1 of 2

১৫. সকাল বেলায় আনন্দ আর কল্যাণ এল

সকাল বেলায় আনন্দ আর কল্যাণ এল। সবে ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়েছে ওদের।

জয়িতা দরজা খুলে নিয়ে এল এই ঘরে। সোফায় বসে কল্যাণ বলল, কি দারুণ ফ্ল্যাটে থাকিস তোরা!

জয়িতা বলল, সাবধানে বসিস, যে কোন মুহূর্তে পায় ভেঙে পড়তে পারে।

সোজা হয়ে বসল কল্যাণ, সেকি রে!

হো হো করে হেসে উঠল সুদীপ, দারুণ বললি জয়ী, কল্যাণ কথাটার ভেতরের মানে ধরতে পারেনি। ও বলছে বাইরেটাই সাজানো, ভেতরে ফাঁকা।

গতরাত্রে জয়িতার সঙ্গে এ বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে তার। সে আর জয়িতা ডাইনিং টেবিলে খেয়েছে। বাকি দুজনের খাবার ঘরে ঘরে পৌঁছেছে শ্রীহরিদা। রামানন্দ রায় খেয়েছেন কিনা জানা নেই, তবে সীতা রায় যে খেতে পারবেন না এটা বিশ্বাস ছিল। ক্রমশ এক সময় রাগ নয়, ওই মানুষ দুটোর জন্যে কষ্ট হচ্ছিল সুদীপের। একটা সম্পর্করহিত-সম্পর্ক নিয়ে বেঁচে আছে দুজনে। শরৎচন্দ্রের একটা লেখা পড়ে আনন্দ বলেছিল একদিন, চমৎকার একটা ব্যাখ্যা পেলাম। নেতিয়ে পড়া আত্মীয়তা। সারা দেশটার মানুষের এখন ওই সম্পর্ক। টার্মসটা এখানে প্রযোজ্য।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, তোর বাবা মা কোথায়?

জয়িতা জবাব দিল, তাঁরা তাঁদের মতো আছেন। এ ঘরে কেউ আসবে না।

কল্যাণ বলল, আমার যদি বোন থাকত তবে তার ছেলে বন্ধুরা এইভাবে বাড়িতে এলে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যেত!

জয়িতা তাকাল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমি তোর বোন হয়ে জন্মাইনি।

কল্যাণকে থামাল আনন্দ, শোন সুদীপ, তুই ঠাকুরপুকুরে যেতে চাইছিস?

হ্যাঁ।

আরও তিনটে দিন অপেক্ষা করা যায় না?

কেন?

ঠাকুরপুকুর আমাদের চারজনের পক্ষে ভাল শেলটার। ওটাকে ডিস্টার্ব করতে চাই না।

সুদীপ মাথা নাড়ল, আমি আগে গেলে ভাল হবে। আত্মীয় বেড়াতে এসেছে বলে পাড়ার সবাই ধরে নেবে। তোরা যখন যাবি তখন কাউকে তো বাইরে বের হতে হবেই। সেই কাজটা আমিই করব। আগে থেকে থাকলে লোকে সন্দেহ করবে না।

কল্যাণ বলল, কথাটা ও ঠিকই বলেছে।

আনন্দ মাথা নাড়ল, বেশ। তাহলে আজ দুপুরের পর ওখানে চলে যা। সঙ্গে কল্যাণকে নিয়ে যাবি। যেন দুই বন্ধু বেড়াতে এসেছিস। কলকাতা দেখবি এমন ভান করবি। বুড়িকে ম্যানেজ করার ভার তোর। তোকে তো কেউ কেউ চেনে ওখানে। যাওয়ার সময় দুটো স্যুটকেস নিয়ে যাবি। মানে লোকে বেড়াতে গেলে যেভাবে যায় সেই রকম ভাবটা যেন থাকে।

আনন্দ একটু চুপ করল। তারপর বলল, আজকের কাগজে প্যারাডাইসের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু নতুন খবর বেরিয়েছে। কাগজ সন্দেহ করছে এটা উগ্রপন্থীদের কাজ। কয়েক হাজার প্রায় নিরন্ন মানুষের সামনে ওখানে যা যা ঘটত তার বিশদ বিবরণ ছেপেছে ওরা। কোন সাধারণ ডাকাত হলে তারা ডাকাতি করত। কাগজ বলেছে যারা ঘটনাটা ঘটিয়েছে তারা চেয়েছিল প্যারাডাইস চিরকালের জন্যে বন্ধ হয়ে যাক। কোন আর্থিক লোভের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। বলা যেতে পারে উগ্রপন্থীরা সফল।

আনন্দ থামলে জয়িতা বলল, যাচ্চলে। কাজটা করলাম আমরা আর কৃতিত্ব পাচ্ছে উগ্রপন্থীরা! আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, উগ্রপন্থী কারা?

জয়িতা উত্তর দিল, ওই যে, মাঝেমাঝেই কাগজে দেখি উগ্রপন্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, তারাই। আনন্দ মাথা নাড়ল, প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে যারা সরাসরি আঘাত হানতে চায় তারাই উগ্রপন্থী। আমাদেরও যদি ওই পর্যায়ে ফেলা হয় তাতে আপত্তি করার কি আছে? কেউ কারও কৃতিত্ব দখল করছে না, তাছাড়া তোরা নিশ্চয়ই হাততালি পাবার জন্যে কাজে নামিসনি।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, পুলিশ কি আমাদের খবর পেয়েছে বলে মনে হয়?

আনন্দ বলল, না। পুলিশের ধারণা ঘটনাটা যারা ঘটিয়েছে তারা স্থানীয় লোক নয়। নির্দিষ্ট ফর্মুলাতে তদন্ত চালালে কখনই ওরা আমাদের কাছে পৌঁছাবে না। তবে সুদীপ, ওই প্রস্তাবটা আমাদের মেনে নেওয়া উচিত। এই ধরনের ঘটনা ঘটাবার পরই আমরা কাগজগুলোকে টেলিফোনে জানাব কেন ঘটালাম। সরাসরি জনসাধারণের ব্যাপারটা জানা উচিত।

জয়িতা বলল, প্যারাডাইসের ঘটনাটা মাথা থেকে চলে গেছে। এবার নতুনটা শুরু কর।

আনন্দ হাসল, এবার খুব সহজে হবে না। মনে রাখিস নকশালরা পর্যন্ত ওখানে একটাও বোমা ফাটায়নি। তোদের কারোর সঙ্গে কোন ওষুধের দোকানের কর্মচারীর যোগাযোগ আছে?

চুপচাপ শুনছিল কল্যাণ, বলল, আমার আছে।

না। তোর সঙ্গে দোকানের মালিকের জানাশোনা। ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ার পর ভদ্রলোক তোকে সন্দেহ করতে পারেন। ঠিক আছে, আমিই ম্যানেজ করব। আমি আর সুদীপ দশটা নাগাদ বড়বাজারে যাব। কল্যাণ দুটো নাগাদ সুদীপকে মিট করবি ধর্মতলায় শহীদ মিনারের সামনে। ওখান থেকে তোরা চলে যাবি ঠাকুরপুকুরে। দুদিন জায়গাটা ভাল করে ওয়াচ করতে হবে। আনন্দ বলল।

জয়িতা খানিকটা উষ্ণ গলায় জিজ্ঞাসা করল, আমি কি করব?

ঘুমুবি। চুপচাপ বাড়িতে বসে রেস্ট নে। তুই আমাদের পোস্ট অফিস। এই বাড়িতে তোর এখন ভূমিকা কেমন? তোর ঘর এটা নয় নিশ্চয়ই!

না।

তোর ঘরে প্রাইভেসি আছে?

আমি ছাড়া আর কেউ যায় না।

চমৎকার। কাল রাত্রে যে জিনিসগুলো কিনেছি সেগুলো রাখার একটা জায়গা দরকার। আমার হোস্টেল মোটেই সেফ নয়। আমি ওগুলো আজ যে-কোন সময়ে এখানে পৌঁছে দেব। তুই বাড়ি থেকে কোথাও যাস না। পুলিশের পক্ষে এতদূর চিন্তা করা সম্ভব নয়। সুদীপ, তোর কাছে আর কত টাকা আছে? টাকাগুলো সঙ্গে নিয়ে ঠাকুরপুকুরে যাবি।

সুদীপ হাত বাড়িয়ে খামটা বিছানা থেকে তুলে নিল, বেশ কয়েক হাজার আছে।

কল্যাণের চোখ বড় হল, তুই ওভাবে টাকাগুলো ফেলে রেখেছিস?

সুদীপ বলল, কী হয়েছে তাতে! এ বাড়িতে ডেকে না আনলে চোর আসে না।

কথাটা শুনে একমাত্র জয়িতাই শব্দ করে হাসল। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার?

সুদীপ মাথা নাড়ল, ছেড়ে দে। আনন্দ, তুই ব্যাপারটা আর একবার খুলে বল।

মাস দুয়েক আগে আনন্দর হোস্টেলের একটি ছেলে হঠাৎ অসুস্থ হয়। সামান্য জুর। টুকিটাকি ট্যাবলেট খেয়েছিল ছেলেটি। জুর কমছিল কিন্তু অস্বস্তি ছিল। সন্ধ্যার পর জুব বাড়তে শুরু করে। ওটা এমন অবস্থা যখন লোকে ডাক্তার ডাকার কথা ভাবে কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ার কথা চিন্তাও করে না। রাত দশটা নাগাদ ছেলেটির পেটে ব্যথা শুরু হল এবং বমি-বমি ভাব এল অথচ বমি হচ্ছিল না। তখন ছেলেরা হোস্টেলের ডাক্তারকে খবর দিল। সব হোস্টেলেই যেমন, এখানেও ভদ্রলোকের চিকিৎসা নিয়ে ঠাট্টা চালু আছে। ঘোড়া ছাড়া কেউ ওঁর ওষুধে সুস্থ হয় না। কিন্তু বৃদ্ধ ভদ্রলোক খুব যত্ন করে দেখলেন। কিছু কিছু লক্ষণ ম্যালেরিয়ার হলেও সব মিলছে না। তিনি জ্বর এবং বমি কমাবার ওষুধ দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হচ্ছিল না। বাড়তে বাড়তে জ্বর চারে পৌঁছে গেল। এবং সেইসঙ্গে বমির ভাবটা বাড়ল। কাছেই মেডিক্যাল কলেজ। ভদ্রলোক একটা বমি বন্ধ এবং পেট ব্যথা সারানোর ওষুধ ইঞ্জেকশনে পুরে বলেছিলেন, মনে হচ্ছে এতে কমবে। আধঘণ্টা অপেক্ষা করি। তারপর প্রয়োজনে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে আনন্দও সেই ঘরে ছিল। অসুস্থ ছেলেটি ভদ্র ব্যবহারের জন্যে সবারই প্রিয়। কিন্তু ইঞ্জেকশনটা পুশ করার পরই অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। ছেলেটির সমস্ত শরীরে লাল লাল দাগ ফুটে উঠল। তার জ্বর কমতে লাগল হু-হু করে। হাসপাতালে পৌঁছবার আধঘণ্টা বাদেই সে মারা গেল। হোস্টেলের ছেলেদের ধারণা হয়েছিল ব্যাপারটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। বমি এবং ব্যথার ইঞ্জেকশনে কেউ মারা যায় না। হাসপাতাল থেকে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হল রক্তচাপে হৃত্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে—এই কারণ দেখিয়ে। ছেলেরা বৃদ্ধ ডাক্তারের ওপর হামলা করেছিল। তিনি সমস্ত দায়িত্ব অস্বীকার করেছিলেন। ওই দুটো ওষুধের মিশ্রণ যে কোন মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর নয়। দরকার হলে তিনি আদালত পর্যন্ত যেতে রাজী হয়েছিলেন। আনন্দর খুব খটকা লেগেছিল। সে পরদিন বৃদ্ধ ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করেছিল। মৃত্যু এবং ছেলেদের আক্রমণে ভদ্রলোক তখন দিশেহারা। আনন্দ একা তার সামনে বসে জিজ্ঞাসা করেছিল, এই রকম ইঞ্জেকশন আপনি আগে কখনও দিয়েছিলেন।

বৃদ্ধ ডাক্তার মাথা নেড়েছিলেন, সারাজীবন, হাজার হাজার। কিন্তু কেন এমন হল এবার বুঝতে পারছি না।

আপনি ঠিক কি ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন?

ডাক্তার ইঞ্জেকশন দুটোর নাম বললেন। হঠাৎ আনন্দর মাথায় প্রশ্নটা এল, ডাক্তারবাবু, আপনি বলুন তো, ওই ইঞ্জেকশন দুটো জেনুইন ছিল কিনা? আজকাল শুনেছি জাল ওষুধ বাজারে বেরিয়েছে।

বৃদ্ধ ডাক্তারকে হতভম্ব দেখাল, তাই যদি হয় তাহলে আমি কি করব?

আপনার ইঞ্জেকশনগুলো কি স্যাম্পেল হিসেবে পেয়েছেন?

না। ফোনে যখন ছেলেটির অসুখের কথা বলা হল তখন তোমাদের ওখানে যাওয়ার সময় দোকান থেকে কিনেছিলাম। এ বাবদ বিল করলে তোমাদের হোস্টেল থেকে টাকা দিয়ে দেওয়া হয়।

কোন্ দোকান থেকে আপনি কিনেছিলেন?

ডাক্তার নাম বললেন। দোকানটাকে দেখেছে আনন্দ। মাঝারি দোকান। সে ইঞ্জেকশন দুটোর নাম লিখে নিয়ে সোজা দোকানটায় হাজির হয়েছিল। মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক ছিলেন দোকানে। দুটো ফাইল কিনল সে। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনারা ওষুধ কেনেন কোত্থেকে?

কেন? ভদ্রলোক সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেন।

না, আমি জানতে চাইছি! সরাসরি কোম্পানি থেকে কিনে আনেন?

না। হোলসেলারের কাছ থেকে।

কথা বাড়ায়নি আনন্দ। ওখান থেকে সোজা প্রফেসর চ্যাটার্জীর গবেষণাগারে চলে গিয়েছিল। প্যাথলজিস্ট এই মানুষটি আত্মভোলা। আনন্দকে খুবই স্নেহ করেন। তাকে বিস্তারিত বলেছিল সে। ভদ্রলোক বাক্সসুদ্ধ ওষুধদুটো নিয়ে দেখেটেখে বললেন, তোমার এমন সন্দেহ হল কেন? ব্যাচ নম্বর পর্যন্ত দেওয়া আছে। যা যা আইনে দরকার তার সবই ছাপা আছে। জাল ভাবার কোন কারণ দেখছি না।

আনন্দ এও বলেছিল, হয়তো কোন কারণ নেই। কিন্তু এই দুটো দেওয়ামাত্র সমস্ত শরীরে চাকা চাকা লাল দাগ ফুটে উঠবে কেন? কেন মনে হবে রক্ত জমে যাচ্ছে চামড়ায়? আমার বিশ্বাস রক্তচাপ বাড়িয়ে দেবার কারণ ওটা। পোস্টমর্টেম করলে বোঝা যেত।

প্রফেসর চ্যাটার্জীর নির্দেশমত বিকেলবেলায় সুদীপকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হয়েছিল আবার। এর মধ্যেই তিনি পরীক্ষা করে রাখবেন। গিয়ে দেখলে চ্যাটার্জী খুব উত্তেজিত। মুখোমুখি হওয়ামাত্র জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় কিনেছ এইগুলো? ইটস ডেঞ্জারাস, রিয়েল ডেঞ্জারাস।

আনন্দ সুদীপের দিকে তাকাল। প্রফেসর বললেন, দুটো ওষুধ ওদের কোম্পানি তৈরি করতে পারে। কারণ বমির ওষুধটাতে আর যাই থাক বমি বন্ধ হবার কোন উপকরণ নেই। ব্যথারটাতেও তাই। যারা তৈরি করেছে তারা ম্যানুফ্যাকচারিং কস্ট ষাট ভাগ কমাতে পেরেছে। এই ওষুধ পুশ করলে কার যদি উপকার হয় তাহলে সেটা সম্পূর্ণ মানসিক। কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে এই ওষুধ পেশেন্টের ক্ষতি করবে না। কোন খারাপ লক্ষণও দেখা যাবে না। ফলে এটা জাল কিনা তা বোঝার কোন উপায় রইল না। কিন্তু মুশকিল হল, ওই দুটো ওষুধ মেশালে যে রি-অ্যাকশন হবে তা মারাত্মক। সরাসরি রক্তে অ্যালার্জি শুরু হয়ে যাবে। শরীরে তার চাপ বাড়বে। এবং সেইসঙ্গে রক্ত দানা বাঁধতে শুরু করবে। এ অন্যায়, ভীষণ। অন্যায়। ডাক্তাররা না জেনে পাপের অংশীদার হচ্ছেন। ইট শুড বি স্টপড়, রাইট নাউ। আমি তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। এক্ষুনি পুলিশকে ইনফর্ম করে ওই দোকানের এই সব ওষুধ সিজ করানো উচিত। প্রফেসর খুব দ্রুত কথা বলছিলেন।

সুদীপ বলল, কিন্তু ওই ওষুধগুলো অন্য দোকানেও নিশ্চয়ই পৌঁছেছে। একটা দোকান থেকে নিয়ে কি লাভ হবে? বন্ধ করতে হলে সোর্সটাকেই আটকানো দরকার।

অফকোর্স। আই মাস্ট রাইট। সরকারকে আমি ডিটেলস দিয়ে লিখব। ওদের তো জাল ওষুধ বন্ধ করার একটা ডিপার্টমেন্ট আছে। কিন্তু তার আগে থানায় যাব। ওরা ইমিডিয়েটলি দোকানটা বন্ধ করুক। তোমরা আমার সঙ্গে যাবে? প্রফেসর উঠে দাঁড়ালেন।

ওরা প্রফেসরের সঙ্গী হয়েছিল। ও সি সবকথা শান্তভাবে শুনলেন। তারপর বললেন, দুটো ওষুধ একসঙ্গে মিশিয়ে শরীরে ঢোকাবার কি দরকার? আলাদা আলাদা ভাবে দিলেই তো হয়।

প্রফেসর থতমত হয়ে গেলেন, মানে? ওষুধগুলো তো জাল।

ওসি বললেন, এ ব্যাপারে আমরা তো অনভিজ্ঞ মশাই। আপনার অভিযোগ উপযুক্ত দপ্তরে করতে হবে।

সেকি! পুলিশ জাল ওষুধের কারবার বন্ধ করবে না? ওই ওষুধ শরীরে ঢোকালে কোন কাজ হয় না।

কিসে কাজ হয় বলতে পারেন? কোন কিছুতেই কাজ হয় না। আপনি ডায়েরি করুন। আমি ওই দোকান থেকে এই দুটো ওষুধ সিজ করে অথরিটির কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওরা অ্যানালিসিস করে যদি প্রমাণ পায় তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সব কিছুর একটা নিয়মকানুন আছে মশাই। ধরুন চোখের সামনে দেখলেন একটা লোককে কেউ খুন করল, আপনি তৎক্ষণাৎ তার ফাসি দিতে পারবেন? আপনারা ডায়েরি করে যান, তারপর যা ব্যবস্থা নেবার আমি নেব।

প্রফেসরকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে সুদীপ বলেছিল, এ তো ঠাণ্ডা মাথায় গণহত্যা! ও সি-র কথা শুনে মনে হল একশ মাসে এক বছর। কি করা যায়?

আনন্দ বলেছিল, কিছু করার নেই একথা আমি বিশ্বাস করি না।

ওরা খোঁজ নিতে আরম্ভ করেছিল। ওই দোকানটি ওষুধ কেনে কোত্থেকে? যারা ওষুধ এদের বিক্রি করে তারা তা কার কাছ থেকে পায়? শেষ পর্যন্ত বড়বাজারের সত্যনারায়ণ পার্কের পাশে একটা রাস্তার হদিশ পেয়েছিল ওরা। আনন্দ তখন ব্যাপারটা নিয়ে আর এগোতে চায়নি। কারণ ওদের সেই পরিচিত ওষুধের দোকানটি পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর আবার স্বাভাবিকভাবে চালু হয়েছে। সেই সময় ওই ঠিকানায় পৌঁছে কোন লাভ হত না। বরং বিপদের সম্ভাবনাই থাকত। যারা জাল ওষুধের কারবার করে তারা নিশ্চয়ই নিরীহ মানুষ হবে না। এবং তার প্রমাণও পেয়েছিল ওরা। কেউ বা কারা প্রফেসরকে টেলিফোনে হুমকি দেয়, যদি তিনি জাল ওষুধ নিয়ে বেশি মাথা ঘামান তাহলে যে কোনদিন তাকে শেষ নিঃশ্বাস নিতে হবে। সেদিনই খবরের কাগজে জাল ওষুধ বাজারে শীর্ষক একটি সংবাদ বেরিয়েছে। টেলিফোনটি পাওয়ার পর প্রফেসর সাহস হারিয়ে ফেললেন। তিনি এ ব্যাপারে কথাবার্তা বন্ধ করলেন। পশ্চিম বাংলায় যে কোন সাড়াজাগানো ঘটনার পরিণতি যা হয় এক্ষেত্রেও তাই হল, দুদিনেই লোকে বিস্মৃত হল, ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে যেতে তাই দেরি হল না।

কিন্তু এই ঘটনাটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে চারজনেব। বড়বাজার মানেই অসৎ মানুষের ডেরা নয়। সেখানে নিরীহ, ভদ্রমানুষ প্রচুর আছেন। কিন্তু মতলববাজ ব্যবসায়ীর সংখ্যা কম নয়। আনন্দর ধারণা গ্রামের একজন জোতদারের শোষণক্ষমতার চেয়ে লক্ষ গুণ ক্ষমতাবান হল এখানকার পুঁজিপতি অসৎ ব্যবসায়ীরা। ওই একটি অঞ্চল সমস্ত পূর্বদেশে শুধু অর্থনীতি নয়, মানুষের বেঁচে থাকার সামান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করছে। রাইটার্সে সরকার আছেন ঠিকই কিন্তু একটি অদৃশ্য শাসনব্যবস্থা এখান থেকেই চালু আছে। সাতষট্টি থেকে বাহাত্তর—সারাদেশ যখন তোলপাড় তখন সাধারণ মানুষের প্রাণ গিয়েছিল সিঁথি কিংবা কসবায় কিন্তু বড়বাজারে একটাও বোমা পড়েনি। পুঁজিপাতের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ থাকলে সেটাই তো স্বাভাবিক ছিল।

সুদীপ বলল, আমাদের জানাশোনার মধ্যে একটি প্রাণ অকারণে শেষ হয়েছিল। কিন্তু আর একজন এই জাল ওষুধের শিকার হয়েছে আমি জানি না। এসব কেউ বন্ধ করবে না। আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় বৃথাই আমরা মাথা ঘামাচ্ছি। শরীরের একটা অংশে যদি পচন ধরে সেটা কেটে বাদ দিয়ে দেহটাকে বাঁচানো যায়, কিন্তু যে দেহের সর্বত্র পচন সেখানে কোন্টা বাদ দিবি? যেদিকে তাকাবি কোরাপশন! ট্রাফিক পুলিশ থেকে সরকারী অফিসার হাত বাড়িয়েই থাকে। খাবার ওষুধ এমন কি মানুষ স্বপ্নেও ভেজালে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। যদি দশ বছর বয়সের ছেলেমেয়েগুলোকে রেখে বাকি সব সিটিজেন অফ ইন্ডিয়াকে সমুদ্রে ফেলে দিয়ে আসা যায় তাহলে হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম সঠিক সমাজব্যবস্থা গড়ে নিতে পারবে।

আনন্দ হেসে ফেলল, তুই যেমন এই কথা বলছিস তেমনি দেশের কিছু কিছু মানুষ এই অসঙ্গতি দেখতে পাচ্ছেন। আমরা শুধু তাদের আলস্যকে বিরক্ত করব। এই সব মানুষকে কিন্তু তুই সমুদ্রে ফেলছিস না?

কি বলতে চাইছিস?

আচ্ছা ধর, আমার মা। কোন রাজনীতি বোঝেন না, প্যাচ পয়জারে নেই, তিনি চান আমি সুস্থ থাকি, দুবেলা নিশ্চিন্তে জীবন অতিবাহিত করতে পারি। তার জন্যে আমার একটা ভাল চাকরি কিংবা ব্যবসা চাই। তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন না যে আমি ব্যবসায় অসৎ মানুষকে ঠকাই কিংবা ফাঁকি দিয়ে চাকরি করে কর্তৃপক্ষকে ডোবাই। কিন্তু তিনি চাইবেন খাটি খাবার, ওষুধে অন্ধ-নির্ভরতা। এই মানুষটিকে তুই বর্জন করবি কোন যুক্তিতে? আর এইরকম মা-মাসী অথবা বোনের সংখ্যাই এই দেশে বেশি। পুরুষেরা যারা অর্থের জন্যে বাইরে বেরিয়ে তাল রাখতে পারছে না তারাই বাধ্য হচ্ছে অসৎ উপায় অবলম্বন করতে। দশ জন অন্ধের সঙ্গে তোকে এক ঘরে কয়েক বছর রাখলে তোর নিজেরই লজ্জা করবে চোখ চেয়ে দেখতে। তুই তখন চোখ বন্ধ করে অন্ধ সেজে সহজ হবি। চারপাশে লোকে যখন বেআইনি পথে জীবনযাপন করছে তখন নিজের অজান্তেই মানুষ তাই করে ফেলে। বেআইনটাই আইন হয়ে দাঁড়ায়।

আনন্দ থামতে জয়িতা বলল, তাহলে তুই বলছিস পুরুষরাই কোরাপটেড, মেয়েরা নয়।

তা বলিনি। তবে একথা ঠিক মেয়েদের স্থির থাকার পার্সেন্টজ নব্বই ভাগ। এবং তার কারণ আছে। আমাদের দেশে মেয়েরা বাড়ির বাইরে টাকা রোজগার করতে আসছে বড় জোর চল্লিশ বছর। মার কাছে শুনেছি কলেজে পড়ার সময় মেয়েরা অধ্যাপকের পেছন পেছন ক্লাসে ঢুকত বেরুতে। সেটা তো সাতান্ন আটান্ন সালের কথা। দীর্ঘদিন গৃহবন্দী থাকায় মেয়েদের নিজেদের আচরণ সম্পর্কে সচেতনা তৈরি হয়েছে। একটি পুরুষের চেয়ে একটি শিক্ষিত মহিলা অনেক বেশি ডিগনিফাইড়, নিজের সম্ভ্রম বজায় রাখতে অনেক বেশি সচেষ্ট। ওই পুরনো সংস্কারেই বাইরের মানুষের সংস্পর্শে এলে ওঁরা একটা পর্দা ফেলে রাখেন। জীবিকার প্রয়োজনে আজ মেয়েদের বাইরে আসতে হচ্ছে। একই অভাবী অবস্থায় দুজন কর্মচারী পাশাপাশি কাজ করলে দেখা যাবে দশজনের মধ্যে আটজন পুরুষ যেখানে ঘুষ নিচ্ছেন সেখানে হয়তো দশজনের মধ্যে দুজন মহিলা ঘুষ নিতে পারেন। আমি এখনও বিশ্বাস করি এই দেশে যদি কখনও বিপ্লব আসে, যদি সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন হয় তাহলে মেয়েরাই সেটা করবে। এখনও সততা শব্দটাকে ওরাই বাঁচিয়ে রেখেছে। অতএব সুদীপ, তোর সঙ্গে আমি একমত নই। আমাদের চার জনের পক্ষে এই দেশের ছবিটা পালটে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা ধাক্কা দিতে পারি। এই ধাক্কার কাঁপুনিটা সাধারণ মানুষের মনে পৌঁছানো দরকার। হয়তো হাতেগরম ফল পাওয়া যাবে না, কিন্তু কে বলতে পারে এটাই বীজ হয়ে দেখা দেবে না এক সময়। তবে চারটে ঘটনা ঘটনোর আগে কেউ যেন আমরা ধরা না পড়ি। ধরা পড়ার সুযোগ আছে এমন ঝুঁকি যেন না নিই। এবং যদি ধরা পড়ি তাহলে আদালতে আমরা কেউ উকিলের সাহায্য নিয়ে মিথ্যে বলব না। আদালতকে স্পষ্ট বলব আমরা কি করতে চেয়েছি কেন চেয়েছি।

কল্যাণ বলল, আগে ধরা পড়ি তারপর ওসব ভাবা যাবে।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, তোর এখনও এদেশের আদালতের ওপর বিশ্বাস আছে?

জয়িতা হাত তুলল, আমরা কিন্তু বারংবার পুরোনো তর্কে ফিরে যাচ্ছি। আমাদের প্রোগ্রামটা নিয়ে কথা এগোচ্ছে না। আমরা কি বড়বাজারেই প্রথম অ্যাকশন করব?

কল্যাণ বলল, আমার মনে হয় আগে রেসকোর্সটা টার্গেট করা উচিত।

আনন্দ মুখ ফেরাল, কেন?

কল্যাণ এবার সোজা হয়ে বসল, রেসকোর্সটা মোস্ট ডেঞ্জারাস, অন্তত আমাদের সামাজিক অবস্থায়। প্রথম কথা, বিশাল জায়গা খোদ শহরের বুকে ফেলে রাখা হয়েছে। কলকাতায় এত স্পেস ক্রাইসিস অথচ কতকগুলো অর্থবান সেটাকে দখল করে রেখেছে মানুষকে বধ করতে। স্পোর্টস না ছাই! হাজার হাজার মধ্যবিত্ত গরীব মানুষকে বড়লোক হবার লোভ দেখিয়ে ওখানে ডেকে নিয়ে গিয়ে নিঃস্ব করে ছেড়ে দেওয়া হয়। সরকার চোখের সামনে এই শোষণ দেখেও নির্লিপ্ত কারণ তারা শতকরা চল্লিশ ভাগ ট্যাক্স পাচ্ছেন। আমি একদিন রেসকোর্সে গিয়েছিলাম ব্যাপারটা দেখতে। অন্তত নব্বই ভাগ গরীব মানুষ এই লোভের শিকার হয়েছেন। একটা রেসে দশটা ঘোড়া দৌড়াচ্ছে। যে কোন একটা জিতবে। অর্থাৎ যে টাকা পাবে সে বাকি নজনের লাগানো টাকার একটা অংশ পাচ্ছে। যারা টাকা দিচ্ছে তারা ওই নজনের টাকার সামান্য অংশ বিজয়ীকে দিয়ে বাকিটা হাতিয়ে নিচ্ছে। হিসেব করলে দেখা যাবে দশ টাকা যদি রেসুড়েরা খরচ করে তার চার টাকা নেয় সরকার, চারটাকা রেসকোর্স আর দুটাকা পায় বিজয়ীরা। আর এই দুটাকা রোজগার করতে তাদের দুশো টাকা বেরিয়ে যায়। এই শোষণযন্ত্রের চাপে গরীব আরও গরীব হচ্ছে। হাজার হাজার সংসার তার শিকার হচ্ছে। আর আশ্চর্য ব্যাপার জানিস, রেসকোর্সে দেখলাম অল্পবয়সী ছেলেদের ভিড়। ওই বয়সেই তাদের লোভের স্বাদ দেওয়া হয়েছে। সরকার জানেন ব্যাপারটা। আইন কর্তাদের সুবিধে দিচ্ছে। এইটা বন্ধ করা দরকার। স্পোর্টসের নাম করে মানুষ মারার এই যন্ত্রটাকে অকেজো করে দেওয়া উচিত।

আনন্দ বলল, আমি তোর সঙ্গে একমত। কিন্তু রেসকোর্স বন্ধ করা সোজা ব্যাপার নয়। ওদের সিস্টেমটা ব্যাপক। প্যারাডাইসের মতো চারটে বোম ফেলে বন্ধ করা যাবে না। ব্যাপারটা আমি যেভাবে ভেবেছি তাতে কিছুটা সময় দরকার। সেদিক দিয়ে কিছুটা কাজও এগিয়েছে। আমি জানি কথা বলে কোন কাজ হবে না। তবু কথা বলব। টেলিফোনেই। ওদের সুবুদ্ধির কাছে আবেদন করব। এবং নাকচ হওয়া মাত্র সেটা খবরের কাগজে জানিয়ে দেব। সারা দেশে একটা টেনশন তৈরি হোক। কিন্তু তার আগে আমাদের আর একটি কঠিন কাজ করা দরকার। সেইটে ওই জাল ওষুধ বন্ধ করা। আমি মনে করি দুটো কারণে এটাই আমাদের প্রাথমিক কাজ হওয়া উচিত। এই মিশ্রিত ওষুধ মানুষকে মেরে ফেলছে, এককভাবে কোন উপকারেই আসছে না। দ্বিতীয়ত, এই ঘটনা পরবর্তীকালে আমাদের সম্পর্কে আতঙ্ক তৈরি করতে সাহায্য করবে। এখন কিভাবে আমরা কাজটা করব?

ওরা আলোচনা করল। কাজের কথায় এসে গেলে সুদীপ খুব সিরিয়াস। কল্যাণের একটু তর্ক করা অভ্যেস। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত পৌঁছে গেল ওরা। এতক্ষণ এই ঘরে কেউ আসেনি। হঠাৎ শ্রীহরিদাকে দেখা গেল। তার হাতের ট্রেতে চায়ের কাপ এবং বিস্কুট। কল্যাণ হেসে বলল, যাক, আমি ভেবেছিলাম তোদের বাড়িতে এসবের কোন ব্যবস্থা নেই।

জয়িতা বলল, আমি কাউকে চা দিতে বলিনি। ইনফ্যাক্ট দিতে চাইনিও।

কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, কেন?

তার কথা বলা শেষ হওয়ামাত্রই শ্রীহরিদা ট্রে নামিয়ে রেখে ঘোষণা করল, সাহেব বেরিয়ে যাচ্ছেন। তোমাকে একবার দেখা করতে বলল।

সুদীপ অবাক হয়ে জয়িতাকে জিজ্ঞাসা করল, ওকে বললে কথা বুঝতে পারে?

আমাদের কথা পারে। চা খেয়ে নে। ওর বলার ভঙ্গিতে উষ্ণভাব ছিল না।

কল্যাণ বলল, রাগ করিস না। আমার খুব দূর-সম্পর্কের এক আত্মীয়েব বাড়িতে রাত আটটায় যেতে হয়েছিল একবার। খুব বড়লোক, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে থাকেন। কথা বলছি এমন সময় ভদ্রমহিলা বললেন, আটটা বেজে গেছে, এখন নিশ্চয়ই তুমি কিছু খাবে না? বলাব ভঙ্গিটা এমন যে পেটে প্রচণ্ড খিদে থাকা সত্ত্বেও হ্যাঁ বলতে পারিনি।

সুদীপ বলল, আমি হলে বলতাম আজ্ঞে না, খিদে পেয়েছে খেতে দিন। আসলে তোর মধ্যেও এক ধরনের মেকি ভদ্রতা কিছুটা ঢুকে আছে।

বাজে কথা বলিস না। কল্যাণের গলা উত্তপ্ত হল, কথাটা শোনামাত্র ভদ্রমহিলাকে আমার দয়া করতে ইচ্ছে করল। এই সব বড়লোকগুলোকে আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না।

এটাও এক ধরনের কমপ্লেক্স।

তুই কিন্তু গায়ে পড়ে পেছনে লাগছিস সুদীপ!

জয়িতা উঠে পড়ল, আমি মাঝেমাঝে ভাবি আমরা চারজন একসঙ্গে মিললাম কি করে? স কিছুর পেছনে যে কারণ থাকে একথাটা বোধ হয় সব সময় সত্যি নয়।

আনন্দ মাথা নাড়ল, বেসিক বোধটা এক বলে আমরা তাড়াতাড়ি কাছাকাছি হয়েছি এবং আমি তোদের বলব ওইটেকে বাঁচিয়ে রাখতে। নইলে তোরা জয়েন্ট দিতে পারতিস, আই এ এস হতে পারতিস, এসব করার দরকার ছিল না। ভারতবর্ষের একটি ছাপ মারা নাগরিক হতে তোদের বেশি কষ্ট করতে হত না।

হঠাৎ আবহাওয়াটা থমথমে হয়ে গেল। সুদীপ হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ তুলল। জয়িতা বেরিয়ে এসে কয়েক পা হাঁটতেই রামানন্দ রায়কে দেখতে পেল। স্যুট-টাই পরে তিনি একটু অধৈর্যভঙ্গিতে অপেক্ষা করছেন। জয়িতা মুখোমখি হওয়ামাত্র জিজ্ঞাসা করলেন, এভরিথিং অলরাইট?

অভ্যস্ত প্রশ্নটি শুনে জয়িতার ঠোঁটে হাসি ফুটল, ডেকেছ?

না, মানে, তুমি আজ বেরুবে?

দেখি।

তোমার মা খুব আপসেট।

তাতে আমার কি?

আই নো, আই নো জয়, তুই আমাদের ঘৃণা করিস এটা বলেছিস। কিন্তু আমি তো কাউকে ঘৃণা করতে পারি না। কেউ একটা অন্যায় করলে আমি পালটা আর একটা অন্যায় করে নিজেকে ঠিক রাখি। আচ্ছা চলি। রামানন্দ রায় হঠাৎ কথা শেষ করে বেরিয়ে গেলেন। জয়িতা ওঁর চলে যাওয়া দেখল। এবং এই মুহূর্তে হঠাৎ তার বুকে একটা বাষ্প গুড়ি দিচ্ছিল। সে ওপাশের দরজাটার দিকে তাকাল। সীতা রায় কি করছেন সে জানে না। হার হারানো, না সান্যালের জন্যে তিনি আপসেট কে জানে! ব্যাপারটা ভাবতেই তার বুক থেকে বাষ্পটা মিলিয়ে গেল।

 

সুদীপ আনন্দ আর কল্যাণ য়ুনিভার্সিটির স্টপেজে নামামাত্র মনে হল কানের পর্দা ফেটে যাবে। ফুটপাত দখল করে মাইকে ছাত্ৰ-কর্মচারীরা চিৎকার করে যাচ্ছে। কাছাকাছি দুটো দল পরস্পর পরস্পরকে দোষী প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। ওরা উলটো ফুটপাতে চলে এল। সুদীপ বলল, দু-দলের ডায়ালগ এক হয়ে কানে ঢুকছে?

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, কোন ডিফারেন্স পাচ্ছিস?

না।

এদের আন্দোলনটা কিসের জন্যে?

দুদলই পরস্পরকে দোষী করছিল। এক দল উপাচার্যের কীর্তিকলাপ বন্ধ করতে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দিচ্ছিল। আর একদল এদের বামফ্রন্টের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করছিল। ওরা লক্ষ্য করল প্রতিটি বক্তাই উত্তেজিত, হাত-পা নেড়ে বিশ্বরাজনীতি প্রসঙ্গ নিয়ে আসছিল বক্তৃতাকে জ্বালাময়ী করতে। এবং তখনই ঠিক মাঝখানে একটা বোমা ফাটল সশব্দে। সঙ্গে সঙ্গে দুদলে প্রচণ্ড হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল। চিৎকার চেঁচামেচি। ভাইসব যাবেন না, কমরেড ভয় পাবেন না। পিঁপড়ের লাইন থেকে আঙুল সরিয়ে নেবার পর তারা যেমন আবার একত্রিত হয় তেমনি কিছুক্ষণ পরে আবার বক্তৃতা আরম্ভ হল। এবার দুপক্ষই পরস্পরকে বর্বর আক্রমণের জন্যে দায়ী করতে লাগল। আনন্দরা নড়েনি। পুরো ঘটনাটা দেখার পর আনন্দ বলল, ওরা কি করছে বল তো? কি ইস্যু নিয়ে এইভাবে নিজেদের শক্তি সময় অপচয় করছে? এতে কার কি লাভ হবে? আর ওরা তা জেনেই এইটে করছে। একটা নিরাপদ আন্দোলনের মধ্যে না থাকলে নেতৃত্ব হাতছাড়া হয়ে যাবে। দাদারা যা বলেছে তাই করছে ওরা। দেশ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ দূরের কথা, সহপাঠীদের জন্যও ভাবনা নেই। বোমাটা কায়দা করে  এমন জায়গায় ফাটাল যাতে কারোর গায়ে আঁচ না লাগে। এসব দেখলে বমি আসে।

আনন্দকে প্রচণ্ড উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। সুদীপ বলল, তাড়াতাড়ি চল, হাতে সময় নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *