১৫. সিংহদের অট্টালিকার নীচমহলের কর্তৃত্ব

সিংহদের অট্টালিকার নীচমহলের সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব দিবাকরের স্ত্রী সোহাগবালার হাতে।

দিবাকর এ বাড়ির গোমস্তাই শুধু নয়, রামকমল সিংহের দক্ষিণহস্ত স্বরূপ। সে দিনকে রাত এবং রাতকে দিন করার কাজে পরম দক্ষ। আপনাভোলা রামকমল সিংহকে সে পোস্তার হাটে বিক্রয় করে আবার কুলিবাজার থেকে ক্ৰয় করে আনার ক্ষমতা রাখে, নেহাৎ বিধুশেখরের তীক্ষ্ণ নজরের জন্যই তা সম্ভব হয় না। বিধুশেখরকে দিবাকরের মতন ধুরন্ধর ব্যক্তিও ডরায়। দিবাকর যে তার স্বগ্রাম জয়নগরে পাকা কোঠাবাড়ি বানিয়েছে এবং প্রতি বছরই বিঘের পর বিঘে জমি খাস করে ভূসম্পত্তি বাড়াচ্ছে, তা বিধুশেখরের অজানা নেই। বিধুশেখর মনে করেন, চাকর-কর্মচারীদের খানিকটা চুরির প্রশ্রয় না দিলে ঠিক কাজ আদায় করা যায় না। তবে মাঝে মাঝে হুঁশিয়ারি দিতে হয়।

অকস্মাৎ হয়তো একদিন দিবাকরকে ডেকে বিধুশেখর বলেন, এবার গাঁয়ে গিয়ে কি পুকুর কাটালে নাকি হে, দিবাকর?

দিবাকর কেঁপে ওঠে। এ বুড়োর কানে সে খবরও পৌঁছে গেছে? তার পশ্চাতে কাকে যে চর লাগানো হয়েছে, তা দিবাকর কিছুতেই ধরে উঠতে পারে না।

বিধুশেখর হাত তুলে তাকে অভয় দিয়ে বলেন, তা বেশ করেচো। গাঁয়ে একজন পুকুর কাটালে পাঁচজনের উবগার হয়। তা পুকুর উচ্ছগু্য করতে হয় জানো তো? কার নামে উচ্ছগু্য করলে?

দিবাকর চট করে উত্তর দেয়, আজ্ঞে, আমাদের কত্তার নামে!

–পাগল হোয়েচো নাকি! জ্যান্ত মানুষের নামে উচ্ছুগ্যু হয়? কেন, তোমাদের গৃহদেবতা নেই? পুকুর কেটোচো আর মা কালীর প্রতিষ্ঠা করোনি?

দিবাকররা বৈষ্ণব। তাদের বাড়িতে কালী পুজো হয় না, এমনকি অন্যত্র ঐ অনুষ্ঠানে সে প্ৰণাম দিতেও যায় না।

সে বললো, সাত পুরুষ ধরে আমাদের বাড়িতে নারায়ণের পুজো হয়।

—বলোনি তো সে কতা আগে কখনো। থাউকো খাতায় তোমার নামে পঞ্চাশ টাকা লিখিয়ে নিও, আমি রামকমলকে বলে দেবোখন। সেই টাকায় ঠাকুরের মাতায় একটা সোনার মুকুট গড়িয়ে দিও!

দিবাকর বুঝতে পারে না, বিধুশেখর কোনদিক থেকে প্যাঁচটা কষলেন। তবে এটা যে এক প্রকার সতকীকরণ, তা বুঝতে কোনো ভুল হয় না। পুকুর কাটার খরচ কোথা থেকে জোগাড় করলো, সে প্রশ্ন না তুলে অযাচিতভাবে পঞ্চাশ টাকা বখশিস! দিবাকর চলে ডালে ডালে তো বিধুশেখর চলেন পাতায় পাতায়।

কিন্তু অন্দরমহলের নীচতলায় সোহাগবালার ক্রিয়াকলাপের হদিশ বিধুশেখরও পান না। সেটা একটা পৃথক জগৎ।

বাড়িতে শুধু দাসদাসীর সংখ্যাই আঠারো, এছাড়া রয়েছে নিজস্ব রাজক, গোয়ালা, মালি, পাঁচক, দ্বারবান, পালকি-বেহারি ও সহিস। দাসদাসীরা পৃথক পৃথক কাজের জন্য নির্দিষ্ট। খোদ কর্তার জন্য তিনজন, গিন্নীমার তিনজন, দুই পুত্রের জন্য চারজন, এছাড়া কর্তার বিধবা ভ্ৰাতৃবধু, পিসী ইত্যাদির জন্যও একজন করে রয়েছে। একজন অন্যের কাজ করবে না। এই তো কর্তার মা মারা গেলেন গত বছর, তাঁর দুজন নিজস্ব দাসী এখনো রয়ে গেছে। পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকে, তাদের জন্য কাজ খালি নেই।

এ বাড়িতে দুই হেসেল। একটি ওপরতলার কর্তাদের জন্য, অন্যটি আশ্রিত পরিজন ও দাসদাসীদের। এর মধ্যে দ্বিতীয় হেঁসেলটি সম্পূৰ্ণ সোহাগবালার করায়ত্তে। সোহাগবালার দাপটে তার মুখের ওপর কেউ রা কাড়তে পারে না।

বাড়ির পেছনে মস্ত বাগান, গোয়াল ঘর ও পুষ্করিণী। বাগানের এক পাশে সারি সারি গোলপাতার ঘর, তার পেছনে কয়েকটি খাটা পায়খানা। এ গোলপাতার ঘরগুলি দাসদাসীদের। তার একটি ঘর থেকে প্রতিনিয়ত কান্নার স্বর ভেসে আসে।

গঙ্গার ঘাট থেকে বিম্ববতী এক মা আর ছেলেকে কুড়িয়ে এনেছেন। স্ত্রীলোকটির স্বামী হারিয়ে গেছে আর মেয়ে মারা গেছে শুনে চক্ষের জল ফেলেছেন তিনি। তারপর সোহাগবালাকে ডেকে নির্দেশ দিয়েছেন, এখন থেকে ওরা এ বাড়িতেই থাকবে।

প্রথম দিন থেকেই ওদের অপছন্দ করেছে সোহাগবালা। নতুন কোনো আশ্রিত এলেই তার এই মনোভাব হয়। অন্যান্য আশ্রিতরাও বিষচক্ষে দেখলে থাকোমণি আর দুলালচন্দ্ৰকে। আশ্রিতদের ধর্মই এই ওপর মহল থেকে করুণা কণা পাবার প্রতিযোগিতায় তারা পরস্পরকে হিংসে করে। মরে গেলেও একজন আর একজনকে সাহায্য করবে না।

নবাগতদের শায়েস্তা করবার জন্য সোহাগবালার নিজস্ব কিছু প্রক্রিয়া আছে। গিন্নীমা তো কয়েকদিনের মধ্যেই ওদের কথা ভুলে যাবেন। তখন সোহাগবালা ওদের ওপর এমন অত্যাচার চালাবে যে কিছুদিনের মধ্যেই ওরা বাপ বাপ বলে পালাবার পথ পাবে না। তবে প্রথম কয়েকদিন একটু তোয়াজ করতে হবে, হঠাৎ গিন্নীমার টনক নড়লে আর রক্ষে নেই। মাগীটা দিনরাত পা ছড়িয়ে বসে ড়ুকরে ড়ুকরে অলক্ষুণের মতন কাঁদে। আর যেন কারুর স্বামী হারায় না। দুনিয়ায়। আর যেন কারুর মেয়ে মরে না। স্বামীটা হারিয়েছে না। ওদের ফেলে পালিয়েছে তার ঠিক কী? আর ছেলেটাও মায়ের পাশে বসে ঘ্যানোর ঘ্যানোর করে। খেতে ডাকলেও আসে না। যেন নবাবের বেটী, ওদের ঘরে গিয়ে খাবার দিয়ে আসতে হবে।

লোক পাঠিয়ে ছেলেটাকে জোর করে ধরে আনালে সোহাগবালা। খালি গা, সামান্য একটি নেংটি পরা, বছর ছয়েক বয়েস দুলালচন্দ্রের, শরীরে এখনো গ্ৰাম্য শ্যাওলা লেগে আছে মনে হয়। চোখ দুটি জলে-পড়া বালকের মতন।

দালানে একটা ছোট জলচৌকির ওপর বসে সোহাগবালা, সামনে পানের সরঞ্জাম ছড়ানো। প্রতিদিন সকাল থেকে দু প্রহর বেলা পর্যন্ত এখানে বসে থেকে সে সবদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখে আর মুখের মধ্যে সমানে পানের জাবর কাটা চলতে থাকে। তার শরীরখানি অতিশয় পৃথুলা, পাতলা শাড়ি ভেদ করে তার বিশাল দুই বুক ও কোমরের চর্বির স্তর স্পষ্ট দেখা যায়। ফস মুখখানিতে যেন গনগনে চুল্লির আঁচ।

দুই ভৃত্য দুলালচন্দ্ৰকে ধরে এনে সামনে দাঁড় করাবার পর সোহাগবালা একবার আপাদমস্তক দেখলে তাকে, তারপর পাশের পিকদানিতে লাল থুতু নিক্ষেপ করে বললো, তোরা মায়ে পুতে ভেবেচিস কী, অ্যাঁ? ডেড় মাস হয়ে গেল, এখুনো বসে বসে কাঁদবি? হাতে করে কুটোটি নাড়ারও নাম নেই!

দুলালচন্দ্ৰ ভয়ে সিঁটিয়ে রইলো। কী উত্তর দেবে সে জানে না।

সোহাগখালা বললো, এই, তোরা এই ছোঁড়াকে কাজে লাগিয়ে দে আজ থেকে। এক গামলা জল আর একটা ন্যাতা দে। ওকে, এই দালানটা পুঁছুক।

যদিও একাজের জন্য অন্য লোক আছে, তবু দাসদাসীরা এই বালকটিকে কাজে নিয়োগ করতে বেশ উৎসাহী হয়ে উঠলো। তক্ষুনি এসে গেল মাটির গামলায় জল ও পাটের ন্যাত। এক দাসী জলে ভেজানো ন্যাতাটা দুলালচন্দ্রের হাতে তুলে দিয়ে বললো, আবাগীর ব্যাটা ডাঁইরে ডাঁইরে দেকচিস কী! নে, পৌঁছ। গোমস্তা-মা রেগে গেলে তোকে কাঁচা খেয়ে ফেলবেন!

দুলালচন্দ্ৰ দালান মুছতে শুরু করে দিল। এ কাজে সে খুব একটা অসুখী হলো না, কারণ দিনের পর দিন অন্ধকার ঘরে বসে মায়ের কান্না শুনতে শুনতে তারও একঘেয়ে লাগছিল। এখানে তবু কতরকমের মানুষ।

উঠোনের ওপর ধপাস ধপাস করে ফেলা হলো দুটো বড় বড় কাতলা মাছ। মাছ দুটি দাপটের সঙ্গে লাফাতে লাগলো। কয়েকবার। মস্ত বড় বঁটি নিয়ে বসে গেল দুজন। সোহাগবালা দূর থেকে বসে নির্দেশ দেয়, মুড়ো দুটো সরিয়ে রাখ-কত্তাবাবু বাড়ি নেই, ওপরের হেঁসেলে মুড়ে যাবে না। পেটি আর গাদার মাচ আলাদা রাখ, পরে টুকরোগুলো আমায় গুণে দেকাবি.দূযোধন, তুমি এখেনে হাঁ করে ডাঁড়িয়ে কী দেকচো? দুধটা ক্ষীর করেচো? যাও আগে সেটা করো গো-হাঁ লা পাঁচী, গিন্নীমার পাখিদের ছোলা দিইচিলি ওপরে? দিসনি এখনো-ওমা তোদের নিয়ে কি কর্বো–মরণ আমার-এক মন ছোলা এয়েচে এ মাসে। এবং মধ্যে ফুইরে গ্যালো-পাখির বদলে কি হাতিকে ছোলা খাওয়াচ্চিস?

পাঁচী উত্তর দিল, এক মণ কোতায় গো, ফড়ে মিনসে যে আদ মণ মেপে দিয়ে গ্যালো…। সাহাগবালা প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললো, তোর মাতা! চুনীর বাপ নিজে এক মণের কতা বলেচে, আমি নিজে দেকে নিইচ আর তুই আমায় চোখ ঠারাবি! ইন্দিকে আয়, আয় ইদিকে—

এইসব ডামাডোলের মধ্যে দুলালচন্দ্ৰ এক কাণ্ড করে বসলো। জলভর্তি অত বড় মাটির গামলাটা সে টেনে টেনে সরাতে পারে না, একবার জোরে হ্যাঁচকা টান দিতেই সেটি উল্টে গিয়ে দ্বিখণ্ড হলো, সমস্ত জল গড়িয়ে গেল উঠোনে, মাছ-কাটা লোকগুলো, আ মোলো, আ মোলো বলে চেঁচিয়ে উঠলো।

সোহাগবালা বললো, দেকেই বুঝিচিলুম। অলুক্ষণে ছেলে।! দিলে তো সব নষ্ট করে। এই নকুড়, দে তো। ওর কান ধরে দু থাবড়া!

ছেলের টানে টানে এই সময় থাকোমণি এসে উপস্থিত সেখানে। তার ছেলে মার খাচ্ছে দেকে সে ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং ছেলেকে সরিয়ে এনে জুড়ে দিল মড়াকান্না, ওগো, ওর বাপ নেই গো! ওর বাপকে খুঁজে দাও তোমরা—

সোহাগবালা বিস্ময়ে আতঙ্কে চোখ কপালে তুলে ফেললো একেবারে। মাগীর এত বড় সাহস, অন্দরমহলের দালানে এসে কাঁদছে। এই কান্নার শব্দ একবার ওপর মহলে পৌঁছলে আর উপায় আছে?

সোহাগবালা বলে উঠলো, ওরে, মাগীটাকে শিগগির থামা, মুখে নুড়ো ওঁজে দে, ওর থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দে, কী সকবনেশে রে বাবা, আমাদের সববাইকে ধমক খাওয়াবে।

সত্যিই দুজন ভৃত্য থাকোমণির মুখ চেপে ধরে চিৎ করে শুইয়ে ফেললো মাটিতে। থাকোমণি মুণ্ডকাটা পাঠার মতন ছটফট করতে লাগলো—

সোহাগবালা নিজের আসন ছেড়ে কখনো ওঠে না। আজ সেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ওদের কাছে এসে বললো, দ্যাকো বাছা, এ বাড়িতে যদি প্ৰাণ নিয়ে টিকতে চাও, তাহলে কক্ষনো টু শব্দটি কর্বে না। ফের যদি কোনোদিন চিল্লানি শুনি তাহলে জ্যান্ত হাত পা বেঁধে পুকুরে ফেলে দেবো। এই বলে রাকলুম।

চাকর দুটি তাকে ছেড়ে দেবার পর থাকোমণি চোখের সামনে সেই ভীমা মূর্তি দেখে আর কথা বলার সাহস পেলো না। বিস্ফারিত চক্ষে তাকিয়ে রইলো। এরা যে যে-কোনো মুহূর্তে তাকে বা তার ছেলেকে মেরে ফেলতে পারে, এই বোধ তার তৎক্ষণাৎ হয়ে গেল।

সোহাগবালা আবার বললো, দ্যাকো তোমার ছেলের কিত্তি! সামান্য এই বারোণ্ডাটা পুঁছতে বলিচি আর অমনি এই গামলাটা ভেঙে ফেললে গা? এর দাম কে দেবে? গতর দিয়ে শুধতে পারো তো ভালো, নইলে তিনবেলা খাওয়া বন্দ।

অর্থাৎ সেদিন থেকে থাকোমণিকে লাগিয়ে দেওয়া হলো দালান মোছার কাজে। তিন মহলা বাড়ির একতলায় মোট আটটি দালান, সবই মুছতে হবে তাকে। ঠিক ঝকঝকে তকতকে হলো কিনা, তা দেখবার জন্য সোহাগবালা মাঝে মাঝেই এক একজনকে তদারকে পাঠায়। সে আবার নিজের কাজ দেখাবার জন্য অদৃশ্য ছোপের দিকে আঙুল নির্দেশ করে থাকোমণিকে পুরো দালানটি আবার মুছতে বাধ্য করে। অথবা সে সোহাগবালার কাছে নালিশ জানায় যে থাকোমণি একই ময়লা জলে বারবার ন্যাত ডোবায়, প্ৰত্যেকটি দালানে গিয়ে সে গামলার জল বদলে নেয় না।

বকুনি ও চড়চাপড় খেতে খেতে থাকোমণি ক্রমশ অভিজ্ঞ দাসী হয়ে উঠলো। সে বুঝে গেছে যে এ বাড়িতেই তার নিয়তি তার জন্য অন্ন বরাদ্দ করেছে। এ বাড়ির বাইরে সে এক পা দিতেও সাহস করে না। এই নগরীতে প্রথম দিন আসার স্মৃতি মনে পড়লেই তার বুক থরথর করে কাঁপে।

থাকোমণির বুকের অশ্ৰুসাগর শুকিয়ে গিয়ে এখন সেখানে খর মরুভূমি। সে আর কাঁদে না। সে আর তার স্বামী ত্ৰিলোচন দাসকে খুঁজে পাবে না, এমন বদ্ধমূল বিশ্বাস তার জন্মে গেছে। ভিনকুড়ি গ্রামের খালাধারে একটি ছোট মাটির বাড়ি, তার স্বামী-শ্বশুরের ভিটে, পিছন দিকে এক লপ্তে ধান জমি, বাড়ির সামনে পাশাপাশি দুটি জাম গাছ, পেছন দিকে সার বাঁধা দু গণ্ডা সুপুরি গাছ, একটি পারিবারিক গোরু, এবং বৃষ্টির দিনে এ সব কিছুরই ওপর কাছে নেমে আসা আকাশ! এ সবই এখন স্বপ্নের মতন মনে হয়, যেন গতজন্মে ছিল। সেই স্বাধীন জীবনে সে আর কোনোদিন ফিরে যাবে না, এই অচেনা বাড়ির দাসীগিরি করেই তার সারা জীবন কাটবে। সে দাসী অথবা বৗদী। তার পুত্র তার বাপ-পিতামহের বৃত্তি যে চাষবাস, তা আর শিখবে না, সে-ও দাস হবে।

সারাদিন পরিশ্রমের পর থাকোমণি এক একদিন সন্ধ্যেবেলা তার ঘরের দরজার কাছে থুম হয়ে বসে থাকে। হয়তো তার মনে পড়ে ভিনকুড়ি গ্রামে তার নিজের সংসারের কথা, যত ছোটই হোক, তবু সে ছিল সেই সংসারের কর্ত্রী যত অভাবই থাক, তবু ছিল একটা অনির্দিষ্ট সুখ বোধ। কার অভিশাপে, কোন পাপে সেই সব কিছু ছারখার হয়ে গেল, তা সে আজও বুঝতে পারে না। কেন জমিদারের লোক এসে তাদের বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিয়ে গেল একদিন? কেন তার স্বামী সেই রাত্রে জল আনতে গিয়ে আর ফিরলো না।

দুলালচন্দ্র অবশ্য এ সব আর ভাবে না কিছুই। বালকদের বাল্যস্মৃতি থাকে না। তারা উপস্থিতকে নিয়ে বাঁচে। মাকে একলা ফেলে সে এই সময় পুকুর ধারে গিয়ে হাঁসগুলিকে আ চৈ চৈ চৈ চৈ বলে ডাকে কিংবা একটা সদ্যোজাত বাছুরের পেছনে পেছনে অকারণে দৌড়োয়।

পাশাপাশি অন্য ঘরগুলিতে যে সব দাস-দাসীরা থাকে তাদের কারুর সঙ্গেই থাকোমণির ঘনিষ্ঠতা হয়নি। তারা এখনো থাকোমণির দিকে আড়চক্ষে তাকায় এবং কথার ছলে হুল ফোঁটায়। বাবুদের বাড়ি থেকে চুরি করা জিনিসপত্রের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে তারা সর্বক্ষণ ঝগড়ায় মেতে থাকে। বস্তুত, কোলাহল, কুকথা ও খেউড়ই তাদের জীবনের প্রধান ব্যসন। এদিককার গোলমাল বাবুদের মহলের ওপরতলা পর্যন্ত পৌঁছোয় না, তাই নিজেদের ঘরে এসেই তারা জিভের অর্গল খুলে দেয়।

এই সব অন্য দাস-দাসীরাও এসেছে কাছাকাছি গাঁ থেকে। যারা দু-এক পুরুষ আগে ভূমিহীন হয়ে শ্ৰমদাস হয়েছে, তারা অনেক পোড় খেয়ে এখন ঘাগী। ভূত্যাতন্ত্রে বেশী দিনের অভিজ্ঞতার জন্য তারা গর্বিত এবং এই জন্যই নতুন দাস-দাসীদের তারা অবজ্ঞা করে, নিজেদের গ্রামীণ পরিচয় মুছে ফেলে তারা থাকোমণির মতন স্ত্রীলোকদের মনে করে গাঁইয়া ভূত।

প্রাসাদের পিছনের এই ভৃত্য-উপনিবেশটিতে জন্ম, মৃত্যু কিছুই থেমে থাকে না। সব কিছু চলে আপন নিয়মে। বিবাহ এখানে একপ্রকার নিষিদ্ধ বলেই ব্যভিচার চলে প্রবলভাবে। ওসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। একমাত্র ঝগড়ার সময়ই জানা যায় যে, কে কার নাঙ আর কোন মাগী শতেক ভাতারী। তবে ব্যভিচার যতই চলুক, কোনো নারীর পক্ষে গৰ্ভবতী হওয়া এখানে সাঙ্ঘাতিক অপরাধ। এবং সে দায় শুধু নারীদের বলেই সব শাস্তি তাদেরই প্ৰাপ্য। কেউ গর্ভবতী হলেই অমনিসেই গোলপাতার ঘরের অন্ধকারেও সমাজ এসে উঁকি মারে। বিধবা কিংবা কুমারীর পেটে সন্তান? ওকে দূর করে দাও, ওকে পিটিয়ে মারো! অন্য দাস-দাসীরাই সমাজের প্রতিনিধি হয়ে এই শোরগোল তোলে এবং যথাসময়ে সে কথা সোহাগবালার কানে ঠিক পৌঁছে যায়।

মাতু মাতু বলে একটি মেয়েকে ডাকে সবাই, তার আসল নাম কী, তা থাকোমণি জানে না। আঠারো উনিশ বছর বয়েস, হাতে লোহা নেই এবং সাদা থান পরে বলে বোঝা যায়। সে বিধবা, সেই মাতু একদিন ধরা পড়ে গেল। তার পেট হয়েছে, সে নাকি বাগানে বসে একটা ভাঙা মাটির হাঁড়ির চাড়া কড়মড়িয়ে চিবিয়ে খাচ্ছিল। তাহলে তো আর কোনো সন্দেহই নেই। ড়ুবে ড়ুবে জল খায় মেয়েটা, এতদিন কেউ কিছু টেরই পায়নি, আবার লোক দেখিয়ে একাদশীর দিন উপোস দেওয়া হতো! কার সঙ্গে হলো তোর আশনাই, বল? সবাই রসালে কাহিনীটি শুনতে চায়। মাতু প্ৰথমে কিছুতেই বলবে না। রান্নার ঠাকুর দুযোধন এই সব কথা বার করার ব্যাপারে খুব ওস্তাদ। মাতুর চুলের মুঠি ধরে সে তাকে দু-একবার শূন্যে তোলার চেষ্টা করতেই মাতুর প্রতিরোধ ভেঙে পড়লো। তৃত্যদের মধ্যে কেউ নয়, রাখুনামে বাগানের মালিই মাতুর প্রেমিক। কোন রাখু? যে তিন মাস আগে ছুটি নিয়ে দেশে যাবার নাম করে পালিয়েছে। তবে তো সে বখেরা চুকেই গেল!

সন্ধ্যেবেলা দেয়ালগিরি। আর রেড়ির তেলের লণ্ঠনগুলো জ্বালার আগেই অন্ধকার দালানে সোহাগবালা একগাছা মোটা দড়ি এনে দুজন ভৃত্যকে বললো, তোরা দু দিকে এটা ধর!

তারপর মাতুকে বললো, এবার লাপ। এদিক ঠেঙে লাপিয়ে এদিকে এসে পড়!

মাতুর তখন মধ্যপ্রদেশ রীতিমত স্ফীত। গমনাগমন আলস্য মাখা। সে হাপুস নয়নে কেঁদে বললো, আমি পারবো না, পারবো না, গোমস্তা-মা তোমার পায়ে ধরচি।

সোহাগবালা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে সেই অন্ধকারেও যেন চোখ জ্বালিয়ে বললো, ঠেঙিয়ে তোর বিষ ঝেড়ে দোবো! হারামজাদী, তোর নজ্জা করে না! ফের কতা! লাপা বলাচি, লাপা!

মাতু তখনও দ্বিধা করছে দেখে সোহাগবালা নিজেই ঠাঁই ঠাঁই করে দুখানা চড় মারলো তার গালে।

শাড়ি পরে লাফানো যাবে না বলে মাতুকে আগেই উলঙ্গ করা হয়েছে, এই অন্ধকারের মধ্যে কেউ তো দেখবে না, সুতরাং তার লজ্জারও কিছু নেই। আরও কয়েকবার চড়াচাপড় খাওয়ার পর সে বাধ্য হয়েই লাফাতে শুরু করলো। সোহাগবালা গুণতে লাগলো, এক-দুই-তিন।

ভৃত্যদের শেখানো ছিল আগে থেকেই। প্রথমে নীচু করে ধরে থাকা দড়ি একটু একটু করে তোলা হতে লাগলো ওপরে। এবং এক একবার ইচ্ছে করেই হঠাৎ বেশী উঁচু করে মাতুর পায়ে জড়িয়ে দিতে লাগলো, যাতে সে ধপাস করে আছড়ে পড়ে মাটিতে। সেই রকম এক একবার মাতু পড়ে যায় আর সবাই হেসে ওঠে।

একদিন পর একদিন বাদ দিয়ে এক পক্ষকালব্যাপী চললো এই ব্যায়াম প্রক্রিয়া। প্রথমদিন কুড়িবার, পরদিন পচিশ, তার পরদিন তিরিশ এইভাবে বাড়তে থাকে। কিন্তু এত করেও কিছু হলো না, মাতুর উদর হেতমপুরের কুমড়োর মতন ক্রমেই প্ৰকাণ্ড হতে লাগলো। সোহাগবালা মাতুর সেই স্থলে হাত রেখে অনুভব করে বোঝে যে মা-খাগী সন্তানটা দিব্যি নড়াচড়া করছে।

মাতু কেঁদে কেটে বলে, আমায় ছেড়ে দাও গো, গোমস্তা-মা। যেদিকে দু চোখ যায় আমি চলে যাই। তারপর আমার কপালে যা আছে হবে।

এত বড় অনাচারের কথা শুনে সোহাগবালা থ হয়ে যায়। কাঁচা বয়েসের বিধবা, পেটে একটা সন্তান নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াবে? ওকে যে শেয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খাবে! তাছাড়া, ধর্ম বলে কি কিছু নেই? যা খুশি করলেই হলো? মাতুর ভালোর জন্যই যে তার পেটের কাঁটাটা খসানোর চেষ্টা হচ্ছে, সে কথাও ও বোঝে না! ছোটলোকরা এমনই অকৃতজ্ঞ হয় বটে। সোহাগবালা বলে, তোর জিভ টেনে আমার ছিঁড়ে দিতে ইচ্ছে হয়, হারামজাদী! আগে এ কতা মনে ছেল না!

মাতুর পরবর্তী ব্যায়াম হলো গরম ভাতের ফ্যান ভর্তি গামলা মাথায় করে বয়ে নিয়ে যাওয়া। পেল্লায় আকারের গামলা, অত বড় জিনিসটা ভর্তি অবস্থায় একজনের পক্ষে বয়ে নিয়ে যাওয়াই দুষ্কর, সে গামলা তিনজন মিলে ধরাধরি করে চাপিয়ে দেয় মাতুর মাথায়, পুকুর ধার পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে ফ্যান ফেলে আসতে হবে। এর দু রকম সুযোগ। একে তো অত ভারী জিনিস বইলেই পেটের জিনিস নষ্ট হয়ে যায়, তা ছাড়াও, গামলা থেকে ফ্যান ছলকে পড়বেই মাটিতে আর সেই ফ্যানের ওপর পা দিলেই মাতু পা হড়কে পড়ে যাবে। গরম ফ্যান সমেত গামলা নিয়ে পড়ে গেলে আর মাতুর নিস্তার আছে? ও যদিও বা প্ৰাণে বাঁচে, পেটেরটা কিছুতেই বাঁচবে না।

কিন্তু কোথা থেকে যেন অমানুষিক শক্তি পেয়ে গেছে মাতু। অত বড় গামলা সে ঠিক বয়ে নিয়ে যায়, এবং অসম্ভব জেদের ফলেই যেন এক ফোঁট ফ্যানও ছলকে পড়ে না মাটিতে। দিনের পর দিন সে সোহাগবালা এবং অন্য সকলের প্রত্যাশা নষ্ট করে দেয়।

সোহাগবালা এবার নিল মোক্ষম ব্যবস্থা। আর দেরি করা চলে না, যে-কোনো দিন বাচ্চাটা ভূমিষ্ঠ হয়ে ট্যা ট্যা করতে পারে। চিত্তেশ্বরীর মন্দিরের কাছে একজন নামকরা দেয়াসিনী থাকে, তার কাছে এক বিশ্বস্ত ভৃত্যকে পাঠালো সোহাগবালা। সব দিক তো সোহাগবালাকেই সামলাতে হবে। কর্তাদের কানে যদি যায় যে, বাড়িতে বিধবা মেয়ে এমন অধৰ্ম করেছে, তাহলে তাঁরা সোহাগবালার ওপরেই দোষারোপ করবেন না? ঐ দেয়াসিনীর জড়িবুটি আগেও পরখ করে দেখা আছে সোহাগবালার, ফল একেবারে অব্যৰ্থ। ভৃত্যটি নিয়ে এলো কিছু শেকড়বাকড় আর তামাকের গুলির মতন কয়েকটি কালো কালো বড়ি। সব বেটে খাওয়াতে হবে একসঙ্গে, অর স্বাদের জন্য মেশাতে হবে একটু এখোগুড়। এরই জন্য মূল্য দিতে হলো নগদ তিনটি টিংকা।

মাতুকে কদিন ধরে চোখে চোখে রাখা হয়েছে, তবু সে পালিয়ে গিয়ে বসেছিল পুকুর পাড়ে। সেখান থেকে ধরে এনে তিন-চারজন মিলে তাকে চেপে মাটিতে শুইয়ে আর দুজনে জোর করে তার ঠোঁট ফাঁক করে ঢেলে দিল সেই কাথি। এবং এই প্রথম একটু নরম গলায় সোহাগবালা বললো, আর কোনো ভয় নেই বাছা, চুপ করে ঘুমিয়ে থাক, কাল সকালেই পেট খালাস হয়ে যাবে, দুদিন পরই আবার কাজকম্মো করতে পারবি।

সেই রাত্রেই মারা গেল মাতু। মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়েছে প্ৰায় তিন ঘণ্টা ধরে। শেষের দিকে সে ধড়ফড় করতে করতে বলছিল, ওগো, আমাকে একটু বাইরে নিয়ে যাও, আমি নাকে হাওয়া পাচ্ছি নি-ওগো…। কেউ নিয়ে যায়নি বাইরে। এক সময় সব শব্দ থেমে গেল। তার গর্ভের গোঁয়ার সন্তানটি তার পরেও কিছুক্ষণ বেঁচে ছিল কিনা কে জানে! হয়তো সে মাতৃগর্ভ ফুড়ে বাইরে আসবার চেষ্টা করেছিল, পারেনি।

এক দিন এক রাত সেই ঘরেই পড়ে রইলো মাতুর লাশ। তারপর ভোরবেলা ডেকে আনা হলো দুজন মুদ্দাফরাসকে। মাতুর দেহটা হোগলায় জড়িয়ে বাঁশে বেঁধে বুলিয়ে তারা ফেলে দিয়ে এলো গঙ্গায়। মাতুর ক্ষুদ্র জীবন কাহিনী এখানেই শেষ। কর্তাদের কানে এ খবর কিছুই পৌঁছালো না। শুধু দিন সাতেক পরে বিম্ববতীর বড় জা। হেমাঙ্গিনীর বাপের বাড়ি থেকে একজন আত্মীয় আসায় তার জন্য ধুতি কুচোতে দিয়ে হেমাঙ্গিনী তাঁর নিজস্ব দাসীকে বললেন, মাতু বলে একটা মেয়ে আচে না, তাকে ডাক বরং, সে বেশ ভালো কাপড় কুচোয়। হেমাঙ্গিনীর দাসী তখন সংবাদ দিল, সে তো নেই মা, সে মরে গ্যাচে! হেমাঙ্গিনী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ওমা, সে কী কতা! জলজ্যান্ত মেয়েটা কদিন আগেও দেখলুম। যে! দাসী তখন ফিসফিস করেণ জানালো যে মাতু কলঙ্কিনী হয়ে বিষ খেয়েছে! হেমাঙ্গিনী নাক কুঁচকোলেন। এ সব অপবিত্ৰ কথা কানে তোলাই পাপ। একটু পরেই তিনি প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলেন। ব্যস, মাতু একেবারে মুছে গেল ওপর তলা থেকে।

মাতুর পরিণতি দেখে খুব একটা বিস্মিত বা ভীত হয়নি থাকোমণি। তারও অভিমত এই যে, একে বিধবা, তায় কুলটা, এমন মেয়েমানুষদের তো এমন গতিই হয়। তবু যে পেটের সন্তানটাকে মেরে মাতুকে বাঁচিয়ে রাখার অনেক চেষ্টা করেছিল সোহাগবালা, তাতে প্রমাণিত হয় যে, বাইরে যতই বকাঝকা করুক, সোহাগবালার অন্তরে দয়ামায়া আছে। সে যাই হোক, কিন্তু ভূতের ভয় ধরে গোল থাকোমণির। মাতুর ঘরখানা ছিল তার পাশেই এখনো সেটা খালি পড়ে আছে। থাকে।মণি যখন-তখন মাতুকে দেখতে পায়। এক মুহূর্তে সে থাকোমণির দিকে চেয়ে ভয়ঙ্করভাবে হাসে, আবার পরের মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। এক একদিন মাঝ রাত্তিরে সে মাতুর ঘর থেকে গোঁ গোঁ শব্দ পায়। অমনি উঠে বসে থাকোমণি ভয়ে ঠকঠকিয়ে কাঁপে।

আশ্চর্য ব্যাপার, মাতুর প্রেতকে আর কেউ দেখতে পায় না। থাকোমণির চাঁচামেচি শুনে অনেক সময় অন্য দাস-দাসীরা ছুটে আসে, মাতুর শূন্য ঘরে উঁকি মারে, কিন্তু কেউ কিছু প্রমাণ পায় না। এ বাড়িতে আগে থেকেই একটি বাঁধা ভূত আছে। সন্ধের পর পাইখানার দিকে তাকে প্রায়ই দেখা যায়, অনেকেই দেখেছে। অধিকন্তু ন দোষায় হিসেবে মাতুর প্রেতীকেও অনেকেই মেনে নিতে রাজি ছিল, কিন্তু কিছুতেই সে অন্যদের কাছে ধরা দেয় না। একমাত্র শুধু থাকোমণির সামনেই সে মাঝে মাঝে এসে হাজির হয়, বুক কাঁপানো স্বরে হি হি করে হাসে এবং তারপরই মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে বলে, ওগো, আমি নাকে হাওয়া পাচ্চিনি, ওগো, আমায় একটু হাওয়া দাও-।

সেইজন্যই থাকোমণি সন্ধ্যেবেলা আর পারতপক্ষে ঘরের বার হতে চায় না। দুলালচন্দ্ৰকেও সে কাছে রাখতে চায়। কিন্তু দুলালচন্দ্ৰ শুনবে কেন? একটু সুযোগ পেলেই সে সুড়ৎ করে বেরিয়ে পালায়।

থাকোমণি কোনোদিন এ বাড়ির ওপর মহলে যায়নি। হুকুম নেই। বাড়ির কতা এবং গিন্নীমাদেরও সে দূর থেকে কয়েকবার মাত্র দেখেছে। স্বর্গে থাকেন দেবতারা, বাবুরাও প্রায় সেই রকমই দূরের মানুষ। অবোধ দুলালচন্দ্ৰ কিন্তু দু একবার চুপি চুপি ওপরে উঠে গেছে সিঁড়ি দিয়ে। সন্ধ্যের পর ঝাড়লণ্ঠনগুলি যখন জ্বলে দোতলায়, তখন যেন ঠিক বাদলা পোকার মতন সেই আলোয় আকৃষ্ট হয়ে দুলালচন্দ্ৰ ওপর মহলে একটু দেখতে যায়। এজন্য ওপর মহলের দাস-দাসীদের কাছ থেকে সে তাড়া খেয়েছে কয়েকবার।

একদিন সে নবীনকুমারের চোখে পড়ে গেল। চিন্তামণি নবীনকুমারকে সন্দেশ খাওয়াচ্ছিল এমন সময় কে রে? কে রে? বলে উঠলো। সিঁড়ির মুখে একটি বিহ্বল কালো বালকের মুখ।

নবীনকুমার বললো, ওকে ডাকো! ওকে ডাকো!

চিন্তামণির কথায় দুলালচন্দ্র এগিয়ে এলো কাছে। নবীনকুমার বাটি থেকে একটা সন্দেশ তুলে বললো, এই নে!

চিন্তামণি তাকে নিষেধ করতেই নবীনকুমার তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠলো, হ্যাঁ দোবো! বেশ করবো! দুটো দেবো, তিনটে দেবো, চারটে দেবো!

নবীনকুমার নিজে থেকেই দুলালচন্দ্ৰকে বেছে নিল তার খেলার সাথী হিসেবে। যদিও তাদের বয়েসের বেশ তফাত। নবীনকুমারের সদ্য তিন পেরিয়েছে, দুলালচন্দ্রের সাড়ে ছয়। কিন্তু এ বাড়িতে তো আর কোনো অল্পবয়েসী ছেলেমেয়ে নেই। নবীনকুমার তাকে নিয়মিত নিজের ভাগের সন্দেশ খেতে দেয়।

নবীনকুমারের খেলাগুলোও ভারী অদ্ভুত। কোনোদিন সে দুলালচন্দ্রকে মাটিতে শুয়ে পড়তে বলে। তারপর সে তার বুকের ওপর উঠে দাঁড়ায়। সে মা কালী সাজবে। দুলালচন্দ্রের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে সে দু হাত ছড়িয়ে জিভ বার করে দেয়। কোনোদিন সে দুলালচন্দ্রকে উপুড় হয়ে শুয়ে ময়ুর সাজতে বলে। তখন তার পিঠের ওপর বসে নবীনকুমার হয় কার্তিক ঠাকুর। তার কোমরে গোঁজা কাঠের তলোয়ার।

সহজাত বুদ্ধিতেই যেন এই দুই শিশু জানে, কে প্ৰভু, কে ভৃত্য। দুলালচন্দ্র খুশী মনেই প্ৰভু-পুত্রকে পিঠে তুলে নেয় বা বুকে দাঁড়াতে দেয়। তার বদলে সে পায় অমৃতের আস্বাদযুক্ত সন্দেশ।

চিন্তামণি দাসী একদিন একটি সোনার বালা চুরি করে ধরা পড়েছিল। বিম্ববতী বহুদিনের বিশ্বস্ত পুরোনো দাসীকে সেই প্ৰথম অপরাধের জন্য ছাড়িয়ে দেননি বটে, কিন্তু ক্ষমা চাইয়ে নাকে খৎ দিইয়েছিলেন। সেই দৃশ্যটি নবীনকুমার দেখে ফেলে ও বেশ মজা পায়।

পরদিনই সে বললো, এই দুলাল, নাক খৎ দে তো!

দুলালচন্দ্ৰ নাকে খৎ দিতে জানে না। তখন নবীনকুমারই তাকে দেখিয়ে দিল, এই যে, এমনি করে…

সেই সময় তিনতলা থেকে নেমে এলো গঙ্গানারায়ণ। ছোট ভাইটিকে মাটির ওপর নাক দিয়ে থাকা অরভুত ভঙ্গিতে দেখে হেসে ফেললো সে। ও কি, ছোটুকু! ও কি! বলে ভাইকে কোলে তুলে নিল। কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে খুব প্রীতি করে গঙ্গানারায়ণ। তার দু গালে হামি দিয়ে আদর করলো।

নবীনকুমার বললো, আমি নাকখৎ শোকাচ্ছি ওকে!

গঙ্গানারায়ণ হো হো করে হেসে বললো, ও নাকে খৎ দিতে জানে না, আর তুই শিখে গেলি? এ তো ভারী মজার কথা!

গঙ্গানারায়ণের কোনো ব্যস্ততা ছিল, তাই বেশীক্ষণ না দাঁড়িয়ে সে চলে গেল।

নবীনকুমার দুলালচন্দ্রকে বললো, এইবার তুই দে!

দুলালচন্দ্ৰ মেঝেতে একবার নাকটা ঠেকালো। কিন্তু এ খেলাটা তার ঠিক পছন্দ হলো না। সে বললো, না ছোটবাবু, অন্য খেলা বলো।

কিন্তু নবীনকুমারের জেদ। একবার কিছু ধরলে সে তো আর সহজে ছাড়বে না। অবিলম্বে তার চিৎকার শুনে দৌড়ে এলো চিন্তামণি। দুলালচন্দ্ৰ নাকে খৎ দিতে রাজি হচ্ছে না। শুনে সে বললো, হতচ্ছাড়া ছেলে, কতা শুনচিস নি? ছোটবাবু তোকে নাকে খৎ দিতে বলেচে, এক্ষুনি দিবি! তোর সঙ্গে খেলে, এই না তোর কত বাপের ভাগ্যি!

সেই সময় দিবাকরও আসছিল ওপরে। সেও মামলাটি শুনে দুই ধমক দিল দুলালচন্দ্ৰকে। কানটি ধরে মুলে দিয়ে বললো, ছোটবাবুর হুকুমের যদি কোনো নড়াচড় হয় তো তোর গদোন যাবে, মনে রাকিস।

দুলালচন্দ্র মসৃণ দুগ্ধ-ধবল শ্বেত পাথরের মেঝেতে নাক খৎ দিতে লাগলো। একটু দিয়েই থেমে গেলে চলবে না। বারান্দার এক প্ৰান্ত থেকে অন্য প্ৰান্ত পর্যন্ত যেতে হবে। আবার সেইরকমভাবে ফেরা। নবীনকুমারের হাতে জগন্নাথ-ক্ষেত্রে থেকে আনা একটি রঙীন লাঠি, সেটা দিয়ে দুলালচন্দ্রের পেছনে মারতে মারতে সে খলখল করে হাসতে লাগলো। দুলালচন্দ্র একটু থামলেই সে আবার বলে, হাট, হ্যাট। চল রে, ঘোড়া, চলরে গাধা, চলরে ঘোড়া…

কী সুন্দর নবীনকুমারের কণ্ঠস্বর। সুরেলা, রিনিঝিনি! যে শোনে, তারই ওকে আদর করতে ইচ্ছে করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *