সেন-বর্মণ যুগ
পাল-চন্দ্ররাষ্ট্রে ও তাহাদের কালে ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসেব আদর্শ ছিল উদার ও নমনীয়; কম্বোজ সেন-বৰ্মণ আমলে সেন-বৰ্মণ রাষ্ট্রের সক্রিয় সচেতন চেষ্টার ফলে সেই আদর্শ হইল সুদৃঢ়, অনমনীয় ও সুনিদিষ্ট। যে বর্ণ-বিন্যস্ত সমাজব্যবস্থা আজও বাংলাদেশে প্রচলিত ও স্বীকৃত তাহার ভিত্তি স্থাপিত হইল এই যুগে দেড় শতাব্দীর মধ্যে। বাংলার সমাজ ব্যবস্থার এই বিবর্তন প্রায় হাজার বৎসরের বাংলাদেশকে ভাঙ্গিয়া নৃতন করিয়া ঢালিয়া সাজাইয়াছে। কি করিয়া এই আমূল সংস্কার, এত বড় পরিবর্তন সাধিত হইল তাহা একে একে দেখা যাইতে পারে।
কম্বোজ-রাজবংশকে অবলম্বন করিয়াই এই বিবর্তনের সূচনা অনুসরণ করা যাইতে পারে। এই পার্বত্য কোমটি বোধ হয় বাংলা দেশে আসার পর আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতি আশ্রয় করেন। প্রথম রাজা রাজ্যপাল ছিলেন ‘পরমসুগত’ অর্থাৎ বৌদ্ধ; কিন্তু তাঁহার পুত্র নারায়ণপাল হইলেন বাসুদেবের ভক্ত। নারায়ণপালের ছোট ভাই সম্রাট নয়পাল একবার নবমী দিবসে পূজাস্নান করিয়া শঙ্কর ভট্টারকের (শিবের) নামে জনৈক ব্রাহ্মণকে বর্ধমানভুক্তিতে কিছু ভূমি দান করেন। বৌদ্ধ রাজার বংশধরদের ব্রাহ্মণ্যধর্মের ছত্রছায়ায় আশ্রয় লইতে দেখিয়া স্পষ্টই বুঝা যায় সমাজচক্র কোন দিকে ঘুরিতেছে। পালবংশের শেষের দিকেও একই চিহ্ন সুস্পষ্ট। শেষ অধ্যায়ে পালরাষ্ট্রও এই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক সমাজশাসনের স্পর্শে আসিয়াছিল। পালবংশ ও পালরাষ্ট্রকে বিলুপ্ত করিয়া, সেনবংশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হইল; চন্দ্রবংশকে বিলুপ্ত করিয়া হইল বর্মনবংশের প্রতিষ্ঠা। যে দুটি বংশ ও রাষ্ট্র বিলুপ্ত হইল তাহারা উভয়ইে বাঙালী ও বৌদ্ধ, এবং যে দুটি বংশ ও রাষ্ট্র নূতন প্রতিষ্ঠিত হইল তাহারা উভয়েই ভিন প্রদেশাগত। উভয়েই অত্যন্ত নৈতিক ও গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি আশ্রয়ী। বাঙালীর সামাজিক ইতিহাসের দিক হইতে এই দু’টি তথ্যই অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক অর্থবহ।
সেন-রাজবংশ কর্ণাটাগত; তাঁহারা আগে ছিলেন ব্রাহ্মণ, পরে যোদ্ধবৃত্তি গ্রহণ করিয়া হইলেন ক্ষত্রিয়, এবং পরিচয় হইল ব্রহ্মক্ষত্র রূপে। বর্মণ-বংশ কলিঙ্গাগত বলিয়া অনুমিত, অন্ততঃ ভিন্ন প্রদেশী এবং দক্ষিণাগত, সন্দেহ নাই; এবং বর্ণহিসাবে ক্ষত্রিয়। দক্ষিণদেশ সাতবাহন এবং তৎপরবর্তী সালঙ্কায়ন, বৃহৎফলায়ন, আনন্দ, পল্লব, কদম্ব প্রভৃতি রাজবংশের সময় হইতেই নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের কেন্দ্র, যাগযজ্ঞহোম প্রভৃতি নানাপ্রকার ব্রাহ্মণ্য পূজানুষ্ঠানে গভীর বিশ্বাসী, এবং প্রচলিত বর্ণাশ্রমের উৎসাহী প্রতিপালক। দক্ষিণদেশের এই নিষ্ঠাপূৰ্ণ ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার লইয়া সেন ও বর্মণ রাজবংশ বাংলা দেশে আসিয়া সুপ্রতিষ্ঠিত হইল। দেখিতে দেখিতে বাংলা দেশ যাগযজ্ঞহোমক্রিয়ার ধূমে ছাইয়া গেল, নদ-নদীর ঘাটগুলি বিচিত্র পুণ্যস্নানার্থীর মন্ত্রগুঞ্জরণে মুখরিত হইয়া উঠিল, ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর পূজা, বিভিন্ন ব্রতানুষ্ঠান দ্রুত প্রসারিত হইল। সহজ স্বাভাবিক বিবর্তনের ধারায় এই দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হয় নাই; পশ্চাতে ছিল রাষ্ট্রের ও রাজবংশের সক্রিয় উৎসাহ, অমোঘ ও সচেতন নির্দেশ। এই যুগের লিপিমালা, অসংখ্য পুরাণ, স্মৃতি, ব্যবহার ও জ্যোতিষগ্রন্থ ইত্যাদিই তাহার প্রমাণ।