স্যার সিঙ্গাপুর থেকে চোখের চিকিৎসা করে আসার পর বেশ কয়েকবার যাওয়া হল। তার চোখেমুখে পানি নেমেছে। একটানা কথা বলতে গেলে হাঁপিয়ে ওঠেন। উঁচু চেয়ার থেকে ঝুকে টেবিলের ওপর বইপত্র পড়ার সময় তাকে একটি শিশুর মতো দেখায়। নানান কথা জিগ্গেস করে স্যারকে কষ্ট দিতে ভীষণ খারাপ লাগে। ইদানীং স্যারের মধ্যে নতুন প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কথা বলা শুরু করলে থামতে চান না। একটানা কথা বলতে থাকেন। আগে কথা বলার সময় উইট ঠিকরে বেরিয়ে আসতো। হালে সে জিনিসটি বিশেষ লক্ষ করা যাচ্ছে না। স্যার তাঁর স্মৃতির ভাণ্ডে যতো কথা জমা হয়ে আছে সব উজাড় করে দিতে পারলেই যেনো বেঁচে যান। আগে স্যার হিসেব করে কথা বলতেন। কেউ আহত হচ্ছে কি না, সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে আগুপাছু নানারকম ভেবে তার মতামত প্রকাশ করতেন। বর্তমান সময়ে তিনি তার সঞ্চিত কথা নিঃশেষ করে ফেলার একটা নেশা যেনো তাকে পেয়ে বসেছে। বোধহয় তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন তার সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। তাই তিনি যাদেরকে নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন, তাদের কাছে অভিজ্ঞতার কথা, উপলব্ধির কথা, চিন্তার কথা প্রকাশ করে স্বস্তি অনুভব করেন।
তবে একটা কথা—যাদেরকে তিনি নির্ভরযোগ্য মনে করেন না, তাদের কাছে কদাচিৎ মুখ খুলে থাকেন। খুব চাপাচাপি করা হলে মুখের ওপর বলে বসতে তাঁর বাধে না, আমার শরীর ভালো নয়, কথাবার্তা বিশেষ কইবার পারুম না। তারপর তিনি একটা বই টেনে নিয়ে তাতে ড়ুবে যান। এই ধরনের পরিস্থিতিতে হাজার চেষ্টা করেও তার মুখ থেকে একটা শব্দ বের করা অসম্ভব।
এক শুক্রবার বেলা এগারোটার দিকে আমি এবং ওবেইদ জায়গীরদার সাহেব স্যারের সামনে গেলাম। জায়গীরদার সাহেবের নাম বলায় স্যার চিনতে পারলেন। স্যার ত, তাড়ি বাধানো দাঁতগুলো মুখের ভেতর পুরে দিয়ে টিপে টুপে ঠিক করে মাড়িতে বসালেন। কথাটা শুরু হল রাজনীতিবিদদের জীবিকা নিয়ে। স্যার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির প্রসঙ্গ উথাপন করলেন। তিনি বলতে থাকলেন
শহীদ যাগো লগে চলাফেরা করতেন, যেমন ধরেন শরৎ বোস, সে সময়ে তার ইয়ারলি ইনকাম আছিল পঁচিশ তিরিশ লাখ টাকার মতো। বিধান রায়ও মোট আয় করতেন। সোহরাওয়ার্দির সেইরকম কোনো বাঁধাপড়া ইনকাম আছিল না, বাধ্য অইয়া তার চাঁদার টাকার ওপর ডিপেন্ড করতে অইত। বাংলাদেশ হওনের পর একবার আমাদের তাজুদ্দিন সাব কইলেন, এই দেশে আর পলিটিকস করুম না। আমি কইলাম পলিটিকস যে করবেন না বললেন, চলবেন কীভাবে? আপনের একটা ওকালতির সনদ আছে। আমার তা মনে অয় না, আপনে কোনোদিন কোর্টে গেছেন। এই কথা যদি কামাল হোসেন কইতেন তা অইলে একটা কথা আছিল। কামাল হোসেনের হাফ এ ডাজেন অপশান আছে। ইচ্ছা করলে তিনি বিদেশে গিয়া প্রাকটিস করবার পাড়েন, য়্যুনিভার্সিটিতে পড়াইতে পারেন। কিন্তু আপনেরা মুখে কইলেও পলিটিকস ছাড়বার পারবেন না।
আমি প্রশ্ন করলাম, স্যার আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দিন ছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার সঙ্গে এমন কারোর পরিচয় হয়েছিল কি না, যার স্মৃতি যতোদিন বেঁচে থাকবেন অনুরাগ সহকারে লালন করবেন?
স্যার বললেন, আমি মুনীরের নাম কমু।
আমি অধিকতর নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললাম, আপনি কী মুনীর চৌধুরী সাহেবের কথা বলছেন?
স্যার বললেন, হ, মুনীরের মতো মানুষ আমি খুব কমই দেখছি। তার মধ্যে হিংসা বিদ্বেষের কোনো লেশ কোনোদিন দেখি নাই। অত্যন্ত উচ্চ মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ আছিল মুনীর।
আমি স্যারের চোখমুখের দিকে তাকালাম। তার চোখের কোনায় পানি চিকচিক করছে। কিছুক্ষণ কথা কালতে পারলেন না। একটু থেমে আবার শুরু করলেন।
একসময় আমি আর মুনীর দুইজনে আজিমপুর দুটি য়্যুনিভার্সিটির ফ্লাটে কাছাকাছি থাকতাম। একদিন বেয়ানবেলা বাজার থিকা ফিরার পথে আমার ফ্লাটে আইস্যা চুপ কইর্যা বসল। অনেকক্ষণ কথা কয় না। আমি জিগাইলাম কী অইছে? অনেকক্ষণ চুপ কইরা থাকনের পর কইল, গত রাইতে লিলি (বেগম মুনীর চৌধুরী) আমারে কইল তুমি যদি রাজ্জাক স্যারের মতো অইবার চাও তোমার বিয়া করন ঠিক আয় নাই।
স্যার বললেন, আমি কইলাম ঠিকই তা কইছে! সকালে তোমার আমার এইহানে আসার কী দরকার? এমনি ত প্রতিদিন য়্যুনিভার্সিটিতে দেখা অয়।
স্যার স্মৃতি হাতড়ে মুনির চৌধুরীর বিষয়ে বলছিলেন, লিবারেশন ওয়ারের সময়ে একদিন আমার ভাইস্তা আবুল খায়ের মুনীরের লগে দেখা করবার গেছিল। মুনীর অনেক মানুষের লগে কথা কইতে আছিল। আবুল খায়েররে দেইখ্যা কইল তুমি অপেক্ষা করো। সকলে যখন চইল্যা গেল মুনীর আবুল খায়েররে জিগাইল কেমন আছ। আবুল খায়ের হেসে জবাব দিল ভালা। মুনীর কইল আইচ্ছা যাও। মুনীরের সেন্স আছিল ভয়ঙ্কর কীনা। কোথায় আছে, কীভাবে আছে যদি জাইন্যা লইয়, আর্মির টর্চারের মুখে বইসায় দেঅন অসম্ভব না। এই কথা চিন্তা কইর্যা মুনীর তার কাছে আর কিছুই জিগায় নাই।
মুনীর অ্যান্ড মোরতাজা দে ডাইড ফর প্রিন্সিপল। ইচ্ছা করলেই তারা বাঁচতে পারত।
আমি অধিকতর স্পষ্ট হওয়ার জন্য জানতে চাইলাম, স্যার, আপনি কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার মোরতাজার কথা বলছেন?
স্যার বললেন, হ, মোরতাজা উচ্চশ্রেণীর চরিত্রের অধিকারী আছিল। হে তার বউরে কইয়া রাখছিল, আমি যদি কোনো বিপদে পড়ি, তুমি সোজা স্যারের কাছে চইল্যা যাইবা। তার পর স্যার মুক্তিযুদ্ধের সময়ের আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করলেন। আমার অ্যাকাউন্ট আছিল ইস্টার্ন ব্যাংকে। য়্যুনিভার্সিটি থেইক্যা মাইনার চেকটা নিয়া আমি মাখনের কাছে দিলাম। মাখন টাকাটা তুইল্যা আমার হাতে দিল।
আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য জানতে চাইলাম, স্যার, আপনি কি তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতা আবদুল কুদ্দুস মাখনের কথা বলছেন?
স্যার বললেন, না না! নূরুল আমিন সাহেবের ছেলে রাজিয়া খানের স্বামী আনোয়ারুল আমিনের কথা কইতাছি। প্রতি মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেকটা তার কছে যাইত। কীরকম রিসক ঘাড়ে লাইছিল চিন্তা কইর্যা দেখেন। সবকিছু কাগজপত্রে রেকর্ডেড। জানবার পারলেই নিৰ্ঘাত মৃত্যু।
রাজ্জাক স্যার খায়রুল কবিরের প্রসঙ্গ টেনে আনলেন। তিনি সাংবাদিক হিসেবে জীবন শুরু করেছিলেন। পরে ব্যাংকের চাকুরিতে যোগ দিয়েছিলেন।
স্যার তার সম্পর্কে এভাবে বলতে আরম্ভ করলেন, আপনেরা খায়রুল কবির সাব’রে সর্বাংশে ভালো মানুষ কইবেন না। তার চরিত্রে এইদিক ওইদিক অনেক আছে। কিন্তু তার কাছে আমি না শুধু, আমার পরিবারের বেবাক মানুষ অত্যন্ত ঋণী। সে সময়ে আমার টাকার ক্রাইসিস। গ্রামে পালাইয়া বেড়াইতে আছি। এরই মাঝে একদিন খায়রুল কবির খোঁজখবর লইয়া আমার কাছে লোক পাঠাইয়া জানাইলেন আপনের টাকার প্রয়োজন আছে জানি, তার জন্য আপনে কোনো চিন্তা কইরেন না। মাসে-মাসে টাকা আপনার কাছে আমি পাঠাইয়া দিমু। যত কাল দেশ স্বাধীন অয় নাই, খায়রুল কবির সাব তার কথা রাখছেন।
আমি কথা প্রসঙ্গে জানালাম, আলাউদ্দিন খান সাহেবের ওপর একটি উপন্যাস লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। স্যার বললেন, আলাউদ্দিন খান একজন ঋষিতুল্য মানুষ আছিলেন। আপনে চেষ্টা করলে লিখতে পারবেন। আলাউদ্দিন খান সাহেব এমনিতে বিনয়ী মানুষ আছিলেন, কিন্তু একবার চটলে আর রক্ষা আছিল না। ক্ষীতিমোহন সেনের সঙ্গে খান সাহেবের একটা বিষয়ে মিল আছে। রাইগ্যা গেলে দুইজনই ভয়ানক অইয়া উঠতেন। রবীন্দ্রনাথ ক্ষীতিমোহনবাবুরে অনেক খোসামোদ কইর্যা শান্তিনিকেতনে রাখছিলেন। ক্ষীতিমোহনবাবু ছাড়া আর সকল মানুষরে রবীন্দ্রনাথ তুমি সম্বোধন করতেন। কিন্তু ক্ষীতিমোহনকে রবীন্দ্রনাথ আপনি সম্বোধন করতেন। ক্ষীতিমোহনবাবুও রাইগ্যা গেলে প্রচণ্ড অইয়া উঠতেন। আশু সেন আছিলেন ক্ষতিমোহনবাবুর জামাই। যখন জানতে পারলেন, আগে আশুবাবু আরেকটা মেমসাহেব বিয়া করছিলেন, ক্ষীতিমোহনবাবু জামাইরে খুন করবার লইছিল। কিছুদিন আগে দেশ পত্রিকা ক্ষীতিমোহন সেনের চিঠিপত্র ছাপাইছে দেখছেন নিহি? পড়লে বুঝতে পারবেন মানুষটা কেমন আছিল।
আমি বললাম, ক্ষীতিমোহন সেনের ‘কবীর’, ‘চিন্ময়বণবঙ্গ’, ‘ভারতবর্ষের হিন্দু মুসলমানের যুক্ত সাধনা’ এসব বই আমি পড়েছি।
স্যার বললেন, বই পড়ে ক্ষীতিমোহন সেনের সবটা জানা যাইব না। চিঠিপত্রের মধ্যেই মানুষটার আসল পরিচয় পাওন যায় বেশি। স্যার বলতে থাকলেন, আমি যত অসাম্প্রদায়িক মানুষ দেখছি ক্ষিতিমোহনবাবু এবং তার জামাই আশুবাবুর মতো আর কাউরে দেখি নাই। আশু সেন আছিলেন হাইকোর্টের জজ। পরে ঢাকা য়্যুনিভার্সিটির ট্রেজাররি অইছিলেন। এখন যে নোবেল প্রাইজ ধরি-ধরি করতাছেন অমত্য সেন, আশু সেন আছিলেন তাঁর বাবা। অমত্য অইল গিয়া ক্ষীতিমোহন সেনের নাতি। বিক্রমপুরের খাঁটি বাঙাল।
রাজ্জাক সার অত্যন্ত তাজিম সহকারে কাজী মোতাহার হোসেনের কথা স্মরণ করলেন। লেকচারার হিসেবে মাইনা পাইতেন একশো বিশ টাকা। রিডার হিসেবে রিটায়ার করার সময়ও কত পাইতেন, তিনশো টাকার বেশি না। এ নিয়া তারে কেউ কোনোদিন কথা বলতে শুনে নাই। ইংরেজি বাংলা দুইডা ভাষাতে সুন্দরভাবে পড়াইবার পারতেন। হরিদাস ভট্টাচার্য ফিলসফির মাস্টার আছিলেন। অগাধ পাণ্ডিত্য! তাঁরাও টাকাপয়সার দিকে নজর আছিল না। মাঝে মাঝে হুমায়ূন কবির ভাইভা নিতে অইলে তার বাড়িতে থাকতেন। হরিদাসবাবুরে জর্জ দ্যা ফিফথ লেকচার দিবার জন্য ডাকা অইল। তাঁর আগে এই লেকচার দিছিলেন অলডাস হাক্সলি। এ্যালডাস হাসিকলির কথা সকলে কয়, হরিদাস বাবুরে মনে রাখছে কয় জন।
আমি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কথা ওঠালাম।
রাজ্জাক স্যার বললেন, শহীদুল্লাহ সাহেব যে বিষয়ে পিএইচডি করছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইংরেজ ভাইস চ্যাঞ্চেলর মনে করতেন, শহীদুল্লাহ সাহেবের সে বিষয়ে কাজ করার যোগ্যতা আছিল না।
আমি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অন্যবিধ কীর্তির প্রতি স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করলাম, দেখলাম তিনি সে বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী নন।
আমরা ওঠবার চেষ্টা করছিলাম। স্যার অনেক কথা বলে ফেলেছেন। এরই মধ্যে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। টের পাচ্ছিলাম, কথা বলতে তাঁর হাফ ধরে যাচ্ছে। আমাদের খারাপ লাগছিল। আমরা তাকে কষ্ট দিচ্ছি। কিন্তু শেষ মুহুর্তে স্যার আবার মুনীর চৌধুরীর কথা ওঠালেন।