১৫. সরকারি হুকুম বনাম ফেরি

সরকারি হুকুম বনাম ফেরি

ঘাটমাঝি, ঘাট আর ফেরির ঠিকেদার, বয়েল গাড়ি বা হ্যাকারির চৌধুরি এদের যে মোর্চা বা সংঘ তার সর্দার বা মাথারাই হল সমাজের সবচেয়ে বড় বজ্জাত। এদের বজ্জাতির হাত থেকে ছাড় পাওয়া প্রায় অসম্ভব বললেই চলে। মাঝে মাঝেই ম্যাজিস্ট্রেট হুজুরেরও শিরদর্দের কারণ হয়ে ওঠে এই বজ্জাতেরা। তাঁর সব চেষ্টাই বেকার হয়ে যায় এদের কাছে। এমন কোনও আহেলা খুঁজে পাবেন না যাকে দস্তুরি দিয়ে বশ করা না যায়। পির-পয়গম্বরের সামনে এরা যেমন শির ঝোঁকায়, তেমনটাই ঝুঁকিয়ে থাকে দস্তুরি পেলে। কোনও ফরিয়াদি যদি তাদের জবরদস্তির কোনও সাবুদ পেশ করতে পারত তা হলে আমি হলফ করে বলতে পারি জরুর মিলত সাজা। তবে তেমন কোনও নজির আমার সামনে নেই।

বেনারসের যে কোনও ঘাটে কোন নাও লাগবে আর কোন নাও ছাড়বে তা ঘাটমাঝিদের তহরির ঠেকালে তবেই ঠিক হত। মর্জি হল আর নাও ভাড়া নিলাম তা চলবে না। ঘাটমাঝি দস্তুরি পাবে তবে মিলবে হুকুম। সওদাগরেরা তাই আগে থেকে ঘাটমাঝিদের সঙ্গে একটা বন্দোবস্ত করে নেয়। ভাড়ার সঙ্গেই ঠিক হয়ে যায় দস্তুরি কত। বজ্জাতগুলোর এমনই হালচাল যে দেখলে মনে হবে মহারানির হুকুমনামা নিয়ে ঘুরছে। এক সাহেব মুসাফির একবার ম্যাজিস্ট্রেট হুজুরের কাছে আর্জি জানালেন, তাকে একটা নাও এর বন্দোবস্ত করে দিতে হবে। দেশের এক মাথা থেকে আরেক মাথা সেই নাও চেপে সাহেব ঘুরবে। কোতোয়ালকে হুকুম করা হল নাও এর বন্দোবস্ত করতে। কোতোয়ালের সেই হিম্মত কোথায় যে ঘাটমাঝিদের বাদ দিয়ে কিছু করে। ঘাটমাঝি যে নাও-এর ইন্তেজাম করল সেখানে তারই হুকুম মোতাবেক ঠিক হল কিরায়া আর তার দস্তুরি। এই বজ্জাতদের সঙ্গে যোগসাজশ থাকে নাও-এর চরণদার আর মহাজনের নফর চাকরদের। এরা শুধু মওকা খোঁজে কি করে বিমা কোম্পানিকে ফাঁকি দেওয়া যাবে। চালু রেওয়াজ হল, যে নাওগুলোর আচ্ছা হাল সেগুলো সওদাগরের জন্য রেখে দেওয়া আর বেহালগুলোতে মালপত্তর-বস্তা চাপিয়ে বেনামদারকে খবর করা সেগুলো রওনা হয়েছে। আজব আজব কারণে ঘাটমাঝিদের বখরা যায় বেড়ে। যেমন ফৌজের দরকারে যদি হুকুমদখল করা হয় নাও, তখন দেখবেন ম্যাজিস্ট্রেটের চাপরাশি আর কমিশারিয়েটের কর্তাও হাত মিলিয়েছে ঘাটমাঝির সঙ্গে। শুরুতেই গিয়ে তারা দখল নেয় আচ্ছা-খাসা নাওগুলোর। রিশবত কবুল করলে দুসরা বাত। জরুরত পড়লে তারা তখন নাও থেকে ঘাটের উপর ফেলে দেবে বস্তা আর সওদা। সেখানেই পড়ে থাকতে থাকতে হয় সেগুলো বরবাদ না হলে চুরি হয়ে যায়। মালিক যদি তাদের ঠেকানোর চেষ্টা করে তখন আবার আর এক গল্প। সরকারি কাজে বাধা দিচ্ছে বলে তখন তাদের গ্রেফতার করা হবে। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে কেউ দরবার করলে দেখা যাবে ঘাটমাঝি আর পুলিশ জোট বেঁধেছে। যতগুলো নাও দরকার তার থেকে অনেক কম হাজির করা হবে। ফৌজের কাম কাজ যাতে বন্ধ হয়ে না যায় তার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট হুজুরও তখন খামোশ।

নিলাম ডেকে হর সাল ঠিক হয় বড় বড় সব নদীতে কাদের ফেরি চলবে। যে সব থেকে বেশি দর দেবে সেই পাবে ইজারা। চুক্তি মোতাবেক বলা থাকে, ইন্তিজাম করতে হবে ঠিকঠাক নাও। নাও-এর সঙ্গে থাকতে হবে এলেমদার মাঝি-মাল্লা। ঘাটের উপর পুঁতে দেওয়া হয় একটা করে পাথরের টালি। নাগরি আর ফারসিতে তার উপর খোদাই করা থাকে ম্যাজিস্ট্রেটের মঞ্জুর করে দেওয়া ভাড়া। বলা থাকে, কেউ বেশি ভাড়া চাইলে তার জরিমানা হবে। বেশক সবাই জানে যে ফেরির পাটোয়ারিগুলোই হচ্ছে আসল বজ্জাত। তেমন বুঝলে কাজে ইস্তফা দেবে, চালাবে না ফেরি, ফাঁসিয়ে দেবে ইজারাদারকেই। বলবে ইজারাদারই হুকুম দিয়েছে বেআইনি কাজ কারবার করতে। কেউ যদি তার খিলাফ কোনও নালিশ রুজু করে তখন সে নিজের তরফে আরও বেশি সাক্ষী এনে খাড়া করবে। এই রকম মামলায় আইনি সাবুদ পেশ করা খুব মুশকিল। এমনিতেই ফরিয়াদির তকলিফ কিছু কম হয়নি। তার উপরে আবার জুড়ে যায় মামলা করার গেরো।

হালফিল কাজে বহাল হয়েছে এমন কয়েকজন সাহেব নদী পার হয়ে আসছিল রাজঘাট। আমার হুজুর নাজির সাহেবকে বলা হল তাদের খাতির করে নিয়ে আসার জন্য। আমিও চললাম হুজুরের পিছু পিছু। নজরে এল এক বিরাট কিশতি। কমসে কম পঞ্চাশ জন গোরা আদমি তাতে চেপে আছে। কিশতিটা কেবল ভেসে রয়েছে হালের কসরতে। মাঝি মওকায় ছিল নাও ঘাটে ভিড়িয়েই ফেরার হবে। নাজিরের হুকুম মতো আমি তাকে গ্রেফতার করলাম। “বদমাশ, হিসাব মাফিক তোর আর তিনজন দাঁড়ি কোথায়?” চিৎকার করে উঠলেন নাজির। “গোরা লোগ এত তাড়া করছিল যে দু’জন আসার আগেই নাও ভাসাতে হল।” আমার উপর হুকুম হল, বদমাশটাকে একটু মেরামত করার। দিলাম দু’-চার লাথ আর ঢুঁশা। ঘাটে যত নাও ছিল কোনওটারই ঠিকঠাক দাঁড়ি ছিল না। নাজির সব দেখে শুনে হুকুম দিলেন, “আভি আভি ধনপট সিং কো পকড় কে লাও। বাতিল করতে হবে ব্যাটার ইজারা। কোম্পানি কা গোরা তাদের জান নিয়ে তামাশা!” আমিও হুজুরের কথায় ঘাড় হেলিয়ে রওনা দিলাম। “আরে! পাঁচকড়ি খান ভাইয়া, আও, আও।” সেয়ানা পাটোয়ারি বলতে বসল, “হয়ে যাক এক ছিলিম গাঁজা।” আমি কী তেমন কাঁচা ছোকরা যে এত সহজেই বশ করা যাবে! শুরু করলাম চোটপাট। “আরে ইয়ার! তোমার পাঁচ রুপিয়ার কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। আরে ইয়াদ করো সেই তলোয়ারটার কথা! এই নাও দাম।” কায়দা বুঝতে আমার কোনও অসুবিধা হল না। চুপচাপ টাকাটা নিয়ে বসলাম গাঁজায় দম দিতে। এবার ধীরে ধীরে ধনপট জানতে চাইল, আমি কেন হাজির। মামলাটা খোলসা করতেই সে জবাব দিল, “ব্যস! খালি এই। তুমি শুধু দেখতে থাক কেমন করে আমি সামলাই।” হাজির হলাম নাজিরের দরবারে। ধনপট একটা লম্বা সেলাম ঠুকল হুজুরকে। শুরু হল তাঁর বাছাই করা গালিগালাজ। বাদ গেল না মা-বেটি কেউ। ফেরির পাটোয়ারি এত শুনেও কোনও জবাব দিল না। নাজিরের হাতে কেবল ধরিয়ে দিল একটা ছোট্ট চিট। ওই কাগজের চিটের ক্ষমতা দেখলে তাজ্জব হতে হয়। নাজির আর ইজারাদার চলল ঘাটের দিকে আমিও বেয়াকুবের মতো তাদের পিছু ধরলাম। আখেরে হুজুরকে রিপোর্ট দাখিল করা হল, গোরা লোগ সহি সালামত পারাপার করেছে।

ওই একই বছর অগাস্ট মাস, নদীতে তখন বান ডেকেছে। নজরে পড়ল একটা কিশতি এধার-ওধার দুলতে দুলতে ভয়ানক জোরে ভেসে আসছে। কমসে কম সত্তর থেকে পঁচাত্তরজন আদমি তখন ওই নাও-এর উপর। কিশতি আর পানির ফারাক ইঞ্চি ছয়েক। নাও চালাচ্ছে দু’জন। একজন হাল, আর একজন দাঁড়। দেখতে দেখতে কিশতি গিয়ে পড়ল একটা ঘূর্ণিতে। মাঝিদের তাকত ছিল না তার থেকে বের হয়। শুরুতে একবার পাক খেল তারপর সবকুছ খতম। কী নাও, কী সওয়ারি কারও কোনও হদিশ মিলল না। জরিমানা হল পাটোয়ারির। কিন্তু তাতে কী জান ওয়াপস মিলল? পাটোয়ারির খিলাফ তো খুনের মামলা রুজু হওয়ার কথা, না হলে কঠোর দণ্ড। আখেরে কিছুই হল না।

হ্যাকারি বা বয়েল গাড়ির চৌধুরিরা হচ্ছে মহা ওস্তাদ। এদের থেকেও মাতব্বর তাদের চ্যালারা। যে কোনও গাড়ির আড্ডা বা বাজার চত্বরে দেখা যাবে চ্যালাদের। মালিকের তরফদারি করছে। সওদাগর বা মহাজনের জরুরত পড়লে হ্যাকারির ইন্তেজাম করে দেবে চৌধুরিরাই। ঠেলাগাড়ির মালিকদের থেকে তারা তখন অনেক বেশি দরাজ। টাকায় তখন দস্তুরি কেবল দু-আনা, যেখানে হওয়ার কথা চার আনা। কমিশারিয়েট বা ম্যাজিস্ট্রেট হুজুর যদি আম আদমির ওয়াস্তে হ্যাকারি ম্যালিকদের কোনও কিছু হুকুম করেন তখন দেখবেন চৌধুরিদের খেল। স্রেফ জবরদস্তি সওয়ারি আর তার বউ-বাচ্চাকে মালপত্র সমেত গাড়ি থেকে নামিয়ে দিচ্ছে। ডাল-চালের বস্তারও একই হাল। সবকিছু পড়ে থাকবে সড়কের ধারে। কোনও নালিশে কাজ হবে না। সরকার বলবে আম-আদমির ওয়াস্তে দশটা গাড়ি মজুদ রাখতে হবে। দেখবেন হাজির হয়েছে একশোটা। এতগুলো গাড়ি কেন, সওয়াল করলে জবাব মিলবে, ভুল হো গয়া সরকার। দশটা গাড়ির জন্য বরাদ্দ তিরিশটা বয়েল; এই তিরিশটা বয়েলের খোরাকি বাবদ দিনের খরচ কম সে কম চার টাকা। আরও আছে নোকর-চাকরদের খরচ, পুরোটা নিশ্চয় টাকা পাঁচেকে সামাল দেওয়া যাবে না। মালিক যদি কঞ্জুস হয় তা হলে তো কথাই নেই, কিছুতেই সে নিজের থেকে টাকা বের করবে না। চলবে টানা-হ্যাঁচড়া—একবার কোতোয়ালি তো একবার সদর বাজার। আখেরে সাহেব কমসুরিয়ত (saheb kumsuriat)। এক আধলাও গাড়ির মালিকের জুটবে না যতক্ষণ না ফৌজের কুচকাওয়াজ শুরু হচ্ছে; হতে পারে সেটা এক হপ্তা আবার লেগে যেতে পারে তিন হপ্তাও। ততক্ষণ তাকে নোকর-চাকর আর গোরু বাছুরের খোরাকি জুগিয়ে যেতে হবে। তার জবানে এটা হচ্ছে— বা খয়ের খোওয়া-ই কোম্পানি (ba-khyr khwab-i-kompanee)। যদি তাকে এই সময় চৌধুরির হাতে কুড়িটা টাকা দিতে হয় কিংবা তার আধা কবুল করতে হয় বরকন্দাজকে তা হলেও তার লাভ কিছু কম হয় না বলেই আমার বিশ্বাস। আপনারা কী বলবেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *