1 of 2

১৫. শ্রীনাথ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল

শ্রীনাথ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, এসো। কিছু বলবে?

তৃষা খুব তীক্ষ্ণ চোখে সজলের দিকে চেয়ে ছিল। চৌকাঠের ওপাশ থেকেই বলল, ক্ষুরটা কি তুমি সজলকে দিয়ে দিলে?

হুঁ।

কেন দিলে?

ওর ওটার ওপর খুব লোভ। প্রায়ই চুরি কবে আমার ঘরে ঢুকে ক্ষুরটা নিয়ে দুষ্টুমি করে বেড়ায়।

তাই দেবে? বাচ্চা ছেলের হাতে ধারালো জিনিস থাকলে কত কী বিপদ হতে পারে।

শ্রীনাথের যে কথাটা মনে হয়নি তা নয়। কোথায় যেন একটু অপরাধবোধ জেগে ওঠে তার। বলে, ওকে বলেছি রেখে দিতে।

তৃষা কঠিন গলায় বলল, সজল কি খুব বাধ্য ছেলে? ওকে তুমি চেনো না?

শ্রীনাথ বিরক্ত হয়ে বলে, অ৩ ভেবে দেখিনি। না দিলেও তো নিজে থেকেই নেবে।

তাই ওই সর্বনেশে জিনিস হাতে তুলে দিতে হবে? ওইটে দিয়েই মুরগি কেটেছিল!

সজল টেবিলের ধারটায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মা বাবা দু’জনকেই সে সাংঘাতিক ভয় পায়। ক্ষুরটা নিয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে মুঠোয় ধরে রেখেছে। চোখ দরজার দিকে।

শ্রীনাথ কঠিন স্বরে বলে, তার আগে আমার জানা দরকার মুরগি কাটার জন্য ক্ষুরটা ও পেয়েছিল কী করে! আমার ঘরে ঢুকল কী করে?

তৃষা শ্রীনাথের দিকে স্থির তীব্র চোখে চেয়ে বলে, সেটা ওকেই জিজ্ঞেস কোরো। আমার সেটা জানার কথা নয়।

শ্রীনাথ এ নিয়ে কথা বাড়াতে চায় না। চাবিব কথা উঠলে সজলের নাম ফাঁস হয়ে যাবে। তাই সে তৃষার চোখের দিকে না তাকিয়ে বলল, আমার দেওয়ার ভাগ দিয়েছি। তোমার ভয় করলে ওর কাছ থেকে নিয়ে নাও।

তৃষার গলায় বেশির ভাগ সময়ে উম্মা থাকে না, কাঠিন্য থাকে। ঠান্ডা নিরুত্তাপ একরকম রক্ত জল করা গলায় বলল, ও খুব স্বাভাবিক নয়। ক্ষুর, ছুরি বা ওরকম কিছু পেলে ও যা-খুশি করতে পারে। নিজের গলাতেও বসিয়ে দেওয়া অসম্ভব নয়। এটা তোমার না জানার কথা নয়। নিজেও দেখছ।

শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে, আমি জানব কী করে? আমাকে কেউ এ রকম কিছু বলেনি তো!

নিজের ছেলে সম্পর্কে আর-একটু খোঁজ-খবর রাখাটা বোধ হয় ছেলের ভালর জন্যই দরকার।

বলে তৃষা সজলের দিকে তাকাল। খুবই শান্ত গলায় বলল, ক্ষুরটা তোমার বাবাকে ফেরত দাও।

সজল টেবিলের ওপর ক্ষুবটা রেখে দেয়। আস্তে করে বলে, বাবা বলছিল আমি যেন বড় হয়ে ওটা দিয়ে দাড়ি কামাই।

তৃ তেমনি শান্ত স্বরে বলে, দাড়ি যখন হবে তখন ক্ষুরেরও অভাব হবে না!

এর মধ্যে শ্রীনাথের কিছু বলা সাজে না। সে তাই অপমানিত বোধ করেও চুপ করে থাকে।

তৃষা চৌকাঠ ডিঙোল না। দরজার কোণে বাঁকা হয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, কিছু বলতে আসিনি। সজলকে বিকেলে আসতে বলেছিলে, ও অনেকবার তোমার খোঁজ করে ফিরে গেছে। রাতে আবার এল। অন্ধকার উঠোন পেরোতে ভয় পায় বলে সঙ্গে এসেছি। দেরি দেখে সজল ভাবছিল।

শ্রীনাথ বলল, অফিসে কাজ ছিল। বিকেলে ফিরতে পারিনি।

সে তো থাকতেই পারে।–তৃষা স্টোভে বসানো জলটার দিকে চেয়ে বলল, তোমার জল ফুটে গেছে।

ডেকচির ঢাকনা ঠেলে ফুটন্ত জল পড়ে স্টোভের আগুন লাফাচ্ছে। শ্রীনাথ উঠবার আগেই অবশ্য তৃষা গিয়ে আঁচল দিয়ে ডেকচিটা নামিয়ে স্টোভটা এক ফুয়ে নিভিয়ে দিয়ে বলল, আজকাল বোজ রাতে স্নান করছ! কী ব্যাপার?

শ্রীনাথ বাধোবাধো গলায় বলে, কলকাতায় যা ধুলো ময়লা… তার ওপর প্রেসের কালিঝুলি… শরীরটা কেমন খিত খিত করে।

আগে তো এই অভ্যাস ছিল না!

এখন হচ্ছে।

তৃষা আর এ নিয়ে ঘাঁটাল না। বলল, প্রীতমবাবুর অসুখের খবর পেয়েছিলাম। তাকে একবার দেখতে গিয়েছিলে?

শ্রীনাথ একটু লজ্জা পায়। বলে, না। সময় হয়নি।

কী হয়েছে তাও তো জানা দরকার ছিল। তুমি যাবে বলে আমি বিলুর চিঠির জবাব পর্যন্ত দিইনি। এটা ভীষণ অভদ্রতা হল। ওরা কী মনে করছে!

শ্রীনাথ শ্বাস ফেলে বলল, জেনে আর হবেটা কী? ওসব না জানাই ভাল।

তৃষার গলা একটু তীক্ষ্ণ হল, কেন?

আমরা ওদের জন্য আর কী করতে পারি?

করতে না পারলেই বা, বিপদের দিনে গিয়ে একটু সামনে দাঁড়ালেও মানুষ জোর পায়। তোমারই বোন-ভগ্নিপতি, তাই বলেছিলাম।

শ্রীনাথ উদাস গলায় বলল, কেউ কারও না। আমার আর ওসব সেন্টিমেন্ট নেই।

না থাকলে তো মুক্ত পুরুষ। তবে তুমি যাবে না জানলে আমি বিলুর চিঠির জবাব দিতাম। চাই কি একবার নিজেই যাওয়ার চেষ্টা করতাম।

শ্রীনাথ আজকাল সংসারের কোনও দায়দায়িত্বের কথা শুনলেই রেগে যায়। যখন চাকরির টাকায় সংসার টানত তখন অভ্যাস ছিল। এখন দায়দায়িত্ব না নিয়ে নিয়ে তার ভেতরটা অলস হয়ে গেছে। কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। কারও সঙ্গে দেখা করার কথা ভাবতে তার গায়ে জ্বর আসে।

শ্রীনাথ বলল, তুমি গেলেই তো ভাল হয়।

তাই যেতে হবে দেখছি।

সজল মা-বাবার কথা শুনছিল না। খুব সাবধানে হাত বাড়িয়ে ক্ষুরটা ছুঁয়ে দেখছিল। কী দারুণ ধার!

শ্রীনাথ কথাটা কী ভাবে তুলবে বুঝতে পারছিল না। একটু দোনোমোনো করে বলল, আজ বুলু অফিসে এসেছিল।

তৃষা অবাক হল না। শান্ত স্বরে বলল, তাই নাকি?

শমিতার বুঝি বাচ্চা হবে।

ও। ছোটবাবু কি সেই খবর দিতেই এসেছিল? না কি অন্য মতলব আছে?

মতলবের কথা বলতে পারব না। তবে বলছিল সামনের রবিবার বাবাকে এখানে দিয়ে যাবে। বাবার ওখানে খুব অসুবিধে হচ্ছে।

তৃষা মৃদু একটু হেসে বলে, তা তুমিও কী বললে?

আমি মতামত দিইনি।

ওমা! কেন?

আমি তো মতামত দেওয়ার মালিক নই। তোমার সঙ্গে কথা বলে জানাব বলেছি।

এতে আমার সঙ্গে পরামর্শ করার কী আছে? ছোটবাবু যদি শ্বশুরমশাইকে না রাখতে চায় রাখবে। আমাদের এখানে অনেক ঘর আছে। উনি স্বচ্ছন্দে এসে থাকতে পারেন। এর আগেও তো আমি বলেছি, শ্বশুরমশাইকে দিয়ে যেতে। ছোটবাবু রাজি হয়নি।

শ্রীনাথ এ কথা শুনে খুশি হল না, অখুশিও হল না। তবে একটু অবাক হল। তৃষা এখনও সম্পর্ক অস্বীকার করছে না, এখনও উদারভাবে দায়দায়িত্ব নিতে চাইছে। অথচ এক সময়ে শ্বশুর-শাশুড়ির দায়দায়িত্ব নিয়ে গরিব অবস্থায় অনেক মন কষাকষি হয়েছে তাদের। তৃষা কেন এত উদার হয়ে যাচ্ছে সেটা বোঝা মুশকিল।

শ্রীনাথ বলল, ঠিক আছে। বুলুকে তাই বলে দেব।

বোলো। না বললেও ছোটবাবু দিয়ে যাবে ঠিকই। বাবা এখানে থাকলে ওরও যাতায়াতের একটু উপলক্ষ হয়।

তৃষার বুদ্ধি দেখে একটু তাক লাগে শ্রীনাথের। তৃষার বুদ্ধি বরাবরই প্রখর ছিল৷ এখন মানুষ চরিয়ে সেটা আরও সাংঘাতিক ধারালো হয়েছে।

শ্রীনাথ মাথা নিচু করে বসে নিজের হাতের দিকে চেয়ে রইল। কিছু বলার নেই।

তৃষা বলে, তোমার জল ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। স্নান করলে করে নাও।

হুঁ।–বলে শ্রীনাথ ওঠে।

সজলকে আর কিছু বলবে?

না। ক্ষুরটা দেওয়ার জন্যই ডেকেছিলাম।

ক্ষুরটা ও নেবে না। ওটা সাবধানে রেখে দাও যাতে কেউ নাগাল না পায়। আর কখনও আমাকে জিজ্ঞেস না করে ওকে কিছু দিয়ো না।

শ্রীনাথ একটু বিষ-হাসি হেসে বলেই ফেলল, ক্ষুরের চেয়ে বন্দুক অনেক বিপজ্জনক। তুমি বন্দুকটাও সাবধানে রেখো।

বন্দুকের কথা যে তৃষা শ্রীনাথকে বলেনি সেইটে মনে করেই শ্রীনাথ চিমটিটুকু কাটল।

তৃষা অবশ্য চোখের পাতাও ফেলল না। মুখের ভাবেরও কোনও বদল হল না তার।

শান্ত স্বরে তৃষা বলল, তুমি কোনও ব্যাপারেই মাথা ঘামাও না বলে বন্দুকের কথাটা তোমাকে বলিনি। আজকাল অনেক সময়ে নগদ টাকা বা সোনাদানা ঘরেই রাখতে হয়। চারদিকে যে ভীষণ ডাকাতি হচ্ছে সেই কথাটা ভেবেই বন্দুকটা ফেরত চেয়েছি। বন্দুক থাকবে আমার স্টিলের আলমারিতে। কোনও ভয় নেই।

আমাকে বলোনি বলে কিছু মনে করিনি। তবে কথাটা বুলুর মুখ থেকে শুনে জানতে হল বলে খারাপ লাগে। বাইরের লোকেও যা জানে তা ঘরের নোক হয়েও আমি জানি না।

তৃষা সজলের দিকে চেয়ে বলল, তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো। রাত হয়েছে।

মা-বাবার কথা চালাচালি হাঁ করে শুনছিল সজল। তৃষা বলার পর বাধ্য ছেলের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বারান্দায় মেঝের ওপর তৃষা তার মস্ত ফ্লাশলাইট উপুড় করে রেখে এসেছিল। বাতি জ্বালিয়ে সজলকে পথটা দেখিয়ে দিয়ে আবার ফিরে আসে তৃষা। আগের ভঙ্গিমাতেই দরজায় ঠেস দিয়ে একটু বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ছেলের সামনে ওসব কথা না তুললেই ভাল।

আমি তুলতে চাই না। কথা আপনি ওঠে।

বন্দুকের কথা তোমাকে হোটবাবু বলেছে?

হ্যাঁ।

অনেক খবর রাখে তা হলে?

নিজের স্বার্থেই রাখে। বোধ হয় এখানকার লোকজনকে নিয়ে একটা ঘোঁটও পাকাচ্ছে।

সেটা জানি। এখানকার অনেক লোকও মুখিয়ে আছে আমাকে জব্দ করার জন্য।

শ্রীনাথ অধৈর্যের গলায় বলে, সেটা নতুন কথা নয়। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে কবে এখনও লোকে আমাদের শত্রু ভাববে কেন?

সবাই ভাবে না।

কিছু লোকেই বা ভাববে কেন?

শ্রীনাথ সামান্য উঁচুতে তোলে গলা। বরাবর সে অসম্ভব শান্তিপ্রিয় ফুর্তিবাজ মানুষ। কোনও ঝুট ঝামেলা পছন্দ করে না। কোনও বিরুদ্ধতা দেখলেই সে গুটিয়ে যায়।

তৃষা বলল, তাতে তোমার দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তারা আমাকেই শত্রু ভাবে। তোমাকে নয়।

শ্রীনাথ শ্লেষের হাসি হেসে বলল, যাক এতদিনে তবু স্বীকার করলে যে তুমি আর আমি দুটো সম্পর্কহীন আলাদা লোক।

তৃষা ভ্রু কুঁচকে বলে, কথাটার মানে কি তাই দাঁড়াল?

তাই দাঁড়ায়।

আমি তো ওরকম ভেবে বলিনি।

শ্রীনাথ ইজিচেয়ারে বসে পড়ে আবার। মাথার পাতলা চুলে উত্তেজিত আঙুল চালাতে চালাতে বলে, কী ভেবে বলেছ তা তুমি জানো আমিও জানি।

তৃষা শান্ত গলায় এতটুকুও উত্তেজিত না হয়ে বলে, তুমি বিষয়-সম্পত্তির মধ্যে থাকে না। সে হয়তো তোমার অভিমান। সম্পত্তি যেহেতু আমার নামে। তুমি দেখো না বলেই আমাকে দেখতে হয়। লোকেও লক্ষ করছে বিষয়-সম্পত্তি আমিই দেখি। আমিই সংসার চালাই। লোকে সেটা সহ্য করতে পাবে না। একজন মেয়েমানুষকে ক্ষমতায় দেখতে পুরুষরা পছন্দ করে না। তার ওপর এখানকার বেশির ভাগ পুরুষই অপদার্থ, কুচুটে, পরশ্রীকাতর। তাদের তেমন কোনও কাজ না থাকায় ওইসব করে বেড়ায়। তবে তোমার সম্পর্কে তাদের কোনও রাগ নেই।

শ্রীনাথ অধৈর্যের গলাতেই বলে, সেটাই বা তুমি কী করে জানলে?

তৃষা একটু ফিচেল হাসি হেসে বলে, লোকে বলে আমি নাকি তোমার মতো ভাল লোককে পায়ের তলায় দাবিয়ে রেখেছি। তুমি নাকি খুবই ন্যায়বান, যুক্তিবাদী, সৎলোক। এমনকী তুমি আমাকে ছেড়ে নাকি অন্য জায়গাতে চলে যাওয়ারও চেষ্টা করছ। এ রকম খারাপ একজন মহিলার সঙ্গে বাস করতে তোমার নাকি ভীষণ ঘেন্না হয়। এ সব শুনেই বুঝি, লোকের রাগ তোমার ওপর নয়।

তৃষা ইদানীং একসঙ্গে এত কথা বলেনি শ্রীনাথের সঙ্গে। তৃষা আজকাল তর্ক করে না, আলোচনা করে না, কথার পিঠে পিঠে খানিকক্ষণ জবাব দিয়ে এক সময়ে চুপ করে যায়। আজ তৃষার এত কথা এবং কথার মধ্যে চাপা একটা হতাশার ভাব লক্ষ করে অবাক মানে শ্রীনাথ।

সে বলল, এখানকার লোক কী বলে তা আমার কানে বেশি আসে না। তবে এটা বুঝি যে, এতদিনেও আমরা এ জায়গার লোক হয়ে উঠতে পারিনি।

তৃষা একটা শ্বাস ফেলে বলে, এক জায়গায় বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে বসলেই সেই জায়গা আপন হয় না। পুরুষানুক্রমে থাকলে আত্মীয়তা জ্ঞাতিগুষ্টি বাড়লে তবে হয়।

তবু চেষ্টা করা উচিত ছিল।

কথাটা কি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছ?

তবে আর কাকে?

আমাকে দায়ী করছ কেন? এ জায়গার আপন হতে তুমিও তো চেষ্টা করছ না। কেবল একটা পালাই-পালাই ভাব।

শ্রীনাথ সাবধান হয়। বদ্রীকে দিয়ে সে যে জমি কেনার চেষ্টা করছে অন্য জায়গায় সেটাও কি তৃষা জানে? জানার কথা নয়। বদ্রীও বেশ কিছুদিন হল আসে না।

একটু চিন্তিত দেখাল শ্রীনাথকে। আস্তে করে বলল, এ জায়গাকে আমার আপন করে কী লাভ? তুমি থাকবে, সুতরাং দায়িত্ব তোমারই।

কেন? তুমি থাকবে না?

আছিই তো। যতদিন থাকা যায় থাকবও।

তৃষা বড় বড় চোখে তার দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, বিষয়-সম্পত্তি আমার হলেও সংসারটা কিন্তু আমার নয়। ছেলেমেয়েও আমি বাপের বাড়ি থেকে আনিনি। সুতরাং এখন থাকা না থাকার কথা তোলা খুব বীরপুরুষের কাজ হবে না।

আমি বীরপুরুষ নই বলেই কথাটা উঠল।

তুমি স্নান করে এসো। আমি যাই।— বলে তৃষা নিচু হয়ে বারান্দা থেকে তার ফ্ল্যাশ লাইট কুড়িয়ে নিল। তারপর অন্ধকারে তাকে আর দেখা গেল না।

শ্রীনাথ ডেকচির জল নিয়ে কলপাড়ে গিয়ে খুব ঘষে ঘষে স্নান করল আজ।

কলপাড় থেকেই দেখা যাচ্ছিল, পুকুরের ধারে আজও শুকনো কাঠকুটো দিয়ে মস্ত আগুন জ্বেলেছে নিতাই।

স্নান করে ফিরে এসে বারান্দায় উঠে শ্রীনাথ হাঁক পাড়ল, নিতাই নাকি রে?

হ্যাঁ।

শুনে যা।

ভেজা গায়ে উত্তুরে হাওয়ায় ভোলা বারান্দায় শীতে কাঁপছিল শ্রীনাথ। নিতাই কাছে আসতেই বলল, শুনলাম এর মধ্যে কবে যেন সরিৎবাবু তোকে মেরেছে।

নিতাই হাসে, দুর। দূর। মারবে কী? গাঁজার নেশায় তখন বাবুর গায়ে জোর ছিল নাকি?

শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে, সরিৎ গাঁজা খেয়েছিল?

বোজ নয়। সেদিন খেয়েছিল।

মারল কেন?

আজ্ঞে নেশা-ভাঙের মুখে কোন কথা থেকে কোন কথা বেরিয়ে যায়। তার কোনটা শুনে বাবুর রাগ হল কে বলবে?

মেরেছিল যে, সেটা আমাকে বলিসনি কেন?

নিতাই খুব হেসে-টেসে বলল, পরদিনই আবার খাতির হয়ে গিয়েছিল কিনা।

সরিৎ ছেলেটা কেমন? গুন্ডামি-টুন্ডামি করে না তো!

আজ্ঞে না। লোক খুব ভাল।

বদ্রী তপাদারের বাড়িটা চিনিস?

খুব চিনি। লাইনের ওধারে উত্তরদিকে আমরাগান পেরিয়ে মাইলটাক।

কাল ওকে গিয়ে খবর দিবি তো। বলবি জরুরি দরকার। আসে যেন একবার কাল পরশু।

দেবোখন। এই সেদিনও মা ঠাকরোন ডাকিয়ে এনেছিলেন। আমিই গিয়ে খবর দিয়েছিলাম কিনা।

শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে, সজলের মা বদ্রীকে ডাকিয়েছিল?

আজ্ঞে।

কেন?

তা জানি না। আশ্চর্য তো!

আচ্ছা, তুই যা।

খুবই অন্যমনস্ক হয়ে গেল শ্রীনাথ। এত অন্যমনস্ক যে ঘরে ঢুকেও সে ঘরটাকে লক্ষই করল না। ডেকচি, বালতি, মগ, গামছা সব যন্ত্রের মতো যেখানকার জিনিস সেখানে রাখল। ধোয়া লুঙ্গি পরল, উলিকটের গেঞ্জি গায়ে দিয়ে চাদর জড়াল। চুল আঁচড়াল।

তারপর ইজিচেয়ারে বসতে গিয়েই সাপ দেখার মতো চমকে উঠল ভীষণ। বুকের ভিতর ধড়াস ধড়াস করে হৃৎপিণ্ড আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছে।

তার বিছানায় খুব অলস ভঙ্গিতে টর্চ হাতে তৃষা বসে আছে।

বোধ হয় চমকানোতে মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল শ্রীনাথের। বোধ হয় চমকটা বাইরে থেকেও বুঝতে পেরেছিল তৃষা। উঠে এসে বুকে হাত রেখে বলল, আমারই অন্যায়। একটা জানান দেওয়া উচিত ছিল। ভয় পেয়েছ?

শ্রীনাথ কথা বলতে পারল না বুকের অসহ্য ধড়ধড়ানিতে। শুধু মাথা নেড়ে জানাল, না।

আমাকে তোমার ভয় কিসের?

অনেকক্ষণ দম নিয়ে স্বাভাবিক হল শ্রীনাথ। বুকটা তার বোধ হয় ভাল নয়। ক্ষীণ একটু যন্ত্রণা হচ্ছে যেন। এক মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটিটিভ বন্ধু কে সাবধান করে দিয়েছিল, দেখো ভায়া, যদি বাঁ দিকের বুকের নিপলের দুইঞ্চি নীচে কখনও ব্যথা-ট্যথা হয় তবে ঠিক হার্ট ট্রাবলের লক্ষণ বলে জেনো।

ব্যথাটা হচ্ছে। শ্রীনাথ চোখ বুজে অনুভব করে।

তৃষা ইজিচেয়ারের ধারে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। বলল, তোমার তো কখনও এমন শরীর খারাপ হয় না।

শ্রীনাথ চোখ মেলে বলল, ওটা কিছু নয়। বলল, কী বলবে?

এখন তোমার ভাল লাগছে তো!

হ্যাঁ। ভাল।

তৃষা আবার বিছানায় গিয়ে বসল। তোমার খাবারটা আমি এ ঘরেই পাঠিয়ে দিতে বলেছি। এই শীতে আবার অত দূরে যাবে?

শ্রীনাথ মৃদু স্বরে বলে, ভালই করেছ।

আবার ভেবে বসবে না তো যে, তোমাকে এইভাবে আলাদা আর পর করে দিচ্ছি! লোকে কত ভুল ভাবতে ভালবাসে।

আজ এত আদুরেপনা কেন তা বুঝল না শ্রীনাথ। কিন্তু একটু হাসল। বলল, না, তা কেন?

তৃষা বসে রইল। গেল না। ভারী অস্বস্তি হতে লাগল শ্রীনাথের। আজ কেন সব অন্য রকম হচ্ছে?

একটু বাদেই খাবার নিয়ে এল বৃন্দা। সামান্য খেল শ্রীনাথ। বৃন্দা দাঁড়িয়ে থেকে এঁটো পরিষ্কার করে নিয়ে গেল। তবু তৃষা বসে আছে।

শ্রীনাথ ইজিচেয়ারে বসে বলল, কিছু বলবে?

তৃষা মৃদু হেসে বলে, বলার জন্যই বসে আছি।

বলো।

তোমার শরীর এখন কেমন লাগছে?

খুব ভাল। কিছু হয়নি।

তৃষা উঠে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এল। আবার বিছানায় বসে অদ্ভুত এক হাসি হেসে বলল, আমি তোমার বউ না?

তাই তো জানি!–অবাক, ভীষণ অবাক হয়ে বলে শ্রীনাথ।

তৃষা বলে, বউ হলেও আমি ভাল বউ নই। তোমাকে একটা জিনিস থেকে বহুকাল বঞ্চিত করে রেখেছি। তাই না?

শ্রীনাথ খুব গম্ভীর হয়ে গেল। বুকের মধ্যে আবার সেই ধড়াস ধড়াস। সারা গায়ে শীতকাঁটা।

বলল, ঠিক নয়?–তৃষা আদুরে গলায় বলে।

শ্রীনাথ তৃষার মুখের দিকে তাকায়। না, তৃষার কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। যেমন দৈনন্দিন মানুষটি ছিল, তেমনি আছে। শুধু চোখ-দুটো একটু দিপ-দিপ করে জ্বলছে। মুখে অদ্ভুত এক মোহিনী হাসি।

তৃষা বসা স্বরে ফিস ফিস করে বলল, আজ নাও। দিতে এসেছি। অভিমান কোরো না, মুখ ফিরিয়ে থেকো না। লক্ষ্মীটি!

শ্রীনাথের গলা শুকিয়ে আসছিল। তার শরীরের কামনা মরে যায়নি বটে, বরং সে রোজই তীব্র কাম বোধ করে। তবু এখনও এক রাত্রে দু’জন মেয়েমানুষের পাল্লা টানবার ক্ষমতা তার নেই। হাওড়া ময়দানের নমিতা তাকে আজ নিঃশেষ করেছে।

মৃদু স্বরে শ্রীনাথ বলে, আজ নয়।

আজই!–বলে উঠে আসে তৃষা। পাশে দাঁড়ায়। কানের কাছে মুখ এনে বলে। আজই। আজ আমি ভীষণ পাগল হয়েছি।

শ্রীনাথ সিঁটিয়ে যায়। কাঠ হয়ে বসে থাকে। তারপর বলে, তোমার এত ইচ্ছে ছিল না তো কখনও!

তুমি তার কী জানবে!

আমি জানব না তো জানবেটা কে?

আজ জেনে দেখো।

আজ নয়, তৃষা।

আজই। আজই চাই। এসো।

তৃষা শ্রীনাথের কোমর ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়। তৃষার গায়ে অনেক জোর। এত জোর যে শ্রীনাথ ওকে ঠেকাতে পারল না।

বুকের বাঁ দিকে নিপলের ঠিক দু ইঞ্চি নীচে ক্ষীণ ব্যথাটা আবার টের পেল শ্রীনাথ।

তৃষা কানে কানে বলে, আমার যদি ইচ্ছেই না থাকবে তাহলে তোমার এতগুলো ছেলেপুলে হল কী করে?

শ্রীনাথ হঠাৎ বলে ফেলল, ইচ্ছে হয়তো আছে, তবে তা আমাকে নিয়ে নয়। আমার প্রতি তুমি বরাবর ক্যালাস ছিলে।

অবাক গলায় তৃষা বলে, তোমাকে নিয়ে নয়? তবে কাকে নিয়ে?

অনেক কথাই বলতে পারত শ্রীনাথ। কিন্তু ভদ্রতাবোধ এসে গলা টিপে ধরল। বাধা হয়ে দাঁড়াল লজ্জা। মৃত দাদা মল্লিনাথের প্রতি একরকম মায়া হল এ সময়ে। এত অকপটে তৃষার সঙ্গে সম্পূর্ণ ভাঙচুর করতে বুঝি-বা হল ভয়। তাই বলতে পারল না।

তৃষা বাতি নিভিয়ে দিয়ে চলে এল বিছানায়। এক ঝটকায় নিজেকে খুলে ফেলল। শ্রীনাথকেও শরীরে কোনও আবরণ রাখতে দিল না। নগ্ন শরীরে লেপটা টেনে নিল। বলল, লেপটা ভীষণ গণ্ডা কাল বের করে রেখে যেয়ো, রোদে দেব। চাবিটা রেখে যেয়ো, তাহলেই হবে।

শ্রীনাথ জবাব দেওয়ার আগেই তৃষা তার মুখ বন্ধ করে দিল জোরালো এক চুমুতে। বড় ঘিনঘিন করছিল শ্রীনাথের। মুখে লালা, ঠোঁট, শ্বাস কিছুই তার শরীরে সাড়া তুলছে না। নেতিয়ে অবশ হয়ে আছে শরীর।

এসো।–বলে হাত বাড়ায় তৃষা।

না তৃষা, আজ আমার ইচ্ছে নেই।

কানের কাছে হঠাৎ তীক্ষ্ণ শোনায় তৃষার গলা, ইচ্ছে নেই কেন? বহুদিন তো এসব হয়নি। ইচ্ছে না হওয়ার কথা নয়।

তৃষার হাত দারোগার মতো খানাতল্লাস করতে থাকে তার শরীরে।

শ্রীনাথ লড়াই করে, না তুষা, আজ আমার মন ভাল নেই।

তবু তৃষার সমস্ত শরীর হামলে পড়ে তার ওপরে। তার হাত তৎপর হয়। এমনকী টর্চ জ্বেলেও কী যেন দেখার চেষ্টা করে সে।

হঠাৎ শ্রীনাথ বুঝতে পারে, তৃষার এক ফোটাও কাম নেই। এতটুকুও ভালবাসা জাগেনি আজ ওর এই রাতে। তৃষার চোখ আর হাত একটা কিছু বুঝতে চাইছে। দেখতে চাইছে।

শ্রীনাথ ভয়ে প্রাণপণ প্রতিরোধের চেষ্টা করে। নিজেকে ঢাকতে চায়। তৃষাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করে সে।

কিন্তু জোরালো হাতে পায়ে বিছানার সঙ্গে তৃষা তাকে বেঁধে রাখে। পুরুষকে জাগিয়ে তোলার যতরকম মুদ্রা আছে তা প্রয়োগ করে যায় সে। টর্চ জ্বেলে পরীক্ষা করে তাকে।

তারপর গভীর এক খাস ফেলে তাকে ছেড়ে দেয়।

শ্রীনাথ উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে থাকে ঘেন্নায়। তৃষা জানল, সে আজ অন্য মেয়েমানুষের কাছে গিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *