সেদিন ছিল ছুটি। ফারুককে আপিসে যেতে হবে না। তাহমিনার শুধু সকালের টিউশানি। বিকেলেরটায় ছুটি তারো। দুপুরে তাহমিনা বেরিয়ে গেল একেলা। বলে গেল ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ফিরবে। ফারুক সে সময়টা শুধু শুয়ে ঘুমিয়ে কাটালো।
ফিরে যখন এলো তখন ফারুক জানালার কাছে চেয়ার টেনে বসে বলল, এলে?
হুঁ। কোথায় গিছলাম বলোত?
তুমি না বললে জানব কী করে, বাহ্।
আমিন বাগে।
তোমার মার কাছে? হঠাৎ কী ব্যাপার?
সব সম্পর্ক চুকিয়ে এলাম।
ফারুক ঘুরে ওর মুখোমুখি হলো। কেন যেন ভয় পেল। কেন যেন তাহমিনাকে সে সমর্থন করতে পারল না মনে মনে।
শাড়ির আঁটসাট ভাঁজ শিথিল করে অলস ভঙ্গিতে খোঁপা আলগা করে দিতে দিতে তাহমিনা ছোট্ট হাই তুলে বলল, তোমাকে বলিনি। মা জানতে পেরেছিলেন সব। ভেবেছিলুম জানাবো না। এখনকার জন্যে নয়, বিয়ের ওপরই দুঃখ হোতো তার। সেটাও আমি চাইনে। লাবলু একদিন এসেছিল সন্ধ্যের পর। মা এক পাও নড়তে পারেন না, নইলে দেখতে নিজেই চলে আসতেন। তাছাড়া বোধ হয় আমাকে ঘেন্নাও করেন, নইলে আসতে কি?
লাবলু কী বলেছে? জাকি?
জাকি ভাই অফিসিয়াল কাজে করাচি গিছলেন, আজকেই ফিরেছেন। এখনো আপিসে। দেখো আজকেই না এসে পড়ে এখানে।
কেন?
দেখো, আসবেই। মাকে সব কথা বলেছি, না বলে উপায় ছিল না। তোমাকে বলিনি, তুমি ব্যস্ত হয়ে পড়বে তাই। কী আশ্চর্য জানো, মা আমাকে অবাক করে দিয়েছেন। একটুও কাঁদলেন না, কিছু না, শুধু চুপ করে রইলেন।
মা আঘাত পেয়েছেন।
কী জানি। আর বাবা, বাবা আমার নাম অবধি শুনতে চাননি। আমি তার কাছে মরে গেছি। দুঃখ শুধু, কেউ বুঝলো না ফারুক। তারপর একটু পর, একটু থেমে তাহমিনা মাথা ঝাঁকিয়ে সেই আবহ কাটিয়ে দিতে দিতে বলল, মা শুধু বললেন, কবে মরে যাই তার ঠিক নেই, আমাকে ফেলে যাবি?
তাহমিনা উত্তরে কী বলেছে ফারুক তা শুধালো না। তাহমিনাও বলল না। চুপ করে রইল। তারপর হঠাৎ তাহমিনা মাথা ঝাঁকিয়ে সেই আবহ কাটিয়ে দিতে দিতে বলল, চল বেরোই। আজ না সিনেমায় যাব।
তাহমিনা অনুমান করেছিল ঠিকই যে জাকি আজকেই আসবে। এলো তাই। তাহমিনা মালেকাবাণুকে বলেছিল, লাবলুও জানতো, তারা কোথায় বাসা করেছে, সেই নিশানা ধরে। কিন্তু পেল না কাউকে। ঝিকে জিগ্যেস করে জানলো সিনেমায় গেছে। মরিস নিয়ে আবার সে বেরিয়ে গেল। ফিরে যখন এলো তখনো ওরা ফেরেনি। ঝি ওপরের ঘর খুলে দিলে পর সে বসে রইল।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তাহমিনা বলল, ওপরের ঘরে আলো জ্বলছে। ঝিটার আক্কেল দেখো। বাসায় এক দণ্ড না থাকলে এমনি করতে হয়!
কোন দরকারে হয়ত জ্বেলেছে।
এমনি কথা বলতে বলতে ওরা ওপরে এসে দোরপর্দা সরিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেল। তাহমিনা চোখ নিচু করল কিছুটা। ফারুক তাকিয়ে রইল সোজাসুজি। জাকি একটা খাড়া পিঠ চেয়ার টেনে বসে আছে। তাহমিনা ঢুকতে ঢুকতে বলল, জানতুম তুমি আসবে। কিন্তু সব কথা আমি মাকে বলে এসেছি।
জাকি একটুকাল নিঃশ্বাস বন্ধ করে থেকে তারপর বলল, আমার সাথেও তোমার কথা হওয়া দরকার। তাই এসেছি।
বেশ। যা বলবে আমাকেই বলবে, ফারুককে কিছু বলতে পারবে না। আমার ওপর তোমার অধিকার আছে মনে করেই এসেছ, কিন্তু ওর ওপর যে নেই এটা মনে রাখলে খুশি হব।
বল।
তাহমিনা খাটের পাশে এসে বসলো। তার কথাগুলো শোনাল দৃঢ় আর অনমনীয়। এমনভাবে শুরু করলো যেন এখুনি সে শেষ করে ফেলতে চায় সব কথা। সময় নষ্ট হতে দিতে চায় না। ফারুক সরে গেল সেখান থেকে।
জাকি নরম সুরেই শুরু করল, তুমি যে এমুন করবে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
আমিও না।
তাহমিনার উত্তর শুনে চমক ভাঙ্গল জাকির। প্রশ্ন করলো, কেন?
নতুন করে বলবার ইচ্ছে নেই, নইলে বলতাম। মার কাছ থেকেই শুনে নিও।
কিছু হলে আমাকে তোমার বলা উচিত।
তোমরা আমার ভালোর জন্যেই সব করেছিলে। সে ভালো সইলো না। তাই নিজের ভালো নিজেই বেছে নিয়েছি।
আমাদের মুখে চুন কালি দিয়ে?
আমি ছোট্ট আর নই, আমি সব বুঝি।
তবুও?
হ্যাঁ।
জাকি থামল। তারপর সুর চড়িয়ে বলল, আবিদ চুপ করে থাকবে না, তা জানো?
তার যা খুশি করতে পারে।
ও।
কিছু করতে হলে সে-ই করবে। তোমাদের করবার কিছু নেই।
হয়ত নেই; আশরাফের চিঠি পাবার পর অন্তত বোন হিসেবে আমার যা করবার আছে তা করতে চেয়েছি। সেটা কি অনুচিত?
না। আমার যা বলবার সব মাকে বলেছি।
শুনেছি।
তারপর না এলেও তোমার চলত। সেই আমার শেষ কথা। তুমি এখন যাও।
এত শীগগীর যে তাহমিনা যবনিকা টানবে তা জাকি আশা করে নি। নরম সুরে তোক, চড়া সুরে হোক সে একটা বিহিত করতেই এসেছিল। কিন্তু তাহমিনার মুখোমুখি এসে সে যেন। কেমন খেই হারিয়ে ফেলেছিল। তাছাড়া এরপর, সে ভাবল, আর কিছু বলা বৃথা। উঠে দাঁড়াল। বলল, বেশ আজ থেকে মনে করবো আমাদের কোন বোন ছিল না। আমি চললাম।
তাহমিনা কোনো উত্তর করল না। যখন ও দরোজার কাছে গেল, তখন বলল, এরপর বাসায় বোধ হয় আমাকে যেতে দেবে না?
সে তোমার ইচ্ছে।
জাকি সিঁড়ি বেয়ে দুধাপ নামল। পাশে আলো জ্বলছে। জাকিকে একটু বেঁটে দেখাল ওপর থেকে।
মার খবর পাবো না?
তোমার দরকার কি?
আমার মার খবর দেবে না? যেতে দেবে না?
এ মুখ দেখিও না তাকে।
জাকি নেমে গেল। তাহমিনা দাঁড়িয়ে রইল সিঁড়ির ওপরেই। একটু পরে সে শব্দ শুনল বেবি মরিস স্টার্ট নিচ্ছে।
.
একদিন সকালে ফারুক আবিষ্কার করল তাহমিনা কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে। আশ্চর্য মন্থরতা তার চলনে। আর চোখ জোড়া আয়ত উজ্জ্বল। ফারুকের দিকে তাকাতে গিয়ে বারবার চোখ নামিয়ে নিল। বলনে কেমন চাপা খুশি, ফারুক লক্ষ্য করল। দুপুরে প্রায় সে ভুলেই গেল কথাটা। আর তার মনে রইল না।
রাতে যখন ফারুক ফিরে এলো তখন তাহমিনা এলিয়ে ছিল বিছানার ওপর। কাপড় বদলাতে বদলাতে ফারুক শুধালো, খেয়েছ?
না।
আজ দেরি যে বড়?
ভালো লাগছে না। তুমি খেয়ে নাও।
ফারুক খাটের কাছে এসে বসে বলল, কী হলো তোমার?
কিছু না।
তবে?
নাগো না, অসুখ করেনি। একদিন কি খারাপ লাগতে নেই? কী যে তোমার বুদ্ধি। যাওতো এখন।
ফারুক খেয়ে এসে শুয়ে পড়ল তার পাশে। তাহমিনা এপাশ ওপাশ করল খানিক। একবার গলায় বাহু জড়িয়ে দিল তার। মুখ লুকালো। পড়ে রইল অনেকক্ষণ, তারপর আবার মুখ। তুলে নিল। ফারুক শুধালো, কিছু বলছ না মিনু।
উ।
আজ তোমাকে– কি হয়েছে তোমার?
তাহমিনা বালিশে নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইল। ফারুক ওর চিবুকে হাত রেখে তাকাল। আবছা আলোতেও দেখতে পেল তার ঠোঁটে মিহি হাসির রেখা—- অদ্ভুত একটা ভাঁজ। সহসা তার মনে বিদ্যুতের মত নিমেষের জন্য একটা কথা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তার হাত কাঁপল একটু।
তবে কি তাই মিনু?
হুঁ।
কবে টের পেলে? কিছু বলোনি?
আজকেই।
কী করে বুঝলে?
ও তুমি বুঝবে না। তারপর তাহমিনা তাকাল ফারুকের চোখে চোখে অন্ধকার। ফারুক তখন চোখ বুজেছে কিন্তু তা দেখতে পেল না তাহমিনা। সে তাকিয়ে রইল।