১৫. রুমু বোগি উঠে বসল

রুমু বোগি উঠে বসল।

বলল, দাদা, তুমি বলো।

ঝগড়ু, ভুলো যেদিন পালিয়ে গিয়ে রাত করে ফিরেছিল, সেদিন ও কোথা থেকে হলদে পাখি খেয়ে এসেছিল, ওর ঠোঁটের কোনায় হলদে পালক গোঁজা ছিল।

সে কী, বোগিদাদা!

হ্যাঁ, ঝগড়ু, হ্যাঁ। পরদিন সকালে দেখি ভুলো নেই, কিন্তু তোমার ঘরে একটা কালো ছেলে। তার চোখ পাটকিলে রঙের আর কানের উপরদিকটা খোঁচামতে। তুমি মুখ ঢাকছ কেন, ঝগড়ু?

বেজায় আশ্চর্য লাগছে কিনা। কিন্তু ও যে আমার শালার ছেলে।

রুমু ব্যস্ত হয়ে উঠল। না, ঝগড়ু, ওই ভুলো। সোনা-রুপোর মাদুলিটা জোগাড় করা, অমনি দেখবে ও ভুলো। আচ্ছা ঝগড়ু, তোমার বউ কিছু বলবে না তো?

আরে বউকে কিছু বলে কাজ নেই। তবে নাথুর সাহায্য দরকার হবে। এক-আধ দিন অপেক্ষা করতে পারবে তোমরা? আমাদের গাঁয়ের লখনিয়া ময়ূর-মেয়ের জন্য চল্লিশ বছর অপেক্ষা করেছিল, আর তোমরা এক-আধ দিন অপেক্ষা করতে পারবে তো?

পারব, ঝগড়ু, পারব! ময়ূর-মেয়ের কথা বলল।

বুঝলে বোগিদাদা, লখনিয়া তোমাদের মতো ছিল, কষ্ট পাবার ভয়ে কাউকে ভালোবাসত না, কোনো মানুষকে না, কোনো জিনিসকে না। মানুষ চলে যায়, ভুলে যায়, মরে যায়, আর জিনিস ভেঙে যায়, চুরি যায়, হারিয়ে যায়, মরচে ধরে, পোকায় খায়। কী হবে ভালোবেসে?

মেলা টাকাপয়সা ছিল লখনিয়ার, দিব্যি খেত-দেত, ফুর্তি করত। একদিন চাঁদনি রাতে লখনিয়া পাশের গাঁ থেকে বিয়ের নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরছে, দেখে মহুয়া গাছতলায় ময়ূর নাচছে।

যাঃ, শুধু মেঘলা দিনে ময়ূর নাচে।

না বোগিদাদা, চাঁদের আলোতেও ময়ূর নাচে। লখনিয়া তাই দেখে থমকে দাঁড়াল, ময়ূরটা নেচে নেচে একেবারে ওর সামনে এসে দাঁড়াল, কী জানি কেন লখনিয়ার তাকে ভালো লাগল। যেই ভালো লাগল, চোখের সামনে ময়ূরটা একটি সুন্দর মেয়ে হয়ে গেল। ময়ূরের পেখমের মতো ঝলমলে রূপ। চেয়ে চেয়ে আর লখনিয়ার মন ভরে না, হাত বাড়িয়ে যেই-না তাকে ধরতে গেল, অমনি বাতাসের মতো মিষ্টি সুরে বলল, অত সহজে পাওয়া যায় না, লখনিয়া, অপেক্ষা করতে হয়। বলেই কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে গেল।

সবাই বলল, লখনিয়া বিয়েবাড়িতে নেশা করেছিল, কী দেখতে কী দেখেছে। কিন্তু লখনিয়া ময়ূর-মেয়ের জন্য চল্লিশ বছর অপেক্ষা করেছিল।

থামলে কেন, ঝগড়ু, তারপর সে এসেছিল?

তা আর আসবেনা? ততদিনে লখনিয়া বুড়ো হয়ে গেছিল, চোখে ভালো দেখতে পেত না, কিন্তু তবু ময়ূর-মেয়ের রূপটি ঠিক চিনতে পেরেছিল। মরার আগে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছিল, মুখোনি হাসিতে ভরে গেছিল। এটাও বিশ্রী গল্প, দিদি?

রুমু বলল, না, ঝগড়ু, খুব ভালো গল্প।

বোগি বলল, তাই বলে সত্যি করে ময়ূর কখনো মানুষ হয় না!

ঝগড়ু, একটু হেসে উঠে গেল।

চারদিকের শব্দ যেন ক্রমে দূরে সরে যেতে লাগল। টেবিলের উপর ঘড়ির টিকটিক কখনো এত জোরে মনে হয় যে কান ঝালাপালা হয়ে যায়; আবার তারপরই এত দূরে সরে যায় যে প্রায় শোনাই যায় না। চারদিক চুপ হয়ে যায়, এত চুপচাপ যে কানে তালা লেগে যায়। ঘুমে বোগির চোখ জড়িয়ে আসছে, মনে পড়ল সেজো মামা বলেছে কানের মধ্যে বোঁ বোঁ আওয়াজ হল নিজের রক্ত চলাচলের শব্দ।

ঠিক তারপরেই যেন সকাল হয়ে গেল। দিদিমা দরজা খুলে, জানলার পর্দা সরিয়ে বললেন, কত ঘুমুবি তোরা? ওঠ শিগগির, চেয়ে দেখ তোদের আঁস্তাকুড়ের শিম গাছে কী সুন্দর ফুল ধরেছে!

এক লাফে রুমু বোগি রান্নাঘরের সামনে। একটা-দুটো ফুল নয়, ছড়া ছড়া ফুল, ফিকে নীল, গাঢ় নীল, বেগনি, গোলাপি, আশ্চর্য তাদের রং, প্রজাপতির মতো গড়ন, মিহি এক্টা সুগন্ধ।

ঝগড়ুও এল একটু বাদে, কুয়ো থেকে জল তোলা হলে।নাথুও এসেছিল কাপড়ের গাঁটরি মাথায় করে। গুণমণির ফুল ধরেছে। একটা বিড়ি খাইয়ে দাও, ঝগডু, আজ বড়ো ভালো দিন।

নাথুকে নিয়ে ঝগড়ু, কুয়োতলায় গেলে পর ঝগড়ুর বউ এল কালো ছেলেটাকে কোলে করে গুণমণিকে দেখতে; ছেলেটার গায়ে লাল ফতুয়া।

কী রূপ গো, দিদি, বাড়িখানি আলো হয়ে গেছে!

ততক্ষণে রোদ উঠে গেছে, বউ ছেলেটার গায়ের ফতুয়া ছাড়িয়ে দিল। তার গলায় একটা সোনা রুপোর মাদুলি বাঁধা।

কী দেখছ, দিদি, দাদা কাল রাতে পাঠিয়েছে দুমকা থেকে, জ্বর বন্ধ হবার জন্য।

তুমি যে বলেছিলে সোনা রুপো কেনবার পয়সা নেই?

কী জানি, দিদি, পাঠিয়েছে তো দেখছি।

সেদিন বিকেল বেলায় ভুলো ফিরে এল। নোংরা, ধুলো-মাখা গলায় একটা নারকোলের দড়ি বাঁধা, হাঁপাতে হাঁপাতে জিব ঝোলাতে ঝোলাতে এল। রুমু বোগিকে দূর থেকে দেখেই ভুলো দৌড়োতে লাগল। কাছে এসে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে নোংরা পা দিয়ে ওদের কাপড়চোপড় ময়লা করে দিয়ে, ওদের মুখ চোখ চেটে একাকার করল।

দিদিমা এসে বললেন, স্নান না করিয়ে ছুঁসনে ছুঁসনে বলছি!

 দাদু বললেন, দেখেছ ব্যাটার কাণ্ড! কেউ বেঁধে রেখেছিল নিশ্চয়।

এমন সময় ঝগড়ু, এসে দাঁড়াল।

ভুলোকে ফেলে রুমু ঝগড়ুর গলা জড়িয়ে ধরল। আর ভুলোও সেই সুযোগে দিল ঝগড়ুর পায়ের গুলিতে দাঁত বসিয়ে। পেজোমি একটুও কমেনি।

অনেক পরে, রাতে, ভুলোকে ঘরে নিয়ে শুয়ে বোগি বলল, রুমু!

কী দাদা?

ঝগড়ুর ঘরে কালো ছেলেটা নেই। বউ বলল, ওর বাবা-মা ওকে নিয়ে দুমকায় চলে গেছে।

সত্যি, দাদা, সত্যি?

নেই তো দেখলাম।

ও-ই তবে ভুলো, না দাদা? সত্যিই তবে ও-ই ভুলো।

কী জানি রুমু; ঝগড়ু বলে সত্যি যে কোথায় শেষ হয়, স্বপ্ন যে কোথায় শুরু হয় বলা মুশকিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *