১৫
সার্পেন্টাইন লেনে একটা অন্ধকার কামরা ভাড়া নিয়ে শিবনাথের বন্ধু মোহিত কারবার আরম্ভ করেছিল। কার্ডবোর্ডের বাক্স তৈরি ক’রে পরে শ পাঁচশ হাজার করা হিসাবে সেগুলো এখানে ওখানে সাপ্লাই দেয়। বন্ধু হলেও শিবনাথ মোহিতের এই ব্যবসাটাকে খুব ভাল চোখে কোনদিন দেখেনি। বরং মনে মনে সে একটা নাক সিঁটকানো ভাব পোষণ করত। দিনরাত পরিশ্রম ক’রে জুতো আর গেঞ্জির বাক্স তৈরী করা, তারপর রোদে পুড়ে, জলে ভিজে কখনো রিক্সায় কখনো কুলির মাথায় চাপিয়ে সেগুলো বড়বাজারে, চীনাবাজারে নিয়ে যাওয়া, তারপর আবার মালের দাম আদায়ের জন্য হন্যে কুকুরের মত বগলে খাতা নিয়েই মহাজনদের দরজায় দরজায় ছুটোছুটি করা–শিবনাথ মনে মনে নাক-সিঁটকাতো এবং হাসত। নিজে যখন সে চাকরি করত, তখন তো বটেই, বেকার হবার পরও শিবনাথ মোহিতকে অনুকম্পা করা ছাড়া আর কিছু করত না। অবশ্য এদিকে অনেকদিন সার্পেন্টাইন লেনে শিবনাথ পা বাড়ায়নি এবং মোহিতের কারবারের অবস্থা কি দাঁড়িয়েছে সে খোঁজ করারও প্রয়োজনবোধ করেনি। আজও সে করত না। বৌবাজার ক্রশ করার সময় মোহিত হঠাৎ কোন্ দিক থেকে এসে শিবনাথের হাত চেপে ধরেছিল। শিবনাথ চমকে উঠে ঘাড় ফিরিয়ে প্রথমটায় মোহিতকে চিনতেই পারেনি। না পারার কারণ ছিল। মোহিতের মাথায় আর তৈলহীন রুক্ষ একবোঝা চুল গায়ে ময়লা খাকি হাফ শার্ট বা পায়ে মোটা চপ্পল ছিল না। সুন্দর চকচকে পাট করা চুল, ভাল ক’রে কামানো মসৃণ গাল, চাঁচা ঘাড়, সিল্কের পাঞ্চাবি, পেটেন্ট লেদার পাম্পশু, নরুণ-পাড় মিহি ধুতি, আঙুলে আঙটি, মুখে সিগারেট এবং শিবনাথ লক্ষ্য করল মোহিতের পিছনে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথায় একটা ঝুড়ি। ঝুড়িতে সবজি, ফল এবং আরো যেন কি কি, আর হাতে ঝুলছে এতবড় একটা মাছ।
‘তারপর, হাঁ করে তাকিয়ে দেখচ কি?’ মোহিত হাসে।
‘তারপর, কি খবর, বাজারে গিয়েছিলে?’ শিবনাথ প্রশ্ন করে।
‘হ্যাঁ।’ মোহিত ঘাড় নাড়ে। ‘বাজার-টাজার করার বড় একটা সময় পাইনে, আজ হঠাৎ ইচ্ছা হল,–তা ছাড়া,’ হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে মোহিত পিছনের লোকটিকে বলল, ‘এই তুই চলে যা,–আমি–আমার ফিরতে একটু দেরি হবে।’
‘চাকর?’
‘হুঁ।’ মোহিত বন্ধুর হাত ধরে আকর্ষণ করে : ‘এসো।’
‘বাসা কোথায়?’
‘স্কট লেন।’
‘কারবার বুঝি সেই সার্পেন্টাইন লেনেই আছে।’
মোহিত বন্ধুর চোখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে।
‘না, তোমার সামনেই–সার্পেন্টাইন লেনের ঘরে কুলোচ্ছিল না। এসো।’
শিবনাথ মোহিতের সঙ্গে আরও কয়েক পা অগ্রসর হ’ল। ঠিক বড় রাস্তা না। একটু ভিতরের দিকে একটা বাড়ির সামনে এসে দু’জন দাঁড়ায়। শিবনাথ চোখ তুলে প্রকাণ্ড সাইনবোর্ড দেখতে পেল : দি ইস্টার্ন কার্ড-বোর্ড বক্স ম্যানুফ্যাকচারার্স।’
দরজার সামনে দুটো লরি দাঁড়ানো এবং দুটো গাড়িতেই পাহাড়ের মত উঁচু করে কাগজের বাক্স সাজানো রয়েছে।
‘কারবার এখন বেশ বড় হয়েছে তোমার দেখতে পাচ্ছি।’ অস্ফুটস্বরে বলল শিবনাথ।
‘না, কোথায় আর বড়,–এসো।’
বন্ধুর হাত ধরে মোহিত সিঁড়ি বেয়ে দোতলার একটি ঘরে উঠে গেল।
‘তোমার আফিস ঘর?’ শিবনাথ প্রশ্ন করল।
‘হ্যাঁ, বসো।’
পর্দা, গালিচা, চেয়ার, টেবিল সাজানো সুন্দর ঘর। টেবিলের ওপর সুদৃশ্য পেপারওয়েট, পিন-কুশন, অ্যাশট্রে এবং ফুলদানির মাঝখানে গোল্ডফ্লেকের হলদে টিন। ঈর্ষান্বিত চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে শিবনাথ দেখল এবং অত্যন্ত সতর্কভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
‘তারপর, তোমার খবর কি, আছে কোথায়?’
‘এখানেই।’ শিবনাথ বেলেঘাটার উল্লেখ করল না এবং তার সম্পর্কে বন্ধু আর কোনো প্রশ্ন করতে না পারে তাই তাড়াতাড়ি শিবনাথ প্রশ্ন করল, তারপর বাড়ি খবর কি, বাচ্চা-কাচ্চা ক’টি হল?’
মোহিত হঠাৎ কথা বলল না। কেবল সিগারেটের টিনটা শিবনাথের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে টেবিলের কাগজপত্রগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। শিবনাথ একটা সিগারেট তুলে ধরায়।
‘চা খাবে?’–মোহিত কাগজ থেকে মুখ তুলল।
অল্প হেসে শিবনাথ মাথা নাড়ল।
মোহিত বেল্ টিপতে একজন বেয়ারা ছুটে এল। চায়ের কথা বলে দিয়ে যেন এবার বন্ধুর সঙ্গে ভাল ক’রে কথা বলতে মোহিত কাগজপত্রগুলো একদিকে সরিয়ে রেখে কৌটো থেকে সিগারেট তুলে মুখে গুঁজল।
‘তারপর? অনেকদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই। তুমি এখন কোন্ অফিসে?
শিবনাথ একটা মিথ্যা অফিসের নাম বলল এবং ঠোঁটের মৃদু হাসিটা না মুছে আস্তে আস্তে বলল, ‘চাকরিতে সুখ নেই ব্রাদার, ব্যবসা,–বিজনেস ছাড়া দিনের নাগাল পাওয়া যায় না।’
মোহিত কথা বলল না।
শিবনাথ সন্তর্পণে প্রশ্ন করল, ‘তারপর, গাড়িটাড়ি করেছ বুঝি?’
‘না-রে ভাই, না, না।’ মোহিত প্রবলবেগে মাথা নাড়ল। ‘যতটা ভাবছ–ততটা করতে পারিনি, কিছুই করা হয়নি।‘
চা এল।
মোহিত বলল, ‘হ্যাঁ’ কি বলছিলে, বাচ্চা? চা খাও।’
‘কি, নিজের মনে হাসছ?’ বাটিতে চুমুক দিয়ে শিবনাথ মুখ তুলে মোহিতের চোখের ভিতরে তাকায়। ‘বলতে লজ্জা করছে নাকি, আমার কিন্তু অই একটিই,–একটা মেয়ে।
‘আমার একটিও না।’ মোহিত শিবনাথের চোখের ভিতরে তাকাল। শিবনাথ লক্ষ্য করল, মোহিত হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে গেছে।
‘কেন’, প্রশ্ন করতে করতে শিবনাথ থেমে গেল।–
বাটিতে দীর্ঘ চুমুক দিয়ে মোহিত একটা লম্বা নিশ্বাস ছাড়ল।
‘একটি সন্তান হবে সেই সুযোগ আমাদের জীবনে এল না।’
শিবনাথ মোহিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘দুঃখ ভাল, বুঝলে ব্রাদার, যতদিন দুঃখে ছিলাম জীবন একরকম মন্দ ছিল না। বলে মোহিত অল্প হাসল।
‘এখন সুখ পেয়ে কি অশান্তি হচ্ছে’, প্রশ্নটা ঠোঁটের আগায় এনেও শিবনাথ চুপ করে রইল। মোহিত বলল, –’বরং যখন দরিদ্র ছিলাম, অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটত, আশা ছিল। তখন ইচ্ছা ক’রে সন্তান আনিনি। বার্লির জল খাইয়ে বাচ্চা মানুষ করার আইডিয়াকে আমরা বরাবর ঘৃণা করতুম।’
‘আজ?’ শিবনাথ প্রশ্ন করল।
‘আজ সুখে থেকে সুখে খেয়ে বৌ অন্য রকম বুলি শিখেছে। আজ সে সন্তান চাইছে না, তার শরীর খারাপ হবে, চেহারা ভাঙ্গবে, সময়ের আগে বুড়িয়ে যাবে, এই দুর্ভাবনা।’
‘কি চাইছে তবে?’ এবার শিবনাথ মুখ না খুলে পারলে না।
‘চাইছে শাড়ি গয়না জুতো ক্রিম পাউডার’–মোহিত হঠাৎ থামল
‘আর?’ শিবনাথ হাসে।
মোহিত হাসে না।
‘চাইছে, রোজ মাংস ভাত খেতে, আঙুর আপেল, ক্ষীর-ননী।’
শিবনাথ এবার কিছু প্রশ্ন না ক’রে টেনে টেনে হাসে।
‘আর চাইছিল ঘরের এক ফোঁটা কাজকর্ম না-করতে’, মোহিত বলল, দুটো চাকরে কুলোচ্ছিল না, আর একটা চাকর রেখে দিয়েছিলাম ইদানীং শ্রীমতীর জন্যে।
মোহিতের গলার স্বর শুনে শিবনাথ চমকে উঠল।
মোহিত স্বরটাকে তেমনি বিকৃত করে বলল, ‘প্রচুর সময় অবসর চাওয়ার অবশ্য কারণ ছিল তার। যথেষ্ট সময় না পেলে এবং যখন খুশি বাইরে বেরোতে না পারলে ইচ্ছামতন প্রেমসাগরে সাঁতার কাটা যায় না, সাদা কথাটা আশা করি তোমার বুঝিয়ে বলতে হবে না।’ চেয়ারের হাতল দুটো শিবনাথ শক্ত হাতে চেপে ধরল এবং হাঁ-করে বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
মোহিত নতুন সিগারেট ধরালো। একটু সময় চুপ থেকে পরে আস্তে আস্তে বলল, ‘কাজেই বাচ্চার বাপ হওয়া আমার আর হ’ল না।’
‘এখন’, ঢোক গিলে শিবনাথ কি যেন বলতে চেষ্টা করল। কিন্তু তার আগেই মোহিত বলল, ‘সাঁতার-কাটা এদিকে খুব বেড়ে গিয়েছিল। তাই সেদিন মায়াকে আমি বুঝিয়ে বললাম, ‘এটাকে স্বামী-স্ত্রীর জীবন বলে না। বেশ তো, রাত দুটোর আগে তোমার যদি ঘরে ফেরার সম্ভব না হয় তো তুমি আলাদা থাক। আমার আপত্তি নেই। বরং তখন কোনো রাত্রে ঘরে ফেরা যদি সম্ভব না-ও হয় আর একজনের কাছে জবাবদিহি করার হাঙ্গামা থেকে রেহাই পাবে।’
এবার শিবনাথ অল্প হেসে প্রশ্ন করল, তাতে তিনি কি বললেন, তোমার স্ত্রী?’
‘রাজী হ’ল। মায়া আর এখন আমার সঙ্গে নেই তো। পার্ক-সার্কাস না কোথায় আছে ঠিক বলতে পারব না,–অর্থাৎ পা বাড়িয়েই ছিল, কেবল আমার একটা কথা, একটু বলার অপেক্ষা। ব্যস, যেদিন বললাম তার পরদিনই ও তার জিনিস-পত্তর নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে।’
একটা লম্বা নিশ্বাস ছাড়ল শিবনাথ।
প্রসঙ্গ শেষ ক’রে মোহিত যে খুব একটা গম্ভীর বিমর্ষ চেহারা ক’রে চুপ ক’রে রইল তা না। বেশ একটু উৎফুল্ল গলায় পরে বলল, ‘জল যেদিকে গড়াবার সেদিকে গড়াতে দিয়ে আমিও শান্তিতে আছি ব্রাদার।’
‘তুমি এখন’…শিবনাথ বলতে ইতস্ততঃ করল।
‘আমিও এখন আর একটিকে নিয়ে আছি, রক্ষিতা,–হ্যাঁ, তা-ই বলব, বলতে আমার লজ্জা করে না। কেন করবো বলো, দুঃখ ভুলতে কেউ যখন মদ খেতে আরম্ভ করে, তখন কি আর সে একথা ভেবে লজ্জা পায়, না ভয় করে যে, লোকে তার মুখের গন্ধ টের পাবে? এ-ও তেমনি। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুরা, এখানে আমরা কর্মচারীরাও জানে মোহিত রায় একটা বেশ্যাকে নিয়ে আছে। বাঁচতে হলে একটা নেশার দরকার, কি বল?’ মোহিত শব্দ ক’রে হাসল।
শিবনাথ নীরব।
একজন, খুব সম্ভব কর্মচারী, কি একটা কাগজ হাতে ক’রে মোহিতের সামনে এসে দাঁড়াল। কাগজটায় মোহিত সই ক’রে দিতে লোকটি আবার বেরিয়ে গেল। আকাশের আলোর জোর কমে গেছে, জানালায় চোখ পড়তে শিবনাথ টের পেল এবং ঠিক সেই মুহূর্তে সে লক্ষ্য করল বেয়ারা ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলে।
‘তারপর, কোনদিকে যাচ্ছিলে?’ মোহিত চোখ তুলল।
‘এই এমনি একটু বেড়াতে বেরিয়েছিলাম।’ শিবনাথ টিন থেকে আর একটা সিগারেট তুলল।
সিগারেট ধরিয়ে শিবনাথ কি যেন একটু চিন্তা করল। বস্তুতঃ নিজের স্ত্রী সম্পর্কে এত সব ব’লে এবং এখন সে কিভাবে জীবন যাপন করছে তা-ও বন্ধুর কাছে সগর্বে ঘোষণা ক’রে এমন মোহিত একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যে, শিবনাথ কথাটা বলতে আর ইতস্ততঃ বোধ করছিল না। এমন কি বর্তমানে যে স্ত্রী-কন্যা নিয়ে টিনের ঘরে বাস করছে এবং বেশ অর্থকষ্টের মধ্যে আছে বন্ধুর কাছে এটা আর গোপন না করলেও বিশেষ কিছু এসে যেত না। তার চেয়ে মোহিতের দুঃখ অনেক বেশি, মনের অবস্থা তার আরও খারাপ শিবনাথ অনুমান করতে পারল। কিন্তু তবু আর একবার চিন্তা করে শিবনাথ সে সমস্ত কথা একেবারে চেপে গেল। বরং হেসে অন্যভাবে সে বন্ধুকে বিষয়টা খুলে বলল।
শুনে মোহিত ভ্রুকুঞ্চিত করল ও মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ বার করল।
‘তা, এতক্ষণ বলনি কেন, প্রথমেই তো তোমার দরকারী কথাটা বলা উচিত ছিল। ছি ছি,–আজেবাজে এতগুলো কথা ব’লে খামকা আমি তোমার সময় নষ্ট করলাম, কি মুশকিল! তা এখন তোমার স্ত্রী আছেন কেমন?’
‘এখন একটু ভাল। শ’দুই টাকা এক মধ্যে বেরিয়ে গেছে। ওষুধ ইঞ্জেকশন ফাঁক যাচ্ছে না! তারপর পথ্য, এটা-ওটা।’
‘তা তো যাবে। মোহিত গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। ‘অসুখটা কি বললে?’
‘বিকলাই ইনফেকশন ডাক্তার বলছে।’ শিবনাথ দেয়ালের দিকে চোখ ফেরায়। একটু থেমে থেকে পরে বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘বুঝতে পারছ, আমাদের চাকুরে জীবন। একেবারে ধরা-বাঁধা মাইনে, তার ওপর কি না হঠাৎ এই খরচের ধাক্কা–’ মোহিত কথা না কয়ে মনিব্যাগ খুলে গুণে গুণে পাঁচটা দশ টাকার নোট বার করে টেবিলে রাখল।
শিবনাথ কথা না কয়ে হাত বাড়িয়ে নোটগুলো তুলে তৎক্ষণাৎ ভাঁজ করে পকেটে পুরল।
একটু পর আস্তে আস্তে বলল, ‘সামনের মাসে হয়তো পারব না। তার পরের মাসে আমি টাকাটা তোমার ফিরিয়ে দিচ্ছি, ব্রাদার।’
‘আমি কি বলছি তোমাকে যে, পরের মাসেই আমার টাকাটা চাই। কি আশ্চর্য!’ মোহিত দেয়ালের দিকে চোখ ফেরালো। ‘সামান্য পঞ্চাশটা টাকা তোমার এই বিপদে যদি সাহায্য করতে না পারলাম তো–’
‘না না, সেকথা বলছি না’; অভিমানাহত বন্ধুকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করল শিবনাথ। ‘তুমি পার, তোমার ক্ষমতা আছে বলে আর কারোর কাছে না চেয়ে তোমার কাছেই তো চাইলাম।’
মোহিত নীরব।
‘আচ্ছা, উঠি আজ। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।’ শিবনাথ উঠে দাঁড়াল।
ডাক্তারের কি নাম, কোথায় ধাম, সেসব প্রশ্ন করার তিলমাত্র আগ্রহ মোহিতের চেহারায় না দেখে শিবনাথ আরাম পেল। ‘চলি’। আর একবার বললে সে।
মোহিত কথা না কয়ে শুধু ঘাড়টা কাত করল এবং তেমনি বাঁদিকের দেয়ালে চোখ রেখে কি যেন ভাবতে লাগল।
মোহিত কি ভাবছে চিন্তা ক’রে শিবনাথ অবশ্য মাথা খারাপ করল না। কী আর ভাববে। যে যার ভাবনায় অস্থির। নিজের অবস্থার কথাই চিন্তা করছে মোহিত। ভাবতে ভাবতে হৃষ্টমনে লম্বা লম্বা পা ফেলে সে বৌবাজারের পেভমেন্টে এসে দাঁড়াল। এই ধরনে একটা ভাবনায় মোহিত ডুবে আছে দেখেই তো শিবনাথ হুট্ করে তার কাছে পঞ্চাশটা টাকা চাইতে পারল। কথাটা চিন্তা করে শিবনাথ নিজের মনে হাসল। অবশ্য রুচির কাছে এসব কিছুই বলবে না, সে মনে মনে ঠিক ক’রে রাখল।
না, বলবে,–শিবনাথ ভাবল, মোহিতের গল্পটা রুচির কাছে বলার প্রয়োজন আছে। প্রচুর টাকা-পয়সা সচ্ছল দিনের মুখ যখন দেখতে শুরু করেছিল বেচারা, আর এক দিক থেকে চাপ চাপ অন্ধকার, স্তূপাকার মেঘ এসে ছেয়ে ফেলল জীবন, সুখ-শান্তি। টিনের ঘরে থাকতে পারছে না রুচি, মনের ভার কাটছে না, যেহেতু শিবনাথের চাকরি নেই। চাকরি, টাকা, ধন-দৌলত ….
কিন্তু কী তার দাম, কতটা তার আশ্বাস, অথবা শিবনাথ চিন্তা করল, ঘরে টাকাপয়সা না থাকলে রাত্রে চোখে ঘুম আসে না, টাকাপয়সা থেকে মোহিত কত ঘুমোতে পারছে!
ঘুমোচ্ছে বই কি! শিবনাথ আবার নিজের মনে হাসল। মেয়েটা দেখতে মোহিতের স্ত্রীর চেয়ে ভাল না কুৎসিত, জানতে একবার ইচ্ছা হয় বৈকি শিবনাথের। মোহিত দুঃখ ভুলতে মদ ধরেছে। মেয়ে-মদ। দুঃখ ভুলতে আর কে মদ ধরেছে, বেলেঘাটার বাসে বসে চিন্তা করতে করতে শিবনাথের কে. গুপ্তর চেহারাটা মনে পড়ল। বেচারা! মনে মনে অনুকম্পা করল সে লোকটাকে। তা তো বটেই। ওরা কে. গুপ্ত, বলাই, বিধু মাস্টার, অমল চাকলাদার শত মাথা খুঁড়লেও কারো কাছ থেকে একটা আধলা কর্জ আনতে পারবে না। বেশভূষা ছাড়াও ওদের এক একজনের চেহারার মধ্যেই এমন দৈন্যের ছাপ রয়েছে যে, একটা আধলা দিয়ে কেউ তাদের বিশ্বাস করতে পারছে না। মনে ক’রে শিবনাথ প্রতেকটি চেহারা স্বতন্ত্রভাবে মনের সামনে আনতে চেষ্টা করল, আর ভিড়ের মধ্যেও চেষ্টা ক’রে কষ্টেসৃষ্টে সে গাড়ির সামনের দিকে টাঙানো বড় আরশিটার মধ্যে নিজের মুখখানা দেখল। সুন্দর পরিচ্ছন্ন মসৃণ মুখমণ্ডল। পাঁচু ভাদুড়ী যত্ন করে কামিয়ে দিয়েছে। কত অভিজাত, কত ভদ্র এই চেহারা! না হলে শিবনাথ অত্যন্ত গর্ববোধ করল ভেবে, একবার, একটিবার মুখ থেকে কথাটা বার করতে মোহিত আজ এতগুলো টাকা তার হাতে তুলে দিয়েছে! কাজেই একটা সুবিধা হচ্ছে না বলে রুচি যতই রাগারাগি করুক, অভিমান করুক, শিবনাথ নিরাশ হবে না, হয়নি। হলে সে আর বিধু মাস্টারের মধ্যে তফাত থাকত কোথায়! চোখে-মুখে অন্ধকার দেখে নারিকেলডাঙ্গার ট্যুইশানিটা সে তাহলে নিতে পারত। একটা মাস কুকুরের মত খাটলে তবে কুড়িটা টাকা। শিবনাথ সর্বাঙ্গে শিউরে উঠল।
১৬
অনেকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবাই আগুন দেখল এবং নানারকম গল্প করল।
প্রথমটায় ‘আগুন’ শুনে সবাই চমকে ওঠে। বুঝি বা নিজের গায়ে আগুন লাগল, ঘরে, পাশের ঘরে, না, তা-ও না, পাশের বস্তিতে। ছুটোছুটি ঠেলাঠেলি ক’রে যে-যার ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে, এক লাফে উঠোন পার হয়ে রাস্তায়, রাস্তা ডিঙিয়ে বনমালীর দোকান লাগোয়া পোড়ো জমিতে, জাম গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ায় সব। দেখে নিশ্চিন্ত হল। বেশ দূরে, ডোমপাড়ায় আগুন। একটা ঘর শেষ হয়ে আর একটা এইমাত্র ভাল করে জ্বলতে আরম্ভ করেছে। ফরসা হয়ে গেছে চারদিক।
‘রাত্রির আগুন সুন্দর দেখায়।’
‘আগুন একটু দূরে থেকে দেখতেই ভাল। আকাশে যেন কে কুঙ্কুম ছড়িয়েছে।’
কে. গুপ্ত অল্প হেসে ঘাড়টা তেরচা ক’রে শিবনাথের দিকে চোখ রেখে বলল, ‘আপনার মধ্যে দেখছি মশাই বিস্তর কবিত্ব, কি ব্যাপার, কবিতা-টবিতা লেখার অভ্যেস আছে নাকি?’
‘না।’ শিবনাথ হেসে বলল, ‘অনেক আগে ছেলেবেলায় লিখতুম। তারপর বুঝতেই পারছেন, চাকরির ঘানিতে পড়ে সব গেছে –‘
কে. গুপ্ত আগুন দেখতে ঘাড় ফেরায় এবং তৎক্ষণাৎ, যেন অনেকটা নিজের মনে আবৃত্তি করল :
‘The wild fingers of fier are making corruption clean … ‘
কে. গুপ্ত থামতে, ওপাশে ছিল বিধু মাস্টার, বলল, ‘লরেন্স বিনিয়নের লেখা। আমরাও পড়েছি, আমাদের সময়েও সিলেকশনে ছিল।’
কথা বলল না কেউ। কে. গুপ্ত শিবনাথ, শিবনাথের পাশে বলাই, বনমালী, বনমালীর ওপাশে শেখর ডাক্তার, রমেশ রায়, অমল চাকলাদার, ক্ষিতীশ।
এখানে অনেকেই ইংরাজী কবিতার দু’ লাইনের মানেটি বুঝতে পারেনি অনুমান ক’রে বিধু মাস্টার হেসে বলল, ‘যা কিছু খারাপ, কুৎসিত,–আগুনে তা খেয়ে সাফ করে দিলে।’ তর্জমা ক’রে চুপ করে রইল।
‘ডোমেদের তুমি খারাপ কুৎসিত বলছ কোন্ হিসাবে?’ বেশ বিরক্ত হয়ে শেখর ডাক্তার প্রশ্ন করল। ‘আগে একথার উত্তর দাও তো শুনি?’
‘ওরা আমাদের চেয়ে ঢের ভাল খায়’, রমেশ রায় এখানে কোনো কোনো ভাড়াটেকে ঠেস দিয়ে কথাটা বলছে কিনা বোঝা গেল না। বলেই চুপ ক’রে রইল।
‘হ্যাঁ, ওরা ডেইলি মাছ খায়, মাংস খায়।’একটি যুবক বলল, ‘এবং ফুর্তি-টুর্তি এখনো ওদের মধ্যে আছে। বিয়ের সময়, পুজোর সময় সাত আট রাত গান গেয়েই জেগে কাটায়। আমরা পারি না।’
‘না, আমি ওদের এই যেমন থাকাটা নিয়ে বলছিলাম। প্রত্যেকটা ঘর ভেঙেচুরে যাচ্ছিল, পুরনো হয়ে গেছল খুব। আশেপাশে নোংরাও জমছিল বিস্তর। কেউ তো আর ওদের দিকে তাকায় না। এখন যদি নতুন করে ভাল ঘর-টর ওঠে, দেখতে আগের চেয়ে ভাল হবে। সেটাই আমার বক্তব্য।’
‘হেঁ হেঁ, নোংরা বলছেন, কুৎসিত বলছেন মশাই, ওই যে-ঘরটা এখন আরো বেশি দপদপ ক’রে জ্বলছে সেই ঘরেই একটা মেয়ে কাঞ্চি নাম। সকালবেলা আমাদের বাড়ির সামনে রাস্তা দিয়ে কাঞ্চি বাজারে যায়। দেখেছেন তার শরীর, চলা বলা, হাঁটার কায়দা? আমার তো মনে হয়, আমাদের ভদ্রলোকদের ঘরে এমন চমৎকার মেয়ে কম আছে।’
‘আপনি কি করাপশনের কথা বলছেন নাকি? আমাদের ভদ্রলোক বাবুদের ঘরে যত কেলেঙ্কারী হচ্ছে মশাই, ওদের জাতের মধ্যে তার ছটাকও দেখা দেয়নি।’
চারদিক থেকে এভাবে আক্রান্ত হ’ল বিধু মাস্টার। যেন আগে বুঝতে পারেনি। কথাটা বলে ফেলেই চুপ করে ছিল যদিও।
মাস্টারের মনের অবস্থাটা উপভোগ করতে করতে শিবনাথ মেয়েদের দিকে তাকায়। মনে মনে সে রুচিকে খুঁজছিল।
যদি ইতিমধ্যে মঞ্জুকে নিয়ে ফিরে এসে গিয়ে থাকে। এটাও ভাবছিল।
এখানে সেই রকম কাউকে দেখতে না পেয়ে শিবনাথ নিশ্চিন্ত হ’ল। জানে সে কোনো কোনো দিন রুচির, যদি কিছু জিনিসপত্তর কেনা-কাটা করার থাকে ফিরতে বেশ রাতই হয়।
আজ অবশ্য কি নিয়ে ফিরতে পারে সেটা অনুমান করতে পারল না শিবনাথ। তাতেই যা একটু অস্বস্তি বোধ করে নালাটা ডিঙ্গিয়ে সে রাস্তায় উঠে এল। কেউ কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে আগুন দেখছে। দুটি মেয়ে। একবার আগুনটা বেশ বড় হয়ে উঠতে জলপাই পাতার চিকরি-কাটা ছায়া-পড়া মুখ দু’টো চকিতে শিবনাথ দেখে থমকে দাঁড়ালো।
ওরা ঠিক আগুন নিয়ে গল্প করেছে কি না জানবার ইচ্ছাটাই যেন শিবনাথের প্রবল। তাই সে আর না হেঁটে দাঁড়াল। সিগারেটের ইচ্ছা হওয়া সত্ত্বেও সিগারেট ধরাল না। একটা গাছের আড়ালে ছিল সে।
‘তারপর? কি বললেন তিনি? আমার পরিষ্কার করে সব বল।’
‘প্রথম দিনই আমায় জুতো ও শাড়ি কিনতে টাকা দিলেন। এই একগোছা নোট। আমার ভীষণ লজ্জা করছিল নিতে।’
‘লজ্জা করলে চলবে না। বড়লোক মানুষ। বয়সও বিশেষ হয়নি। রুচি ও মেজাজে ক্ষুরের ধার। তার বাড়িতে সর্বদা যাওয়া-আসা করছ। সারাটা দুপুর সেখানে থাকতে হচ্ছে, একটু ভালভাবে, ফিটফাট না থাকলে চলবে না।’
চুপ করে রইল সেই মেয়েটি।
‘চাকরিটা যে তোমার আজই হয়েছে, সেজন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাও।
বয়োজ্যেষ্ঠা বলল, ‘ক’দিন ধরে আমায় বলছ কাজ দাও, কাজ দাও, তা জানো তো অফিসে-আদালতে ঘোরার সময় আমার নেই। তাছাড়া হাসপাতালে আট ঘণ্টা ডিউটি দিয়ে তারপর আর কোথাও যাবার ইচ্ছা ও ধৈর্য থাকে না। শেয়ালদায় ভাগ্যিস শিশিরবাবুর সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল, কাজেই তোমার কাজটি আজকেই হয়ে গেল।’
‘উনি বুঝি শিশিরবাবুর বন্ধু?’
‘হ্যাঁ, মিহিরবাবু, নাম মিহির ঘোষাল।’
‘অই একটি ছেলেই বুঝি ভদ্রলোকের?’
‘হ্যাঁ।’
‘আর বিয়ে করবেন না?’ .
‘জানি না।’
ছোট মেয়েটি একটু চুপ থেকে পরে আস্তে আস্তে বলল, ‘অবশ্য, তিনি বললেন, আমি যতক্ষণ তাঁর বাড়িতে থাকব, তিনি বাড়িতে থাকছেন না। কাজে বেরিয়ে যান।’
বোকা মেয়ে।’ বড় মেয়েটি বলল, ‘বাড়িতে থাকতে পারছেন না বলেই তো তোমায় তাঁর ঘর আলগাতে বলা!’
‘ছেলেটির কি অসুখ?’
‘অসুখ হবে কেন। ঘরে মা নেই। ছোট শিশু। সারা দুপুর ছেলে রাখতে হবে। তাছাড়া তাঁর মতে ঝি-চাকর দিয়ে শিশু বড় করা যায় না। তুমি সারাদিন তাঁর বাড়িতে থেকে বেবিকে দুধ খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, গল্প বলা, ছড়া কাটা, সময়মত চান-টি করানো, গা-টি মোছানো, এসব করবে। পাউডার, তেল যখন যেটি মাখাবার দরকার মাখাবে। এ-ই কাজ। বলেনি তোকে?’
‘হ্যাঁ, আর বললেন, টুটুল ঘুমিয়ে পড়লে তখন তুমি খুশি মতন আলমারি থেকে বই বেছে নিয়ে পড়তে পার, গান-বাজনার শখ থাকলে এবং টুটুলের ঘুম ভাঙতে পারে ভয় করলে আমার বৈঠকখানায় গিয়ে সেতার, এসরাজও একটু-আধটু বাজাতে পারো। সেতার, এসরাজ দুটোই তাঁর বাড়িতে আছে।’
‘হ্যাঁ, খুব শৌখীন লোক ছিলেন এককালে। আর কি বললেন?’
‘বললেন, তিনটের পর বাগানে ছায়া পড়ে। যদি ঘরে থাকতে ভাল না লাগে, টুটুলকে নিয়ে তুমি বাগানে বিকলেটা সেখানে ব’সে কাটাতে পারবে। এ-বাড়িতে আমার বাগানটা সব চাইতে নাইস।’
বড় মেয়েটি কিছু বলল না।
ছোট রুমাল দিয়ে মুখ মুছল।
‘কি কি করতে হবে যখন বুঝিয়ে দিলেন, বলতে কি আমার একটু সাহস হল, কমলাদি। প্রথমটায় ঘাবড়ে গেছলাম তোমার মুখে শুনে। শিশিরবাবুর এক বন্ধু একটি ইয়ং নার্স চাইছেন। কার আবার অসুখ।’
‘নার্স, নার্সিং বলতে অনেক রকমের কাজ বোঝায় যদিও।’ কমলা বলল, ‘যদি রোগীর জন্যে নার্স চাইতো তো সেখানে আর তোমায় দিয়ে চলত না। পাশ না করলে সে সব চাকরি করা যায় না। তোমার ভাগ্য ভাল যে, হঠাৎ এ ধরনের একটা কাজ পেয়ে গেছ। মাইনেও বেশ ভাল।’
‘পৃথিবীতে কত রকমের কাজ আছে, তাই ভাবি।’বীথি অল্প হাসল। এবং আগুনটা আবার একটা ঝলক দিয়ে উঠতে কমলার কানের লাল রিং জ্বলজ্বল করে উঠতে দেখা গেল। পায়ে একটা মশা বসেছিল কিন্তু জুতোর শব্দ হতে পারে দুর্ভাবনায় শিবনাথ পা-টাও নাড়ল না, মুখ বুজে মশার কামড় সহ্য করে কথা শুনল।
‘তা আমি অবশ্য মাকে এত সব কথা বলিনি। বলেছি, ভদ্দরলোকের বাড়িতে অফিস। তাঁর চিঠি-পত্র দেখতে হবে।’
‘হ্যাঁ, তাই তো বলবে তুমি। তা-ই তোমাকে বলে দেওয়ার জন্যে শিশিরবাবুকে আমি পই পই করে বলে দিয়েছিলাম। বাড়িতে এসে মাকে কি বলবে। বলে দেননি শিশিরবাবু?’
ছোট মেয়েটি ঘাড় নাড়ল।
‘হ্যাঁ, আর একটা কথা, কাল শাড়ি-জুতোর টাকা পেলে, মা-কে তা বলে কাজ নেই। আমার কাছ থেকে ক’টা টাকা ধার করেছ বলবে। ভদ্দর লোকের বাড়িতে এই রকম বেশে যাওয়া যায় না, তাই জুতো ও একটা শাড়ি কিনেছো।
ছোট মেয়েটি ঘাড় নাড়ল।
‘তারপর অবশ্য কবে আমার টাকা ফিরিয়ে দিলে কি না দিলে সে খোঁজ আর উনি করছেন না। কাজেই হুট করে কালই মাকে পোশাকের টাকা পাওয়া গেছে বলে লাভ সেই।‘
বীথি মাথা নাড়ল।
‘তা-ই আমি মাকে বলেছি।’
‘আর শোন।’কমলা বোঝাল, ‘মাস গেলে মাইনেটা পেয়েই ব্যাঙ্কে একাউন্ট খুলে ফেল।’ বীথি ঘাড় নাড়ল।
‘যত টাকাই তুমি,সংসারে সাহায্য করবে, সবই লাগবে। দুটো পয়সা আমার তো মনে হয়, প্রত্যেক মেয়েরই হাতে রাখা উচিত।’ একটু থেমে কমলা বলল, ‘তোমাদের যা রাবুে গোষ্ঠী, কিছু বাঁচাতে পারবে বলে মনে হয় না। ‘
‘বকুলের একাউন্ট আছে ব্যাঙ্কে?’
‘জানি না।’ আবার একটু চুপ করে থেকে কমলা বলল, ‘বকুলের কথা ছেড়ে দাও। দশ দিক থেকে ওর রোজগার যেমন, একলা নিজের জন্যে ও দশ হাতে খরচও করে শুনছি।’
‘হ্যাঁ, শুনেছি অনেক শাড়ি-জুতো ওর।’ বীথি বলল, ‘ওদের সংসার ছোট–আমাদের মত এতগুলো ভাই-বোন তো নেই।’ বলে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বীথি পরে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, কমলাদি, শুনলাম সেদিন, বকুলদি নাকি বার-এ যায়?
‘জানি না।’ গম্ভীর থেকে কমলা আগুন দেখতে লাগল। অল্প বাতাসে জলপাই-পাতা নড়ছিল।
‘আগুনটা এবার পড়েছে’, বীথি বলল। একটু চুপ থেকে পরে প্রশ্ন করল, ‘বার্ কথাটার ঠিক মানে কি কমলাদি?’
শুঁড়িখানা। ইংরেজিতে বার্ বলে। বাবুরা বসে মদ খায় সেখানে।’
‘ইস্ বকুলদিটা কি বিশ্ৰী!
বীথির জিহ্বা ও ঠোঁটের অস্পষ্ট শব্দ হয় একটা।
‘কে বিশ্রী, কে সুশ্রী তা নিয়ে তোমার মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই।’ কমলা মুখে রুমাল বুলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আর একটা কথা তোমাকে বলে রাখছি। এখন থেকে দুটো পয়সা হাতাবে বলে কথায় কথায় সিনেমায় যাওয়া, রেস্টুরেন্টে খাওয়া এসব করবে না।’
‘না, রেস্টুরেন্টে খাওয়া এমনি আমার পছন্দ হয় না।’ বীথি মৃদু হাসল।
‘বলছি এজন্যে, এতেও কম পয়সা নষ্ট হয় না।’
‘সত্যি’, বীথি বলল, ‘বাজে খরচ।’
‘বরং এই পয়সা দিয়ে নিজের জন্যে বাড়িতে আলাদা করে একটু দুধ রেখে খাও, একটু মাখন খাও।’
‘হ্যাঁ ওতে শরীর ভাল থাকে।’ বীথি ঘাড় নাড়ল।
‘স্বাস্থ্য!’ কমলা বলল, ‘বকুলের আর যা দোষ থাক না কেন, স্বাস্থ্যটি চমৎকার –শরীরের দিকে ওর ভয়ানক নজর, এইজন্যে মেয়েটাকে ভাল লাগে।’
‘হ্যাঁ, সেজেগুজে যখন বেরোয়, ভারি সুন্দর লাগে দেখতে।’
‘কেননা, বকুল জেনেছে, স্বাস্থ্যই মেয়েদের বড় সম্পদ, অস্ত্র, যে-মেয়ের শরীর সুন্দর না, তার মেয়ে-জন্ম বৃথা।’ কথার শেষে কমলা একটা ছোট নিশ্বাস ফেলল এবং যেন অনেকটা নিজের মনেই শেষ দিকের কথাটা বলল। আগুন নিভে গেছে। বীথি পরে কি বলছিল শোনা গেল না। কেননা, দমকলগুলো তখন ফিরে যাচ্ছে। যেন তিন-চারটা। একসঙ্গে আবার ঘণ্টা বাজছে জোরে। হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল বলে শিবনাথ মেয়ে দু’টিকে ‘আর দেখতে পেল না।
.
ভিন্ন পাড়ায় আগুন দেখে হাল্কা হয়ে সব ঘরে ফিরছিল। কেউ কেউ গুনগুনিয়ে গান গাইছিল। হাসছিল। খাওয়ার কথা বলছিল। রান্নার কথা। কেউ আধখানা রান্না নামিয়ে ঘর থেকে ছুটে বাইরে গিয়েছিল আগুন দেখতে। আগুন দেখা শেষ হতে এখন আবার রান্নার কথা ভাবছে এবং বাড়ি ফেরার পথে কাউকে না কাউকে বলছে সে কথা। কিন্তু কলরবে কথা পরিষ্কার বোঝা গেল না। আবার কেউ কেউ ঘুম, বিছানা, মশারি খাটানো, ছারপোকার গল্প করছে। কি ছেলে ঘুম-পাড়ানোর কথা খাওয়া ও ঘুম নেই দলে এমন লোকের সংখ্যাও কম ছিল না। কিন্তু তারাও চুপ করে ছিল না। পেটে আগুন জ্বলছে বলে তাদের মাথা গরম। আর মাথা গরম থাকলে আবোল-তাবোল যা মুখ দিয়ে আসে, তাই তারা বলে ফেলছিল।
পরশু রাত্রে ঠিক এমন সময় সরকার ঘর-ভাড়ার তাড়া দিয়ে গেছে। সময়টা মনে পড়তে দাঁত কিড়মিড়ে সুরে কে যেন বলছিল, শালার এখানে কবে আগুন লাগবে। বারোটা ঘর এক সাথে পুড়ে সাফ হবে সেদিন।–’
তৎক্ষণাৎ আর একজনের গলার স্বর চড়ে গেল বলে বাকি কথাগুলো বোঝা গেল না।
‘কেন, মূল জায়গাটায় আগুন দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। কি, দালান পোড়ানো যায় না। খুব যায়–কিন্তু আমাদের মধ্যে একতা কোথায়। না হলে দু’ ঘণ্টায় পারিজাতের বাড়ি, বাগান, গ্যারেজ, গাড়ির মায় কর্পোরেশনের পিলার ঘেঁষে যে দেওয়ালটা তা-ও পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া যায়–কিন্তু –‘
অমল চাকলাদারের আক্ষেপের সুর শোনা গেল। অমলের একটু পিছনেই ছিল বলে শিবনাথ গলাটা চিনল।
‘পারিজাতের জমির একটা ঘাসের ডগায় আগুন দেবার ক্ষমতা নেই হে তোমার, খামকা কেন তড়পাচ্ছ।’
পাশেই ছিল বলে রমেশ রায়ের মোটা গলায় ধমকানি শিবনাথের কানে যেন বাড়ি মারল। ‘বুঝলেন তো, রমেশ রায়ের রাগ কেন অমলের ওপর–’ ফিসফিস করে বনমালী শিবনাথকে বলল।
‘হ্যাঁ। পারিজাতের গেঞ্জির কারখানা, অমলের বৌ।’ সংক্ষেপে শিবনাথ উত্তর করল। বনমালী গুজগুজ করে হাসল।
একটু দূরে বিধুমাস্টার কি বলছিল শোনা গেল না। কিন্তু শেখর ডাক্তারের কথাগুলো বুঝতে কষ্ট হল না।
‘ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়েছিলে তো। যদি চুরি হয় তো আগুন দেখার শখ বেরিয়ে যাবে।’
বিধু মস্টারকে না, স্ত্রীকে প্রশ্ন করছিল ডাক্তার। প্রভাতকণা দশজনকে শুনিয়ে বেশ উঁচু গলায় বলছিল, ‘না গো না, তোমার মত আমি কাঁচা ছেলে নই, তোমার মত কাছা ছাড়া লোক হলেই হয়েছিল আর কি। দুদিন পরে যে-মা মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে–বলি রাজ্যের কলেরা রুগী হাঁটকে এসে তুমি ভাল করে হাত-পা ধুয়েছ তো, না কি অমনি —
কল্ থেকে এইমাত্র ফিরেছে শেখর। হাতে সেই ফাইবারের মত বড় সুটকেস। কালো কোট গায়ে, তাই রবারের কালো নলটা দেখা যাচ্ছিল না। পাকুড় গাছের নিচে গ্যাসের আলো লেগে স্টেথস্কোপের সাদা মুখটা একবার ঝিকিয়ে উঠছিল।
‘শালার এতদূরে ছুটোছুটি আর ভাল লাগে না,–রাত কটা বাজে, সুনীতির খাওয়া হয়েছে?’
কিন্তু সেকথার উত্তর না দিয়ে প্রভাতকণা হাসল, ‘ও, তুমি চাইছ পাড়ায় কেন কলেরা লাগে না। পৌষ গেল, মাঘ যাচ্ছে, বাড়িতে আগুন কই?’
‘তোমার মত কাঁচা মেয়ে নই আমি, গিন্নী, যে ঘুঁটের আগুনে হাত পোড়াব; শালার এ- বাড়িতে যদি এশিয়াটিক কলেরার জার্মও ঢোকে তো পেটের অসুখ ছাড়া আর কিছু করাতে পারবে না। না খেয়ে এক একটি পেট এমন চিমসে মেরে গেছে–হ্যাঁ–হ্যাঁ–আর, পেটের অসুখ হলে এ-বাড়ির লোকে ক’দাগ ওষুধ খায়, আর খেয়ে কত তার দাম দেয়, তোমায় কি আমার বলে দিতে হবে। এ-বাড়ির ব্যারামের চিকিচ্ছে করতে আমি ডাক্তারি বিদ্যা শিখিনি।’
তার উত্তরে প্রভাতকণা কি বলল, শোনা গেল না। শোনা যাচ্ছিল পাঁচু ভাদুড়ীর গলা। প্রচুর খেয়ে এবং টেনে এসেছে পাঁচু। এবং এখন বাড়িতে গিয়ে নাক ডেকে প্রচুর ঘুমোবে, তাই রসবোধটা ওর সকলের চেয়ে বেশি হয়েছে বোঝা গেল। ‘পকেটে চিংড়ি মাছ নিয়ে এলে ডোমপাড়ার আগুনে দিব্যি সেঁকে সেঁকে মুখে ফেলা যেত হা হা–আরে দাদা, যুদ্ধের আমলে আমেরিকান সৈন্যগুলোকে দেখতুম পেন্টালুনের পকেটে ডিমের বড়া নিয়ে ঘুরত। শালারা সেলুনে বসে দাড়ি কামাতে কামাতে ডিমের বড়া ভেঙে মুখে দিত হা–হা–’
একটু ছাওয়া দিয়েছে তখন। মাথার ওপর গাছের পাতার সর্ সর্ শব্দ হয়। সবাই বাড়িতে ঢুকেছে। শিবনাথ রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে ইতস্ততঃ করছিল। কেননা, রুচি ফেরেনি। ঘরে গিয়ে একলা কি করবে ভাবছিল, এমন সময় হাতের ওপর চাপ অনুভব করল। ‘কে?’ চমকে শিবনাথ ঘাড় ফেরায়। কে. গুপ্ত। ‘কি ব্যাপার?’
‘না কিছু না।’ শিবনাথ সংক্ষেপে উত্তর করল।
‘গিন্নী বুঝি ঘরে ফেরেন নি’?
‘না।’
মশাই, এই তো সন্ধ্যে, আসুন একটু আড্ডা দেওয়া যাক।’
‘বনমালী কি আজ দোকান খুলবে?’
‘খুলবে না মানে!’ কে. গুপ্ত খুক্ করে হাসল। ‘অই দেখুন অলরেডি খুলে বসেছে। আগুন দেখতে গিয়ে একটু সময় তো বন্ধ রেখেছিল। আসুন।’
চোখ তুলে শিবনাথ দেখন দোকানের দরজা খোলা। আলো জ্বলছে। সামনের বেঞ্চটা খালি। না, খালি নয়। কে একজন যেন বসে আছে।
চারু। আমার ফ্রেন্ড চারু রায়।’
‘হঠাৎ?’
হ্যাঁ, ক্যামেরা নিয়ে ছুটে এসেছিল ফায়ারের ছবি তুলতে। স্টক শট্ নিয়ে রাখছে। ওর বইয়ের একটা দৃশ্যে আগুন আছে বলছিল। মায়াকানন। নামটা মনে আছে?’
শিবনাথ ঘাড় নাড়ল।
‘কি করে খবর পেলে?’ বিস্মিত হয়ে শিবনাথ প্রশ্ন করলে, ‘ও তো থাকে অনেক দূরে।’
‘তাতে কি, তার জন্যে কি। কে. গুপ্ত গম্ভীর গলায় বলল, ‘মাছি, কোথায় কার খড়ের চালায় আগুন লেগেছে, কোন যুবতীর অঙ্গে রূপের আগুন জ্বলছে টের পেয়ে তা ক্যামেরায় ধরতে ছুটে আসে। ওদের খবর দিতে হয় না।’
শিবনাথ চুপ।
কে. গুপ্ত মোটেই আস্তে কথা বলছিল না। বেশ চড়া গলা। আশে আশে আর লোক ছিল না। তাই রক্ষা।
‘আমাদের কিরণের ছবিও অমনি তুলে ফেলেছে।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ, আপনি কি লক্ষ্য করেন নি? মাথার কাপড় ছিল না। খোঁপাটা ভেঙে সারা পিঠে চুল ছড়িয়ে পড়েছিল। সুপুরি গাছের গুঁড়িতে দাঁড়িয়ে বিধু মাস্টারের মেয়েদের সঙ্গে আগুন দেখছিল; আগুনের আভায় মুখটা গোলাপের মত হয়ে উঠেছিল। আমি তো মশাই আগুন যত না দেখেছি, অমল চাকলাদারের বৌকে দেখেছি তার চার ডবল। আপনি কি টের পাননি?’
‘না।’ শিবনাথ সংক্ষেপে বলল।
কে. গুপ্তকে সে খুব বেশি দোষ দিতে পারল না। বস্তুতঃ ডোমপাড়া পুড়ে যখন ছাই হয়ে যাচ্ছিল, তখন সে-ও কি ভিড় থেকে সরে গিয়ে চোরের মত জলপাই গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দুটি মেয়েকে দেখছিল না! ওদের কথাও শুনেছে।
সুতরাং কে. গুপ্তর এই কথাটার ওপর খুব গুরুত্ব আরোপ না করে সে বরং ভাবছিল, চারু ক্যামেরার মুখটা আর কার দিকে ঘুরিয়েছিল।
এই আগুন এবং দর্শকদের ছবিতে রুচি থাকবে না দেখে শিবনাথ মনে মনে খুশি হল বৈকি। শিবনাথ খুশি গলায় প্রশ্ন করল, ‘তা আপনার বন্ধুর মায়াকানন কবেতক রিলিজড হচ্ছে। সপরিবারে আমরা এ-ছবি দেখতে যাব কিন্তু।’
কে. গুপ্ত কথা বলল না।
১৭
একসঙ্গে হঠাৎ পঞ্চাশটা টাকা পেলে সবাই এদিনে খুশি হয়। রুচি বলল, ‘যাক, সামনের মাসের জন্যে নিশ্চিন্ত। কিন্তু একমাসই। কাজেই এর মধ্যে চেষ্টাচরিত্র ক’রে যাহোক একটা কিছুতে লেগে পড়ো। আর একটু ভাল করে ঘোরাঘুরি কর তুমি। এখানে এক মুহূর্ত আমার থাকতে ইচ্ছে করছে না।’
ভীষণ কাঁদছিল দশ নম্বর ঘরের কিরণ। তার তলপেটে লাথি মেরেছে অমল। মাথার কাপড় ফেলে অমন আলুধালু চুলে এলোপাথাড়ি অন্ধকারে ও ছুটে গিয়েছিল কার ‘পারমিট’ নিয়ে কাল রাত্রে ডোমপাড়ার আগুন দেখতে। আগুনের চেয়েও লম্বা ‘জিভ’ বার করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু-একজন কিরণের রূপ-যৌবন চাটছিল, তা কি সে টের পায়নি? অমলের চোখে কিছুই এড়ায় নি! ইত্যাদি–
তারপর আবার দুপদাপ শব্দ।
‘বৌটাকে মেরে ফেলবে।’ বলছিল কেউ কেউ।
রুচির খাওয়া হয়ে গেছে। স্কুলে যাবে। মঞ্জুও যাবে সঙ্গে। কাপড়-জামা পরা হয়ে গেছে।
এমন সময় ভীষণ কান্না।
শিবনাথ খাওয়া সেরে সবে সিগারেট ধরিয়েছে।
কিরণ! কিন্তু পাশের ঘরে হিরণের ওপর নির্যাতন কম হচ্ছিল না। বেশ জোরে জোরে কাঁদছিল। ঘর খোলা ফেলে গিয়েছিল আগুন দেখতে। বড় কাঁসার থালাটা চুরি গেছে। রাগ করে বিমল কাজে যায়নি। সেই সকাল থেকে স্ত্রীকে বকছে। থালার শোকে অকথ্য গালাগাল দিচ্ছে। সব চোর-ছেঁচড়ের বাস এ-বাড়িতে, নবাবজাদী কি কথাটা ভুলে গিয়েছিল? বিমল ফিরেছিল অনেক রাত্রে ওভারটাইম খেটে। এর অনেক আগেই আগুন নিভে গিয়েছিল। কাজেই হিরণ ঘরে ফিরে এসেছিল বলে বিমল টের পায়নি, কেমন করে তার ঘরে এই সর্বনাশটা হয়ে গেল। আজ সকালে জেরা করে জেনেছে!
এ বাজারে এমন একখানা থালার দাম ষোল সতেরো টাকা। এটা বিমলের পিতৃদত্ত সম্পত্তি। বিমলের সাধ্য নেই, এই রোজগারে আর এই বাজারে এমন একখানা থালা কেনে। বিমল এই থালায় করে পচা চিংড়ি, ট্যাংরা খায়। কিন্তু তার বাবা খেয়ে গেছে বাউসের পেটি, রুইয়ের মুড়ো। ছোটলোকের ঘর থেকে যে-মেয়ে এসেছে, সেই মেয়ে এই থালার মর্যাদা বুঝবে কি। তাই তো ঘর খোলা ফেলে রেখে গেল, আর থালাটা চোরে নিয়ে গেল।
লক্ষ্মীমণির ঘরেও আগুন জ্বলছিল এবং কাল আগুন দেখতে যাওয়ার ফলেই হয়েছে এটা।
বিকালে একটা বার্লির কৌটো কিনে এনেছিল বিধু মস্টার। সেটা আজ পড়ে থাকতে দেখা গেছে বাইরের নর্দমায়। কে নিল, কে চুরি করল। না, মানুষে নেয়নি ওটা। কুকুরে মুখে করে নিয়ে গেছে। দেখেছে হিরুর মা। ডোমপাড়ার আগুন দেখা শেষ করে সকলের আগে হিরুর মা-ই বাড়ি ফিরছিল ও কুকুরটাকে একটা বার্লির কৌটো মুখে করে নিয়ে যেতে দেখেছিল। অর্থাৎ আগুন দেখতে যাওয়ার তাড়াহুড়োয় বারান্দার উনুনের ধার থেকে সরিয়ে কৌটোটা আর ঘরে রেখে যাওয়া হয়নি। টিনের মুখ কেটে একবার মাত্র বার্লি জ্বাল দেওয়া হয়েছিল। হাতে আজ একটা পয়সা নেই। আবার সে বার্লি কিনে আনে কি দিয়ে। ধারে কিছু আনবে না, বিধু পরশু প্রতিজ্ঞা করেছে।
সকাল থেকে কিছু না খেয়ে কোলের বাচ্চাটা ট্যাঁ-ট্যাঁ করছিল, আর বারান্দায় একটা জলচৌকির ওপর বসে বিধু মাস্টার চীৎকার করছিল। একমাস পর আবার যে হাসপাতালে যাবে, সেই স্ত্রীলোকের এত রঙ্গরস কেন, নেচে আগুন দেখতে যাওয়ার বল সে কোথায় পায়। না, অন্ধকারে নর্দমায় কি গাছের গুঁড়িতে ঠোকর খেয়ে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে abortion হয়ে মরত বলে মাস্টার দুঃখ করত না, করছে না। দুঃখ তার একটিন বার্লির জন্য। চামেলীর মার কাছ থেকে ট্যুইশন-ফি’র এডভান্স হিসাবে দুটো টাকা চেয়ে এনে, খুচরো বার্লির পয়সা দিতে দিতে হয়রান হয়ে যাচ্ছিল বলে একটা টিন কিনে আনল। সেই টিনের এ অবস্থা। নর্দমা থেকে ধাঙ্গড়কে দিয়ে ওটা তোলা হয়। কিন্তু ঘরে আনা হল না। ধাঙ্গড়টা নিয়ে গেল। তার বৌয়ের নতুন বাচ্চা হয়েছে। হেসে সবাইকে কথাটা শুনিয়ে বার্লির কৌটো গামছায় বেঁধে ফেলল। প্রিয়জনের শ্মশান-যাত্রা দেখে মানুষ যেমন হাউ হাউ করে ওঠে, তেমনি দিশাহারা হয়ে মাস্টার চীৎকার করে উঠোন কাঁপিয়ে তুলল। ‘এসব স্ত্রীলোককে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে হয়, পিঠে কাঠের চেলা ভাঙতে হয়। ত্রয়োদশবার যে-রমণীর পেট ফুলেছে, তার আক্কেল না থাকলে মুশকিলের কথা।’
সাধু-অসাধু ভাষার সংমিশ্রণে মাস্টার স্ত্রীকে অনর্গল বকছিল।
আর আগুন জ্বলছিল চার নম্বর আর ন’নম্বর ঘরে। ডাক্তারের স্ত্রী প্রভাতকণা আর প্রীতি- বীথির মা’র ঝগড়া। দুটো জিহ্বা দিয়ে যে কত আগুন ঝরছিল, তা বাড়ির উঠোনটা টের পেল। মাছি বিজ বিজ করছিল উঠোনে, বারান্দায়, দরজায় থামের গায়ে। দুজনের চীৎকারে হুঙ্কারে মাছিগুলো ভয় পেয়ে চঞ্চল হয়ে উড়তে শুরু করেছিল।
ইলিশ মাছ আনা হয়েছিল সকালে বীথিদের ঘরে। একটা বিড়াল হঠাৎ একটা ভাজা মাছ মুখে করে তাড়া খেতে খেতে গিয়ে ঢুকেছিল প্রভাতকণার ঘরে। বাস্, তাই থেকে প্রলয় কাণ্ড। প্রভাতকণা ছুটে এসেছিল বীথিদের ঘরের দরজায়। যদি সামলে না খেতে পারে, তবে লোকে এই ‘বিষ্ঠা’ খায় কেন। বিড়ালের মুখে কুকুরের মুখে এই ‘পায়খানা’ তুলে দিয়ে আর পাঁচটা মানুষের ঘর-দরজা নোংরা করতে দেওয়ার কি অর্থ থাকতে পারে। অনর্গল বকছিল প্রভাতকণা। কাজেই বীথির মা’র ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছিল। ‘চোখ টাটাচ্ছে। আমার দুই মেয়ে চাকরি করছে, আমার ঘরে মাছটা, ডিমটা আসছে, হিংসায় পেট ফাটছে আবাগীদের। বিষ্ঠা! আমার ঘরের ইলিশ মাছ ভাজা হল বিষ্ঠা। বিষ্ঠা, তোমরা খাও, তোমাদের চৌদ্দ পুরুষে খায়।’
দুই মেয়ের চাকরির কথায় প্রভাতকণা অট্টহাস্য করে উঠল। তার কারণ প্রভাতকণার মামাতো ভাই সুধীর, কাল সন্ধায় বেড়াতে এসে বোনকে একটা রসালো খবর দিয়ে গেছে। এ-বাড়ির ঘটনা। সুধীর শ্যামবাজারে থাকে। এ বাড়িতে নিয়মিত যাওয়া-আসা আছে। ভায়ের মুখে ঘটনাটি শুনে অবধি প্রভাতকণার জিহ্বা চুলবুল করছিল। কতক্ষণে বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে বীথির মা’র ঘরের দরজা মুখ করে খবরটা রাষ্ট্র করবে। যাতে সকলে জানে। প্রমথদের ধুমসি বিড়ালটা বীথিদের ঘর থেকে একটা মাছভাজা মুখে করে ওর ঘরে ঢুকতে প্রভাতকণা সুযোগ পেয়ে গেল। জিহ্বার চুলবুলি নিয়ে আর বসে রইল না।
একে ইলিশ মাছ, তার ওপর বারান্দায় উনুন। কাদের রান্না হচ্ছে বুঝতে কষ্ট হয় না। প্রভাতকণা উঠোন থেকে এক লাফে উঠে গেল বীথিদের দরজায় এবং মাছভাজার মামলা নিয়ে বেশিক্ষণ তাকে লড়তে হল না।
দুই মেয়ের চাকরির কথা মা উচ্চারণ করতে প্রভাতকণা চোখ দুটোকে ডিমের বড়ার মতন গোল করে ফেলল।
‘ভাগ্যিস্ আমরা খালপারে আছি। ন’ মাসে ছ’ মাসে কলকাতায় যাই। কি করে জানব, কোটি চাকরি করছে, কোটি রাস্তায় টো টো করছে।’ ঘাড় ঘুরিয়ে প্রভাতকণা বিধু মাস্টারের ঘরের চৌকাঠে দাঁড়ানো লক্ষ্মীমণিকে দেখছিল। যেন নিজের ঘরের আগুন এখন কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা, পাশের ঘরের আগুন দেখতে চোখ মুছে মাস্টারগিন্নী এইমাত্র চৌকাঠের কাছে এসে দাঁড়ালো দরজার পাল্লা ধরে। অন্তঃসত্ত্বা লক্ষ্মীমণি দরজার সবটা জুড়ে দাঁড়ায়।
এবং তার সঙ্গেই যেন কথা হচ্ছে, এভাবে গলার আওয়াজটা আরো চড়িয়ে ও রসিয়ে প্রভাতকণা বলল, ‘শেয়ালদায় চায়ের দোকানে আড্ডা মারছিল দিদি! কমলা সঙ্গে ছিল। তা কমলা যেখানে কাণ্ডারিনী, ফল কি হয় বুঝতেই পার।’
ভাগ্যিস্ কমলা বাড়িতে ছিল না। তাই কথাগুলো সে শুনল না। কমলার ঘরের দরজার তালা! সকালে উঠে হাসপাতালে ডিউটি দিতে গেছে।
কমলার ঘর বন্ধ জেনে, নিশ্চিন্ত হয়ে প্রভাতকণা আর একগাল হেসে ফেলল, –তা শ্রীকৃষ্ণও ছিল সেখানে। তিনজনের হাসির চোটে চায়ের দোকানের সামনে রাস্তার লোক চমকে উঠেছিল! আমার ভাই সুধীরও ছিল সেই রাস্তায়। রেস্টুরেন্টে বসা গোপিনী দুটিকে দেখে সুধীরের কষ্ট হয়নি চিনতে। কাল বিকেলে সুধীর এসেছিল আপনি দেখেন নি। হ্যাঁ, আমার ভাই। শ্যামবাজারে থাকে। প্রায়ই তো সে আসে এ বাড়ি।’
লক্ষ্মীমণি ঘাড় নাড়ল কি নাড়ল না, বোঝা গেল না।
কিন্তু প্রভাতকণা চুপ থাকল না।
‘কাল সুধীর বলে গেল ঘটনা। এই তো চাকরি করা। তার আবার অত ঢক্কানিনাদ, থু-থু।
বীথিদের দরজায় থুথু ছিটোবার ভান করল প্রভাতকণা।
‘তুমি একটু ভাল করে কথাবার্তা বলবে সুনীতির মা।’ কথা বলার ধরন দেখে রাগে দুঃখে ঠকঠক করে কাঁপছিল বীথির মা। মার পিছনে দাঁড়িয়ে বীথিও কথাগুলো শুনছিল।
লাল হয়ে উঠেছিল বীথি।
আর থাকতে না পেরে চীৎকার করে বলল, ‘আপনি চুপ করুন, আপনি চুপ করুন। ভাল লাইনে কথা বলতে যদি না পারেন, এখান থেকে চলে যান। আমি চাকরি করি কি করি না, তা আপনার কাছে প্রমাণ দিতে চাই না। বেশ তো, আসুক না কমলাদি। ওর নামে যা-তা বলা বার করে দেব।
বীথির রাগ হচ্ছিল বেশি, কাল শেয়ালদা স্টেশনের রেস্টুরেন্টে শিশিরবাবুর সঙ্গে বসে সে ও কমলা চা খেয়েছিল বটে, কেননা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার নতুন কাজের কথা বলার সুবিধা হচ্ছিল না। আর সেই শিশিরবাবুকে দেখে এসেই ডাক্তারের শালা সুধীরচন্দ্র এ-বাড়ি এসে এটার এই কদর্থ করেছে।
‘হ্যাঁ, আমার মেয়ে চাকরি করবেই। সেইজন্য তার বাইরেও যেতে হবে। আমার স্বামী ডাক্তার না চোর যে, ওষুধের নামে জল খাইয়ে আর জলের ইঞ্জেকশন দিয়ে মানুষের পয়সা লুঠবে। তাহলে আমিও বীথির বিয়ে দিতাম।’ রাগে বীথির মার চোখে জল এসে গেল।
‘বিয়ে হবে না, ছাই হবে। ওই যে মামাটি আসে, ওই সুধীর মামাই কাল–ছোঃ, আজ তিন বছর তো শুনছি, সুনীতির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে–হচ্ছে না কেন, বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে কোন্ দিক থেকে কথাটা কি এক-আধ দিন ভেবে দেখেছেন সুনীতির মা?’ পিছন থেকে প্রীতি কথা কয়ে উঠল। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ঝগড়া শোনার পর সে এই প্রথম মুখ খুলল।
প্রীতির কথা শেষ হতে ওপাশের ঘরের দরজার চৌকাঠে দাঁড়ানো লক্ষ্মীমণির ঠোঁটে একটা বেশ বড় রকমের মোচড় দেখা গেল।
দেখে প্রভাতকণা আগুন হয়ে উঠল। ‘হিংসুক, হিংসায় তোমাদের পেট ফাটছে প্রীতি- বীথি। তাই তো এসব বাজে কথা বলছ। আমার মেয়ের বিয়ে হবেই। তোমাদের নাকের ওপর দিয়ে বরের হাত ধরে এই নরকপুরী ছেড়ে চলে যাচ্ছে এই ফাল্গুনেই। গয়না গড়ানোর বড় কাজটি সারা হয়েছে।
বলে আর সেখানে না দাঁড়িয়ে পায়ের দুপ-দাপ শব্দ করে উঠোন ডিঙিয়ে প্রভাতকণা নিজের ঘরে চলে গেল।
প্রীতি-বীথি একসঙ্গে হেসে উঠে পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। বীথি ফিস-ফিস করে বলল, ‘জব্দ, এ্যাদ্দিনে খুব জব্দ হয়েছে ডাক্তারগিন্নী, আর মেয়ের বিয়ের দেমাক দেখাতে
আসবে না আমাদের দরজায়।’
প্রীতি, যেন রুদ্ধশ্বাসে ঝগড়াটা বসিয়ে দিতে পেরে খুশি হয়েছে, এখন নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘হওয়া উচিত, আমরা বাইরে ঘুরছি বলে আমরাই খারাপ, আর তোমরা তোমাদের মেয়েরা ঘরে থাকছ বলে সোনা-মুক্তা। দেখিস এই সুধীর মামাটি খাবে, শেষ করবে সুনীতিকে। মেয়ের বিয়ের আহ্লাদ বেরোচ্ছে ডাক্তারনীর শীগগিরই।’
এ-কথায় বীথি সরাসরি কিছু বলল না মা আর দিদির সামনে। পাশের ঘরের লক্ষ্মীমণির মত ঠোঁটে মোচড় দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
বস্তুতঃ ঘর থেকে এসব কদর্য ঝগড়া শুনতে হবে ভয় পেয়ে সময়ের একটু আগেই রুচি মঞ্জুর হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে স্কুলে চলে গেছে। যবার সময় শিবনাথকে বলে গেল–যেন বাড়িতে ঘুমিয়ে বা বসে এগারো ঘরের ‘কেচ্ছা’ শুনে সময় না কাটিয়ে শিবনাথ বেরিয়ে যায়। ঘোরাঘুরি করলে অন্য দুএকটা ট্যুইশানির খবর পাওয়া যেতে পারে।
আজ উপদেশটা ঠাণ্ডা রকমের ছিল। তাই ট্যুইশানির’ কথায় ততটা ঠোঁট বাঁকা না করে মৃদু হেসে ঘাড় নাড়ল শিবনাথ। অর্থাৎ যা করবার, যেটি করবার উপযুক্ত লাইন সে মনে মনে বাছছে, সেটি যতক্ষণ না হবে এবং হওয়ার পর স্ত্রীকে এসে সরবে ঘোষণা না করতে পারবে, তার আগে মাষ্টারি কি ট্যুইশানি করব না বলে ঝগড়া বাধানোটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এখন বুঝতে পেরে শিবনাথ শিষ্ট ছেলের মত রুচির কথায় কেবল সায় দিয়ে গেল।
রুচি চলে যাবার পর আরো একটা আস্ত সিগারেট সে টেনে টেনে শেষ করল, আর ডাক্তারগিন্নী ও প্রীতি-বীথির ঝগড়াটা উপভোগ করল। কমলার এ সময়ে বাড়িতে উপস্থিত থাকাটা বাঞ্ছনীয় ছিল; মনে মনে বলল শিবনাথ এবং যখন ডোমেদের ঘর জ্বলছিল, কাল রাত্রে জলপাই গাছের অন্ধকারে দাঁড়ানো দুটি মেয়ের গল্প মনে পড়ে এখন আরো বেশি করে দাঁড়িয়ে সে বীথিকে দেখতে লাগল। মনে হয় বীথি এখন কাজে বেরোবে। পুরনো কিন্তু ফরসা একখানা শাদা জমির শাড়ি পরনে। কালো পাড়। জুতোটা বেশি পুরনো বলে মুচিকে দিয়ে কালি বুলানোর পরও কেমন নিষ্প্রভ থেকে গেছে।
এই শাড়ি এবং জুতো কাল আর থাকছে না অবশ্য, শিবনাথ মনে মনে বলল এবং আর বেশিক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁ করে অন্যের ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকাটা অশোভন হবে চিন্তা করে ভিতরে চলে এল, পায়চারি করল একটু সময়, তারপর কি ভেবে গায়ে জামা চড়িয়ে দরজায় তালা বন্ধ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল।
১৮
দু’চার দিনের আলাপেই শিবনাথ রমেশ রায়ের ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ল। এবং কথাবার্তা বলে বুঝতে পারল আসলে লোকটি খারাপ না। কর্মঠ, মিতব্যয়ী এবং ভবিষ্যৎদর্শী। এককথায় সাবধানী লোক।
লোকে রমেশ রায়কে ‘চামার’ বলে কারণ সে সিনেমা দেখে না, মদ খায় না, সিগারেট ছোঁয় না। নানাভাবে পয়সা রোজগার করে এবং লোকটা নীরস।
‘আমার কোনো সাধ-আহ্লাদ নেই, বুঝলেন মশাই, শত্রুরা তাই ঠাওরে নিয়ে রাতদিন দুর্নাম গাইছে।
শত্রু কারা শিবনাথকে প্রশ্ন করতে হল না। রমেশ রায় আঙ্গুলের মাথা ধরে ধরে তাদের নাম বলে গেল। ‘পাঁচু ভাদুড়ী, বিধু মস্টার, ডাক্তার–কে আমার শত্রু না মশাই। বলে বেড়াচ্ছে আমি রায় সাহেবের দালাল। আরে শালা, তোরা যে এ কথাটা বলিস, পারিজাত এক মাস আমার ঘরভাড়া মাফ দিয়েছে তোরা বলতে পারিস?’
টেবিলের ওপর জোরে কিল বসিয়ে রমেশ রাগ প্রকাশ করল।
‘আমি আমার নিজের চেষ্টায়, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দাঁড়িয়েছি। আমি কি মাথা বিক্রি করে দেবার পাত্র রায় সাহেব, তস্য পুত্র পারিজাত, বা তস্য মহিষী দীপ্তি রায়ের কাছে? বলুন তো?’
কিছু না বলে শিবনাথ হাঁ করে রমেশের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রমেশ ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ, কর্তারা মাঝে মাঝে ডাকেন, এস্টেটের কোথাও গণ্ডগোল বাধলে ডাকিয়ে দুটো একটা কথা বলেন। চুপ করে শুনি। কখনো যদি বুঝি ‘কাজটা’ করা ভাল, করতে বলি। ভাল না দেখলে নিষেধ করি। এবং দেখা গেছে আমার কথামত কাজ করে রায় সাহেব, রায় সাহেবের ছেলে লাভবান হয়েছে। গোড়ায় আমাকে দিয়ে উপকার পেয়েছে বলে এখন আর ছাড়তে চাইছে না, সব কাজে আমার ডাক, সব বিষয়ে রমেশের পরামর্শ।’
একটু থেমে রমেশ বলল, ‘চিংড়িঘাটার মোড়ে বরফ-কলটা বসাবার কথা আমি বলেছিলাম, দেখুন সেই কারখানায় আজ বছরে কত টাকা লাভ হচ্ছে। তাই তো বলছিলাম মশাই, রাজা জমিদার আমার কথা শোনে, তোরা পরামর্শ নিবি কেন। আমার কথা শুনলে আজ অমলের এই দুরবস্থা হত কি, একবার চিন্তা করে দেখুন।’
‘তা তো বটেই।’ গম্ভীর হয়ে শিবনাথ ঘাড় নাড়ল। ‘ছেলেটা একটু কেমন যেন জেদী একরোখা।
‘বেরিয়ে যাবে কাল সকালে জেদ। রমেশ গলার একটা শব্দ করল।
‘কাল বুঝি–’
তার আগেই রমেশ বলে শেষ করল, ‘দারোয়ান পাঠিয়ে পারিজাত ঘর থেকে জিনিস পত্তর টেনে বার করে অমলকে ওঠাবে। বিকেলে দশ নম্বরে নতুন ভাড়াটে আসছে।
শিবনাথ কথা না বলে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল।
‘ইচ্ছা ছিল কিছু টাকা দিয়ে আপাততঃ সরকারকে বুঝিয়ে বলব, থাক এখন তুলে কাজ নেই, এই দুঃসময়ে কোথায় গিয়ে বেচারা আবার ঘর খুঁজবে, তাও অনেক টাকার ধাক্কা। বরং এখানকার ভাড়াটা আস্তে আস্তে ও দিয়ে দিতে পারবে, কিন্তু মশাই–।’ রমেশ একটু থামল, থেমে পরে আস্তে আস্তে বলল, ‘কিন্তু কোন্ ভরসায় ওর হয়ে বাড়িভাড়ার টাকা দিতে যাব?’
‘তা তো ঠিকই।’ শিবনাথ ঘাড় নাড়ল।
‘তোর চাকরি নেই, অথচ বৌয়ের চাকরি হয়ে গিয়েছিল। ও আর বলতে হত না। রাত দিন মেয়ে নিচ্ছে এখন গেঞ্জির কলে। বাড়ির কাছেই ছিল। আর রাজ্যের মেয়ে এসে ঢুকছে। তোর বৌয়ের চেয়ে ঢের শিক্ষিত ভাল ভাল ঘরের মেয়েরা সব আসছে। কি করবে মশাই, পেট তো আগে।’
অল্প হেসে শিবনাথ বলল, ‘কনজারভেটিভ অর্থাৎ গোঁড়া মন। শিক্ষার অভাবেই আমাদের দেশে অমলের সংখ্যা আজও বেশি।’
‘আমার তো মশাই, যখন আপনার স্ত্রী কাজে বেরোয়, দেখে এত আনন্দ লাগে।’
‘ও হয়ে যাবে।’ হাসিটাকে না নিভিয়ে শিবনাথ বলল, ‘যত দেশ শিক্ষিত হবে, এই সব আপত্তি বাধা ভয় কমতে থাকবে। আগের তুলনায় এখন ঢের বেশি মেয়েরা বাইরে বেরোচ্ছে, কাজ নিচ্ছে।’
‘এখন ঘর বলে ঘর, গাছতলায়ও তোমার জায়গা হবে না, আর গাছতলায় থাকলেও বা খাবে কি–পেটের আগুনে তো সতীত্ব শোনে না।’ কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে রমেশ বলতে লাগল, ‘আমার চায়ের দোকানের পাওনা কুড়ি টাকা, আমি আগে উশুল করব কাল সকালে। দারোয়ান এসে জিনিসপত্তর টেনে বার করার আগে আমি অমলের ঘরে ঢুকে থালাটা, প্লাসটা, কড়াই ডেকচি হাতা খুন্তি যা হাতের কাছে পাওয়া যায় নিয়ে নেব। আর, আছেই বা কী ছাই ওর ঘরে। সব মিলিয়ে কুড়ি টাকার সামগ্রী হবে না, গিন্নী কাল আমায় বলছিল। আমি তো বেশিক্ষণ ঘরে থাকি না, মেয়েছেলেরাই টের পায় পাশের ঘরে কি খায়, আর সেই খাওয়া কলাপাতায় সারে কি রুপোর বাসনে। আমার তো মনে হয় এলুমিনিয়ামের দু-একখানা বাসন ছাড়া আর কিছু নেই। তামা কাঁসা পাব না।’
শিবনাথ রমেশের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
‘তা আপনি একবার দেখা করুন। বেশ ভাল লোক। কথায় বলে চাটে পাট। বড় মানুষের সঙ্গে থাকা ভাল।
অর্থাৎ এতক্ষণ পর রমেশ শিবনাথকে উপদেশ দিতে আরম্ভ করল। শিবনাথ একবার গিয়ে পারিজাতের সঙ্গে দেখা করুক। ভাল লোক। তা ছাড়া কারবারী জমিদার ওরা। অনেক কিছুর ওপর হাত রাখে, অনেকের সঙ্গে জানাশোনা। হয়তো খুব সহজেই শিবনাথের একটা সুবিধা করে দিতে পারবে।
শিবনাথ মৃদু ঘাড় নাড়ল।
না, রমেশ আজ বিকেলে চায়ের দোকানে ডেকে এনে শিবনাথকে উপদেশ দিচ্ছে বলে তার রাগ হল না, তার দুঃখ একটু লজ্জাই করছিল। এখানে আসতে না আসতে যে ক’দিনের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেল, প্রায় সবাই শুনল শিবনাথ বেকার। এবং এটা হয়েছে রুচির জন্য। আজ স্ত্রী সন্তুষ্ট পঞ্চাশটা টাকা হাতে তুলে দেওয়াতে।
কাল। কাল সকালের ব্যাপারটা খারাপ হয়েছে। ‘ও-মাসে তোমার সুবিধা না হলে আমি চলে যাব দিদির কাছে।’ রুচি রাগের বশে কথাগুলো বেশ জোরে বলেছিল। কত জোরে বলেছিল শিবনাথ খেয়াল করেনি, এখন বুঝছে।
‘আমার তো জানবার কথা নয়। কাল রাত্রে আগুন দেখে ঘরে ফিরে গিন্নী বলছিল। বারো নম্বর ঘরের ভদ্রলোকের চাকরি নেই।’
রমেশ শিবনাথের চোখের দিকে তাকাল। তাকিয়ে হাসল।
‘আমিও তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়েছি গিন্নীর কথার। বারো নম্বর ঘরের বাবুর চাকরি থাকা না-থাকা প্রশ্নের মধ্যে আসে না, কেননা তাঁর স্ত্রী গ্র্যাজুয়েট, এবাড়ির সব মেয়ের চেয়ে শিক্ষিত এবং একটা ইস্কুলে চাকরিও উনি করছেন।
শিবনাথ কথা বলল না।
অবশ্য শিবনাথের ভাল লাগল তার এবং তার স্ত্রী সম্পর্কে রমেশ রীতিমত একটা শ্রদ্ধার ভাব রেখে কথা বলছিল। বাড়ির আর পাঁচজন সম্পর্কে কী তাচ্ছিল্যভরে সে এতক্ষণ নানারকম কথা বলেছে শিবনাথ শুনেছে, শুনতে হয়েছে। কেননা রুচির বুদ্ধির দোষে রমেশ শিবনাথের বেকার অবস্থা জেনে প্রায় তার পেটের মধ্যে ঢুকছিল। মেয়েটির কত বয়েস, ব্যাঙ্কে কি তার কোনো একাউন্ট আছে, লাইফ ইন্সিওর কিছু করা আছে কি? যদি না করে থাকে বেলেঘাটায় তার এক বন্ধু আছে। একটা বড় কোম্পানীর এজেন্ট। শিবনাথ যদি ইচ্ছা করে তো তাকে দিয়ে কালই রমেশ একটা পলিসি করিয়ে দিতে পারে।
স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ ক’রে কাল কথা দেবে বলে শিবনাথ অল্প হেসে মাথা নেড়েছে।
সেদিকে আর বিশেষ মনোযোগ না দিয়ে তারপরই রমেশ তুলেছে এবাড়ির আর দশটা পরিবারের কথা। কার কত আয়, কে কি হালে চলছে। আর একটা পরিবার ধাঁ করে ডুবল বলে। বছর বছর মুখ বাড়ছে, উপার্জন করার লোক নেই। বিধু মাস্টার মুখ ফুটে কিছু বলে না, কিন্তু রমেশের সন্দেহ আছে, দরকার হলে মেয়েগুলোকে কাজে পাঠাতে রাজী হবে কিনা মাস্টার। কেবল সরস্বতী সরস্বতী করছে, ওদিকে তো নুন লঙ্কাপোড়া ভাতও নিয়মিত জুটছে না। আর অই খেয়েই বা কোন্ ছেলে মেয়ে জজ ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে রমেশের জানা নেই। দু’বেলা যাহোক জুটছে, আরো কিছুদিন টিকতে পারে, কিন্তু একেবারেই আর ভরসা নেই, পাঁচ নম্বর, দশ নম্বর আর এগারো নম্বর ঘরে! শিবনাথ ঘরের সঙ্গে চেহারাগুলো মিলিয়ে দেখল। কে. গুপ্ত, বলাই, অমল।
কে. গুপ্ত ও বলাই সম্পর্কে সংক্ষেপে সেরে রমেশ অতক্ষণ দীর্ঘ বক্তৃতা করল অমল সম্পর্কে।
‘আচ্ছা আমি এখন উঠি।’চা-খাওয়া বেশ কিছুক্ষণ হয় শেষ হয়েছে। আগের এক পেয়ালা চা-এর দাম এখনকার পয়সা টেবিলের ওপর রেখে শিবনাথ আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। ক্যাশ বাক্সের সামনে পিতলের রেকাবীতে রমেশ মৌরী রেখে দিয়েছে। চিমটি কেটে খানিকটা মৌরী তুলে মুখে ফেলে দিয়ে শিবনাথ অল্প হাসল, ‘ওয়াইফের সঙ্গে কনসাল্ট করে দেখি, আপনার বন্ধুকে দিয়ে একটা পলিসি করবার ইচ্ছা আমার আছে।’
‘ছি ছি ছি!’ যেন বেশ লজ্জিত, জিভের আধখানা বার করে তাতে একটা কামড় বসিয়ে রমেশ বলল, আমি আজই এখনি গিয়ে এই নিয়ে মিসেসকে বিরক্ত করতে বলব না। তাছাড়া তিনি এখন খেটেখুটে ফিরছেন। অত ব্যস্ত হবার কিছু নেই। আজ কাল পরশু। সুবিধামত নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে আমায় একবার একটু জানালেই হবে, আমি অমিয়কে খবর দেব। পলিসি করে দিয়ে যাবে। ডাক্তারের ফি এখন আপনার কাছ থেকে নেবে না। ওয়েট কম থাকলে চালিয়ে নেবে। আর বয়েস পাঁচ বছর কমিয়ে ও আপনার প্রিমিয়াম রেট নিচুতে নামিয়ে দেবে। ঝানু এজেন্ট মশাই। পনরো মিনিটে ফল্স হরোস্কোপ তৈরি করিয়ে দেয়।’
‘আচ্ছা আমি মনে রাখব।’ শিবনাথ মাথা নাড়ল।
রমেশ বলল, ‘ইন্সিওর একটা দু’টো করে রাখা ভাল। যা দিনকাল, যা আমাদের আয়ু। তাছাড়া সবাইকে তো বললে হয় না, সকলের পিছনে ছুটে লাভও নেই। অমিয় তো এ তল্লাটের আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছে, বলছে সব ছাগল-কুত্তার দল। খেয়ে বাঁচে না তা প্রিমিয়াম চালাবে কি করে? এসব হাঁটুভাঙ্গা কেস অমিয় আজকাল আর হাতে নিয়ে চায় না। গোড়ায় নিয়ে অনেক ঠকেছে।’
শিবনাথ বলল, ‘আচ্ছা আমি চলি।’
রমেশ বলল, ‘আর একবার আপনি পারিজাতবাবুর সঙ্গে দেখা করুন। আমার তো মনে হয়, খুব শীগগির আপনার কোথাও একটা উনি জুটিয়ে দিতে পারেন।
‘আচ্ছা।’ শিবনাথ হেসে ঘাড় নাড়ল।
‘না, কারো কারো ধারণা ওঁরা বড়লোক, আমাদের কিছুতেই নেই, বরং দেখা করলে সম্মান রাখবে না। মশাই, সেই টাইপের লোকই নন পারিজাত কি তার বাপ, কি পারিজাতের স্ত্রী। চমৎকার লোক।’
শিবনাথ চুপ করে রইল।
তাছাড়া পান থেকে চুন খসেছে, আমায় রায়সাহেবের পরিবারের লোক চেয়ারে বসতে বলেনি, ব্যস্ হয়ে গেল, শালা ক্যাপিটেলিস্ট, শালা দাম্ভিক,–ইত্যাদি।’
রমেশের কথা বলার ধরন দেখে শিবনাথ আর একবার হাসল।
‘কথায় বলে কিনা, উপকারীরে বাঘে খায়। রায়সাহেব ঘর দিয়েছে, সস্তায় থাকতে বললে, একমাস দু’মাসের ভাড়া তিনি মাপ করেছেন এমন নজীরও আছে। আর দু’তিনটে কারখানা, এতবড় একটা দোকান, সুযোগ পেলেই এবাড়ি এ পাড়ার লোককেই কাজ দিচ্ছেন। এই তাঁরাই হলেন গিয়ে সবচেয়ে খারাপ। অধার্মিক। সারাদিনই তো বাড়িতে জটলা পাকানো হয় : ইলেকট্রিক নেই, আর একটা কল বসছে না, অথচ মাস মাস ভাড়াটি আদায় করতে সরকারকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। নরকে যাবে বাপ ছেলে। মানুষের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে যারা বড়লোক, তারা কুষ্ঠ হয়ে মরে, যক্ষ্মায় মরে। শোনেননি অমলের লাফালাফি, বলাইর হুঙ্কার?
‘হ্যাঁ, শুনেছি, পরশু রাত্রে যখন ভাড়া আদায় করতে মদন ঘোষ এসেছিল।’
‘তা শুনবেন বৈকি। আপনিও তো বারোঘরের এক ঘর।’রমেশ চিবুক নাড়ল। সেই জন্যেই বলছিলাম খুব ভাল লোক। লোকেরা নিজেদের অভাবের জ্বালায় তাঁদের নামে বদনাম দেয়, গালিগালাজ করে। আসলে লোক খুবই ভাল।’
‘না, আমি দেখা করব।’
‘তাঁরা চাইছেন, আপনাদের মত শিক্ষিত জ্ঞানীগুণী লোকদের আস্তানা গড়ে উঠুক এখানটায়; যারা ভদ্র যারা মার্জিত। তখন বাড়িও ইমপ্রুভ করবে।
‘তা তো করবেই।’ শিবনাথ একবার দরজার দিকে তাকাল।
‘মান সম্মান।’ রমেশ এবার নিজের মনে কথা বলল, ‘মাস্টারের ফ্যামিলিটার কি হাল দাঁড়িয়ে দেখছেন না। ছেলেগুলোর একটার পরনেও ছেঁড়া পেন্টলুন ছাড়া দেখি না। আর মেয়েগুলো কী পোষাক পরে ইস্কুলে ছোটে দেখেন তো রোজই। তবু ইস্কুলে পাঠানো চাই। নইলে সম্মান থাকে না। দু’দিন পর যে রাস্তায় দাঁড়াবে, তাই আমি দেখছি।’
দেওয়ালের দিকে চোখ রেখে রমেশ এমনভাবে বলল, যেন সে আবার জরিপ করেছে এবাড়ির এক একটি পরিবারের অবস্থা।
মাস্টারের জন্যে আমারও কষ্ট হয়।’ শিবনাথ বলল, ‘ছেলেটাকে নাকি বলছিল আনাজ বিক্রি করতে শেয়ালদায় গিয়ে, রাজী হয়নি।
‘হবে কি করে। যেমন ট্রেনিং পাচ্চে ঘরে।’
‘কে, তাঁর স্ত্রী?’
‘হ্যাঁ, বাড়ির লক্ষ্মীমণি। তিনি বছরের পর বছর হাসপাতালে যাচ্ছেন, আর খান কি না খান গ্রাহ্যি না ক’রে বাচ্চাগুলোকে কবিতা আওড়াতে শেখাচ্ছেন, হাট্টিমা টিম টিম।’
‘ভাল না, এরকম আউটলুক রাখা নির্বুদ্ধিতা।’ গম্ভীরভাবে বলল শিবনাথ।
‘তা ছাড়া বড় মেয়ে দু’টোর মাথায় কিছু নেই। আমি বলছিলাম একদিন মাস্টারকে ডেকে, দিন ঢুকিয়ে এপাড়ার কারখানায়। এখানে ঢোকাতে লজ্জা করে, ওপাড়ার মোজার কলে ঢুকিয়ে দিন।’
‘রাজী হয়নি বুজি?
‘বলল, গিন্নী বারণ করেছে।’
‘মূর্খ।’ অস্ফুটে বলল শিবনাথ। তারপর যেন কল্পিত বিধুমাস্টারকে অনুকম্পা করছে এমনভাবে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাদের দেশের লোকের মধ্যে এখনো অনেক গলদ আছে, সেই জন্যেই তো স্বাধীনতা পেয়েও আমরা উঠতে পারছি না–জাতির অগ্রসর নেই।
বলে শিবনাথ রমেশের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হ’ল। রমেশ হঠাৎ কেমন অন্যমনস্ক হয়ে আছে। তার কথা শুনছে না। যে প্রসঙ্গ চলছিল, তার সঙ্গে আর তার সম্পর্ক নেই যেন।
শিবনাথ তৎক্ষণাৎ দরজার দিকে চোখ ফেরাতে কারণটা বুঝল।
বেবির চুল ধরে ওকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এসেছে ক্ষিতীশ দোকানের মধ্যে।
ক্ষিতীশের আর এক হাতে একটা থলে। থলের ভিতর চাল কি ডাল আছে বোঝা যায়।
হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বেবি ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ক্ষিতীশ দাঁত মুখ খিঁচিয়ে চীৎকার ক’রে উঠল, ‘চুপ কর হারামজাদী। কাঁদবি তো লাথি মেরে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব।’
‘কি ব্যাপার?’
রমেশ চট করে উঠে দুজনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায়।
‘ব্যাপার তেমন কিছু না।’ যেন খুব বিরক্ত হয়ে ক্ষিতীশ তার দাদার কথার উত্তর দেয়। তৃতীয় ব্যক্তি শিবনাথ উপস্থিত, তাতে তার গ্রাহ্য নাই। গলা বড় করে সে ঘটনা বলল।
ক্ষিতীশ যে-থলেটা ধরে রেখেছে, তার ভিতরে চাল। আড়াই সের। তার বেশি হবে না ক্ষিতীশ বলছিল। কিন্তু বেবি বলছে এখানে তিন সের চাল আছে। সে ভাল করে ওজন দেখে এনেছে।
হ্যাঁ, ধাপার বাজারে কেনা চাল।
দোকানীর দাঁড়িপাল্লার দোষে ওজন কমতে পারে। ধাপার বাজারে ওজনে কম ওঠে। বেবি প্রতিবাদ করতে গিয়ে ক্ষিতীশের কাছে ধমক খেয়েছে এবং ক্ষিতীশ তার চুল ধরেছে।
কেননা, সময়মত রেশনের চাল ধরতে পারেনি বলে ক্ষিতীশ বেবিকে ব্ল্যাকে চাল আনতে ধাপার বাজারে পাঠিয়েছিল। সেখানেও সে চুরি করল।
‘যাক যা হবার হয়েছে।’ রমেশ ব্যাপারটা মিটমাট করতে চেষ্টা করল। ‘অভাবের সংসার, বাপটা তো অকম্মার ঢেঁকি। মুদির দোকানের সামনে বসে রাতদিন আড্ডা দেয় দেখি। তা করবে কি; কথায় বলে অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়। হাজার হোক মানুষের পেট তো। কত আর না খেয়ে থাকবে। চাল চুরি করুক, কি আধসেরের পয়সা গাপ মারুক, একটা কিছু করেছে। আর কোনদিন করবে না, এখন আবার ভাল করে বলে দে।’
বলে রমেশ লাল চোখে বেবির দিকে তাকাল।
কে. গুপ্তর মেয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ আর হাত দিয়ে ঢাকা নেই এখন। তাই শিবনাথ চোখের চারধারে জলে দাগ দেখতে পেল। যেন বেবি অনেকক্ষণ কেঁদেছে।
ক্ষিতীশ ওর চুল থেকে মুঠি আলগা করেছে। কিন্তু মুখের কর্কশ ভাব দূর হয়নি।
‘না না, আমি আজই দূর ক’রে দেব। চা চিনি বা দোকানের একটু কেরোসিন চুরি ক’রে এ্যাদ্দিন ক্ষান্ত ছিল, এখন মূল জিনিস পয়সা চুরি আরম্ভ হয়েছে, চালাকি, চুরি। সময় পাই না। মাসের বিশ দিনই আমাকে ব্ল্যাকে চালটা গমটা আনতে হচ্ছে। আর এই করে যদি ও সে-সব থেকে পয়সা খায় তো আমরা দাঁড়াব কোথায় বলতে পার?’ ক্ষিতীশ দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।
দাদা কথা বলছে না দেখে ক্ষিতীশ বলল, ‘তা ছাড়া আরো কথা আছে, আমি ওকে দোকানে রাখব না আরো কয়েকটা কারণে।’
‘কি, কি কারণে, তুই আমায় সব খুলে বল না?’’রমেশ ক্ষিতীশের চোখের দিকে তাকাল। ‘আমি মাথার ওপর আছি যখন, অসুবিধা-টসুবিধাগুলো তো আমার কানে তুলবি। কি হয়েছে বল্।’
ক্ষিতীশ মাথা নাড়ল।
‘বলাবলির আর আছে কি। কেন রাখতে চাইছি না ওকে দোকানে তা আমিও যেমন জানি, তুমিও জান। তা বদনাম উঠলে আমার নামেই আগে উঠবে। তুমি অনেকদিন বিয়ে-থা ক’রে সংসারী হয়েছ, আমি একটা ব্যাচিলার।’
আরে ধ্যেৎ, ওসব বাজে কথা কে বলে। বদনামের আছে কি? এই তো একরত্তি মেয়ে। এখনো ফ্রক ছেড়ে কাপড় ধরেনি।’
‘ওই ধরালেই ধরে।’ ক্ষিতীশ দেওয়ালের দিকে চোখ ফেরাল। আমাদের মা-জেঠীদের তো শুনেছি দশ এগারো বছরে পা দিতেই বিয়ে হয়েছিল।’
‘তা হয়েছিল যেদিন সেদিন হয়েছিল। দু’টো যুদ্ধের পর দেশের হাওয়া পাল্টে গেছে।’ রমেশ এবার শিবনাথের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের শাস্ত্রের বিধান ছিল অষ্টম বয়সে গৌরীদান। কি বলেন মশাই। ওর বয়সে আমাদের মা-মাসীদের গর্ভে আমরা যে এসেই গেছি। এখন আর সে-সব নিয়ে দুশ্চিন্তা করলে চলবে কেন?’
কথা শেষ করে রমেশ হাসল।
শিবনাথ কথা বলল না।
লক্ষ্য করল বেবির কর্ণমূল লাল না হলেও ঘরের মেঝে থেকে আর চোখ তুলছে না। চোখের জল শুকিয়ে গেছে।
যেন আবহাওয়া একটু তরল হয়েছে। নরম নিচু গলায় ক্ষিতীশ বলল, ‘আমি বলে রাখলাম, শেষটায় না তুমি একদিন আমায় দোষ দাও মাগনা চা-চিনি খাওয়াচ্ছি—’
‘আরে না, ও তো দোকানে রীতিমত কাজই করছে, এমনি কি আর, –তবে হ্যাঁ দ্যাখো মেয়ে, চুরিটুরি আমি বরদাস্ত করব না আবার বলে দিচ্ছি। আর একদিন চুরি করেছ শুনতে কি দেখতে পেলে আমি কুকুরের মত লাথি মেরে দোকান থেকে তাড়িয়ে দেব।’রমেশ বেবির দিকে চোখ বড় ক’রে তাকিয়ে কথা বলছিল। বেবি ঘাড় কাত করে উপদেশ শুনল। যাও ভাল ক’রে দু’কাপ চা ক’রে নিয়ে এসো, আপনি কি আর একটু –‘
‘না না আমাকে একটু বেরোতে হবে কাজে’–শিবনাথ এই ফাঁকে বলে ফেলল।
‘আচ্ছা।’রমেশও আর পীড়াপীড়ি করল না। হেসে ঘাড় কাত ক’রে বলল, ‘মোটের ওপর আপনি একবার ওদের সঙ্গে—’
‘হ্যাঁ, আমি পারিজাতবাবুদের সঙ্গে শীগিরই দেখা করব।’ বলে শিবনাথ দ্রুত ব্যস্ত পায়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এসে নিজের সম্পর্কে যত না চিন্তা করল, লোকটি সম্পর্কে ভাবল অনেক বেশি। ব্যবসায়ী মানুষ। লেখাপড়ার ধার ধারে কম। মনের পালিশ সে-জন্যই বিশেষ নেই। কিন্তু তা হলেও রমেশ খারাপ লোক শিবনাথের মনে হ’ল না। দরকার হলে সে লোকের উপকারই করে। লোকের সম্পর্কে অনেকের চেয়ে বেশি সজাগ, ক’দিনের আলাপে শিবনাথ টের পেয়েছে এবং এটা আজকের দিনে কম কথা কি।
১৯
তৃতীয় ব্যক্তি শিবনাথ দোকান থেকে বেরিয়ে যেতে ক্ষিতীশ হাত নেড়ে ফিসফিস ক’রে বেবির ওপর রাগ হওয়ার আসল কারণটা দাদার কাছে প্রকাশ করল।
শুনে রমেশ একটু সময় গুম মেরে থেকে পরে বেবিকে ডাকল।
ক্ষিতীশ হাত বাড়িয়ে চা-টা তুলে দাদাকে একটা দিয়ে এবং নিজে একটা বাটি রেখে রুক্ষ গলায় বলল, ‘পই-পই করে হারামজাদীকে আমি বারণ করে দিয়েছি কক্ষনো আমাদের নাম বলবি না। এতে, এটা অবশ্য খোরাকির চাল, আমাকে যত না বেশি পাবে দাদার ক্ষতি হবে অনেক বেশি। চায়ে চুমুক দিয়ে ক্ষিতীশ দাদার দিকে তাকায়।
‘পুলিস কোন্খানটায় তোকে ধরেছিল?’
‘রেললাইনের ধারে।’ বেবি সভয়ে রমেশের দিকে তাকাল।
ক্ষিতীশ বলল, ‘শালারা এক আধসের চালও এখন নিতে দিচ্ছে না, ভয়ানক কড়াকড়ি শুরু করেছে।
রমেশ কথা বলল না। যেন কি ভাবছে।
ক্ষিতীশ বলল, ‘সেজন্যেই আমি নিজে না গিয়ে ওকে পাঠালুম। ভাবছিলাম, আজ সারদা পেট্রল দিতে আসবে।’
‘সারদা বুঝি মেয়েছেলের চাল আটকায় না?’ রমেশ ঈষৎ হাসল।
‘তা না,’ ক্ষিতীশ আড়চোখে একবার বেবিকে দেকে বলল, ‘সারদা তো আমার বন্ধু। সেজন্যেই ওকে ততটা ভয় নেই। তাছাড়া খোরাকির চাল দেখলে কোন প্রশ্নই করত না। লোকটা ভাল।’
‘কে আজ ডিউটিতে ছিল?’ রমেশ প্রশ্ন করল।
‘সেই যে রোগা-মতন লোকটা। আমি নাম জানি না।’
তুই কোথায় লুকিয়েছিলি?’
‘পুলের ধারে শ্যাওড়া গাছটার আড়ালে।’ ক্ষিতীশ বাকি চা-টুকু শেষ করল।
রমেশ চা শেষ ক’রে বাটিটা নামিয়ে টেবিলে রাখল। তারপর বেবির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোকে পেট্রলম্যানটা কি জিজ্ঞেস করেছিল?’
‘বলল, কোথায় থাকসি তুই?’
‘কি বললি?’
বেবি মাটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল।
ক্ষিতীশ হুঙ্কার ছেড়ে বলল, ‘বললাম তো, ও আমাদের ফাঁসাবে, সেই মতলবে আছে, না হলে হুট ক’রে দোকানের নাম বলে দেয়? কেন, ওর কি ঘর নেই, বস্তিবাড়িতে ওরাও তো একটা ঘর নিয়ে আছে, খোরাকির চাল নিয়ে যাচ্ছে বললে ল্যাঠা চুকে যেত। না,–বলল কি না, ক্ষিতীশদার চাল, আমি ক্ষিতীশদার দোকানে থাকি।’
‘মূর্খ।’ দাঁতে দাঁতে চেপে রমেশ রাগ প্রকাশ করল।
শুধু কি তাই।’ যেন রাগের মাথায় ক্ষিতীশ আর একবার বেবির চুলের মুঠি ধরতে গেল। রমেশ হাত তুলে বারণ করল।
‘আলাপটা যে শুধু চাল নিয়ে হয়েছিল, আমার মনে হয় না। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আমি তো লক্ষ্য করলাম। রীতিমত হাসাহাসি করছিল ও পুলিশটার সঙ্গে। যেন কত পীরিত!’
ক্ষিতীশের দিকে তাকিয়ে রমেশ বেবির চেহারা লক্ষ্য করছিল।
‘কেমন, খুব হাসাহাসি হচ্ছিল পুলিসের সঙ্গে?’
‘বেবি চোখ না তুলে শুধু মাথা নাড়ল।
‘আমি হাড় ভেঙে দেব, যদি বাইরের লোকের সঙ্গে বেয়াদবি করতে দেখি বা শুনি।’ বলে রমেশ ঘাড় ঘুরিয়ে ক্ষিতীশকে বলল, ‘শালাদের ও-ই কর্ম। ডিউটি আর কি। মেয়েছেলেদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করা। পরশু ওপাড়ার সনাতন একটা পেট্রলম্যানের নাকের তলা দিয়ে দু’মণ পার করলে। কিছু বললে না। হরিহর এসে আমায় বললে ঘটনাটা।
‘কারণ?’
‘খুব সহজ।’ রমেশ দাঁত বার করে হাসল। ‘পিছনেই পাঁচ দশ সের চাল নিয়ে দু’টো অল্প বয়সের বৌ আসছিল। হারামজাদার চোখ ছিল সেখানে।’
ক্ষিতীশ হাসল না। কটমট করে আবার একটু সময় বেবির দিকে তাকিয়ে থেকে, পরে দাদার দিকে চোখ ফেরাল।
রমেশ হাসিটা নিভিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বেবিকে বলল, ‘যাগে ওদের সঙ্গে হাসাহাসি বেশি কথা বলা একদম চলবে না। পেট্রলম্যান আসছে দেখলে অন্য রাস্তায় ঘুরে যেতে হবে। তা এক সের সঙ্গে থাকুক, কি দশ সের–মোটের ওপর–’
‘ভাল ক’রে কে . গুপ্তর মেয়েকে বলে দাও দাদা, ভাল ক’রে বলে দাও।’ ক্ষিতীশ চায়ের বাটি হাতে নিয়ে পর্দার ওপারে সরে গিয়ে গজগজ করতে লাগল। ‘আমার কথাবার্তা তো লবাবের মেয়ের কাছে পেচ্ছাব। গ্রাহ্যিই করে না আজকাল। তা না করুক দুঃখু নেই। ভয় তোমাকে নিয়ে দাদা, তোমার জন্যে ভাবনা। না হলে পুলিস কনস্টেবলের সঙ্গে পীরিত করতে এক কথার জায়গায় একশটা কথা বলতে আপত্তি করার ছিল কি; কিন্তু বলতে গিয়ে গাছেমাছে জড়িয়ে, কি না কি বলে আসেন উনি, সেই ভয়ে সারা হয়ে যাচ্ছি। গন্ধ পেয়ে ঠিক একদিন এখানে এসে উঠবে, আমি বলে রাখলাম।’ ব’লে ক্ষিতীশ একটু থামল। জল পড়ার শব্দ শোনা গেল। যেন কি ধোয়া হচ্ছে। একটু পর আবার তার গলা শোনা যায়। ‘তা আসে আসুক, আমার কি, দোকানও আমার নামে না, আর সেই কারবারেরও আমি কিছু নই। আমি ঠিক করেছি ডিগবয় চলে যাব মামার কাছে। সেখানে তেলকলে লোক নিচ্ছে চিঠি পেলাম। মামার চিঠি বুঝি তুমি দ্যাখোনি। এখানে থেকে কি শেষটায় জেলখানায় যাব। আমি পারব না। গুপ্ত মেয়েকে নিয়ে তুমি দোকান চালাও। মামা সুবিধে করে না দেয়, আমি বাটা কোম্পানীতে ঢুকবো। সেখানেও লোক নিচ্ছে।’
তুই চুপ কর, তুই চুপ করবি?’ পর্দার এ পারে রমেশ রায় গর্জন ক’রে উঠল। ‘জেলখানা যাব! জেলে দেওয়া এতই সহজ। কি হয়েছে। খোরাকির চাল ও তো বলেই এসেছে, ব্যস্, ফুরিয়ে গেল। গন্ধ? গন্ধ পাওয়া এতই সহজ?’ রমেশ নাক দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ বার করল। ‘বলে কিনা হাতি-ঘোড়া গেল তল, পাঁঠা বলে কত জল’। লেঠেল পেট্রলম্যান এসে হদিস পাবে রায়ের কারবারের। রেখে দে।’ রজ্জু দেখে সর্প ভয়। তোর হয়েছে সেই অবস্থা?’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রমেশ বলল, ‘আর কথায় কথায় ডিগবয় মামার কাছে চলে যাব বলিস, চাকরিতে ঢুকেই দেখ না, কত রস সেখানে। কুত্তার জীবন, বুঝলি ক্ষিতীশ, শেয়ালকুত্তার মত দেখে ওপরওয়ালারা কর্মচারীদের, তোকে আমি কতদিন বোঝাব।’
‘তা কি জানি না, ব্যবসা-বাণিজ্যে আমারও শখ কম নেই।’ ক্ষিতীশের গলা। ‘তা তুমি একবার লবাবের বেটীকে বলে দাও, যেন একটু বুঝেসুঝে চলেন। এর ওর তার সঙ্গে হাজার রকমের কথাবার্তা বলা আমি পছন্দ করি না। লাইনমত যদি চলতে পারে এখানে থাকুক, না পারে চলে যাক–কাজ নেই আমার চা বানিয়ে।’
‘তা চলবে, চলবে, চঞ্চল স্বভাবটি এখনো কাটেনি। ছেলেমানুষ, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।’ রমেশের গলা হঠাৎ মোলায়েম হয়ে গেল। পর্দার ওপার থেকে ক্ষিতীশ শুনল দাদার গলা। বুঝল বেবির সঙ্গে কথা বলছে।
‘এমন উষ্কখুষ্ক হয়ে থাকিস কেন, চুলে একটু তেলটেল দিতে পারিস না। ঈস্ দ্যাখো, হাঁটুর কাছে কত ময়লা লেগে আছে। চান করার সময় গামছা দিয়ে ভাল করে রগড়ালে ত পারিস!–
‘গামছা থাকলে তো।’ পর্দার ওপারে ক্ষিতীশ বলল।
রমেশ কথা বলল না।
রেবির ভয়ের ভাবটা কেটে গেছে। চেহারা এখন অনেকটা স্বাভাবিক এবং এক দৃষ্টে রমেশ রায় তার হাঁটু দেখছে, টের পেয়ে যেন তাড়াতাড়ি মেঝেয় বসে পড়ে ফ্রকটাকে দু’পায়ের ওপর টেনে দিতে চেষ্টা করল।
‘বস্তিতে এসে ঠাঁই নিয়েছে, চাল-চালনও হয়েছে এখন সেরকম।’ পর্দার ওপার থেকে ক্ষিতীশ বলল, ‘তেল সাবান গামছায় তো আর লাখ টাকা খরচ নেই, আমি দিতেও চেয়েছিলাম। ওর মা নিষেধ করেছে এসব নিতে।’
‘কেন?’ এপার থেকে রমেশ প্রশ্ন করল। বেবি মাথা নিচু ক’রে শুনছে, কিছু বলছে না।
‘লোকে নিন্দা করবে।’ ক্ষিতীশ, বলল, ‘পরের দেওয়া তেল, সাবান মাখছে মেয়ে, জানাজানি হয়ে গেলে নাকি বাড়িতে পাড়ায় নানারকম কথা উঠবে।’
‘কেন, কে. গুপ্তের ফ্যামিলি তো খুব ফরোয়ার্ড বলে জানতাম। সাহেবী চালে সারাজীবন কাটিয়ে এল। রমেশের চোখ গোল হয়ে গেল।
‘তা হলে হবে কি।’ ক্ষিতীশ বলল, ‘যখন ছিল তখন ছিল। এখন আর সেই ঠাটঠমক নেই। পয়সার জোর গেছে। একটু এদিক-সেদিক হলে বাকি এগারোটা ঘর হাসিহাসি করবে।’
‘বটে! যত দোষ তেল-সাবানের বেলায়।’রমেশ হাসতে চেষ্টা করেও হাসল না, বরং একটু রাগের সুরে বলল, ‘মেয়েকে পাঠিয়ে চা, চিনি, কয়লা, কেরোসিন নিতে বুঝি সুপ্রভা দেবীর লাজ নেই, না কি লোকে তখন মুখ বুজে থাকে।’
ক্ষিতীশের গলা আর শোনা গেল না।
মেঝের ওপর নখের আঁচড় কেটে বেবি একটা পাখি আঁকতে চেষ্টা করছিল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে পরে রমেশ একটা নিশ্বাস ছাড়ল। ‘বুদ্ধির দোষ, বুঝবার ভুল, পারিজাতের খোঁয়াড়ে যে এসে মাথা গলাচ্ছে, তারই মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’
.
মাথা খারাপ হয়েছে বেশি বলাইর। না হ’লে শীতের দুপুরে আইসক্রীমের গাড়ি নিয়ে বেরোবে কেন! তা-ও কি আর তিন চাকার সাইকেলে বসানো ম্যাগ্নোলিয়া’ না ‘হ্যাপিবয়’-এর সুন্দর রং করা ছিমছাম বাক্স। সে-সব এখানে চলে না। ‘ম্যাগ্নোলিয়া’, ‘হ্যাপিবয়’, ‘জলিচ্যাপ’, ‘স্যুইটবেবি’ যারা খায়, তারা শহরের বুকে থাকে। তাদের ‘গায়ে ঝকমকে জামাকাপড়, সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগে থাকে। কথায় কথায় টুপটাপ সিকি দু’আনি ফেলে দিয়ে শীতের দুপুরেও একটার জায়গায় তিনটে করে ‘জলিচ্যাপ্’ খায় সেখানে ছেলেমেয়েরা।
এ-তল্লাটে অন্য মানুষেরা থাকে। বলাইয়ের ভাল জানা আছে। তাই এক পয়সার জিনিস সে বেছে নিয়েছে। যেমন জলো হলদেটে রং কাঠের বাক্সটার, তেমনি বাক্সের ভিতরের জিনিসের রং। যেন খালের ঘোলাটে জল জমিয়ে তৈরি করা। হয়তো এক ফোঁটা মোষের দুধ থাকবে। স্যাকারিন দিয়ে মিষ্টি করা। তা যত সাই হোক, খেতে মিষ্টি না লাগলে একটু দুধের তার না পেলে একটা পয়সাই বা খরচ করতে যাবে কেন বস্তির ছেলেমেয়েরা।
কিন্তু বেলা বারোটা থেকে ঘুরছে বলাই, চার ছটাও বিক্রি করতে পারে নি। হাত দিয়ে ঠেলতে হয় বাক্সটা।
দু’টো মাত্র রবারের চাকার ওপর বসানো। হাতল ছেড়ে দিলে বাক্সটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। সুতরাং গাড়ি সোজা রেখে ক্রমাগত হাঁটার হাঙ্গামাও কম না। শীতের রোদেও সে ঘামছিল। হিউজ রোড পিলখানার ওধার থেকে সে ঠেলতে ঠেলতে আসছে।
হাতে ফোস্কা পড়ে গেছে বলাইর।
খোয়া-বসানো রাস্তা।
পিচ উঠে গিয়ে পাথরের খোয়াগুলো শিং ও মাথা উঁচিয়ে গাড়ির চাকা ঠুকতে উঠে পড়ে লেগেছে। কর্পোরেশনের কাজের বাপান্ত করে বলাই বড় রাস্তা ছেড়ে দিয়ে গলিতে ঢোকে।
টিনের বেড়া ঘেরা বস্তি না, মাটির বেড়া ঘেরা ঘর। ঘরগুলোর চেহারা দেখে বলাই বুঝল একটা পয়সা খরচ করে ছেলেময়েদের আইক্রীম কিনে খাওয়াবে বাপ দাদাদের ক্ষমতা নেই এখানে। তাই আর ‘আইসক্রীমের’ বাংলা ‘ঠাণ্ডামেঠাই’ কথাটা মোলায়েম করে না হেঁকে একরকম চুপচাপ গলি পার হয়ে চলল।
‘এই আইসক্রীম দাঁড়াও।’
গলি শেষ হবার মুখে ছোট্ট ছেলেটি কোথা থেকে ছুটে এসে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ায়, বলাইর গাড়ির সামনে।
বছর তিন চার বয়স।
তা হ’লেও সে দু’হাত তুলে বলাইর গাড়ি আটকাতে চাইছে।
‘পয়সা নিয়ে আয়।’
‘পয়সা নেই এমনি দাও।’
হাসল বলাই। হেসে একটু চুপ থেকে পরে পেট-মোটা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল ‘ভাগ।’
কিন্তু ছেলে নাছোড়বান্দা।
‘একটাতে কি আর তুমি গরিব হয়ে যাবে। একটা দাও আমাকে। আমার পয়সা নেই।’
‘তোর মাকে গিয়ে বল্।’ কেন জানি বলল বলাই। বলে চারদিকে তাকাল।
‘এই তো আমি এখানে। আমি গাছতলায় বসে আছি বাবা। আমি ওর মা।’
মাটির ঘর থেকে দূরে একটা নিচু জমিতে একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে আছে স্ত্রীলোকটি। সামনে একটা কাপড়ের পুঁটুলি। প্রৌঢ়া বলাইর দিকে তাকিয়ে আছে। ‘ওর খাই-খাই এখনো কমেনি বাবা। অবুঝ। তা তুমি ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দাও। কাঁদবে না।’
যেন পরীক্ষা করবার জন্যে বলাই হেঁচকা টান মেরে গাড়ির সামনে থেকে ছেলেটাকে সরিয়ে দিলে।
কাঁদল না ছেলেটা। দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল্ ক’রে বলাইর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর তাকাল গাড়িটার দিকে। যেন গাড়িটার ওপর তার আক্রোশ, রাগ ও অভিমান। আইসক্রীমগুলো ওখানে কেন লুকিয়ে। বাক্সের ওপরে উঠে এসে হাওয়া খাক না। ‘এক থাবা মেরে আমি সবগুলো কেড়ে নিয়ে ছুটে পালাই।’
যেন ছেলে চোখের ভাষা পড়তে পেরে আরও একটু মজা দেখতে বলাই হেঁকে উঠল: ‘ভাগ্।’
কিন্তু ছেলে নড়ল না। স্ত্রীলোকটি ওধার থেকে বলল, ‘দাঁড়াও বাবা। তুমি দু’মিনিট এখানে একটু জিরিয়ে নিতে পার। গাড়িটা গাছের গুঁড়িতে ঠেকিয়ে রাখতে পার।
বলাই তাই করল।
গাড়িটা এতক্ষণ পর হাতছাড়া করতে পেরে সে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ফতুয়ার পকেট থেকে বিড়ি ও দেশলাই বার করল। বিড়ি ধরিয়ে চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে সে ছেলে, ছেলের মা আর তার ‘হরেকৃষ্ণ’ মার্কা আইসক্রীমের গাড়িটা দেখতে দেখতে নিজের বরাতের কথা যেন বেশি ভাবল! তার রুজি।
হঠাৎ বলাই লক্ষ্য করল কে একজন ভদ্রলোক। পথচারী, অনুমানে বুঝল।
লোকটি সামনে এসে দাঁড়াতে ছেলের মা উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোকের সামনে অত্যন্ত কুণ্ঠিতভাবে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘বাবা, আমায় একটা পয়সা দিন। ভিক্ষে চাইছি।’
একবার বলতেই ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা ডবল পয়সা তুলে স্ত্রীলোকটির হাতে ফেলে দিলেন।
ভদ্রলোক একটু দূরে সরে যেতে ছেলেটির মা বলল, ‘দাও বাবা। খেতে যখন চাইছে। একবেলা পেট ভরে ভাত খায় না। তা যদি এক পয়সার আইসক্রীম’ খেয়ে থাকতে পারে, ভুলে থাকে খিদে–থাকুক!
বলে ডবল পয়সাটা বলাইর বাক্সের ওপর রাখল।
স্ত্রীলোকটির চোখে জল এসে গেছে। বলাই অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলে।
‘তা এমনি কি আর একটা আমি দিতে পারতাম না। পয়সা লাগবে না, নিয়ে যান।’
বলাই বাক্সের ডালা তুলে একটা আইসক্রীম বার করল।
‘নে ধর্।’
ছেলেটা হাত বাড়িয়ে আইসক্রীমের কাঠিটা ধরল।
স্ত্রীলোকটি আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছল।
‘কটা আর বিক্রি হয় সারাদিন ঘুরে। আমি কি জানি না। আমার জানা আছে তোমার ওই ব্যবসা।
বলাই আকাশের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পরে চোখ নামাল।
‘থাকতুম বাবা এখানেই। এই বস্তির একটা ঘরে দেওরকে নিয়ে ছিলাম।’ চোখ মোছা শেষ ক’রে স্ত্রীলোকটি আঙুল দিয়ে একটা মাটির ঘর দেখিয়ে দিলে। বলাই পুঁটুলিটার ওপর আর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে কিছু অনুমান করল।
‘তা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’
‘দেওর বার করে দিয়েছে। ওর ছেলেপুলে আছে। এক হাতের রোজগার। সংসার চালাতে পারছে না। বাড়তি লোক আমরা, ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।’
বিধবা। যেন এতক্ষণ পর বেশভূষার দিকে নজর পড়তে বলাই কথাটা চিন্তা করার সময় পেল।
‘আপনার স্বামী, খোকার বাপ কোথায়?’
স্ত্রীলোকটি তৎক্ষণাৎ কথা না বলে আর একবার আঁচল দিয়ে চোখ মুছল। মোছা শেষ ক’রে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্বর্গে গেছেন।’
‘অল্প বয়সে মারা গেলেন খোকার বাবা?’ বলাই ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল।
স্ত্রীলোকটি মাথা নাড়ল।
‘গাড়ি চাপা পড়েছিল।’
‘কোথায়–’ এর বেশি বলাই প্রশ্ন করতে পারল না। চুপ করে গেল।
‘শহরে। আইসক্রীমের গাড়ি চালাচ্ছিল। আর কিছু সুবিধে করতে না পেরে শেষটায় ওই ব্যবসা ধরেছিল।’
টান দিয়ে গাড়িটা গাছের গুঁড়ি থেকে আলগা ক’রে টেনে এনে বলাই সামনে দিকে এগোতে লাগল। ‘ঠাণ্ডা মেঠাই! গলায় বেশ জোর দিয়ে মিঠে নরম সুরে সে হাঁকতে হাঁকতে গাড়ি চালায়। হাঁটে জোরে জোরে।
ফিরি নিয়ে বেরিয়ে এরকম অনেক ঘটনা বলাই শুনেছে, দেখেছে। সেজন্য মন খারাপ ক’রে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে তার দিন চলে না। কিন্তু মন খারাপ হওয়ার জিনিসের যেমন দুনিয়ায় অভাব নেই, তেমনি মন খারাপ চাপা দেবার সুযোগ সুবিধাই বা চারদিকে কম ছড়িয়ে আছে কি। গাড়িটা লেভেল ক্রসিং-এর ওপর একটা ধাক্কা মেরে ঠেলে তুলে দিয়ে বলাই হাতল-ধরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাণ্ডটা দেখল।
শহরের জঞ্জাল নিয়ে গাড়ি ধাপার মাঠের দিকে ছুটছিল। কিন্তু হঠাৎ মাঝপথে গাড়িটা দাঁড়াল। ইঞ্জিনের কাছে একটা টুকরি হাতে মোবারক দাঁড়িয়ে। কালিঝুলি মাখা শার্ট পেন্টলুন পরা ড্রাইভার বেলচা নিয়ে ইঞ্জিনের পিছনে টাল ক’রে রাখা কয়লা তুলে মোবারকের টুকরিতে ফেলতে লাগল। টুকরি ভরে মোবারক সেটা মাথায় তুলে লাইনের ওধারে নেমে গেল। ইঞ্জিন তখনও দাঁড়িয়ে। সোঁ সোঁ শব্দ হচ্ছে। কয়লার ধোঁয়ায় আকাশটা কালো হয়ে গেছে। একটু পর মোবারক টুকরিটা হাতে ঝুলিয়ে আবার লাইনের ওপর উঠে এল। ড্রাইভার বেলচা দিয়ে কয়লা কেটে কেটে টুকরিতে ফেলতে লাগল। মোবারক এদিক ওদিক তাকায় কিন্তু যে লোকটি ইঞ্জিন থেকে কয়লা নামিয়ে দিচ্ছে, তার কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। টুকরি ভরে যেতে মোবারক চলে গেল। কয়লা রেখে দিয়ে আবার ফিরে এল। দশবার। বলাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুনল দশ টুকরি কয়লা। ইঞ্জিন থেকে নামিয়ে দেওয়ার পর ড্রাইভার সাহেব সিটি দিয়ে ইঞ্জিন ছেড়ে দিলে। গুমগুম আওয়াজ তুলে ময়লার গাড়ি ধাপার মাঠের দিকে চলে গেল। জায়গাটা এখন ফাঁকা। পাশে বেগুন ক্ষেত থেকে অনেকগুলি শালিক উড়ে এসে রেললাইনের ওপর বসে কি যেন খুঁটে খুঁটে খেতে লাগল, যেন জঞ্জাল-ভর্তি গাড়িগুলো থেকে হাওয়ায় কি সব খাদ্য নিচে উড়ে পড়েছে। বলাই গামছা দিয়ে কপাল মুছে আবার তার আইসক্রীমের গাড়ি ঠেলতে লাগল। লাইনের ওপারে যেতে মোবারকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
মোবারক ঠোঁট টিপে হাসে।
‘দশ টুকরি সরানো হ’ল বুঝি?’
‘হুঁ।’ মোবারক আর একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে এবার শব্দ ক’রে হাসল।
‘আমার কি, ওরা যদি গায়ে পড়ে দিতে আসে আমি নেব না কেন?’
‘চুরি না করলে চলবে কেন?’ মোবারক আস্তে কথা না বলে বেশ বড় গলায় বলল, ‘ক টাকা মাইনে দেয় শশী ড্রাইভারকে সে খবরটা রাখিস্। যা পায় খেতে পরতে কাবার। বড় সংসার ওর। পাঁচটা বাচ্চা। মেয়েটা তো দেখ-দেখ ক’রে বড় হয়ে গেল। মেয়ের বিয়ের ভাবনা হয়েছে শশীর। বাড়তি রোজগার না থাকলে, ক’টা টাকা হাতে না জমলে বিয়ে দিতে পারবে না, বলে শশী।
‘তা কর্পোরেশনের বাবুরা টের পায় না, কয়লার হিসাব রাখে না?’
মোবারক আরো জোরে হাসল।
‘বাবুদের না খাইয়ে কি শশী খায়। গুদামবাবুর সঙ্গে বন্দোবস্ত আছে।’
‘গুদামবাবুর ওপরে তো বাবু আছে, তারা দেখে না?’ বলাই একটু অবাক
‘তারাও খায়।’ মোবারক মাথা নাড়ে আর হাসে। ‘বুঝলি বলাই, সেখানে কলমের চুরি। চালাকি চুরি।’
‘তা ওরা তো মোটা মাইনে পায়। চুরি করার দরকার কি?’
‘চুরি করার দরকার রাজা বাদশারও থাকে। মোটা মাইনেওয়ালাদের মোটা খরচ আছে যে।’ একটু চুপ থেকে মোবারক বলল, ‘তা গত সন দু’জন বাবুর চাকরি গেছে এই ক’রে কাগজে হিসাবটা দেখাবার সময় কেমন গোলমাল ক’রে ফেলল, ধরা পড়ে গেল।’
বলাই কথা বলল না।
‘নে বিড়ি খা। এখন আইসক্রীম ধরলি নাকি?
‘হুঁ।’ মোবারকের হাত থেকে বিড়ি তুলে নিয়ে বলাই বলল, ‘বাজে মাল, বিক্রি নেই।’ মোবারক কিছু বলল না। তার কাঠ-কয়লার ব্যবসা। কাঁচা কাঠ পুড়িয়ে কয়লা করে। একটু দূরে ওর টালিছাওয়া লম্বা ঘর। ঘরের সামনের জমিতে স্তূপ করে রাখা কাঁচা কাঠ। আর একদিকে টাল দিয়ে রাখা চারকোল। কাঠ পোড়াবার জন্য তার বিস্তর পাথুরে কয়লার দরকার। শশীর সঙ্গে বন্দোবস্ত ক’রে সে সস্তায় এখন ভাল কয়লা পাচ্ছে। বলাই একটু সময় সেদিকে তাকিয়ে থেকে পরে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল।
‘ফলের ব্যবসাটা আর হাতে আনতে পারলি না?’
‘নাঃ।’ বলাই মোবারকের দিকে চেয়ে আকাশের দিকে চোখ রাখল। ‘ফলের পরে সাবান ধরলাম, বেগুন ধরলাম, একটায়ও সুবিধা হয়নি। আর এ তো শালা ছোটলোকের খাদ্য। তা- ও কিনে খাবার ক্ষমতা নেই এ তল্লাটের মানুষের।’
মোবারক কিছু বলল না। বলাইর হলদে গাড়িটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে অল্প হাসল শুধু।
‘কিছু পুঁজির যোগাড় করতে পারলে ভাল একটা কারবারে হাত দিতাম।’ যেন নিজের মনে বলল বলাই।
কিসের কারবার মোবারক প্রশ্ন করল না যদিও। বিড়িটা শেষ করে সে বলল ‘আচ্ছা চলি ভাই।’ বলে আর না দাঁড়িয়ে তার ঘরের দিকে চলে গেল। বলাই একটু হাসল। পুঁজির কথায় মোবারকের ভয় হয়েছে পাছে বলাই কিছু টাকা পয়সা চেয়ে বসে। কারবারী লোক, কাজেই সেদিক থেকে বেজায় হুঁশিয়ার।
আর এক ধাক্কায় গাড়িটা লাইন থেকে নামিয়ে বলাই এবার মাঠের রাস্তা ধরে চলতে লাগল। কিন্তু চলতে চলতে মোবারক কি শশী ড্রাইভারের কথা ভাবল না সে, কি পিছনে ফেলে আসা রাস্তায় দাঁড়ানো সেই ছোট্ট ছেলে ও তার বিধবা মার কথা। যত সে বাড়ির দিকে এগোচ্ছে একটা মুখ কেবল চোখের সামনে ভাসছে। ‘সন্ধ্যার দিকে আসবি একবার। সারাদিন তোকে চিন্তা করবার সময় দিলাম। যদি বাঁচতে চাস রমেশ রায়ের শেষ উপদেশ নে।’ ঘাড় ঘুরিয়ে বলাই দেখল সূর্য ডুবু ডুবু। গাড়িটা বনমালীর দোকানের সামনে রেখে রমেশ রায়ের শেষ পরামর্শ শুনতে বলাই তার চায়ের দোকানের দিকে এগোতে লাগল। কিন্তু দোকানে বারো নম্বর ঘরের শিবনাথবাবুকে ব’সে থাকতে দেখে বলাই ভিতরে ঢুকল না। এদিকে ওদিকে পায়চারি ক’রে সময় কাটাল। শিবনাথ দোকান থেকে বেরিয়ে যেতে দেখল কে. গুপ্তের মেয়েকে নিয়ে দাদা ও ভাই কি সব বলাবলি করছে। কিছুক্ষণ পর মেয়েটা দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তা ধরল। যেন ফ্রকের তলায় লুকিয়ে কি সব নিয়ে যাচ্ছে। বলাই আর সেদিকে তাকিয়ে না থেকে আস্তে আস্তে দোকানে ঢুকে রমেশের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
‘কি, মাথা ঠিক করেছিস?’
বলাই শব্দ না করে বেঞ্চের ওপর বসল। একটা সিগারেট ধরিয়ে রমেশ প্রশ্ন করল, ‘মন ঠিক ক’রেছিস, যা বললাম ভেবে দেখেছিস?’
আর একটু সময় কি ভেবে বলাই রমেশের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল। একটা পাংশু হাসি মুখ। ‘ভয় করচে যে!’ যেন বলতে চেষ্টা করেও বলাই বলতে পারল না।