১৫. রানীর সম্মানে

১৫. রানীর সম্মানে

নিঝুম দুপুর। গ্রীষ্মের রোদে দীর্ঘ রাজপথের ধুলো সাদাটে হয়ে তেতে রয়েছে। পথের দু’পাশে অনড় দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো। দূরের বিস্তীর্ণ ময়দানে আলস্য ভরে বইছে গরম হাওয়া, আরো দূরে চাইলে মনে হয় কাঁপছে। ঝর্ণার মাছগুলো ঝাঁক বেঁধে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা হলুদ পাথরের ছায়ায়। দু’পাশে পাখা মেলে থির হয়ে বসে আছে ফড়িংগুলো ঝর্ণার ধারের কোনো চোখা কাঠির ওপর, রোদ লেগে চিকচিক করছে রঙচঙে পাখা।

এই গরমের মধ্যে দুধ-সাদা এক ঘোড়ায় চড়ে রাজপথ ধরে এগিয়ে আসছে চমৎকার পোশাক-পরিচ্ছদ পরা এক তরুণ। চলতে চলতে থেমে দাঁড়িয়ে ঘাড় ফিরিয়ে চাইছে তার দিকে পথচারীরা। এত সুন্দর আর এত চমৎকার পোশাক পরা তরুণ এর আগে নটিংহামশায়ারে দেখেনি কেউ। পনের-ষোল বছর মত বয়স, ধবধবে সাদা গায়ের রঙ-তরুণীদেরও হার মানায়। লম্বা হলুদ চুল উড়ছে বাতাসে, সিল্ক আর মখমলের পোশাকে আঁটা দামী পাথর ঝলসে উঠছে রোদ লেগে, জিনের গায়ে বাড়ি খাচ্ছে কোমরে ঝোলানো ছোরার খাপ। বিখ্যাত লণ্ডন শহর থেকে আসছে এই ছেলে- রানীর ব্যক্তিগত পরিচারক, রিচার্ড পার্টিংটন, রানীর আদেশে শেরউডের জঙ্গলে বসবাসকারী এক রবিন হুডের কাছে চলেছে সে।

লেস্টার শহর থেকে একটানা বিশ মাইল পথ চলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তরুণ পার্টিংটন, তাই বিশাল ওকের ছায়ায় শান্ত সুশীতল এক সুন্দর সরাইখানা দেখতে পেয়ে খুশি হয়ে ঘোড়া থামালো। নীল শূকরের ছবি আঁকা রয়েছে সরাইখানার দরজায়। এক পাত্র রেনিশ ওয়াইন দিতে বলে কপালের ঘাম মুছলো তরুণ। তারপর দেখলো সরাইখানার বাইরে গাছের ছায়ায় বেঞ্চি পেতে বসে এল আর বিয়ার খাচ্ছে কয়েকজন লোক। ওদের মধ্যে তাগড়া চেহারার দু’জন লোকের পরনে রয়েছে লিংকন গ্রীনের পোশাক, গাছের গায়ে হেলান দিয়ে রেখেছে ওরা মস্ত দুটো ওকের লাঠি। গল্প থামিয়ে সবাই চেয়ে রয়েছে তার দিকে।

ট্রে-তে সাজিয়ে এক বোতল ওয়াইন আর একটা লম্বা সরু গ্লাস এনে দিল সরাইখানার মালিক। ঘোড়ার ওপর বসেই হলুদ মদ ঢাললো পার্টিংটন গ্লাসে, তারপর গ্লাসটা ওপরে তুলে বললো, ‘আমার মনিব মহামান্য রানী এলেনরের সুখ ও স্বাস্থ্য পান করছি, সেই সাথে কামনা করছি শীঘ্রিই যেন যাত্রা শেষ হয় আমার, যেন পেয়ে যাই দুঃসাহসী রবিন হুডকে।

কথা শুনে ওর দিকে আরো কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো সবাই, তারপর সবুজ পোশাক পরা লোক দু’জন নিচু স্বরে কি যেন আলাপ করলো নিজেদের মধ্যে। আলাপ শেষ হতেই উঠে দাঁড়ালো ওদের একজন। এত লম্বা আর এত বিশাল চেহারার লোক জীবনে কোনদিন দেখেনি পার্টিংটন। ‘রবিন হুডের কাছে আপনার কি দরকার, পরিচারক মশায়?’ জানতে চাইলো লোকটা। ‘কি চান রানী এলেনর তার কাছে? প্রশ্নটা নিছক কৌতূহলবশে করছি না, সদুত্তর পেলে আমি হয়তো রবিন হুডকে খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি আপনাকে।’

‘তাই নাকি, চেনো তুমি তাকে?’ খুশি হয়ে উঠলো তরুণ। ‘আমাকে তার কাছে পৌছে দিলে উপকার করবে তুমি তার, খুশি হবেন রানী।’

সবুজ পোশাক পরা চমৎকার রোদ-পোড়া চেহারার কোঁকড়া বাদামী চুলো অপর লোকটি কথা বলে উঠলো এবার। ‘আমরা শুনেছি আমাদের মহামান্যা রানী খুবই দয়ালু মানুষ, আপনাকেও সৎ লোক বলেই মনে হচ্ছে। আমরা দু’জন আপনাকে রবিন হুডের কাছে নিয়ে যেতে পারি; কিন্তু পরিচারক মশায়, আগে থেকে জানিয়ে রাখছি, ওর কোন ক্ষতি হলে ভাল হবে না।’

‘সে ব্যাপারে তোমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারো,’ বললো রিচার্ড পার্টিংটন, ‘কোন অমঙ্গলের বার্তা বয়ে আনিনি আমি। রানীর কাছ থেকে একটা বাণী নিয়ে এসেছি আমি রবিন হুডের কাছে। তোমরা যদি পথ দেখিয়ে আমাকে নিয়ে চলো তাহলে বড় ভাল হয়।’

‘বেশ, চলুন তাহলে,’ বললো ঢ্যাঙা লোকটা। সঙ্গীর দিকে ফিরলো সে। সত্যিই কোন ক্ষতির আশঙ্কা নেই তো, উইল?’ সঙ্গী মাথা নাড়তেই নিজের লাঠিটা হাতে নিয়ে তৈরি হয়ে গেল সে। উঠে পড়লো উইল স্টিউটলিও, লাঠি হাতে ঢ্যাঙা দৈত্যের পাশে এসে দাঁড়াল। মদের দাম চুকিয়ে দিয়ে রওনা হয়ে গেল ওরা।

গ্রীনউড গাছের শীতল ছায়ায় বসে অ্যালান-এ-ডেলের মধুর কণ্ঠের গান শুনছিল রবিন আর তার দলের কয়েকজন। মন্ত্রমুগ্ধের মত চুপ হয়ে গেছে সবাই, মৃদু মৃদু দুলছে গানের ছন্দে; এমনি সময়ে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ কানে গেল ওদের। পরমুহূর্তে জংলা পথ ছেড়ে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এলো লিটল জন আর উইল স্টিউটলি, তাদের পিছনে দুধ-সাদা ঘোড়ায় চেপে আসছে ফুটফুটে সুন্দর এক তরুণ।

এগিয়ে গেল রবিন। লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নামলো রিচার্ড পার্টিংটন, মাথা থেকে লাল মখমলের টুপি খুলে সৌজন্য প্রকাশ করলো। মৃদু হেসে রবিন বললো, ‘স্বাগতম। আপনার মত একজন সুদর্শন, সুসজ্জিত তরুণের গরীবদের এই শেরউড জঙ্গলে পদার্পণের কারণ জানতে পারি?’

‘আপনিই বোধহয় রবিন হুড, আর এরা সবাই আপনার অনুচর?’ জিজ্ঞেস করলো পার্টিংটন। রবিনকে মাথা ঝাঁকাতে দেখে বললো, ‘আপনার জন্যে মহামান্যা রানী এলেনরের শুভেচ্ছা বয়ে এনেছি আমি। তিনি আপনার কথা অনেক শুনেছেন, আপনার বীরত্ব ও মহত্ত্বের খবর জেনেছেন, তাই একবার তিনি আপনাকে স্বচক্ষে দেখতে চান। রানী বলে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমার সাথে লণ্ডন শহরে একবার আসেন, আপনার নিরাপত্তার জন্যে তাঁর সাধ্যমত সবই করবেন তিনি, যাতে নিরাপদে এই জঙ্গলে ফিরে আসতে পারেন তার সমস্ত ব্যবস্থা করবেন। আগামী চারদিন পর লণ্ডনের ফিারি ময়দানে আমাদের মহামান্য রাজা দ্বিতীয় হেনরী বিরাট এক শূটিং ম্যাচের আয়োজন করেছেন। সারা দেশের সেরা তীরন্দাজ সবাই তীর ছুঁড়বে সেখানে। মহামান্যা রানীর ইচ্ছে, আপনিও যোগদান করুন এই প্রতিযোগিতায়। তাঁর বিশ্বাস, আপনি অংশ গ্রহণ করলে কারো সাধ্য নেই আপনার কাছ থেকে জয়ের মালা ছিনিয়ে নেয়। শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে তিনি নিজের বুড়ো আঙুল থেকে খুলে এই সোনার আংটিটা পাঠিয়েছেন আপনার জন্যে। ‘

আংটিটা দেখেই কুর্ণিশ করলো রবিন হুড, সসম্মানে চুম্বন করে ওটা পরে নিল নিজের কনিষ্ঠ আঙুলে।

‘আসছি আমি,’ বললো সে, ‘রানীর আদেশ শিরোধার্য, অমান্য করবার প্রশ্নই ওঠে। কিন্তু রওনা হওয়ার আগে আপনার জন্যে একটু খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা…’

‘কোন দরকার নেই,’ বললো রিচার্ড পার্টিংটন। হাতে সময় নেই আমাদের। এক্ষুণি তৈরি হয়ে রওনা হওয়া দরকার। মহামান্যা রানী বলে দিয়েছেন, আপনি যদি ইচ্ছে করেন, দলের কয়েকজনকে সাথে নিতে পারেন, তাদেরকেও একই ভাবে অভ্যর্থনা করবেন তিনি।’

‘ঠিকই বলেছেন,’ বললো রবিন, হাতে বিশেষ সময় নেই। এক্ষুণি তৈরি হয়ে নিচ্ছি আমি। আর হ্যাঁ, তিনজনকে নেব আমি সাথে। লিটল জন, উইল স্কারলেট আর অ্যালান-এ-ডেল-জলদি তৈরি হয়ে নাও তোমরা তিনজন। উইল স্টিউটলি-আমার অনুপস্থিতিতে দলনেতা হিসেবে কাজ চালাবে তুমি।’

নাচতে নাচতে ছুটলো গুহার দিকে লিটল জন, উইল স্কারলেট আর অ্যালান-এ- ডেল। নিজেও যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হয়ে নিল রবিন হুড। অল্পক্ষণেই তৈরি হয়ে ফিরে এলো চারজন। রবিন পরেছে পা থেকে মাথা পর্যন্ত নীল পোশাক, লিটল জন আর উইল স্কারলেট পরেছে ওদের প্রিয় লিংকন গ্রীন, আর অ্যালান-এ ডেল পরেছে আগাগোড়া লাল পোশাক। চমৎকার লাগছে ওদের সবাইকে দেখতে। প্রত্যেকেই টুপির নিচে পরে নিয়েছে একটা করে সোনার কারুকাজ করা ইস্পাতের শিরস্ত্রাণ, জামার নিচে পরেছে চিকন লোহার জাল দিয়ে তৈরি বর্ম-এ বর্ম ভেদ করা কোন তীরের কর্ম নয়।

দুধ-সাদা ঘোড়ায় চড়ে বসলো তরুণ পার্টিংটন, দলের সবার সাথে হাত মিলিয়ে নিয়ে রওনা হয়ে গেল ওরা চারজন লণ্ডন শহরের উদ্দেশে।

লেস্টারশায়ারের মেলটন মব্রেতে এক সরাইখানায় সেই রাতটা কাটালো ওরা, পরের রাত কাটালো নথ্যাম্পটনশায়ারের কেটারিং-এ, তার পরের রাত বেডফোর্ড শহরে, এবং শেষ রাত হার্টফোর্ডশায়ারের সেন্ট অ্যালবান্স-এ। এখানে অবশ্য পুরো রাতটা থাকলো না ওরা, হাতে সময় কম, তাই মাঝরাতের দিকেই নেমে পড়লো পথে। দ্রুতপায়ে হাঁটছে ওরা আর দু’চোখ ভরে দেখছে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। উজ্জ্বল তারাগুলো নিস্প্রভ হয়ে এলো ক্রমে, ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে গ্রীষ্মের আশ্চর্য সুন্দর কোমল প্রভাত। লাল সূর্য উঠলো পুবাকাশে, ঘাসের বুকে চিকচিক করছে শিশির বিন্দু, দূরের উপত্যকায় ঝুলছে আবছা কুয়াশা, মিষ্টি সুরে ডাকতে শুরু করেছে পাখি, ঝোপের গায়ে মাকড়সার জালগুলো যেন পরিদের রূপালী কাপড়-ঝিলমিল করছে রোদ লেগে। অবশেষে একটা বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়লো বিখ্যাত লণ্ডন শহরের সুউচ্চ বুরুজ, দেয়াল আর দালান-কোঠা। পৌছে গেল ওরা লণ্ডনে।

রানী এলেনর বসে আছেন তাঁর রাজকীয় নিকুঞ্জে। জানালা গলে সোনালী রোদ এসে পড়েছে ঘরে। আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে সহচরী কয়েকজন পরিচারিকা। হাওয়ায় ভেসে আসছে লাল গোলাপের হালকা মিষ্টি সুবাস। এমন সময় একজন এসে খবর দিল, নিচের কাচারীঘরে অপেক্ষা করছে চারজন স্বাস্থ্যবান যুবক সহ তাঁর ব্যক্তিগত পরিচারক রিচার্ড পার্টিংটন। খুশি হয়ে উঠলেন রানী, আদেশ করলেন যেন এক্ষুণি ওদের নিয়ে আসা হয় তাঁর সামনে।

রবিন হুড, লিটল জন, উইল স্কারলেট আর অ্যালান-এ-ডেলকে নিয়ে আসা হলো রানীর নিকুঞ্জে। বুকে হাত বেঁধে হাঁটু মুড়ে সসম্ভ্রমে অভিবাদন করলো রবিন রানীকে। সহজ সরল ভাষায় বললো, ‘আপনি ডেকেছিলেন; আমি, রবিন হুড, এসেছি। আদেশ করুন। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও সে আদেশ পালন করবো আমি।

মিষ্টি হাসিতে ভরে উঠলো রানী এলেনরের সুন্দর মুখ। উঠে দাঁড়াতে বললেন তিনি রবিনকে, তারপর আদর করে বসালেন সবাইকে। খাবার নিয়ে আসার আদেশ দিলেন পরিচারিকাদের। খাওয়া-দাওয়া ও বিশ্রামের পর ওদের জীবনের নানান কথা জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন রানী। একে একে সব প্রশ্নের জবাব দিল রবিন। হেরিফোর্ডের বিশপ, স্যার রিচার্ড অফ লী এবং এমেটের কোষাধ্যক্ষের ঘটনা শুনে কখনও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তাঁর মুখ, কখনও দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে গেল হৃদয়, তারপর অলৌকিক উপায়ে বিশ মার্ক যখন আটশো পাউণ্ডেরও বেশি হয়ে গেল তখন উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠলেন তিনি। গল্প শেষ হতেই গান শোনানোর অনুরোধ করলেন তিনি অ্যালান-এ- ডেলকে। বিন্দুমাত্র ভণিতা না করে হার্পে সুর বেঁধে নিল অ্যালান-এ-ডেল, তারপর ধরলো গান। মুহূর্তে সম্মোহিত হয়ে পড়লো কামরার সবাই, সব ক’জোড়া চোখ স্থির হয়ে রয়েছে অ্যালানের মুখের ওপর, টু শব্দ নেই কারো মুখে, নড়াচড়া করতেও ভুলে গেছে। আশ্চর্য এক স্বর্গীয় সুধা নিঃসৃত হচ্ছে ওর কণ্ঠ থেকে। গান থেমে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ কথা সরলো না কারো মুখে।

.

প্রতিযোগিতার সময় ঘনিয়ে এলো। এলাহী কারবার চলছে ফিসারি ময়দানে। দশটা দলে ভাগ করা হয়েছে রাজার তীরন্দাজ বাহিনীকে। প্রত্যেক দলে রয়েছে আশিজন করে তীরন্দাজ, তাদের নেতৃত্বে একজন করে ক্যাপটেন। ময়দানের শেষ প্রান্তে টাঙানো হয়েছে দশটা ডোরাকাটা তাঁবু, প্রত্যেকটি তাঁবুর মাথায় আলাদা রঙের একটা করে পতাকা উড়ছে মৃদু বাতাসে। মাঝখানের হলুদ পতাকা টাঙানো তাঁবুর ক্যাপটেন রাজার ধনুক-বাহক বিখ্যাত টেপাস, তার একপাশে নীল পতাকাধারী তাঁবুর ক্যাপটেন গিলবার্ট অফ দ্য হোয়াইট হ্যাণ্ড, অন্যপাশে রক্ত-লাল রঙা পতাকা টাঙানো তাঁবুর ক্যাপটেন বাকিংহামশায়ারের তরুণ ক্লিফটন। অন্য সাতটি তাঁবুর ক্যাপটেনও খুবই নামজাদা ধনুর্বিদ, যেমনঃ কেন্টের এগবার্ট কিংবা সাউথ্যাম্পটনের উইলিয়াম-এরা প্রত্যেকেই দক্ষ তীরন্দাজ, কিন্তু প্রথম তিনজনের মত অতটা বিখ্যাত নয়। তাঁবুগুলো থেকে কথাবার্তা আর হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে, পিঁপড়ের মত পিলপিল করে প্রতিটা তাঁবুতে ঢুকছে-বেরোচ্ছে পরিচর্যায় নিযুক্ত ভৃত্যের দল—কারও হাতে এল বা বিয়ারের পাত্র, কেউ নিয়ে চলেছে কয়েক গাছি ধনুকের ছিলা, কেউ বা তীর ভরা তূণ।

ময়দানের দুইপাশে দর্শকদের জন্য ধাপে ধাপে উঁচু হয়ে যাওয়া বেঞ্চের সারি। উত্তর পাশের সারিগুলোর মাঝামাঝি জায়গায় উঁচু মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে রাজা আর রানীর বসার জন্যে। বিচিত্র রঙের ক্যানভাসের ছাত, রঙিন ঝালর আর ফিতে দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে মঞ্চটা। রাজা-রানী এসে পৌঁছোননি এখনও, কিন্তু বেঞ্চিগুলো ভর্তি হয়ে গেছে, গিজগিজ করছে হরেক রঙের জামা পরা অসংখ্য মানুষ, ধাপের পর ধাপ অনেক উঁচু পর্যন্ত কেবল মাথা আর মাথা তাকালে ধাঁধা লেগে যায় চোখে। যেখানে দাঁড়িয়ে তাঁর ছোঁড়া হবে সেই দাগ থেকে একশো ষাট গজ দূরে টাঙানো হয়েছে দশটা টার্গেট, প্রতিটা টার্গেটের পাশে যে-দল সেটা লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়বে সেই দলের বিশেষ রঙের ছোট একটা করে পতাকা ঝুলছে। সব কিছু তৈরি, এখন শুধু রাজা-রানী এসে পৌছবার অপেক্ষা।

খানিক পর শোনা গেল ট্রাম্পেটের গগন বিদারী নিনাদ। উপস্থিত সবার দৃষ্টি চলে গেল আওয়াজটা যেদিক থেকে আসছে সেইদিকে। দেখা গেল, ছয়জন বিচিত্র ঝলমলে পোশাক পরা ট্রাম্পেট-বাদক ঘোড়ায় চেপে এগিয়ে আসছে এদিকে, মুখে ধরা রয়েছে রূপোর ট্রাম্পেট। তাদের পিছনে ছাই-রঙা একটা সুন্দর ঘোড়ায় চেপে আসছেন রাজা দ্বিতীয় হেনরী, পাশে সাদা একটা ঘোড়ায় বসে রয়েছেন রানী এলেনর। রাজা-রানীর দু’পাশে পায়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে রক্ষীদল, রোদ লেগে ঝকঝক করছে ওদের কুঠার ও বর্ণার তীক্ষ্ণ ফলাগুলো। এদের পেছনেই রয়েছেন রাজার পারিষদবর্গ। উজ্জ্বল, রঙচঙা পোশাক-পরিচ্ছদ আর দামী অলংকার ঝিকমিকিয়ে উঠলো রোদ লেগে। গোটা মাঠটা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে নানা বর্ণের রেশম আর মখমলের নড়াচড়ায়।

উঠে দাঁড়ালো দর্শকবৃন্দ। তাদের বিপুল হর্ষধ্বনিতে কেঁপে উঠলো আকাশ বাতাস। রুমাল বা স্কার্ফ ধরা হাত নাড়ছে সবাই রাজা-রানীর উদ্দেশে। মঞ্চের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ঘোড়া। ঘোড়া থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন রাজা ও রানী মঞ্চের ওপর, সেখানে পাশাপাশি সাজানো দুটো আসনে বসলেন তাঁরা।

হৈ-চৈ থেমে যেতেই বেজে উঠলো একটা বিউগল। সাথে সাথেই লাইন করে সব ক’টি তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলো তীরন্দাজরা। আটশো নিপুণ তীরন্দাজ ছন্দোবদ্ধ পদক্ষেপে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো রাজা-রানীর মঞ্চের সামনে। গর্বের সাথে তাদের ওপর চোখ বুলালেন রাজা হেনরী, খুশিতে বুকটা ভরে গেল তাঁর। ব্যক্তিগত ঘোষক মন্ত্রের স্যার হিউকে প্রতিযোগিতার নিয়ম ঘোষণার আদেশ দিলেন তিনি। মঞ্চের সামনের প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালেন স্যার হিউ, পরিষ্কার উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন প্রতিযোগিতার নিয়ম-কানুন ও পুরস্কারের কথা, উপস্থিত দর্শকমণ্ডলী সবাই স্পষ্ট শুনতে পেল প্রত্যেকটি শব্দ।

‘প্রত্যেকে নিজ নিজ দলের টার্গেট লক্ষ্য করে সাতটা তীর ছুঁড়বে, প্রত্যেক দলের আশিজনের ভেতর থেকে বেছে বের করা হবে সেরা তিনজন তীরন্দাজকে। এই তিনজন আবার তিনটে করে তীর ছুঁড়বে, এদের মধ্যে যে সেরা হবে তাকে প্রতিযোগিতা করতে হবে বাকি নয়টা দলের সেরা তীরন্দাজের সাথে। দশটি দলের দশজন সেরা তীরন্দাজ প্রত্যেকে তিনটি করে তীর ছুঁড়বে। প্রথম পুরস্কার বিজয়ীকে দেয়া হবে পঞ্চাশটি স্বর্ণমুদ্রা, একটা সোনার কারুকাজ করা রূপোর তৈরি শিঙা, এবং একটি চামড়ার তুণে সাদা রাজহাঁসের পালক বাঁধা, শেষ মাথায় সোনার রিঙ পরানো দশটি তীর। দ্বিতীয় পুরস্কার বিজয়ী পাবে ড্যালেন লী-তে চরে বেড়ানো একশোটা হরিণ, যখন খুশি মেরে নেবে সে সেখান থেকে। তৃতীয় পুরস্কার বিজয়ীকে দেয়া হবে বিশাল দুটো পিপে ভর্তি চমৎকার রেনিশ মদ। বাকি সাতজনের প্রত্যেককে দেয়া হবে আশিটা করে রূপোর পেনি।’

স্যার হিউর ঘোষণা শেষ হতেই মাথার ওপর ধনুক তুলে জয়ধ্বনি করলো তীরন্দাজেরা, তারপর তালে তালে পা ফেলে ফিরে গেল নিজেদের তাঁবুতে।

শুরু হলো প্রতিযোগিতা। উদ্বোধনী তীর ছুঁড়লো প্রত্যেক দলের ক্যাপটেন, তারপর একে একে দাগের ওপর এসে দাঁড়ালো দলের আর সবাই। প্রথম কিস্তিতে দশটি টার্গেট লক্ষ্য করে বর্ষিত হলো পাঁচ হাজার ছয়শো তীর। গেরস্ত বাড়ির কৌতূহলী কুকুরে শুঁকলে শজারুর পিঠের যা অবস্থা হয়, দশটা টার্গেটকে এখন দেখতে লাগছে অনেকটা সেই রকম। বিচারকমণ্ডলী অনেক বাছ-বিচার করে প্রত্যেকটি দল থেকে সেরা তিনজনের নাম ঘোষণা করলেন উচ্চকণ্ঠে। আগেরগুলো সরিয়ে নিয়ে দশটা নতুন টার্গেট টাঙানো হলো সেই জায়গায়। সাথে সাথেই স্তব্ধ হয়েগেল দর্শক-গ্যালারীর বাকবিতণ্ডা ও হট্টগোল। দাগের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে দশটি দলের সেরা তিনজন করে মোট ত্রিশজন তীরন্দাজ।

এবার আর প্রথম দফার মত অত সময় লাগলো না, প্রত্যেক দল থেকে ছোঁড়া হলো মাত্র নয়টি করে তীর। টার্গেটের বাইরে গেল না একটি তীরও, কিন্তু গিলবার্টের দলের নয়টার মধ্যে পাঁচটাই লাগলো গিয়ে কেন্দ্রের গোলসাদা অংশে অবশ্য এর মধ্যে তিনটে তীর গিলবার্টের নিজের ছোঁড়া। আবার এগিয়ে গেলেন বিচারক-মণ্ডলী, প্রত্যেকটি দলের সেরা তীরন্দাজের নাম ঘোষণা করলেন উঁচু গলায়। জানা গেল, গিলবার্টের এ পর্যন্ত ছোঁড়া মোট দশটা তীরের ছয়টাই গিয়ে বিধেছে ঠিক মধ্যচক্রে, টেপাস এবং ক্লিফটনও তার থেকে খুব একটা পিছিয়ে নেই-প্রায় একই সমান ভাল করেছে তারাও, বাকি সাতজনও ছুঁই ছুঁই করছে এদের; প্রথম দ্বিতীয় বা তৃতীয় কে হবে, আগে থেকে বলার উপায় নেই। দারুণ জমে উঠেছে খেলা। চাপা উত্তেজনায় গরম হয়ে উঠেছে দর্শকবৃন্দ।

তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে দিয়ে যার যার তাঁবুতে ফিরে গেল সেরা দশজন, খানিক বিশ্রাম নিয়ে, প্রয়োজন মনে করলে ধনুকের ছিলা পাল্টে নিয়ে, আবার আসবে তারা একটু পর। মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আসবে, কারণ নিজের যোগ্যতা প্রমাণের এ-ই শেষ সুযোগ।

গ্যালারীর মৃদু গুঞ্জন এখন জোর হাওয়া লাগা ঘন জঙ্গলে পাতার মর্মর ধ্বনির মতো শোনাচ্ছে। হাসিমুখে রানী এলেনর ফিরলেন রাজার দিকে। ‘তোমার কি মনে হয় এই দশজনই গোটা ইংল্যাণ্ডের সেরা তীরন্দাজ?’

‘ঠিক,’ হাসিমুখে বললেন রাজা হেনরী। ‘শুধু ইংল্যাণ্ডেই নয়, আমার ধারণা, সারা দুনিয়ায় এরাই শ্রেষ্ঠ, কোন তুলনা নেই এদের।’

‘তোমার সেরা তিনজন তীরন্দাজের চেয়েও ভাল তিনজন তীরন্দাজ যদি আমি হাজির করে দিতে পারি?’

হেসে উঠলেন রাজা হেনরী। বললেন, ‘তাহলে বলবো আমি যা পারিনি, তুমি সেই অসাধ্য সাধন করেছো। অযথা গর্ব করছি না, সত্যিই বলছি, টেপাস, গিলবার্ট আর বাকিংহামশায়ারের ক্লিফটনের সমকক্ষ তীরন্দাজ গোটা দুনিয়ায় খুঁজে পাবে না তুমি।’

‘গোটা দুনিয়ায় খোঁজার দরকার কি?’ মৃদু হাসলেন রানী, ওদের চেয়ে অনেক ভাল তীরন্দাজ রয়েছে। তোমার রাজত্বেই। সত্যিকার গুণী লোকদের খুঁজে পাওনি তুমি, কিন্তু আমি পেয়েছি; তুমি যদি বলো, আমি এক্ষুণি হাজির করতে পারি ওদের। অনায়াসে হারিয়ে দেবে ওরা তোমার আটশো তীরন্দাজ থেকে বেছে বের করা সেরা তিনজন তীরন্দাজকে।’

‘তাই নাকি?’ কৌতুকে চকচক করছে রাজার দু’চোখ। তা নিয়ে এসো না!’ আনতে পারি, যদি তুমি ওদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করো।’

‘সত্যিই!’ হা হা করে হেসে উঠলেন রাজা। ‘আশ্চর্য! রানীকে মানায় না, এমন সব অদ্ভুত ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছো তুমি আজকাল। ঠিক আছে, তুমি যদি সত্যি সে-রকম লোক হাজির করতে পারো, কথা দিচ্ছি, যে অপরাধই করে থাকুক তারা, আগামী চল্লিশ দিন তাদের মাথার একটা চুলও স্পর্শ করবো না আমি। আরও কথা দিচ্ছি, যদি সত্যিই তারা আমার সেরা তিনজন তীরন্দাজকে হারিয়ে দিতে পারে, তাদেরকেই ঘোষণা করা হবে পুরস্কার-বিজেতা হিসেবে। যাই হোক, তুমি যখন তীর-ধনুকের ব্যাপারে হঠাৎ এত আগ্রহী হয়ে উঠেছো, তোমার-আমার মধ্যে ছোট্ট একটা বাজিও হয়ে যাক, কি বলো?’

‘বেশ তো,’ বললেন রানী। ‘আমি অবশ্য এসব বাজি টাজি ভাল বুঝি না, কিন্তু তুমি যদি খুশি হও, ঠিক আছে, ধরবো বাজি। কি বাজি ধরবে তুমি তোমার লোকদের পক্ষে?’

মজা হবে ভেবে খুশি হয়ে উঠলেন রাজা হেনরী। ‘হেরে গেলে আমি দেব তিন টান (২৫২ গ্যালনের বড় পিপে) রেনিশ ওয়াইন, দশ টান এল, স্প্যানিশ ইউ-এর চমৎকার দু’শো ধনুক আর দু’শো তীর-ভর্তি তূণ। এবার শোনা যাক, তুমি কি দেবে।’

আশেপাশে দাঁড়ানো সবার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এই মজার ব্যাপারটার পরিসমাপ্তি কিভাবে হয় তা দেখার জন্যে আগ্রহী হয়ে উঠেছে সবাই। রানীকে গম্ভীর ভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি প্রকাশ করতে দেখে একটু অবাক হলো তারা। রানী বললেন, ‘বেশ তো, আমি রাজি।’ চারপাশে তাকালেন। আপনাদের মধ্যে কে থাকবেন আমার পাশে? আমার লোকেদের পক্ষে বাজি ধরতে আর কে রাজি?’

কেউ কোন জবাব দিল না, টেপাস, গিলবার্ট আর ক্লিফটনের বিরুদ্ধ-পক্ষে বাজি ধরার ইচ্ছে বা সাহস কারো নেই।

‘কই?’ আবার জিজ্ঞেস করলেন রানী। ‘কেউ নেই আমার সমর্থনে? আপনি? হরিফোর্ডের লর্ড বিশপ, আপনি ধরবেন বাজি?’

‘না, না!’ সভয়ে বললেন লর্ড বিশপ, ‘এই পোশাক পরা মানুষের বাজি ধরা অধর্ম। তাছাড়া, আমার বিশ্বাস, দুনিয়ার কারও পক্ষেই এদেরকে হারানো সম্ভব নয়, অযথা গচ্চা যাবে আমার টাকা।’

‘বুঝতে পারছি, ওই পোশাক পরেও সুবিধে মনে করলে বাজি ধরতে রাজি ছিলেন আপনি, আসল বাধাটা ধর্মীয় নয়, টাকা খোয়া যাবার ভয়!’ হাসি মুখে বললেন রানী। গুনে খুক খুক করে হেসে উঠলো আশপাশের কয়েকজন, হাসি হাসি হয়ে উঠলো রাজার মুখটাও। লর্ড বিশপের অর্থলিপ্সার কথা জানা আছে সবারই। ঘাড় ফিরিয়ে স্যার রবার্ট লী বলে এক নাইটের দিকে চাইলেন রানী। ধন সম্পদের তো অভাব নেই আপনার, আপনিও কি এগিয়ে আসবেন না একজন মহিলার সমর্থনে?’

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই,’ বললেন স্যার রবার্ট লী। রানীর সন্তুষ্টি বিধানের জন্যে এবং তাঁর সম্মান রক্ষার্থে কিছু টাকা পানিতে ফেলতে আমার আপত্তি নেই। অন্য কেউ হলে একটা ফুটো পয়সাও বাজি ধরতাম না আমি। কারণ, টেপাস, গিলবার্ট আর ক্লিফটনের সামনে দাঁড়াতে পারে এমন তীরন্দাজ সত্যিই নেই।’

রাজার দিকে ফিললেন রানী। ‘কারো সমর্থনের দরকার নেই আমার। তোমার রেনিশ ওয়াইন, এল আর তীর-ধনুকের চেয়েও অনেক দামী একটা জিনিস ধরছি আমি রাজি। আমার কোমরের এই মণি-মুক্তো খচিত কটিবন্ধ খুলে দেব আমি, যদি হেরে যাই বাজিতে।

‘বেশ,’ বললেন রাজা হেনরী, ‘ডেকে পাঠাও তোমার ধনুর্বিদদের। এই দেখো, দাগের ওপর এসে দাঁড়াচ্ছে আমার দশজন। এদের প্রতিযোগিতা শেষ হয়ে যাক, তারপর তোমার তিনজনকে মোকাবিলা করবে আমার সেরা তিনজন।

‘ঠিক আছে,’ বলে ইশারায় রিচার্ড পার্টিংটনকে ডাকলেন রানী, কানে কানে কিছু বললেন; মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করে চলে গেল ছেলেটা, কোনাকুনি ভাবে ময়দানটা পেরিয়ে মিশে গেল লোকের ভিড়ে। তাই দেখে মঞ্চে উপস্থিত সুধিমণ্ডলীর মধ্যে কানাকানি ফিসফাস আলোচনা শুরু হয়ে গেল-কেউ ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কাদের ডাকতে পাঠালেন রানী, এত বড় তীরন্দাজদের বিরুদ্ধে কারা যুঝবে রানীর স্বপক্ষে।

প্রতিযোগিতার শেষ পর্ব অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এখন, দাগের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে দশ দলের থেকে বাছাই করা সেরা দশজন। থমথমে নীরবতা বিরাজ করছে গোটা ময়দানে। হঠাৎ কোন বাচ্চার খোলা গলার ক্যাঁ করে চেঁচিয়ে ওঠার শব্দ ছাড়া আর সব নিস্তব্ধ। যেন দম আটকে রেখেছে সবাই। ধীর স্থির ভঙ্গিতে অতি সাবধানে তিনটে করে তীর ছুঁড়লো প্রত্যেকে, গ্যালারিতে এতই অখণ্ড নীরবতা বিরাজ করছে যে প্রতিটা তীর টার্গেটে গিয়ে বেঁধার শব্দ কানে এলো সবার। শেষ তীরটা ছোঁড়া হয়ে যেতেই প্রচণ্ড এক হর্ষধ্বনি উঠলো সারামাঠের সবার কণ্ঠ থেকে। দেখা গেল, এবারও কেন্দ্র-চক্রের দাদা অংশে গিয়ে বিঁধেছে গিলবার্টের তিনটে তীর, দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে টেপাস দুটো তীর কেন্দ্রচক্রে এবং একটা তীর তার পাশের কালো চক্রে লাগিয়ে, কিন্তু ক্লফটনকে হারিয়ে তৃতীয় স্থানে উঠে এলো সাফোকের হিউবার্ট—দু’জনই দুটো তীর লাগিয়েছে সাদা কেন্দ্র-চক্রে, তবে ক্লিফটনের তৃতীয় তীর বিধেছে গিয়ে চতুর্থ চক্রে, আর হিউবার্টেরটা লেগেছে তৃতীয় চক্রে।

গিলবার্টের দলে খুশির হুল্লোড় পড়ে গেছে, লাফাচ্ছে সবাই, চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছে, টুপি খুলে ছুঁড়ে দিচ্ছে আকাশে, করমর্দন করছে একে অন্যের সাথে।

এই গোলমাল আর চিৎকারের মধ্য দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে রাজা-রানীর মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসছে পাঁচজন লোক। এখানকার বেশির ভাগ লোকই চেনে রিচার্ড পার্টিংটনকে, কিন্তু বাকি চারজন সম্পূর্ণ অচেনা। নীল পোশাক পরা লোকটা হাঁটছে তরুণ পার্টিংটনের পাশাপাশি, তাদের পেছনে আসছে দু’জন সবুজ পোশাক পরা তাগড়া চেহারার জোয়ান এবং একজন লাল পোশাক পরা তরুণ। তরুণের হাতে তিনটে বিশাল ধনুক, দুটো ধনুকের গায়ে রূপো দিয়ে নক্সা আঁকা, তৃতীয়টা সোনা দিয়ে।

সবাই লক্ষ্য করছিল এই পাঁচজনকে, এমন সময় দেখতে পেল রাজার মঞ্চ থেকে একজন সংবাদ-বাহক দৌড়ে গিয়ে কিছু বলছে গিলবার্ট, টেপাস আর হিউবার্টকে। চুপ হয়ে গেল সবাই। তিনজন বিজয়ীকে রাজার মঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে দর্শকরা বুঝে নিল অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটতে চলেছে, গলা সামনে বাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ওরা ব্যাপারটা কি।

পার্টিংটনের সাথে এসে রাজা-রানীর মঞ্চের সামনে দাঁড়ালো চারজন, হাঁটু ভাঁজ করে মাথার টুপি খুললো রানীর সম্মানে। সামনে ঝুঁকে এলেন রাজা হেনরী, এদের কাউকেই চিনতে পারলেন না তিনি। কিন্তু এদের চেহারা দেখেই চমকে উঠলেন হেরিফোর্ডের বিশপ, যেন এইমাত্র বোলতার হুল ফুটেছে তাঁর গায়ে। কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেই দেখতে পেলেন তিনি হাসিমুখে চেয়ে রয়েছেন রানী তাঁর দিকে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে চুপ রইলেন তিনি, ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠছে তাঁর মুখ।

‘লক্সলি,’ খানিকটা সামনে ঝুঁকে পরিষ্কার কণ্ঠে বললেন রানী। ‘রাজার সাথে বাজি ধরেছি আমি, বলেছি তুমি আর তোমার দু’জন লোক রাজার সেরা তিন তীরন্দাজকে হারিয়ে দিতে পারবে। আমার খাতিরে চেষ্টা করে দেখবে একবার?’

‘নিশ্চয়ই,’ উত্তর দিলো রবিন হুড। আমার সাধ্য মত চেষ্টা করবো আমি। আপনার মান যদি রাখতে না পারি, জীবনে ধনুক স্পর্শ করবো না আর।’

রানীর নিকুঞ্জে গিয়ে মার্জিত পরিবেশে রীতিমত অস্বস্তি আর আড়ষ্টতায় ভুগেছে লিটল জন, মুখ তুলে কথা বলতে পারেনি রানীর সাথে, কিন্তু তাজা সবুজ ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করলো সে। বললো, ‘আপনার সুন্দর মুখের ওপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ বর্ষিত হোক। আপনার সম্মান ক্ষুণ্ণ হয় এমন কাজ যদি কেউ করে, বেশি কিছু বলতে চাই না, পিটিয়ে লাশ করে ফেলব মাথা ফাটিয়ে ছেড়ে দেব আমি তাকে। হ্যাঁ!’

‘অ্যাই, লিটল জন! এসব কথা বলতে হয় না!’ চাপা গলায় ধমক দিল রবিন। কিন্তু বোঝা গেল, ওর এই আন্তরিক অভিব্যক্তিতে অসন্তুষ্ট হয়নি কেউ; মৃদু হাসলেন রানী, পারিষদদের অনেকেই হেসে উঠলো।

হেরিফোর্ডের লর্ড বিশপ কিন্তু হাসলেন না। রাজার মুখেও হাসির লেশমাত্র নেই। রানীর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, ‘কারা এরা? কাদের ডেকে এনেছো তুমি আমাদের সামনে?

নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না হেরিফোর্ডের লর্ড বিশপ, লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ইয়োর ম্যাজিস্টি, ওই যে নীল পোশাক পরা লোকটা দেখা যাচ্ছে, ওর নাম রবিন হুড, মিডকান্ট্রির এক কুখ্যাত দস্যু, রবিন হুড! ওই যে ঢ্যাঙা দৈত্যের মত লোকটা দেখছেন, ওর নাম লিটল জন, দস্যু রবিন হুডের দোসর। তার পাশের জনের নাম উইল স্কারলেট। আর লাল পোশাক পরা ছোকরা একজন চারণ, ওর নাম অ্যালান-এ-ডেল।’

এই কথা শুনে কালো হয়ে পরস্পরের সাথে সেঁটে গেল রাজার দুই ভুরু। রানীর দকে ফিরলেন তিনি, কঠোর কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘এসব কথা সত্য?’

‘হ্যাঁ,’ হাসি মুখেই জবাব দিলেন রানী। সত্যি কথাই বলেছেন বিশপ। তিনি চনতে পেরেছেন এদের, কারণ কিছুদিন আগে রবিন হুডের সাথে তিনটে দিন চাটিয়েছেন তিনি শেরউড জঙ্গলে, মনের আনন্দে হরিণ শিকার করেছেন, সেই মাংস দয়ে রান্না করা ভুরিভোজ খেয়েছেন তৃপ্তির সাথে। তিনি যে তাঁর বন্ধুর সাথে এরকম বশ্বাসঘাতকতা করে বসবেন, একথা ভাবতেও পারিনি। যাই হোক, মনে রেখো, মাগামী চল্লিশ দিনের জন্যে ক্ষমা করে দিয়েছো তুমি ওদেরকে।’

‘আমার শপথ আমি রক্ষা করবো,’ বললেন রাজা, কিন্তু কণ্ঠস্বরের কাঁপুনি শুনে বাঝা গেল ভয়ঙ্কর রেগে গেছেন তিনি, ‘কিন্তু চল্লিশ দিন পার হয়ে গেলে দেখবো আমি ক করে রক্ষা পায় ও আমার হাত থেকে। ওদের অনেক দুষ্কৃতির কথা কানে এসেছে মামার। ভালোমত শায়েস্তা করে ছাড়ব আমি ওদের।’ এই বলে নিজের তীরন্দাজদের দকে ফিরলেন তিনি। ইতিমধ্যেই শেরউডের দস্যুদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে হাঁ করে কথা নছে ওরা। ‘শোনো গিলবার্ট, টেপাস আর হিউবার্ট!’ হাঁক ছাড়লেন রাজা। আমি একজনকে কথা দিয়েছি, এই তিনজনের সাথে প্রতিযোগিতায় নামবে তোমরা তিনজন 1 যদি তোমরা এই বদমাশদের হারিয়ে দিতে পারো, তোমাদের প্রত্যেকের টুপি আমি ঘরে দেব রূপোর পেনি দিয়ে, কিন্তু যদি হেরে যাও, তোমাদের জেতা পুরস্কার চলে যাবে ওদের হাতে। তোমরা রাজি আছো এই প্রতিযোগিতায়?’

‘হুজুর যখন কথা দিয়েছেন, আমরা রাজি,’ বললো গিলবার্ট। ‘কোন আপত্তি নেই মামাদের কারো।‘

‘খুশি হলাম,’ বললেন রাজা। যার যা জানা আছে, সমস্ত কৌশল প্রয়োগ করো গয়ে। যদি জিততে পারো, তোমাদের সারা জীবনের সুখ-শান্তির ব্যবস্থা করে দেব মামি।’

ঘুরে দাঁড়িয়ে যার যার তাঁবুতে ফিরে গেল তিন বিজয়ী, রবিন আর তার সঙ্গীরা গয়ে দাঁড়ালো দাগের ওপর। ধনুকে ছিলা পরিয়ে যার যার তূণ থেকে বেছে ভাল তীর বর করার কাজে লেগে গেল ওরা।

এদিকে রাজার তীরন্দাজরা তাঁবুতে ফিরতেই ওদের ছেঁকে ধরলো আর সবাই াঞ্চের কাছে কি ঘটলো জানার জন্যে। মিডকান্ট্রির সেই বিখ্যাত রবিন হুড আজকের এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে শুনে হাঁ হয়ে গেল সবার মুখ। কেবল রবিন ডই নয়, লিটল জন, উইল স্কারলেট, অ্যালান-এ-ডেল-সবার নামই জানা আছে তাদের। খবরটা প্রচার হয়ে গেল অন্যান্য তাঁবুতেও, তারপর উঠলো দর্শকদের কানে। মল্লক্ষণের মধ্যেই দুই গ্যালারির যত লোক, কারোই আর বাকি থাকলো না খবরটা জানতে। উঠে দাঁড়িয়েছে সবাই, ঘাড় বাঁকিয়ে দেখার চেষ্টা করছে বিখ্যাত দস্যুদের।

ছয়টা নতুন টার্গেট টাঙানো হলো ছ’জনের জন্যে। নিজ নিজ তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে দাগের ওপর দাঁড়ালো গিলবার্ট, টেপাস আর হিউবার্ট। রবিন ও গিলবার্ট একটা দ্রো টস্ করে স্থির করলো আগে তীর ছোঁড়ার সুযোগ পাবে কার দল। জিতলো গলবার্ট। হিউবার্টকে প্রথম তীর ছোঁড়ার আদেশ দিল সে।

তীর ছোঁড়ার ভঙ্গি নিয়ে দাঁড়ালো হিউবার্ট, বাম পা সামনে, ডান পা পিছনে; ইলায় পরালো একটা বাছাই করা গোল, সোজা তাঁর, তারপর অত্যন্ত সাবধানে ধীরস্থির চুঙ্গিতে ছুঁড়লো সেটা। সোজা মাঝের সাদা কেন্দ্র-চক্রে গিয়ে বিধলো তীর। দ্বিতীয় টীরটাও বিধলো সেখানে। কিন্তু তৃতীয় তীরটা লাগলো গিয়ে তার পাশের কালো ঘরে, নাদা অংশের থেকে মাত্র এক আঙুল বাইরে। বিপুল হর্ষধ্বনি উঠলো দর্শকদের মধ্যে থেকে, কারণ আজকের প্রতিযোগিতায় হিউবার্ট যতবার তীর ছুঁড়েছে তার মধ্যে এবারের নিশানা হয়েছে সবচেয়ে ভাল।

হাসলো রবিন হুড। বললো, ‘এর চেয়ে ভাল করা তোমার জন্যে কঠিনই হয়ে যাবে, উইল। নাও, এবার তোমার পালা, পেশীগুলো টান টান করে নিয়ে মারো দেখি তীর-শেরউডের নাম ডুবিয়ো না।’

সিধে হয়ে দাঁড়ালো উইল স্কারলেট, হাসিমুখে তীর যোজনা করলো ছিলায়, কিন্তু অতি সাবধানতার জন্যে নষ্ট করে ফেললো প্রথম নিক্ষেপ। কালো ঘরের পাশেরটায় গিয়ে লাগলো তীর, অর্থাৎ কেন্দ্র-চক্রের পাশের পাশেরটায়। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো রবিন। তারপর বললো, ‘সহজ ভঙ্গিতে মারো, বাছা। তোমাকে বার বার বলিনি, অতক্ষণ টেনে ধরে রেখো না ছিলাটা?’ এই কথায় হুঁশিয়ার হয়ে গেল উইল স্কারলেট, পর পর দুটো তীর সেঁধিয়ে দিল কেন্দ্র-চক্রে। কিন্তু ভুল যা হবার হয়ে গেছে, হিউবার্টকে পরাজিত করতে পারেনি সে। প্রচণ্ড হাততালিতে ফেটে পড়লো দর্শকবৃন্দ, সবাই খুশি হিউবার্টকে বিজয়ী দেখে।

বাঁকা দৃষ্টিতে চাইলেন রাজা রানীর মুখের দিকে। ‘এই যদি নমুনা হয়, বাজিতে হার হয়ে যাবে তোমার, গিন্নী।’ টিটকারিতে ভূক্ষেপ করলেন না রানী, মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকালেন, তিনি আশা করছেন রবিন হুড ও লিটল জন মান বাঁচাবে তাঁর।

এবার টেপাসের পালা। উইল স্কারলেটের মত একই ভুল করে বসলো টেপাস, জেতার আগ্রহে অতি-সতর্কতা অবলম্বন করতে গেল। প্রথম তীরটা বিধলো মাঝের সাদা ঘরে, কিন্তু দ্বিতীয়টা গিয়ে বিধলো পাশের কালো ঘরে, শেষের তীরটা অবশ্য কপাল গুণে বিধলো গিয়ে একেবারে কেন্দ্র-বিন্দুতে, এক্কেবারে ছোট্ট কালো বিন্দুটার ওপর। ‘বাহ্, বাহ্, চমৎকার! প্রশংসা করলো রবিন। ‘দারুণ দেখিয়েছো, টেপাস! নিঃসন্দেহে এটা আজকের সেরা শট। কিন্তু, ভায়া, গোলমাল করে ফেলেছে। দ্বিতীয়টায়। নাও, লিটল জন, এবার তোমার পালা।’

দাগের ওপর দাঁড়িয়ে কোন রকম ভণিতা না করে টপাটপ তিনটে তীর মেরে দিল লিটল জন, বাম হাতে ধরা ধনুকটা একবার নামাবারও প্রয়োজন বোধ করলো না, একটা করে তীর জুড়লো ছিলায়, কানের কাছে টেনে এনেই ছেড়ে দিল সোজা উড়ে গিয়ে সাদা মধ্য-চক্রে বিধলো একের পর এক তিনটে তীরই। হর্ষ বোধ করলো না কেউ এতে। যদিও সারাদিনের সেরা নিক্ষেপ প্রত্যক্ষ করলো সবাই এইমাত্র, হর্ষধ্বনি বেরোলো না কারো মুখ থেকেই। লণ্ডনবাসীরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না গ্রাম থেকে এসে টেপাসের মত এতবড় একজন তীরন্দাজকে হারিয়ে দিয়ে যাবে কেউ তা সে যত বিখ্যাত লিটল জনই হোক না কেন।

এবার দাগের ওপর গিয়ে দাঁড়ালো গিলবার্ট অফ দা হোয়াইট হ্যাণ্ড। অতি সাবধানে তিনটে তীর ছুঁড়লো সে, তিনটেই সোজা গিয়ে বিধলো সাদা চক্রে।

‘চমৎকার, গিলবার্ট!’ প্রশংসার চাপড় দিল রবিন গিলবার্টের কাঁধে। ‘অপূর্ব! তোমার তুলনা হয় না! এতবড় তীরন্দাজ সত্যিই দেখিনি আমি আগে। স্বাধীন জীবন বেছে নেয়া উচিত ছিল তোমার। কল্পনাও করতে পারবে না তুমি এই ইঁট পাথরের দেয়াল ঘেরা লণ্ডন শহরের বাইরে কি আশ্চর্য মুক্ত, আনন্দময় জীবন পড়ে রয়েছে।’ কথা বলতে বলতেই তূণ থেকে একটা তীর বের করে ছিলায় পরালো রবিন।

দাড়িকে শুনিয়ে বিড়বিড় করলেন রাজা, ‘আটকুড়ি মোমবাতি দেব সেইন্ট হিউবার্ট, তিন আঙুল চওড়া। শুধু বদমাশটার কনুইটা একটু নাড়িয়ে দাও! অন্তত একটা তীর যেন পাশের কালো ঘরে গিয়ে বেঁধে!’ কিন্তু কানে বোধহয় তুলো দিয়ে রেখেছেন আজ সেইন্ট হিউবার্ট, রাজার প্রার্থনা শুনতে পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না।

‘সত্যিই,’ এখনো কথা বলে চলেছে রবিন। একবার এসে আমাদের শেরউড থেকে ঘুরে যাও না?’ বলতে বলতে কানের পাশে নিয়ে এলো সে তীর পরানো ছিলাটা। ‘লণ্ডনে তোমরা-’ এই পর্যন্ত বলেই ছেড়ে দিল সে তীর, -পাতিকাক বা দাঁড়কাক ছাড়া তীর মারার কিছু খুঁজে পাও না, আর ওখানে আমরা মারি চমৎকার সব হরিণের কলজে লক্ষ্য করে।’ কথার মাঝে হেলা ভরে ছোঁড়া তীরটা যখন সোজা গিয়ে কেন্দ্র-বিন্দুর আধ ইঞ্চি ডাইনে বিধলো, হাঁ হয়ে গেল গিলবার্টের মুখ।

‘মাই গড!’ চেঁচিয়ে উঠলো গিলবার্ট। ‘নীল পোশাক পরা খোদ শয়তান নাকি হে তুমি! এই ভাবে হেলাফেলা করে–

‘না, হে, না,’ হাসতে হাসতে বললো রবিন, আরেকটা তীর জুড়ে ফেলেছে সে ধনুকে, অতটা খারাপ লোক—’ টঙ্কার শোনা গেল ছিলার, নই আমরা।’ এবার তীরটা গিয়ে বিধলো কেন্দ্র-বিন্দুর ঠিক আধ ইঞ্চি বামে। ছানাবড়া হয়ে গেছে গিলবার্টের চোখ।

হাসতে হাসতেই তৃতীয় তীর ছুঁড়লো রবিন। সোজা গিয়ে ঢুকলো সেটা দুই তীরের মাঝখানে, ঠিক কেন্দ্র-বিন্দুতে। তিনটে তীরের পালকগুলো মিলেমিশে মনে হচ্ছে একটাই মোটা তীর বিধে রয়েছে টার্গেটের ঠিক মাঝখানে।

দর্শকমণ্ডলীর মধ্যে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠলো। এরকম অবিশ্বাস্য শূটিং তারা জীবনে দেখেনি, রবিন হুডের পরে আর কোনদিন দেখবে বলেও আশা করে না। সবাই দেখতে পেল, হেরে গেছে রাজার প্রথম ও দ্বিতীয় পুরস্কার বিজয়ী। দেখা যাচ্ছে, হেরে গিয়েও মলিন হয়নি গিলবার্টের মুখ, সোৎসাহে রবিনের হাত ধরে প্রবলবেগে ঝাঁকাচ্ছে সে।

কিন্তু চটে গেলেন রাজা। যদিও পরিষ্কার বুঝতে পারছেন তিনি ওই লোকগুলোর সাথে পারবে না তাঁর নিজের লোক, তবু চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, ‘হয়নি! খেলা শেষ হয়নি এখনও! পরাজিত হয়নি গিলবার্ট। ওর তীর তিনটেও তো মাঝখানের চক্রে লেগেছে। মেনে নিচ্ছি, বাজিতে হেরে গেছি আমি, কিন্তু ওর পুরস্কার ও হারায়নি এখনও। আবার তীর ছুঁড়তে বলো ওদের। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন অপরকে হারাতে না পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত চলতে থাকবে প্রতিযোগিতা।’ রাজাকে রাগে কাঁপতে দেখে কথা বাড়াবার সাহস পেলেন না স্যার হিউ, মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলেন রবিন হুড আর গিলবার্টের কাছে, রাজার আদেশ শোনালেন তাদের।

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই,’ মাথা ঝাঁকালো রবিন। ‘কোন আপত্তি নেই আমার। মহামান্য রাজার সন্তুষ্টির জন্যে এখন থেকে আগামী কাল দুপুর পর্যন্ত একটার পর একটা তীর ছুঁড়তে রাজি আছি আমি। নাও, গিলবার্ট, ছোঁড়ো তীর, প্রতিযোগিতা শুরু হোক আবার।’

পরদিন দুপুর পর্যন্ত তীর ছোঁড়ার দরকার পড়লো না। হঠাৎ সামান্য একটু বাতাস ওঠায় গিলবার্টের প্রথম তীরটাই একটু সরে গিয়ে কালো ঘরে বিধলো, শর্ষে পরিমাণ বামে পড়লেই বিধতো মাঝের সাদা ঘরে।

কপালটা মন্দ তোমার, গিলবার্ট,’ বললো রবিন। হাসতে হাসতে ছুঁড়লো তীর। সোজা গিয়ে ঠিক কেন্দ্র-বিন্দুতে বিধলো ওটা।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন রাজা হেনরী। রাগতঃ দৃষ্টিতে চাইলেন নিজের চারপাশের লোকজনের মুখের দিকে। কারও মুখে হাসি বা খুশির আভাস দেখলে তার কপালে কি যে খারাবী ঘটতো কেউ বলতে পারে না। পাথরের মূর্তির মত বসে রইলো সবাই গম্ভীর হয়ে। কারও সাথে কোন কথা না বলে রানীকে পাশে নিয়ে পারিষদবর্গকে ওঠার ইঙ্গিত দিয়েই নেমে গেলেন তিনি মঞ্চ থেকে, ঘোড়ায় চেপে চলে গেলেন মাঠ থেকে। রাগে টগবগ করে ফুটছে তাঁর গায়ের রক্ত।

রাজা চলে যেতেই তীরন্দাজ বাহিনীর সবাই ঘিরে ধরলো রবিন, লিটল জন, উইল আর অ্যালানকে। সবাই কাছ থেকে এক নজর দেখতে চায় মিডকান্ট্রির জনপ্রিয় দস্যুদের। একই উদ্দেশ্যে জনতার একটা বিরাট অংশ জুটে গেল ওদের চারপাশে। উইল স্কারলেটের কানে কানে বললো লিটল জন, ‘মনে হচ্ছে জীবনে কোনদিন এমন চিড়িয়া দেখেনি এরা কোনদিন! সবাই কেমন হাঁ করে গিলছে আমাদের দেখো, আমরা যেন কাম্বারল্যাণ্ডের দৈত্য, কিংবা ওয়েলশের বামন!’

কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনজন বিচারক এগিয়ে এলেন পুরস্কার বিতরণ করতে। রবিনের উদ্দেশ্যে বললেন প্রধান বিচারক, শর্ত অনুযায়ী তুমিই প্রথম পুরস্কার বিজয়ী; কাজেই এই ধরো তোমার রূপোর বিউগল, এই নাও দশটা তীর-ভরা তৃণ, আর এই যে এই থলির ভেতর রয়েছে দুই-কুড়ি দশটা স্বর্ণমুদ্রা। এবার ফিরলেন তিনি লিটল জনের দিকে, ‘দ্বিতীয় পুরস্কার বিজয়ী তুমি; ড্যালেন লী থেকে একশোটা হরিণ মেরে নিতে পারবে তুমি যখন খুশি।’ হিউবার্টের দিকে ফিরলেন তিনি এবার, তৃতীয় পুরস্কারটা নিজের আয়ত্তে রাখতে পেরেছো তুমি, যখনই তুমি চাইবে, তোমার ঠিকানায় পৌঁছে দেয়া হবে দুই টান রেনিশ ওয়াইন। এরপর একে একে নাম ধরে ডাকলেন তিনি অপর সাতটি দলের সেরা তীরন্দাজদের, প্রত্যেকের হাতে তুলে দিলেন চার-কুড়ি রূপোর পেনি।

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষ হতেই উঁচু গলায় ঘোষণা করলো রবিন হুড, ‘এই শুটিং ম্যাচের সম্মানে রূপোর বিউগলটা নেব আমি স্মারক চিহ্ন হিসেবে। কিন্তু তুমি, গিলবার্ট, নিঃসন্দেহে রাজার তীরন্দাজ বাহিনীর সেরা ধনুর্বিদ-খুশি মনে সোনার মুদ্রা ভরা থলেটা দিয়ে দিচ্ছি আমি তোমাকে। নাও, ধরো। খাটি, সাচ্চা লোক তুমি, এই থলে তোমার প্রাপ্য। এছাড়াও দশটি দলের সেরা দশজন তীরন্দাজকে আমি একটা করে সোনার তীর দিতে চাই। নিজেদের কাছে রাখবে এটা, বুড়ো হয়ে নাতী-নাতনীদের গল্প শোনাবেঃ এক কালে সারা দুনিয়ার সেরা দশজন তীরন্দাজের একজন ছিলে তোমরা রবিনের উদার মনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনে খুশি হয়ে হৈ-হৈ করে উঠলো সবাই।

এবার হেঁড়ে গলায় হাঁক ছাড়লো লিটল জন, ‘বন্ধু টেপাস, এইমাত্র তোমাদের বিচারক ড্যালেন লীর যে-সব হরিণের কথা বললেন, ওগুলো আমার কোন দরকার নেই। আসলে আমাদের ওখানে শুধু যথেষ্ট নয়, যথেষ্টরও বেশি হরিণ রয়েছে। কাজেই তোমার চমৎকার শূটিং দেখে খুশি হয়ে একশো হরিণের পঞ্চাশটা আমি তোমাকে দিয়ে দিতে চাই, বাকি পঞ্চাশটা পাবে পাঁচটা করে প্রত্যেক দলের ক্যাপটেন। যখন খুশি মেরে নিয়ো তোমরা।’

খুশি হয়ে শোরগোল তুললো সবাই লিটল জনের কথাতেও, শূন্যে ছুঁড়ে দিল মাথার টুপি। রবিন হুড ও তার সহকারীর বিরাট মনের পরিচয় পেয়ে এদের সম্পর্কে ধারণা সম্পূর্ণ বদলে গেল তীরন্দাজ বাহিনীর।

এই হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো লম্বা এক রক্ষী, রবিনের জামার আস্তীন ধরে টানলো একপাশে। আপনার কানে কানে একটা কথা বলবো,’ বললো সে। কথাটার মাথামুণ্ডু অবশ্য কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি। রিচার্ড পার্টিংটন বলে এক ছোকরা অনেকক্ষণ ধরেই খুঁজছে আপনাকে, কিন্তু ভিড় ঠেলে এগোতে পারছে না সামনে। আপনাকে একটা কথা জানানোর জন্যে অনেক করে অনুরোধ করলো ছোকরা- অর্থহীন কথা—কিন্তু ওর অনুরোধ ঠেলতে না পেরে রাজি হয়ে গেলাম। কোন্ এক ভদ্রমহিলা নাকি আপনাকে জানাতে চান কি যেন কথাটা? ও, হ্যাঁ- গজরাচ্ছে সিংহ। সাবধান!’

‘তাই নাকি?’ ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠলো রবিনের। পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে সে ভদ্রমহিলাটি আর কেউ নন,স্বয়ং রানী এলেনর। তিনি জানাচ্ছেন, এখুনি সাবধান না হলে রাজার খড়গ নেমে আসবে ওদের মাথার ওপর। কিন্তু রক্ষীকে বললো, ‘ভারি মজার কথা তো! যাই হোক, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তুমি জানো না কতটা উপকার করলে তুমি আজ আমার।’

নিজের তিন সঙ্গীকে একটু আড়ালে টেনে নিয়ে জানালো রবিন, এক্ষুণি লণ্ডন ছেড়ে না পালালে ভয়ঙ্কর বিপদে পড়তে হবে ওদের। একবিন্দু সময় নষ্ট না করে সিদ্ধান্ত নিল ওরা তখুনি। ভিড় ঠেলে এগোতে শুরু করলো মন্থর গতিতে। ভিড়ের চাপ কমতেই লম্বা পা ফেলে রওনা হয়ে গেল লণ্ডন শহর ছেড়ে উত্তর দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *