১৫. শেষ কথা
অনেক দিন পরের কথা।
শীতের রাতে আকাশে একটা চাঁদ উঠেছে, কুয়াশায় সেই চাঁদকে কেমন যেন অস্পষ্ট দেখায়। চারিদিকে জোছনার ঘোলাটে আলো। কান পেতে থাকলে শোনা যায় গাছের পাতা থেকে টুপটুপ শব্দ করে শিশির পড়ছে মাটিতে।
এর মাঝে নানি একটা হ্যারিকেন নিয়ে বের হচ্ছেন, রাশা জিজ্ঞেস করল, “নানি, তুমি কই যাও?”
নানি লাজুক মুখে একটু হাসলেন, বললেন, “আমি আর কোথায় যাব? তোর নানার সাথে একটু কথা বলে আসি!”
রাশা বলল, “আমি আসি তোমার সাথে?”
“আসবি? আয় তাহলে! কবরস্থানে রাতবিরেতে ভয় পাবি না তো?”
“না, নানি। তুমি ভয় না পেলে আমিও ভয় পাই না।”
“হ্যাঁ, ভয় কিসের? তোর নানা আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে না?”
রাশা চোখের কোনা দিয়ে নানির মুখের দিকে তাকাল। নানি এমনভাবে কথা বলেন যে শুনে মনে হয় সত্যিই বুঝি নানা কবরের মাঝে শুয়ে নানির জন্যে অপেক্ষা করে থাকেন।
আহাদ আলীর বাড়ির পিছনে একটা বড় মাদার গাছের নিচে খুঁড়ে সত্যিই নানার দেহাবশেষটা পাওয়া গিয়েছিল। জায়গাটা আহাদ আলীই দেখিয়ে দিয়েছিল, তার হাতে হাতকড়া লাগিয়ে সেখানে রাখা হয়েছিল। যেদিন খুঁড়ে বের করা হয় সেদিন রাশাও ছিল সেখানে, সালাম নানা কিন্তু তাকে যেতে দেননি। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, “তুমি কাছে এসো না সোনা?”
“কেন নানা?”
তোমার নানা ছিলেন অসম্ভব দুদর্শন একজন মানুষ। সেটাই তোমার কল্পনাতে থাকুক? কেন তুমি তার হাড়গোড়কে দেখে মন খারাপ করবে?
রাশা তাই তার নানার দেহাবশেষটুকু দেখেনি। মাটি খুঁড়ে সবাই মিলে সেটা বের করে একটা কফিনে করে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা দিয়ে সালাম নানা কফিনটাকে ঢেকে দিয়েছিলেন। দশ গ্রামের হাজার হাজার মানুষ মিছিল করে কফিনটাকে তাদের গ্রামে নিয়ে এলো। সেখানে তার জানাজা পড়ানো হলে তারপর সাদা কাফনের কাপড়ে ঢেকে নানাকে কবরস্থানে করব দেয়া হলো।
সেই থেকে নানি সময় পেলেই কবরস্থানে এসে নানার কবরের পাশে বসে থাকেন। রাশার মনে হয় নানির ভেতরে সেই অস্থিরতাটুকু আর নেই, তার ভেতরে কেমন যেন একটা শান্তি এসেছে। রাশা টের পায় নানি অপেক্ষা করছেন করে নানার কাছে ফিরে যাবেন।
রাশা আর তার নানি হ্যারিকেন দুলিয়ে দুলিয়ে গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাছে, ঠিক তখন মাথার উপর দিয়ে একটা রাতজাগা পাণি করুণ স্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। পাখির ডাকটা শুনলেই বুকের ভেতর কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। নাকি একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “রাশা।“
“জি নানি।“
“তোর মায়ে কোনো চিঠি পেয়েছিস?”
উঁহু রাশা হাসার চেষ্টা করে বলল, “মাহতাব পিয়ন খুব ফাঁকিবাজ নানি। বেশি চিঠি জমা না হলে আসতেই চায় না।”
“তোর মাও মনে হয় চিঠি লেখার সময় পায় না!”
“সেটাও ঠিক।” রাশা একটু থেমে বলল, “আম্মু মনে হয় আমার ওপরে একটু রাগ করেছে, তাই না নানি? কিন্তু কী করা বলো, এখন তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না!”
নানি কিছু বললেন না, রাশা বলল, “আম্মু যদি একা থাকতেন আমি চলে যেতাম। কিন্তু আম্মুর সাথে থাকবে একটা মানুষ তাকে আমি চিনি না জানি না। আম্মু নাকি অনেক চেষ্টা করে সেই মানুষটাকে রাজি করিয়েছেন যেন আমি যেতে পারি। আমাকে নাকি অন্য টিনএজারদের মতো হলে হবে না, আদব-লেহাজ থাকতে হবে।”
নানি বললেন, “ভালোই হয়েছে তুই যাসনি! তুই চলে গেলে মনে হয় এক সপ্তাহের মধ্যে আমি মরে যাব।”
রাশা নানির হাত ধরে বলল, “না, নানি! তুমি মারা যাবে কেন? এখন তুমি মারা যেতে পারবে না। তুমি মারা গেলে আমার কী অবস্থা হবে চিন্তা করেছ?”।
নানি একটা ছোট নিশ্বাস ফেললেন, বললেন, “এই দুনিয়ায় কারো জন্যে কিছু আটকে থাকে না রে সোনা! পৃথিবী চলতে থাকে। আমি মারা গেলেও তোর পৃথিবী চলবে!”
.
গ্রামের পথে হেঁটে হেঁটে দুজনে কবরস্থানে পৌঁছায়। লোহার গেটটা খুলে নানির হাত ধরে রাখা কবরস্থানে এসে ঢুকল। ভেতরে ফুলের তীব্র একটা গন্ধ। কোথায় যেন একটা বুনো ফুল ফুটেছে। নানি হ্যারিকেনটা কবরের মাথায় রেখে কবরের পাশে পা ছড়িয়ে বসলেন। কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে তাকিয়ে রইলেন, তারপর গভীর মমতায় কবরের মাটির উপর হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। রাশা হারিকেনের স্লান আলোতে দেখতে পেল নানির চোখ থেকে সরু দুটো পানির ধারা নিচে নেমে আসছে। কত যুগ আগে এই মানুষটি তার একজন আপনজনকে হারিয়েছে, এত দিন পরেও মনে হয় দুঃখ এতটুকু কমেনি।
রাশা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার সামনে একজন মানুষ। একজন মানুষের দুঃখ।
এই দেশে এরকম তিরিশ লক্ষ মানুষ আছে। তাদের তিরিশ লক্ষ দুঃখ। এত দুঃখ এই দেশের মাটি কেমন করে সইতে পারল?