রাত্রে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত জেগে থাকি, কথাবার্তা বলি; কিন্তু আজ রাত্রে তার কিছুই করতে পারছি না। যখনই দোয়া করতে যাই তখনই ঘুম এসে মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তখন হযরত ঈসা (আ) বললেন, রাখাল মাঠ থেকে বিদায় নিচ্ছে আর বকরীগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। এ জাতীয় আরও বিভিন্ন কথা তিনি বলতে থাকেন এবং নিজের বিয়োগ ব্যথার কথা ব্যক্তি করেন।
অতঃপর ঈসা (আ) বললেন : আমি তোমাদেরকে একটি সত্য কথা বলছি- তোমাদের মধ্যে একজন আজ মোরগ ডাক দেয়ার পূর্বে আমার সাথে তিনবার বিশ্বাসঘাতকতা করবে, তোমাদের মধ্যে একজন সামান্য কয়েকটি দিরহামের বিনিময়ে শক্ৰদের কাছে আমার সন্ধান বলে দেবে এবং আমার বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ ভক্ষণ করবে। এরপর তারা সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ল ও বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল। এদিকে ইয়াহুদীরা ঈসা (আ)-কে সন্ধান করে ফিরছে। তারা শামউন নামক এক হাওয়ারীকে ধরে বলল, এই ব্যক্তি ঈসার শিষ্য। কিন্তু সে অস্বীকার করে। বলল, আমি ঈসার শিষ্য নই। এ কথা বললে, তারা শামউনকে ছেড়ে দিল। কিছুক্ষণ পরে তাকে অন্য ইয়াহুদীরা পাকড়াও করলে সে পূর্বের ন্যায় উত্তর দিয়ে আত্মরক্ষা করল। এমন সময়। ঈসা হঠাৎ মোরগের ডাক শুনতে পান। মোরগের ডাক শুনে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং কাঁদতে থাকেন। প্রভাত হওয়ার পর জনৈক হাওয়ারী ইয়াহুদীদের নিকট গিয়ে বলল, আমি যদি তোমাদেরকে ঈসা মাসীহর সন্ধান দিই, তা হলে তোমরা আমাকে কী পুরস্কার দিবে? ইয়াহুদীরা তাকে ত্রিশটি দিরহাম দিল, বিনিময়ে সে তাদের নিকট তাঁর সন্ধান বলে দিল। কিন্তু এর পূর্বেই তাকে ঈসার অনুরূপ চেহারা দান করা হয় এবং তাদেরকে বিভ্রান্তিতে ফেলা হয়। ফলে তাকেই তারা পাকড়াও করে রশি দ্বারা শক্ত করে বাঁধল এবং একথা বলতে বলতে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে গেল যে, তুমিই তো মৃতকে জীবিত করতে, জীন-ভূত তাড়াতে, পাগল মানুষকে সুস্থ করে দিতে। এখন এই রশির বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করা দেখি! তারা তার উপর থুথু নিক্ষেপ করল, দেহে কাটা ফুটাল এবং যেই ক্রুশে বিদ্ধ করার জন্যে স্থাপন করা হয়েছিল, সেখানে তাকে নিয়ে আসল।
ইতিমধ্যে ঈসা (আ)-কে আল্লাহ নিজ সান্নিধ্যে তুলে নিয়েছেন এবং ইয়াহুদীরা ঐ চেহারা পরিবর্তিত ব্যক্তিকে ক্রুশবিদ্ধ করল। ক্রুশের উপরে লাশ সাত দিন পর্যন্ত ছিল। এরপর ঈসা। (আ)-এর মা এবং অন্য এক মহিলা যে পাগল ছিল এবং যাকে ঈসা (আঃ) সুস্থ করেছিলেন উভয়ে কাঁদতে কাঁদতে ক্রুশবিদ্ধ লোকটির কাছে আসলেন। তখন হযরত ঈসা (আ)-তাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কাঁদছেন কেন? তারা বললেন, আমরা তো তোমার জন্যে কাদছি। ঈসা (আ) বললেন, আমাকে আল্লাহ তাঁর সান্নিধ্যে তুলে নিয়েছেন এবং উত্তম অবস্থায় রেখেছেন; আর এই যাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে তার ব্যাপারে ইয়াহুদীরা বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে। অতঃপর তিনি হাওয়ারীদের প্রতি নির্দেশ দিলেন যেন, অমুক স্থানে তারা তার সাথে সাক্ষাত করেন। নির্দেশ মতে এগারজন হাওয়ারী তথায় গিয়ে তার সাথে সাক্ষাতে মিলিত হন। সেই এক হাওয়ারী অনুপস্থিত থাকে, যে ঈসাকে দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করেছিল এবং ইয়াহুদীদেরকে তাঁর সন্ধান বলে দিয়েছিল; তার সম্পর্কে ঈসা (আ) শিষ্যদের নিকট জিজ্ঞেস করলেন। উত্তরে তারা জানাল যে, সে তার কর্মের উপর অনুতপ্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছে। ঈসা। (আ) বললেন, যদি সে তওবা করত। তবে আল্লাহ তার তওবা কবুল করতেন। অতঃপর তিনি ইয়াহয়া নামক সেই যুবকের কথা জিজ্ঞেস করলেন, যে তাদেরকে অনুসরণ করত। তিনি জানালেন, সে তোমাদের সাথেই আছে। এরপর ঈসা (আ) বললেন, তোমরা এখান থেকে চলে যাও; কেননা, অচিরেই তোমরা নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ভাষায় কথা বলবে। সুতরাং তাদেরকে সতর্ক করবে এবং দীনের দাওয়াত দেবে।
এই হাদীসের সনদ গরীব ও অভিনব। তবে নাসারাদের বর্ণনা সমূহের মধ্যে এটা অনেকটা বিশুদ্ধ। তারা বলেছে, মসীহ মারিয়ামের নিকট এসেছিলেন। মারিয়াম খেজুর গাছের শাখার কাছে বসে কাদছিলেন। ঈসা (আঃ) তাকে দেহের ক্ষত-বিক্ষত স্থানগুলো দেখান এবং মারিয়ামকে জানান যে, তার রূহকে উপরে তুলে নেয়া হয়েছে এবং দেহকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে। নাসারাদের বর্ণিত এ ঘটনা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, মনগড়া, অতিরঞ্জিত ও বাতিল। সত্যের পরিপন্থী ও অতিরিক্ত সংযোজন।
ইব্ন আসাকির ইয়াহয়া ইব্ন হাবীবের সূত্রে বর্ণনা করেন যে, যে ব্যক্তিকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল, মারিয়াম ধারণা করেছিলেন যে, সে তাঁরই পুত্র। তাই তিনি ঘটনার সাত দিন পর
সাড়া দেয় এবং সেখানেই লাশটি দাফন করা হয়। তারপর মারিয়াম ইয়াহয়ার মাকে বললেন, চল, আমরা মাসীহর কবর যিয়ারত করে আসি। উভয়ে রওয়ানা হলেন। কবরের কাছাকাছি পৌঁছলে মারিয়াম ইয়াহয়ার মাকে বললেন, পর্দা কর! ইয়াহয়ার মা বললেন, কার থেকে পর্দা করব? বললেন : কেন কবরের কাছে ঐ যে লোকটিকে দেখা যায়, তার থেকে! ইয়াহয়ার মা বললেন, কী বলছি? আমি তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না! মারিয়াম তখন ভাবলেন, ইনি জিবরাঈল ফিরিশতা হবেন। বস্তৃত জিবরাঈলকে তিনি বহু পূর্বে দেখেছিলেন।
যা হোক, ইয়াহয়ার মাকে সেখানে রেখে মারিয়াম কবরের কাছে গেলেন। কবরের নিকট গেলে তিনি তাকে চিনতে পান। আর জিবরাঈল বললেন, মারিয়াম! কোথায় যোচ্ছ? মারিয়াম বললেন, মাসীহর কবর যিয়ারত করতে এবং তাকে সালাম জানাতে। জিবরাঈল বললেন, মারিয়াম! এ তো মাসীহ নয়। তাঁকে তো আল্লাহ তার সান্নিধ্যে তুলে নিয়েছেন, কাফিরদের হাত থেকে তাঁকে পবিত্র করেছেন। তবে কবরবাসীকে মসীহর আকৃতি বদলে দেয়া হয়েছে এবং তাকেই, ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে। এর নিদর্শন হচ্ছে এটা যে, ঐ লোকটির পরিবারের লোকজন একে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কোথাও তার সন্ধান পাচ্ছে না এবং তার কি হয়েছে তাও তারা জানে না; এর জন্যে তারা কেবল কান্নাকাটি করে ফিরছে। তুমি অমুক দিন অমুক বাগানের নিকট আসলে মাসীহর সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে; এ কথা বলে জিবরাঈল সেখান থেকে প্রস্থান করেন।
মারিয়াম তার বোনের নিকট ফিরে এসে জিবরাঈলের ব্যাপারে জানালেন এবং বাগানের বিষয়টিও বললেন। নির্দিষ্ট দিনে মারিয়াম সেই বাগানের নিকট গেলে সেখানে মাসীহকে দেখতে পান। ঈসা (আ) মাকে দেখতে পেয়ে তার দিকে ছুটে আসেন, মা তাকে জড়িয়ে ধরেন, এবং তার মাথায় চুম্বন দেন। তিনি পূর্বের মত তাঁর জন্যে দোয়া করেন। তারপর বলেন, মা! আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা আমাকে হত্যা করতে পারেনি, আল্লাহ আমাকে তার সান্নিধ্যে তুলে নিয়েছেন এবং আপনার সাথে সাক্ষাত করার অনুমতি দিয়েছেন। অচিরেই আপনার মৃত্যু হবে। ধৈর্য ধরুন ও বেশী বেশী আল্লাহকে স্মরণ করুন। অতঃপর ঈসা উর্ধলোকে চলে গেলেন। এরপর মারিয়ামের সাথে তাঁর মৃত্যুর পূর্বে ঈসার আর সাক্ষাত হয়নি। রাবী বলেন, ঈসা। (আ)-এর উর্ধ্যারোহনের পরে তার মা পাঁচ বছর জীবিত ছিলেন এবং তিল্পান্ন বছর বয়সকালে তিনি ইনতিকাল করেন।
হাসান বসরী (র) বলেছেন, যে দিন হযরত ঈসা (আ)-কে আসমানে নেয়া হয় সে দিন পর্যন্ত তাঁর বয়স হয়েছিল চৌত্ৰিশ বছর। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে জান্নাতবাসীদের চুল ছোট হবে, দীড়ি উদ্ধৃত হয়নি তাঁরা এমন যুবকই হবেন। তাদের চোখে সুরমা লাগান থাকবে ও তারা তেত্রিশ বছরের যুবক হবেন। অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, জান্নাতবাসীরা ঈসা (আ)-এর সমবয়সের হবেন এবং ইউসুফ (আঃ)-এর সৌন্দর্যমণ্ডিত চেহারা লাভ করবেন। হাম্মাদ ইব্ন সালমা … সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিাব থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ)-কে যখন আসমানে তুলে নেয়া হয় তখন তার বয়স ছিল তেত্ৰিশ বছর।
হাকিম তাঁর মুসতাদরাক গ্রন্থে এবং ইয়াকুব ইব্ন সুফিয়ান ফাসাবী তার ইতিহাস গ্রন্থে ইব্ন আবি মারিয়ামের সূত্রে … আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমাকে ফাতিমা (রা) বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে জানিয়েছেন : একজন নবীর পরে যদি আর এক জন নবীর আবির্ভাব হয় তবে পরবর্তী নবীর বয়স পূর্ববতী নবীৱ বয়সের অর্ধেক হয়। নবী (সা) আমাকে আরও বলেছেন যে, ঈসা ইব্ন মারিয়াম একশ বিশ ৰছর জীবিত ছিলেন। সুতরাং আমি দেখছি, ষাট বছরের মাথায় আমার মৃত্যু হবে। ফাসাবীর বর্ণিত এ হাদীসের সনদ গরীব পর্যায়ের।
ইব্ন আসাকির বলেন, বিশুদ্ধ মত এই যে, ঈসা (আ) ঐ পরিমাণ বয়স পাননি। এর দ্বারা তাঁর উম্মতের মধ্যে তাঁর অবস্থানকাল বুঝােনই উদ্দেশ্য। যেমন সুফিয়ান ইব্ন উয়ায়না .. ইয়াহিয়া ইব্ন জাদা থেকে বর্ণনা করেন, হযরত ফাতিমা (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা) আমাকে জানিয়েছেন : ঈসা ইব্ন মারিয়াম বনী ইসরাঈলের মধ্যে চল্লিশ বছর অবস্থান করেছিলেন। এ হাদীসের সনদ বিচ্ছিন্ন। জারীর ও ছাওরী আমাশের মাধ্যমে ইবরাহীম থেকে বর্ণনা করেন : ঈসা (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্যে চল্লিশ বছর অবস্থান করেছিলেন। আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত ৪ হযরত ঈসা (আঃ)-কে রমযান মাসের বাইশ তারিখের রাত্রে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়। হযরত আলী (রা)-ও শক্ৰদের বর্শার আঘাত পাওয়ার পাঁচ দিন পর রমযানের বাইশ তারিখ রাত্রে ইনতিকাল করেন।
যাহহাক (র) ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, ঈসা (আ)-কে যখন আসমানে তুলে নেয়া হয় তখন এক খণ্ড মেঘ তার নিকটবতী হয়। তিনি এর উপর বসেন। মা মারিয়াম সেখানে উপস্থিত হন। পুত্রকে বিদায় জানান ও কান্নাকাটি করেন। তারপরে তাকে তুলে নেয়া হয়। মারিয়াম তাকিয়ে সে দৃশ্য দেখতে থাকেন। উর্ধে উঠার সময় ঈসা (আঃ) তার মাকে নিজের চাদরখানা দিয়ে যান এবং বলেন, এইটি হবে কিয়ামতের দিনে আমার ও আপনার মধ্যে পরিচয়ের উপায়। শিষ্য শামউনের উদ্দেশ্যে তিনি নিজের পাগড়ীটি নিক্ষেপ করেন। ঈসা যখন উপরের দিকে উঠতে থাকেন তখন মা মারিয়াম হাতের আঙ্গুল উঠিয়ে ইংগিতে তাকে বিদায় জানাতে থাকেন। যতক্ষণ না তিনি চোখের আড়ালে চলে যান। মারিয়াম ঈসাকে অত্যধিক স্নেহ করতেন। কেননা, পিতা না থাকার কারণে ঈসা পিতামাতা উভয়ের ভালবাসা মাকেই দিতেন। সফরে হোক কিংবা বাড়িতে হোক মারয়াম ঈসাকে সর্বদা কাছে রাখতেন, মুহুর্তের জন্যেও দূরে যেতে দিতেন না। জনৈক কবি বলেছেন :
এক মুহুর্তের বিরহ যেখানে আমার নিকট মৃত্যু যন্ত্রণার ন্যায় কঠিন, সেখানে রোজ হাশর পর্যন্ত দীর্ঘ বিরহ ব্যথা আমি কিভাবে সইব?
ইসহাক ইব্ন বিশর মুজাহিদ ইব্ন জুবায়র (র) সূত্রে বর্ণনা করেন, ইয়াহুদীরা মসীহরূপী যেই ব্যক্তিকে ক্রুশবিদ্ধ করেছিল তাকে তারা আসল মসীহ বলেই বিশ্বাস করত। অধিকাংশ নাসারা মূর্খতাবশত এই বিশ্বাসেরই সমর্থক ছিল। এরপর তারা মাসীহর শিষ্য সমর্থকদের উপর ধর-পাকড়, হত্যা ও নির্যাতন আরম্ভ করে। এ সংবাদ রোম অধিপতি ও তদানিন্তন দামিশকের বাদশাহর নিকট পৌঁছে। বাদশাহকে জানান হয় যে, ইয়াহুদীরা এমন এক ব্যক্তির শিষ্য সমর্থকদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে, যে ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর রাসূল বলে দাবী করে, সে মৃত্যকে জীবিত করে, জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে নিরাময় করে এবং আরো অনেক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটায়। ইয়াহুদীরা তার উপর চড়াও হয় এবং তাকে হত্যা করে। তাঁর শিষ্য ও অনুসারীদেরকে লাঞ্ছিত করে ও বন্দী করে রাখে। এ সব কথা শুনে বাদশাহ উক্ত নবীর কতিপয় অনুসারীকে তাঁর নিকট আনার জন্যে দূত প্রেরণ করেন।
বাদশাহর দূত কয়েকজন অনুসারীকে সেখানে নিয়ে আসে। এদের মধ্যে ইয়াহয়া ইব্ন যাকারিয়্যা এবং শামউন সহ বেশ কিছুলোক ছিলেন। বাদশাহ তাদের নিকট মাসীহর কার্যাবলী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা বিস্তারিতভাবে মাসীহর কাজকর্ম সম্পর্কে বাদশাহকে অবগত করেন। সবকিছু শুনে বাদশাহ তাদের নিকট মাসীহর দীন গ্রহণ করেন। তাদের দীনের দাওয়াতের প্রসার ঘটান। এভাবে ইয়াহুদীদের উপরে সত্য বিজয় লাভ করে এবং নাসারাদের বাণী তাদের উপর শ্রেষ্ঠত্বের সম্মানে ভূষিত হয়। অতঃপর বাদশাহ ক্রুশবিদ্ধ লাশের কাছে লোক প্রেরণ করেন। শূল কাষ্ঠ থেকে লাশ নামান হয় এবং ক্রুশ-ফলকটি নিয়ে আসা হয়। বাদশাহ ক্রুশ ফলককে সম্মান প্রদর্শন করেন। তখন থেকে নাসারা সম্প্রদায় ক্রুশচিহ্নকে সম্মান করতে শুরু করে। এ ঘটনার পর থেকে নাসারা (খ্ৰীষ্টান) ধর্ম রোম সাম্রাজ্যে প্রসার লাভ করে। কিন্তু কয়েকটি কারণে এই বর্ণনাটি সংশয়মুক্ত নয়। এক? ইয়াহিয়া ইব্ন যাকারিয়্যা (আ) নবী ছিলেন। ঈসা (আ)-কে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে, এ কথা তিনি স্বীকার করতেন না। কেননা তিনি ছিলেন মাসুম নবী। ঈসা (আঃ)-কে নিরাপদ হেফাজতে নেয়া হয়েছে এই সত্যে তিনি বিশ্বাস করতেন। দুই : মাসীহর আগমনের তিনশ বছর পর রোম সাম্রাজ্যে খৃষ্টান ধর্ম প্রবেশ করে, তার পূর্বে নয়। এটাই ঐতিহাসিক সত্য। কেননা রোমে খ্ৰীষ্টান ধর্ম প্রবেশ করেছিল কুসতুনতীন ইব্ন কুসতুন-এর শাসনামলে, যিনি ছিলেন কনষ্টানটিনোপল তথা ইস্তাম্বুল শহরের প্রতিষ্ঠাতা। এ বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করব। তিন : ইয়াহুদীরা ঐ ব্যক্তিকে শূলে চড়ানোর পর সেই স্থানটিকে একটি ঘৃণিত স্থান হিসেবে ফেলে রাখে। সেখানে তারা ময়লা-আবর্জনা ও মৃত জীবজন্তু নিক্ষেপ করত। সম্রাট কনস্টানটাইনের আমল পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে।
অতঃপর সম্রাট কনস্টানটাইনে মা হায়লানা আল হারানিয়া আল-ফুনদুকানিয়া উক্ত ক্রুশবিদ্ধ লোকটিকে মাসীহ বলে বিশ্বাস করেন এবং সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করেন। তিনি সেখানে লোক প্রেরণ করেন। তারা ক্রুশের শূল দণ্ডটি খুঁজে পায়। কথিত আছে, উক্ত শূলদণ্ড যেই কোন রোগী স্পর্শ করলে আরোগ্য লাভ করত। আল্লাহই ভাল জানেন ঘটনা এই রকম হয়েছিল। কিনা? কেননা যেই ব্যক্তি শূলে জীবন দিয়ে আত্মোৎসর্গ করেছিল। সে একজন নেককার লোক ছিল। অথবা হতে পারে এটা সেই যুগের খ্ৰীষ্টদের জন্যে একটি ফিৎনা বিশেষ। যে কারণে তারা উক্ত দণ্ডকে সম্মান করত এবং স্বর্ণ ও মুক্তা দ্বারা তাকে মুড়িয়ে রেখেছিল। এখান থেকে তারা বরকত ও কল্যাণের প্রতীক হিসেবে ক্রুশটিক ব্যবহার করা আরম্ভ করে।
এরপর সম্রাটের মা হায়লানার নির্দেশে ঐ স্থানের সমস্ত আবর্জনা পরিষ্কার করে যেখানে উন্নত মানের পাথর দ্বারা একটি সুশোভিত গীর্জা নির্মাণ করা হয়। বর্তমান কালে যা বায়তুল মুকাদদাস শহর নামে খ্যাত। এই শহরটির অপর নাম কুমামা (কুমামা অর্থ আবর্জনা, যেহেতু পূর্বে এখানে আবর্জনা ছিল)। খৃষ্টানরা একে কিয়ামাহও বলে। কেননা, কিয়ামতের দিন এই স্থান থেকে মাসীহর দেহ পুনরুখিত হবে বলে তাদের বিশ্বাস। সম্রাট জননী হায়লানা অতঃপর নির্দেশ দেন যে, এখন থেকে এই শহরের সমস্ত ময়লা আবর্জনা ও পচা-গলা ইয়াহুদীদের কিবলা হিসেবে পরিচিত বায়তুল মুকাদাসে অবস্থিত শুভ্ৰ পাথর (সাখরা)-এর উপর ফেলতে হবে। নির্দেশ মতে সমস্ত আবর্জনা সেখানেই নিক্ষেপ করা অব্যাহত থাকে। অবশেষে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করেন। তিনি স্বয়ং সেখানে গমন করে নিজের চাদর দ্বারা বায়তুল মুকাদ্দাস ঝাড়ু দেন এবং সকল নাপাকী ও ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করেন। অবশ্য তিনি ইয়াহুদীদের কিবলা হিসেবে রক্ষিত পাথরের পেছনে মসজিদের প্রতিষ্ঠা করেন নি। বরং তার সামনের দিকে রেখেছেন— যেখানে রাসূল (সা) ইসরার রাত্রে নবীদের সাথে সালাত আদায় করেছিলেন।
ঈসা (আ)-এর গুণাবলী স্বভাব-চরিত্র ও মাহাত্ম্য আল্লাহর বাণী : ما المسيح ابن مريم الأرسول. قد خلّت من قبله الرسل، وأمئة صديقة. মারিয়াম-তনয় মসীহ তো কেবল একজন রাসূল, তার পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে এবং তার মা সত্যনিষ্ঠ ছিল। (৫ মায়িদাঃ ৭৫)
মাসীহ্, অর্থ অত্যধিক ভ্ৰমণকারী। ঈসা (আ)-এর প্রতি ইয়াহুদীদের কঠোর শক্ৰতা, মিথ্যা আরোপ এবং তাঁর উপর ও তাঁর মায়ের উপর অপবাদ দেওয়ার কারণে সৃষ্ট ফিৎনা ফসাদ থেকে দীনকে রক্ষার জন্যে তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় সফরে কাটান। এই কারণে তাকে মাসীহ বলে আখ্যায়িত করা হয়। কেউ কেউ বলেন, তার পায়ের তলা সমতল থাকার কারণে হযরত ঈসা (আ)-কে মাসীহ বলা হয়। আল্লাহর বাণী :
অতঃপর আমি তাদের অনুগামী করেছিলাম আমার রাসূলগণকে এবং অনুগামী করেছিলাম মারয়াম তনয় ঈসাকে আর তাকে দিয়েছিলাম ইনজীল। (৫৭ হাদীদ : ২৭)
আল্লাহর বাণী
এবং মারিয়াম-তনয় ঈসাকে স্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছি, এবং পবিত্র আত্মা দ্বারা তাকে শক্তিশালী করেছি। (২ বাকারা ৪ ৮৭)
এ সম্পর্কে কুরআনে প্রচুর আয়াত বিদ্যমান } ইতিপূর্বে বুখারী ও মুসলিমে হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, এমন কোন শিশু সন্তান নেই, যাকে জন্মের সময় শয়তান পেটের পার্শ্বদেশে খোঁচা না দেয়। জন্মের সময় শয়তানের খোচার কারণেই সে চিৎকার করে কাদে। তবে মারিয়াম ও তাঁর পুত্র ঈসা (আ)-এর ব্যতিক্রম। শয়তান তাঁকে খোচা মারতে গিয়েছিল। কিন্তু তা না পেরে ঘরের পর্দায় খোচা মেরে চলে যায়। উবাদা থেকে উমোয়র ইব্ন হানীর বর্ণিত হাদীস ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুলাহ্ (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। তিনি একক তার কোন শরীক নেই, আর মুহাম্মদ (সা) তার বান্দা ও রাসূল। আর ঈসা আল্লাহর বান্দা, তার রাসুল এবং তার কলেমা যা তিনি মারয়াম-এর নিকট প্রেরণ করেছিলেন এবং তার পক্ষ থেকে প্রেরিত রূহ। (আরও সাক্ষ্য দিবে যে, ) জান্নাত সত্য ও জাহান্নাম সত্য, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্ৰবেশ করাবেন, তার অন্য আমল যা-ই হোক না। কেন। বুখারী ও মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, তবে এ পাঠটি বুখারী ও মুসলিমে শাবী আবু বুরদা, আবু মূসা আশআরী (রা) থেকে বর্ণিত।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন যদি কোন লোক তার দাসীকে আদব-কায়দা শেখায় এবং তা ভালভাবে শেখায় এবং তাকে ইলম শেখায় আর তা উত্তমভাবে শেখায় তারপর তাকে অযাদি। করে দেয় এবং পরে তাকে বিয়ে করে নেয়। তবে সে দুটি প্রতিদান পাবে। আর যদি কেউ ঈসা। (আ)-এর প্রতি ঈমান রাখে। অতঃপর আমার প্রতিও ঈমান আনে, তার জন্যেও দুটি পুরস্কার। আর গোলাম যদি তার প্রতিপালককে ভয় করে এবং দুনিয়ার মুনিবাদেরকেও মেনে চলে। তবে সেও পাবে দুটি পুরস্কার। এ পাঠ বুখারীর।
ইমাম বুখারী (র) ইবরাহীম ইব্ন মূসার সূত্ৰে…… আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা) বলেছেনঃ যে রাতে আমার মিরাজ হয়েছিল, সে রাতে মূসার সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছিল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ তার বর্ননা দিয়ে বলেন, তিনি ছিলেন দীর্ঘ দেহী ব্যক্তি, তার চুল কোঁকড়ান ছিল। মনে হচ্ছিল, তিনি যেন ইয়ামান দেশীয় শানুয়া গোত্রের লোক। তিনি বলেন, ঈসার সাথেও আমার সাক্ষাত হয়েছিল। অতঃপর তিনি তার বর্ণনা দিয়ে বলেন : তিনি ছিলেন মধ্যম দেহী ও গৌরবর্ণের। যেন তিনি এই মাত্ৰ হাম্মামখানা থেকে বের হয়েছেন। ঐ রাতে আমি ইবরাহীমকেও দেখতে পেয়েছি। আর তাঁর বংশধরদের মধ্যে তার সাথে আমার চেহারার মিল সবচাইতে বেশী। ইবরাহীম ও মূসা (আ)-এর বর্ণনায় আমরা এ হাদীসখানা উল্লেখ করেছি। ইমাম বুখারী মুহাম্মদ ইব্ন কাহীর সূত্রে……. ইব্ন উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ মিরাজের রাতে আমি ঈসা, মূসা ও ইবরাহীমকে দেখতে পেয়েছি। ঈসা গৌর বর্ণ, কোঁকড়ানো চুল এবং প্রশস্ত বক্ষ বিশিষ্ট লোক, মূসা বাদামী রং বিশিষ্ট, তার দেহ সুঠাম এবং মাথার চুল কোঁকড়ান, যেন জািঠ গোত্রের লোক। এ হাদীসটি কেবল বুখারীতেই আছে।
ইমাম বুখারী (র) ইবরাহীম ইব্ন মুনযিরের সূত্রে……. আব্দুল্লাহ ইব্ন উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন, একদা নবী করীম (সা) লোকজনের সামনে মাসীহ দাজ্জালের কথা উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন, আল্লাহ একচক্ষু বিশিষ্ট নন। শুনে রেখো, মাসীহ দাজ্জালের ডান চোখ কানা। তার চোখ যেন ফুলে যাওয়া আংগুরের মত ভাসাভাসা। আমি এক রাতে স্বপ্নে আমাকে কাবার কাছে দেখলাম। হঠাৎ সেখানে বাদামী রং-এর এক ব্যক্তিকে দেখলাম। তোমরা যেমন সুন্দর বাদামী রঙের লোক দেখে থাক তার চাইতেও বেশী সুন্দর ছিলেন তিনি। তার মাথার সোজা চুলগুলো তাঁর দুকাঁধ পর্যন্ত বুলিছিল। তার মাথা থেকে ফোটা ফোঁটা পানি ঝরে পড়ছিল। তিনি দুজন লোকের কাধে হাত রেখে কাবা শরীফ তাওয়াফ করছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? তারা জবাব দিল, ইনি হলেন মাসীহ ইব্ন মারিয়াম। তারপর তার পেছনে আর একজন লোক দেখলাম। তার মাথার চুল ছিল বেশী কোঁকড়ান, ডান চোখ কানা। আকৃতিতে সে আমার দেখা লোকদের মধ্যে ইব্ন কাতানের সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ। সে একজন লোকের দুকাঁধে ভর করে কাবার চারদিকে ঘুরছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই লোকটি কে? তারা বলল, এ হল মাসীহ দাজ্জাল। ইমাম মুসলিম এ হাদীসখানা মূসা ইব্ন উকবার সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বুখারী বলেন, আবদুল্লাহ ইব্ন নাফিও এ হাদীস অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। অতঃপর তিনি যুহরী থেকে বর্ণনা করেন, ইব্ন কাতান খুজাআ গোত্রের লোক, জাহিলী যুগে তাঁর মৃত্যু হয়। এ হাদীসে রাসূল (সা) হিদায়েতকারী মাসীহ ও গোমরাহকারী মাসীহর মধ্যে পার্থক্য বলে দিয়েছেন। যাতে ঈসা মাসীহ পুনরায় আগমন করলে মুমিনগণ তার উপর ঈমান আনতে ও মাসীহ দাজ্জাল থেকে সতর্ক হতে পারেন। ইমাম বুখারী আবদুল্লাহ ইব্ন মুহাম্মাদের সূত্ৰে…… আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ ঈসা (আ) এক ব্যক্তিকে চুরি করতে দেখে তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি চুরি করেছ? সে বলল, কখনও নয়। সেই সত্তার কসম, যিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। তখন ঈসা (আ) বললেন, আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলাম ও আমার দু চোখকে অবিশ্বাস করলাম। আবদুর রাজ্জাক (র) থেকেও অনুরূপ হাদীস মুহাম্মাদ ইব্ন রাফি বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ আফফানের সূত্ৰে……. আবু হুরায়রা (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেন।
এ হাদীস থেকে হযরত ঈসা (আঃ)-এর পবিত্র ও বলিষ্ঠ চরিত্র ফুটে উঠেছে। যখন লোকটি আল্লাহর কসম বলল, তখন তিনি মনে করলেন যে, কোন ব্যক্তি আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম খেতে পারে না, বরং নিজের চোখে দেখা বিষয়কে আগ্রাহ্য করে তার ওযরই গ্ৰহণ করলেন। তিনি বললেন, আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনছি। অর্থাৎ তোমার কসমের জন্যে তোমার কথা।
সত্য বলে মেনে নিচ্ছি এবং আমার চোখকে অবিশ্বাস করছি। ইমাম বুখারী (র) ……. ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, তোমরা হাশরের মাঠে খালি পা, নগ্ন দেহ এবং খ্যাতনা বিহীন অবস্থায় সমবেত হবে। তারপর তিনি এ আয়াত পাঠ করলেন, যেভাবে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছি, ঠিক তেমনিভাবে দ্বিতীয় বারও করবো। এটা আমার ওয়াদা। আমি তা অবশ্যই পূর্ণ করবো। (২১ আম্বিয়া : ১০৪)
হাশরের দিন সর্বপ্রথম র্যাকে কাপড় পরানো হবে, তিনি হলেন ইবরাহীম (আ)। তারপর আমার অনুসারীদের কিছু সংখ্যককে ডান দিকে জান্নাতে এবং কিছু সংখ্যককে বাম দিকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন আমি বলব, এরা তো আমার লোক। তখন বলা হবে, আপনি তাদের থেকে বিদায় নেয়ার পর থেকেই তারা পিছটান দিয়েছে। যেমন বলেছিলেন, পূণ্যবান বান্দা ঈসা ইব্ন মারয়াম। তাঁর উক্তিটি হলো এ আয়াত : আর আমি যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম, ততদিন আমি তাদের উপর সাক্ষী ছিলাম। এরপর আপনি যখন আমাকে উঠিয়ে নিলেন তখন আপনিই তাদের হেফাজতকারী ছিলেন। আর আপনি তো সব কিছুর উপর সাক্ষী। যদি আপনি তাদেরকে আযাব দিতে চান তবে এরা তো আপনারই বান্দা। আর যদি আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন, তবে আপনি নিশ্চয়ই পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়! এ হাদীসটি বর্ণিত সূত্রে কেবল ইমাম বুখারীই বৰ্ণনা করেছেন, ইমাম মুসলিম এ সূত্রে বর্ণনা করেন নি। এ ছাড়াও ইমাম বুখারী হুমায়াদী সূত্রে……. ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি হযরত উমর (রা)-কে মিম্বারের উপর দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছেন, তিনি বলছেন, আমি নবী (সা)-কে বলতে শুনেছি, তোমরা আমার প্রশংসা করতে গিয়ে অতিশয়োক্তি করো না, যেমন ঈসা ইবুন মারিয়াম সম্পর্কে নাসারারা করেছিল। আমি তো আল্লাহর বান্দা মাত্র। সুতরাং তোমরা আমার সম্পর্কে বলবে, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।
ইমাম বুখারী (র) আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। নবী করীম (সা) বলেছেন, তিন জন শিশু ব্যতীত আর কেউ দোলনায় কথা বলেন নি। (১) হযরত ঈসা (২) বনী ইসরাঈলের মধ্যে এক ব্যক্তি ছিল, যাকে জুরাইজ বলে ডাকা হত! একদা সে নামোযরত থাকা অবস্থায় তার মা এসে তাকে ডাকল। সে ভাবল, আমি কি ডাকে সাড়া দিব, না নামাযে নিমগ্ন থাকব। জবাব না পেয়ে তার মা বলল, ইয়া আল্লাহ! ব্যভিচারণীর চেহারা না দেখা পর্যন্ত তুমি একে মৃত্যু দিও না। জুরাইজ তার ইবাদত খানায় থাকতেন। একবার তার কাছে এক মহিলা আসল। সে অসৎ উদ্দেশ্যে তাঁর সাথে কথা বলল। কিন্তু জুরাইজ তাতে রাজী হলেন না। অতঃপর মহিলাটি একজন রাখালের নিকট গেল এবং তাকে দিয়ে মনোবাসনা পূরণ করল। পরে সে একটি পুত্ৰ সন্তান প্রসব করল। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, এটি কার সন্তান? স্ত্রীলোকটি বলল, জুরাইজের। লোকেরা তার কাছে আসল এবং তার ইবাদত খানাটি ভেঙ্গে দিল। আর তাকে নিচে নামিয়ে আনল ও গালিগালাজ করল। তখন জুরাইজ উয়ু করে সালাত আদায় করলেন : এরপর নবজাত শিশুটির নিকট এসে তাকে জিজ্ঞেস করলেন : হে শিশু! তোমার পিতা কে? সে জবাব দিল, অমুক রাখাল আমার পিতা। তখন বনী ইসরাঈলের লোকেরা জুরাইজকে বলল, আমরা আপনার ইবাদতখানাটি সোনা দিয়ে তৈরি করে দিচ্ছি। জুরাইজ বললেন, না, তবে কাদা মাটি দিয়ে তৈরি করে দিতে পোর। (৩) বনী ইসরাঈলের একজন মহিলা তার শিশুকে দুধ পান। করাচ্ছিল। তার কাছ দিয়ে একজন সুদৰ্শন পুরুষ আরোহী চলে গেল। মহিলাটি দোয়া করল, ইয়া আল্লাহ! আমার ছেলেটিকে তার মত বানাও। শিশুটি তখনই তার মায়ের স্তন ছেড়ে দিল এবং আরোহীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ইয়া আল্লাহ! আমাকে তার মত করো না। এরপর মুখ ফিরিয়ে মায়ের দুধ পান করতে লাগল। আবু হুরায়রা (রা) বলেন, আমি যেন নবী করীম (সা)-কে দেখতে পাচ্ছি, তিনি নিজের আংগুল চুষে দেখাচ্ছেন। এরপর সেই মহিলাটির পাশ দিয়ে একটি দাসী চলে গেল। মহিলাটি বলল, ইয়া আল্লাহ! আমার শিশুটিকে এর মত করো না। শিশুটি তৎক্ষণাৎ মায়ের স্তন ছেড়ে দিয়ে বলল, ইয়া আল্লাহ! আমাকে তার মত কর। মা জিজ্ঞেস করল, তা কেন? শিশুটি জবাব দিল, সেই আরোহী লোকটি ছিল বড় জালিম, আর এ দাসীটিকে লোকে বলছে তুমি চুরি করেছ, যেনা করেছ। অথচ সে এসবের কিছুই করেনি।
ইমাম (র) বুখারী আবু হুয়ায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,আমি শুনেছি, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আমি মারয়ামের পুত্র ঈসার বেশী নিকটতম। আর নবীগণ যেন পরস্পর বৈমাত্রেয় ভাই, অর্থাৎ বাপ এক, মা ভিন্ন ভিন্ন। আমার ও ঈসার মাঝখানে কোন নবী নেই। এই সূত্রে ইমাম বুখারীই-এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইব্ন হাব্বান এবং ইমাম আহমদ হাদীসটি ঈষৎ শাব্দিক পরিবর্তনসহ বর্ণনা করেন। তবে ইমাম আহমদের বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে, কিয়ামতের পূর্বে ঈসা পুনরায় দুনিয়ায় অবতরণ করবেন। যখন তাঁকে দেখবে তখন তোমরা চিনতে পারবে। কারণ তিনি হবেন মাঝারি গড়নের। গায়ের রং লালচে সাদা। মাথার চুল সোজা। মনে হবে যেন মাথার চুল থেকে পানি টপকে পড়ছে। যদিও তিনি পানি স্পর্শ করেন নি। তিনি এসে ক্রুশ ভাঙ্গবোন, শূকর হত্যা করবেন। জিযিয়া কর রহিত করবেন। একমাত্র ইসলাম ছাড়া সে যুগের সকল ধর্ম ও মতবাদ খতম করবেন। আল্লাহ তার হাতে মিথুক মাসীহ দাজ্জালকে ধ্বংস করবেন। সমস্ত পৃথিবী শান্তি ও নিরাপত্তায় ভরে যাবে। এমনকি উট ও সিংহ, বাঘ ও গরু এবং নেকড়ে ও বকরী একই সাথে একই মাঠে বিচরণ করবে। কিশোর বালকগণ সাপের সাথে খেলা করবে। কিন্তু কেউ কারও ক্ষতি করবে না। যতদিন আল্লাহর ইচ্ছা ততদিন তিনি পৃথিবীতে থাকবেন। তারপর তিনি স্বাভাবিকভাবে ইনতিকাল করবেন এবং মুসলমানরা তার জানাযা পড়বে। আবু দাউদ ……. হামমাম ইব্ন ইয়াহিয়া থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। হিশাম, ইব্ন উরওয়া আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : ঈসা (আ) পৃথিবীতে চল্লিশ বছর অবস্থান করবেন। এই কিতাবের মালাহিম (যুদ্ধ বিগ্রহ) অধ্যায়ে ঈসা (আ)-এর অবতরণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। তাফসীর গ্রন্থেও আমরা সূরা নিসার এই আয়াত : কিতাবীদের মধ্যে প্রত্যেকে তার মৃত্যুর পূর্বে তাঁর প্রতি ঈমান আনবেই এবং কিয়ামতের দিন সে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে। (৪নিসাঃ ১৫৯)-এর তাফসীর প্রসঙ্গে এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : ঈসা (আ)-এর পুনরায় দুনিয়ায় আগমন কিয়ামতের অন্যতম লক্ষণ। দামিশকের শুভ্ৰ মিনারায় উপর তিনি অবতরণ করবেন। তিনি যখন অবতরণ করবেন। তখন ফজরের নামাযের ইকামত হতে থাকবে। তাকে দেখে মুসলমানদের ইমাম বলবেন, হে রুহুল্লাহ! সম্মুখে আসুন ও নামাযের ইমামতি করুন! ঈসা (আ) বলবেন, না, আপনারা একে অন্যের উপর নেতা, এ সম্মান আল্লাহ এ উম্মতকেই দান করেছেন। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ঈসা। (আঃ) ইমাম ছাহেবকে বলবেন, আপনিই ইমামতি করুন। কেননা, আপনার জন্যে ইকামত দেয়া হয়েছে। অতঃপর ঐ ইমামের পেছনে তিনি সালাত আদায় করবেন। নামায শেষে তিনি বাহনে আরোহণ করে মাসীহ দাজ্জালের সন্ধানে বের হবেন এবং মুসলমানরা তার সাথে থাকবেন। দাজ্জালকে লুদ তোরণের নিকট পেয়ে সেখানেই তিনি নিজ হাতে তাকে হত্যা করবেন। ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দামিশকের পূর্ব পার্শ্বে এই মিনার যখন শুভ্ৰ পাথর দ্বারা নির্মাণ করা হয় তখনই দৃঢ় আশা করা হয়েছিল যে, এখানেই তিনি অবতরণ করবেন। এই স্থানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর নাসারাদের অর্থ দ্বারাই এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ঈসা (আ) এখানে অবতরণ করে শূকর নিধন করবেন। ক্রুশ ভেংগে চুরমার করবেন এবং ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দীন তিনি গ্রাহ্য করবেন না।
ঈসা (আ) রাওহা থেকে হজ্জ কিংবা উমরা অথবা উভয়টির নিয়ত করে বের হবেন এবং তা সম্পন্ন করবেন। চল্লিশ বছর জীবিত থাকার পর তিনি ইনতিকাল করবেন। তাকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হুজরায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁর প্রথম দুই খলীফার নিকট দাফন করা হবে। এ সম্পর্কে ইব্ন আসাকির তাঁর ইতিহাস গ্ৰন্থ ঈসা (আ)-এর বর্ণনা প্রসংগে হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত মারফু হাদীসে উল্লেখ করেছেন যে, হযরত ঈসা (আ)-কে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হুজরা শরীফের মধ্যে রাসূলুল্লাহ, আবু বকর ও উমরের সাথে দাফন করা হবে। কিন্তু এই হাদীসের সনদ বিশুদ্ধ নয়। ইমাম আবু ঈসা তিরমিয়ী আব্দুল্লাহ ইব্ন সালাম (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তাওরাত কিতাবে মুহাম্মদ (সা) ও ঈসা ইব্ন মারিয়ামের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে আছে যে, হযরত ঈসাকে মুহাম্মদ (স)-এর সাথে দাফন করা হবে। এ হাদীসের অন্যতম রাবী আবু মওদূদ মাদানী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হুজরায় একটি কবর পরিমাণ স্থান খালি আছে। ইমান তিরমিয়ী (র) এ হাদীসকে হাসান বলেছেন। ইমাম বুখারী (র) বলেন, আমার মতে এ হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়। ইমাম বুখারী সুলায়মান থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত ঈসা ও মুহাম্মদ (সা)-এর মধ্যে নবুওতের বিরতিকাল ছয় শ বছর। কাতাদার মতে, পাঁচ শ ষাট বছর। কারও মতে পোচ শ চল্লিশ বছর। যোহহাকের মতে, চার শ ত্রিশ বছরের কিছু বেশী কিন্তু প্ৰসিদ্ধ মত ছয় শ বছর। তবে কেউ কেউ বলেছেন, চান্দ্ৰ বছরের হিসেবে ছয় শ বিশ বছর এবং সৌর বছর হিসেবে ছয় শ বছর।
ইব্ন হিব্বান তাঁর সহীহ গ্রন্থে ঈসা (আঃ)-এর উম্মতগণ কত দিন সঠিক দীনের উপরে ও নবীর আদর্শের উপরে টিকেছিল সে সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি আবুদ দারদা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন : আল্লাহ দাউদ নবীকে তাঁর অনুসারীদের মধ্যে মৃত্যু দেন। কিন্তু এতে তাঁর অনুসারীরা বিপথগামীও হয়নি, দীনও পরিবর্তন করেনি। আর ঈসা।
মাসীহর অনুসারীরা তাঁর বিদায়ের পরে দুশ বছর তার নীতি ও আদর্শের উপরে টিকে ছিল। ইব্ন হিব্বান এ হাদীসকে সহীত বললেও মূলত এর সনদ গরীব পর্যায়ের। ইব্ন জারীর মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাকের বরাত দিয়ে লিখেছেন যে, ঈসা (আ)-কে আসমানে তুলে নেয়ার পূর্বে তিনি হাওয়ারীগণকে উপদেশ দিয়েছেলেন, তারা যেন মানুষকে এক ও লা-শরীক আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাকতে থাকে। তিনি তাদের প্রত্যেককে সিরিয়া ও প্ৰাচ্য-প্রতীচ্যের জনগোষ্ঠির এক এক এলাকা দাওয়াতী কাজের জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন।
বর্ণনাকারীগণ বলেছেন যে, সে এলাকায় যে হাওয়ারীকে নিয়োগ করা হয়েছিল, তিনি সেই এলাকার অধিবাসীদের সাথে তাদের নিজ ভাষায় কথা বলতেন। অনেক ঐতিহাসিক বলেছেন, হযরত ঈসা (আ)-এর নিকট থেকে চার জন লোক ইনজীল উদ্ধৃত করেছেন। তাঁরা হলেন, লুক, মথি, মার্কস ( মার্ক) ও ইউহান্না (যোহন)। কিন্তু এই ইনজীল চতুষ্টয়ের মধ্যে একটির সাথে আর একটির যথেষ্ট গরমিল বিদ্যমান। একটির মধ্যে বেশী তো আর একটিতে কম। উক্ত চার জনের মধ্যে মথি ও ইউহান্না হযরত ঈসার যুগের এবং তারা তাকে দেখেছিলেন। মার্কস ও লুক তাঁর সমসাময়িক ছিলেন না, বরং তারা ছিলেন ঈসার শিষ্যদের শিষ্য। তবে তারা মাসীহর উপর যথার্থ ঈমান আনেন ও তাকে সত্য নবী বলে স্বীকার করেন। দামিশকের এক ব্যক্তি ঈসা। মাসীহর উপর ঈমান আনেন, তার নাম যায়ন (L, …>)। তবে তিনি পোল নামক জনৈক ইহুদীর ভয়ে দামিশকের পূর্ব গেটে গীর্জার নিকটে একটি গুহায় আত্মগোপন করে থাকেন। উক্ত ইহুদী ছিল অত্যাচারী ও ঈসা (আ)-এর প্রতি এবং তাঁর আদর্শের প্রতি চরম বিদ্বেষী। এই ব্যক্তির এক ভাইপো ঈসা (আ)-এর উপর ঈমান আনার কারণে সে তার মাথার চুল মুড়িয়ে দেয়। শহরের রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরায় এবং পাথর মেরে তাকে হত্যা করে। একদিন সে শুনতে পেল ঈসা (আ) দামিশক অভিমুখে রওনা হয়েছেন। তখন সে তাঁকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে খচ্চরে আরোহণ করে সেদিকে বেরিয়ে পড়ল।
কাওকাব নামক স্থানে পৌঁছে সে ঈসা (আ)-কে দেখতে পেল। ঈসা (আ)-এর শিষ্যদের দিকে অগ্রসর হতেই এক ফেরেশতা এসে পাখা দিয়ে আঘাত করে তার চোখ কানা করে দিলেন। এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে তার অন্তরে ঈসা (আ)-এর প্রতি বিশ্বাস জন্মায়। তখন সে ঈসা (আ)-এর নিকট গিয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করে ঈমান আনে। ঈসা (আ) তার ঈমান গ্রহণ করলেন। তঃপর সে ঈসা (আঃ)-কে তার চক্ষুদ্বয়ের উপর হাত বুলিয়ে দিতে অনুরোধ করল, যাতে আল্লাহ তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন। ঈসা (আ) বললেন, তুমি যায়ন-এর কাছে ফিরে যাও। দামিশকের পূর্ব প্রান্তে লম্বা বাজারের পার্শ্বে তাকে পাবে। সে তোমার জন্যে দোয়া করবে। ঈসা। (আ)-এর কথামত সে সেখানে এসে যায়নকে পেল। যায়ন তার জন্যে দোয়া করলে সে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেল। পোল আন্তরিকভাবে ঈসার প্রতি ঈমান এনেছিলেন তিনি তাকে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল হিসেবে বিশ্বাস করতেন। তার নামে দামিশকে একটি গীর্জা তৈরি করা হয়। পোলের গীর্জা নামে খ্যাত এই গীর্জাটি সাহাবাদের যুগে দামিশক বিজয়কালেও বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীকালে এটা ধ্বংস হয়ে যায়। সে ইতিহাস আমরা পরে বলব।
পরিচ্ছেদ
হযরত ঈসা মাসীহ (আ)-কে আসমানে উঠানোর পর তাঁর সম্পর্কে তাঁর অনুসারীদের মধ্যে বিভিন্ন মতামতের সৃষ্টি হয়। ইব্ন আব্বাসসহ প্রথম যুগের অনেক মনীষী এ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। আমরা সূরা সাফ-এর আয়াত— পরে আমি মুমিনদেরকে শক্তিশালী করলাম তাদের শক্ৰদের মুকাবিলায়; ফলে তারা বিজয়ী হল। (৬১ সাফঃ ১৪)-এর ব্যাখ্যায়। ইব্ন আব্বাস (রা) প্রমুখ বলেছেন, তাদের একদল বিশ্বাস করে যে, তিনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। তিনি আমাদের মধ্যে ছিলেন, এখন তাঁকে আসমানে তুলে নেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় দল বলে, তিনি হলেন স্বয়ং আল্লাহ। তৃতীয় দলের মতে, তিনি আল্লাহর পুত্র। বস্তৃত প্রথম দলের বিশ্বাসই যথার্থ। অন্য দল দুটির বক্তব্য জঘন্য কুফুরী। তাদের মতবিরোধ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন : অতঃপর দলগুলো নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি করল, সুতরাং দুর্ভোেগ কাফিরদের মহাদিবস আগমনকালে। (১৯ মারুয়াম : ৩৭) Y
এ ছাড়া ইনজীলের চারজন বৰ্ণনাকারীর বর্ণনা উদ্ধৃত করােব মধ্যেও কম, বেশী পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে। তারপর হযরত ঈসা (আ)-এর তিনশ বছর পর ইনজীল ও ঈসায়ী ধর্মের উপর বিরাট দুর্যোগ নেমে আসে। চার দলের চারজন আর্ক বিশপ, পাদ্রী ও সাধু-সন্ন্যাসীগণ মাসীহ সম্পর্কে এত অসংখ্য মতে বিভক্ত হয়ে পড়েন, যা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। তারা তাদের এ বিরোধের ফয়সালার জন্যে কনষ্টান্টিনোপল নগরীর প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট কনস্টান্টাইনের শরণাপন্ন হয়। এটা ছিল তাদের প্রথম মহাসম্মেলন। সম্রাট সবকিছু শুনে অধিকাংশ দল যে মতের উপর ঐকমত্য পোষণ করে, সে মতকেই গ্ৰহণ করেন। এই দলের নামকরণ করা হয় মালাইকা (মালাকিয়া)। এ মতের বাইরে যারা ছিল তাদেরকে নির্যাতীত করেন ও দেশান্তরিত করেন। আবদুল্লাহ ইব্ন আদায়ুসের অনুসারী যারা ঈসা (আ)-কে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল হিসেবে বিশ্বাস করতেন তাঁরা একঘরে হয়ে পড়েন। তাঁরা বিভিন্ন পাহাড়ী অঞ্চলে ও উপত্যকায় গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। তারা সেখানে ইবাদতখানা, গীর্জা ও উপাসনালয় তৈরি করেন এবং সন্ন্যাসী জীবন-যাপন করতে থাকেন। এঁরা উপরোক্ত ফের্কাসমূহের সংশ্রব থেকে দূরে থাকেন। অপরদিকে মালাইকা সম্প্রদায় গ্ৰীক স্থাপত্যের অনুকরণে বিভিন্ন জায়গায় বিরাট বিরাট গীর্জা স্থাপন করে। তারা তাদের কিবলা পূর্ব দিকে পরিবর্তন করে, যদিও কিবলা ইতিপূর্বে উত্তরে জাদাইর দিকে ছিল।
বেথেলহাম ও কুমামার ভিত্তি স্থাপন হযরত ঈসা মাসীহ (আ) যে স্থানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে স্থানে সম্রাট কনস্টান্টাইন একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন, যার নাম রাখা হয় বায়তু লাহাম (বেথেলহাম)। অপর দিকে সম্রাটের মা হায়লানা কথিত ক্রুশবিদ্ধ ঈসার কবরের উপর আর একটি প্রাসাদ তৈরি করেন, যার নাম রাখা হয় কুমামা। ইহুদীদের প্রচারণায় পড়ে তারাও বিশ্বাস করত যে, নবী ঈসা মাসীহকেই ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এই মত পোষণকারী পূর্বের ও পরের সকলেই কাফির। এরা বিভিন্ন রকম মনগড়া বিধি-বিধান ও আইন-কানুন তৈরি করে। এসব বিধানের মধ্যে ছিল পুরাতন নিয়ম তথা তাওরাতের বিরোধিতা করা। তারা তাওরাতে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ ও হারাম বস্তুকে হালাল করে নেয়, যেমন শূকর খাওয়া। তারা পূর্বমুখী হয়ে উপাসনা করে। অথচ ঈসা-মাসীহ বায়তুল মুকাদাসের শুভ্র পাথরের দিকে মুখ করে ছাড়া ইবাদত করতেন না। শুধু তিনিই নন, বরং মূসা (আ)-এর পরবর্তী সকল নবী বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামায আদায় করেছেন। এমনকি শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-ও হিজরতের পরে ষোল কিংবা সতের মাস পর্যন্ত বায়তুল মুকাদাসকে কিবলা করে নামায আদায় করেছেন। পরে তিনি আল্লাহর হুকুমে ইবরাহীম খলীল (আ) কর্তৃক নির্মিত কাবা ঘরের দিকে ফিরে নামায পড়েন।
তারা গীর্জাগুলোতে মূর্তি স্থাপন করে অথচ ইতিপূর্বে গীর্জয় কখনও কোন মূর্তিা রাখা হতো না। তারা এমন সব আকীদা তৈরি করে যা শিশু, মহিলা ও পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই বিশ্বাস করত। এই আকীদার নাম ছিল আমান। প্রকৃত পক্ষে এটা ছিল সম্পূর্ণ কুফরী আকীদা ও বিশ্বাস ভঙ্গের নামান্তর। মালাকিয়া ও নাসতুরিয়া দলভুক্ত সকলেই ছিল নাসিতুরাস এর অনুসারী। এরা ছিল দ্বিতীয় মহা সম্মেলনপন্থী। আর ইয়াকুবিয়া সম্প্রদায় হচ্ছে ইয়াকুব আল বারাদায়ীর অনুসারী। এরা হল তৃতীয় মহা সমাবেশ পহী। এ দুই দলই প্রথমোক্ত দলের একই আকীদা পোষণ করত, যদিও খুঁটিনাটি বিষয়ে পারস্পরিক বিরোধ ছিল। আমি তাদের কুফরী আকীদার কথা বর্ণনা করছি।
আর কুফরের বর্ণনা করায় কেউ কাফির হয় না। তাদের আকীদার বাক্যগুলোর মধ্যে এমন সব জঘন্য শব্দ আছে, যার মধ্যে কুফরীর ভাব অতি প্রকট এবং তা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর। এ আকীদা মানুষকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পৌঁছিয়ে দেয়। তাদের বলে থাকে যে, আমরা এক আল্লাহ্কে বিশ্বাস করি যিনি সবকিছুর নিয়ন্ত্রক, আসমান ও যমীনের দৃশ্যমান, অদৃশ্যমান সবকিছুর সৃষ্টিকর্ত, ঐ একই প্রতিপালককে আমরা মানি। মাসীহ সেই এক আল্লাহ্রই একক পুত্র। অনাদিকালেই পিতা থেকে তাঁর জন্ম। তিনি নূর থেকে সৃষ্ট নূর। সদা প্ৰভু থেকে তিনিও সদা প্ৰভু। তিনি জন্মলাভ করেছেন, সৃষ্ট হননি। সেই মূল উপাদানে তিনি পিতার সমকক্ষ যার দ্বারা সবকিছু সৃষ্ট হয়েছে। আমাদের ললাটলিপি অনুযায়ী আমরা মানুষ। আমাদের মুক্তির জন্যে তিনি আসমান থেকে অবতরণ করেছেন এবং পবিত্র আত্মা দ্বারা দেহ ধারণ করেছেন ও কুমারী মারুয়ামের গর্ভ থেকে মানবরূপে আত্মপ্ৰকাশ করেছেন। এরপর মালাতিস নাবাতীর আমলে ক্রুশবিদ্ধ হয়েছেন, দুঃখ পেয়েছেন। তারপরে সমাধিস্থ হয়েছেন। সমাধিস্থ হওয়ার তিন দিন পর কবর থেকে বেরিয়ে এসেছেন এবং আসমানে উঠে গিয়ে পিতার ডান পাশে বসে আছেন। আবার তিনি দেহ ধারণ করে আসবেন। জীবিত ও মৃতদের খোঁজ খবর নিবেন। তাঁর রাজত্বের ক্ষয় নেই। তিনি পবিত্র আত্মা। তিনি প্ৰভু, জীবন দানকারী। পিতার কাছ থেকে এসেছেন। পিতার সাথে থাকবেন। পুত্ৰ সিজদা পাওয়ার যোগ্য। নবীকুলের মধ্যে দোলনায় কথা বলার শ্ৰেণীরব তিনিই লাভ করেছেন। আল্লাহর সাথে পবিত্র ও পূর্ণাংগ সম্পর্ক তার। সমস্ত পাপ ক্ষমা করার জন্যে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি চিরঞ্জাব, মৃতকে জীবন দানকারী, সর্বদা বিরাজমান ও যিম্মাদার।
অতীতকাল বলতে এখানে বনী ইসরাঈলের যুগ থেকে আরবের জাহিলী যুগের পূর্ব পর্যন্ত সময় বুঝান হয়েছে। এই সময়কালের বড় বড় ঘটনা এখানে আলোচনা করা হবে। আর আরবের জাহিলী যুগ সম্পর্কে এই অধ্যায়ের পরে আলোচনা আসবে। আল্লাহর বাণী : পূর্বে যা ঘটেছে তার সংবাদ আমি এভাবে তোমার নিকট বিবৃত করি এবং আমি আমার নিকট হতে তোমাকে দান করেছি। উপদেশ (২০ তাহা : ৯৯)। সূরা ইউসুফে আল্লাহ বলেন, আমি তোমার নিকট উত্তম কাহিনী বর্ণনা করছি, ওহীর মাধ্যমে তোমার নিকট এই কুরআন প্রেরণ করে; যদিও এর পূর্বে তুমি ছিলে অনবহিতদের অন্তর্ভুক্ত। (১২ ইউসুফ : ৩)