পঞ্চদশ অধ্যায় – শিব–দুর্গার হিমালয় পর্বতে বাস করিবার প্রস্তাব
মার্কণ্ডেয় বলিলেন; অনন্তর, দক্ষতনয়া কোন সময়ে বর্ষাকালে, পৰ্বতপ্রস্থে অবস্থিত বৃষধ্বজকে বলিলেন,–এই পরম দুঃসহ বর্ষাকাল উপস্থিত, এখন নানাবর্ণের জলদজাল দিত্মণ্ডল ও গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন করিয়া রহিয়াছে। ১-২
কদম্ব-কুসুম-পরাগমিশ্রিত-জলকণাবাহী বেগবান্ প্রভঞ্জন হৃদয় কম্পিত করত বহিতেছে। ৩
বিদ্যুৎ-পতাকাভূষিত আসারবর্ষী জলদাবলীর তীব্রতর ঘোর গর্জনে কাহার চিত্ত বিক্ষুদ্ধ না হয়? ৪
সূর্যের প্রকাশ নাই; নিশাকর মেঘগর্ভে লুকায়িত; এখন দিবা-রাত্রি সমান; এ কালের দিনও বিরহীদিগের প্রাণান্তকর। ৫
হে শঙ্কর। মেঘজাল, গর্জন করিতেছে, পবন চালিত হওয়াতে একস্থানে থাকিতে পারিতেছে না, তাহাতে বোধ হইতেছে ইহারা যেন লোকের মস্তকে পড়িল। ৬
ভীরু-ভয়াবহ ও কামুকজনের অভিলষিত মহাবৃক্ষসকল পবনচালিত হওয়াতে দেখাইতেছে, যেন উহারা গগনমণ্ডলে নাচিতেছে। ৭
স্নিগ্ধ-নীলাঞ্জনামল জলদ-জালের নিম্নে বলাকাবলী যমুনাজলস্থিত ফেনরাশির ন্যায় সাতিশয় দীপ্তি পাইতে লাগিল। ৮
সুনীল-সমুদ্র-সলিলে প্রদীপ্ত বাড়বানলের ন্যায় এই সৌদামিনী মেঘজালো পরি ক্ষণে ক্ষণে দেখা যাইতেছে। ৯
এখন গৃহ-প্রাঙ্গণেও শম্প-অঙ্কুর দেখা যাইতেছে;–হে বিরূপাক্ষ! অন্য স্থলে অর্থাৎ যেখানে সচরাচর শস্প উৎপন্ন হয়, তথায় সে শস্প উৎপন্ন হইতেছে তাহা আর বলিব কি? ১০।
যেমন ক্ষীরসমুদ্র মন্দর পর্বতস্থিত তরুনিকরের শ্যামল পত্রপুঞ্জে শোভিত হইয়াছিল, সেইরূপ এই শুভ্রবর্ণ হিমাচল, মেঘ-শ্যামল কক্ষভূমি দ্বারা শোভা পাইতেছে। ১১
যেমন লক্ষ্মী কলিকালে সজ্জনদিগকে পরিত্যাগ করিয়া যে সে লোকের আশ্রয় গ্রহণ করেন, সেইরূপ, পুষ্পশোভা পলাশ কুসুম ত্যাগ করিয়া কূটজ পুষ্প ভজনা করিল। ১২
ময়ূরগণ, নিরন্তর মেঘশব্দে আনন্দিত হইয়া বৃষ্টি সূচনা করত বনে বনে সতত কেকারব করিতেছে। ১৩
মেঘ দর্শনে উৎসুক অতিমত্ত চাতকগণের আসন্নবৃষ্টিসূচক মধুর ধ্বনি শ্রবণ কর। ১৪
এখন ইন্দ্রধনু, গগনমণ্ডলে দেখা দিয়াছে। বুঝি আসাররূপ শর-নিকর দ্বারা তাপ-শত্রুকে বিনাশ করিবার জন্যই তাহার আবির্ভাব। ১৫
দেবাদিদেব! মেঘগুলির একবার অত্যাচার দেখ;-বেটারা কিনা আপনাদিগের অনুগত ময়ূর ও চাতককে উৎকট করকাঘাতে পীড়া দিতেছে। ১৬
হে গিরিশ! ময়ূর ও চাতককুলের মিত্রের নিকটেও নিগ্রহ দেখিয়া হংসগণ দূরবর্তী হইলেও সেই মানসসরোবরে চলিয়াছে। ১৭
এই বিষম সময়ে কাক ও চকোরেরাও নীড় নির্মাণ করিতেছে, তুমি গৃহবিনা সুখে থাকিবে কিরূপে? ১৮
হে পিনাকপাণি! আমি মেঘ ভয়ে বড় কাতর হইয়াছি; অতএব আমার কথানুসারে অবিলম্বে বাসস্থান করিতে যত্নশীল হও। ১৯
হে বৃষধ্বজ! তুমি কৈলাসে হিমালয়ে মহাকৌষী-নদীতীরে অথবা পৃথিবীতে যেখানে হয় তোমার উপযুক্ত বাসস্থান কর। ২০
দাঙ্গায়ণী শম্ভুকে বারংবার এই কথা বলিলে, তিনি মৌলিভূষণ-শশধরের বিশদ-কিরণচ্ছুরিত বদনে ঈষৎ হাস্য করিলেন। ২১
অনন্তর, সৰ্ব্বতত্ত্বজ্ঞ মহাত্মা ঈশ্বর, ঈষৎ-হাশ্যে উদ্ভিন্ন-ওষ্ঠাধর হইয়া পরমেশ্বরী সতীদেবীর সন্তোষ-বিধান করিলেন। ২২
ঈশ্বর বলিলেন, হে মনোহরে! আমি তোমার প্রীতির জন্য যে স্থানে বাস করিব, তথায় আমার পুরীতে কদাচ মেঘ যাইতে পারিবে না। ২৩
হে মনোহারিণি! মেঘগণ বর্ষাকালেও হিমালয় পর্বতের নিতম্বদেশ পৰ্যন্ত সতত বিচরণ করে। ২৪
মহাদেবি! জলদজাল, কৈলাস পর্বতের মেখলা পৰ্যত সঞ্চরণ করে, তাহার ঊর্ধ্বে কদাচ যাইতে পারে না। ২৫
পুষ্করাবর্তকাদি মেঘগণও সুমেরুপৰ্বতের জানুমূল পর্যন্ত যাইতে পারে, তাহার ঊর্ধ্বে পারে না *। ২৬ [* “জঘনস্যোর্ধ্বং” ও “জম্বুমূলং সমাসাদ্য” এই পাঠের অনুসৃত অর্থ এই–জঘন ভাগস্থিত জম্বুতরুমূল পর্যন্ত গমন করে, জঘনের ঊর্ধ্বে যাইতে পারে না।”]
প্রিয়ে! এই সকল গিরিবরের মধ্যে যেখানে বাস করিতে তোমার মন চাহে, শীঘ্র আমাকে তাহা বল। ২৭
সুবর্ণময় পক্ষের পবনবেগে বিকম্পিত পল্লব স্বেচ্ছাবিহারী মধুর-কূজন বিহঙ্গ বর্গে তোমার বড় আমোদ; এই হিমালয় পর্বতে তাহা সতত সুলভ। ২৮
সিদ্ধাঙ্গনাগণ, তোমার সহিত চিরসখ্য করিতে ইচ্ছা করেন, অতএব তাহারা ফলাদি দান করত তোমার আনন্দ-উপকার করিতে এই স্বেচ্ছাবিহার ভূমি মণিকুট্টিমশোভিত গিরিবরে আসিবে। ২৯
দেবকন্যা, নাগকন্যা, গিরিকন্যা ও কিন্নর-কন্যাগণ, সকলেই আমোদ-প্রমোণ বিলাস-বিত্ৰমে সতত তোমার সহায়তা করিবে। ৩০
সুরসুন্দরীগণ, তোমার এই নিরুপম-রূপরাশি ও বদনমণ্ডল আর তাহা দিগের নিজ নিজ দেহ ও লাবণ্যের দিকে চাহিয়া তাহারা আপন আপন শরীর ও রূপ গুণে নিত্য অবহেলা করিবে। ৩১
রূপে-গুণে ত্রিলোক-বিখ্যাতা গিরিরাজ-মহিষী মেনকাও অভ্যর্থনাদি দ্বারা নিত্য তোমার মানসিক আনন্দবিধান করিবেন। ৩২
গিরিরাজ-বংশীয়া গুণবতী পুরস্ত্রীগণ, তোমার সহিত সারল্য-পূৰ্ণ প্ৰীতি বিস্তার করিবেন, তাহাতে তোমার প্রীতিসহকারে সতত নিজকুলোচিত শিক্ষাও হইবে। ৩৩
গিরিরাজ হিমালয়ে কুঞ্জসকল কোকিলকুলের বিচিত্ৰ-কাকলীরবে আনন্দময়; বসন্ত সতত বিরাজমান; স্বচ্ছ জলপূর্ণ শত শত সরোবর; আর কমলপূর্ণ পুষ্করিণীও শত শত। তাই বলি প্রিয়ে! হিমালয়ে থাকিতে ইচ্ছা হয় কি? ৩৪
সর্বকামপ্রদ কল্পপাদপে আচ্ছন্ন হিমালয়ের হরিত বর্ণ তরুরাজির কুসুমচয় উপভোগ করিতে পারিবে। ৩৫
হে মহাভাগে! দেবগণের লীলাভূমি সেই হিমাচল প্রশান্ত শ্বাপদকুল, বহুতর মুনি, যতি এবং নানাবিধ মৃগগণে পরিবৃত রহিয়াছে। ৩৬
তথায় মানস প্রভৃতি স্ফটিক-সুবর্ণ-প্রবাল-রজতময় বহুতর সরোবর, সেই সকল সরোবর আবার রত্নময় নাল-দণ্ড সুবর্ণময় ফুল্লকমল কমলকুল ও মনোহর নীলোৎপলাদি দ্বারা পরিশোভিত। ৩৭-৩৮
শিশুমার ও শঙ্খ-কচ্ছপ-মকরকুলে আবৃত এবং স্নানকালে শত শত সুর রমণীগণের অঙ্গবিধৌত বিবিধ গন্ধদ্রব্য, কুক্কম ও পরিভ্রষ্ট বিচিত্র সৌরভ-বাসিত স্বচ্ছজলে পরিপূর্ণ। ৩৯-৪০
তাহাদিগের তীরে হরিতবর্ণ উত্তঙ্গ পাদপশ্রেণী; তদীয় শাখাসকল পবন হিল্লোলে নাচিয়া নাচিয়া যেন আপনাদিগের সম্পদের কথা জানাইতেছে। ৪১
ইহাতে সরোবরকুলের বড়ই শোভা। সেই সকল সরোবরে কলহংস, সারস, মদগু, চক্রবাক ও মধুমত্ত ভ্রমরকুল, সতত বিরাজমান। ৪২
অথবা ইন্দ্র, অগ্নি, যম, নৈর্ঋত, বরুণ, বসু, কুবের এবং আমি–আমাদিগের পুরীপরিসরে শোভিত শৃঙ্গ, রম্ভা, শচী, মেনকা প্রভৃতি রম্ভোরুগণ-নিষেবিত, দেবগণের আবাসভূমি সৰ্বশ্রেষ্ঠ মহাগিরি উচ্চচূড় সুমেরুপৰ্বতে বাস করিতে ইচ্ছা কর কি? ৪৩-৪৫
তথায় অপ্সরোগণসেবিতা ইন্দ্রাণী শত শত দেবীগণ পরিবৃত হইয়া সর্বদা তোমার সহায়তা করিবেন। ৪৬
অথবা কুবেরনগর-শোভিত, গঙ্গাজল-প্রবাহ-পূত, পূর্ণচন্দ্ৰসম-শুভ্রবর্ণ আমার চিরবাসস্থান গিরিশ্রেষ্ঠ কৈলাসে থাকিতে ইচ্ছা হয় কি? ৪৭
ঐ পৰ্বতের গুহা ও সানুদেশে ব্ৰহ্মকন্যাগণ সদা বিচরণ করে। ৪৮
বিবিধ মৃগগণ সেবিত শত শত কমলাকর সরোবরে আবৃত কৈলাসপৰ্বত কোন গুণেই সুমেরুর ন্যূন নহে। ৪৯
এই সকল স্থানের মধ্যে যেখানে বাস করিতে তোমার আন্তরিক ইচ্ছা, তাহা শীঘ্র বল, আমি তোমার সহিত সেইখানেই বাস করিব। ৫০
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–শঙ্কর, এই কথা বলিলে, দাক্ষায়ণী, নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করত ধীরে ধীরে মধুরভাষে মহাদেবকে বলিলেন,–আমি তোমার সহিত হিমালয় পর্বতেই বাস করিতে ইচ্ছা করি; অতএব তুমি অবিলম্বেই এই মহাগিরিতে বাস কর। ৫১-৫২।
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–অনন্তর মহাদেব তাহার কথা শুনিয়া পরমানন্দে দাক্ষায়ণী সমভিব্যাহারে সিদ্ধরমণীগণ-সেবিত মেঘ ও বিহঙ্গকুলের অগম্য সরোবর-কানন-শোভিত উত্তুঙ্গ হিমালয়শিখরে গমন করিলেন। ৫৩-৫৪
পঞ্চদশ অধ্যয় সমাপ্ত। ১৫